নরমাংস ভক্ষণ
ক্যানিবালিজম বা নরমাংস ভক্ষণ মানে হচ্ছে মানুষের আচরণ যেখানে একজন মানুষ আরেকজনের মাংস ভক্ষণ করে। তবে এর অর্থ বিবর্ধিত করে প্রাণীতত্ত্বে বলা হয়েছে কোন প্রাণীর আচরণ যেখানে সে তার নিজের প্রজাতির মাংস আহার করে এবং এটা তার সহযোগীও হতে পারে। ক্যানিব্যালাইজ শব্দটি যা ক্যানিবালিজম থেকে এসেছে এর মানে হলো সামরিক অংশের পুনোৎপাদন।[১] ক্যানিবালিজিমের চর্চা হয়েছে লিবিয়া[২] ও কঙ্গোতে[৩] বেশ কিছু যুদ্ধে। করোওয়াই হলো এমন একটি উপজাতি যারা এখনো বিশ্বাস করে যে নরমাংস ভক্ষণ সংস্কৃতিরই একটি অংশ।[৪][৫] কিছু মিলেনেশিয়ান উপজাতিরা এখনো তাদের ধর্মচর্চায় ও যুদ্ধে এই চর্চা করে।[৬] ক্যানিবালিজিম বিদেশী প্রভুদের যুক্তিকে শক্ত করে দাসত্বের পক্ষে। ক্যানিবালিজম নৃতত্ত্ববিদের সমস্যায় ফেলে যে মানুষের আচরণের গ্রহণযোগ্যতার সীমানা নির্ধারণে।[৭]
নরমাংস ভক্ষণের কারণ
[সম্পাদনা]নরমাংস ভক্ষণের কারণগুলোর মাঝে রয়েছে:
- সাংস্কৃতিক রীতি হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা
- চরম পরিস্থিতিতে গ্রহণ করা হয় যেমন দুর্ভিক্ষের সময়
- মানসিক সমস্যার কারণে বা সামাজিক আচরণের বিচ্যুতির কারণে [৮]
প্রাথমিকভাবে নরমাংস ভোজের সামাজিক আচরণ ২ প্রকার: প্রথমত, একই সম্প্রদায়ের মানুষের মাংস খাওয়া, অন্যটি হচ্ছে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের মাংস খাওয়া। এই অভ্যাসে ২ ধরনের নৈতিক পার্থক্য আছে। একটা হচ্ছে একজনকে হত্যা করা তার মাংস খাওয়ার জন্য ও আরেকটি হচ্ছে স্বাভাবিকভাবে মৃত মানুষের মাংস খাওয়া।
ইতিহাস
[সম্পাদনা]৭ম শতকে মুসলিম-কোরাইশদের যুদ্ধের সময় ক্যানিবালিজমের ঘটনা ঘটে। ৬২৫ সালে উহুদের যুদ্ধের সময় হামযা ইবনে আবদু মুত্তালিব নিহত হলে তার কলিজা ভক্ষণের চেষ্টা করেন কোরাইশ নেতা আবু সুফিয়ান ইবনে হারবের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাহ।[৯] পরে তিনি মুসলমান হয়ে যান। ও মুয়াবিয়ার (রা:) মা হন। যিনি ইসলামি ইতিহাসে উম্মাইয়া খেলাফতের প্রতিষ্ঠা করেন। জেরুজালেমেও কিছু ঘটনা ঘটে।হাঙ্গেরীর মানুষরা মানুষের মাংস খায় যারা ১০ম শতাব্দীতে মাত্র মূর্তিপূজক থেকে খ্রিস্টানে পরিণত হয়। সেখান দিয়ে ক্রুসেডাররা তাদের পবিত্র ভূমি জেরুজালেমের দিকে এগিয়ে যেত।আসলে ইংরেজি শব্দ ওগি যার মানে রাক্ষস তার উৎস কিন্তু এই হাঙ্গেরীর ফরাসী শব্দ হনগি।[১০] মুসলিম পরিব্রাজক ইবনে বতুতা বলেন যে তাকে এক আফ্রিকান রাজা সতর্ক করে বলেন যে কাছেই নরখাদক জংলী আছে। তবে বতুতা এও বলেন যে আরব ও খ্রিস্টানরা নিরাপদ কারণ তাদের মাংস অপরিণত। ইউরোপে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য এরকম ঘটনা ঘটে যেখানে হাজারের মতো বিটুমিন-এ সংরক্ষিত মমি মাটির ওপর চলে আসে ও ঔষধ হিসেবে বিক্রি হয়।[১১]
আধুনিক কালে
[সম্পাদনা]জেমস ডব্লিউ ডেভিডসন ১৯০৩ সালে তার লেখা বই দ্যা আইল্যান্ড অব ফরমোসা গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে কীভাবে তাইওয়ানের চীনা অভিবাসীরা তাইওয়ানের আদিবাসীদের মাংস খেয়েছিল ও বিক্রি করেছিল।[১২] ১৮০৯ সালে নিউজিল্যান্ডের মাওরি উপজাতিরা নর্থল্যান্ডে দ্যা বয়েড নামের একটি জাহাজের প্রায় ৬৬ জন যাত্রী ও ক্রুকে খুন করে ও তাদের মাংস খায়। মাওরিরা যুদ্ধের সময় তাদের প্রতিপক্ষের মাংসও খায় স্বাভাবিকভাবে। [১৩] অনেক সময় সাগর যাত্রীরা ও দূর্যোগে আক্রান্ত অভিযাত্রীরাও টিকে থাকার জন্য অন্য সহযাত্রীদের মাংস খেয়েছে। ১৮১৬ সালে ডুবে যাওয়া ফেঞ্চ জাহাজ মেডুসার বেচে যাওয়া যাত্রীরা ক্যানিবালিজমের আশ্রয় নেয় টানা চার দিন সাগরে ভেলায় ভেসে থাকার পর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে
[সম্পাদনা]১৯৪৩ সালে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানীর প্রায় ১,০০,০০০ যুদ্ধবন্দি সেনাকে রাশিয়ার সাইবেরিয়াতে পাঠানোর সময় তারা ক্যানিবালিজমের আশ্রয় নেয়। কারণ তাদের ক্রমাগত কম পরিমাণের খাবার সরবরাহ ও অসুখে আক্রান্ত হওয়া। মাত্র ৫,০০০ জন বন্দি স্ট্যালিনগ্রাডে পৌছতে সক্ষম হয়।[১৪] ল্যান্স নায়েক হাতেম আলী নামে একজন ভারতীয় যুদ্ধবন্দি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিউ গিনি তে জাপানী সেনাদের মাংস খাওয়ার কথা বলেন। তারা জীবন্ত মানুষের শরীর থেকে মাংস কেটে নিত ও ঐ ব্যক্তিকে তারা নালায় ফেলে মারত।[১৫] ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে জাপানী সেনা চিচিজিমাতে পাঁচজন আমেরিকান বিমান সেনাকে হত্যা করে খেয়ে ফেলে।[১৬]
অন্যান্য ক্ষেত্রে
[সম্পাদনা]বিশ শতকে নরমাংস ভোজন হয়েছে ধর্মীয় কারণে, খরা, দূর্ভিক্ষে ও যুদ্ধবন্ধীদের উপর নির্যাতনের অংশ হিসেবে যাকে আইনের লঙ্ঘন হিসেবেই বিবেচনা করা হয়েছে। আঘোরী নামে উত্তর ভারতের একটি ক্ষুদ্র উপজাতিরা মানুষের মাংস খায় তাদের ধর্মীয় উপাসনার অংশ হিসেবে ও অমরত্ত্ব অর্জনের জন্য। তারা মনে করে এভাবে তারা অতিপ্রাকৃতিক শক্তিও লাভ করবে। তারা মানুষের মাথার খুলিতে খাবার খায় বয়স বেড়ে যাওয়া রোধ করতে ও ধর্মীয় সুবিধা পেতে।[১৭][১৮][১৯] ১৯৩০-এর দশকে ইউক্রেনে, রাশিয়ার ভলগা, দক্ষিণ সাইবেরিয়া ও কুবানে এমন ঘটনা ঘটে ভয়াবহ দূর্ভিক্ষের সময়ে।
সাম্প্রতিক উদাহরণ
[সম্পাদনা]ড্রেঞ্জেল ভারগাস নামের ভেনেজুয়েলার একজন ব্যক্তি ২ বছরে কমপক্ষে ১০ জন ব্যক্তিকে খুন করে খেয়ে ফেলেন যাকে ১৯৯৯ সালে আটক করা হয়। জেফরি ডাহমার নামের আমেরিকান একজন ব্যক্তির বাসায় মানুষের হাড় ও মাংস পাওয়া যায়। তাকে গ্রেফতার করা হয় ১৯৯১ সালে।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] ২০০১ সালের মার্চে জার্মানিতে আরমিন মাইভাস ইন্টারনেটে একটি বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১৮ থেকে ৩০ বছরের সুঠামদেহী জবাইযোগ্য ও আহার হতে চাওয়া মানুষের সন্ধান চাইছিলেন। বার্ন্ড জুর্গেন ব্রান্ডিস নামের একজন এতে সাড়া দেন ও খুন হয়ে যান। পরে আরমিন মাইভাসকে আটক করা হয়। রামেস্টেইন ব্যান্ডের মেইন টেইল ও ব্ল্যাড বাথ ব্যান্ডের ইটেন গান এই ঘটনার ওপর ভিত্তি করে রচিত। পিটার ব্রায়ান নামের একজন ব্রিটিশকে ইস্ট লন্ডনে ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে গ্রেফতার করা হয় যিনি তার বন্ধুকে খুন করেন ও খেয়ে ফেলেন। নিজের মাকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর মরদেহ খাওয়ার অভিযোগে স্পেনের আলবার্তো সানচেজ গোমেজ (২৮) নামে এক যুবককে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে দেশটির আদালত। খবর বিবিসির। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্পেনের পূর্ব মাদ্রিদে এ ঘটনা ঘটেছিল। ওই সময় গোমেজকে আটকের পর তার মায়ের মরদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বাড়ির পাশ থেকে কিছু প্লাস্টিকের পাত্র থেকে উদ্ধার করা হয়। সে সময় গোমেজ মানসিক অবসাদগ্রস্ত ছিলেন বলে দাবি করলেও আদালত তা প্রত্যাখ্যান করে। [২০]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ Cannibalize in On-line Etymological Dictionary
- ↑ Cannibalism in Liberia war - Seen in front of camera and commander boasts about it
- ↑ UN call against cannibalism on the BBC website.
- ↑ "Sleeping with Cannibals | Travel | Smithsonian Magazine"। Smithsonianmag.com। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-০৮-৩০।
- ↑ "cannibalism (human behaviour) - Britannica Online Encyclopedia"। Britannica.com। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১০-২৪।
- ↑ A cannibal practising tribe by the BBC recorded on YouTube
- ↑ Brief history of cannibal controversies ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তারিখে; David F. Salisbury, August 15, 2001, Exploration ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৩০ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে, Vanderbuilt University.
- ↑ Eat or be eaten: Is cannibalism a pathology as listed in the DSM-IV?[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
- ↑ Ibn Ishaq (1955) 380—388, cited in Peters (1994) p. 218
- ↑ Maalouf, Amin (1984). The Crusades Through Arab Eyes. New York: Schocken Books. আইএসবিএন ০-৮০৫২-০৮৯৮-৪.
- ↑ "Medieval Doctors and Their Patients"। mummytombs.com। ২০০৭-১১-২৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১২-০৩।
- ↑ Davidson, James Wheeler (1903). The Island of Formosa, Past and Present. Macmillan & Co.. p. 255
- ↑ 'Battle rage' fed Maori cannibalism ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৫ জুন ২০২০ তারিখে, 8 September 2007 - Maori news — NZ Herald
- ↑ Beevor, Antony. Stalingrad: The Fateful Siege. Penguin Books, 1999.
- ↑ Lord Russell of Liverpool (Edward Russell), The Knights of Bushido, a short history of Japanese War Crimes, Greenhill Books, 2002, p.121
- ↑ "সংরক্ষণাগারভুক্ত অনুলিপি" (পিডিএফ)। ৩ নভেম্বর ২০১৯ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৪ নভেম্বর ২০১০।
- ↑ Indian doc focuses on Hindu cannibal sect, MSNBC
- ↑ Aghoris, Australian Broadcasting Corporation
- ↑ The Aghoris, Channel 4
- ↑ Triggle, Nick (২০০৯-০৯-০৩)। "NHS 'failed' over cannibal killer"। BBC News। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৪-২৮।
বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা]- All about Cannibalism: The Ancient Taboo in Modern Times (Cannibalism Psychology) at CrimeLibrary.com
- Cannibalism, Víctor Montoya
- The Straight Dope ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ৬ জানুয়ারি ২০০৯ তারিখে Notes arguing that routine cannibalism is myth
- Did a mob of angry Dutch kill and eat their prime minister? ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২০ নভেম্বর ২০০৮ তারিখে (from The Straight Dope)
- Harry J. Brown, 'Hans Staden among the Tupinambas.'