প্রিয়দারঞ্জন রায়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
প্রিয়দারঞ্জন রায়
জন্ম(১৮৮৮-০১-১৬)১৬ জানুয়ারি ১৮৮৮
নোয়াপাড়া, চট্টগ্রাম বৃটিশ ভারত (বর্তমানে বাংলাদেশ
মৃত্যু১১ ডিসেম্বর ১৯৮২(1982-12-11) (বয়স ৯৪)
জাতীয়তাভারতীয়
মাতৃশিক্ষায়তনপ্রেসিডেন্সি কলেজ
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
কর্মক্ষেত্ররসায়ন বিজ্ঞান

ড.প্রিয়দারঞ্জন রায় (ইংরেজি: Dr.Priyadaranjan Ray) (১৬ জানুয়ারি ১৮৮৮ – ১১ডিসেম্বর ১৯৮২) ছিলেন একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বিজ্ঞানী।[১]

জন্ম ও পরিবার[সম্পাদনা]

প্রিয়দারঞ্জন রায়ের জন্ম ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জানুয়ারি বৃটিশ ভারতের অধুনা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী নোয়াপাড়া গ্রামে, এক সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবারে। পিতা জমিদার কালীচরণ রায় ছিলেন চট্টগ্রামের রাঙামাটির সাব-ডেপুটি কালেক্টর এবং মাতা শ্যামাসুন্দরী দেবী। রায় পরিবার নোয়াপাড়ায় দুশো বছর অবস্থান করলেও তাদের পূর্বপুরুষ আনন্দ রায়ের আদি নিবাস ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার ত্রিবেণীতে। ১৬৬৩- ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দের সময়কালে মহারাষ্ট্রীয় অভ্যুত্থান ও অত্যাচার হতে রক্ষায় তারা ত্রিপুরায় চলে যান। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র বিষ্ণুপ্রসাদ বাংলার নবাব মুশিদকুলি খাঁর দরবারে উচ্চ পদে ছিলেন। তার বুদ্ধিমত্তায় জেরে তিনি চট্টগ্রামের বহু গ্রামের জমিদারি লাভ করেন এবং এভাবেই চট্টগ্রামের নোয়াপাড়ায় প্রিয়দারঞ্জন রায়েদের পূর্বপুরুষের বাসস্থান গড়ে ওঠে। নোয়াপাড়ার রায় পরিবারের সে সময় যেমন শিক্ষা দীক্ষার প্রসারে সুনাম ছিল, তেমনি মানুষের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য, ন্যায়পরায়ণতার জন্য সুপরিচিতি ছিল। প্রখ্যাত কবি নবীনচন্দ্র সেন, শিক্ষাবিদ বিভূতিভূষণ সেন সহ বহু বিশিষ্টজনেরা এই রায় পরিবার হতে এসেছেন। প্রিয়দারঞ্জন তার পিতামাতার চার পুত্র সন্তানের মধ্যে তৃতীয় সন্তান ছিলেন। তার তিনজন ভগিনী ছিল।[২]

শিক্ষা[সম্পাদনা]

প্রিয়দারঞ্জনের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু গ্রামের রাসমোহন সেনের পাঠশালায়। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে যখন তিনি নবম শ্রেণীর ছাত্র, তখন তার পিতা মারা যান। তা সত্ত্বেও প্রিয়দারঞ্জন ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে প্রথম শ্রেণীতে এন্ট্রান্স পাশ করেন এবং 'রায়বাহাদুর গোলকচন্দ্র স্কলারশিপ' পান। ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে মেরিট স্কলারশিপসহ এফ.এ পাশের পর কলকাতায় চলে যান এবং প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখানে বি.এ পড়ার সময় তিনি ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের সঙ্গে ইডেন হিন্দু হস্টেলে থাকতেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে তিনি শিক্ষক হিসাবে পান অধ্যক্ষ এইচ এম পারসিভাল, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু, আচার্য আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় প্রমুখকে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নবিজ্ঞানে অনার্স সহ বি.এ পাশ করেন। পরে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের পরামর্শে তিনি রসায়ন বিজ্ঞান বেছে নেন। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন এবং ইউনিভার্সিটি গোল্ড মেডেল, মতিলাল মল্লিক স্বর্ণপদক লাভ করেন। হেমেন্দ্রকুমার সেন, বিমানবিহারী দে, রমেশচন্দ্র রায় প্রমুখ রসায়নবিদ তার সহপাঠী ছিলেন। [২]

প্রারম্ভিক কর্মজীবন ও দুর্ঘটনা[সম্পাদনা]

১৯১১ খ্রিস্টাব্দে এম. এ পাশের পর তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের গবেষণাগারে অজৈব রসায়নে কাজ করতে আরম্ভ করেন। হেমেন্দ্রকুমার সেনের সঙ্গে যৌথভাবে - "দি অ্যাকশন অফ হাইড্রাজাইন অ্যান্ড হাইড্রোঅক্সিলামাইন অন ফেরিসায়ানাইড অ্যান্ড এ নিউ মেথড ফর এস্টিমেশন অফ হাইড্রাজাইনস অ্যান্ড ফেরিসায়ানাইডস" শীর্ষক এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই আগস্ট গবেষণাগারে এক দুর্ঘটনায় সম্পূর্ণভাবে তার বামচোখ এবং আংশিকভাবে ডান চোখ ও শরীরের কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেকারণে প্রায় দুবৎসর তিনি গবেষণার কাজ করতে পারেন নি।

শিক্ষকতা[সম্পাদনা]

১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে প্রিয়দারঞ্জন কলকাতার সিটি কলেজে রসায়নে অধ্যাপক নিযুক্ত হন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় নবপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান কলেজে তিনি আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের সহকারী হিসাবে ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে নিযুক্ত হন। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি রসায়নের সহকারী পালিত অধ্যাপকের পদ পান। অজৈব রসায়ন বিভাগে অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজে ব্রতী ছিলেন এবং জীবনের গুরুত্বপূর্ণ চারটি দশক গবেষণায় কাটিয়ে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে অবসর নেন। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি রুবিয়ানিক অ্যাসিড সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার জন্য খ্যাতি লাভ করেন। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘোষ ট্রাভেলিং ফেলোশিপ নিয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হয়ে বিদেশে যান। সুইজারল্যান্ডের বার্নে এবং অস্ট্রিয়ার গ্রাজে বিখ্যাত অধ্যাপকদের গবেষণারে কাজ করে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে দেশে ফিরে আসেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি Chemische Analyse নামের একটা রসায়নের প্রামাণিক গ্রন্থের সহযোগী সম্পাদক নিযুক্ত হন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের খয়রা অধ্যাপক এবং রসায়ন বিভাগে পালিত নিযুক্ত হয়ে অবসর গ্রহণ করেন।[১]

বৈজ্ঞানিক গবেষণা[সম্পাদনা]

অজৈব রসায়নে তার গবেষণা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে রুবিয়ানিক অ্যাসিড সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। জটিল যৌগ নিয়ে, বিশেষকরে জটিল যৌগের গঠন নির্ণয়ে চৌম্বিক ধর্মের প্রয়োগ সংক্রান্ত গবেষণা বিশেষ উল্লেখযোগ্য। অজৈব রসায়নে তার যথেষ্ট পাণ্ডিত্য ছিল। তার শিক্ষক আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এ বিষয়ে মন্তব্যে বলেন-

"প্রিয়দারঞ্জন রায়কে কমপ্লেক্স ও ভ্যালেন্সি এবং মাইক্রোকেমিস্ট্রি বিষয়েও এক স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। কেমিক্যাল সোসাইটিতে কোন লেখা পাঠানোর আগে আমার অভ্যাস হল, আগে তাকে দেখিয়ে তার সমালোচনা ও মতামত গ্রহণ করা। ১৯২৬ এবং ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির বার্ষিক সভার জন্য আমার সভাপতির ভাষণ মোটামুটি তার অভিমত ও পরামর্শে তৈরি হয়।"

[২]

অবসরের পর তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্সের অবৈতনিক অধ্যাপক ও পরে ড.মেঘনাদ সাহার মৃত্যুর পর প্রতিষ্ঠানের ডিরেক্টর হয়ে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে পর্যন্ত ওই পদে ছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স বর্তমানে ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য এবং ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটির সভাপতি ও ১৯৫৮-৫৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন। [১] পদার্থবিজ্ঞান, শারীরবিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তার যথেষ্ট পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি প্রাচীন ভারতে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ক গ্রন্থের সম্পাদনা করেছেন। ইংরাজী ও বাংলা উভয় ভাষাতেই স্বাচ্ছন্দ্যে ছিলেন। তার জনপ্রিয় গ্রন্থ হল - অতিকায় অণুর বিচিত্র কাহিনী। সংস্কৃত সাহিত্য ও দর্শনে তার গভীর আগ্রহ ছিল। সমাজকল্যাণমূলক ও পল্লি উন্নয়নের কাজেও আত্মনিয়োগ করেছিলেন।

জীবনাবসান[সম্পাদনা]

রসায়নের খ্যাতনামা অধ্যাপক জীবনের শেষ দিকে দৃষ্টিহীন, বাকহীন হয়ে বেশ কয়েকমাস নিঃসঙ্গ অবস্থায় অথচ যেন প্রসন্নতায় কাটিয়েছেন। কিন্তু ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দের ১১ই ডিসেম্বর সকালবেলা চিরনিদ্রায় চলে যান।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, দ্বিতীয় খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, জানুয়ারি ২০১৯, পৃষ্ঠা ৪৩৩, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-২৯২-৬
  2. >BM11_8601.pdf "Priyadarajan Ray (1888-1992) (ইংরাজীতে)" (পিডিএফ)। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০১-১৯