অণুজীববিজ্ঞান

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(অণুজীব বিজ্ঞান থেকে পুনর্নির্দেশিত)
ছত্রাক, শেওলা, জীবাণু এবং ভাইরাসের চিত্রাবলী দ্বারা বেষ্টিত একটি মাইক্রোস্কোপ দেখা যাচ্ছে চিত্রটিতে।

অণুজীববিজ্ঞান (ইংরেজি: Microbiology) হল জীববিজ্ঞানের একটি শাখা যেখানে অণুজীব নিয়ে আলোচনা করা হয়।[১] অণুজীববিজ্ঞানের আলোচনার মধ্যে ভাইরাস বিজ্ঞান, ছত্রাক বিজ্ঞান, পরজীবী বিজ্ঞান, ব্যাকটেরিয়া বিজ্ঞান, অনাক্রম্য বিজ্ঞান, ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। অণুজীববিজ্ঞানের এসব শাখায় অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিদেরকে অণুজীববিজ্ঞানী (Microbiologist) বলা হয়। অণুজীব মূলত তিন প্রকার: ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও অ্যামিবা।[২][৩][৪]

অণুজীব[সম্পাদনা]

বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া

ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক, শৈবাল, প্রোটোজোয়া, আর্কিয়া, ইত্যাদি জীব অণুজীবের অন্তর্গত (যদিও বহুকোষী ছত্রাকশৈবাল-ও পাওয়া যায়)। এরা হয় প্রাক-কেন্দ্রিক না হয় সু-কেন্দ্রিক।

অণুজীববিজ্ঞানী[সম্পাদনা]

লুই পাস্তুর

১৬৭৬ সালে ব্রিটিশ শৌখিন বিজ্ঞানী অ্যান্থনি ভন লিউয়েনহুক সর্বপ্রথম অণুজীব আবিষ্কার করেন। যে সকল বিজ্ঞানী অণুজীববিজ্ঞানকে আধুনিক বিজ্ঞানের এক সম্ভাবনীয় শাখা হিসেবে গড়ে তুলেছেন তাদের মধ্যে লুই পাস্তুর, রবার্ট কখ, অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং, সারগেই উইনুগার্ডস্কি, মারটিনাস বেইজারিঙ্কের অবদান অন্যতম।

আলোচ্য বিষয়[সম্পাদনা]

অণুজীববিজ্ঞান অণুজীবের কোষীয় গঠন, শারীরতত্ত্ব (Metabolism), বংশগতি (Genetics), বৃদ্ধি(Growth), বাস্তুসংস্থান (Ecology), বিবর্তন (Evolution)ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করে। তাছাড়া যেহেতু কিছু অণুজীব (জীবাণু) ও অন্যান্যপশু পাখির বিভিন্ন সংক্রামক রোগ ঘটাতে পারে, ফলে এই সব রোগ, সেই সাথে এদের প্রতিরোধ ও প্রতিকারও অণুজীব বিজ্ঞানে আলোচ্য বিষয়। সেই সাথে আমাদের শরীর কীভাবে এই সব জীবাণুর সাথে লড়াই করে তা মূলত অণুজীব বিজ্ঞানেরই আর এক শাখা ইমিউনলজি(immunology) তে আলোচনা করা হয়। জীবনরক্ষাকারী ঔষধ অ্যান্টিবায়োটিক (Antibiotic) অণুজীব বিজ্ঞানের এক বিশাল আবিষ্কার। অ্যান্টিবায়োটিক হল এমন সব পদার্থ যা কিনা একধরনের অণুজীব তৈরি করে এবং তা অন্য অণুজীবের বিপক্ষে কাজ করে। রোগ প্রতিরোধকারী নানা ভ্যাক্সিন ও রোগ প্রতিকারকারী বিভিন্ন ঔষধের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান স্টেরয়েড অণুজীব হতে পাওয়া যায়।

পরিবেশ অণুজীব বিজ্ঞান[সম্পাদনা]

অণুজীব বিজ্ঞানের যে শাখায় পরিবেশ ও অণুজীবের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে অণুজীব বাস্তুবিজ্ঞান (Microbial Ecology) বলা হয়। এই শাখায় অণুজীবের সাথে অণুজীবের; অণুজীবের সাথে অন্যান্য জীবের এবং অণুজীবের সাথে পরিবেশের অজীব (abiotic) উপাদানের সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা হয়। তিনটি প্রধান ডোমেইন যা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ-ইউক্যারিওটা, আরকিয়া ও ব্যাকটেরিয়া। অণুজীব তাদের সর্বব্যাপী উপস্থিতির কারণে জীবসীমায় (biosphere) গুরুত্বপূর্ণ। অণুজীব জীব-ভূতত্ত্বীয় (biogeochemical) নানা প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক ভূমিকা পালন করে।

ফলিত অণুজীব বিজ্ঞান[সম্পাদনা]

অণুজীব বিজ্ঞানের এই শাখায় অণুজীবে বিভিন্ন ব্যবহারিক প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করা হয়।

অণুজীব ও খাদ্য[সম্পাদনা]

পনির

অণুজীব বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে ফলিত অণুজীববিজ্ঞান (Applied Microbiology)। বিভিন্ন রকম খাদ্য প্রস্তুতি (Preparation) ও প্রক্রিয়াজাতকরণের (Processing) কারণে অণুজীববিজ্ঞান অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এক বিষয়। দুধ হতে প্রস্তুতকৃত বিভিন্ন খাদ্য যেমন দই, পনির, ছানা ইত্যাদি মূলত দুধের শর্করার ওপর অণুজীবের গাঁজন (fermentation) প্রক্রিয়ার ফসল। তাছাড়া যেহেতু অনেক খাবার অণুজীবের বিপাক ক্রিয়ার (Metabolism) দরুন নষ্ট হতে পারে ফলে এগুলোর প্রক্রিয়াজাত করণে অণুজীব বিজ্ঞানের জ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন খাদ্যমান স্বাদকারক উপাদান যেমন টেস্টিং সল্ট এই জৈবিক পদ্ধতিতে উৎপাদন করা হয়। বিভিন্ন দেশে (যেমন জাপান, ইন্দোনেশিয়া, চীন, ভারত ইত্যাদি) অনেক অণুজীবকে খাদ্য হিসেবেও ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের বিসিএসআইআর-এর বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশের আবহাওয়ায় সারা বছর উৎপাদনক্ষম শৈবাল স্পিরুলিনা (Spirulina) আবিষ্কার করেছেন, যা খাদ্য হিসেবে শুধু সুস্বাদুই নয়, সেই সাথে পুষ্টিকরও বটে।

অণুজীব ও জৈবপ্রযুক্তি[সম্পাদনা]

চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ, কাগজের মন্ড প্রস্তুতি, কাপড় উৎপাদন ইত্যাদি শিল্পে অণুজীবের ঊৎসেচক (enzyme) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে এই সব শিল্প-কারখানায় অণুজীব বিজ্ঞানীর উপস্থিতি অপরিহার্য। তাছাড়া বিভিন্ন বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক পদার্থ যেমন এসিটিক এসিড (Acetic acid) , সাইট্রিক এসিড (Citric acid), এলকোহল(Alcohol), এসিটোন (Acetone), বিউটানল (Butanol), ফিউমারিক এসিড(Fumaric acid), ইত্যাদি জৈবিক পদ্ধতিতে উৎপাদন, রাসায়নিক পদ্ধতিতে উৎপাদন অপেক্ষা সাশ্রয়ী। আর এই জৈবিক কাজটি করে দেয় অণুজীব। জীবনরক্ষাকারী ঔষধ অ্যান্টিবায়োটিক (Antibiotic)অণুজীব বিজ্ঞানের এক বিশাল আবিষ্কার। অ্যান্টিবায়োটিক হল এমন সব পদার্থ যা কিনা একধরনের অণুজীব তৈরি করে এবং তা অন্য অণুজীবের বিপক্ষে কাজ করে।

অণুজীব ও পরিবেশ দুষণ[সম্পাদনা]

আমাদের এই আধুনিক দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের এক অভিশাপ হচ্ছে দূষণ। এটা থেকে পরিত্রাণের অন্যতম পথ হল অণুজীব। কিছু পদার্থ (যা বিগত কয়েক শতকে আমরা পৃথিবীতে আবির্ভাব ঘটিয়েছি, যেমনঃ প্লাস্টিক, ডিডিটি ইত্যাদি) ছাড়া আর সব পদার্থই কোনও না কোনও অণুজীব তার খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। অবশেষে সে যা নিসৃত করে তা হয় পরিবেশ-বান্ধব (Environment friendly) অথবা সেই সাথে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। আজকাল অনেক দেশে বিভিন্ন কীট-পতঙ্গ থেকে ফসলকে রক্ষা করতে অণুজীব ব্যবহৃত হচ্ছে।

অণুজীব ও জ্বালানি[সম্পাদনা]

অণুজীবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন হল জৈব জ্বালানি (biofuel)। কিছু কিছু অণুজীব মিথেন (Methane) গ্যাস উৎপাদন করতে পারে। বাংলাদেশে যে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যায় তার প্রায় ৯৬% হল মিথেন, অন্যদিকে অণুজীব কর্তৃক উৎপাদিত জৈবগ্যাসে মিথেনের পরিমাণ প্রায় ৬০-৭০%। জৈব ডিজেল (Biodiesel) দ্বারা এখন ব্রাজিলে গাড়ি চালানো সম্ভব হয়েছে। আসলে জৈব ডিজেল হল অ্যালকোহল (মূলত মিথানল), উদ্ভিদ তেল, প্রাণিজ তেলের মিশ্রণ। অ্যালকোহল শিল্প-কারখানায় শর্করার হতে গাঁজন প্রক্রিয়ায় অণুজীবের সাহায্যে তৈরি করা হয়।

অণুজীব ও খনিজ পদার্থ[সম্পাদনা]

খনি থেকে বিভিন্ন খনিজ পদার্থ উত্তোলনের নানা পর্যায়ে অণুজীবের গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে। মাটির নিচে খনিজ তেলের উপস্থিতি ঐ স্থানে পেট্রোলিয়াম ভক্ষণকারী ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি থেকে জানা যায়। অন্যান্য খনিজ পদার্থ যেমন সালফারের উত্তোলনে সালফার জারক (Sulfate oxidizer) ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়।

অণুজীব ও কৃষি[সম্পাদনা]

জৈবসারও আসলে অণুজীবের কার্যাবলীর ফসল। জৈবসার হিসেবে মাটিতে নাইট্রোজেন সংবন্ধনকারী ব্যাকটেরিয়া (যেমনঃ Rhizobium, Azorihobium, Azotobacter) ব্যবহার করা হয় যা মাটিতে প্রয়োজন মতো নাইট্রোজেন সংবন্ধন করে। তবে আমাদের দেশে ব্যবহৃত গোবরও জৈবসার বলে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে সার তৈরির প্রধান কাঁচামাল গ্যাস শেষ হয়ে গেলে, আমাদের জন্য জৈবসার ব্যবহার করা অনেক লাভজনক হবে। তাছাড়া জৈবসার পরিবেশের উপর কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে না।

অণুজীববিজ্ঞান ও বংশাণু প্রকৌশল[সম্পাদনা]

অণুজীবের সবচাইতে আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হল এদের অনেক বৈশিষ্ট্য বংশাণুগত পুনঃসংযোজন (জেনেটিক রিকম্বিনেশন, Genetic Recombination) দ্বারা পরিবর্তন, পরিবর্ধন করা যায়। ডায়াবেটিক রোগীর এক অত্যাবশকীয় ঔষধ ইনসুলিন (Insulin) এখন বাণিজ্যিকভাবে প্রস্তুত করা যাচ্ছে কারণ মানুষের ইনসুলিন সংশ্লেষণকারী বংশাণু (Gene) আমাদের অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়া ইসচেরিচিয়া কোলাইয়ের (Escherichia coli) বংশাণুতে প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়েছে। শিল্প ক্ষেত্রে এখন এই পুনঃসংযোজক ব্যাকটেয়া থেকেই ব্যাপক পরিমাণে ও সস্তায় ইনসুলিন প্রস্তুত করা হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Madigan M, Martinko J (editors) (২০০৬)। Brock Biology of Microorganisms (13th সংস্করণ)। Pearson Education। পৃষ্ঠা 1096। আইএসবিএন 0-321-73551-X 
  2. Penn, M; Dworkin, M (১৯৭৬)। "Casey Harmonh and two visions of microbiology"Bacteriological reviews40 (2): 276–83। পিএমআইডি 786252পিএমসি 413958অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  3. Symbiosis : An Introduction to Biological Associations: An Introduction to Biological Associations (2nd সংস্করণ)। New York: Oxford University Press। ২০০০। পৃষ্ঠা 10। আইএসবিএন 9780198027881। সংগ্রহের তারিখ ২০১৬-০৩-২৫ 
  4. Smith, KA (২০০২)। "Medical immunology: A new journal for a new subspecialty"Medical immunology (London, England)1 (1): 1। ডিওআই:10.1186/1476-9433-1-1পিএমআইডি 12437786পিএমসি 131025অবাধে প্রবেশযোগ্য 

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]