লাইন প্রথা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

লাইন প্রথা ১৯২০ সালে আসামের কামরূপনওগাঁও জেলায় বাঙ্গালি অভিবাসীদের বসবাসের জন্য একটি সীমারেখা। এটি ছিল আসাম রাষ্ট্রের স্বদেশীয় সম্প্রদায়কে অভিবাসী মুসলমান বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী থেকে পৃথক করে রাখার ব্যবস্থা। আদিবাসী ও বাঙ্গালি অভিবাসীদের মধ্যে কোনরকম দ্বন্দ্ব পরিহারের উদ্দেশ্যে এই প্রথা প্রবর্তিত হয়।[১]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

ব্রিটিশ যুগে বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে পূর্ববাংলার বহু ভূমিহীন কৃষক জমিদার-মহাজনদের অত্যাচারে টিকতে না পেরে ময়মনসিংহ, রংপুর, সিলেট, কোচবিহার ও ত্রিপুরা (এখন ভারতের অন্তগর্ত) সহ বিভিন্ন অঞ্চলের লাখ লাখ ভূমিহীন ও গরীব কৃষক পার্শ্ববর্তী প্রদেশ আসামের অনাবাদী গোয়ালপাড়া, তেজপুর, নওগং, দারং ও কামরূপ জেলার গভীর ও দুর্গম জঙ্গল পরিষ্কার করে চাষাবাদ ও বসবাস শুরু করেছিল। তারা এ দুনিয়ায় তাদের একমাত্র ভরসাস্থল পেলো মওলানা ভাসানীকে। অবশ্য তিনিও তখন আশ্রয় প্রার্থীদের অন্যতম। ব্রিটিশ-ভারতের আইন অনুযায়ী আসামে বসবাস করা অন্যায়ের কোন কিছু ছিলো না। ব্রিটিশ ভারতের যে কোনো এলাকার মানুষ অন্য যে কোনো প্রদেশে জীবিকার বা অন্য প্রয়োজনে গিয়ে বসবাস করতে পারতো। তবে সাধারণত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার দরিদ্র মানুষই স্বল্প জনসংখ্যাসম্পন্ন অর্থ্যাৎ জনবিরল এলাকায় গিয়ে বসতি স্থাপন করতো। পূর্ববঙ্গের মানুষ অন্য কোন স্থানে না গিয়ে আসামে যাবার কারণ শুধু অর্থনৈতিক নয়, জাতিগত ও সাংস্কৃতিকও। আসামের দক্ষিণ অংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল শত শত বছর বাংলাদেশের অন্তর্গত ছিলো। এগুলোতে অসমীয়া অধিবাসীদের চেয়ে বাঙ্গালী সব সময়ই বেশি ছিলো। ভাষা ও সামাজিক রীতিনীতি এবং ব্যবহারাদিতে ভারতবষর্ষে আসামী এবং বাঙ্গালী এই দুই জাতির মধ্যে রূপ সাদৃশ্য ও ঘনিষ্ঠতার জন্য তা সম্ভব হয়। প্রথমদিকে দুটি প্রধান কারণে আসাম সরকার বাঙ্গালীদের স্বাগত জানিয়েছিলোঃ এক. সেকালের প্রাণনাশী অসুখ কালাজ্বরে মৃত্যুর ফলে আসামের জনসংখ্যা দ্রুত কমে গিয়েছিলো; দুই. বিপজ্জনক জন্তুুর বিচরণক্ষেত্র জঙ্গল পরিষ্কার করে বাঙ্গালীদের চাষাবাদের ফলে খাদ্যোৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি সরকারের ভূমি রাজস্ব আয়ও অনেক বেড়েছিলো। বাঙ্গালী কৃষকদের এই অবদান সত্ত্বে ১৯২০ এর দশকের শেষদিকে আসামে বাঙ্গালী বিরোধী উদ্যোগ ও তৎপরতা শুরু হয়েছিল। স্বার্থান্বেষী অহমীয় ভূ-স্বামীদের প্ররোচনায় এবং দিল্লীকেন্দ্রিক ব্রিটিশ সরকারের সমর্থনে আসাম সরকার ‘লাইন প্রথা’ নামের এমন এক আইন প্রবর্তন করেছিলো, যার ফলে নির্দিষ্ট কিছু এলাকার বাইরে বাঙ্গালীদের বসবাস নিষিদ্ধ হয়ে যায়, ভূমির বন্দোবস্ত পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হয় বাঙ্গালীরা। মওলানা ভাসানী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসন বিরোধী আন্দোলন পরিচালনার পাশাপাশি একই যোগে তিনি কৃষক-জনতার প্রত্যক্ষ শোষক জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধেও আন্দোলন সংগঠিত করেছেন, সেগুলোর সরাসরি নেতৃত্ব দিয়েছেন। জমিদার-মহাজন বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে প্রথম ময়মনসিংহ জেলা থেকে এবং পরবর্তীকালে ১৯২৬ সালের শেষ দিকে তাকে বাংলা প্রদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিলো। সে পরিস্থিতিতে সরকার কর্তৃক গ্রেফতার ও জমিদারদের নির্যাতন এড়ানোর জন্য ১৯২৬ সালে আসাম চলে গেলেও ১৯২৯ সালের আগে তার সেখানে কোনো বাড়িঘর ছিলো না। বছর তিনেক তিনি পুলিশের চোখ এড়িয়ে কখনো বর্তমান বাংলাদেশে এসেছেন আবার চলে গেছেন প্রধানত আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়, কারণ সেখানেই বাঙ্গালীদের সংখ্যা ছিল বেশি। ১৯২৯ সালের জানুয়ারী মাসের প্রচন্ড শীতের মধ্যে গোয়ালপাড়া জেলার ধুবড়ী মহকুমার অন্তর্গত ঘাগমারী নামক জায়গায় কিছুটা জঙ্গল পরিষ্কার করে ‘এক টাকা চৌদ্দ আনা’ ব্যয় করে তিনি বাঁশ ও খড়ের একটি ঘর তৈরি করে সেখানে সপরিবারে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। দুর্দান্ত ম্যালেরিয়ার জন্য ঘাগমারী কুখ্যাত। চারদিকে গহীন জঙ্গল। বাঘ, ভালুক প্রভৃতি নানা প্রকার হিংস্র জন্তর আনা-গোনা তার চারদিকে। এই ভয়াবহ বিপদসঙ্কুল স্থানে তার স্ত্রী পিতৃভূমি বাংলায় ফিরে আসার জন্য ব্যগ্র হলেন। স্ত্রীকে মওলানা ভাসানী পাঁচবিবিতে তার পিত্রালয়ে পাঠিয়ে দেন এবং বলে দেন যে, যে, ‘আমার নিরন্ন, বিবস্ত্র বাঙ্গালী চাষীদের একটা সুরাহা যতদিন না হবে, ততদিন আমি আর বাংলায় ফিরে যাব না।’ সত্যি মওলানা ভাসানী ফিরে আসেন নি, যতদিন পর্যন্ত সরকারী ক্ষমতা বলে তাকে তাড়িয়ে দেয়া না হয়। সময়ের সাথে পরিবর্তন ঘটেছিল ঘাগমারীর চেহারা। ধীরে ধীরে মাথা তোলে ঘাগমারী। নির্জল ঘাগমারী অচিরেই একটি বিরাট লোকালয়ে পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে মওলানা ভাসানী সেখানে গড়ে তোলেন, ইসলামিয়া কলেজ, হাই স্কুল, প্রাথমিক স্কুল, পশু চিকিৎসালয় প্রভৃতি। এই প্রতিষ্ঠানগুলো পরিচালনায় মওলানা ভাসানীর অদম্য উৎসাহ ও কর্মদক্ষতা এবং শিক্ষা বিস্তারে তার অনন্য সাধারণ আন্তরিকতার পরিচয় পেয়েছিল আসামের জনসাধারণ। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালে হামিদাবাদে তার নিজের জমিজমা ও সমস্ত বিষয় সম্পত্তি এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালনার জন্য ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী। পরে মওলানা ভাসানীর হাতে গড়া এই বিরাট জনপদের নামও যায় পাল্টে। ভক্তরা এ নতুন নামকরণ করেন-হামিদাবাদ। আসামের জঙ্গল ঘাগমারীতে আশ্রয় প্রার্থীদের জন্য তিনি যে সংগ্রাম চালিয়েছিলেন, তা বহুলাংশে সাফল্যও লাভ করেছিল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হতে আর কিছুদিন দেরী হলে আসামে আশ্রয়প্রার্থী বাংলার ভূমিহীন চাষীদের ভূমির ব্যবস্থা সম্পূর্ণ হয়ে যেত, একথা বোধ হয় আজ নিশ্চিত করে বলা চলে। প্রথম দিকে তিনি বহিরাগতদের সমস্যাবলী নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসার চেষ্টা করেন, কিন্তু তাতে সংশ্লিষ্ট কেউ মওলানা ভাসানীর কথায় গুরুত্ব না দেওয়ায় আলোচনা ফলাফল শুন্য হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি সংগ্রামকেই জালেমের জুলুম থেকে রেহাই পাবার একমাত্র পথ হিসেবে বিবেচনা করলেন। তিনি সরকারের দমননীতির প্রতিবাদ করার জন্য বহিরাগত বাঙ্গালী কৃষকদের সংঘবদ্ধ করতে থাকেন, তাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আতœপ্রকাশ ঘটে ‘আসাম চাষী মজুর সমিতি’ নামক সংগঠনের। এই সমিতির ভাসানী ছিলেন সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নূরুল হক। এই সমিতি লাইন প্রথার বিরুদ্ধে নানা জায়গায় সভা সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানায়। (সূত্রঃ ব্রিটিশ ভারতে মওলানা ভাসানীর সংগ্রাম, শাহ আহমদ রেজা, সাপ্তাহিক পূর্ণিমা ২০ ডিসেম্বর ২০০০) ‘লাইন প্রথা’ আইন প্রবর্তিত হওয়ার পর একইযোগে শুরু হয়েছিলো ‘বাঙ্গাল খেদা’ অভিযান। স্বার্থান্বেষী অহমীয়াদের পাশাপাশি আসাম সরকারও প্রত্যক্ষভাবে বাঙ্গালীদের বিতাড়নের অভিযানে অংশ নিয়েছিলেন। আসাম সরকারের পুলিশ নিষ্ঠুর অত্যাচারের মাধ্যমে বাঙ্গালীদের উচ্ছেদ করতো, আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিতো তাদের ঘরবাড়ি, কোনো অঞ্চলে হাতি দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হতো বাঙ্গালীদের গ্রামীণ আবাসিক এলাকা। আসামে যাওয়ার পর থেকেই মওলানা ভাসানী বাঙ্গালী কৃষকদের স্বার্থ বিরোধী ‘লাইন প্রথা’ এবং ‘বাঙ্গাল খেদা’ অভিযানের বিরুদ্ধে প্রচন্ড আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। ‘আসাম চাষী-মজুর সমিতি’ গঠনের পর আন্দোলন বেগ পাওয়ায় মওলানা ভাসানী পরে সে আন্দোলনের সাথে যুক্ত করেন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ও কৃষক-প্রজা পার্টিকে। ১৯৩৫ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ‘লাইন প্রথা’ ও ‘বাঙ্গাল খেদা’ বিরোধী আন্দোলন প্রচন্ড হয়ে ওঠে, প্রদেশের রাজধানী গৌহাটিসহ বাঙ্গালী অধ্যুষিত জেলা ও মহকুমাগুলোতে মিছিল-সমাবেশ হতে থাকে প্রতিদিন। এমনি একটি প্রতিবাদ মিছিলে আসাম সরকারের পুলিশ গুলি চালায়, তিনজন আন্দোলনকারীর মৃত্যু ঘটে এবং আহত হন ২৫ জন। পুলিশ মিছিল থেকে অসংখ্য নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে, প্রদেশের অন্য অনেক এলাকা থেকেও গ্রেফতার করা হয় আন্দোলনরত নেতা-কর্মীদের। এই আন্দোলনেরই একটি পর্যায়ে তাকে গৌরিপুরের মহারাজার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয়েছিলো।আসামের গোয়ালপাড়া জেলার গৌরিপুরের হিন্দু মহারাজারা বংশানুক্রমে কৃষক প্রজাদের ওপর নির্মম শোষণ-নির্যাতন চালাতেন, বাড়ি ও জমি থেকে উচ্ছেদ করতেন খাজনা না দেয়ার অভিযোগে, এমনকি প্রকাশ্যে হত্যাও করতেন নিজেদের কর্তৃত্ব অক্ষুণ্ণ রাখার উদ্দেশ্যে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কৃষক প্রজাদের ওপর চলতো নির্যাতন। ওদিকে বিশেষ করে মুসলমানদের ওপর চলতো সাম্প্রদায়িক নির্যাতন। ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষে, এমনকি পবিত্র ঈদ-উল আজহার সময়ও মুসলমানরা গরু জবেহ বা কোরবানী করতে পারতেন না। মহারাজার এ ধরনের শোষণ-নির্যাতনের প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। আন্দোলনের প্রাথমিক দিনগুলোতে শোষণ-নির্যাতন বন্ধ করার জন্য, কৃষক-প্রজাদের প্রতি সদয় ও মানবিক আচরণ করার জন্য তিনি মহারাজা প্রভাত চন্দ্র বড়য়ার প্রতি আবেদনও জানিয়েছিলেন। কিন্তু সে আবেদন উপেক্ষিত হয়েছে, উল্টো মওলানা ভাসানীর জীবননাশের হুমকি দেয়া হয়েছে এবং নানাভাবে চেষ্টাও করা হয়েছে তাকে হত্যা করার জন্য। হত্যার হুমকিসহ সার্বিক শোষণ নির্যাতনের প্রতিবাদ এবং জমিদার-মহাজন বিরোধী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে মওলানা ভাসানী অনশন শুরু করেছিলেন ১৯৩২ সালে। তার এই অনশনের প্রতিক্রিয়া ঘটেছিলো দ্রুততার সঙ্গে। গৌরিপুরের মহারাজার শাসনাধীন অঞ্চলে ছাড়িয়ে বাংলা-আসামের বিভিন্ন এলাকায় জমিদার-মহাজনবিরোধী আন্দোলন প্রচন্ড হয়ে উঠেছিলো, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে কৃষক-প্রজারা একাত্মতা ঘোষণা করেছিলেন নেতার অনশনের সঙ্গে। বিশেষ করে গৌরিপুর অঞ্চলের উপজাতীয়রাসহ কৃষক প্রজারা উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন ভীষণভাবে, মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর আশংকায় তারা এমনকি সশস্ত্র প্রতিরোধের পরিকল্পনা করেছিলেন। উদ্বিগ্ন কৃষক-প্রজারা মওলানা ভাসানীর প্রতি অনশন প্রত্যাহার করে নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। একই অনুরোধ জানাতে কলিকাতা থেকে আসামের ধুবড়িতে এসেছিলেন কৃষক-প্রজা পার্টির নেতা শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক, এসেছিলেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ। শেরে বাংলা ফজলুল হক আসাম সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন এবং তার ফলে মুক্তি পেয়েছিলেন বন্দী নেতা-কর্মীরা। আন্দোলনরত উদ্বিগ্ন কৃষক-প্রজাসহ আগত ফজলুল হকসহ মুসলিম নেতৃবৃন্দের অনুরোধে ১৩ দিন পর মওলানা ভাসানী অনশন ভেঙেছিলেন। মওলানা ভাসানীর ১৩ দিনব্যাপী এই অনশনের চাপে আন্দোলনরত বন্দী নেতা-কর্মীদের মুক্তি দেয়ার পাশাপাশি বাঙ্গালীদের ওপর নির্যাতন কমিয়ে আনাতেও বাধ্য হয়েছিল আসাম সরকার। ‘লইন প্রথা’ বাতিল না হলেও স্তিমিত হয়েছিলো ‘বাঙ্গাল খেদা’ অভিযান। আসামে বসবাসরত বাঙ্গালীদের বৈধ নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিলো এবং আসাম প্রাদেশিক পরিষদে বাঙ্গালীদের জন্য সংরক্ষিত হয়েছিল ন’টি আসন (এরকম একটি আসনে মওলানা ভাসানী ১১ বছর সদস্য বা এমএলএ ছিলেন)। ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সঙ্গে সেকালের বাঙ্গালী কৃষকদের আন্দোলনকেও যুক্ত ও সংহত করা ছিলো মওলানা ভাসানীর অন্য এক উল্লেখযোগ্য অবদান। অনশন ভাঙার পর পর মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এক বিশাল কৃষক-প্রজা সম্মেলন। হিন্দু-মুসলমানদের পাশাপাশি গারো, রাবা ও খাসিয়াসহ উপজাতীয়রাও সে সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন, কলিকাতা থেকে এসেছিলেন শেরে বাংলা সহ বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ। তিন লাখের বেশি কৃষক-প্রজার সমাবেশ ঘটেছিলো সে সম্মেলনে, চারশ’র বেশি গরু ও ছাগল জবেহ করা হয়েছিলো যোগদানকারীদের খাওয়ানোর জন্য। সেকালের এই সম্মেলন সম্পর্কে মওলানা ভাসানী পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘..... সম্মেলনে মরহুম শেরে বাংলা ও পাক-ভারতের তিনশ’ বিখ্যাত নেতা যোগদান করেন। গৌরিপুরের মহারাজা প্রভাত চন্দ্র বড় য়া মুসলমান প্রজাদেরকে গরু জবেহ করিতে দিতেন না। যদি কেহ গরু জবেহ করিত, তবে তাহাকে বাড়ি-জমি হইতে উচ্ছেদ করা হইত। ভাসানচরের সম্মেলনে লাখ লাখ লোককে গৌরিপুরের মহারাজের বে-আইনি আদেশের বিরুদ্ধে ৭ হাজার মণ চাউলের ভাত ও ৩৯৬টি গরু জবেহ করিয়া খায়ানো হয় এবং গৌরিপুরের মহারাজের বে-আইনি আদেশের অবসান ঘটানো হয়। সম্মেলনের বিরাট খরচ গরীব জনসাধারণই বহন করিয়াছিল।’ (সূত্রঃ সংগ্রামী জননেতা মওলানা ভাসানী’, মোশাররফ উদ্দিন ভূঞা ও আবুল ওমরাহ মুহম্মদ ফখরুদ্দীন সম্পাদিত সংকলন, প্রকাশক শফিউর রহমান খান, চলন্তিকা বইঘর, ঢাকা, জানুয়ারী ১৯৭০)। কৃষক-প্রজাদের এত বিশাল সম্মেলন এবং সেখানে বিশেষ করে গরু জবেহ করার এই অকল্পনীয় ঘটনা গৌরিপুরের মহারাজার জন্য ছিলো এক মারাত্মক চপেটাঘাতের মতো। তিনি এর ফলে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন এবং কৃষক-প্রজাদের অনেকাংশে অব্যাহতি দেন খাজনার পীড়ন ও ঋণের দায় থেকে। যুগ যুগ ধরে চলে আসা নির্যাতনও এরপর কমে আসে, এরপর মুসলমানরা অর্জন করে গরু জবেহ করার অধিকার। পরবর্তীকালে আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে মওলানা ভাসানী কেন্দ্রীয় কমিটির মাধ্যমে ‘লাইন প্রথা’ বাতিল করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। দাবিটিকে তিনি আসামের আইন পরিষদেও প্রধান একটি বিষয়বস্তুুতে পরিণত করেছেন এবং ‘লাইনপ্রথা’ বিতর্ক চলেছে বছরের পর বছর, ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার সময় পর্যন্ত। নিজের নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগ আসামে প্রাদেশিক সরকার গঠন করার পরও মওলানা ভাসানী তার আন্দোলনকে অব্যাহত রেখেছিলেন। সে আন্দোলন একযোগে চলেছে আইন পরিষদের ভেতরে-বাইরে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]