দিনাজপুর জমিদারি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

দিনাজপুর জমিদারি উৎপত্তি সম্পর্কে ঐতিহাসিকরা আজও কোন সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। প্রচলিত কিংবদন্তি অনুযায়ী জনৈক দিনাজ অথবা দিনারাজ নামের ব্যক্তি দিনাজপুর রাজ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা এবং তার নামানুসারেই রাজবাড়ীতে অবস্থিত মৌজার নাম হয় দিনাজপুর। যখন মুর্শিদকুলি খান কর্তৃক সুবা বাংলায় জমিদারী ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয়, সে সময় তিনি দিনাজপুরের জমিদার হিসাবে জমিদারী সনদ প্রাপ্ত হন। পরবর্তীকালে বৃটিশ শাসনামলে ঘোড়াঘাট সরকার বাতিল করে বৃটিশরা নতুন জেলা গঠন করে এবং রাজার সম্মানে এ জেলার নামকরণ করে দিনাজপুর।[১]

ইতিহাস[সম্পাদনা]

মুগল সম্রাট আকবর-এর শাসনামলে ব্রহ্মচারী ও মোহন্ত হিসেবে পরিচিত কাশী ঠাকুর নামক একজন সন্ন্যাসী দিনাজপুর ও মালদা জেলায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিকারী হন। কাশী ঠাকুর নিজেকে রাজা গণেশ-এর বংশোদ্ভূত বলে দাবি করতেন। জানা যায়, তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি তাঁরই প্রিয়ভাজন কায়স্থ শিষ্য শ্রীমন্ত দত্ত চৌধুরীকে উইল করে দিয়ে যান। পরবর্তীকালে এ সম্পত্তি শ্রীমন্তের দৌহিত্র সুখদেব উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করেন। সুখদেব রংপুর, বগুঁড়া ও মালদা, দিনাজপুর এবং বগুঁড়ায় প্রতিষ্ঠিত জমিদারির উত্তরাধিকারী হয়েছিলেন। তিনি এ জমিদারি দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও-এর অন্তর্ভুক্ত ঘোড়াঘাট, নবাবপুর, ক্ষেতলাল, শিবগঞ্জ, পাঁচবিবি, বদলগাছিআদমদীঘি থানায় সম্প্রসারণ করেন।[১]

বিশাল এ জমিদারির বিবেচনায় সম্রাট আওরঙ্গজেব ১৬৭৭ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূুষিত করেন। ১৬৮২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র প্রাণনাথ উত্তরসূরি হিসেবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। তিনিই ছিলেন পরিবারের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ক্ষমতাবান ব্যক্তি।

দেওয়ানি শাসনামলের শুরুতে দিনাজপুর জেলার আয়তন খুব বড় ছিল না বলে মীর কাশিমের আমলে জমিদারদের চাপের মুখে থাকতে হতো। নবাবি আমল বিলুপ্তির পর দেওয়ানি শাসনামলে দিনাজপুরের রাজা তার জমিদারীর আয়তন বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট হন। যারফলে পার্শ্ববর্তী বিচ্ছিন্ন কিছু কিছু অঞ্চল এ জমিদারের অর্ন্তভূক্ত হয়। জেমস্ রেনেলের বিবরণ অনুযায়ী ১৭৮৪ খ্রিষ্টাব্দে দিনাজপুরের আয়তন ছিল ৩,৫১৯ বর্গমাইল। রেনেলের বিবরণের পর বুকানন হ্যামিল্টনের বিবরণে জানা যায় যে, দিনাজপুরের আয়তন ক্রমশই বৃদ্ধি পেয়েছিল যা ওয়াল্টার হ্যামিল্টনের মন্তব্যে জানা যায়। স্থায়ী বন্দোবস্ত করা কালে দিনাজপুরের আয়তন ক্রমশই বৃদ্ধি হতে থাকে। ইদ্রকপুর জেলার প্রায় সমগ্র জেলা, শিলবাড়ী বা শালবাড়ী জেলার কিছু অংশ এবং মালদহ জেলার অধিকাংশ দিনাজপুরের অন্তর্ভুক্ত হয়। বুকানন হ্যামিল্টনের জরিপ অনুযায়ী আয়তনের পরিমাণ ছিল ৫,৩৭৪ বর্গমাইল।[২]

১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করার সময় দিনাজপুর জমিদারি বাংলার সবচেয়ে বড় জমিদারিগুলোর একটি ছিল। দিনাজপুর জমিদারি এ সময় তৃতীয় বৃহত্তম জমিদারি ছিল। এ জমিদারির অনুমিত রাজস্বের পরিমাণ ছিল ১৪,৮৪,০০০ সিক্কা রুপি। বর্ধমান ও রাজশাহীর জমিদারির পরেই এর অবস্থান ছিল।

জমিদারির পতন[সম্পাদনা]

চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত বাস্তবায়নের দশ বছরের মধ্যে দিনাজপুর জমিদারিসহ বাংলার সব কয়টি বড় জমিদারির চূড়ান্ত পতন ঘটে। ১৭৯৮ সালের ভয়াবহ খরা, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ফকির-সন্ন্যাসীদের বিদ্রোহ ইত্যাদি কারণে যথাসময়ে রাজস্ব জমা দিতে না পারায় জমিদারির জমি বিক্রি শুরু হয়, এবং এর পরের পনেরো মাসের মধ্যে প্রায় পুরো দিনাজপুর জমিদারি নিলামে ওঠে। কোম্পানির কালেক্টরেট কর্মকর্তাদের সঙ্গে জমিদারদের দ্বন্দ্বও এ জমিদারির পতনের অন্য একটি কারণ ছিল। রায়ত বা কৃষকরা খাজনা পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন, ফলে জমিদাররাও তাদের রাজস্ব সময়মতো পরিশোধ করতে পারেননি। এ রাজস্ব আদায়ে সরকার নিলামের মাধ্যমে জমিদারি বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে। রাজা রাধানাথের জমিদারি আমলে দিনাজপুর জমিদারি নিলামে উঠে।

১৮০০ সালের পর দিনাজপুর জমিদারি টিকে থাকলেও তা ছিল পূর্বতন আমলের জমিদারির ছায়ামাত্র। ১৮৯৭ সালে ভয়াবহ ভূমিকম্পে কান্তজী মন্দিরজমিদারবাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরবর্তীকালে মহারাজা গিরিজানাথ রায়বাহাদুরকে এর সংস্কার করতে হয়েছিল। পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০[৩] অনুসারে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করা হলে তাঁর পালক পুত্র জগদীশনাথের আমলে এ জমিদারির বিলুপ্তি ঘটে। ১৯৬২ সালে কলকাতায় জগদীশনাথ-এর মৃত্যু হয়।

ঐতিহাসিক নিদর্শন[সম্পাদনা]

কান্তজির মন্দির
  • কান্তজির মন্দির : প্রাণনাথ ১৭২২ সালে পোড়ামাটির অলংকরণ সমৃদ্ধ অসাধারণ কান্তজির মন্দিরটির (নব-রত্ন মন্দির) নির্মাণকাজ শুরু করেন। তবে তিনি তাঁর জীবদ্দশায় এ মন্দিরের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করে যেতে পারেননি। মন্দিরটি নির্মাণে প্রায় ত্রিশ বছর সময় লাগে এবং ১৭৫২ সালে তাঁরই মতো ক্ষমতাবান ও যোগ্য উত্তরসূরি তাঁর পালক পুত্র রামনাথ এটির নির্মান কাজ সম্পন্ন করেন।
  • দিনাজপুর রাজবাড়ি : দিনাজপুর রাজবাড়ি রাজা দিনাজ স্থাপন করেন। কিন্তু অনেকের মতামত পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে ইলিয়াস শাহীর শাসনামলে সুপরিচিত “রাজা গণেশ” এই বাড়ির স্থপতি।
  • রামসাগর দীঘি : দিনাজপুরের বিখ্যাত রাজা রামনাথ (রাজত্বকাল: ১৭২২-১৭৬০ খ্রিষ্টাব্দ) পলাশীর যুদ্ধের আগে (১৭৫০-১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে) এই রামসাগর দিঘি খনন করেন। তারই নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় রামসাগর

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "দিনাজপুর জমিদারি"বাংলাপিডিয়া। ৫ মে ২০১৪। ২৪ জুন ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ এপ্রিল ২০২০ 
  2. "হামার দিনাজপুরের হিস্টোরী"এনজিও পোর্টাল। ৩ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ এপ্রিল ২০২০ 
  3. "পূর্ববঙ্গ জমিদারি অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০"বাংলাপিডিয়া। ৮ এপ্রিল ২০১৫। ১৯ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ এপ্রিল ২০২০ 

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

গ্রন্থপঞ্জি[সম্পাদনা]

  • কে.ডব্লিউ. স্ট্রং, EB District Gazetteer, Dinajpur, এলাহাবাদ, ১৯১২;
  • জর্জ মিশেল (সম্পাদনা), Brick Temples of Bengal, নিউ জার্সি, ১৯৮৩;
  • নাজিমউদ্দি আহমেদ, Building of the British Raj in Bangladesh, ঢাকা, ১৯৮৬।

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]