আফগান বিদ্রোহ (১৭৪৫–১৭৪৮)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আফগান বিদ্রোহ
মূল যুদ্ধ: বর্গির হাঙ্গামা
তারিখফেব্রুয়ারি ১৭৪৫ – ১৬ এপ্রিল ১৭৪৮
অবস্থান
ফলাফল

বাংলার নবাবের বিজয়[১][২]

  • আফগান বিদ্রোহের অবসান ঘটে[১]
  • বিহারের ওপর বাংলার নবাবের নিয়ন্ত্রণ পুন:প্রতিষ্ঠিত হয়[১]
অধিকৃত
এলাকার
পরিবর্তন
অপরিবর্তিত
বিবাদমান পক্ষ
বাংলা

বিদ্রোহী আফগান সৈন্যদল (গোলাম মুস্তফা খানের নেতৃত্বাধীন)


বিদ্রোহী আফগান সৈন্যদল (সমশের খান ও সরদার খানের নেতৃত্বাধীন) (১৭৪৮)
মারাঠা সাম্রাজ্য (১৭৪৮)
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
আলীবর্দী খান
হাজি আহমদ 
জৈনুদ্দিন আহমদ 

গোলাম মুস্তফা খান 
মুর্তজা খান
আব্দুর রসুল খান


সমশের খান 
সরদার খান 
প্রথম রঘুজী ভোঁসলে
মীর হাবিব
শক্তি
অজ্ঞাত আফগান বাহিনী: অজ্ঞাত
অজ্ঞাত
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
অজ্ঞাত আফগান বাহিনী: অজ্ঞাত
অজ্ঞাত

আফগান বিদ্রোহ (১৭৪৫–১৭৪৮) ছিল বাংলার নবাব আলীবর্দী খানের সৈন্যবাহিনীর অন্তর্গত আফগান সৈন্যদলসমূহের বিদ্রোহ।[১] এই বিদ্রোহগুলো দমিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আলীবর্দীর শাসনব্যবস্থার প্রতি মারাত্মক হুমকি হিসেবে বিরাজ করেছিল।[১]

পটভূমি[সম্পাদনা]

১৭৪১ সাল থেকে শুরু হওয়া মারাঠা আক্রমণ প্রতিরোধে বাংলার নবাব আলীবর্দী খানকে তার আফগান সৈন্যরা বিশেষভাবে সহযোগিতা করেছিল।[১] নবাবের আফগান সেনাপতি গোলাম মুস্তফা খান মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। গোলাম মুস্তফার অধীনে একটি বড় আফগান সৈন্যদল ছিল। তার ধারণা ছিল, তার আফগান সৈন্যদের ওপরই আলীবর্দীর রাজ্যের স্থায়িত্ব নির্ভর করছে।[১] তিনি নবাবের নিকট বিহারের নায়েব নাযিম পদ দাবি করেন। আলীবর্দী তার দাবি পূরণ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। তিনি গোলাম মুস্তফাকে উপহার প্রদান করে এবং আরো নানাভাবে অনুগৃহীত করে তাকে সন্তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন।[১] কিন্তু উচ্চাভিলাষী মুস্তফা তাতে সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। তিনি নবাবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে নিজেই মসনদ দখল করার জন্য মনস্থির করেন।[১]

গোলাম মুস্তফা খানের বিদ্রোহ[সম্পাদনা]

১৭৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে গোলাম মুস্তফা খান তার আফগান সৈন্যবাহিনীসহ বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।[১] তিনি নবাবের রাজধানী মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করেন, কিন্তু নবাবের সৈন্যবাহিনীর নিকট পরাজিত হন।[১] মুর্শিদাবাদ দখলে ব্যর্থ হয়ে তিনি বিহার দখলের জন্য অগ্রসর হন। তার ভ্রাতুষ্পুত্র উড়িষ্যার নায়েব নাযিম আব্দুর রসুল খানও তার সঙ্গে যোগদান করেন[১]। আফগান বিদ্রোহীরা বিহারের রাজধানী আজিমাবাদ দখল করার চেষ্টা করে, কিন্তু বিহারের নায়েব নাযিম জৈনুদ্দিন আহমদ তাদেরকে পরাজিত করেন।[১]

এরপর গোলাম মুস্তফা খান তাকে সহায়তা করার জন্য মারাঠা নেতা রঘুজী ভোঁসলের সঙ্গে যোগাযোগ করেন[৩]। মারাঠা বাহিনীর অগ্রগতির সংবাদ পেয়ে নবাব আলীবর্দীকে তাদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হতে হয়। এ সুযোগে মুস্তফা আবার আজিমাবাদ দখলের জন্য অগ্রসর হন।[১] কিন্তু ভোজপুরের নিকটে সংঘটিত এক যুদ্ধে জৈনুদ্দিন তাকে পরাজিত ও নিহত করেন[১]। মুস্তফা খানের পুত্র মুর্তজা খানের নেতৃত্বে আফগান বিদ্রোহীরা পশ্চাৎপসরণ করে[১] এবং মারাঠাদের সঙ্গে যোগদান করে।[৩] পরবর্তীতে বিভিন্ন অভিযানে তারা মারাঠাদের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।[৩]

বিহারে আফগান বিদ্রোহ[সম্পাদনা]

আফগান সৈন্যাধ্যক্ষদের ষড়যন্ত্র ও পদচ্যুতি[সম্পাদনা]

১৭৪৫ সালে রঘুজী বাংলা আক্রমণ করেন এবং উড়িষ্যা দখল করে বাংলার পশ্চিমাঞ্চলের দিকে অগ্রসর হন।[১] ১৭৪৬ সালের এপ্রিলের মধ্যে নবাব আলীবর্দী বাংলা থেকে মারাঠাদের বিতাড়িত করেন এবং উড়িষ্যা অভিযানের জন্য প্রস্তুত হন।[১] এই সময়ে আলীবর্দীর দুই আফগান সৈন্যাধ্যক্ষ সমশের খান ও সরদার খান মারাঠাদের সঙ্গে আলীবর্দীর বিরুদ্ধে গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আলীবর্দী এ সংবাদ জেনে যান এবং শাস্তিস্বরূপ দুই আফগান সেনাপতিতে পদচ্যুত করেন।[১] পদচ্যুতির পর তারা দু'জন তাদের নিবাস দ্বারভাঙ্গায় প্রত্যাবর্তন করেন।[১]

জৈনুদ্দিনের সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগলাভ[সম্পাদনা]

এসময় বিহারের নায়েব নাযিম জৈনুদ্দিন আহমদ সম্ভব্য মারাঠা আক্রমণ থেকে বিহারকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করছিলেন। তিনি আলীবর্দী কর্তৃক পদচ্যুত দুই আফগান সেনানায়ক সমশের খান ও সরদার খানকে নিজ সৈন্যবাহিনীতে গ্রহণ করেন।[১]

বিদ্রোহ[সম্পাদনা]

১৭৪৮ সালে আফগান নেতা আহমদ শাহ দুররানী ভারত আক্রমণ করেন। এতে জৈনুদ্দিনের সৈন্যবাহিনীর আফগান সৈন্যরা মনে করে যে, ভারতে পুনরায় আফগান শাসন প্রতিষ্ঠার সময় এসেছে।[৩] ১৭৪৮ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি সমশের খান ও সরদার খানের নেতৃত্বে আফগান সৈন্যরা বিদ্রোহ করে এবং অকস্মাৎ আক্রমণ চালিয়ে জৈনুদ্দিন ও তার পিতা হাজী আহমদকে হত্যা করে। জৈনুদ্দিনের স্ত্রী ও নবাব আলীবর্দীর কন্যা আমিনা বেগম ও তার দুই পুত্রকে আফগান বিদ্রোহীরা বন্দি করে।[১]

বিদ্রোহের অবসান[সম্পাদনা]

বিহারে বিদ্রোহের সংবাদ পেয়ে আলীবর্দী সসৈন্যে বিহারে আসেন। অন্যদিকে, মীর হাবিবের নেতৃত্বে মারাঠা সৈন্যরা বিদ্রোহী আফগানদের সঙ্গে যোগদান করার জন্য অগ্রসর হয়। ভাগলপুরের যুদ্ধে নবাবের সৈন্যবাহিনীর নিকট অগ্রসরমান মারাঠা বাহিনী পরাজিত হয়,[১] কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা আফগানদের সঙ্গে যোগদান করতে সমর্থ হয়। অবশেষে ১৭৪৮ সালের ১৬ এপ্রিল কালাদিয়ারার যুদ্ধে আলীবর্দী আফগান ও মারাঠাদের সম্মিলিত বাহিনীকে পরাজিত করেন এবং সমশের খান ও অন্যান্য আফগান নেতা নিহত হন[১]। আলীবর্দী তার কন্যা ও দৌহিত্রদের মুক্ত করেন এবং আফগান বিদ্রোহের অবসান ঘটে।[৩]

ফলাফল ও তাৎপর্য[সম্পাদনা]

১৭৪৮ সালের মধ্যে বাংলায় আফগান বিদ্রোহ চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়[৩]। কিন্তু বহুসংখ্যক আফগান সৈন্যের নবাবের সৈন্যদল ত্যাগ, সুদক্ষ সেনাপতি গোলাম মুস্তফার দলত্যাগ, বিশ্বস্ত জৈনুদ্দিন ও হাজী আহমদের মৃত্যু - প্রভৃতি নবাব আলীবর্দীর সামরিক শক্তিকে বহুলাংশে হ্রাস করে। পক্ষান্তরে, বহু দলত্যাগী আফগান সৈন্যের মারাঠাদের সঙ্গে যোগদানের ফলে মারাঠারা আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করা বাংলার নবাবের জন্য কঠিনতর হয়ে দাঁড়ায়।[১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ড. মুহম্মদ আব্দুর রহিম, (বাংলাদেশের ইতিহাস), আলীবর্দী ও মারাঠা আক্রমণ, পৃ. ২৯৩–২৯৯
  2. মোহাম্মদ শাহ (২০১২)। "মারাঠা হামলা"ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিআইএসবিএন 9843205901ওএল 30677644Mওসিএলসি 883871743 
  3. "Relation of Alivardi with the Marathas"