জার্মান সাম্রাজ্যে ইহুদি নৃগোষ্ঠী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(জার্মান সাম্রাজ্যে ইহুদিরা থেকে পুনর্নির্দেশিত)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময় (১৯১৪) জার্মান সাম্রজ্যের বিস্তৃতি

জার্মান সাম্রাজ্যে ইহুদি নৃগোষ্ঠী (দ্বিতীয় রাইখ: ১৮৭১ - ১৯১৪) ছিল সাম্রাজ্যের মোট জনসংখ্যার মাত্র প্রায় ১ শতাংশ।[১] ১৮৮০ সালের হিসেবে যেখানে সমগ্র রাইখের (জার্মান সাম্রাজ্যের নাম) জনসংখ্যা ছিল মোট ৪ কোটি ৫২ লক্ষ ৩৪ হাজার ৬১ জন, তার মধ্যে ইহুদি জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৫ লক্ষ ৬১ হাজার ৬১২ জন, অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.২৪%।[২] তবে সংখ্যার হিসেবে জার্মানির জনগণের এক অতি সামান্য বা নগন্য অংশ হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষা-সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞান-গবেষণা, শিল্প ও সঙ্গীতচর্চা, প্রভৃতি জীবনের নানা ক্ষেত্রে তারা তাদের প্রতিভার ও দক্ষতার যথেষ্ট সাক্ষর রেখেছিল। শুধুমাত্র ধর্ম ছাড়া জীবনযাত্রার প্রায় আর কোনও ক্ষেত্রেই তাদের অন্য সাধারণ জার্মান নাগরিকদের সাথে তেমন কোনও পার্থক্য পরিলক্ষিত হত না।[৩] এবং বামপন্থা, যুক্তিবাদ, উদারনৈতিকতা, প্রভৃতির চর্চার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি, সারা দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও দ্রুত শিল্পায়নের ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা যত বাড়ছিল, সাধারণভাবে সমাজজীবনে খ্রিস্টান জার্মানদের সাথে ইহুদিদের ধর্মীয় প্রভেদের গুরুত্বও ক্রমশ কমে আসছিল। এরই ফলস্বরূপ আন্তর্ধর্মীয় বিবাহর সংখ্যাও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল।[১] ইহুদিদের মধ্যেও সেইসময় জার্মান জাতীয়তাবোধের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। মোটের উপর জার্মানির বহু-সাংস্কৃতিক সমাজজীবনের অন্যান্য সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী, যেমন ক্যাথলিক, পোল, ফরাসি, ডেন বা সর্বদের মতো ইহুদিরাও হয়ে উঠেছিল জার্মান সমাজজীবনেরই এক অংশ। রাষ্ট্রীয় ও সমাজজীবনের সর্বত্র তাদের সমান আইনি অধিকারও স্বীকৃত হয়েছিল।[৪] আর অর্থনৈতিক দিক থেকে তাদের কারুর কারুর সাফল্য ছিল রীতিমতো ঈর্ষনীয়।

পূর্ব ইতিহাস[সম্পাদনা]

জার্মানিতে ইহুদিদের বসতি প্রায় দুই সহস্রাব্দ প্রাচীন। খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে চতুর্থ শতকের মধ্যেই তারা প্রথম জার্মানিতে পদার্পণ করে। প্রথম দিকে তারা নানারকম জীবিকা গ্রহণ করলেও পরের দিকে মহাজনী কারবারে তারা বিশেষভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। মধ্যযুগ থেকে শুরু করে আমাদের আলোচ্য সময়, অর্থাৎ দ্বিতীয় রাইখের সময়সীমা (১৮৭১-১৯১৪/১৯১৯) পর্যন্ত বারে বারে তাদের উপর নানা আক্রমণ নেমে এলেও এবং জার্মানির বৃহত্তর জনসংখ্যার এক অংশ তাদের প্রতি বিদ্বেষের মনোভাব পোষণ করলেও এই দীর্ঘ সময় জুড়ে জার্মানিতে তাদের অবস্থান ছিল একরকমের নিরবচ্ছিন্ন। তবে কখনোই তারা জনসংখ্যার খুব একটা বড় অংশে পরিণত হয়নি। আধুনিক যুগের অগ্রগতির সাথে সাথে তাদের আলাদা গোষ্ঠী পরিচয়ের বাইরে বেরিয়ে এসে ক্রমশ জার্মানির সাধারণ সমাজ ও জাতীয়জীবনের এক অঙ্গাঙ্গী অংশে পরিণত হওয়ার একটা প্রক্রিয়াও কাজ করতে শুরু করে; দ্বিতীয় রাইখ তথা জার্মান সাম্রাজ্যের আমলে এই প্রক্রিয়া যথেষ্ট জোরদার হয়ে ওঠে। আবার একই সময় তাদের প্রতি জাতিবিদ্বেষও বাড়তে থাকে, পরবর্তীকালের নাৎসি গণহত্যা যারই ফলশ্রুতি। জার্মানিতে ইহুদিদের অবস্থানের পূর্ব ইতিহাস নিচে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

রোমান আমল[সম্পাদনা]

মধ্য ইউরোপের জার্মানভাষী অঞ্চলে ইহুদিদের বসবাসের ইতিহাস কম করেও ১৭০০ থেকে ২০০০ বছরের পুরনো। এমনকী রোমান সাম্রাজ্যের আমলে চতুর্থ শতকেও পশ্চিম জার্মানির বেশ কিছু রোমান উপনিবেশ, যেমন - কোলন, ট্রিয়ের, মাইনৎস, ওয়রমস, স্পাইয়ার, প্রভৃতি শহরে ইহুদি বসতির কথা আমরা জানতে পারি।[৫][৬] ৩২১ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট কনস্তানতাইন কোলন শহরের কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি লিখে জানান যে শহরের সিনেটে ইহুদি প্রতিনিধিদের অন্তর্ভুক্তিতে তার সম্মতি রয়েছে। এর থেকেই বোঝা যায় সে' সময় কোলন শহরে ইতোমধ্যেই ইহুদিদের সংখ্যা অন্তত এতটাই ছিল, যে সিনেটে তাদের প্রতিনিধিত্বর প্রয়োজনিয়তা দেখা দিয়েছিল।[৭][৮][৯] মূলত রাইন নদীর পশ্চিম পাড় বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণে তাদের বসতির কথা সে'সময় জানতে পারা যায়।[৫] সে' সময় স্থানীয় জার্মান উপজাতির মানুষ ছিল খুবই অনগ্রসর ও রোমানদের প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন কাজের পক্ষে অনুপযুক্ত। রোমান উপনিবেশগুলিতে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে নানা ধরনের কাজ পাওয়ার সুযোগের সুবাদেই তাই এই সময় ইহুদিরা এই অঞ্চলে তাদের বসতি গড়ে তোলে। সেই সময় ইহুদিরা মূলত জমির মালিক ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠী হিসেবে রাইন ও নিম্ন দানিয়ুব উপত্যকায় তাদের বসতি স্থাপন করেছিল। রোমান সাম্রাজ্যের সর্বত্রই তারা অন্যান্যদের সাথে সমান নাগরিক অধিকারও ভোগ করত। এখানেও তার কোনও অন্যথা ছিল না। রোম সাম্রাজ্যে তাদের ধর্মকেও একটি অনুমোদিত ধর্ম (religio licita) বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। ফলে রোমের রাষ্ট্রধর্মপালনের বাধ্যবাধকতা থেকে তারা মুক্ত ছিল। তবে খোলাখুলি নিজেদের ধর্মপালনসহ কোনও কোনও ক্ষেত্রে (যেমন অ-ইহুদি দাস রাখা, প্রভৃতি) কিছু কিছু বিধিনিষেধ তাদের উপর জারি ছিল।[১০] স্থানীয় মানুষের সাথে তখন তাদের যথেষ্ট সুসম্পর্ক ছিল বলেই জানা যায়। প্রশাসনের তরফেও তাদের উপর অনেক সময়েই বিভিন্ন দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়। এমনকী আদেশপ্রদানকারী অফিসার পদেও এইসময় তাদের নিয়োগের কথা জানা যায়।[৫] তবে এই সময় রাইন নদীর পূর্ব বা দানিয়ুব নদীর উত্তর পাড়ে তাদের কোনও বসতির কথা জানা যায় না।

মধ্যযুগ[সম্পাদনা]

৫ম - ৮ম শতাব্দী[সম্পাদনা]

রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরও জার্মানির এইসব সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলিতে ইহুদিদের বসতি বজায় থাকে। ধীরে ধীরে তারা উত্তরে ও পূর্বে দেশের আরও অভ্যন্তরেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। তবে কীভাবে তারা ধীরে ধীরে রাইন নদী ও দানিয়ুব নদী পার হয়ে পশ্চিম ও দক্ষিণ থেকে ক্রমশ দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়ে, সে' সম্পর্কে এখনও বিস্তারিত গবেষণার অবকাশ রয়ে গেছে। কিন্তু যেহেতু তখনও পর্যন্ত জার্মান উপজাতিগুলির পুরোপুরি খ্রিস্ট ধর্মে ধর্মান্তকরণের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়নি, হয়তো সেই কারণেই এই সময়ের জার্মানিতে বিভিন্ন জার্মানিক রাজ্যগুলি গির্জার দাবির কাছে নতি স্বীকার করে অন্যান্য পূর্বতন রোমান অঞ্চলগুলির মতো ইহুদিদের উপর আইনি, নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকারের উপর নানা বিধিনিষেধ চাপাতে রাজি হয়নি। ফলে জার্মানিতে ইহুদিরা ইউরোপের অন্যান্য বহু অঞ্চলের তুলনায় সেই সময়ে অপেক্ষাকৃত স্বাধীনভাবে বসবাস করতে পারত। কিন্তু রোমান আমল থেকেই তাদের সাথে সাধারণ জার্মান অধিবাসীদের জাতি ও সংস্কৃতিগত কিছু পার্থক্য ছিল[৫], যা এইসময়েও বজায় থেকে যায়। তারউপর সাধারণ জনগনের মধ্যে খ্রিস্ট ধর্মের প্রভাব যত বাড়তে শুরু করে, ইহুদিদের উপর নানাবিধ চাপও ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে।

৮ম - ১০ম শতাব্দী[সম্পাদনা]

পবিত্র রোমান সম্রাট শার্লেমাইনের আমলে (রাজত্বকাল ৭৬৮ - ৮১৪ খ্রিঃ) আমরা প্রথম জার্মানির একজন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ইহুদির নাম পৃথক ভাবে জানতে পারি। সে' সময়ের আখেন শহরের অন্যতম নাম করা ইহুদি ব্যবসায়ী 'ইশাক'কে সম্রাট শার্লেমাইন আরও দু'জন অভিজাত জার্মান নাগরিকের সাথে বাগদাদে খলিফা হারুন অল রশিদের কাছে ৭৯৭ - ৮০২ খ্রিষ্টাব্দে তার দূত হিসেবে প্রেরণ করেছিলেন।[১১] শার্লেমাইনের দূতেদের হয়ে অনুবাদ করা ও তাদের গাইড হিসেবে কাজ করা ছিল তার দায়িত্ব। ৮০২ খ্রিষ্টাব্দে ইশাক বাগদাদ থেকে খলিফার উপহার একটি হাতি নিয়ে পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী আই লা শাপেল বা আখেনে ফিরে আসে ও সম্রাটের হাতে সেই উপহার তুলে দেয়।[১১] এতদ্‌সত্ত্বেও শার্লেমাইনের রাজত্বকাল ইহুদিদের জীবনে বাস্তবে দ্বিমুখী প্রভাববিস্তার করে বলে মনে করা হয়ে থাকে। একদিকে তিনি যেমন কূটনীতির ক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবহার করেন, অন্যদিকে তার রাজত্বকালে সুবৃহৎ সাম্রাজ্যকে ধরে রাখার প্রয়োজনে গির্জাকেও আরও বেশি পরিমানে ব্যবহার করা শুরু হয়। গির্জার আইন রাষ্ট্র বিভিন্ন ক্ষেত্রে মেনে নিতে শুরু করলে ধার দেওয়ার ব্যবসা সংখ্যাগুরু খ্রিস্টীয় জনগণের ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ বিবেচিত হতে শুরু করে। ফলে মহাজনী কারবার একচেটিয়াভাবে ইহুদিদের করায়ত্ত্ব হয়ে পড়ে। দেশের বেশিরভাগ মানুষের সাথে ইহুদিদের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও শীঘ্রই এর প্রভাব পড়তে শুরু করে। ব্যবহারিক প্রয়োজনে মানুষ তাদের খোঁজ করলেও, তাদের কারবারের প্রতি একই সাথে একধরনের অশ্রদ্ধার মনোভাবও প্রশ্রয় পেতে থাকে। পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের পরবর্তী শাসক সম্রাট প্রথম লুইসের আমলে ৮২৫ খ্রিষ্টাব্দে ইহুদিদের যেমন একদিকে বেশ কিছু বিশেষ সুবিধে দেওয়া হয়, অন্যদিকে বোহেমিয়াস্পেনের মধ্যে তাদের দ্বারা পরিচালিত দাসব্যবসাকেও বেশ কিছু নিয়মনীতির প্রচলন করে রাষ্ট্রীয় নজরদারির মধ্যে আনা হয়। সম্রাট কর্তৃক ইহুদিদের এইসব বিশেষ অধিকারের স্বীকৃতি লিয়ঁর আর্চবিশপ আজোবেয়ারকে এতটাই ক্ষিপ্ত করে তোলে যে তিনি তাদের filii diaboli বা 'শয়তানের বংশধর' বলে আক্রমণ করেন।[১২][১৩]

রাইন উপত্যকা ও জার্মানির দক্ষিণ অংশ হিব্রু ভাষায় আশকেনাস নামে পরিচিত ছিল। পরবর্তীকালে এই শব্দটির দ্বারা সমগ্র জার্মানিকেই বোঝানো হতে শুরু করে। বিখ্যাত অস্ট্রীয় সাংবাদিক ও লেখক আর্তুর কোয়েস্টলারের তত্ত্ব অনুযায়ী মধ্যযুগ থেকেই জার্মানি তথা পূর্ব ইউরোপে বসবাসকারী যে আশকেনাস ইহুদিদের কথা জানতে পারা যায়, তারা জাতিগতভাবে ইজরায়েলীয় ছিল না। বরং তুর্ক জাতিগোষ্ঠীভুক্ত কাজারদের সাথে তাদের মিল যথেষ্ট। অষ্টম - নবম শতাব্দীতে তারা ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করে ও মধ্য-পূর্ব ইউরোপে এসে তাদের বসতি স্থাপন করে।[১৪][১৫] কিন্তু এই তত্ত্ব নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে। অন্য কিছু বিশেষজ্ঞের মতে - কিয়েভের গ্র্যান্ড প্রিন্স প্রথম সিয়াতোস্লাভের (৯৪২ - ৯৭২ খ্রিষ্টাব্দ) হাতে কাজার সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে অবশ্যই কিছু পরিমাণে কাজার জনগোষ্ঠীর মানুষ মধ্য-পূর্ব ইউরোপে পালিয়ে এসে বসতি স্থাপন করে; সেখানে তাদের সাথে আশকানাজ ইহুদিদের মিলমিশও হয়। কিন্তু তাদের সংখ্যা কখনই তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। জিনগত সাদৃশ্য বিচার করলেও দেখা যায় আশকানাজ ইহুদি জনগোষ্ঠীর মানুষের সাথে বর্তমানের নিকট প্রাচ্যের অধিবাসীদেরই বেশি মিল। অর্থাৎ, এদের এক বড় অংশই ব্যবসাবাণিজ্য বা অন্য কোনও কারণে নিকট প্রাচ্য থেকে এসে এই অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে ও পরবর্তীকালে এখানেই থেকে যায়।[১৬][১৭]

১১শ শতাব্দী পরবর্তী সময়[সম্পাদনা]

১০ ও ১১ শতাব্দীতে জার্মানিতে ইহুদিদের সংখ্যা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। দশম শতাব্দীতে যেখানে জার্মানিতে ইহুদিদের সংখ্যা ছিল ৫০০০'এর কাছাকাছি, একাদশ শতাব্দীতে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় প্রায় ২০,০০০। এইসময় ইতালি ও দক্ষিণ ফ্রান্স থেকে বহু ইহুদি ব্যবসায়ী রাইন নদী তীরবর্তী শহরগুলিতে এসে বসবাস শুরু করে। এখানে এইসময় তাদের শিক্ষা সংস্কৃতি ও ব্যবসা বাণিজ্যের যথেষ্ট বিকাশ ঘটে। দশম শতাব্দীর শেষের দিক থেকে তারা আরও পূর্বদিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে এবং মাগডেবুর্গ, মেরসেবুর্গ প্রভৃতি পূর্ব জার্মান শহরেও বসতিস্থাপন করে। সব মিলিয়ে বলা যায়, পবিত্র রোমান সাম্রাজ্যের অটোনীয় (৯১৯ - ১০২৪ খ্রিষ্টাব্দ) ও সালিয়ের বংশের (১০২৪ - ১১২৫ খ্রিষ্টাব্দ) সম্রাটদের আমলে ইহুদি ব্যবসায়ীরা যথেষ্টই সুযোগসুবিধা লাভ করেছিল। ব্যবসাবাণিজ্যে তাদের দক্ষতাকে শাসকরাও ব্যবহার করত।

রাইন নদী তীরবর্তী ওয়র্মস, স্পাইয়ার, প্রভৃতি শহর, রাইন উপত্যকারই আরেক গুরুত্বপূর্ণ শহর মাইনৎস, দক্ষিণে দানিউব নদী তীরবর্তী শহর রেগেনসবুর্গ, প্রভৃতিস্থান এইসময় ইহুদিদের মধ্যে জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে বিকাশ লাভ করে। এর মধ্যে স্পাইয়ার, ওয়র্মস ও মাইনৎস শহর একত্রে শুম শহরমণ্ডলী (SchUM) বলে খ্যাত ছিল। হিব্রু ভাষায় শহরগুলির নামের আদ্যাক্ষরগুলি নিয়ে এই শুম শব্দটি গড়ে উঠেছিল। মধ্যযুগে ইহুদিদের জ্ঞানচর্চার প্রধান কেন্দ্র হিসেবেই এই শুম শহরমণ্ডলীর খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। মাইনৎস শহরের ইতিহাস থেকেও আমরা জানতে পারি যে ৯০০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ সময় থেকেই এই শহর মধ্য ইউরোপে ব্যবসাবাণিজ্যের এক অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে বিকাশ লাভ করতে শুরু করে। এই সময় ও তার পরবর্তী ৪০০ বছর, শহরের সমৃদ্ধ ব্যবসা বাণিজ্য দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে অনেক ইহুদি ব্যবসায়ীই এখানে বসতি স্থাপন করে; তাদের সাথে সাথে এখানে এসে জড়ো হন বিভিন্ন ইহুদি রাব্বি ও পণ্ডিতগণ। তাদের শিক্ষা পাণ্ডিত্য সংলাপ ও সিদ্ধান্তের খ্যাতি এক সময় এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে ইহুদি জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হিসেবে মাইনৎস ও পার্শ্ববর্তী রাইনতীরবর্তী শহরগুলির গুরুত্ব বাগদাদকেও ছাপিয়ে যায়। আশকেনাস বা জার্মান ইহুদিদের প্রধান কেন্দ্রই হয়ে ওঠে মাইনৎস, ব্যাবিলনের প্রভাব কাটিয়ে উঠে স্বতন্ত্র পথে শুরু হয় তাদের বিকাশ।[১৮] সুবিখ্যাত ইহুদি পণ্ডিত গেরশম বেন জুডা (৯৬০ - ১০৪০) দশম শতাব্দীতেই মাগেনৎসায় (মাইনৎস শহরের হিব্রু নাম) একটি ইয়েশিভা বা ইহুদি ধর্মচর্চার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।[১৮] এই বিদ্যালয়ের খ্যাতিতে আকৃষ্ট হয় সারা মধ্য ও পশ্চিম ইউরোপের ইহুদি পণ্ডিতরা। বিখ্যাত পণ্ডিত ও বাইবেলবিদ ফ্রান্সের ত্রোয়ার রশিও (১০৪০ - ১১০৫) এই বিদ্যালয়েরই ছাত্র ছিলেন।[১৯] চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এই শহর মধ্য ইউরোপের ইহুদিদের সবচেয়ে বড় বাসস্থল রূপে পরিগণিত হত। তখন এখানে ইহুদি জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৬০০০।[১৮]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Evans, Richard J.. The Coming of the Third Reich. London: Penguin Books, 2003. আইএসবিএন ৯৭৮-০-১৪-১০০৯৭৫-৯ পৃঃ ২৩।
  2. Zu den Konfessionen ausführlich: Nipperdey: Arbeitswelt und Bürgergeist, পৃঃ ৪২৮–৫২১; Wehler: Gesellschaftsgeschichte Bd. 3, পৃঃ ১১৭১–১১৯০।
  3. Kaplan, Marion A.. The Acculturation, Assimilation and Integration of Jews in Imperial Germany : a Gender Analysis. Year book of Leo Baeck Institute. Vol. 27. (1982).
  4. Evans, Richard J.. The Coming of the Third Reich. পৃঃ ২২।
  5. Gamm, Hans-Jochen. Das Judentum: Eine Einführung. Berlin: Lit Verlag, 2011. আইএসবিএন ৯৭৮-৩-৬৪৩-১০৭৮৭-৯ পৃঃ ৮১।
  6. "Already during Roman times, Jews resided in Cologne". Archäologische Zone – Jüdisches Museum. সংগৃহীত ২২ মার্চ, ২০১৮।
  7. Römisches Köln: Schon in der römischen Zeit lebten Juden in Köln. Archäologisce Zone: Jüdisches Museum. সংগৃহীত ২৬ জানুয়ারি, ২০১৫।
  8. Lieu, Judith, John North and Tessa Rajak ed. The Jews Among Pagans and Christians in the Roman Empire. Routledge, 2013. আইএসবিএন ৯৭৮১১৩৫০৮১৮৮১ পৃঃ ১১৭।
  9. "Jewish Cemeteries in Germany: Cologne – Cockleshell". Archived from the original on March 6, 2008. সংগৃহীত ২২ মার্চ, ২০১৮।
  10. টাসিটাস, হিস্টোরি, পঞ্চম অধ্যায়, ৪র্থ ও ৫ম স্তবক।
  11. Gamm, Hans-Jochen. Das Judentum: Eine Einführung. পৃঃ ৮২।
  12. Jeremy Cohen, Living Letters of the Law: Ideas of the Jew in Medieval Christianity, (Berkeley: University of California Press, 1999), 144–5.
  13. McCracken, Early Medieval Theology, 329.
  14. Koestler, Arthur. Der dreizehnte Stamm. Das Reich der Khasaren und sein Erbe. Molden, Wien/München/Zürich 1977, ISBN 3-217-00790-5; Pawlak, Herrsching 1991, ISBN 3-88199-878-0.
  15. Nicht Abrahams Söhne? In: Der Spiegel. Nr. 26, 1976 (জার্মান)
  16. 40 % der aschkenasischen Juden sind Nachkommen von vier Urmüttern. Newsletter der Botschaft des Staates Israel vom 31. Januar 2006
  17. "In DNA, New Clues to Jewish Roots", New York Times, 14. May 2002, Full text in In DNA, New Clues to Jewish Roots (Memento vom 10. September 2012 im Internet Archive)
  18. https://web.archive.org/web/20131113210512/http://mainz.de/WGAPublisher/online/html/default/hthn-5vgjlb.en.html "The Magic Land of Magenza, Jewish Life and Times in Medieval and Modern Mainz", Landeshauptstadt Mainz. 2013. সংগৃহীত ১৮ মার্চ, ২০১৮।
  19. Germany Virtual Jewish History Tour সংগৃহীত ১৮ মার্চ, ২০১৮।