হাফেজ শিরাজি
শামসুদ্দিন মোহাম্মদ হাফেজ শিরজি | |
---|---|
জন্ম | চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগ (আনুমানিক) মোসল্লা, শিরাজ, ইরান |
মৃত্যু | ৭৯১ হিজরি বা ১৩৮৯ খ্রীস্টাব্দ (আনুমানিক) |
পেশা | কবি |
ভাষা | ফার্সি |
জাতীয়তা | ইরানি |
ধরন | কবিতা |
হাফেজ শিরাজি, মহাকবি হাফেজ, আসল নাম শামসুদ্দিন মোহাম্মদ হলেন একজন ইরানী বা ফার্সি কবি যিনি বুলবুল-ই-শিরাজ উপাধিতে ভূষিত হন। শিরাজ ইরানেরমদিনা,পারস্যের তীর্থভূমি। শিরাজেরই মোসল্লা নামক স্থানে বিশ্ববিশ্রুত কবি হাফেজ চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে জন্মগ্রহণ করেন।[১] ইরানের এক নিশাপুর (ওমর খৈয়াম-এর জন্মভূমি) ছাড়া আর কোন নগরই শিরাজের মত বিশ্বজোড়া খ্যাতি লাভ করেনি। ইরানের প্রায় সমস্ত শ্রেষ্ঠ কবির লীলা-নিকেতন এই শিরাজ। ইরানিরা হাফেজকে আদর করে "বুলবুল-ই-শিরাজ" বা শিরাজের বুলবুলি বলে সম্ভাষণ করে। তারা তাকে "লিসান-উল-গায়েব" (অজ্ঞাতের বাণী), "তর্জমান-উল-আসরার" (রহস্যের মর্মসন্ধানী) বলেও সম্বোধন করেন। হাফেজের কবর আজ ইরানের শুধু জ্ঞানী-গুণীজনের শ্রদ্ধার স্থান নয়, সর্বসাধারণের কাছে "দর্গা", পীরের আস্তানা। তার নামের উচ্চারণ হাফেজ বা হাফিজ।
হাফেজের মৃত্যুর একশত বছরের মধ্যে তার কোন জীবনী রচিত হয়নি। কাজেই তার জীবনের অধিকাংশ ঘটনা আঁধারের নীল মঞ্জুষায় চির-আবদ্ধ রয়ে গেছে। তার জন্ম-মৃত্যুর দিন নিয়ে ইরানেও তাই নানা মুনির নানা মত। হাফেজের বন্ধু ও তার কবিতাসমূহের (দীওয়ানের) মালাকর গুল-আন্দামের মতে হফেজের মৃত্যু-সাল ৭৯১ হিজরি বা ১৩৮৯ খ্রীষ্টাব্দ। কিন্তু তিনিও কবির সঠিক জন্ম-সাল দিতে পারেননি।
হফেজের পিতা বাহাউদ্দীন ইসপাহান নগরী হতে ব্যবসা উপলক্ষে শিরাজে এসে বসবাস করেন। তিনি ব্যবসায়ে বেশ সমৃদ্ধিও লাভ করেন, কিন্তু মৃত্যুকালে সমস্ত ব্যবসায় এমন গোলমালে জড়িয়ে রেখে যান যে শিশু হফেজ ও তার জননী ঐশ্বর্যের কোল থেকে একেবারে দারিদ্র্যের করাল গ্রাসে নিপতিত হন। বাধ্য হয়ে তখন হফেজকে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থোপার্জন করতে হয়। কোন কোন জীবনী-লেখক বলেন, দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে হফেজকে তার জননী অন্য একজন সঙ্গতিসম্পন্ন বণিকের হাতে সমর্পণ করেন। সেখানে থেকেই হফেজ পড়াশোনা করার অবকাশ পান। যেভাবেই হোক, হফেজ যে কবি-খ্যাতি লাভ করার আগে বিশেষরূপে জ্ঞান অর্জন করেছিলেন, তা তার কবিতা পড়েই বোঝা যায়।
হফেজের আসল নাম শামসুদ্দিন মোহাম্মদ। "হফেজ" তার "তখল্লুস", অর্থাৎ কবিতার ভণিতায় ব্যবহৃত উপ-নাম। যারা সম্পূর্ণ কুরআন কণ্ঠস্থ করতে পারেন, তাঁদেরকে আরবি ভাষায় "হাফিজ" এবং ফার্সি ভাষায় "হফেজ" বলা হয়। তার জীবনী-লেখকগণও বলেন, হফেজ তার পাঠ্যাবস্থায় কুরআন মুখস্থ করেছিলেন।
তার পাঠ্যাবস্থায়ই তিনি স্বভাবী দক্ষতায় কবিতা রচনা করতে আরম্ভ করেন, কিন্তু তা তেমন আদর লাভ করতে পারেনি। কিছুদিন পরে "বাবা-কুহী" নামক শিরাজের উত্তরে পর্বতের উপরকার এক দর্গায় (মন্দিরে) ইমাম আলি নামক এক দরবেশের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। সেদিন "বাবা-কুহী"তে রাতভর ধর্মোৎসব চলছিল। হফেজও ঐ উৎসবে যোগ দিতে গিয়েছিলেন। ইমাম আলি হফেজকে রহস্যময় কোন ঐশী খাবার খেতে দেন এবং বলেন, এর পরই হফেজ কাব্যলক্ষীর রহস্যপুরীর সব ঐশ্বর্যের অধিকারী হবে। এই বিবরণে কতটা কল্পনারস মিশে আছে তা নিশ্চিতভাবে বলা না গেলেও এটা সত্য যে হফেজের সমস্ত জীবনী-লেখকই এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। শুধু উল্লেখ নয়, বিশ্বাসও করেছেন।
হফেজ তার জীবদ্দশায় তার কবিতাসমূহ (দীওয়ান) সংগ্রহ করে যাননি। তার বন্ধু গুল-আন্দামই সর্বপ্রথম তার মৃত্যুর পর "দীওয়ান" আকারে হফেজের সমস্ত কবিতা সংগ্রহ ও সংগ্রথিত করেন। কাজেই - মনে হয়, হফেজের পঞ্চশতাধিক যে কবিতা আমরা পেয়েছি, তাছাড়াও অনেক কবিতা হারিয়ে গেছে, বা তিনি সংগ্রহ করতে পারেননি।
হফেজ ছিলেন উদাসীন সুফী। তার নিজের কবিতার প্রতি তার মমতাও তেমন ছিল না। তাই কবিতা লিখবার পরই তার বন্ধুবান্ধব কেউ সংগ্রহ না করে রাখলে তা হারিয়ে যেত। কিন্তু তার কবিতার অধিকাংশই গজল-গান বলে, লেখা হওয়ামাত্র মুখে মুখে গীত হত। ধর্মমন্দির থেকে শুরু করে পানশালা পর্যন্ত সবখানেই তার গান আদরের সাথে গীত হত।
হফেজ সম্বন্ধে বিশ্ববিজয়ী বীর তৈমুরকে নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। হফেজের কবিতার এই দুটি চরণ ততদিনে জগদ্বিখ্যাত হয়ে গেছে -
اگر آن ترک شیرازی به دست آرد دل ما را
به خال هندویش بخشم سمرقند و بخارا را
প্রাণ যদি মোর দেয় ফিরিয়ে তুর্কী সওয়ার মনচোরা
প্রিয়ার মোহন চাঁদ কপোলের
একটি কালো তিলের লাগি বিলিয়ে দেব সমরকান্দ ও রত্নখচা এ বোখারা![২]
সেই সময় তৈমুরের সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল সমরকন্দ। হফেজ তার প্রিয়ার গালের তিলের জন্য তৈমুরের সাম্রাজ্যের রাজধানী বিলিয়ে দিতে চান শুনে তৈমুর ভীষণ ক্রোধান্বিত হয়ে পারস্য জয়ের সময় হফেজকে ডেকে পাঠান। উপায়ন্তর না দেখে হফেজ তৈমুরকে বলেন যে তিনি ভুল শুনেছেন, শেষের চরণের "সমরকন্দ ও বোখারা"র পরিবর্তে "দো মণ কন্দ ও সি খোর্মারা" হবে। "আমি তার গালের তিলের বদলে দু মণ চিনি ও তিন মণ খেজুর দান করব!"
কেউ কেউ বলেন, হফেজ এই উত্তর দেননি। তিনি নাকি দীর্ঘ কুর্নিশ করে বলেছিলেন, "সম্রাট! আমি আজকাল এই রকমই অমিতব্যয়ী হয়ে পড়েছি!" এই জবাব শুনে তৈমুর এত আনন্দ পান যে, শাস্তি দেয়ার বদলে হফেজকে তিনি বহুমূল্য পারিতোষিক দেন। হফেজের নামে এরকম অনেক গল্প চালু আছে, যার বেশীরভাগই বিশ্বাসযোগ্য নয়।
হফেজের প্রায় সব কবিতা "শাখ-ই-নবাৎ" নামক কোনো ইরানি সুন্দরীর স্তবগানে মুখরিত। অনেকে বলেন, "শাখ-ই-নবাৎ" হফেজের দেয়া আদরের নাম। তার আসল নাম হফেজ গোপন করে গেছেন। কোন ভাগ্যবতী এই কবির প্রিয়া ছিলেন, কোথায় ছিল তার কুটির, এ নিয়ে অনেকে অনেক জল্পনা-কল্পনা করেছেন। রহস্য-সন্ধানীদের কাছে এই হরিণ-আঁখি সুন্দরী আজো রহস্যের আড়ালে রয়ে গেছেন।
মহাপ্রয়াণ
[সম্পাদনা]তার মৃত্যু সম্বন্ধে একটি বিস্ময়কর গল্প প্রচলিত আছে। শিবলী নোমানী, ব্রাউন সাহেব প্রভৃতি পারস্য সাহিত্যের সকল অভিজ্ঞ সমালোচকই এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন।
হাফেজের মৃত্যুর পর একদল লোক তার 'জানাজা' পড়তে (মুসলমানী মতে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে) ও কবর দিতে অসম্মতি জানায়। হাফেজের ভক্তদলের সাথে এ নিয়ে বিসম্বাদের সৃষ্টি হলে কয়েকজনের মধ্যস্থতায় উভয় দলের মধ্যে এই শর্তে রফা হয় যে, হফেজের সমস্ত কবিতা একত্র করে একজন লোক তার যে কোন স্থান খুলবে; সেই পৃষ্ঠায় প্রথম দুই চরণ কবিতা পড়ে হফেজের কি ধর্ম ছিল তা ধরে নেয়া হবে।
আশ্চর্যের বিষয়, এভাবে এই দুই চরণ কবিতা পাওয়া গিয়েছিল -
হাফিজের এই শব হ'তে গো তু'লো না কো চরণ প্রভূ
যদিও সে মগ্ন পাপে বেহেশতে সে যাবে তবু।
এর পর উভয়দল মিলে মহাসমারোহে হাফেজকে এক দ্রাক্ষাকুঞ্জে সমাহিত করেন। সে স্থান আজও "হাফেজিয়া" নামে প্রসিদ্ধ। দেশ-বিদেশ হতে লোক এসে আজও কবির কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করে।
হাফেজ পারস্য ছেড়ে কখনো কোথাও যাননি। স্বদেশ ও স্বপল্লীর প্রতি তার অণু-পরমাণুতে অপূর্ব মমতা সঞ্চিত ছিল। বহু কবিতায় তার বাস-পল্লী "মোসল্লা" এবং "রোকনাবাদে"র খালের প্রশংসা দেখতে পাওয়া যায়।
হাফেজ নিজের সম্বন্ধে বলে গেছেন -
আমার গোরের পার্শ্ব দিয়া যেতে চেয়ো আশিস্ তুমি
এ গোর হবে ধর্ম-স্বাধীন নিখিল-প্রেমিক-তীর্থভূমি।
আজ সত্যই হাফেজের কবর নিখিল-প্রেমিকের তীর্থভূমি হয়ে উঠেছে।
উৎসঃ কবি কাজী নজরুল ইসলাম-এর অনুবাদমূলক গ্রন্থ রুবাইয়াৎ-ই-হাফিজ থেকে সংকলিত
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ http://www.britannica.com/EBchecked/topic/251392/Hafez
- ↑ (সূত্র : নজরুল কাব্যে আরবী ফারসী শব্দ, আব্দুস সাত্তার, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা, প্রকাশক : আবুল কালাম আজাদ, প্রকাশকাল : ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৯৯২, ২রা ফাল্গুন ১৩৯৮, কালচারাল কাউন্সেলর দপ্তর লাইব্রেরি গ্রন্থ নং-৮০০/২৮৫)