আভাসকুমার চট্টোপাধ্যায়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আভাস কুমার চট্টোপাধ্যায়
জন্ম(১৯৪২-০১-২১)২১ জানুয়ারি ১৯৪২
মৃত্যু১৪ ডিসেম্বর ২০০২(2002-12-14) (বয়স ৬০)
জাতীয়তাভারতীয়
নাগরিকত্বভারতীয় ভারত
দাম্পত্য সঙ্গীমিলিসেন্ট চ্যাটার্জী
সন্তানপথিকৃত চ্যাটার্জী (পুত্র)

আভাসকুমার চট্টোপাধ্যায় বা 'আভাসকুমার চ্যাটার্জী' বা 'আভাস চ্যাটার্জী' (২১ জানুয়ারি ১৯৪২ – ১৪ ডিসেম্বর ২০০২), ছিলেন একজন ভারতীয় বাঙালি বেসামরিক পদাধিকারী, বুদ্ধিজীবী, লেখক এবং সমাজসেবক। কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে তদানীন্তন বিহার সরকারের প্রশাসনে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্রুসেডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, কিন্তু শেষে গুন্ডামির দুষ্ট কৌশল সহ্য করতে না পেরে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে পদত্যাগ করেন। জীবনের বাকি সময় আদিবাসীদের মাঝে সমাজসেবায় অতিবাহিত করেন।[১][২]

জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন[সম্পাদনা]

আভাসকুমার চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ২১ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের অধুনা বিহার রাজ্যের পূর্ণিয়ায়। ছোটবেলা থেকেই আভাস অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। স্কুল-কলেজের সমস্ত পরীক্ষার প্রথম হতেন। পূর্ণিয়ার এক স্কুল হতে, বিহার স্কুল বোর্ডের পরীক্ষায় ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম হন। ভরতি হন পাটনা কলেজে। এখানেও আইএ ও বিএ পরীক্ষায় প্রথম হন। এরপর ভর্তি হন দিল্লি স্কুল অফ ইকোনমিক্সে। এখানে তার সহপাঠী ছিলেন খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও সাংবাদিক অরুণ শৌরি। অর্থনীতিতে এম.এ পরীক্ষাতেও আভাস প্রথম হন। এরপর – সর্বভারতীয় প্রশাসনিক পরিষেবা তথা 'ইন্ডিয়ান অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস'-এর পরীক্ষায় ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ব্যাচেও প্রথম হন।

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

আভাসকুমার চট্টোপাধ্যায় আইএএস হওয়ার পর বিহার ক্যাডারে যোগ দেন। কর্মজীবন শুরু হয় বিহারের জেলাশাসক পদমর্যাদার আধিকারিক হিসাবে। কর্মক্ষেত্রে তিনি ব্যতিক্রমী যোগ্যতা, মেধা, সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার জন্য সুনাম অর্জন করেন। কিন্ত প্রতি পদে পদে শুরু হয়ে যায় সংঘাত। আপাদমস্তক দুর্নীতিতে ভরা বিহারের প্রশাসনে কোন কিছুর সঙ্গে আপোষ না করে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ক্রুসেডার বা মূর্তিমান ভগীরথ হিসাবেই অবতীর্ণ হলেন। জগন্নাথ মিশ্রের নেতৃত্বের বিহার সরকার তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে, আভাস সহ অন্য দশজন আমলাকে লোভনীয় সুপারটাইম পে স্কেলে কমিশনার পদে উন্নীত করতে চাইলেন। যে কোন সরকারী কর্মচারীর কাছে এই পদের স্কেল অত্যন্ত লোভনীয় এবং যা কিনা জয়েন্ট সেক্রেটারি পদমর্যাদার আমলারাই পেয়ে থাকেন। আভাসকুমারের বয়স তখন সাঁইত্রিশ বৎসর এবং ষোল বৎসর চাকরি হয়েছে। তা সত্ত্বেও,তিনি গ্রহণই করলেন না বরং লিখলেন-

"Let me spend the rest of my service career with the Government in my present grade and earn my bread without adding to my sense of mortification."

দুই মাসের মধ্যেই তাকে বদলি করা হল অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য সরকার অধীনস্থ বিহার রাজ্য পরিবহণ নিগমের জেনারেল ম্যানেজার পদে। ক্রমাগত লোকসানে চলা রুগ্ন সংস্থাটির হাল ধরতে গিয়ে লক্ষ্য করেন সর্বত্রই অনিয়ম আর দুর্নীতি। বিনা টেন্ডার প্রক্রিয়ায় কেনাকাটা, কর্মীনিয়োগে অস্বচ্ছতা প্রশাসনের সর্বত্রই বিরাজমান। শক্ত হাতে এসব বন্ধ করায়, দুই বৎসরের মধ্যে তারই আমলে লাভজনক অবস্থায় আসে সংস্থাটি। কিন্ত বিরোধ বেঁধে যায় সংস্থার সংশ্লিষ্ট চেয়ারম্যান ও বিধায়কের সঙ্গে। লাগাতার বিক্ষোভ আর শ্রমিক অশান্তি সৃষ্টি করে আভাসকে হেনস্থার শিকার হতে হল। তিনি নিরুপায় হয়ে পত্র-পত্রিকায় ফাঁস করেন ব্যাপারটি, গড়াল 'পাবলিক এন্টারপ্রাইজেস ব্যুরো'পর্যন্ত। তদানীন্তন মুখ্যসচিব পি পি নায়ারের তদন্তে কিন্তু আভাসকুমার অমলিনই রইলেন।

পরবর্তীতে যখন তিনি পাটনায় বিভাগীয় সচিব পদে ছিলেন, লালুপ্রসাদ যাদবের নেতৃত্বে বিহার সরকার ক্ষমতাসীন হয়। প্রশাসনিক কাজে আমলাদের উত্যক্ত করার বিরুদ্ধে, স্বজনপোষণ ও সীমাহীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। রাজনৈতিক মদতে গুন্ডামির সামনে তার মত সৎ ও ন্যায়নিষ্ঠ আমলাকে, প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে বেশ কিছু পদোন্নতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে তিনি লালুপ্রসাদের সঙ্গে কয়েকজন জেলাশাসকেরও প্রত্যক্ষ ভূমিকার কথা ফাঁস করে দেন। ফলে ঘরে ও বাইরের প্রচন্ড চাপে সহজ, সরল ও নম্র স্বভাবের আমলা পদত্যাগ করেন ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে মাত্র ৪৯ বৎসর বয়সে। তবে পদত্যাগ পত্রে সেদিনের ভারতীয় রাজনীতি নিয়ে অনবদ্য ভাষায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন–

(ইংরেজি)

«The powers that be in Indian politics are least bothered about nation building. They have little concern about what happens to this country in future, where this nation lands up in the end. Behind the smoke screen of slogans and rhetoric, what has been going on in this country is not grand ceremony of nation building, but a macabre dance of nation destruction [২]»

(বাংলা)

«ভারতীয় রাজনীতিতে যে শক্তিগুলো আছে তারা জাতি গঠন নিয়ে কমই চিন্তিত। ভবিষ্যতে এই দেশের কী ঘটবে, শেষ পর্যন্ত এই জাতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে তাদের সামান্য উদ্বেগ নেই। স্লোগান আর বাকবিতণ্ডার ধোঁয়াটে পর্দার আড়ালে এদেশে যা চলছে তা জাতি গঠনের কোনো জাঁকজমক পূর্ণ বিশাল অনুষ্ঠান নয়, দেশ ধ্বংসের নৃশংস নৃত্য।»

"

রাম জন্মভূমি আন্দোলনের সময়, তিনি বিতর্কিতভাবে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দের ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় কর সেবায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিছু সময়ের জন্য তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের শাখা সংগঠন 'বনবাসী কল্যাণ সংঘ'-এর সংস্পর্শে ছিলেন, কিন্তু হিন্দুধর্মের উপর সংঘ পরিবারের অস্পষ্টতার জন্য তিনি তাদের একজন স্পষ্টবাদী সমালোচক হন। ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে, তিনি পূর্বাচল কল্যাণ আশ্রমের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতার মহাজাতি সদনে একটি বক্তৃতা দেন, যেখানে তিনি হিন্দু জাতীয়তার ধারণার রূপরেখা তুলে ধরেন । বক্তৃতাটি পরে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে "ভয়েস অফ ইন্ডিয়া"র "দ্য কনসেপ্ট অফ হিন্দু নেশন" নামে একটি বইতে সংকলিত হয়েছিল। [৩] আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৮৫৯৯-০৩৩-০ হিন্দি ভাষায় - "হিন্দুরাষ্ট্র কী অবধারণা" শিরোনামে প্রকাশিত হয়।

সমাজসেবা[সম্পাদনা]

সত্তরের দশকের শেষের দিকে, তিনি রাঁচির কাছে জিপসুদি গ্রামে মুন্ডা সমাজের অন্তঃবিবাহী তাঁতি গোষ্ঠী সাওয়ানসিসের সংস্পর্শে আসেন। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে বেসামরিক পরিষেবা থেকে অবসর নেওয়ার পর, আভাস নিজেকে ওই সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত করেন এবং তাঁতি সমাজের তাদের তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে কাজ করেন। তিনি রামকৃষ্ণ মিশন এবং ভারত সেবাশ্রম সংঘ ইত্যাদি দাতব্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন।

ব্যক্তিগত জীবন[সম্পাদনা]

আভাস চ্যাটার্জী ব্রাহ্মণ সন্তান হয়ে খ্রিস্ট ধর্মে বিশ্বাস রাখতেন, বিবাহ করেন ওরাওঁ উপজাতির এক আদিবাসী মহিলা মিলিসেন্টকে। তাদের একমাত্র পুত্র পথিকৃত কলেজ ভ্রমণে গিয়ে দামোদর নদে স্নানের সময়ে এক দুর্ঘটনায় মারা যায় ।

জীবনাবসান[সম্পাদনা]

আদিবাসী সম্প্রদায়ের সঙ্গে বসবাসকালে সেই অঞ্চলের ম্যালেরিয়া নির্মূল করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হন এবং চিকিৎসার জন্য নতুন দিল্লির এইমস্-এ ভর্তি হন। কিন্ত তিনি ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Love for service before self (ইংরাজীতে)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-০৮ 
  2. "Humiliated and Broken"। Archived from the original on ২০১০-০৬-১৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-০৯ 
  3. "The concept of Hindu Nation"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৬-০৯