পথরুঘাটের যুদ্ধ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
পথরুঘাটের যুদ্ধ
পথরুঘাটের যুদ্ধের স্মারক
তারিখ১৮৯৪ সালের ২৮ জানুয়ারি
অবস্থান
কারণখাজনা বৃদ্ধি

পথরুঘাটের যুদ্ধ বা পাথৌঘাটের ধেয়া ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শাসনের বিরুদ্ধে ভারতে ঘটা এক ঐতিহাসিক কৃষক বিদ্রোহ। ১৮৯৪ সালের ২৮ জানুয়ারি তারিখে আসামের দরং জেলার মঙ্গলদৈ শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত পথরুঘাট নামে স্থানে স্থানীয় কৃষকরা মাটির খাজনা বৃদ্ধির প্রতিবাদ করায় ব্রিটিশ পক্ষ প্রতিবাদকারী কৃষকদের উপরে গুলিচালনা করেন। বেসরকারী তথ্যমতে এই বিদ্রোহত ১৪০ জন লোক নিহত এবং ১৫০ জনেরো অধিক লোক আহত হয়েছিল।[১] পথরুঘাটে সংঘটিত হওয়া এই বিদ্রোহকে পথরুঘাটের যুদ্ধ বলা হয়।

পশ্চাদপট[সম্পাদনা]

১৮২৬ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তারিখে ব্রিটিশ এবং মায়ানমারের জার মধ্যে হওয়া ইয়াণ্ডাবু সন্ধির চুক্তিমতে আসাম, আরাকান এবং আভা ব্রিটিশ শাসনের অধীনে যায়। ১৮৩৩ সালে মঙলদৈকে সদর হিসাবে দরং জেলা গঠন করা হয়। ডফলা আক্রমণ প্রতিহত করার সুবিধার্থে, বানপানী ইত্যাদি কারণে ১৮৩৫ সালে দরঙের সদর তেজপুরে স্থানান্তরিত করা হয়।[২]

ব্রিটিশ সরকার ১৮৩২-৩৩ সালে দরঙে লাঙল প্রতি ৩ টাকা করে খাজনা ধরে প্রজাদের থেকে মোট ৪১,৫০৬ টাকা খাজনা উঠিয়েছিল। ১৮৪২-৪৩ সালে জমি পরিমাপ করে বস্তি (ঘর-বাড়ি করার উপযুক্ত), রুপিত (দ এবং চাষ উপযোগী) এবং ফরিঙতী (বাম চাষের উপযুক্ত) - এই তিনটি ভাগ করে খাজনা বাড়ায়। এই হিসাবে ১৮৪২-৪৩ সালে ১,৩৫,৪৫৮, ১৮৫২-৫৩ সালে ১,৫৭,৭৫৯ এবং ১৮৬২-৬৩ সালে ৭,৪৩,৪৮৯ টাকা খাজনা ওঠায়। ১৮৯২-৯৩ সালে পুনরায় জমি পরিমাপ করে ৫ টাকা হারে খাজনা বৃদ্ধি করা হয়।[৩]

এমনধরণের খাজনার ফলে মানুষ জুরুলা এবং অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে পথরুঘাটে মানুষমেল করে ব্রিটিশদের খাজনা না দিতে সিদ্ধান্ত নেয়। ব্রিটিশরা খাজনা কম না করলে মানুষ বিদ্রোহের পথ নিতে বাধ্য হয়।

সমসাময়িক অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহসমূহ[সম্পাদনা]

ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আসামের প্রথম কৃষক বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল নগাওঁ জেলার ফুলগুড়ি নামক স্থানে, ১৮৬১ সালে। ফুলগুড়ি ধেবা নামে পরিচিত এই বিদ্রোহ কেবল আসামে নয়, ভারতে প্রথম ছিল।[৩] সেই সময় ফুলগুড়ি অঞ্চলে কানি চাষ করা হত। ব্রিটিশ সরকার স্বাধীনভাবে কানি চাষ করা বন্ধ করে দেওয়ায় চারা এনে ব্রিটিশ কানি বিক্রী করা আরম্ভ করে। এই আইনের প্রতিবাদে 'ফুলগুড়ি ধেবা' সংঘটিত হয়েছিল।

এর পরে ১৮৬৯ সালে বজালীতে, ১৮৯৪ সালের ১০ জানুয়ারিতে রঙিয়াতে, পরে কামরূপের লসিমা, হাজো ইত্যাদি ছাড়াও নলবাড়ি, করেদরং, টিহু, বরভাগ ইত্যাদিতেও ছড়িয়ে পড়ে।

১৮৯৪ সালের ২৮ জানুয়ারির ঘটনাবলী[সম্পাদনা]

১৮৯৪ সালের ২৮ জানুয়ারির দিনটি পথরুঘাটে মানুষমেল বসে। পথরুঘাট অঞ্চলের গ্রামগুলি থেকে বহু হাজার মানুষ এসে তহশিলদারের বাংলোর সামনে সমবেত হয়ে "হরি বোল", "আল্লাহু আকবর" ইত্যাদি ধ্বনি দিয়ে ব্রিটিশদের প্রতিবাদ আরম্ভ করে খাজনা কমাতে দাবী উত্থাপন করে। তহশিলদারের রিপোর্টমর্মে দরং জেলার জেলাধিপতি মি. অ্যান্ডারশন, আরক্ষী অধীক্ষক (J R Berington) এবং মঙলদৈর মহকুমাধিপতি মি. রেমিংটনও সশস্ত্র বাহিনীসহ সেখানে উপস্থিত হন এবং খাজনা কমিয়ে দেওয়া হবে না বলে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে এবং দুইপক্ষের মধ্যে তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ক্রমশঃ পরিস্থিতি উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে পড়ে এবং সরকারী বাহিনী বেরিংটনের আদেশমর্মে মানুষের উপরে গুলি চালনা করে। মানুষ দলি-চাপরা, লাঠি-ফর্মুতি ইত্যাদির প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে থিতাতে ১৪০ জন নিহত এবং প্রায় ১৫০ জন প্রজ আহত হয়। সরকারী হিসাব মতে ১৫ জন নিহত এবং ৩৭ জন আহত বলে প্রকাশিত হয়। [৪]


তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. দলিপুরাণ
  2. কমলাকান্ত ডেকা (সম্পাদক), ইতিহাসে গরকা পথরুঘাট, পৃষ্ঠা ২৯ 
  3. দীপক কাকতি (২০১২), "আসামের কৃষক বিদ্রোহের জ্বলন্ত স্বাক্ষর - পথরুঘাটের যুদ্ধ", প্রান্তিক (৩১শ বছর ১৩শ সংখ্যা, ১ - ২৫৫ জুন, ২০১২ সংস্করণ), প্রদীপ বরুয়া (প্রকাশিত হয় ১৬ জুন ২০১২) 
  4. Allen, B C (১৯০৫)। "Assam District Gazette"আসাম জেলা গেজেট