বিষয়বস্তুতে চলুন

জাদু (মায়াবিদ্যা): সংশোধিত সংস্করণের মধ্যে পার্থক্য

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বিষয়বস্তু বিয়োগ হয়েছে বিষয়বস্তু যোগ হয়েছে
Tanzina Afrin (আলোচনা | অবদান)
"Magic (supernatural)" পাতাটি অনুবাদ করে তৈরি করা হয়েছে
সম্পাদনা সারাংশ নেই
ট্যাগ: দৃশ্যমান সম্পাদনা মোবাইল সম্পাদনা মোবাইল ওয়েব সম্পাদনা উচ্চতর মোবাইল সম্পাদনা
৬৮ নং লাইন: ৬৮ নং লাইন:
''হালাখা''-য় (ইহুদি ধর্মীয় আইন) ভবিষ্যদ্বাণী এবং অন্যান্য ভবিষ্যৎকথনকে নিষিদ্ধ, এবং [[তালমুদ|তালমুদে]] বহু অটল কিন্তু নিন্দনীয় ঐশ্বরিক অনুষ্ঠানের তালিকা আছে।<sup>[৪০]</sup> ঐতিহাসিক ইহুদিধর্মে [[ব্যবহারিক কাব্বালাহ]] হচ্ছে জাদুর ব্যবহার সম্পর্কিত [[ইহুদী অতীন্ত্রবাদ প্রথা]]<nowiki/>র একটি শাখা। এর চর্চাকারীরা মনে করতেন এটি অভিজাতরা যারা এর আধ্যাত্মিক উৎসকে অশুভ রাজত্বের কিলফোথ থেকে আলাদা করতে পারেন যদি তা [[পবিত্র]] ([[:en:Q-D-Š|Q-D-Š]]) এবং [[বিশুদ্ধ]] (טומאה וטהרה, ''tvmh vthrh )''<sup>[৪১]</sup> পরিস্থিতিতে পালন করা হয়, তাদের জন্যে সংরক্ষিত অনুমোদিত [[শ্বেত জাদু]]। ইহুদীবাদের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞাকে লঙ্ঘন করার উদ্বেগ একে ইহুদী ইতিহাসে একটি গৌণ প্রথা হিসেবে বিদ্যমান থাকা নিশ্চিত করেছে। এর শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত [[দৈবের]] ব্যবহার এবং [[তাবিজ]] আর [[মন্ত্রের]] দেবদূতসুলভ নাম।<sup>[৪২]</sup> ইহুদী লোক ধর্মের এইসব জাদুর রীতি যা ব্যবহারিক কাব্বালাহের অংশে পরিণত হয় তার উৎপত্তি তালমুদিক যুগে।<sup>[৪২]</sup> আরোগ্যলাভের জাদুমন্ত্র, এবং ইহুদী যাজকদের অনুমোদিত জাদুর চিকিৎসার এক ব্যাপক তালিকার উল্লেখ তালমুদে আছে। এই নির্দেশ জারি ছিল যে চিকিৎসার জন্যে ব্যবহৃত হয় এমন কোন চর্চাকে কুসংস্কার বলে বিবেচিত হবে না এবং ইতিহাসের পরিক্রমায় বিভিন্ন স্থানে ইহুদী সম্প্রদায়গুলোতে ঔষধি তাবিজ এবং লোক চিকিৎসার (সেগুলট) ব্যাপক ব্যবহার ছিল।<sup>[৪৩]</sup>
''হালাখা''-য় (ইহুদি ধর্মীয় আইন) ভবিষ্যদ্বাণী এবং অন্যান্য ভবিষ্যৎকথনকে নিষিদ্ধ, এবং [[তালমুদ|তালমুদে]] বহু অটল কিন্তু নিন্দনীয় ঐশ্বরিক অনুষ্ঠানের তালিকা আছে।<sup>[৪০]</sup> ঐতিহাসিক ইহুদিধর্মে [[ব্যবহারিক কাব্বালাহ]] হচ্ছে জাদুর ব্যবহার সম্পর্কিত [[ইহুদী অতীন্ত্রবাদ প্রথা]]<nowiki/>র একটি শাখা। এর চর্চাকারীরা মনে করতেন এটি অভিজাতরা যারা এর আধ্যাত্মিক উৎসকে অশুভ রাজত্বের কিলফোথ থেকে আলাদা করতে পারেন যদি তা [[পবিত্র]] ([[:en:Q-D-Š|Q-D-Š]]) এবং [[বিশুদ্ধ]] (טומאה וטהרה, ''tvmh vthrh )''<sup>[৪১]</sup> পরিস্থিতিতে পালন করা হয়, তাদের জন্যে সংরক্ষিত অনুমোদিত [[শ্বেত জাদু]]। ইহুদীবাদের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞাকে লঙ্ঘন করার উদ্বেগ একে ইহুদী ইতিহাসে একটি গৌণ প্রথা হিসেবে বিদ্যমান থাকা নিশ্চিত করেছে। এর শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত [[দৈবের]] ব্যবহার এবং [[তাবিজ]] আর [[মন্ত্রের]] দেবদূতসুলভ নাম।<sup>[৪২]</sup> ইহুদী লোক ধর্মের এইসব জাদুর রীতি যা ব্যবহারিক কাব্বালাহের অংশে পরিণত হয় তার উৎপত্তি তালমুদিক যুগে।<sup>[৪২]</sup> আরোগ্যলাভের জাদুমন্ত্র, এবং ইহুদী যাজকদের অনুমোদিত জাদুর চিকিৎসার এক ব্যাপক তালিকার উল্লেখ তালমুদে আছে। এই নির্দেশ জারি ছিল যে চিকিৎসার জন্যে ব্যবহৃত হয় এমন কোন চর্চাকে কুসংস্কার বলে বিবেচিত হবে না এবং ইতিহাসের পরিক্রমায় বিভিন্ন স্থানে ইহুদী সম্প্রদায়গুলোতে ঔষধি তাবিজ এবং লোক চিকিৎসার (সেগুলট) ব্যাপক ব্যবহার ছিল।<sup>[৪৩]</sup>


যদিও [[ইহুদী বাইবেলে]]<nowiki/>র [[লেভিটিকাল আইনে]] জাদুবিদ্যা নিষিদ্ধ ছিল, [[দ্বিতীয় টেম্পল যুগে]]<nowiki/>র শেষের দিকে তার ব্যাপক চর্চা ছিল, এবং বিশেষত ৩য়, ৪ঠা, এবং ৫ম খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীতে টেম্পল ধ্বংসের পরবর্তী যুগে উত্তমরূপে নথিভুক্ত করা হয়েছিল।<sup>[৪৪][৪৫][৪৬]</sup>
যদিও [[হিব্রু বাইবেল|ইহুদী বাইবেলে]]<nowiki/>র [[লেভিটিকাল আইনে]] জাদুবিদ্যা নিষিদ্ধ ছিল, [[দ্বিতীয় টেম্পল যুগে]]<nowiki/>র শেষের দিকে তার ব্যাপক চর্চা ছিল, এবং বিশেষত ৩য়, ৪ঠা, এবং ৫ম খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীতে টেম্পল ধ্বংসের পরবর্তী যুগে উত্তমরূপে নথিভুক্ত করা হয়েছিল।<sup>[৪৪][৪৫][৪৬]</sup>


=== গ্রেকো-রোমান বিশ্ব ===
=== গ্রেকো-রোমান বিশ্ব ===
৭৯ নং লাইন: ৭৯ নং লাইন:
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে, ''ম্যাগোস'' সম্পর্কে গ্রীকদের ধারণাটি [[লাতিন ভাষা|ল্যাটিনে]] গৃহীত হয় এবং বেশ কিছুসংখ্যক [[প্রাচীন রোমান]] লেখকেরা একে ''ম্যাগুস'' এবং ''ম্যাগিয়া'' হিসেবে ব্যবহার করেন।<sup>[১৫]</sup> ল্যাটিন ভাষায় এ শব্দটির জ্ঞাত সবচেয়ে পুরনো ব্যবহার হচ্ছে [[ভার্জিলের]] ''[[একোলোগ]]''-এ, ৪০ খৃষ্টপূর্বাব্দের দিকে রচিত, যেখানে ''ম্যাজিকিস'' ... ''সিক্রিস'' (জাদুর রীতিনীতি)-এর উল্লেখ আছে।<sup>[৭৬]</sup> আধ্যাত্মিক শক্তির নেতিবাচক ব্যবহারের জন্যে রোমানরা ইতিমধ্যেই অন্যান্য শব্দ ব্যবহার করতেন, যেমন ''ভেনেফিকাস'' এবং ''সাগা''।<sup>[৭৬]</sup> রোমানরা গ্রীকদের মত একই অর্থে শব্দটিকে ব্যবহার করতেন, কিন্তু এর বিচারিক ব্যবহারের উপর অধিক গুরুত্ম দিতেন।<sup>[১৫]</sup> [[রোমান সাম্রাজ্য|রোমান সাম্রাজ্যে]], জাদুবিদ্যা হিসেবে পরিগণিত সবকিছুকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন জারি করা হয়।<sup>[৭৭]</sup>
খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে, ''ম্যাগোস'' সম্পর্কে গ্রীকদের ধারণাটি [[লাতিন ভাষা|ল্যাটিনে]] গৃহীত হয় এবং বেশ কিছুসংখ্যক [[প্রাচীন রোমান]] লেখকেরা একে ''ম্যাগুস'' এবং ''ম্যাগিয়া'' হিসেবে ব্যবহার করেন।<sup>[১৫]</sup> ল্যাটিন ভাষায় এ শব্দটির জ্ঞাত সবচেয়ে পুরনো ব্যবহার হচ্ছে [[ভার্জিলের]] ''[[একোলোগ]]''-এ, ৪০ খৃষ্টপূর্বাব্দের দিকে রচিত, যেখানে ''ম্যাজিকিস'' ... ''সিক্রিস'' (জাদুর রীতিনীতি)-এর উল্লেখ আছে।<sup>[৭৬]</sup> আধ্যাত্মিক শক্তির নেতিবাচক ব্যবহারের জন্যে রোমানরা ইতিমধ্যেই অন্যান্য শব্দ ব্যবহার করতেন, যেমন ''ভেনেফিকাস'' এবং ''সাগা''।<sup>[৭৬]</sup> রোমানরা গ্রীকদের মত একই অর্থে শব্দটিকে ব্যবহার করতেন, কিন্তু এর বিচারিক ব্যবহারের উপর অধিক গুরুত্ম দিতেন।<sup>[১৫]</sup> [[রোমান সাম্রাজ্য|রোমান সাম্রাজ্যে]], জাদুবিদ্যা হিসেবে পরিগণিত সবকিছুকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন জারি করা হয়।<sup>[৭৭]</sup>


প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে, জাদুবিদ্যাকে সেই সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের সমাজব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করা হত; উদাহরণস্বরূপ, প্রথম শতাব্দীর লেখ [[প্লিনি দ্যা এল্ডার]] দাবি করেন যে জাদুবিদ্যা সৃষ্টি করেছেন ইরানীয় দার্শনিক [[জোরোএস্টার]] , এবং জাদুকর [[অস্থ্যানিস]] যিনি পার্সিয় রাজা [[জারক্সিজ]]-এর সামরিক অভিযানের অনুষঙ্গী ছিলেন একে গ্রীসের পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে আসেন।<sup>[৭৮]</sup>
প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে, জাদুবিদ্যাকে সেই সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের সমাজব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করা হত; উদাহরণস্বরূপ, প্রথম শতাব্দীর লেখ [[প্লিনি দ্যা এল্ডার]] দাবি করেন যে জাদুবিদ্যা সৃষ্টি করেছেন ইরানীয় দার্শনিক [[জরথুস্ত্র|জোরোএস্টার]] , এবং জাদুকর [[অস্থ্যানিস]] যিনি পার্সিয় রাজা [[জারক্সিজ]]-এর সামরিক অভিযানের অনুষঙ্গী ছিলেন একে গ্রীসের পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে আসেন।<sup>[৭৮]</sup>


বিংশ শতাব্দীর প্রাচীন গ্রীক বিদ্যা প্রায় নিশ্চিতভাবেই [[জাদুবিদ্যা]] এবং [[ধর্মের]] অর্থ সম্পর্কে খ্রিষ্টীয় পূর্বধারণা প্রভাবিত, এবং গ্রীক সংস্কৃতিকে পশ্চিমা যুক্তিবিদ্যার ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করার কামনা সৃষ্টি করে প্রাচীন গ্রীক জাদুবিদ্যাকে আদিম এবং তুচ্ছ , এবং এভাবে মূলত হোমারের সাম্প্রদায়িক (''পোলিস'') ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন এক তত্ত্বের। শতাব্দীর শেষ দশক থেকে অবশ্য, ''কাতাডেস্মই'' ([[বন্ধনের মন্ত্|বন্ধনের মন্ত্র]])-এর মত কাজকে সর্বব্যাপিতা এবং মর্যাদা উপলব্ধি করে পণ্ডিতেরা এই দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে বাধ্য হন।<sup>[৪৭]ঃ৯০-৯৫</sup> গ্রীক শব্দ ''ম্যাগেইও'' (জাদুবিদ্যা চর্চা)-এর উৎপত্তি হচ্ছে পূর্বে মূলত ধর্ম চর্চা করে এমন এক [[পার্সিয় জাতি]]<nowiki/>কে দেওয়া গ্রীক নাম ''[[ম্যাগোস]]''।<sup>[৪৮]</sup> অ-নাগরিক [[গুপ্ত ধর্মমত]]<nowiki/>গুলোকেও একইভাবে পুনরায় মুল্যায়ন করা হয়।<sup>[৪৭]ঃ৯৭-৯৮</sup>
বিংশ শতাব্দীর প্রাচীন গ্রীক বিদ্যা প্রায় নিশ্চিতভাবেই [[জাদুবিদ্যা]] এবং [[ধর্মের]] অর্থ সম্পর্কে খ্রিষ্টীয় পূর্বধারণা প্রভাবিত, এবং গ্রীক সংস্কৃতিকে পশ্চিমা যুক্তিবিদ্যার ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করার কামনা সৃষ্টি করে প্রাচীন গ্রীক জাদুবিদ্যাকে আদিম এবং তুচ্ছ , এবং এভাবে মূলত হোমারের সাম্প্রদায়িক (''পোলিস'') ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন এক তত্ত্বের। শতাব্দীর শেষ দশক থেকে অবশ্য, ''কাতাডেস্মই'' ([[বন্ধনের মন্ত্|বন্ধনের মন্ত্র]])-এর মত কাজকে সর্বব্যাপিতা এবং মর্যাদা উপলব্ধি করে পণ্ডিতেরা এই দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে বাধ্য হন।<sup>[৪৭]ঃ৯০-৯৫</sup> গ্রীক শব্দ ''ম্যাগেইও'' (জাদুবিদ্যা চর্চা)-এর উৎপত্তি হচ্ছে পূর্বে মূলত ধর্ম চর্চা করে এমন এক [[পার্সিয় জাতি]]<nowiki/>কে দেওয়া গ্রীক নাম ''[[ম্যাগোস]]''।<sup>[৪৮]</sup> অ-নাগরিক [[গুপ্ত ধর্মমত]]<nowiki/>গুলোকেও একইভাবে পুনরায় মুল্যায়ন করা হয়।<sup>[৪৭]ঃ৯৭-৯৮</sup>
৮৭ নং লাইন: ৮৭ নং লাইন:
[[কালাডেসমই (ল্যাটিনঃ ডেফিক্সিওন্স)]], হচ্ছে মোমের বা সীসার ফলকে ক্ষোদিত এবং মাটির নিচে প্রোথিত অভিশাপ, যা গ্রীক সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ প্রতিনিয়ত ব্যবহার করতেন, মাঝেমাঝে গোটা ''পোলিস''-কে রক্ষা করতে।<sup>[৪৭]ঃ৯৫-৯৬</sup> সাম্প্রদায়িক অভিশাপগুলো সর্বসাধারণের সামনে পালন করা গ্রীক ক্লাসিকাল যুগের পর সংখ্যায় কমে আসে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অভিশাপ প্রাচীনকালে প্রচলিত থাকে।<sup>[৪৯]</sup> এগুলোর নিজস্ব, সহায়ক এবং অলক্ষুণে গুণের কারণে এদেরকে জাদুময় বলে বিশিষ্ট করা হত।<sup>[৪৭]ঃ৯৬</sup> এই গুণগুলো এবং স্বাভাবিকতার সহজাত পরিবর্তনীয় সাংস্কৃতিক ধারণা থেকে এগুলোর অনুভূত বিচ্যুতি, স্পষ্টতই প্রাচীন জাদুবিদ্যাকে ধর্মীয় রীতিনীতি যার একটি অংশ তারা, তাকে অংকিত করে।<sup>[৪৭]ঃ১০২-১০৩</sup>
[[কালাডেসমই (ল্যাটিনঃ ডেফিক্সিওন্স)]], হচ্ছে মোমের বা সীসার ফলকে ক্ষোদিত এবং মাটির নিচে প্রোথিত অভিশাপ, যা গ্রীক সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ প্রতিনিয়ত ব্যবহার করতেন, মাঝেমাঝে গোটা ''পোলিস''-কে রক্ষা করতে।<sup>[৪৭]ঃ৯৫-৯৬</sup> সাম্প্রদায়িক অভিশাপগুলো সর্বসাধারণের সামনে পালন করা গ্রীক ক্লাসিকাল যুগের পর সংখ্যায় কমে আসে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অভিশাপ প্রাচীনকালে প্রচলিত থাকে।<sup>[৪৯]</sup> এগুলোর নিজস্ব, সহায়ক এবং অলক্ষুণে গুণের কারণে এদেরকে জাদুময় বলে বিশিষ্ট করা হত।<sup>[৪৭]ঃ৯৬</sup> এই গুণগুলো এবং স্বাভাবিকতার সহজাত পরিবর্তনীয় সাংস্কৃতিক ধারণা থেকে এগুলোর অনুভূত বিচ্যুতি, স্পষ্টতই প্রাচীন জাদুবিদ্যাকে ধর্মীয় রীতিনীতি যার একটি অংশ তারা, তাকে অংকিত করে।<sup>[৪৭]ঃ১০২-১০৩</sup>


[[গ্রিক ভাষা|গ্রীক]], [[কপ্টিক]], এবং [[ডেমোটিক লিপি (মিশরীয়)|ডেমোটিক]] ভাষায় এক বিশাল সংখ্যক জাদুময় প্যাপিরি আবিষ্কার এবং অনুবাদ করা হয়েছে।<sup>[৪৯]</sup> এগুলোতে প্রাচীন উদাহরণ আছে এসবেরঃ
[[গ্রিক ভাষা|গ্রীক]], [[কিবতীয় ভাষা|কপ্টিক]], এবং [[ডেমোটিক লিপি (মিশরীয়)|ডেমোটিক]] ভাষায় এক বিশাল সংখ্যক জাদুময় প্যাপিরি আবিষ্কার এবং অনুবাদ করা হয়েছে।<sup>[৪৯]</sup> এগুলোতে প্রাচীন উদাহরণ আছে এসবেরঃ


* বিশ্বাস করা হত যে [[জাদুর শব্দ]]<nowiki/>গুলো আত্মাকে আদেশ দিতে পারে;<sup>[৫১]</sup>
* বিশ্বাস করা হত যে [[জাদুর শব্দ]]<nowiki/>গুলো আত্মাকে আদেশ দিতে পারে;<sup>[৫১]</sup>
৯৮ নং লাইন: ৯৮ নং লাইন:
প্রথম খৃষ্টাব্দে, তৎকালীন খৃষ্টান লেখকেরা জাদুবিদ্যা সম্পর্কে [[গ্রেকো-রোমান]] ধারণা গ্রহণ করেন এবং সেটাকে তাদের উঠতি [[খৃস্টীয় ধর্মতত্ত্বে]] একীভূত করেন।<sup>[৭৭]</sup> এইসব খৃষ্টানরা শব্দটির গ্রেকো-রোমান প্রচলিত বাঁধাধরা নেতিবাচক অর্থটি বজায় রাখেন এবং সেগুলোকে ইহুদী চিন্তা থেকে ধারণাগত আদর্শ ধার করেন, বিশেষ করে জাদুবিদ্যা এবং [[অলৌকিক ঘটনা]]<nowiki/>র বিরোধিতাকে।<sup>[৭৭]</sup> তৎকালীন কিছু খৃষ্টান লেখকেরা মানবজগত জাদুবিদ্যার উৎস এই গ্রীক-রোমান ভাবনাকে অনুসরণ করতেন, প্রধানত [[জোরোএস্টার]] এবং [[অস্থ্যানিস]]। খৃষ্টান দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিল এরূপ, যে জাদুবিদ্যা হচ্ছে ব্যাবিলনিয়, পার্সিয়, বা মিশরীয়দের দ্বারা সৃষ্ট।<sup>[৮৭]</sup> খৃষ্টানরা পূর্বের ক্লাসিকাল সংস্কৃতির এই ধারণা যে জাদুবিদ্যা হচ্ছে পরিপূরণ ধর্ম থেকে আলাদা এই ধারণায় বিশ্বাস করতেন, যদিও এই দুইয়ের মধ্যে তাদের প্রভেদটি ভিন্নরকম ছিল।<sup>[৮৮]</sup>
প্রথম খৃষ্টাব্দে, তৎকালীন খৃষ্টান লেখকেরা জাদুবিদ্যা সম্পর্কে [[গ্রেকো-রোমান]] ধারণা গ্রহণ করেন এবং সেটাকে তাদের উঠতি [[খৃস্টীয় ধর্মতত্ত্বে]] একীভূত করেন।<sup>[৭৭]</sup> এইসব খৃষ্টানরা শব্দটির গ্রেকো-রোমান প্রচলিত বাঁধাধরা নেতিবাচক অর্থটি বজায় রাখেন এবং সেগুলোকে ইহুদী চিন্তা থেকে ধারণাগত আদর্শ ধার করেন, বিশেষ করে জাদুবিদ্যা এবং [[অলৌকিক ঘটনা]]<nowiki/>র বিরোধিতাকে।<sup>[৭৭]</sup> তৎকালীন কিছু খৃষ্টান লেখকেরা মানবজগত জাদুবিদ্যার উৎস এই গ্রীক-রোমান ভাবনাকে অনুসরণ করতেন, প্রধানত [[জোরোএস্টার]] এবং [[অস্থ্যানিস]]। খৃষ্টান দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিল এরূপ, যে জাদুবিদ্যা হচ্ছে ব্যাবিলনিয়, পার্সিয়, বা মিশরীয়দের দ্বারা সৃষ্ট।<sup>[৮৭]</sup> খৃষ্টানরা পূর্বের ক্লাসিকাল সংস্কৃতির এই ধারণা যে জাদুবিদ্যা হচ্ছে পরিপূরণ ধর্ম থেকে আলাদা এই ধারণায় বিশ্বাস করতেন, যদিও এই দুইয়ের মধ্যে তাদের প্রভেদটি ভিন্নরকম ছিল।<sup>[৮৮]</sup>
[[চিত্র:Isidor_von_Sevilla.jpeg|বাম|থাম্ব| সেভিলের মধ্যযুগীয় লেখক ইসিডোর, যিনি জাদুময় বলে বিবেচিত কার্যকলাপের তালিকে নির্মাণ করেছিলেন তার ১৭ শতাব্দীর একটি চিত্র]]
[[চিত্র:Isidor_von_Sevilla.jpeg|বাম|থাম্ব| সেভিলের মধ্যযুগীয় লেখক ইসিডোর, যিনি জাদুময় বলে বিবেচিত কার্যকলাপের তালিকে নির্মাণ করেছিলেন তার ১৭ শতাব্দীর একটি চিত্র]]
প্রাচীন খৃষ্টান লেখক যেমন [[হিপ্পোর অগাস্টিনের]] জন্যে, জাদুবিদ্যা শুধুমাত্র ভুয়া এবং অপবিত্র রীতি দ্বারা গঠিত নয়, বরং তা ধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত কারণ এটি [[শয়তানের]] ভৃত্য [[প্রেতাত্মাদের]] সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল।<sup>[৭৭]</sup> এতে, জাদুবিদ্যার সম্পর্কে খৃস্টীয় ধারণাটি [[পৌত্তলিকতাবাদ|পৌত্তলিকতার]] ব্যাপারে খৃস্টীয় তালিকার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত<sup>[৮৯]</sup>, এবং জাদুবিদ্যা এবং পৌত্তলিকতা উভয়ই ''সুপারস্টিটো'' ([[কুসংস্কার]]), প্রাক-খৃস্টীয় রোমান সংস্কৃতি থেকে ধার করা আরেকটি পদের বিশদ তালিকার অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত ছিল।<sup>[৮৮]</sup> উত্তম ধর্মের বিরোধি জাদুবিদ্যার সহজাত নীতিভ্রষ্টতা এবং অন্যায়ের উপর এই খৃস্টীয় জোরদান ছিল সেই যুগের অন্যান্য বৃহৎ [[একেশ্বরবাদ|একেশ্বরবাদী]] ধর্ম, ইহুদীবাদ এবং ইসলামের ধারণা থেকে আরও অনমনীয়।<sup>[৯০]</sup> উদাহরণস্বরূপ, খৃষ্টানরা প্রেতাত্মাদের সম্পূর্ণ অশুভ বলে গণ্য করতেন, [[ইসলামি পুরাণে]] মুসলমানেরা সদৃশ সত্ত্বা, [[জীনদের]] অধিকতর প্রতিকূল সৃষ্টি বলে মনে করতেন।<sup>[৯০]</sup>
প্রাচীন খৃষ্টান লেখক যেমন [[হিপ্পোর অগাস্টিনের]] জন্যে, জাদুবিদ্যা শুধুমাত্র ভুয়া এবং অপবিত্র রীতি দ্বারা গঠিত নয়, বরং তা ধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত কারণ এটি [[শয়তান|শয়তানের]] ভৃত্য [[প্রেতাত্মাদের]] সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল।<sup>[৭৭]</sup> এতে, জাদুবিদ্যার সম্পর্কে খৃস্টীয় ধারণাটি [[পৌত্তলিকতাবাদ|পৌত্তলিকতার]] ব্যাপারে খৃস্টীয় তালিকার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত<sup>[৮৯]</sup>, এবং জাদুবিদ্যা এবং পৌত্তলিকতা উভয়ই ''সুপারস্টিটো'' ([[কুসংস্কার]]), প্রাক-খৃস্টীয় রোমান সংস্কৃতি থেকে ধার করা আরেকটি পদের বিশদ তালিকার অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত ছিল।<sup>[৮৮]</sup> উত্তম ধর্মের বিরোধি জাদুবিদ্যার সহজাত নীতিভ্রষ্টতা এবং অন্যায়ের উপর এই খৃস্টীয় জোরদান ছিল সেই যুগের অন্যান্য বৃহৎ [[একেশ্বরবাদ|একেশ্বরবাদী]] ধর্ম, ইহুদীবাদ এবং ইসলামের ধারণা থেকে আরও অনমনীয়।<sup>[৯০]</sup> উদাহরণস্বরূপ, খৃষ্টানরা প্রেতাত্মাদের সম্পূর্ণ অশুভ বলে গণ্য করতেন, [[ইসলামী পুরাণ|ইসলামি পুরাণে]] মুসলমানেরা সদৃশ সত্ত্বা, [[জ্বীন জাতি|জীনদের]] অধিকতর প্রতিকূল সৃষ্টি বলে মনে করতেন।<sup>[৯০]</sup>


খৃস্টীয় চিন্তায় জাদুকরদের ধারণাটি [[সাইমন ম্যাগাস]] (জাদুকর সাইমন), যিনি [[এক্টস অফ দ্যা এপোসোল]] এবং অপ্রামাণিক কিন্তু প্রভাবশালী [[এক্টস অফ পিটার-]]<nowiki/>এর [[সেইন্ট পিটারের]] বিরোধিতা করেছেন, তার দ্বারা প্রবর্তিত।<sup>[৯১]</sup> ঐতিহাসিক মাইকেল ডি. বেইলি মন্তব্য করেছেন যে মধ্যযুগীয় ইউরোপে, জাদুবিদ্যা ছিল একটি "অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত এবং পরিবেষ্টিত প্রকার।"<sup>[৯২]</sup> খৃস্টীয় ধর্মবিদেরা বিশ্বাস করতেন যে জাদুবিদ্যার বিভিন্নপ্রকার রুপ আছে, যার বেশিরভাগই [[ভবিষ্যৎকথনের]] প্রকারভেদ, উদাহরণস্বরূপ, [[সেভিলের ইসিডোর]] একটি তালিকা নির্মাণ করেছিলেন যেসব বস্তুকে তিনি জাদুময় বলে মনে করতেন যেখানে তিনি ভবিষ্যৎকথনকে চারটি উপাদান, [[ভূতত্ত্ব]], [[জলতত্ত্ব]], [[বায়ুতত্ত্ব]], [[অগ্নিতত্ত্ব]], সেইসাথে পাখিদের উড্ডয়ন এবং জ্যোতিষবিদ্যার মত প্রাকৃতিক দশার পর্যবেক্ষণ দ্বারা তালিকাভুক্ত করেন। তিনি [[বশীকরণ]] এবং বন্ধনী (রোগীদের দেহে জাদুর বন্ধনের চিকিৎসাবিষয়ক ব্যবহার)-কে জাদুময় বলে উল্লেখ করেন।<sup>[৯৩]</sup> মধ্যযুগীয় ইউরোপে জাদুবিদ্যাকে যুক্ত করা হয় ওল্ড টেস্টামেন্টের চরিত্র [[সলোমোনের]] সাথে; বিশ্বাস করা হত যে গ্রন্থগুলো সলোমোন রচনা করেছিলেন কিছুসংখ্যক [[গ্রিমোয়ারস]], বা জাদুবিদ্যা চর্চার রূপরেখা সম্বলিত গ্রন্থসমূহ, বিশেষ করে [[কি অফ সলোমোন]]।<sup>[৯৪]</sup>
খৃস্টীয় চিন্তায় জাদুকরদের ধারণাটি [[সাইমন ম্যাগাস]] (জাদুকর সাইমন), যিনি [[এক্টস অফ দ্যা এপোসোল]] এবং অপ্রামাণিক কিন্তু প্রভাবশালী [[এক্টস অফ পিটার-]]<nowiki/>এর [[প্রেরিত পিতর|সেইন্ট পিটারের]] বিরোধিতা করেছেন, তার দ্বারা প্রবর্তিত।<sup>[৯১]</sup> ঐতিহাসিক মাইকেল ডি. বেইলি মন্তব্য করেছেন যে মধ্যযুগীয় ইউরোপে, জাদুবিদ্যা ছিল একটি "অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত এবং পরিবেষ্টিত প্রকার।"<sup>[৯২]</sup> খৃস্টীয় ধর্মবিদেরা বিশ্বাস করতেন যে জাদুবিদ্যার বিভিন্নপ্রকার রুপ আছে, যার বেশিরভাগই [[ভবিষ্যৎকথনের]] প্রকারভেদ, উদাহরণস্বরূপ, [[সেভিলের ইসিডোর]] একটি তালিকা নির্মাণ করেছিলেন যেসব বস্তুকে তিনি জাদুময় বলে মনে করতেন যেখানে তিনি ভবিষ্যৎকথনকে চারটি উপাদান, [[ভূতত্ত্ব]], [[জলতত্ত্ব]], [[বায়ুতত্ত্ব]], [[অগ্নিতত্ত্ব]], সেইসাথে পাখিদের উড্ডয়ন এবং জ্যোতিষবিদ্যার মত প্রাকৃতিক দশার পর্যবেক্ষণ দ্বারা তালিকাভুক্ত করেন। তিনি [[বশীকরণ]] এবং বন্ধনী (রোগীদের দেহে জাদুর বন্ধনের চিকিৎসাবিষয়ক ব্যবহার)-কে জাদুময় বলে উল্লেখ করেন।<sup>[৯৩]</sup> মধ্যযুগীয় ইউরোপে জাদুবিদ্যাকে যুক্ত করা হয় ওল্ড টেস্টামেন্টের চরিত্র [[সলোমোনের]] সাথে; বিশ্বাস করা হত যে গ্রন্থগুলো সলোমোন রচনা করেছিলেন কিছুসংখ্যক [[গ্রিমোয়ারস]], বা জাদুবিদ্যা চর্চার রূপরেখা সম্বলিত গ্রন্থসমূহ, বিশেষ করে [[কি অফ সলোমোন]]।<sup>[৯৪]</sup>


মধ্যযুগীয় ইউরোপে শুরুর দিকে, ''ম্যাজিয়া'' ছিল ভর্ত্সনার একটি শব্দ।<sup>[৯৫]</sup> মধ্যযুগীয় ইউরোপে, খৃষ্টানরা প্রায়ই মুসলমান এবং ইহুদীদের জাদুচর্চায় লিপ্ত থাকার সন্দেহ করত;<sup>[৯৬]</sup> কিছু ক্ষেত্রে, এইসব উপলব্ধ জাদুর রীতিনীতির- [[ইহুদী কর্তৃক খৃষ্টান শিশু বলির তথাকথিত অভিযোগ]] সহ- ফলাফল হত খৃষ্টানদের হাতে এইসব ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যাকাণ্ড।<sup>[৯৭]</sup> খৃষ্টান গোষ্ঠীগুলোও প্রায়শই অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী খৃষ্টান গোষ্ঠীগুলোকে- যাদেরকে তারা মতবিরোধী মনে করত- দোষারোপ করত জাদুর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার।<sup>[৯১]</sup> মধ্যযুগীয় ইউরোপে ক্ষতি সংঘটনের উদ্দেশ্যে চর্চিত জাদুর প্রকার বলে পরিচিত ''ম্যালেফিসিয়াম'' প্রচলিত ছিল।<sup>[৯২]</sup> পরবর্তী মধ্যযুগগুলোতে এইসব ক্ষতিকর জাদুর চর্চাকারীদের বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় বিভিন্ন নাম প্রাদুর্ভূত হয়ঃ ফ্রেঞ্চ ভাষায় ''সরসিয়ের'', জার্মান ভাষায় ''হেক্সে'', ইতালিয় ভাষায় ''স্ট্রেগা'', এবং স্প্যানিশ ভাষায় ''ব্রুহা''।<sup>[৯৮]</sup> ইংরেজি ভাষায় অনিষ্টকারী জাদুর চর্চাকারীদের নাম, ডাইনি-এর উৎস প্রাক-[[প্রাচীন ইংরেজি ভাষা|প্রাচীন ইংরেজি]] শব্দ ''উইচে''।<sup>[৯৮]</sup>
মধ্যযুগীয় ইউরোপে শুরুর দিকে, ''ম্যাজিয়া'' ছিল ভর্ত্সনার একটি শব্দ।<sup>[৯৫]</sup> মধ্যযুগীয় ইউরোপে, খৃষ্টানরা প্রায়ই মুসলমান এবং ইহুদীদের জাদুচর্চায় লিপ্ত থাকার সন্দেহ করত;<sup>[৯৬]</sup> কিছু ক্ষেত্রে, এইসব উপলব্ধ জাদুর রীতিনীতির- [[ইহুদী কর্তৃক খৃষ্টান শিশু বলির তথাকথিত অভিযোগ]] সহ- ফলাফল হত খৃষ্টানদের হাতে এইসব ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যাকাণ্ড।<sup>[৯৭]</sup> খৃষ্টান গোষ্ঠীগুলোও প্রায়শই অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী খৃষ্টান গোষ্ঠীগুলোকে- যাদেরকে তারা মতবিরোধী মনে করত- দোষারোপ করত জাদুর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার।<sup>[৯১]</sup> মধ্যযুগীয় ইউরোপে ক্ষতি সংঘটনের উদ্দেশ্যে চর্চিত জাদুর প্রকার বলে পরিচিত ''ম্যালেফিসিয়াম'' প্রচলিত ছিল।<sup>[৯২]</sup> পরবর্তী মধ্যযুগগুলোতে এইসব ক্ষতিকর জাদুর চর্চাকারীদের বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় বিভিন্ন নাম প্রাদুর্ভূত হয়ঃ ফ্রেঞ্চ ভাষায় ''সরসিয়ের'', জার্মান ভাষায় ''হেক্সে'', ইতালিয় ভাষায় ''স্ট্রেগা'', এবং স্প্যানিশ ভাষায় ''ব্রুহা''।<sup>[৯৮]</sup> ইংরেজি ভাষায় অনিষ্টকারী জাদুর চর্চাকারীদের নাম, ডাইনি-এর উৎস প্রাক-[[প্রাচীন ইংরেজি ভাষা|প্রাচীন ইংরেজি]] শব্দ ''উইচে''।<sup>[৯৮]</sup>
১১২ নং লাইন: ১১২ নং লাইন:
মধ্যযুগে জাদুবিদ্যায় ব্যবহৃত বহুসংখ্যক যন্ত্রপাতি বা রীতিনীতির কিছু হলঃ বিভিন্ন তাবিজ, কবচ, মিকচার, তারসাথে নির্দিষ্ট মন্ত্র, নৃত্য, এবং [[প্রার্থনা (উপাসনা)|প্রার্থনা]]। এইসব রীতিনীতির সাথে ছিল এদের উপর প্রভাবশালী পৈশাচিক অংশ সম্পর্কিত প্রতিকূল রঞ্জিত ধারণা। জাদুবিদ্যা পরিকল্পিত, শিক্ষণীয়, এবং পিশাচদের দ্বারা চর্চিত এই ধারণাটি এমন যেকোন ব্যক্তির কাছে যৌক্তিক মনে হবে যিনি গ্রীক জাদুময় প্যাপিরি বা [[সেফের-হা-রাজিম]] পড়েছেন এবং আবিষ্কার করেছেন যে চিকিৎসা-সম্পর্কিত জাদু মানুষ বধ করা, সম্পদ অর্জন, অথবা ব্যক্তিগত সুবিধা, এবং নারীদের দৈহিক সম্পর্কে বাধ্য করার রীতির পাশাপাশি আবির্ভূত হয়েছিল।<sup>[১০৩]</sup> গৃহে, দেহে এবং মঠে আর গির্জায় চর্চিত রীতিনীতিগুলো সম্পর্কে আরও উত্তম ধারণা দিচ্ছে পুরাতত্ত্ব।<sup>[৫৮][৫৯]</sup>
মধ্যযুগে জাদুবিদ্যায় ব্যবহৃত বহুসংখ্যক যন্ত্রপাতি বা রীতিনীতির কিছু হলঃ বিভিন্ন তাবিজ, কবচ, মিকচার, তারসাথে নির্দিষ্ট মন্ত্র, নৃত্য, এবং [[প্রার্থনা (উপাসনা)|প্রার্থনা]]। এইসব রীতিনীতির সাথে ছিল এদের উপর প্রভাবশালী পৈশাচিক অংশ সম্পর্কিত প্রতিকূল রঞ্জিত ধারণা। জাদুবিদ্যা পরিকল্পিত, শিক্ষণীয়, এবং পিশাচদের দ্বারা চর্চিত এই ধারণাটি এমন যেকোন ব্যক্তির কাছে যৌক্তিক মনে হবে যিনি গ্রীক জাদুময় প্যাপিরি বা [[সেফের-হা-রাজিম]] পড়েছেন এবং আবিষ্কার করেছেন যে চিকিৎসা-সম্পর্কিত জাদু মানুষ বধ করা, সম্পদ অর্জন, অথবা ব্যক্তিগত সুবিধা, এবং নারীদের দৈহিক সম্পর্কে বাধ্য করার রীতির পাশাপাশি আবির্ভূত হয়েছিল।<sup>[১০৩]</sup> গৃহে, দেহে এবং মঠে আর গির্জায় চর্চিত রীতিনীতিগুলো সম্পর্কে আরও উত্তম ধারণা দিচ্ছে পুরাতত্ত্ব।<sup>[৫৮][৫৯]</sup>


জাদুবিদ্যার প্রতি [[ইসলামের]] প্রতিক্রিয়া অর্থ সাধারণভাবে জাদুর বিরোধিতা নয় বরং অসুস্থতা আর [[ভূতাবিষ্টের]] আরোগ্য লাভ, এবং ডাকিনীবিদ্যার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। প্রথমটি হচ্ছে [[সৃষ্টিকর্তার]] তরফ থেকে একটি বিশেষ উপহার, আর পরবর্তীটি [[জীন]] আর [[শয়তানের]] সাহায্যে অর্জিত। [[ইবনে আল নাদিম|ইবনে-আল-নাদিম]] বিশ্বাস করতেন যে [[ভূতের ওঝারা]] সৃষ্টিকর্তার প্রতি তদের আনুগত্য থেকে তাদের ক্ষমতা অর্জন করেন, আর ডাকিনীবিদরা অবাধ্যতার কাজ করে এবং বলিদান করে পিশাচদের খুশি করে তাদের কাছ থেকে এর বিনিময়ে অনুগ্রহ লাভ করে।<sup>[৬০]</sup> [[ইবনে আরাবী|ইবনে আরাবি']]<nowiki/>র মতে [[আল-হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ আল-শুবারবুলি]] তার ধার্মিকতার কারণে পানির উপরে হাঁটতে পারতেন।<sup>[৬১]</sup> [[কুরআন]] অনুযায়ী, [[সুলেমানের]] ইসলামিক কিংবদন্তী অনুযায়ী, মানবজাতিকে জাদুবিদ্যা শেখায় পিশাচেরা। সুলেমান ডাকিনীবিদের কাছ থেকে [[রচনাগুলো]] নিয়ে যান এবং সেগুলোকে তার সিংহাসনের নিচে লুকিয়ে রাখেন। তার মৃত্যুর পর, [[ইবলিশ]], সুলেমানের দরবারের কাছাকাছি যাওয়াতে অক্ষম হওয়ায়, জনগণকে বলে যে তারা সিংহাসনের নিচে গুপ্তধন খুঁজে পাবে এবং এভাবে তাদেরকে ডাকিনীবিদ্যার দিকে নিয়ে যায়। আরেক বর্ণনা অনুযায়ী, মানবজাতির কাছে [[নির্বাসিত ফেরেশতা]] [[হারুত এবং মারুত]] জাদুবিদ্যা নিয়ে আসে।<sup>[৬২]</sup>
জাদুবিদ্যার প্রতি [[ইসলাম|ইসলামের]] প্রতিক্রিয়া অর্থ সাধারণভাবে জাদুর বিরোধিতা নয় বরং অসুস্থতা আর [[ভূতাবিষ্টের]] আরোগ্য লাভ, এবং ডাকিনীবিদ্যার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। প্রথমটি হচ্ছে [[সৃষ্টিকর্তা|সৃষ্টিকর্তার]] তরফ থেকে একটি বিশেষ উপহার, আর পরবর্তীটি [[জীন]] আর [[শয়তান|শয়তানের]] সাহায্যে অর্জিত। [[ইবনে আল নাদিম|ইবনে-আল-নাদিম]] বিশ্বাস করতেন যে [[ওঝা|ভূতের ওঝারা]] সৃষ্টিকর্তার প্রতি তদের আনুগত্য থেকে তাদের ক্ষমতা অর্জন করেন, আর ডাকিনীবিদরা অবাধ্যতার কাজ করে এবং বলিদান করে পিশাচদের খুশি করে তাদের কাছ থেকে এর বিনিময়ে অনুগ্রহ লাভ করে।<sup>[৬০]</sup> [[ইবনে আরাবী|ইবনে আরাবি']]<nowiki/>র মতে [[আল-হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ আল-শুবারবুলি]] তার ধার্মিকতার কারণে পানির উপরে হাঁটতে পারতেন।<sup>[৬১]</sup> [[কুরআন]] অনুযায়ী, [[সুলায়মান|সুলেমানের]] ইসলামিক কিংবদন্তী অনুযায়ী, মানবজাতিকে জাদুবিদ্যা শেখায় পিশাচেরা। সুলেমান ডাকিনীবিদের কাছ থেকে [[রচনাগুলো]] নিয়ে যান এবং সেগুলোকে তার সিংহাসনের নিচে লুকিয়ে রাখেন। তার মৃত্যুর পর, [[ইবলিশ]], সুলেমানের দরবারের কাছাকাছি যাওয়াতে অক্ষম হওয়ায়, জনগণকে বলে যে তারা সিংহাসনের নিচে গুপ্তধন খুঁজে পাবে এবং এভাবে তাদেরকে ডাকিনীবিদ্যার দিকে নিয়ে যায়। আরেক বর্ণনা অনুযায়ী, মানবজাতির কাছে [[নির্বাসিত ফেরেশতা]] [[হারুত এবং মারুত]] জাদুবিদ্যা নিয়ে আসে।<sup>[৬২]</sup>
[[চিত্র:Natural_Magick_by_Giambattista_della_Porta.jpg|ডান|থাম্ব| 1658 সালে লন্ডনে প্রকাশিত ''ন্যাচারাল'' ম্যাজিকের একটি ইংরেজি অনুবাদের ফ্রন্টিসপিস]]
[[চিত্র:Natural_Magick_by_Giambattista_della_Porta.jpg|ডান|থাম্ব| 1658 সালে লন্ডনে প্রকাশিত ''ন্যাচারাল'' ম্যাজিকের একটি ইংরেজি অনুবাদের ফ্রন্টিসপিস]]
প্রাক-আধুনিক যুগে, জাদুবিদ্যা সম্পর্কে ধারণা আরও ইতিবাচক পুনঃমুল্যায়িত হত ''[[ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস]]'' (প্রাকৃতিক জাদুবিদ্যা)-এর ধারণার সম্প্রসারের কারণে।<sup>[৭৭]</sup> এই শব্দটি দুইজন ইতালীয় মানবতাবাদী [[মারসিলো ফিসিনো]] এবং [[জিওভানি পিকো ডেলা মিরান্ডোলা]] কর্তৃক প্রবর্তিত এবং বিকশিত।<sup>[৭৭]</sup> তারা ম্যাজিয়াকে বহু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে পরিব্যাপ্ত করা একটি আধিভৌতিক বল হিসেবে দেখতেন,<sup>[৭৭]</sup> এবং এভাবে পৈশাচিক জাদুবিদ্যা সম্পর্কে খৃষ্টানদের মূলধারার ধারণা থেকে মৌলিকভাবে আলাদা ছিল। <sup>[১০৯]</sup> তাদের ধারণা পরবর্তী অনেক দার্শনিক এবং লেখকদের প্রভাবিত করে, তাদের মধ্যে ছিলেন [[প্যারাসেলসাস]], [[জিওরডানো ব্রুনো]], [[জোহানেস রিউক্লিন]] এবং [[জোহানেস ট্রিথেমিয়াস]]।<sup>[৭৭]</sup> ঐতিহাসিক [[রিচারড কিয়েকহেফের-]]<nowiki/>এর মতে, ''ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস'' -এর ধারণাটি চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীতে "ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে দৃঢ়স্থান" অর্জন করে,<sup>[১১০]</sup> [[এরিস্টটল]], [[নিওপ্লেটোনিস্ট]], এবং [[হারমিটিসিস্ট]]- মতাবলম্বীদেরসহ বিভিন্ন তত্ত্বীয়বাদের [[প্রাকৃতিক দার্শনিকদের]] আকৃষ্ট করে।<sup>[১১১]</sup>
প্রাক-আধুনিক যুগে, জাদুবিদ্যা সম্পর্কে ধারণা আরও ইতিবাচক পুনঃমুল্যায়িত হত ''[[ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস]]'' (প্রাকৃতিক জাদুবিদ্যা)-এর ধারণার সম্প্রসারের কারণে।<sup>[৭৭]</sup> এই শব্দটি দুইজন ইতালীয় মানবতাবাদী [[মারসিলো ফিসিনো]] এবং [[জিওভানি পিকো ডেলা মিরান্ডোলা]] কর্তৃক প্রবর্তিত এবং বিকশিত।<sup>[৭৭]</sup> তারা ম্যাজিয়াকে বহু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে পরিব্যাপ্ত করা একটি আধিভৌতিক বল হিসেবে দেখতেন,<sup>[৭৭]</sup> এবং এভাবে পৈশাচিক জাদুবিদ্যা সম্পর্কে খৃষ্টানদের মূলধারার ধারণা থেকে মৌলিকভাবে আলাদা ছিল। <sup>[১০৯]</sup> তাদের ধারণা পরবর্তী অনেক দার্শনিক এবং লেখকদের প্রভাবিত করে, তাদের মধ্যে ছিলেন [[প্যারাসেলসাস]], [[জিওরডানো ব্রুনো]], [[জোহানেস রিউক্লিন]] এবং [[জোহানেস ট্রিথেমিয়াস]]।<sup>[৭৭]</sup> ঐতিহাসিক [[রিচারড কিয়েকহেফের-]]<nowiki/>এর মতে, ''ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস'' -এর ধারণাটি চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীতে "ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে দৃঢ়স্থান" অর্জন করে,<sup>[১১০]</sup> [[এরিস্টটল]], [[নয়াপ্লেটোবাদ|নিওপ্লেটোনিস্ট]], এবং [[হারমিটিসিস্ট]]- মতাবলম্বীদেরসহ বিভিন্ন তত্ত্বীয়বাদের [[প্রাকৃতিক দার্শনিকদের]] আকৃষ্ট করে।<sup>[১১১]</sup>


এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুগতরা তর্ক করতেন যে ''ম্যাজিয়া'' ভাল এবং খারাপ উভয়ভাবেই প্রকাশিত হতে পারে; ১৬২৫ সালে, ফরাসী গ্রন্থাগারিক [[গ্যাব্রিয়েল নউডে]] তার ''এপোলোজি ফর অল দ্যা ওয়াইজ মেন ফলসলি সাস্পেক্টেড অফ ম্যাজিক'' রচনা করেন, যাতে তিনি "মোজোয়াইকাল ম্যাজিক"কে- তিনি দাবি করেন এটি ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে এবং ভবিষ্যৎবাণী, অলৌকিক ঘটনা, এবং [[বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা]]- পিশাচদের দ্বারা সংঘটিত "জিওটিক" জাদুবিদ্যা থেকে আলাদা করেন।<sup>[১১২]</sup> যখন ''ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস'' -এর প্রবক্তারা জোর দেন যে এইসব পিশাচদের কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভর করেনা, তখন সমালোচকেরা বিমত পোষণ করেন, এই যুক্তিতে যে পিশাচেরা এইসব জাদুকরদের প্রতারিত করেছে।<sup>[১১৩]</sup> সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে ''ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস''-এর ধারণা ক্রমবর্ধমানভাবে "প্রকৃতিবাদী" দিকে সরে যায়, এটির এবং বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যটি অস্পষ্ট হয়ে উঠে।<sup>[১১৪]</sup> বিশ্বকে বোঝার জন্যে''ম্যাজিয়া ন্যাচারালিসের'' ধারণার বৈধতা তখন অষ্টাদশ শতাব্দীর [[আলোকিত যুগ|আলোকিত যুগে]] ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখে পড়ে।<sup>[১১৫]</sup>
এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুগতরা তর্ক করতেন যে ''ম্যাজিয়া'' ভাল এবং খারাপ উভয়ভাবেই প্রকাশিত হতে পারে; ১৬২৫ সালে, ফরাসী গ্রন্থাগারিক [[গ্যাব্রিয়েল নউডে]] তার ''এপোলোজি ফর অল দ্যা ওয়াইজ মেন ফলসলি সাস্পেক্টেড অফ ম্যাজিক'' রচনা করেন, যাতে তিনি "মোজোয়াইকাল ম্যাজিক"কে- তিনি দাবি করেন এটি ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে এবং ভবিষ্যৎবাণী, অলৌকিক ঘটনা, এবং [[বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা]]- পিশাচদের দ্বারা সংঘটিত "জিওটিক" জাদুবিদ্যা থেকে আলাদা করেন।<sup>[১১২]</sup> যখন ''ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস'' -এর প্রবক্তারা জোর দেন যে এইসব পিশাচদের কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভর করেনা, তখন সমালোচকেরা বিমত পোষণ করেন, এই যুক্তিতে যে পিশাচেরা এইসব জাদুকরদের প্রতারিত করেছে।<sup>[১১৩]</sup> সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে ''ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস''-এর ধারণা ক্রমবর্ধমানভাবে "প্রকৃতিবাদী" দিকে সরে যায়, এটির এবং বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যটি অস্পষ্ট হয়ে উঠে।<sup>[১১৪]</sup> বিশ্বকে বোঝার জন্যে''ম্যাজিয়া ন্যাচারালিসের'' ধারণার বৈধতা তখন অষ্টাদশ শতাব্দীর [[আলোকিত যুগ|আলোকিত যুগে]] ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখে পড়ে।<sup>[১১৫]</sup>


ইতিবাচক অর্থে ''ম্যাজিয়া'' শব্দটিকে পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, পশ্চিমা বিশ্বে তা জাদুবিদ্যার প্রতি চিরাচরিত মনোভাব অপসারণ করতে পারেনি, এটি বিশালাংশে নেতিবাচকই থাকে।<sup>[১১৫]</sup> একইসময়ে ''ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস'' যখন আগ্রহ জন্মাচ্ছিল এবং বৃহতাংশে সহ্য করা হচ্ছিল, ইউরোপে তখন ''ম্যালেফিসিয়া''-য় দোষী সাব্যস্ত অভিযুক্ত ডাইনিদের সক্রিয়ভাবে নিগ্রহ করা হচ্ছিল।<sup>[১১১]</sup> শব্দটির চলমান নেতিবাচক সংলগ্নতা প্রতিফলিত করে, [[প্রটেস্টেন্টরা]] প্রায়শই [[রোমান ক্যাথলিক]] জাদুময় এবং ভক্তিমূলক রীতিনীতিগুলোকে ধার্মিকতার চেয়ে জাদুময় বলে হেয় করতেন।<sup>[১১৬]</sup> বহু রোমান ক্যাথলিকেরা এই অভিযোগ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন এবং বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন রোমান ক্যাথলিক লেখকেরা তাদের রীতিনীতি জাদুর নয় বরং ধার্মিক এই বিতর্কে মনোনিবেশ করেন।<sup>[১১৭]</sup> একই সময়ে, প্রটেস্টেন্টরা প্রায়শই তাদের প্রতিযোগী অন্যান্য প্রটেস্টেন্ট সম্প্রদায়গুলোর বিরুদ্ধে জাদুবিদ্যার অভিযোগ আনতেন।<sup>[১১৮]</sup> এভাবে, জাদুবিদ্যার ধারণাটিকে ধার্মিক বিশ্বাস এবং রীতিনীতি হিসেবে উপযুক্ত বলে গণ্য বিহিত করা হত।<sup>[১১৭]</sup> এই সময়ে একই ধরণের দাবি ইসলামিক বিশ্বেও তোলা হচ্ছিল। আরবীয় মাওলানা [[মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব|মুহাম্মদ ইবনে আব্দ আল-ওয়াহাব]]- [[ওয়াহাবি আন্দোলন|ওয়াহাবি]] মতবাদের প্রবক্তা- উদাহরণস্বরূপ ভবিষ্যৎবাণী এবং ''সিহর'' বলে গণ্য সত্ত্বার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, যেটাকে তিনি পালাক্রমে এক ধরণের ''[[শির্‌ক (ইসলাম)|শিরক]],'' প্রতিমাপূজার পাপ বলে দাবি করেন- এগুলোর মত বিভিন্ন রীতি আর চর্চাকে নিষিদ্ধ করেন।<sup>[১১৯]</sup>
ইতিবাচক অর্থে ''ম্যাজিয়া'' শব্দটিকে পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, পশ্চিমা বিশ্বে তা জাদুবিদ্যার প্রতি চিরাচরিত মনোভাব অপসারণ করতে পারেনি, এটি বিশালাংশে নেতিবাচকই থাকে।<sup>[১১৫]</sup> একইসময়ে ''ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস'' যখন আগ্রহ জন্মাচ্ছিল এবং বৃহতাংশে সহ্য করা হচ্ছিল, ইউরোপে তখন ''ম্যালেফিসিয়া''-য় দোষী সাব্যস্ত অভিযুক্ত ডাইনিদের সক্রিয়ভাবে নিগ্রহ করা হচ্ছিল।<sup>[১১১]</sup> শব্দটির চলমান নেতিবাচক সংলগ্নতা প্রতিফলিত করে, [[প্রতিবাদী মতবাদ (খ্রিস্টধর্ম)|প্রটেস্টেন্টরা]] প্রায়শই [[রোমান ক্যাথলিক]] জাদুময় এবং ভক্তিমূলক রীতিনীতিগুলোকে ধার্মিকতার চেয়ে জাদুময় বলে হেয় করতেন।<sup>[১১৬]</sup> বহু রোমান ক্যাথলিকেরা এই অভিযোগ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন এবং বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন রোমান ক্যাথলিক লেখকেরা তাদের রীতিনীতি জাদুর নয় বরং ধার্মিক এই বিতর্কে মনোনিবেশ করেন।<sup>[১১৭]</sup> একই সময়ে, প্রটেস্টেন্টরা প্রায়শই তাদের প্রতিযোগী অন্যান্য প্রটেস্টেন্ট সম্প্রদায়গুলোর বিরুদ্ধে জাদুবিদ্যার অভিযোগ আনতেন।<sup>[১১৮]</sup> এভাবে, জাদুবিদ্যার ধারণাটিকে ধার্মিক বিশ্বাস এবং রীতিনীতি হিসেবে উপযুক্ত বলে গণ্য বিহিত করা হত।<sup>[১১৭]</sup> এই সময়ে একই ধরণের দাবি ইসলামিক বিশ্বেও তোলা হচ্ছিল। আরবীয় মাওলানা [[মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব|মুহাম্মদ ইবনে আব্দ আল-ওয়াহাব]]- [[ওয়াহাবি আন্দোলন|ওয়াহাবি]] মতবাদের প্রবক্তা- উদাহরণস্বরূপ ভবিষ্যৎবাণী এবং ''সিহর'' বলে গণ্য সত্ত্বার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, যেটাকে তিনি পালাক্রমে এক ধরণের ''[[শির্‌ক (ইসলাম)|শিরক]],'' প্রতিমাপূজার পাপ বলে দাবি করেন- এগুলোর মত বিভিন্ন রীতি আর চর্চাকে নিষিদ্ধ করেন।<sup>[১১৯]</sup>


=== রেনেসাঁ ===
=== রেনেসাঁ ===
{{মূল নিবন্ধ|Witchcraft|Maleficium (sorcery)}}
{{মূল নিবন্ধ|Witchcraft|Maleficium (sorcery)}}
[[রেনেসাঁ মানবতাবাদ]] এক পুনরুত্থান দেখে [[সন্ন্যাসবাদ]] এবং [[নয়াপ্লাতোবাদ|নব্য-প্লেটোবাদ]]- এর বিভিন্ন [[আনুষ্ঠানিক জাদুবিদ্যায়]]। রেনেসাঁ, অন্যদিকে, [[বিজ্ঞানের]] উত্থানের মুখ দেখে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কিত [[টলেমি'র তত্ত্বের]] খারিজ, জ্যোতিষবিদ্যা থেকে জ্যোতির্বিদ্যার, এবং আলকেমি থেকে রসায়নের পার্থক্য ইত্যাদির মাধ্যমে।<sup>[৬৩]</sup>
[[রেনেসাঁ মানবতাবাদ]] এক পুনরুত্থান দেখে [[সন্ন্যাসবাদ]] এবং [[নয়াপ্লাতোবাদ|নব্য-প্লেটোবাদ]]- এর বিভিন্ন [[আনুষ্ঠানিক জাদুবিদ্যায়]]। রেনেসাঁ, অন্যদিকে, [[বিজ্ঞানের দর্শন|বিজ্ঞানের]] উত্থানের মুখ দেখে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কিত [[টলেমি'র তত্ত্বের]] খারিজ, জ্যোতিষবিদ্যা থেকে জ্যোতির্বিদ্যার, এবং আলকেমি থেকে রসায়নের পার্থক্য ইত্যাদির মাধ্যমে।<sup>[৬৩]</sup>


কুসংস্কার, অতিপ্রাকৃতবিদ্যা, এবং সম্পূর্ণ বৈধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান বা ধার্মিক রীতিনীতির চর্চার মধ্যে পার্থক্যে বিশাল অনিশ্চয়তা ছিল। বুদ্ধিগত এবং আধ্যাত্মিক চাপা উত্তেজনার সূত্রপাত হয় প্রাক-আধুনিক [[ডাকিনীবিদ্যা উন্মত্ততায়,]] তা আরও শক্তিশালী হয় [[প্রটেস্টেন্ট সংস্কারের]] অশান্তি দ্বারা, বিশেষত জার্মানি, ইংল্যান্ড, এবং [[স্কটল্যান্ড|স্কটল্যান্ডে]]।<sup>[৬৩]</sup>
কুসংস্কার, অতিপ্রাকৃতবিদ্যা, এবং সম্পূর্ণ বৈধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান বা ধার্মিক রীতিনীতির চর্চার মধ্যে পার্থক্যে বিশাল অনিশ্চয়তা ছিল। বুদ্ধিগত এবং আধ্যাত্মিক চাপা উত্তেজনার সূত্রপাত হয় প্রাক-আধুনিক [[ডাকিনীবিদ্যা উন্মত্ততায়,]] তা আরও শক্তিশালী হয় [[প্রটেস্টেন্ট সংস্কারের]] অশান্তি দ্বারা, বিশেষত জার্মানি, ইংল্যান্ড, এবং [[স্কটল্যান্ড|স্কটল্যান্ডে]]।<sup>[৬৩]</sup>
২২৪ নং লাইন: ২২৪ নং লাইন:


== ডাকিনীবিদ্যা ==
== ডাকিনীবিদ্যা ==
ইতিহাসবিদ [[রোনাল্ড হাটন]] উল্লেখ করেন যে ইংরেজি ভাষায় ডাকিনীবিদ্যা শব্দটির চারটি ভিন্ন অর্থ বিদ্যমান। ঐতিহাসিকভাবে, শব্দটি প্রাথমিকভাবে অন্যদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আধিভৌতিক বা জাদুর চর্চাকে নির্দেশ করত। এটি এই শব্দটির, হাটনের মতে, "সবচেয়ে ব্যাপক এবং নিয়মিত" ব্যাখ্যা।<sup>[২২৭]</sup> উপরন্তু, হাটন বর্তমান তিনটি ভিন্ন সংজ্ঞার ব্যবহার উল্লেখ করেন ; এমন যে কোন ব্যাক্তি যিনি জাদুবিদ্যার চর্চা করেন, উপকারী বা অপকারী যে কোন উদ্দেশ্যে; আধুনিক পৌত্তলিক ধর্ম [[উইকা]]'র চর্চাকারীদের মধ্যে; অথবা পুরুষদের কর্তৃত্ব প্রতিরোধে নারীদের একটি প্রতীক এবং স্বাধীন নারী কর্তৃত্ব স্থাপনে।<sup>[২২৮]</sup> ডাকিনীবিদ্যার বিশ্বাস প্রায়শয়ই যেসব সমাজ এবং দলের [[সাংস্কৃতিক কাঠামোতে]] [[পৃথিবী]] সম্পর্কে জাদুময় [[দৃষ্টিভঙ্গি]] বিদ্যমান সেখানে উপস্থিত থাকে।<sup>[৭৬]</sup>
ইতিহাসবিদ [[রোনাল্ড হাটন]] উল্লেখ করেন যে ইংরেজি ভাষায় ডাকিনীবিদ্যা শব্দটির চারটি ভিন্ন অর্থ বিদ্যমান। ঐতিহাসিকভাবে, শব্দটি প্রাথমিকভাবে অন্যদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আধিভৌতিক বা জাদুর চর্চাকে নির্দেশ করত।<ref>{{বই উদ্ধৃতি|ইউআরএল=http://dx.doi.org/10.1007/978-1-4615-0583-9_59|শিরোনাম=Theoretical Analysis of Hydrolysis of Sulfur Fluorides SFn (n = 3 - 6) in the Gas Phase|শেষাংশ=Larin|প্রথমাংশ=Alexander V.|শেষাংশ২=Meurice|প্রথমাংশ২=Nathalie|শেষাংশ৩=Leherte|প্রথমাংশ৩=Laurence|শেষাংশ৪=Rajzmann|প্রথমাংশ৪=Michel|শেষাংশ৫=Vercauteren|প্রথমাংশ৫=Daniel P.|শেষাংশ৬=Trubnikov|প্রথমাংশ৬=Dmitrii N.|তারিখ=2001|প্রকাশক=Springer US|অবস্থান=Boston, MA|পাতাসমূহ=425–430|আইএসবিএন=978-1-4613-5143-6}}</ref> এটি এই শব্দটির, হাটনের মতে, "সবচেয়ে ব্যাপক এবং নিয়মিত" ব্যাখ্যা। উপরন্তু, হাটন বর্তমান তিনটি ভিন্ন সংজ্ঞার ব্যবহার উল্লেখ করে ; এমন যে কোন ব্যাক্তি যিনি জাদুবিদ্যার চর্চা করেন, উপকারী বা অপকারী যে কোন উদ্দেশ্যে; আধুনিক পৌত্তলিক ধর্ম [[উইকা]]'র চর্চাকারীদের মধ্যে; অথবা পুরুষদের কর্তৃত্ব প্রতিরোধে নারীদের একটি প্রতীক এবং স্বাধীন নারী কর্তৃত্ব স্থাপনে।<sup>[২২৮]</sup> ডাকিনীবিদ্যার বিশ্বাস প্রায়শয়ই যেসব সমাজ এবং দলের [[সাংস্কৃতিক কাঠামোতে]] [[পৃথিবী]] সম্পর্কে জাদুময় [[দৃষ্টিভঙ্গি]] বিদ্যমান সেখানে উপস্থিত থাকে।<sup>[৭৬]</sup>


যাদেরকে জাদুকর হিসেবে পরিগণিত করা হত তারা প্রায়শয়ই তাদের সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সন্দেহের শিকার হতেন।<sup>[২৩০]</sup> এটি বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যদি এইসব পরিগণিত জাদুকর একটি বিশেষ সমাজে ইতিমধ্যে নৈতিকভাবে সন্দেহ করা সামাজিক দল যেমন বিদেশি, নারী, বা অন্যান্য নিচু শ্রেণির সাথে জড়িত থাকেন।<sup>[২৩১]</sup> এইসব নেতিবাচক সংলগ্নতার বিপরীত, জাদুর বলে গণ্য কর্মের বহু চর্চাকারী জোর দেন যে তাদের কাজ মহান এবং উপকারী।<sup>[২৩২]</sup> যে সকল কর্মকে জাদুর বিভিন্ন ধরণ হিসেবে প্রকারভেদ করা হয়েছে, জাদুকরের উদ্দেশ্য যাইই হোক না কেন, সেগুলোর সবই নিহিতভাবে খারাপ কারণ সকল জাদু চর্চা শয়তানের এই সাধারণ খ্রিস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাথে এর বিরোধ দেখা দেয়।<sup>[৯০]</sup> একজন জাদুকরের চর্চার প্রতি পরস্পরবিরোধী আচরণ বিদ্যমান থাকতে পারে; ইউরোপীয় ইতিহাসে, কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করত যে চতুর লোক এবং চিরাচরিত চিকিৎসকেরা হচ্ছে ক্ষতিকারক কারণ তাদের চর্চাগুলো জাদুর বলে বিবেচিত আর এভাবে শয়তানের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে এগুলোর সূত্রপাত, যেখানে একটি স্থানীয় সম্প্রদায় হয়তবা এইসব ব্যক্তিদের মূল্যায়ন এবং শ্রদ্ধা করতে পারে কারণ তাদের দক্ষতা এবং সেবা উপকারী বলে বিবেচিত।<sup>[২৩৩]</sup>
যাদেরকে জাদুকর হিসেবে পরিগণিত করা হত তারা প্রায়শয়ই তাদের সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সন্দেহের শিকার হতেন।<sup>[২৩০]</sup> এটি বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যদি এইসব পরিগণিত জাদুকর একটি বিশেষ সমাজে ইতিমধ্যে নৈতিকভাবে সন্দেহ করা সামাজিক দল যেমন বিদেশি, নারী, বা অন্যান্য নিচু শ্রেণির সাথে জড়িত থাকেন।<sup>[২৩১]</sup> এইসব নেতিবাচক সংলগ্নতার বিপরীত, জাদুর বলে গণ্য কর্মের বহু চর্চাকারী জোর দেন যে তাদের কাজ মহান এবং উপকারী।<sup>[২৩২]</sup> যে সকল কর্মকে জাদুর বিভিন্ন ধরণ হিসেবে প্রকারভেদ করা হয়েছে, জাদুকরের উদ্দেশ্য যাইই হোক না কেন, সেগুলোর সবই নিহিতভাবে খারাপ কারণ সকল জাদু চর্চা শয়তানের এই সাধারণ খ্রিস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাথে এর বিরোধ দেখা দেয়।<sup>[৯০]</sup> একজন জাদুকরের চর্চার প্রতি পরস্পরবিরোধী আচরণ বিদ্যমান থাকতে পারে; ইউরোপীয় ইতিহাসে, কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করত যে চতুর লোক এবং চিরাচরিত চিকিৎসকেরা হচ্ছে ক্ষতিকারক কারণ তাদের চর্চাগুলো জাদুর বলে বিবেচিত আর এভাবে শয়তানের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে এগুলোর সূত্রপাত, যেখানে একটি স্থানীয় সম্প্রদায় হয়তবা এইসব ব্যক্তিদের মূল্যায়ন এবং শ্রদ্ধা করতে পারে কারণ তাদের দক্ষতা এবং সেবা উপকারী বলে বিবেচিত।<sup>[২৩৩]</sup>

১০:৫২, ২৬ মার্চ ২০২২ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

               

দ্য ম্যাজিশিয়ান, ১৯১৯ সালে প্রথম প্রকাশিত রাইডার-ওয়েট ট্যারোট ডেকের একটি চিত্র

জাদুবিদ্যা, মাঝে মাঝে লেখা হয় magick [১] এভাবে, হচ্ছে প্রাকৃতিক বা অতিপ্রাকৃত সত্ত্বা এবং শক্তিকে ব্যবহার করার জন্যে কিছু বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান বা কার্যক্রম সম্পাদন করা। [১] সাধারণভাবে ধর্ম এবং বিজ্ঞান উভয় থেকে আলাদা বলে বিবেচিত বিভিন্ন বিশ্বাস এবং রীতিনীতি এই জাতীয় বিশ্বাসে প্রয়োগ করা হয়। [২]

যদিও ইতিহাসের পর্যায়ক্রমে এর সংজ্ঞা ইতিবাচক থেকে নেতিবাচক হয়েছে, [৪] জাদুবিদ্যা 'বর্তমানে বহু সংস্কৃতিতে গুরুত্মপূর্ণ ধর্মীয় এবং ঔষধি ভূমিকা রেখে চলেছে। [৩]

পশ্চিমা সংস্কৃতিতে, জাদুবিদ্যার সাথে দ্বিতীয় [৬], ভিনদেশী [৭], এবং আদিমতার [৮] ধারণার সংযোগ করা হয়, এটি নির্দেশ করে যে জাদুবিদ্যা হচ্ছে 'সাংস্কৃতিক ভিন্নতার একটি শক্তিশালী নির্দেশক' [১০] এবং একইভাবে, একটি অনাধুনিক বিষয়। উনিশ শতকের শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, পশ্চিমা বুদ্ধিজীবীরা মনে করতেন যে জাদুবিদ্যার চর্চা হচ্ছে আদিম মানসিকতার একটি লক্ষণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য।[৯]

আধুনিক অতিপ্রাকৃতবিদ্যায় এবং নব্য-পৌত্তলিক ধর্মসমূহে, অসংখ্য আত্ম-বিশ্লেষিত জাদুকর এবং জাদুকরীরা নিয়মিত জাদুর রীতিনীতি পালন করেন[৪], তারা বলেন যে জাদু হচ্ছে কারও ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে বাস্তব পৃথিবীতে পরিবর্তন আনার একটি কৌশল। এই সংজ্ঞাটিকে জনপ্রিয় করে তোলেন অ্যালেস্টার ক্রাউলি (১৮৭৫-১৯৪৭), একজন প্রভাবশালী ইংরেজ অতিপ্রাকৃতবিদ, এবং তখন থেকে অন্যান্য ধর্ম (যেমন উইকা এবং লাভেয়ান স্যাটানিজম) এবং জাদু ব্যবস্থাসমূহ (যেমন ক্যাওস ম্যাজিক) এই সংজ্ঞা গ্রহণ করেছে।

ব্যুৎপত্তি

গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস পার্সিয়ান ম্যাগোই -এর প্রাচীনতম সংরক্ষিত বিবরণগুলির মধ্যে একটি প্রদান করেছেন

ইংরেজি ম্যাজিক, মেইজ এবং ম্যাজিশিয়ান শব্দসমূহের উৎপত্তি ল্যাটিন ম্যাগাস থেকে, যা এসেছে গ্রীক μάγος থেকে, যার উৎপত্তি প্রাচীন পার্সিয় maguš. (𐎶𐎦𐎢𐏁|𐎶𐎦𐎢𐏁, জাদুকর) থেকে[১২]। প্রাচীন পার্সিয় মাগু- এসেছে প্রোটো- ইন্দো- ইউরোপীয় মেঘ- মাঘ (সক্ষম) থেকে। পার্সিয় শব্দটি সম্ভবত প্রাচীন সিনিটিক *Mγag (জাদুকর বা ওঝা) -এ প্রভাব ফেলেছে।[১৩] প্রাচীন পার্সিয় শব্দটি সম্ভবত প্রাচীন সেমিটিক ভাষা যেমন টাল্মুডিক হিব্রু মাগশ, আরামাইক আমগুশা (জাদুকর), এবং ক্যাল্ডিও মাঘডিম (প্রাজ্ঞতা এবং দর্শন)-কে প্রভাবিত করেছে; এরপর খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে, সিরীয় মাগুসাই জাদুকর এবং ভবিষ্যৎবক্তা হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করে।[১৪]

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং পঞ্চম শতাব্দীর প্রথমদিকে, এই শব্দটি প্রাচীন গ্রীকে প্রবেশ করে, যেখানে তা প্রতারণাপূর্ণ, লৌকিকতাবর্জিত, এবং বিপজ্জনক বলে বিবেচিত রীতিগুলোকে নির্দেশ করতে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়।[১৫] ল্যাটিন ভাষা এই শব্দটির এই অর্থকে গ্রহণ করে খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে। ল্যাটিন থেকে, এই ধারণাটি খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে খ্রিস্টীয় তত্তে অন্তর্ভুক্ত হয়। সেকেলে খৃষ্টানরা জাদুবিদ্যাকে পিশাচের সাথে সংযুক্ত করতেন, এবং এভাবে একে খৃষ্টধর্মের বিরুদ্ধ বলে বিবেচিত করতেন। এই ধারণাটি মধ্য যুগে অব্যহত থাকে, যখন খৃষ্টান লেখকেরা বিবিধ রীতিনীতিসমূহকে তালিকাবদ্ধ করেন - যেমন বশীকরণ, ডাইনীবিদ্যা, ইন্দ্রজাল, ভবিষ্যৎ কথন, জাদুবিদ্যা, এবং জ্যোতিষবিদ্যা - এসবই পরে "জাদুবিদ্যা" পদের অধীনে। প্রাক-আধুনিক ইউরোপে, প্রটেস্টেন্টরা প্রায়শই দাবি করতেন যে রোমান ক্যাথলিসিজম ধর্ম নয় বরং জাদুবিদ্যা, এবং খৃষ্টান ইউরোপীয়রা যখন ষোড়শ শতাব্দীতে পৃথিবীর অন্য অংশগুলোকে উপনিবেশ বানাতে শুরু করলেন, তারা যেই অ- খ্রিষ্টীয় বিশ্বাসগুলোর দেখা পান সেগুলোকে জাদুকরী বলে আখ্যা দিতে শুরু করেন। সেই একই সময়ে, ইতালীয় মানবতাবাদীরা, এই সংজ্ঞাটিকে পুনরায় ব্যাখ্যা করেন প্রাকৃতিক জাদুর ধারণা হিসেবে ইতিবাচক সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করেন। এই সংজ্ঞাটির নেতিবাচক এবং ইতিবাচক ধারণাটি পরবর্তী শতাব্দীগুলোতে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে পুনরাবৃত্তি হয়।

উনবিংশ শতাব্দী থেকে, শিক্ষার বিভিন্ন শাখায় পণ্ডিতেরা জাদুবিদ্যা শব্দটিকে ব্যবহার করেছেন কিন্তু সেটাকে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন এবং বিভিন্ন জিনিসের প্রসঙ্গে ব্যবহার করেছেন। নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টাইলর (১৮৩২-১৯১৭) এবং জেমস জি. ফ্রেজার (১৮৫৪-১৯৪১)-এর সাথে জড়িত একটি পদ্ধতি, শব্দটিকে ব্যবহার করেন বিভিন্ন বস্তুর মধ্যে প্রচ্ছন্ন সহমর্মিতা যা একে অন্যকে প্রভাবিত করে সেই বিশ্বাসের বর্ণনা দিতে ব্যাখ্যা করেন। এভাবে সংজ্ঞায়িত করায়, জাদুবিদ্যা বিজ্ঞানের বিপরীত বলে অংকিত হয়। একটি কল্পিত পদ্ধতি, সমাজবিজ্ঞানী মারসেল মাউস (১৮৭২-১৯৫০) এবং তার চাচা এমিল দুরখেইম (১৮৫৮-১৯১৭)- এর সাথে জড়িত, শব্দটিকে ব্যবহার করেন ব্যক্তিগত রীতিনীতি এবং আচার- অনুষ্ঠানগুলোকে বর্ণিত করতে এবং একে ধর্মের বিপরীত বলে বর্ণনা করেন, ধর্মের সংজ্ঞা হচ্ছে একটি সাম্প্রদায়িক এবং সংগঠিত কার্যক্রম। ১৯৯০ সালের মধ্যে অসংখ্য বিদ্বানেরা পাণ্ডিত্যের সাথে শব্দটির উপযোগিতাকে অস্বীকার করতে শুরু করেন। তারা যুক্তি দেখান যে শব্দটি বিকল্পভাবে ধর্মীয় বলে বিবেচিত একই রকম বিশ্বাস এবং রীতির মধ্যে যথেচ্ছ সীমারেখা টানে, এবং এটি জাদুবিদ্যার সংজ্ঞা হিসেবে ব্যবহার করতে এথনোসেন্ট্রিক -পশ্চিমা এবং খ্রিষ্টীয় ইতিহাসে উত্থিত- অন্য সংস্কৃতির বিপরীতে- হিসেবে বিবেচিত।

শ্বেত, ধূসর এবং কালো

সাধারণত শ্বেত জাদুকে নিঃস্বার্থ বা সহায়তার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত জাদুকে বোঝায়, অন্যদিকে কাল জাদু স্বার্থপর, ক্ষতিকারক অথবা অশুভ উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত।[৫][৬] বাম-হাত পন্থা এবং ডান-হাত পন্থার শাখা অনুযায়ী, কাল জাদু হচ্ছে ক্ষতিকারক, উপকারী শ্বেত জাদুর বাম হাতের পরিপূরক। শ্বেত, ধূসর বা কাল জাদু কিভাবে গঠিত হয় তা নিয়ে কোন ঐক্যমত্য নেই, ফিল হাইন বলেন, 'অতিপ্রাকৃতবিদ্যার আরও অনেক দিকের মত, 'কাল জাদু' বলতে কি বোঝায় তা অনেকটুকুই নির্ভর করে কে সেটার সংজ্ঞা দিচ্ছে।'[৭] ধূসর জাদু, যাকে 'নিরপেক্ষ জাদুও' বলা হয়ে থাকে, হচ্ছে সেই জাদু যা কোন নির্দিষ্ট উপকারিতার জন্যে পালন করা হয় না, আবার সম্পূর্ণ বিদ্বেষপূর্ণ রীতিতেও নিবদ্ধ নয়।[৮][৯]

উচ্চ এবং নিম্ন

ইতিহাসবিদরা এবং নৃবিজ্ঞানীরা যারা উচ্চ জাদু, এবং নিম্ন জাদু নিয়ে চর্চা করেন তাদের মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করেছেন।[২১] উচ্চ জাদু, আচার-সংক্রান্ত বা আনুষ্ঠানিক জাদু বলেও পরিচিত[১০], হচ্ছে অনেক জটিল, দীর্ঘ এবং বিস্তারিত রীতিনীতি, একই সাথে পরিশীলিত, মাঝে মাঝে ব্যয়বহুল, সরঞ্জাম সম্বলিত।[২১] নিম্ন জাদু, প্রাকৃতিক জাদু নামেও পরিচিত, হচ্ছে কৃষিজীবী এবং লোককথার[১১] সাথে জড়িত, এবং সংক্ষিপ্ত, কথ্য জাদুমন্ত্র সম্বলিত সহজ রীতি সম্পৃক্ত। নিম্ন জাদু ডাইনীবিদ্যার সাথেও ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।[১২] নৃবিজ্ঞানী সুজান গ্রিনউড লিখেছেন যে "রেনেসাঁর সময় থেকে, উচ্চ জাদু স্বর্গ থেকে বল এবং শক্তি ডেকে আনা " এবং দেবত্বের সাথে ঐক্য অর্জনের সাথে সম্পর্কিত।[১৩] উচ্চ জাদু সাধারণত ঘরের ভেতরে আর ডাইনীবিদ্যা প্রায়শয়ই বাইরে চর্চা করা হয়।[১৪]

ইতিহাস

মেসোপটেমিয়া

নিও-অ্যাসিরিয় যুগের ব্রোঞ্জ সুরক্ষা ফলকে অংকিত লামাশতু রাক্ষস

জাদুবিদ্যা বিভিন্ন ধরণের রীতিনীতি এবং চিকিৎসাবিদ্যার সুত্রে, এবং অশুভ লক্ষণের নিবারণে ব্যবহার করা হত। মেসোপটেমিয়ায় (আক্কাডিয় ভাষায় আসিপুতু বা মাসমাসসুতু) প্রতিরক্ষামূলক বা বৈধ জাদু বলতে বোঝাত নির্দিষ্ট বাস্তবতাকে পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত জাদুমন্ত্র এবং রীতিনীতি। প্রাচীন মেসোপটেমীয়বাসীরা বিশ্বাস করতেন যে পিশাচ, প্রেতাত্মা, এবং অশুভ জাদুকরদের বিরুদ্ধে একমাত্র কার্যকরী প্রতিরক্ষা।[২৭] যে আত্মাদের সাথে তারা অন্যায় করেছেন তাদের থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তারা সেই মৃতদের কবরে তাদের সন্তুষ্ট করার জন্যে কিসপু নামের নৈবেদ্য রেখে আসতেন।[২৮] যদি তাতে কাজ না হত, তারা মাঝেমাঝে মৃত ব্যক্তির একটি মূর্তি মাটিতে প্রোথিত করতেন, দেবতাদের কাছে দাবি করতেন আত্মাটিকে দূর করতে, বা ব্যক্তিটিকে ছেড়ে যেতে বাধ্য করতে।[২৯]

প্রাচীন মেসোপটেমীয়বাসীরা অশুভ জাদুকর যারা তাদের অভিশাপ দিতে পারে তাদের থেকে নিজেদের রক্ষা করতেও জাদু ব্যবহার করতেন।[৩০] প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় কাল জাদু বলতে কোন কিছু ছিলনা, এবং একজন ব্যক্তি অবৈধ জাদুর থেকে নিজেকে রক্ষা করতে বৈধভাবে ব্যবহৃত জাদুতে একই কৌশল ব্যবহার করতেন।[৩০] একমাত্র প্রধান পার্থক্য ছিল অভিশাপ গোপনে সম্পন্ন করা হত; আর জাদুর বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা উন্মুক্ত স্থানে, যদি সম্ভব হয় তাহলে দর্শকদের সামনে সম্পাদিত হত।[৩০] কোন জাদুকরকে শাস্তি দেওয়ার একটি পদ্ধতি ছিল মাক্লু, বা 'পোড়ান।'[৩০] ডাইনীবিদ্যার শিকার বলে গণ্য ব্যক্তিটি জাদুকরটির একটি পুত্তলি বানিয়ে রাতের বেলায় সেটার বিচার বসাবেন।[৩০] তারপর, জাদুকরটির অপরাধসমূহের প্রকৃতি একবার নির্ধারিত হলে, সেই ব্যক্তিটি পুত্তলিকাটি পুড়িয়ে ফেলে তার উপরে জাদুকরের প্রভাব নষ্ট করে ফেলবে।[৩০]

অজ্ঞাতভাবে সম্পাদিত পাপ নিজেদের পরিশুদ্ধ করতেও প্রাচীন মেসোপটেমীয়বাসীরা জাদুর রীতিনীতি পালন করতেন।[৩০] এধরণের একটি রীতি ছিল সুরপু, বা "পোড়ান,"[৩১] যেখানে মন্ত্র নিক্ষেপকারী তাদের সবার অসৎকর্মের পাপ বিভিন্ন বস্তু যেমন খেজুরের একটি টুকরা, একটি পেয়াজ, এবং উলের একটি গোছা।[৩১] সেই ব্যক্তি তারপর সেই বস্তুগুলোকে পুড়িয়ে ফেলবেন আর এভাবে অজ্ঞাতভাবে সম্পাদিত সকল পাপ থেকে নিজেদের পরিশুদ্ধ করবেন।[৩১] প্রেমের মন্ত্রের এক সম্পূর্ণ শ্রেণীর অস্তিত্ব ছিল।[৩২] বিশ্বাস করা হত এসব মন্ত্র একজন ব্যক্তিকে আরেক ব্যক্তির প্রেমে ফেলবে, হ্রাস পাওয়া ভালবাসা পুনরুদ্ধার করবে, বা সহবাসের সময় পূর্বে অক্ষম একজন পুরুষের ঋজুতা ধরে রাখতে সাহায্য করবে।[৩২] অন্যান্য মন্ত্র ব্যবহার করা হত একজন ব্যক্তিকে তার রক্ষক দেবতার সাথে পুনর্মিলিত করতে বা একজন স্ত্রীকে তার স্বামী যে তাকে অবহেলা করছিল তার সাথে পুনর্মিলিত করতে।[৩৩]

প্রাচীন মেসোপটেমীয়বাসীরা মূলদ বিজ্ঞান এবং জাদুর মধ্যে কোন পার্থক্য করতেন না।[৩৪][১৫][১৬] যখন একজন ব্যক্তি অসুস্থ হয়ে পড়তেন, চিকিৎসকেরা তাকে ঔষধি চিকিৎসার সাথে সাথে জাদুর সূত্রও পড়ে শোনানর ব্যবস্থাপত্র দিতেন।[১৫][১৬][৩৭] বেশিরভাগ জাদুর আচার-অনুষ্ঠান একজন আসিপু, জাদুকলায় পারদর্শী একজন দ্বারা অনুষ্ঠিত হত।[১৫][১৬][৩৭][১৭] পেশাটি উত্তরাধিকারীরা বংশ পরম্পরাক্রমে অর্জন করতেন[৩৭] এবং অত্যন্ত সম্মানের সাথে দেখা হত এবং প্রায়শয়ই রাজা এবং মহান নেতাদের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করতেন।[৩৯] একজন আসিপু সম্ভবত শুধুমাত্র একজন জাদুকর হিসেবেই কাজ করতেন না, বরং একজন চিকিৎসক, একজন পাদ্রী, একজন লেখক, এবং একজন পণ্ডিত হিসেবেও।[৩৯]

সুমেরীয় দেবতা এনকি, যাকে পরবর্তীতে পূর্ব সুমেরীয় দেবতা এয়া'র সাথে সমন্বয় করা হয়েছিল, ছিলেন জাদুবিদ্যা এবং মন্ত্রের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত,[৪০] তিনি ছিলেন বারু এবং আসিপু'র পৃষ্ঠপোষক দেবতা এবং সকল গুপ্ত জ্ঞানের চূড়ান্ত উৎস হিসেবে ব্যাপকভাবে গণ্য ছিলেন।[৪১][১৮][১৯] প্রাচীন মেসোপটেমীয়বাসীরা অশুভ লক্ষণেও বিশ্বাস করতেন, যেগুলো অভিযাচিত বা অযাচিতভাবে আসত।[৪৪] যেভাবেই আসুক না কেন, অশুভ লক্ষণকে সবসময় অত্যন্ত গুরুত্মের সাথে নেওয়া হত।[৪৪]

জাদুমন্ত্র বাটি

মান্দাইক-ভাষার মন্ত্র বাটি

জাদুমন্ত্র বাটি বা জাদুর বাটি বলে পরিচিত সেকেলে একধরণের প্রতিরক্ষামূলক জাদুবিদ্যায় অশুভের কারণ এবং কিভাবে তা প্রতিহত করা যায় সে সম্পর্কে এক ধরণের সাধারণ সম্মিলিত বিশ্বাসের ধারণা পাওয়া যায়। এই বাটিগুলো মধ্যপ্রাচ্যে, বিশেষ করে উচ্চতর মেসোপটেমিয়া এবং সিরিয়ায় যা হচ্ছে বর্তমান ইরাক এবং ইরান সেখানে প্রস্তুত হত, এবং ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীতে বেশ জনপ্রিয় ছিল।[২০][২১] বাটিগুলো উল্টো করে প্রোথিত করা হত এবং পিশাচ ধরার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত। এগুলো সাধারণত দরজার চৌকাঠের নিচে, উঠোনে, সদ্যমৃতব্যক্তির বাড়ির কোণায় এবং গোরস্থানে রাখা হত।[২২] জাদুমন্ত্র বাটির আরেকটি ধরণ ব্যবহার করা হত ইহুদী জাদুবিদ্যায়। আরামাইক জাদুমন্ত্র বাটিগুলো ইহুদী জাদুবিদ্যার আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে জ্ঞান লানভের একটি গুরুত্মপূর্ণ উৎস।[২৩][২৪][২৫][২৬][২৭]

মিশর

প্রাচীন মিশরীয় তাবিজ হোরাসের চোখ

প্রাচীন মিশরে (মিশরীয় ভাষায় কেমেত), জাদুবিদ্যা (দেবতা হেকা হিসেবে রূপায়িত) ছিল ধর্ম এবং সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ যা আমাদের কাছে মিশরীয় ঐতিহ্যের সৃষ্ট রচনা সংকলনেরর এক সারগর্ভের মাধ্যমে আমাদের কাছে পরিচিত।[২৮]

যদিও জাদুবিদ্যা শ্রেণীটি আধুনিক মিশরীয় পুরাতত্ত্বে একটি বিতর্কিত বিষয়, প্রাচীন পরিভাষায় এর প্রযোজ্যতার ব্যাপারে স্পস্ত সমর্থন আছে।[২৯] কোপ্টিক শব্দ হিক এসেছে ফ্যারাও শব্দ হেকা, যার অর্থের সাথে, এর কোপ্টিক প্রতিরূপের মত কোন ধর্মহীনতা বা অবৈধতার কোন সম্পর্ক নেই, এবং পুরনো রাজ্য থেকে রোমান যুগ হয়ে প্রত্যয়িত হয়েছে।[২৯] হেকা-কে নৈতিকভাবে নিরপেক্ষ বিবেচনা করা হত এবং বিদেশী এবং মিশরীয় উভয়ের রীতিনীতি এবং বিশ্বাসে ব্যবহৃত হত।[৩০] মেরিকারে'র নির্দেশাবলী আমাদের জানায় যে হেকা ছিল মনুষ্যজাতির স্রষ্টার পক্ষ থেকে বদান্যতার একটি উপহার "... ঘটনাচক্রের আঘাত নিবারণের জন্যে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্যে।"[৩১]

জাদুবিদ্যা বিদ্বান পূজারি শ্রেণী এবং অশিক্ষিত কৃষক আর পশুপালক উভয়ই চর্চা করতেন, এবং হেকা'র তত্ত্ব সকল কার্যক্রমে বিদ্যমান ছিল, মন্দির এবং ব্যক্তিগত স্থান উভয়ে।[৩২]

হেকা'র মূল তত্ত্ব বস্তুসমূহে প্রাণ আনার জন্যে শব্দের ক্ষমতার উপরে কেন্দ্রীভূত ছিল।[৩৩] কারেঙ্গা[৩৪] শব্দ এবং উদ্ভিন্ন পৃথিবীকে প্রাণ দেওয়ায় স্রষ্টার তাদের অত্যাবশ্যক সত্ত্বাতত্ত্বীয় ভূমিকাকে প্রধান অস্ত্র হিসেবে ব্যাবহারের মুখ্য ভূমিকা ব্যাখ্যা করে। কারণ বিশ্বাস করা হত যে মানবজাতি দেবতাদের সাথে একটি ঐশ্বরিক স্বত্বার সংযোগ আছে, স্ননউ নটর (দেবতার প্রতিরূপ), মানবজাতি দেবতাদের মতই সৃজনশীলভাবে শব্দকে ব্যবহার করার ক্ষমতা উপভোগ করে।[৩৫]

হুনেফের-এর মৃতদের বই এর একটি চিত্রে কবরের সামনে মুখ গহ্বরের উদ্বোধনের অনুষ্ঠান দেখা যাচ্ছে

মৃতের বই

মিশরীয় পঞ্চম রাজবংশের শেষ ফারাও উনাসের পিরামিডের অভ্যন্তরীণ দেওয়ালগুলো শতশত জাদুর মন্ত্র এবং লিপিতে ঢাকা, উল্লম্ব স্তম্ভে মেঝে থেকে ছাদের দিকে উঠে গেছে।[৩৩]:৫৪ এই লিপিগুলো পিরামিড লিপি বলে পরিচিত এবং পরবর্তী জীবনে টিকে থাকার জন্যে ফারাওয়ের জন্যে প্রয়োজনীয় মন্ত্র আছে এখানে।[৩৩]:৫৪ পিরামিড লিপি সম্পূর্ণ রাজবর্গের জন্যে সীমাবদ্ধ ছিল;[৩৩]:৫৬ মন্ত্রগুলোকে সাধারণ জনগণ থেকে গুপ্ত রাখা হত এবং শুধুমাত্র রাজকীয় কবরে অভ্যন্তরে লেখা হত।[৩৩]:৫৬ তবে প্রথম অন্তর্বর্তী যুগের চরম বিশৃঙ্খলা এবং অস্থিরতার সময়, কবর লুটেরারা পিরামিডগুলোতে প্রবেশ করে এবং জাদুর লিপিগুলো দেখে ফেলে।[৩৩]:৫৬ সাধারণ জনগণ মন্ত্রগুলো শিখে যেতে শুরু করে এবং মধ্য সাম্রাজ্যের শুরুর দিকে, সাধারণ জনগণ একই লিপি নিজেদের শবাধারের পাশে লিখতে শুরু করে, এই আশায় যে এভাবে তারা পরবর্তী জীবনে নিজেদের টিকে থাকা নিশ্চিত করতে পারবে।[৩৩]:৫৫ এই লিপিগুলো শবাধার লিপি বলে পরিচিত।[৩৩]:৫৬

একজন পুরুষ বা নারী মৃত্যুবরণ করার পর, তার মৃতদেহকে মমিতে পরিণত করে লিনেন পট্টিতে মোড়ানো হয় মৃতদেহটি দীর্ঘদিন যেন টিকে থাকে[৩৬] কারণ মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে পরবর্তী জীবনে একজন ব্যক্তির আত্মা ততদিন টিকবে যতদিন তার দেহ এই পৃথিবীতে টিকে থাকবে।[৩৬] একজন মৃত ব্যক্তিকে কবরে সিলগালা করে ফেলার আগে সর্বশেষ অনুষ্ঠানটিকে মুখ গহ্বরের উদ্বোধনের অনুষ্ঠান বলে পরিচিত।[৩৬] এই অনুষ্ঠানে, যাজকেরা বিভিন্ন জাদু সরঞ্জাম মৃতদেহের বিভিন্ন অংশে ছোঁয়ান যা পরবর্তী জীবনে মৃত ব্যক্তিকে পরবর্তী জীবনে দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি, রসনেন্দ্রিয়, এবং ঘ্রাণশক্তি ডান করবে।

তাবিজ

তাবিজ (মেকেত)- এর ব্যবহার জীবিত এবং মৃত প্রাচীন মিশরীয়দের মধ্যে ব্যপক ছিল।[৩৭][৩৩] এগুলোকে প্রতিরক্ষা হিসেবে এবং "বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের মৌলিক ন্যায্যতার পুনঃনিশ্চিত" করতে ব্যবহার করা হত। আবিষ্কৃত সবচেয়ে প্রাচীন তাবিজ হচ্ছে বাদারিয়ান যুগের প্রাক-রাজবংশের, এবং সেগুলো রোমান যুগেও টিকে ছিল।

জুডিয়া

হালাখা-য় (ইহুদি ধর্মীয় আইন) ভবিষ্যদ্বাণী এবং অন্যান্য ভবিষ্যৎকথনকে নিষিদ্ধ, এবং তালমুদে বহু অটল কিন্তু নিন্দনীয় ঐশ্বরিক অনুষ্ঠানের তালিকা আছে।[৪০] ঐতিহাসিক ইহুদিধর্মে ব্যবহারিক কাব্বালাহ হচ্ছে জাদুর ব্যবহার সম্পর্কিত ইহুদী অতীন্ত্রবাদ প্রথার একটি শাখা। এর চর্চাকারীরা মনে করতেন এটি অভিজাতরা যারা এর আধ্যাত্মিক উৎসকে অশুভ রাজত্বের কিলফোথ থেকে আলাদা করতে পারেন যদি তা পবিত্র (Q-D-Š) এবং বিশুদ্ধ (טומאה וטהרה, tvmh vthrh )[৪১] পরিস্থিতিতে পালন করা হয়, তাদের জন্যে সংরক্ষিত অনুমোদিত শ্বেত জাদু। ইহুদীবাদের স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞাকে লঙ্ঘন করার উদ্বেগ একে ইহুদী ইতিহাসে একটি গৌণ প্রথা হিসেবে বিদ্যমান থাকা নিশ্চিত করেছে। এর শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত দৈবের ব্যবহার এবং তাবিজ আর মন্ত্রের দেবদূতসুলভ নাম।[৪২] ইহুদী লোক ধর্মের এইসব জাদুর রীতি যা ব্যবহারিক কাব্বালাহের অংশে পরিণত হয় তার উৎপত্তি তালমুদিক যুগে।[৪২] আরোগ্যলাভের জাদুমন্ত্র, এবং ইহুদী যাজকদের অনুমোদিত জাদুর চিকিৎসার এক ব্যাপক তালিকার উল্লেখ তালমুদে আছে। এই নির্দেশ জারি ছিল যে চিকিৎসার জন্যে ব্যবহৃত হয় এমন কোন চর্চাকে কুসংস্কার বলে বিবেচিত হবে না এবং ইতিহাসের পরিক্রমায় বিভিন্ন স্থানে ইহুদী সম্প্রদায়গুলোতে ঔষধি তাবিজ এবং লোক চিকিৎসার (সেগুলট) ব্যাপক ব্যবহার ছিল।[৪৩]

যদিও ইহুদী বাইবেলেলেভিটিকাল আইনে জাদুবিদ্যা নিষিদ্ধ ছিল, দ্বিতীয় টেম্পল যুগের শেষের দিকে তার ব্যাপক চর্চা ছিল, এবং বিশেষত ৩য়, ৪ঠা, এবং ৫ম খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীতে টেম্পল ধ্বংসের পরবর্তী যুগে উত্তমরূপে নথিভুক্ত করা হয়েছিল।[৪৪][৪৫][৪৬]

গ্রেকো-রোমান বিশ্ব

হেকেটে, যাদুবিদ্যার প্রাচীন গ্রীক দেবী

ইংরেজি শব্দ magic-এর উৎপত্তি প্রাচীন গ্রীসে[৭২] খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং পঞ্চম শতাব্দীর প্রথম দিকে, পার্সিয় শব্দ মাগুস-কে গ্রীকে রূপান্তরিত করা হয় এবং প্রাচীন গ্রীক ভাষায় μάγος এবং μαγεία হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[১৫] এভাবে এর অর্থের পরিবর্তন হয়, নেতিবাচক অর্থ লাভ করে, মাগস-কে দেখা হয় একজন হাতুড়ে চিকিৎসক হিসেবে যার আচার-অনুষ্ঠানগুলো হচ্ছে প্রতারণাপূর্ণ, অদ্ভুত, রীতিবিরুদ্ধ, এবং বিপজ্জনক।[১৫] ডেভিস প্রাচীন গ্রীকবাসীদের- এবং পরবর্তীতে রোমানদের সম্পর্কে- উল্লেখ করেন,"জাদুবিদ্যা ধর্ম থেকে আলাদা ছিল না বরং এর একটি অনভিপ্রেত, অশাস্ত্রীয় অভিব্যক্তি ছিল- দ্বিতীয়ের ধর্ম।"[৭৩] ঐতিহাসিক রিচারড গোরডন ইঙ্গিত দেন যে প্রাচীন গ্রীকবাসীদের জন্যে জাদুর চর্চার জন্যে অভিযুক্ত হওয়া ছিল "এক ধরণের অপমান।"[৭৪]

অর্থের এই পরিবর্তন ছিল গ্রীক নগররাষ্ট্রের সাথে পার্সিয় সাম্রাজ্যের তৎকালীন সামরিক দ্বন্দ্বের প্রভাব।[১৫] এই প্রসঙ্গে, শব্দটির উপস্থিতি দেখা যায় সফোক্লিসের এডিপাস রেক্স, হিপোক্রেটিসের ডে মোরবো স্যাক্রো, এবং গরগিয়াসের এনকোমিমাম অফ হেলেনে-এর মত বিদ্যমান রচনায়।[১৫] উদাহরণস্বরূপ, সফোক্লিসের নাটকে, এডিপাসের চরিত্র অসম্মানের সাথে ভবিষ্যৎবক্তা টাইরেসিয়াসকে ম্যাগোস বলে উল্লেখ করে- এখানে শব্দটির অর্থ কিছুটা হাতুড়ে চিকিৎসক বা চালিয়াতের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ - এ থেকে প্রমাণিত হয় যে এই বিশেষণটি আর শুধুমাত্র পারসিয়দের জন্যে সংরক্ষিত নয়।[৭৫]

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীতে, ম্যাগোস সম্পর্কে গ্রীকদের ধারণাটি ল্যাটিনে গৃহীত হয় এবং বেশ কিছুসংখ্যক প্রাচীন রোমান লেখকেরা একে ম্যাগুস এবং ম্যাগিয়া হিসেবে ব্যবহার করেন।[১৫] ল্যাটিন ভাষায় এ শব্দটির জ্ঞাত সবচেয়ে পুরনো ব্যবহার হচ্ছে ভার্জিলের একোলোগ-এ, ৪০ খৃষ্টপূর্বাব্দের দিকে রচিত, যেখানে ম্যাজিকিস ... সিক্রিস (জাদুর রীতিনীতি)-এর উল্লেখ আছে।[৭৬] আধ্যাত্মিক শক্তির নেতিবাচক ব্যবহারের জন্যে রোমানরা ইতিমধ্যেই অন্যান্য শব্দ ব্যবহার করতেন, যেমন ভেনেফিকাস এবং সাগা[৭৬] রোমানরা গ্রীকদের মত একই অর্থে শব্দটিকে ব্যবহার করতেন, কিন্তু এর বিচারিক ব্যবহারের উপর অধিক গুরুত্ম দিতেন।[১৫] রোমান সাম্রাজ্যে, জাদুবিদ্যা হিসেবে পরিগণিত সবকিছুকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে আইন জারি করা হয়।[৭৭]

প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যে, জাদুবিদ্যাকে সেই সাম্রাজ্যের পূর্বদিকের সমাজব্যবস্থার সাথে সম্পৃক্ত করা হত; উদাহরণস্বরূপ, প্রথম শতাব্দীর লেখ প্লিনি দ্যা এল্ডার দাবি করেন যে জাদুবিদ্যা সৃষ্টি করেছেন ইরানীয় দার্শনিক জোরোএস্টার , এবং জাদুকর অস্থ্যানিস যিনি পার্সিয় রাজা জারক্সিজ-এর সামরিক অভিযানের অনুষঙ্গী ছিলেন একে গ্রীসের পশ্চিমাঞ্চলে নিয়ে আসেন।[৭৮]

বিংশ শতাব্দীর প্রাচীন গ্রীক বিদ্যা প্রায় নিশ্চিতভাবেই জাদুবিদ্যা এবং ধর্মের অর্থ সম্পর্কে খ্রিষ্টীয় পূর্বধারণা প্রভাবিত, এবং গ্রীক সংস্কৃতিকে পশ্চিমা যুক্তিবিদ্যার ভিত্তি হিসেবে স্থাপন করার কামনা সৃষ্টি করে প্রাচীন গ্রীক জাদুবিদ্যাকে আদিম এবং তুচ্ছ , এবং এভাবে মূলত হোমারের সাম্প্রদায়িক (পোলিস) ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন এক তত্ত্বের। শতাব্দীর শেষ দশক থেকে অবশ্য, কাতাডেস্মই (বন্ধনের মন্ত্র)-এর মত কাজকে সর্বব্যাপিতা এবং মর্যাদা উপলব্ধি করে পণ্ডিতেরা এই দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে বাধ্য হন।[৪৭]ঃ৯০-৯৫ গ্রীক শব্দ ম্যাগেইও (জাদুবিদ্যা চর্চা)-এর উৎপত্তি হচ্ছে পূর্বে মূলত ধর্ম চর্চা করে এমন এক পার্সিয় জাতিকে দেওয়া গ্রীক নাম ম্যাগোস[৪৮] অ-নাগরিক গুপ্ত ধর্মমতগুলোকেও একইভাবে পুনরায় মুল্যায়ন করা হয়।[৪৭]ঃ৯৭-৯৮ ধর্মমতের পরিসীমার বাইরে অবস্থিত অভিমত নাগরিক তালিকায় অতিরিক্ত বিকল্পই যোগ করেনা, বরং, মাঝেমাঝে নাগরিক ধর্মমতের এবং প্যানহেলেনিক পুরাকথার একীভূত সমালোচনা ছিল সেগুলোর আসল বিকল্প। - সাইমন প্রাইস, রিলিজিওন্স অফ দ্যা এনশিয়েন্ট গ্রীকস (১৯৯৯)[৮১]

কালাডেসমই (ল্যাটিনঃ ডেফিক্সিওন্স), হচ্ছে মোমের বা সীসার ফলকে ক্ষোদিত এবং মাটির নিচে প্রোথিত অভিশাপ, যা গ্রীক সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ প্রতিনিয়ত ব্যবহার করতেন, মাঝেমাঝে গোটা পোলিস-কে রক্ষা করতে।[৪৭]ঃ৯৫-৯৬ সাম্প্রদায়িক অভিশাপগুলো সর্বসাধারণের সামনে পালন করা গ্রীক ক্লাসিকাল যুগের পর সংখ্যায় কমে আসে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে অভিশাপ প্রাচীনকালে প্রচলিত থাকে।[৪৯] এগুলোর নিজস্ব, সহায়ক এবং অলক্ষুণে গুণের কারণে এদেরকে জাদুময় বলে বিশিষ্ট করা হত।[৪৭]ঃ৯৬ এই গুণগুলো এবং স্বাভাবিকতার সহজাত পরিবর্তনীয় সাংস্কৃতিক ধারণা থেকে এগুলোর অনুভূত বিচ্যুতি, স্পষ্টতই প্রাচীন জাদুবিদ্যাকে ধর্মীয় রীতিনীতি যার একটি অংশ তারা, তাকে অংকিত করে।[৪৭]ঃ১০২-১০৩

গ্রীক, কপ্টিক, এবং ডেমোটিক ভাষায় এক বিশাল সংখ্যক জাদুময় প্যাপিরি আবিষ্কার এবং অনুবাদ করা হয়েছে।[৪৯] এগুলোতে প্রাচীন উদাহরণ আছে এসবেরঃ

  • বিশ্বাস করা হত যে জাদুর শব্দগুলো আত্মাকে আদেশ দিতে পারে;[৫১]
  • আত্মা আহ্বান বা আবির্ভূত করতে সহায়ক রহস্যময় চিহ্ন বা প্রতীকের ব্যবহার।[৫২]

কোডেক্স থিওডোসিয়ানাস প্রদেশগুলোতে (৪৩৮ খ্রি.পূ.) রোমান বিশ্বে শেষের দিকে জাদুবিদ্যা চর্চা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।[৫৩]

অতএব যদি কোন জাদুকর বা কোন জাদুকরের রীতি অনুযায়ী আহ্বায়িত জাদু দ্বারা প্রভাবিত ব্যাক্তিকে... অবশ্যই আমার অথবা সিজারের অনুচরদের দ্বারা গ্রেপ্তার হতে হবে, তার মর্যাদাক্রমের সুরক্ষা সত্ত্বেও সে শাস্তি এবং অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না।

মধ্য যুগ

প্রথম খৃষ্টাব্দে, তৎকালীন খৃষ্টান লেখকেরা জাদুবিদ্যা সম্পর্কে গ্রেকো-রোমান ধারণা গ্রহণ করেন এবং সেটাকে তাদের উঠতি খৃস্টীয় ধর্মতত্ত্বে একীভূত করেন।[৭৭] এইসব খৃষ্টানরা শব্দটির গ্রেকো-রোমান প্রচলিত বাঁধাধরা নেতিবাচক অর্থটি বজায় রাখেন এবং সেগুলোকে ইহুদী চিন্তা থেকে ধারণাগত আদর্শ ধার করেন, বিশেষ করে জাদুবিদ্যা এবং অলৌকিক ঘটনার বিরোধিতাকে।[৭৭] তৎকালীন কিছু খৃষ্টান লেখকেরা মানবজগত জাদুবিদ্যার উৎস এই গ্রীক-রোমান ভাবনাকে অনুসরণ করতেন, প্রধানত জোরোএস্টার এবং অস্থ্যানিস। খৃষ্টান দৃষ্টিভঙ্গিটি ছিল এরূপ, যে জাদুবিদ্যা হচ্ছে ব্যাবিলনিয়, পার্সিয়, বা মিশরীয়দের দ্বারা সৃষ্ট।[৮৭] খৃষ্টানরা পূর্বের ক্লাসিকাল সংস্কৃতির এই ধারণা যে জাদুবিদ্যা হচ্ছে পরিপূরণ ধর্ম থেকে আলাদা এই ধারণায় বিশ্বাস করতেন, যদিও এই দুইয়ের মধ্যে তাদের প্রভেদটি ভিন্নরকম ছিল।[৮৮]

সেভিলের মধ্যযুগীয় লেখক ইসিডোর, যিনি জাদুময় বলে বিবেচিত কার্যকলাপের তালিকে নির্মাণ করেছিলেন তার ১৭ শতাব্দীর একটি চিত্র

প্রাচীন খৃষ্টান লেখক যেমন হিপ্পোর অগাস্টিনের জন্যে, জাদুবিদ্যা শুধুমাত্র ভুয়া এবং অপবিত্র রীতি দ্বারা গঠিত নয়, বরং তা ধর্মের সম্পূর্ণ বিপরীত কারণ এটি শয়তানের ভৃত্য প্রেতাত্মাদের সহযোগিতার উপর নির্ভরশীল।[৭৭] এতে, জাদুবিদ্যার সম্পর্কে খৃস্টীয় ধারণাটি পৌত্তলিকতার ব্যাপারে খৃস্টীয় তালিকার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত[৮৯], এবং জাদুবিদ্যা এবং পৌত্তলিকতা উভয়ই সুপারস্টিটো (কুসংস্কার), প্রাক-খৃস্টীয় রোমান সংস্কৃতি থেকে ধার করা আরেকটি পদের বিশদ তালিকার অন্তর্ভুক্ত বলে বিবেচিত ছিল।[৮৮] উত্তম ধর্মের বিরোধি জাদুবিদ্যার সহজাত নীতিভ্রষ্টতা এবং অন্যায়ের উপর এই খৃস্টীয় জোরদান ছিল সেই যুগের অন্যান্য বৃহৎ একেশ্বরবাদী ধর্ম, ইহুদীবাদ এবং ইসলামের ধারণা থেকে আরও অনমনীয়।[৯০] উদাহরণস্বরূপ, খৃষ্টানরা প্রেতাত্মাদের সম্পূর্ণ অশুভ বলে গণ্য করতেন, ইসলামি পুরাণে মুসলমানেরা সদৃশ সত্ত্বা, জীনদের অধিকতর প্রতিকূল সৃষ্টি বলে মনে করতেন।[৯০]

খৃস্টীয় চিন্তায় জাদুকরদের ধারণাটি সাইমন ম্যাগাস (জাদুকর সাইমন), যিনি এক্টস অফ দ্যা এপোসোল এবং অপ্রামাণিক কিন্তু প্রভাবশালী এক্টস অফ পিটার-এর সেইন্ট পিটারের বিরোধিতা করেছেন, তার দ্বারা প্রবর্তিত।[৯১] ঐতিহাসিক মাইকেল ডি. বেইলি মন্তব্য করেছেন যে মধ্যযুগীয় ইউরোপে, জাদুবিদ্যা ছিল একটি "অপেক্ষাকৃত বিস্তৃত এবং পরিবেষ্টিত প্রকার।"[৯২] খৃস্টীয় ধর্মবিদেরা বিশ্বাস করতেন যে জাদুবিদ্যার বিভিন্নপ্রকার রুপ আছে, যার বেশিরভাগই ভবিষ্যৎকথনের প্রকারভেদ, উদাহরণস্বরূপ, সেভিলের ইসিডোর একটি তালিকা নির্মাণ করেছিলেন যেসব বস্তুকে তিনি জাদুময় বলে মনে করতেন যেখানে তিনি ভবিষ্যৎকথনকে চারটি উপাদান, ভূতত্ত্ব, জলতত্ত্ব, বায়ুতত্ত্ব, অগ্নিতত্ত্ব, সেইসাথে পাখিদের উড্ডয়ন এবং জ্যোতিষবিদ্যার মত প্রাকৃতিক দশার পর্যবেক্ষণ দ্বারা তালিকাভুক্ত করেন। তিনি বশীকরণ এবং বন্ধনী (রোগীদের দেহে জাদুর বন্ধনের চিকিৎসাবিষয়ক ব্যবহার)-কে জাদুময় বলে উল্লেখ করেন।[৯৩] মধ্যযুগীয় ইউরোপে জাদুবিদ্যাকে যুক্ত করা হয় ওল্ড টেস্টামেন্টের চরিত্র সলোমোনের সাথে; বিশ্বাস করা হত যে গ্রন্থগুলো সলোমোন রচনা করেছিলেন কিছুসংখ্যক গ্রিমোয়ারস, বা জাদুবিদ্যা চর্চার রূপরেখা সম্বলিত গ্রন্থসমূহ, বিশেষ করে কি অফ সলোমোন[৯৪]

মধ্যযুগীয় ইউরোপে শুরুর দিকে, ম্যাজিয়া ছিল ভর্ত্সনার একটি শব্দ।[৯৫] মধ্যযুগীয় ইউরোপে, খৃষ্টানরা প্রায়ই মুসলমান এবং ইহুদীদের জাদুচর্চায় লিপ্ত থাকার সন্দেহ করত;[৯৬] কিছু ক্ষেত্রে, এইসব উপলব্ধ জাদুর রীতিনীতির- ইহুদী কর্তৃক খৃষ্টান শিশু বলির তথাকথিত অভিযোগ সহ- ফলাফল হত খৃষ্টানদের হাতে এইসব ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের হত্যাকাণ্ড।[৯৭] খৃষ্টান গোষ্ঠীগুলোও প্রায়শই অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী খৃষ্টান গোষ্ঠীগুলোকে- যাদেরকে তারা মতবিরোধী মনে করত- দোষারোপ করত জাদুর কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার।[৯১] মধ্যযুগীয় ইউরোপে ক্ষতি সংঘটনের উদ্দেশ্যে চর্চিত জাদুর প্রকার বলে পরিচিত ম্যালেফিসিয়াম প্রচলিত ছিল।[৯২] পরবর্তী মধ্যযুগগুলোতে এইসব ক্ষতিকর জাদুর চর্চাকারীদের বিভিন্ন ইউরোপীয় ভাষায় বিভিন্ন নাম প্রাদুর্ভূত হয়ঃ ফ্রেঞ্চ ভাষায় সরসিয়ের, জার্মান ভাষায় হেক্সে, ইতালিয় ভাষায় স্ট্রেগা, এবং স্প্যানিশ ভাষায় ব্রুহা[৯৮] ইংরেজি ভাষায় অনিষ্টকারী জাদুর চর্চাকারীদের নাম, ডাইনি-এর উৎস প্রাক-প্রাচীন ইংরেজি শব্দ উইচে[৯৮]

পুরো মধ্যযুগে আরস ম্যাজিকা বা জাদুবিদ্যা হচ্ছে আধ্যাত্মিকতার বিশ্বাস এবং চর্চার এবং অনেক ক্ষেত্রে শারীরিক আরোগ্যলাভে একটি প্রধান অংশ এবং সহায়ক অবদান রেখেছিল। জাদুবিদ্যা সম্পর্কে ভুল ধারণার একটি খেই অনেক আধুনিক ব্যাখ্যা থেকে উদ্ভূত, যারা এর চর্চা করে তাদের অনিষ্টকরতা বা পৈশাচিক সত্ত্বার অস্তিত্ব সম্পর্কিত। এইসব ভুল ধারনাগুলোর উৎপত্তি প্রাচীনকালে সংঘটিত অসংখ্য কর্ম বা রীতি থেকে, এবং সাধারণ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গিতে এগুলোর ভিনদেশিতার কারনে, রীতিগুলো অস্বস্তি এবং বর্জনের আরও শক্তিশালী অনুভূতির উদ্রেক করে।[৫৪][৫৫]

বিভিন্ন জাদুমন্ত্রের প্রতিক সম্বলিত (হিব্রু ভাষায় (סגולות সেগুলোট)সেফার রাজিয়েল হামালাখ-এর একটি উদ্ধৃতাংশ

১৪দশ শতাব্দীর শুরুর দিকে মধ্যযুগীয় ইহুদী দৃষ্টিভঙ্গী, কাব্বালাহের গুপ্ত এবং জাদুময় উপাদানসহ, দূরকল্পী আধ্যাত্মিকতাবাদ কাব্বালাহ-কে (কাব্বালাহ লিইউনিট) এর ধ্যানমগ্ন ঐতিহ্য, এবং অলৌকিক ব্যবহারিক কাব্বালাহ (কাব্বালাহ মা'আসিত)-এ বিভক্ত করা হয়।[৫৬]

মধ্যযুগে একক সাধারণের থেকে বেশি শক্তিশালী একটি সামাজিক বল ছিল, খৃষ্টান গির্জা কর্তৃক জাদুবিদ্যার সম্পূর্ণ প্রত্যাখ্যান কারণ একে বাইবেলের ডিইউটেরেনোমির ১৮ঃ৯-১২ শ্লোকের সাথে সংযুক্ত অতিপ্রাকৃত ধরণে প্রাকৃতিক পৃথিবীতে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হত। জাদুবিদ্যা শব্দটির সাথে নেতিবাচক বহু অর্থের সংযুক্ততা থাকা সত্ত্বেও, ঐশ্বরিক বা পবিত্র আলোতে দেখা বহু উপাদানও তখন বিদ্যমান ছিল।[৫৭]

মধ্যযুগে জাদুবিদ্যায় ব্যবহৃত বহুসংখ্যক যন্ত্রপাতি বা রীতিনীতির কিছু হলঃ বিভিন্ন তাবিজ, কবচ, মিকচার, তারসাথে নির্দিষ্ট মন্ত্র, নৃত্য, এবং প্রার্থনা। এইসব রীতিনীতির সাথে ছিল এদের উপর প্রভাবশালী পৈশাচিক অংশ সম্পর্কিত প্রতিকূল রঞ্জিত ধারণা। জাদুবিদ্যা পরিকল্পিত, শিক্ষণীয়, এবং পিশাচদের দ্বারা চর্চিত এই ধারণাটি এমন যেকোন ব্যক্তির কাছে যৌক্তিক মনে হবে যিনি গ্রীক জাদুময় প্যাপিরি বা সেফের-হা-রাজিম পড়েছেন এবং আবিষ্কার করেছেন যে চিকিৎসা-সম্পর্কিত জাদু মানুষ বধ করা, সম্পদ অর্জন, অথবা ব্যক্তিগত সুবিধা, এবং নারীদের দৈহিক সম্পর্কে বাধ্য করার রীতির পাশাপাশি আবির্ভূত হয়েছিল।[১০৩] গৃহে, দেহে এবং মঠে আর গির্জায় চর্চিত রীতিনীতিগুলো সম্পর্কে আরও উত্তম ধারণা দিচ্ছে পুরাতত্ত্ব।[৫৮][৫৯]

জাদুবিদ্যার প্রতি ইসলামের প্রতিক্রিয়া অর্থ সাধারণভাবে জাদুর বিরোধিতা নয় বরং অসুস্থতা আর ভূতাবিষ্টের আরোগ্য লাভ, এবং ডাকিনীবিদ্যার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। প্রথমটি হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার তরফ থেকে একটি বিশেষ উপহার, আর পরবর্তীটি জীন আর শয়তানের সাহায্যে অর্জিত। ইবনে-আল-নাদিম বিশ্বাস করতেন যে ভূতের ওঝারা সৃষ্টিকর্তার প্রতি তদের আনুগত্য থেকে তাদের ক্ষমতা অর্জন করেন, আর ডাকিনীবিদরা অবাধ্যতার কাজ করে এবং বলিদান করে পিশাচদের খুশি করে তাদের কাছ থেকে এর বিনিময়ে অনুগ্রহ লাভ করে।[৬০] ইবনে আরাবি'র মতে আল-হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ আল-শুবারবুলি তার ধার্মিকতার কারণে পানির উপরে হাঁটতে পারতেন।[৬১] কুরআন অনুযায়ী, সুলেমানের ইসলামিক কিংবদন্তী অনুযায়ী, মানবজাতিকে জাদুবিদ্যা শেখায় পিশাচেরা। সুলেমান ডাকিনীবিদের কাছ থেকে রচনাগুলো নিয়ে যান এবং সেগুলোকে তার সিংহাসনের নিচে লুকিয়ে রাখেন। তার মৃত্যুর পর, ইবলিশ, সুলেমানের দরবারের কাছাকাছি যাওয়াতে অক্ষম হওয়ায়, জনগণকে বলে যে তারা সিংহাসনের নিচে গুপ্তধন খুঁজে পাবে এবং এভাবে তাদেরকে ডাকিনীবিদ্যার দিকে নিয়ে যায়। আরেক বর্ণনা অনুযায়ী, মানবজাতির কাছে নির্বাসিত ফেরেশতা হারুত এবং মারুত জাদুবিদ্যা নিয়ে আসে।[৬২]

1658 সালে লন্ডনে প্রকাশিত ন্যাচারাল ম্যাজিকের একটি ইংরেজি অনুবাদের ফ্রন্টিসপিস

প্রাক-আধুনিক যুগে, জাদুবিদ্যা সম্পর্কে ধারণা আরও ইতিবাচক পুনঃমুল্যায়িত হত ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস (প্রাকৃতিক জাদুবিদ্যা)-এর ধারণার সম্প্রসারের কারণে।[৭৭] এই শব্দটি দুইজন ইতালীয় মানবতাবাদী মারসিলো ফিসিনো এবং জিওভানি পিকো ডেলা মিরান্ডোলা কর্তৃক প্রবর্তিত এবং বিকশিত।[৭৭] তারা ম্যাজিয়াকে বহু প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে পরিব্যাপ্ত করা একটি আধিভৌতিক বল হিসেবে দেখতেন,[৭৭] এবং এভাবে পৈশাচিক জাদুবিদ্যা সম্পর্কে খৃষ্টানদের মূলধারার ধারণা থেকে মৌলিকভাবে আলাদা ছিল। [১০৯] তাদের ধারণা পরবর্তী অনেক দার্শনিক এবং লেখকদের প্রভাবিত করে, তাদের মধ্যে ছিলেন প্যারাসেলসাস, জিওরডানো ব্রুনো, জোহানেস রিউক্লিন এবং জোহানেস ট্রিথেমিয়াস[৭৭] ঐতিহাসিক রিচারড কিয়েকহেফের-এর মতে, ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস -এর ধারণাটি চতুর্দশ এবং পঞ্চদশ শতাব্দীতে "ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে দৃঢ়স্থান" অর্জন করে,[১১০] এরিস্টটল, নিওপ্লেটোনিস্ট, এবং হারমিটিসিস্ট- মতাবলম্বীদেরসহ বিভিন্ন তত্ত্বীয়বাদের প্রাকৃতিক দার্শনিকদের আকৃষ্ট করে।[১১১]

এই দৃষ্টিভঙ্গির অনুগতরা তর্ক করতেন যে ম্যাজিয়া ভাল এবং খারাপ উভয়ভাবেই প্রকাশিত হতে পারে; ১৬২৫ সালে, ফরাসী গ্রন্থাগারিক গ্যাব্রিয়েল নউডে তার এপোলোজি ফর অল দ্যা ওয়াইজ মেন ফলসলি সাস্পেক্টেড অফ ম্যাজিক রচনা করেন, যাতে তিনি "মোজোয়াইকাল ম্যাজিক"কে- তিনি দাবি করেন এটি ঈশ্বরের কাছ থেকে এসেছে এবং ভবিষ্যৎবাণী, অলৌকিক ঘটনা, এবং বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা- পিশাচদের দ্বারা সংঘটিত "জিওটিক" জাদুবিদ্যা থেকে আলাদা করেন।[১১২] যখন ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস -এর প্রবক্তারা জোর দেন যে এইসব পিশাচদের কর্মকাণ্ডের উপর নির্ভর করেনা, তখন সমালোচকেরা বিমত পোষণ করেন, এই যুক্তিতে যে পিশাচেরা এইসব জাদুকরদের প্রতারিত করেছে।[১১৩] সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যে ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস-এর ধারণা ক্রমবর্ধমানভাবে "প্রকৃতিবাদী" দিকে সরে যায়, এটির এবং বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যটি অস্পষ্ট হয়ে উঠে।[১১৪] বিশ্বকে বোঝার জন্যেম্যাজিয়া ন্যাচারালিসের ধারণার বৈধতা তখন অষ্টাদশ শতাব্দীর আলোকিত যুগে ক্রমবর্ধমান সমালোচনার মুখে পড়ে।[১১৫]

ইতিবাচক অর্থে ম্যাজিয়া শব্দটিকে পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, পশ্চিমা বিশ্বে তা জাদুবিদ্যার প্রতি চিরাচরিত মনোভাব অপসারণ করতে পারেনি, এটি বিশালাংশে নেতিবাচকই থাকে।[১১৫] একইসময়ে ম্যাজিয়া ন্যাচারালিস যখন আগ্রহ জন্মাচ্ছিল এবং বৃহতাংশে সহ্য করা হচ্ছিল, ইউরোপে তখন ম্যালেফিসিয়া-য় দোষী সাব্যস্ত অভিযুক্ত ডাইনিদের সক্রিয়ভাবে নিগ্রহ করা হচ্ছিল।[১১১] শব্দটির চলমান নেতিবাচক সংলগ্নতা প্রতিফলিত করে, প্রটেস্টেন্টরা প্রায়শই রোমান ক্যাথলিক জাদুময় এবং ভক্তিমূলক রীতিনীতিগুলোকে ধার্মিকতার চেয়ে জাদুময় বলে হেয় করতেন।[১১৬] বহু রোমান ক্যাথলিকেরা এই অভিযোগ নিয়ে চিন্তিত ছিলেন এবং বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন রোমান ক্যাথলিক লেখকেরা তাদের রীতিনীতি জাদুর নয় বরং ধার্মিক এই বিতর্কে মনোনিবেশ করেন।[১১৭] একই সময়ে, প্রটেস্টেন্টরা প্রায়শই তাদের প্রতিযোগী অন্যান্য প্রটেস্টেন্ট সম্প্রদায়গুলোর বিরুদ্ধে জাদুবিদ্যার অভিযোগ আনতেন।[১১৮] এভাবে, জাদুবিদ্যার ধারণাটিকে ধার্মিক বিশ্বাস এবং রীতিনীতি হিসেবে উপযুক্ত বলে গণ্য বিহিত করা হত।[১১৭] এই সময়ে একই ধরণের দাবি ইসলামিক বিশ্বেও তোলা হচ্ছিল। আরবীয় মাওলানা মুহাম্মদ ইবনে আব্দ আল-ওয়াহাব- ওয়াহাবি মতবাদের প্রবক্তা- উদাহরণস্বরূপ ভবিষ্যৎবাণী এবং সিহর বলে গণ্য সত্ত্বার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, যেটাকে তিনি পালাক্রমে এক ধরণের শিরক, প্রতিমাপূজার পাপ বলে দাবি করেন- এগুলোর মত বিভিন্ন রীতি আর চর্চাকে নিষিদ্ধ করেন।[১১৯]

রেনেসাঁ

রেনেসাঁ মানবতাবাদ এক পুনরুত্থান দেখে সন্ন্যাসবাদ এবং নব্য-প্লেটোবাদ- এর বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক জাদুবিদ্যায়। রেনেসাঁ, অন্যদিকে, বিজ্ঞানের উত্থানের মুখ দেখে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কিত টলেমি'র তত্ত্বের খারিজ, জ্যোতিষবিদ্যা থেকে জ্যোতির্বিদ্যার, এবং আলকেমি থেকে রসায়নের পার্থক্য ইত্যাদির মাধ্যমে।[৬৩]

কুসংস্কার, অতিপ্রাকৃতবিদ্যা, এবং সম্পূর্ণ বৈধ পাণ্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান বা ধার্মিক রীতিনীতির চর্চার মধ্যে পার্থক্যে বিশাল অনিশ্চয়তা ছিল। বুদ্ধিগত এবং আধ্যাত্মিক চাপা উত্তেজনার সূত্রপাত হয় প্রাক-আধুনিক ডাকিনীবিদ্যা উন্মত্ততায়, তা আরও শক্তিশালী হয় প্রটেস্টেন্ট সংস্কারের অশান্তি দ্বারা, বিশেষত জার্মানি, ইংল্যান্ড, এবং স্কটল্যান্ডে[৬৩]

হাসিবাদে, ব্যাবহারিক কাব্বালাহের চর্চাকে সরাসরি জাদুবিদ্যার মাধ্যমে উৎখাত, ধারণাগত এবং ধ্যানরত প্রবণতার দ্বারা আরও গভীর জোরদান অর্জন করে, সেইসাথে একইসঙ্গে এর সামাজিক অতীন্ত্রিবাদের কেন্দ্রবিন্দু ছিল পার্থিব আশীর্বাদের জন্যে ধ্যানমগ্ন অলৌকিকতার প্রবর্তন।[৬৪] হাসিবাদ কাব্বালাহকে ডেভেইকুট (ঈশ্বরের বিভক্ততা), এবং জাদিক (হাসিবাদের পাদ্রী)-এর বিভক্ততার মাধ্যমে অন্তরীণ করে নেয়। হাসিবাদ মতবাদ অনুযায়ী, তার অনুসারীদের জাদ্দিক ঐশ্বরিক আধ্যাত্মিক এবং শারীরিক দানকে সরবরাহ করে ঈশ্বরের ইচ্ছাকে বদলে (আরও গভীর একটি ইচ্ছা উন্মোচনের মাধ্যমে) তার নিজের ডেভেইকুট এবং আত্ম-অকার্যকারিতার মাধ্যমে। এই তত্ত্বকে জাদিকের ইচ্ছা পরিবর্তনের এবং ঐশ্বরিক ইচ্ছার সিদ্ধান্ত থেকে সরাসরি জাদুময় প্রক্রিয়ার পার্থক্য করার সাথে ডোভ বের অফ মেজেরিচ জড়িত।[৬৫]

ঊনবিংশ শতাব্দীতে, হাইতির সরকার ভুডুকে জাদুবিদ্যার একটি রূপ হিসাবে বর্ণনা করে এর বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন শুরু করে; এটি ভুডু চর্চাকারীদে ধর্ম সম্পর্কে তাদের নিজস্ব ধারণার সাথে বিরোধপূর্ণ। [১২৩]

ষোড়শ শতাব্দীতে, ইউরোপীয় সম্প্রদায়গুলো পৃথিবীর অন্যান্য মহাদেশগুলোকে জয় করে উপনিবেশ বানাতে শুরু করে, এবং এভাবে তারা যেসব ব্যাক্তিদের দেখা পেল তাদের মাঝে জাদুবিদ্যা এবং ডাকিনীবিদ্যা সম্পর্কিত ইউরোপীয় ধারনাগুলোকে প্রয়োগ করতে শুরু করল।[১২৪] সাধারণত, এইসব ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকরা স্থানীয় ব্যাক্তিদের আদিম এবং বর্বর হিসেবে গণ্য করত যাদের বিশ্বাস হচ্ছে নারকীয় এবং যেগুলোকে নির্মূল করতে হবে এবং খৃষ্টান ধর্ম দ্বারা প্রতিস্থাপিত করতে হবে। [১২৫]যেহেতু ইউরোপীয়রা সাধারণত এইসব অ-ইউরোপীয় মানুষদের নৈতিকভাবে এবং বুদ্ধিগতভাবে নিজেদের থেকে নিকৃষ্ট মনে করত, তারা ভাবত যে এইসব সম্প্রদায়গুলোর জাদুবিদ্যা চর্চায় অধিকতর প্রবণতা থাকবে।[১২৬] যেসব নারী গতানুগতিক আচার-অনুষ্ঠান পালন করতেন ইউরোপীয়রা তাদের ডাইনি বলে আখ্যা দিত।[১২৬]

বিভিন্ন ক্ষেত্রে, এইসব অনুপ্রবেশকারী ইউরোপীয় ধারণা এবং শব্দ দেশীয় ধারণার সাথে মিশে গিয়ে নতুনভাবে রূপান্তরিত হয়।[১২৭] উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিম আফ্রিকায়, পর্তুগীজ ভ্রমণকারীরা তাদের ফেটকারিয়া (প্রায়শয়ই মায়াবিদ্যা হিসেবে অনুবাদকৃত) শব্দটি এবং এর ধারণা আর ফেটিকো (মন্ত্র), যেখানে এটিকে ফেটিশ ধারণায় পরিবর্তিত করা হয়, শব্দগুলো এবং এগুলোর ধারণা স্থানীয় জনগণের মাঝে প্রবর্তন করে।[১২৭] যখন পরবর্তী ইউরোপীয়রা এইসব পশ্চিম আফ্রিকার সম্প্রদায়গুলোর দেখা পায়, তারা ভুলভাবে বিশ্বাস করে যে ফেটিচে হচ্ছে প্রাক-আন্তঃমহাদেশীয় সাক্ষাতের ফলাফল নয় বরং স্থানীয় আফ্রিকান শব্দ। মাঝেমাঝে, ঔপনিবেশিক জনগণ নিজেরা এইসব ইউরোপীয় ধারণাগুলোকে নিজস্ব উদ্দেশ্যে গ্রহণ করত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, জা-জ্যাক ডেসসালাইনেসের নব্য স্বাধীন হাইতি সরকার ভুডু-র চর্চা দমন করতে শুরু করেন, এবং ১৮৩৫ সালে আইনি-ভাষায় সকল ভুডু চর্চাকে সরটিলেগে (মায়াবিদ্যা/ ডাকিনীবিদ্যা) বলে লিপিব্দধ করে, এই ইঙ্গিত করে যে এগুলো সব ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে পালন করা হয়, আর ভুডু চর্চাকারীরা ইতিমধ্যেই ক্ষতি করার অনুষ্ঠানগুলোকে ম্যাজাই নামে একটি পৃথক এবং স্বতন্ত্র তালিকায় রাখা হয়।[১২৩]

বারোক যুগ

এই যুগের মায়াবিদ্যা বা জাদুর বিষয়ের লেখকদের মধ্যে রয়েছেন:

  • মাইকেল সেন্ডিভোগিয়াস (১৫৬৬-১৬৩৬)
  • টমাসো ক্যাম্পানেলা (১৫৬৮-১৬৩৯)
  • জ্যাকব বোহমে (১৫৭৫-১৬৫০)
  • জ্যা ব্যাপটিস্ট ভ্যান হেলমন্ট (১৫৭৭-১৬৪৪)
  • ফ্রাঞ্জ কেসলার (১৫৮০-১৬৫০)
  • আদ্রিয়ান ভন মাইনসিচ্ট (১৬০৩-১৬৩৮)
  • স্যার কেনেলম ডিগবি (১৬০৩-১৬৬৫)
  • জোহান ফ্রেডরিখ শোয়েটজার (১৬২৫-১৭০৯)
  • আইজ্যাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭), আইজ্যাক নিউটনের মায়াবিদ্যা অধ্যয়ন

আধুনিক যুগ

ঊনবিংশ শতাব্দীতে, ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীরা জাদুবিদ্যার চর্চাকে পাপ হিসেবে দিয়ে দেখত না বরঞ্চ জাদুবিদ্যার চর্চা এবং বিশ্বাসকে "প্রভাবশালী সাংস্কৃতিক যুক্তির বিরোধী ধারণার একটি স্খলিত রূপ- মানসিক বিকলতার একটি লক্ষণ এবং জাতিগত বা সাংস্কৃতিক নিকৃষ্টতার চিহ্ন" বলে গণ্য করত।[১২৮]

পশ্চিমা সমাজে অভিজাতরা ক্রমবর্ধমান হারে জাদুবিদ্যা চর্চার ফলপ্রসূতাকে যখন প্রত্যাখ্যান করছে, আইনি ব্যাবস্থা জাদুবিদ্যা চর্চাকারীদের পৈশাচিক এবং ডাকিনীবিদ্যার অপরাধে শাস্তির হুমকি দেওয়া বন্ধ করল, এবং এর বদলে তাদের সক্ষমতার বাইরে মানুষকে বিভিন্ন বস্তু দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মাধ্যমে প্রতারণা করার অভিযোগে তাদেরকে হুমকি দেয়।[১২৯]

পৃথিবী জুড়ে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক ক্ষমতার এই বিসতৃতি প্রভাবিত করে শিক্ষাবিদরা কিভাবে জাদুবিদ্যার ধারণা গঠন করবে।[১৩০] ঊনবিংশ শতাব্দীতে, বেশকিছু পণ্ডিত জাদুবিদ্যার চিরাচরিত, নেতিবাচক ধারণাটিকে গ্রহণ করেন।[১১৫] তারা যে এটা করা বেছে নেবেন তা অনিবার্য ছিলনা, কারণ তারা সেই সময়ের হেলেনা ব্লাভাটস্কি- যিনি একটি ইতিবাচক অর্থে জাদুবিদ্যা শব্দটি এবং ধারণাটিকে-এর মত সক্রিয় রহস্যবাদীদের দ্বারা গৃহীত উদাহরণগুলোকে হয়তবা অনুসরণ করেছিলেন।[১১৫] বিভিন্ন লেখকেরা জাদুবিদ্যার ধারণাটিকে ব্যবহার করেছিলেন ধর্মের সমালোচনা করার জন্যে এই যুক্তিতে যে ধর্মে তখনও জাদুবিদ্যার বহু নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে মার্কিন সাংবাদিক এইচ. এল. মেঙ্কেনের ১৯৩০ সালে প্রকাশিত তার বিতর্কিত গ্রন্থ ট্রিটিস অন দ্যা গডস; তিনি জাদুবিদ্যার সাথে ধর্মের তুলনা করে ধর্মের সমালোচনা করার চেষ্টা করেন, তর্ক করেন যে এই দুটোর মধ্যে পার্থক্য ভুল স্থানে স্থাপিত।[১৩১] জাদুবিদ্যার ধারণাটি মনোবিজ্ঞানের নতুন শাখার তাত্ত্বিকদের দ্বারাও গৃহীত হয়েছিল, যেখানে তা প্রায়শয়ই কুসংস্কারের সাথে একই অর্থে ব্যবহার করা হত, যদিও পরবর্তী শব্দটি পূর্বের মনোবিজ্ঞানের গ্রন্থগুলোতে বেশি প্রচলিত ছিল।[১৩২]

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এবং বিংশ শতাব্দীতে, লোকসাহিত্যিকরা ইউরোপের গ্রাম্য সম্প্রদায়গুলোকে জাদুবিদ্যা চর্চার জন্যে পরীক্ষা করেন, সেই সময়ে তারা সাধারণত মনে করতেন এটি হচ্ছে প্রাচীন বিশ্বাস ব্যাবস্থার অবশিষ্টাংশ।[১৩৩] ১৯৬০ সালের দিকে জান ফাভ্রে-সাদা-এর মত নৃবিজ্ঞানীরা ইউরোপীয় প্রসঙ্গে জাদুবিদ্যা নিয়ে গভীর নিরীক্ষা শুরু করেন, পূর্বে তারা অ-পশ্চিমা প্রসঙ্গে জাদুবিদ্যার উপর মনোনিবেশ করতেন।[১৩৪] বিংশ শতাব্দীতে, জাদুবিদ্যা অধিবাস্তববাদী- ইউরোপে উদ্ভাবিত একটি শৈল্পিক আন্দলন-দের কাছেও জাদুবিদ্যা একটি আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়, উদাহরণস্বরূপ অধিবাস্তববাদ আন্দ্রে ব্রেটন ১৯৫৭ সালে লা'আর্ট ম্যাজিক প্রকাশ করেন, জাদুবিদ্যা এবং শিল্পের মধ্যে যাকে তিনি যোগসূত্র বলে মনে করতেন সেটার আলোচনা করে।[১৩৫]

যে কোন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গে প্রয়োগ করা সুই জেনেরিস-এর একটি প্রকার হিসেবে জাদুবিদ্যাকে পণ্ডিতদের প্রয়োগটির যোগসূত্র ছিল পশ্চিমা এবং অ-পশ্চিমা উভয়ের শ্রোতাবৃন্দের কাছে আধুনিকতার উত্তরণ।[১৩৬]

জাদুবিদ্যা শব্দটি জনপ্রিয় কল্পনা এবং বাগধারায় অনুপ্রবেশ করে।[৮] সাম্প্রতিক প্রসঙ্গে, জাদুবিদ্যা শব্দটি মাঝেমাঝে ব্যবহৃত হত "এক প্রকারের উত্তেজনা, বিস্ময়, বা আকস্মিক আনন্দের বর্ণনা দিতে," এবং "এক ধরণের উচ্চ প্রশংসার" প্রসঙ্গে।[১৩৭] বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে এর ঐতিহাসিক বৈপরীত্য সত্ত্বেও, বিজ্ঞানীরা শব্দটিকে বিভিন্ন ধারণা, যেমন ম্যাজিক এসিড, ম্যাজিক বুলেট, এবং ম্যাজিক এঞ্জেলস[৮]

চিত্র:Aleister Crowley.jpg
আধুনিক আনুষ্ঠানিক জাদুর অনেক ধারণা অ্যালিস্টার ক্রাউলি'র ধারণা দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত।

আধুনিক পশ্চিমা জাদুবিদ্যা সাম্প্রতিক ধর্ম এবং আধ্যাত্মিকতাবাদ সম্পর্কিত ব্যাপক পূর্ব ধারণার বিরোধিতা করে।[১৩৮] জাদুবিদ্যা সম্পর্কিত বিতর্কিত আলোচনাগুলো আধুনিক জাদুকরদের আত্মবোধকে প্রভাবিত করে, যাদের বেশ কয়েকজন- যেমন আলেইস্টার ক্রাউলি এবং জুলিয়াস ইভোলা- ছিলেন এই বিষয়ের অধ্যয়নের সাহিত্যে জ্ঞানী ছিলেন।[১৩৯] ধর্ম বিষয়ক পণ্ডিত হেনরিক বগড্যান-এর মতে ক্রাউলি প্রদত্ত জাদুবিদ্যা সম্পর্কিত সংজ্ঞাটি, "যৌক্তিকভাবে সর্ববিদিত এমিক সংজ্ঞা।"[১৩৯] ক্রাউলি- যিনি magic এর বদলে 'magick' বানানটি অধিকতর পছন্দ করতেন একে মঞ্চের ভেলকি থেকে আলাদা করতে[১]- বিশ্বাস করতেন যে জাদুবিদ্যা হচ্ছে ঐশ্বরিক ইচ্ছার সাথে অনুসারী সাধিত পরিবর্তনের বিজ্ঞান এবং শিল্প।"[১৩৯] ক্রাউলির সংজ্ঞা পরবর্তী জাদুকরদের প্রভাবিত করে।[১৩৯] উদাহরণস্বরূপ ফ্র্যাটারনিটি অফ দ্যা ইনার লাইটেডিওন ফরচুন মন্তব্য করেন যে "জাদুবিদ্যা হচ্ছে ঐশ্বরিক ইচ্ছানুযায়ী চেতনার পরিবর্তনের শিল্প।"[১৩৯] জেরাল্ড গার্ডনার, গার্ডনারিয়ান উইকা-এর প্রতিষ্ঠাতা বলেন যে, জাদুবিদ্যা হচ্ছে, "শারীরিকভাবে অস্বাভাবিকতা সংঘটনের প্রচেষ্টা,"[১৩৯] আর এন্টন লাভে, লাভেয়ান স্যাটানিজম-এর প্রতিষ্ঠাতা, জাদুবিদ্যাকে বর্ণনা করেন এভাবে, "একজনের ইচ্ছাশক্তিনুযায়ী অবস্থা বা ঘটনার পরিবর্তন, যা সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে অপরিবর্তনীয়।"[১৩৮]

বিশৃঙ্খলা জাদুবিদ্যা আন্দোলন বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে আবির্ভূত হয়, অন্যান্য অতিপ্রাকৃত ঐতিহ্যের প্রতীকী, আচার-অনুষ্ঠানের, তত্ত্বীয় বা অন্যপ্রকারের আলঙ্কারিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচ্যুত এবং জাদুবিদ্যাকে মৌলিক কৌশলের একটি গুচ্ছে পরিণত করার এক প্রচেষ্টা।[৬৬]

জাদুবিদ্যা সম্পর্কিত এইসব আধুনিক পশ্চিমা ধারণাগুলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পরিব্যাপ্ত এক অজানা অতিপ্রাকৃত শক্তির সাথে সংযুক্ত রচনাবলীর উপর নির্ভরশীল ছিল।[১৪১] হানেগ্রাফের মতে, এটি পরিচালিত হত "জাদুবিদ্যার এক নব্য অর্থ, যা পূর্বের যযুগগুলোতে সম্ভবত বিদ্যামান ছিলনা, বিশেষত কারণ এটি "বিশ্বের মোহমুক্তির" প্রতিক্রিয়ায় বিশদ।"[১৪১]অনেকের কাছে, এবং সম্ভবত বেশিরভাগ আধুনিক পশ্চিমা জাদুকরেরা, ধারণা করা হয় যে জাদুবিদ্যার উদ্দেশ্য হচ্ছে ব্যক্তিগত আত্মিক উন্নয়ন।[১৪২] আত্ম-উন্নয়নের একটি প্রকার হিসেবে জাদুবিদ্যাকে দেখার উপলব্ধিটি আধুনিক পৌত্তলিকতা এবং নব্যযুগ প্রপচের বিভিন্ন প্রকারে জাদুবিদ্যার রীতিনীতি যেভাবে গ্রহণ করা হয়েছে তার কেন্দ্রবিন্দু।[১৪২] আধুনিক জাদুবিদ্যা রীতিনীতির একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হচ্ছে যৌন জাদুবিদ্যা[১৪২] এই রীতিটি প্যাশকাল বেভারলি র‍্যান্ডলফ-এর রচনায় প্রকাশিত হয় এবং পরবর্তীকালে ক্রাউলি আর থিওডর রিউস-এর মত অতিপ্রাকৃত জাদুকরদের মধ্যে গভীর আগ্রহের উদ্রেক করে।[১৪২]

আধুনিক অতিপ্রাকৃতবিদদের দ্বারা গৃহীত জাদুবিদ্যা শব্দটি কিছুক্ষেত্রে হতে পারে সাধারণত শক্তির প্রভাবশালী ব্যবস্থাগুলোকে পরাভূত করার পশ্চিমা সম্প্রদায়ের সেইসব ক্ষেত্র যেগুলো প্রান্তিক বলে বিবেচিত সেগুলোর জয়জয়কার করার একটি ইচ্ছাকৃত প্রচেষ্টা।[১৪৩] উদাহরণস্বরূপ, প্রভাবশালী মার্কিন উইকান এবং লেখক স্টারহক বলেন যে, "জাদুবিদ্যা হচ্ছে মানুষকে অস্বস্তিতে ফেলার আরেকটি শব্দ, তাই আমি এটাকে ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যবহার করি, কারণ আমরা যেসব শব্দ আমাদের আরাম দেয়, যে শব্দগুলো শুনতে গ্রহণীয়, যৌক্তিক, বৈজ্ঞানিক, এবং বুদ্ধিগতভাবে সঠিক বলে মনে হয়, হচ্ছে আরামদায়ক কারণ সেগুলো বিরহের ভাষা।"[১৪৪] বর্তমানকালে, কিছু সংস্কৃতিবিরুদ্ধ উপদলগুলোর কাছে শব্দটি "cool" বলে বিবেচিত।"[৬৭]

পাপুয়া নিউ গিনি'র আইনে, জাদুবিদ্যা একটি আইনত সঙ্গত ধারণা, যা চিকিৎসা এবং সন্তানধারণ ক্ষমতার মত বৈধ শুভ জাদু, এবং ব্যাখ্যাহীন মৃত্যুর জন্যে দায়ী অবৈধ কাল জাদুর মধ্যে পার্থক্য প্রভেদ করে।[৬৮]

ধারণাগত বিকাশ

নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড এভান এভানস-প্রিচারড'এর মতে, জাদুবিদ্যা আফ্রিকার আজান্দে সম্প্রদায়ের মত কিছু সংস্কৃতিতে বিশ্বাস এবং জ্ঞানের মূলদ কাঠামো গঠন করেছে।[৬৯] ইতিহাসবিদ ওয়েন ডেভিস মন্তব্য করেন যে জাদুবিদ্যা শব্দটি "সাদাসিধা সংজ্ঞার সীমার বাইরে,"[১৪৮] এবং এর "ব্যাপক অর্থ বিদ্যমান।"[১৪৯] মাইকেল ডি. বেইলি জাদুবিদ্যাকে "একটি গভীরভাবে বিতর্কিত প্রকার"[১৫০] এবং অত্যন্ত আশঙ্কাপূর্ণ একটি তকমা" বলে তালিকায়িত করেন, তিনি উল্লেখ করেন যে, এটি ছিল "গভীরভাবে অস্থির" কারণ শব্দটির এইসব সংজ্ঞাগুলো "কালের বিবর্তনে আর বিভিন্ন সংস্কৃতিতে নাটকীয়ভাবে বৈচিত্র্যপূর্ণ।"[১৫১] জাদুবিদ্যার সংজ্ঞা কিভাবে দেওয়া যায় তা নিয়ে বিশেষজ্ঞরা ব্যাপক বিতর্কে জড়িয়েছেন,[১৫২] এসব বিতর্ক জন্ম দেয় চরম দ্বন্দ্বের।[১৫৩] এইসব বিতর্কের মাঝে, বিশেষজ্ঞদের গোষ্ঠীগুলো জাদুবিদ্যার একটি সংজ্ঞা সম্পর্কে একমত হতে অপারগ হয়েছেন, ধর্মের একটি সংজ্ঞা দিতে একমত হতে তারা একইভাবে অপারগ হয়েছিলেন।[১৫৩] ধর্ম বিশেষজ্ঞ মাইকেল স্টাউসবারগ মানুষের দ্বারা জাদুবিদ্যার ধারণাটি নিজেদের এবং তাদের রীতিনীতি আর বিশ্বাসকে নির্দেশ করতে ব্যবহার করার প্রপচটির সবচেয়ে পুরনো নির্দেশনা প্রাচীনযুগের শেষের দিক বলে উল্লেখ করেন। যদিও, ইতিহাসের পাতায় যারা নিজেদের জাদুকর বলে বর্ণনা করেছেন, তাদের মধ্যেও জাদুবিদ্যা কি কোন একমত ছিলনা।[১৫৪]

আফ্রিকায়, জাদুবিদ্যা শব্দটি সাদামাটাভাবে একটি কর্ম হিসেবে নৈতিক বলে গণ্য হতনা এবং তদনুসারে জাদুবিদ্যার চর্চার প্রথম থেকে একটি নিরপেক্ষ কর্ম, কিন্তু বিশ্বাস করা হয় যে জাদুকরের ইচ্ছায় তা শুভ বা খারাপ (অশুভ)-এর প্রতিনিধিত্ব করে এমন ফলাফলে পরিণত হয় এবং লাভ করে এমন এক শক্তির ব্যবস্থাপনাকে নির্দেশ করে।[৭০][৭১] প্রাচীন আফ্রিকান সংস্কৃতি সাধারণত সর্বদা জাদুবিদ্যা, এবং অন্যান্য জিনিস যেগুলো জাদুর নয় যেমন ঔষধ, ভবিষ্যৎকথন, ডাকিনীবিদ্যা এবং মায়াবিদ্যা'র মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করত।[৭২] ধর্ম এবং জাদুবিদ্যা কিভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্কিত সহ শ্রদ্ধার বিকাশ এবং কোনটা থেকে কোনটি বিকশিত হয়েছে সে ব্যাপারে অভিমতগুলো বিভিন্ন প্রকারের, কেউ কেউ ভাবেন যে এগুলো একটি শরীক উৎস থেকে একসাথে বিকশিত হয়েছে, কেউ কেউ ভাবেন যে ধর্ম জাদুবিদ্যা থেকে বিকশিত হয়েছে, এবং কেউ কেউ ভাবেন যে জাদুবিদ্যা ধর্ম থেকে এসেছে।[৭৩]

জাদুবিদ্যা সম্পর্কিত নৃতত্ত্বীয় এবং সমাজবিদ্যাগত তত্ত্বগুলো কোন একটি সমাজে সাধারণত অন্যথায় সদৃশ চর্চাগুলো থেকে নির্দিষ্ট চর্চাকে তীব্রভাবে নির্ধারিত করে।[৮৮] বেইলি'র মতে, "বহু সংস্কৃতিতে এবং ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে, জাদুবিদ্যার প্রকারভেদ প্রায়শয়ই সামাজিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে গৃহীত ঐশ্বরিক বা অতিপ্রাকৃত স্বত্বা বা শক্তির সাথে সম্পর্কিত কর্মগুলোকে সংজ্ঞায়িত এবং সীমাবদ্ধতাকে বজায় রাখে। তদধিক, মূলত, এগুলো সুসংগত বিশ্বাসের ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করার সেবা করে থাকে।"[১৫৯] এতে, তিনি উল্লেখ করেন যে "এই পার্থক্যগুলো নিরূপণ করা এক প্রকার শক্তি প্রয়োগ।"[১৫৯] এই প্রবণতাটি জাদুবিদ্যার গবেষণায় প্রতিক্রিয়া রাখে, শিক্ষাবিদদের পেশায় এর প্রভাবের জন্যে তারা নিজেদের গবেষণা কাজকে আত্ম-সমালোচনা করেন।[৭৪]

র‌্যান্ডাল স্টাইয়ার্স উল্লেখ করেছেন যে জাদুকে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা করা "একটি সীমানা নির্ধারণের কাজ" এর প্রতিনিধিত্ব করে যার দ্বারা এটি "অন্যান্য সামাজিক অনুশীলন এবং জ্ঞানের পদ্ধতির" যেমন ধর্ম এবং বিজ্ঞানের বিপরীতে যুক্ত হয়। [১৬১] ইতিহাসবিদ কারেন লুইস জলি জাদুকে "বর্জনের একটি বিভাগ, ধর্ম বা বিজ্ঞানের বিপরীত চিন্তাভাবনার একটি অগ্রহণযোগ্য উপায়কে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যবহৃত" হিসাবে বর্ণনা করেছেন।[১৬১]

আধুনিক শিক্ষা জাদুবিদ্যার বিভিন্ন প্রকারের সংজ্ঞা এবং তত্ত্ব প্রবর্তন করেছে।[১৬৩] বেইলি'র মতে, "এইসব সাধারণত জাদুবিদ্যাকে ধর্ম এবং বিজ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত করেছে বা এদের থেকে স্বতন্ত্রভাবে উপস্থাপন করেছে।[১৬৩] ধর্ম এবং সামাজিক বিজ্ঞানের গবেষণার শুরু থেকে, জাদুবিদ্যা "তত্ত্বীয় সাহিত্যের একটি মুখ্য বিষয়" ছিল যা এইসব অধ্যয়নে কর্মরত বিশেষজ্ঞদের দ্বারা রচিত।[১৫২] জাদুবিদ্যা হচ্ছে ধর্ম গবেষণায় একটি অতি ব্যাপক তাত্ত্বিক ধারনাগুলোর একটি,[১৬৪] এবং এটি নৃবিজ্ঞানের শুরুর তাত্ত্বিকতায় এক গুরুত্মপূর্ণ ভূমিকা রাখে।[১৬৫] স্টায়ারস বিশ্বাস করতেন যে এটি সামাজিক তাত্ত্বিকদের কাছে এত শক্তিশালী আবেদন রেখেছিল কারণ এটি "প্রকৃতি এবং আধুনিকতার সীমারেখা গ্রন্থবদ্ধ এবং বিরোধিতা করার এক প্রাচুর্যময় স্থান" সরবরাহ করে।[১৬৬] গবেষকরা সাধারণত একে ধর্মের বিপরীত এক ধারণা হিসেবে ব্যাবহার করেছেন, জাদুবিদ্যাকে ধর্মের "অবৈধ (এবং মেয়েলি) সহোদর" বলে বিবেচনা করেছেন।[১৬৭] বিপরীতভাবে, অন্যরা একে ধর্ম এবং বিজ্ঞানের মাঝামাঝি এক প্রকার হিসেবে ব্যাবহার করেছেন।[১৬৭]

জাদুবিদ্যার আলোচনা বিশেষজ্ঞরা যে পরিপ্রেক্ষিতে করেছিলেন তা আধুনিক যুগে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক ক্ষমতার বিস্তৃতি দ্বারা প্রভাবিত ছিল।[১৩০] জাদুবিদ্যার সংজ্ঞা দেওয়ার এইসব বারংবার প্রচেষ্টা বৃহত্তর সামাজিক ধারণার সাথে সদৃশ ছিল,[১০] এবং ধারণাটির নমনীয়তা একে "একটি বিতর্কিত এবং ভাবাদর্শগত ধারণা হিসেবে সহজেই গ্রহণীয়" করে তোলে।[১১৭] বুদ্ধিজীবীরা যাদেরকে তারা আদিম বলে বিশেষায়িত করতেন, তাদের মধ্যে আর জাদুবিদ্যার মধ্যে যে সূত্রগুলো ইউরোপীয় এবং ইউরো-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশিকতাকে বৈধ করে, যেহেতু এইসব পশ্চিমা ঔপনিবেশিকরা এই মত পোষণ করতেন যে যারা জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস করত এবং এর চর্চা করত তারা নিজেদের পরিচালনা করতে অক্ষম এবং যারা জাদুবিদ্যার বদলে বিজ্ঞান এবং/অথবা (খৃষ্টান) ধর্মে বিশ্বাস করে তাদের দ্বারা তাদের শাসিত হওয়া উচিত।[৯] বেইলি'র মতে, "কিছু মানুষের (অ-ইউরোপীয় বা দরিদ্র, গ্রাম্য ইউরোপীয় যেই হক), জাদুবিদ্যার সাথে সম্পৃক্ততা তাদেরকে যারা শাসন করে তাদের থেকে তাদেরকে দূরে স্থাপন করে এবং পৃথক করে, এবং ব্যাপকভাবে সেই শাসনকে ন্যায্যতা প্রদান করে।"[৭]

বিশেষজ্ঞরা জাদুবিদ্যার বিভিন্ন সংজ্ঞা প্রদান করেছেন, যদিও হানেগ্রাফের মতে- এইসবকে প্রচণ্ড প্রভাবশালী তত্ত্বের ক্ষুদ্র সংখ্যক প্রকারভেদ বলে ধরে নেওয়া যায়।"[১৬৪]

বুদ্ধিগত অভিগমন
এডওয়ার্ড টাইলর, একজন নৃবিজ্ঞানী যিনি সমবেদীজাদুর, একটি ধারণা যা তিনি তার সর্বপ্রাণবাদ ধারণার সাথে যুক্ত করেছিলেন, প্রসঙ্গে জাদু শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন,

জাদুবিদ্যার সংজ্ঞা দিতে বুদ্ধিগত অভিগমন দুইজন প্রখ্যাত ইংরেজ নৃবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড টাইলর এবং জেমস জি. ফ্রেজার-দের সাথে সম্পর্কিত।[১৬৮] এই অভিগমন জাদুবিদ্যাকে বিজ্ঞানের তাত্ত্বিক বিপরীত বলে গণ্য করত,[১৬৯] এবং এই বিষয়ে বহু নৃতাত্ত্বিক ধারণাকে সর্বাগ্রে দখল করে।[১৭০] এই অভিগমনটি বিবর্তনবাদী আদর্শের অভ্যন্তরে অবস্থিত ছিল যা ১৯ শতকের গোড়ায় সামাজিক বিজ্ঞানের চিন্তাকে সমর্থন করে।[১৭১] জাদুবিদ্যাকে বিবর্তনবাদী ক্রমবিকাশে ধর্মের পূর্ববর্তী বলে যেই সামাজিক বিজ্ঞানি প্রবর্তন করেন তিনি হচ্ছেন হারবারট স্পেন্সার,[১৭২] তার এ সিস্টেম অফ সিন্থেটিক ফিলোসোফি-এ, তিনি সমবেদী জাদুবিদ্যার প্রসঙ্গে জাদুবিদ্যা শব্দটিকে ব্যবহার করেন।[১৭৩] স্পেন্সার জাদুবিদ্যা এবং ধর্ম উভয়ের উৎস বস্তুর প্রকৃতি এবং সেগুলোর সাথে অন্য বস্তুর সম্পর্কের ব্যাপারে ভুল ধারণায় বলে গণ্য করতেন।[১৭৪]

টাইলারের জাদুবিদ্যার ব্যাপারে উপলব্ধি সর্বপ্রাণবাদের ধারণার সাথে সংযুক্ত।[১৭৫] ১৮৭১ সালে তার গ্রন্থ প্রিমিটিভ কালচার-এ টাইলার জাদুবিদ্যাকে "আদর্শ উপমাকে প্রকৃত উপমা হিসেবে গণ্য করার ভ্রান্তি" বলে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেন।[১৭৬] টাইলারের মতে, "আদিম মানব, সত্যের সাথে সংশ্লিষ্ট যেসব বস্তুকে সে অভিজ্ঞতার দ্বারা আবিষ্কার করে সেগুলোকে ধারণার সাথে সংশ্লিষ্ট করে, ভুলক্রমে এই কর্মকে ওল্টানোর প্রচেষ্টা করে, এবং সেই ধারণার সেই সংশ্লিষ্টতা নিশ্চয়ই বাস্তবে সদৃশ সংশ্লিষ্টতা আছে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া। তিনি এভাবে আবিষ্কার করার, পূর্ব অনুমান করার, এবং এখন আমরা যেগুলোকে একটি আদর্শ তাৎপর্য আছে বলে দেখি সেইসব প্রক্রিয়াগুলোকে সম্পাদন করেন।"[১৭৭] টাইলার জাদুবিদ্যাকে খারিজ করতেন, একে "মানবপ্রজাতিকে জ্বালাতন করা ভ্রমগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকারকগুলোর একটি" বলে বর্ণনা করেন।[১৭৮] টাইলারের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচণ্ড প্রভাবশালী ছিল,[১৭৯] এবং জাদুবিদ্যাকে নৃবিজ্ঞানের গবেষণায় একটি প্রধান প্রসঙ্গ বলে স্থাপিত করে।[১৭২]

জেমস ফ্রেজার জাদুকে মানব বিকাশের প্রথম পর্যায় হিসাবে বিবেচনা করেছিলেন, যা ধর্ম এবং তারপর বিজ্ঞান দ্বারা অনুসৃত হয়

টাইলারের ধারণাগুলো জেমস ফ্রেজার গ্রহণ করে আরও সরলীকৃত করেন।[১৮০] তিনি জাদুবিদ্যা শব্দটিকে সমবেদী জাদু বোঝাতে ব্যবহার করেন,[১৮১] একে জাদুকরের বিশ্বাস "যে বস্তুসমূহ দূরত্ব থেকে একটি গুপ্ত সমবেদনার সাথে একে অপরকে প্রভাবিত করে," যাকে তিনি "একটি অদৃশ্য ইথার" বলে বর্ণনা করেন-এর উপর নির্ভরশীল একটি চর্চা বলে বর্ণনা করেন।[১৭৭] তিনি এই জাদুবিদ্যাকে আরও দুইপ্রকারের বিভক্ত করেন, "হোমিওপ্যাথিক" (অনুকারী, অনুকরণকারী) এবং "সঙ্ক্রামক।"[১৭৭] প্রথমটি হচ্ছে "অনুরূপ অনুরূপের জন্ম দেয়," বা দুটি বস্তুর মধ্যে সাদৃশ্য একে অন্যকে প্রভাবিত করতে পারে এই ধারণা। পরবর্তী ধারণাটি এই ধারণার উপর ভিত্তি করা যে দুটি বস্তুর মধ্যে দ্বন্দ্ব সেই দুটি বস্তুকে দূর থেকে একে অপরকে প্রভাবিত করতে থাকে।[১৮২] টাইলারের মত, ফ্রেজার জাদুবিদ্যাকে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতেন, একে বর্ণনা করেন এভাবে "বিজ্ঞানের জারজ সহোদরা," "এক বিশাল সর্বনাশা হেত্বাভাস" থেকে উৎপন্ন।[১৮৩]

টাইলারআর ফ্রেজারের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে জাদুবিদ্যার একটি বিশ্বাসকে মানবতার সাংস্কৃতিক বিকাশের একটি প্রধান ধাপ বলে বিশেষায়িত করেন, একে একটি ত্রিধার একটি অংশ বলে বর্ণনা করেন যেখানে জাদুবিদ্যা প্রথম, ধর্ম দ্বিতীয়, এবং অবশেষে বিজ্ঞান তৃতীয় স্থানে আসে।[১৮৪] ফ্রেজারের কাছে, সকল আদি সমাজব্যবস্থা জাদুবিদ্যায় বিশ্বাসী হিসেবে শুরু হয়, তারপর তাদের কেউ কেউ এটি থেকে সরে গিয়ে ধর্ম গ্রহণ করে।[১৮৫] তিনি বিশ্বাস করতেন যে জাদুবিদ্যা এবং ধর্ম উভয়ই আত্মায় বিশ্বাস করত কিন্তু এইসব আত্মার প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ছিল। ফ্রেজারের কাছে, জাদুবিদ্যা এইসব আত্মাকে "রুদ্ধ বা বাধ্য করে" আর ধর্ম "এদেরকে সন্তুষ্ট বা অনুকূল করায়" মনোনিবেশ করে।[১৮৫] তিনি স্বীকার করেন যে তাদের পরিণাম ছিল তাদের স্বীকৃত ভিত্তি বিভিন্ন নিদর্শনে জাদুময় এবং ধর্মীয় উপাদানের একটি সমন্বয়; উদাহরণস্বরূপ, তিনি দাবি করেন যে পবিত্র বিবাহ একটি উর্বরতা অনুষ্ঠান ছিল যা উভয় দৃষ্টিভঙ্গির একটি সমন্বয়।[১৮৬]

কিছু বিশেষজ্ঞ ফ্রেজারের ব্যবহৃত কাঠামোটি টিকিয়ে রাখেন কিন্তু এটার ধাপগুলোর ক্রমগুলোকে পরিবর্তন করেন; জার্মান জাতিতাত্ত্বিক উইলহেলম শিমিডট যুক্তি দেখান যে ধর্ম- যা দ্বারা তিনি একেশ্বরবাদকে বোঝান- ছিল মানব বিশ্বাসব্যাবস্থার প্রথম ধাপ, যা পরবর্তীতে জাদুবিদ্যা এবং বহু-ঈশ্বরবাদ এ দুইয়ে অধঃপতিত হয়।[১৮৭] বাকিরা বিবর্তনবাদী কাঠামোকে সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে লোকসাহিত্যিক এবং নৃবিজ্ঞানী এন্ড্রু ল্যাং তার রচনা "ম্যাজিক এন্ড রিলিজন"-এ ফ্রেজারের জাদুবিদ্যা বিবর্তনের কাঠামোর একটি অংশ হিসেবে ধর্মকে স্থান ছেড়ে দিয়েছে এ ধারণাটিকে খণ্ডন করেন; ফ্রেজার নিজের জাদুবিদ্যার ধারণা প্রমাণ করার জন্যে কাঠামো কিরকম আদিবাসী অস্ট্রেলীয়দের বিশ্বাস আর চর্চার নৃতাত্ত্বিক ভুল বিবরণের উপর নির্ভরশীল তার ওপর জোর দিয়ে ল্যাং একে প্রত্যাখ্যান করেন।[১৮৮]

কার্যকরী অভিগমন

জাদুবিদ্যার সংজ্ঞা সম্পর্কিত কার্যকরী অভিগমনটি ফরাসী সামাজিক বিজ্ঞানি মারসেল মাউস এবং এমিল ডুরখেইমের সাথে সংশ্লিষ্ট।[১৮৯] এই অভিগমন অনুযায়ী, জাদুবিদ্যাকে ধর্মের তাত্ত্বিক বিপরীত হিসেবে দেখা হয়।[১৯০]

জাদুবিদ্যা সম্পর্কিত মাউসের ধারণাটিকে তিনি তার ১৯০২ সালের রচনা "এ জেনারেল থিওরি অফ ম্যাজিক"-এ প্রবর্তন করেন।[১৯১] মাউস জাদুবিদ্যা শব্দটিকে "একটি সংঘটিত ধর্মানুষ্ঠানের অংশ নয়ঃ একটি ব্যক্তিগত, গুপ্ত, রহস্যময়, এবং সর্বোপরি নিষিদ্ধ কোন রীতির দিকে যায় এমন যে কোন রীতি" হিসেবে ব্যবহার করেন।[১৮৯] বিপরীতক্রমে, তিনি ধর্মকে সংঘটিত ধর্মানুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত করেন।[১৯২] জাদুবিদ্যাকে সহজাতভাবে অ-সামাজিক বলে মাউস ধারণাটি সম্পর্কে ঐতিহ্যগত খৃষ্টান উপলব্ধি দ্বারা প্রভাবিত হন।[১৯৩] মাউস ইচ্ছাকৃতভাবে ফ্রেজার প্রবর্তিত বুদ্ধিগত অভিগমনটিকে প্রত্যাখ্যান করেন, এই বিশ্বাসে যে জাদুবিদ্যা শব্দটিকে সমবেদী জাদুবিদ্যা হিসেবে সীমাবদ্ধ করাটা অসংযত, ফ্রেজার যেমনটা করেছিলেন।[১৯৪] তিনি এই মত প্রকাশ করেন যে "সমবেদী নয় এমন জাদুময় রীতি তো আছেই, বরং সমবেদী জাদুবিদ্যার একটি বিশেষ ক্ষমতাও নয়, যেহেতু ধর্মে সমবেদী রীতির অস্তিত্ব আছে।"[১৯২]

ডুরখেইম মাউসের ধারণাগুলোকে তার ১৯১২ সালের গ্রন্থ দ্যা এলিমেন্টারি ফর্মস অফ দ্যা রিলিজিয়াস লাইফ-এ গ্রহণ করেন।[১৯৫] ডুরখেইম বিশ্বাস করতেন যে জাদুবিদ্যা এবং ধর্ম উভয়ই "পবিত্র বস্তু, অর্থাৎ, পৃথক এবং নিষিদ্ধ বস্তুসমূহের" সাথে সম্পর্কযুক্ত।[১৯৬] তিনি এগুলোকে তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন বলে গণ্য করতেন।ডুরখেইম জাদুবিদ্যা শব্দটিকে সহজাতভাবে সমাজবিরোধী বস্তু, তিনি একটি সামাজিক দল দ্বারা শরীক ধর্মীয় বিশ্বাসগুলো যাকে গির্জা বলে নির্দেশ করেন সেগুলোর বিপরীত, বলে বর্ণনা করেন।[১৯৭] ডুরখেইম এই ধারণায় বিশ্বাস করতেন যে "জাদুকরের কৌশলে ধর্ম বিরোধী কিছু একটা আছে,"[১৯০] এবং এও যে জাদুবিদ্যায় বিশ্বাস "যারা এর সাথে সম্পর্কিত তাদেরকে এর সাথে বেঁধে ফেলেনা, না তাদেরকে সাধারণ একটি জীবন যাপনকারী কোন দলের সাথে ঐক্যবদ্ধ করেনা।"[১৯৬] ডুরখেইমের সংজ্ঞা কিছুক্ষেত্রে সমস্যার মুখোমুখি হয় - যেমন উইকানদের দ্বারা চর্চিত রীতিনীতিগুলো- যাতে সম্প্রদায়ের রীতিনীতিগুলো হয় চর্চাকারী বা প্রত্যক্ষদর্শীদের দ্বারা জাদুর বলে বিবেচিত।[১৯৬]

জাদুবিদ্যা এবং ধর্মকে দুটি স্বতন্ত্র, পৃথক বিভাগে আলাদা করা যেতে পারে এই ধারণার সমালোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।[১৯৯] সামাজিক নৃবিজ্ঞানী আলফ্রেড র‌্যাডক্লিফ-ব্রাউন বিশ্বাস করতেন যে "জাদুবিদ্যা এবং ধর্মের মধ্যে একটি সরল দ্বিধাবিভক্তি" অসহায়ক এবং এইভাবে উভয়কেই আচারের বৃহত্তর বিভাগের অধীনে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।[২০০] পরবর্তীতে অনেক নৃবিজ্ঞানী তার উদাহরণ অনুসরণ করেন।[২০০] তা সত্ত্বেও, এই পার্থক্যটি এখনও বিশেষজ্ঞরা প্রায়ই এই বিষয়ে আলোচনা করেন।[২০০]

ভাবোদ্দীপক অভিগমন

জাদুবিদ্যারর ভাবোদ্দীপক অভিগমন ইংরেজ নৃবিজ্ঞানী রবার্ট রানুলফ ম্যারেট, অস্ট্রিয়ান সিগমন্ড ফ্রয়েড এবং পোলিশ নৃবিজ্ঞানী ব্রনিস্লো ম্যালিনোস্কির সাথে যুক্ত।[২০১]

ম্যারেট জাদুবিদ্যাকে দুশ্চিন্তার একটি প্রতিক্রিয়া বলে গণ্য করতেন।[২০২] ১৯০৪ সালে, তিনি বলেন যে জাদুবিদ্যা হচ্ছে দুশ্চিন্তার অনুভূতি উপশম করার জন্যে পরিকল্পিত বিশোধক বা উদ্দীপক একটি চর্চা।[২০২] তার ধারণা বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে তিনি জাদুবিদ্যা এবং ধর্মের মধ্যে প্রভেদের ধারণাটিকে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রত্যাখ্যান করেন এবং "জাদুময়-ধর্মীয়" শব্দটিকে উভয়ের আশু বিকাশকে বর্ণনা করতে ব্যবহার করতে শুরু করেন।[২০২] ম্যালিনাউস্কি জাদুবিদ্যা সম্পর্কে ম্যারেটের মত একই ধারণা পোষণ করতেন, ব্যাপারটিকে ১৯২৫ সালে একটি রচনায় আলোচনা করেন।[২০৩] তিনি ফ্রেজারের বিবর্তনবাদী যে সামাজিক বিকাশের বিভিন্ন স্বতন্ত্র ধাপে জাদুবিদ্যা ধর্মের পূর্বে আসে এবং তারপর বিজ্ঞান আসে, এই যুক্তিতে যে এই তিনটিই প্রতিটি সমাজে বর্তমান ছিল এই তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করেন।[২০৪] তার মতে, জাদুবিদ্যা এবং ধর্ম উভয়ই "আবেগের পীড়ার পরিস্থিতিতে উত্থিত এবং সক্রিয় হয়" যদিও ধর্ম হচ্ছে অন্যদিকে প্রাথমিকভাবে অভিব্যক্তিময় এবং জাদুবিদ্যা হচ্ছে প্রাথমিকভাবে ব্যবহারিক।[২০৪] তিনি তাই জাদুবিদ্যাকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেন "একটি ব্যবহারিক শিল্প যা কিছু কর্মের সমন্বিত যেগুলো একটি নির্দিষ্ট সমাপ্তির কিছু উপায় মাত্র যা পরবর্তীতে অনুসৃত হওয়ার প্রত্যাশা আছে।"[২০৪] ম্যালিনাউস্কির মতে, জাদুবিদ্যার কর্মগুলো একটি নির্দিষ্ট সমাপ্তির জন্যে সম্পাদিত হত, যেখানে ধর্মীয় কর্মগুলোর সমাপ্তি ছিল নিজেদের মধ্যেই।[১৯৮] উদাহরণস্বরূপ তিনি বিশ্বাস করতেন যে সন্তান লাভের রীতিগুলো হচ্ছে জাদুময় এবং কারণ এগুলোকে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণের অভিলাষ নিয়ে সম্পাদিত হত।[২০৪] তার কার্যকারী অভিগমনটির একটি অংশ হিসেবে, ম্যালিনাউস্কি জাদুবিদ্যাকে অযৌক্তিক হিসেবে দেখতেন না বরং প্রদত্ত সামাজিক এবং পরিবেশগত পরিপ্রেক্ষিতে সংবেদ্য বলে একটি উপকারী ভূমিকা আছে এমনকিছু হিসেবে দেখতেন।[২০৫]

সিগমুন্ড ফ্রয়েডও জাদুবিদ্যা সম্পর্কে ধারণা প্রবর্তন করেছিলেন

ফ্রয়েড জাদুবিদ্যা শব্দটিকে স্বাধীনভাবে ব্যবহার করেছিলেন।[২০৬] তিনি জাদুবিদ্যাকে মানবাবেগ থেকে উদ্ভূত বলেও গণ্য করতেন আবার ম্যারেটের চেয়ে ভিন্নভাবে এর ব্যাখ্যা করেন।[২০৭] ফ্রয়েড ব্যাখ্যা করেন যে "জাদুবিদ্যার ঐক্যবদ্ধ তত্ত্ব কেবলমাত্র জাদুবিদ্যা যে পন্থায় অগ্রসর হয় তার ব্যাখ্যা দেয়; তা এর প্রকৃত নির্যাসের ব্যাখ্যা দেয়না, অর্থাৎ যেই ভুল ব্যাখ্যা প্রকৃতির আইনকে মানসিক আইন দ্বারা প্রতিস্থাপিত করে।"[২০৮] ফ্রয়েড জোর দেন যে আদিম মানবকে জাদুবিদ্যার ধারণার দিকে যা ঠেলে দেয় তা হচ্ছে কামনার শক্তিঃ "তার কামনাগুলো একটি প্রেরণাদায়ক প্রবৃত্তি দ্বারা অনুষঙ্গী, ইচ্ছাটি, যা তার কামনাকে পরিতৃপ্ত করতে পরবর্তীতে পুরো পৃথিবীকে বদলে দেবে। এই প্রেরণাদায়ক প্রবৃত্তিটি সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হয়েছিল সন্তোষজনক পরিস্থিতির বিবরণ দিতে এমনভাবে যে তা সন্তুষ্টি অনুভব করা সম্ভব করে তোলে যা দ্বারা প্রেরণাদায়ক অলীক বিশ্বাস হিসেবে বর্ণনা করা যায়। এ ধরণের সন্তোষজনক কামনার বিবরণ শিশুদের খেলার সাথে বেশ তুলনীয়, যা তাদের পূর্বের সন্তুষ্টির বিশুদ্ধ প্রেরণাদায়ক কৌশলের অনুবর্তী। [...] কালের বিবর্তনে, জাদুবিদ্যার চর্চার অভিপ্রায় থেকে মানসিক ঝোঁক সরে গিয়ে যে বিস্তৃতি দ্বারা এটি পরিচালিত হত তার দিকে চলে যায়- অর্থাৎ, চর্চার দিকেই। [...] এটি এভাবে স্পষ্টত যে যেন জাদুবিদ্যার চর্চা নিজেই কাম্য ফলের সাথে এর সাদৃশ্যের কারণে, সেই ফলাফলের সংঘটনকে একাকী নির্ধারণ করে।"[২০৯]

১৯৬০-এর গোড়ার দিকে, নৃতাত্ত্বিক মুরে এবং রোজালি ওয়াক্স এই মতবাদ প্রচার করেন যে বিশেষজ্ঞদের অবশ্যই বৈজ্ঞানিক জ্ঞান সম্পর্কে পশ্চিমা ধারনা দিয়ে যুক্তিযুক্ত না করে বরং একটি সমাজের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে জাদুবিদ্যাকে দেখা উচিত।[২১০] তাদের ধারণাগুলো অন্যান্য নৃতাত্ত্বিকেরা জোরালোভাবে সমালোচনা করেন, যারা বলেন যে তারা পৃথিবী সম্পর্কে পশ্চিমা এবং অ-পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে একটি মিথ্যা বিভক্তি সৃষ্টি করেছেন।[২১১] পৃথিবী সম্পর্কে জাদুবিদ্যার দৃষ্টিভঙ্গি তাও ইতিহাস, লোকসাহিত্যে, দর্শনে, সাংস্কৃতিক তত্ত্ব, এবং মনোবিজ্ঞানে ব্যাপক স্থান দখল করে নেয়।[২১২] জাদুবিদ্যার চিন্তার ধারণাও বিভিন্ন মনোবিজ্ঞানীরা ব্যবহার করেছেন।[২১৩] ১৯২০ সালে, মনোবিজ্ঞানী জ্যা পিয়াজে ধারণাটিকে শিশুরা মানসিক এবং শারীরিক অবস্থার মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করতে অক্ষম এই যুক্তির একটি অংশ হিসেবে ব্যবহার করেন।[২১৩] এই ধারণা অনুযায়ী, শিশুরা তাদের জাদুবিদ্যার চিন্তা ছয় এবং নয় বছর বয়সের মধ্যে ত্যাগ করে।[২১৩]

স্ট্যানলি টামবিয়াহ-এর মতে, জাদুবিদ্যা, বিজ্ঞান, এবং ধর্ম এইসকলের নিজস্ব "যৌক্তিকতার গুণ" আছে এবং এরা রাজনীতি আর ভাবাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত।[২১৪] ধর্মের বিরোধী হিসেবে, টামবিয়াহ বলেন যে মানবজাতির ঘটনাসমূহের ওপরে যথেষ্ট ব্যক্তিগত নিয়ন্ত্রণ আছে। বিজ্ঞান, টামবিয়াহ-এর মতে, হচ্ছে "আচরণের একটি ব্যবস্থা যা দ্বারা মানুষ পরিবেশের ওপরে কর্তৃত্ব অর্জন করে।"[২১৫]

জাতিকেন্দ্রিকতা

জাদুবিদ্যা-ধর্ম-বিজ্ঞান ত্রিভুজটি ইউরোপীয় সমাজে বিবর্তনবাদী ধারণার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে অর্থাৎ জাদুবিদ্যা ধর্মে বিবর্তিত হয়, যা পরবর্তীতে বিজ্ঞানে বিবর্তিত হয়।[১৯০] যদিও অ-পশ্চিমা সংস্কৃতি বা পশ্চিমা সমাজের প্রাক-আধুনিক ধরণের আলোচনায় একটি পশ্চিমা বিশ্লেষণকারী মাধ্যমের ব্যবহার সমস্যার উদ্রেক করে যেহেতু এটি সেগুলোর ওপরে ভিনদেশী পশ্চিমা প্রকারভেদ আরোপ করতে পারে।[২১৬] যেখানে জাদুবিদ্যা পশ্চিমা সমাজের ইতিহাসে একটি এমিক (ভেতরের) বলে বিদ্যমান থাকে, যখন অ-পশ্চিমা সমাজে এবং এমনকি কিছু নির্দিষ্ট পশ্চিমা সমাজেও একটি এটিক (বাইরের) বলে বিদ্যমান থাকে। এই কারণে, মাইকেল ডি. বেইলি'র মত বিদ্বানেরা শিক্ষাবিজ্ঞানের প্রকার হিসেবে বিষয়টিকে সম্পূর্ণ বর্জন করার ইঙ্গিত দেন।[২১৭] বিংশ শতাব্দীতে, এশিয় এবং আফ্রিকান সমাজের উপর মনযোগী অসংখ্য বিশেষজ্ঞরা জাদুবিদ্যা শব্দটিকে প্রত্যাখ্যান করেন, সাথে সাথে ডাকিনীবিদ্যার মত সাদৃশ্যপূর্ণ ধারণাগুলো আরও যথাযথ বিষয় এবং ধারণা্র সপক্ষে যা জুজু'র মত এইসব নির্দিষ্ট সমাজে বিদ্যমান ছিল।[২১৮] একইরকম একটি অভিগমন অসংখ্য বিশেষজ্ঞ যারা ইউরপের প্রাক-আধুনিক সমাজ যেমন ক্লাসিক্যাল প্রাচীনত্ব নিয়ে গবেষণা করছিলেন তারা গ্রহণ করেন, যারা জাদুবিদ্যার আধুনিক ধারণাটিকে অসঙ্গত ভাবতেন এবং যেসব প্রাচীন সংস্কৃতি নিয়ে তারা গবেষণা করছিলেন সেগুলোর কাঠামোতে উত্থিত আরও নির্দিষ্ট ধারণার অনুকূল ছিলেন।[২১৯] বিপরীতক্রমে, এই শব্দটি ইঙ্গিত দেয় যে জাদুবিদ্যার সকল প্রকার হচ্ছে জাতিকেন্দ্রিক এবং এই যে এধরণের পশ্চিমা পূর্বধারণা হচ্ছে বিশেষজ্ঞ গবেষণার একটি অনিবার্য উপাদান।[২১৬] এই শতাব্দীতে বিশেষজ্ঞরা এমিক জাতিকেন্দ্রিক গবেষণার দিকে ঝুঁকে গেছেন যা বিশেষত এমিক/এটিক বিভেদ নিয়ে গবেষণা করে।[৭৫]

অসংখ্য বিশেষজ্ঞরা তর্ক করেছেন যে শিক্ষাবিজ্ঞানে একটি বিশ্লেষণকারী মাধ্যম হিসেবে শব্দটির ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা উচিত।[২২১] উদাহরণস্বরূপ ধর্ম বিশেষজ্ঞ জোনাথন জি. স্মিথ বলেন যে এটিক শব্দ হিসেবে এর কোন ব্যবহারিকতা নেয় যে একে বিশেষজ্ঞদের ব্যবহার করা উচিৎ।[২২২] ধর্মবিষয়ক ঐতিহাসিক উটার হানেগ্রাফ একমত হন, এই ভিত্তিতে যে এর ব্যবহার পশ্চিমা শ্রেষ্ঠত্বের ধারণার ওপর ভিত্তি করে গঠিত এবং"অ-ইউরোপীয় মানুষদের অন্ধকারাচ্ছন্ন কুসংস্কার থেকে ধ্মান্তরিত করার 'বৈজ্ঞানিক' ন্যায্যতা দান" করে... মন্তব্য করেন যে "জাদুবিদ্যা শব্দটি ঐতিহাসিক গবেষণায় একটি গুরুত্মপূর্ণ বস্তু, কিন্তু গবেষণার কাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে নয়।"[২২৩]

বেইলি মন্তব্য করেন যে, একবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, কিছুসংখ্যক বিশেষজ্ঞ জাদুবিদ্যার ব্যাপক সংজ্ঞা দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু এর পরিবর্তে "বিশেষ প্রসঙ্গে সযত্ন মনোযোগ" নিবেশ করেন, একটি নির্দিষ্ট সমাজে জাদুবিদ্যা শব্দটির কি অর্থ তা গবেষণা করেন; এই অভিগমন, তিনি উল্লেখ করেন যে, "একটি সার্বজনীন প্রকার হিসেবে জাদুবিদ্যার বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।"[২২৪] ধর্মবিষয়ক বিশেষজ্ঞ বারন্ডট-ক্রিসচিয়ান ওটো এবং মাইকেল স্টাউসবারগ বলেন যে জাদুবিদ্যার ধারণা দিকে না গিয়ে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে প্রায়শয়ই জাদুর বলে বিবেচিত তাবিজ, অভিশাপ, আরোগ্যলাভের পদ্ধতি, এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক চর্চা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের আলোচনা করা সম্ভব।[২২৫] জাদুবিদ্যাকে বিশ্লেষণকারী ভাষ্য হিসেবে ব্যবহারকে প্রত্যাখ্যান করা উচিত ধারণাটি নৃবিজ্ঞানে বিকশিত হয়, ১৯৮০ সালে ক্লাসিক্যাল গবেষণা এবং বাইবেল গবেষণার দিকে চলে যাওয়ার আগে।[২২৬] ১৯৯০ সাল থেকে, ধর্ম বিশেষজ্ঞদের মধ্যে শব্দটির ব্যবহার কমে যায়।[২২২]

ডাকিনীবিদ্যা

ইতিহাসবিদ রোনাল্ড হাটন উল্লেখ করেন যে ইংরেজি ভাষায় ডাকিনীবিদ্যা শব্দটির চারটি ভিন্ন অর্থ বিদ্যমান। ঐতিহাসিকভাবে, শব্দটি প্রাথমিকভাবে অন্যদের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে আধিভৌতিক বা জাদুর চর্চাকে নির্দেশ করত।[১] এটি এই শব্দটির, হাটনের মতে, "সবচেয়ে ব্যাপক এবং নিয়মিত" ব্যাখ্যা। উপরন্তু, হাটন বর্তমান তিনটি ভিন্ন সংজ্ঞার ব্যবহার উল্লেখ করে ; এমন যে কোন ব্যাক্তি যিনি জাদুবিদ্যার চর্চা করেন, উপকারী বা অপকারী যে কোন উদ্দেশ্যে; আধুনিক পৌত্তলিক ধর্ম উইকা'র চর্চাকারীদের মধ্যে; অথবা পুরুষদের কর্তৃত্ব প্রতিরোধে নারীদের একটি প্রতীক এবং স্বাধীন নারী কর্তৃত্ব স্থাপনে।[২২৮] ডাকিনীবিদ্যার বিশ্বাস প্রায়শয়ই যেসব সমাজ এবং দলের সাংস্কৃতিক কাঠামোতে পৃথিবী সম্পর্কে জাদুময় দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান সেখানে উপস্থিত থাকে।[৭৬]

যাদেরকে জাদুকর হিসেবে পরিগণিত করা হত তারা প্রায়শয়ই তাদের সমাজের অন্যান্য সদস্যদের সন্দেহের শিকার হতেন।[২৩০] এটি বিশেষ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য যদি এইসব পরিগণিত জাদুকর একটি বিশেষ সমাজে ইতিমধ্যে নৈতিকভাবে সন্দেহ করা সামাজিক দল যেমন বিদেশি, নারী, বা অন্যান্য নিচু শ্রেণির সাথে জড়িত থাকেন।[২৩১] এইসব নেতিবাচক সংলগ্নতার বিপরীত, জাদুর বলে গণ্য কর্মের বহু চর্চাকারী জোর দেন যে তাদের কাজ মহান এবং উপকারী।[২৩২] যে সকল কর্মকে জাদুর বিভিন্ন ধরণ হিসেবে প্রকারভেদ করা হয়েছে, জাদুকরের উদ্দেশ্য যাইই হোক না কেন, সেগুলোর সবই নিহিতভাবে খারাপ কারণ সকল জাদু চর্চা শয়তানের এই সাধারণ খ্রিস্টীয় দৃষ্টিভঙ্গির সাথে এর বিরোধ দেখা দেয়।[৯০] একজন জাদুকরের চর্চার প্রতি পরস্পরবিরোধী আচরণ বিদ্যমান থাকতে পারে; ইউরোপীয় ইতিহাসে, কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করত যে চতুর লোক এবং চিরাচরিত চিকিৎসকেরা হচ্ছে ক্ষতিকারক কারণ তাদের চর্চাগুলো জাদুর বলে বিবেচিত আর এভাবে শয়তানের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে এগুলোর সূত্রপাত, যেখানে একটি স্থানীয় সম্প্রদায় হয়তবা এইসব ব্যক্তিদের মূল্যায়ন এবং শ্রদ্ধা করতে পারে কারণ তাদের দক্ষতা এবং সেবা উপকারী বলে বিবেচিত।[২৩৩]

পশ্চিমা সমাজগুলোতে, জাদুবিদ্যার চর্চা, বিশেষত ক্ষতিকারকগুলো, সাধারণত নারীদের সাথে সম্পর্কিত ছিল।[২৩৪] উদাহরণস্বরূপ, প্রাক-আধুনিক যুগের ডাইনী বিচারের সময়, ডাইনী বলে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ব্যক্তিদের তিন-চতুর্থাংশ ছিল নারী, আর মাত্র এক-চতুর্থাংশ ছিল পুরুষ।[২৩৫] নারীদের এই যুগে ডাকিনীবিদ্যার অপরাধে অভিযুক্ত এবং বিচার করা হয় সম্ভবত কারণ আইনত তাদের অবস্থান ছিল বেশ অসুরক্ষিত, তাদের পুরুষ আত্মীয়দের থেকে স্বাধীনভাবে তাদের আইনত কোন অবস্থান বলতে ছিলই না।[২৩৫] পশ্চিমা সমাজে নারী এবং জাদুবিদ্যার মধ্যে ধারণাগত সংযোগটি সম্ভবত এসেছে কারণ জাদুর বলে বিবেচিত অসংখ্য রীতিনীতি- চর্চা থেকে উর্বরতা অনুপ্রেরণা থেকে গর্ভপাত সংঘটনের আরক- সবই ছিল নারীমণ্ডলের সাথে সম্পর্কিত।[২৩৬] এর আরেকটি কারণ হতে পারে বহু সংস্কৃতি নারীদের বুদ্ধিগতভাবে, নৈতিকভাবে, আধ্যাত্মিকভাবে, এবং শারীরিকভাবে পুরুষদের থেকে খাটো করে দেখত।[২৩৭]

জাদুকর

১৫ শতকের ট্যারো ডেকের জাদুকর তাস।

জাদুর বলে তকমা লাগান রীতিনীতিগুলোর বেশিরভাগই যে কেউ পালন করতে পারেন।[২৩৩] উদাহরণস্বরূপ, কিছু মন্ত্র কোন বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বা কোন বিশেষ ক্ষমতার দাবি ছাড়া কোন ব্যক্তি উচ্চারণ করতে পারে।[২৩৯] বাকিগুলো সম্পাদন করতে বিশেষ প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পরে।[২৩৮] যেসব ব্যক্তি নিয়মিতভাবে জাদুর চর্চা করতেন তাদের কয়েকজনকে, অথবা গুণিন/জাদুকরী, ডাইনী, বা চতুর লোকের সাথে সম্পর্কিত ধারণাগুলোকে জাদুকর বলে চিহ্নিত করা হত।[২৩৯] একজন জাদুকর বলে পরিচিতি একজন ব্যক্তির নিজের সম্পর্কে আত্ম-দাবি থেকে উৎসারিত, অথবা অন্যেরা তাদের ওপরে এই তকমা চাপিয়ে দিতে পারে।[২৩৯] পরবর্তী ক্ষেত্রে, একজন ব্যক্তি এ ধরণের তকমাকে গ্রহণ করতে পারে, অথবা এটাকে প্রত্যখ্যান করতে পারে, মাঝেমাঝে তীব্রভাবে।[২৩৯]

নিজেদের জাদুকর বলে পরিচয় দেওয়াতে অর্থনৈতিক প্ররোচনা থাকতে পারে।[১২৯] বিভিন্ন ধরণের ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসকদের বিভিন্ন প্রকারের ক্ষেত্রে, জাদুকর বা বাজীকরদেরদের পরবর্তী ক্ষেত্রসহ, জাদুকর তকমাটি একটি পেশাগত বর্ণনা হয়ে উঠতে পারে।[২৩৯] বাকিরা দাবি করেন যে এধরণের একটি পরিচিতি তাদের বিশেষ অসাধারণ ক্ষমতা বা মেধা আছে এই খাঁটি বিশ্বাস থেকে আসতে পারে।[২৪০] কে এধরণের ভূমিকা গ্রহণ করতে পারে এ ব্যাপারে বিভিন্ন সমাজে বিভিন্ন সামাজিক নিয়মনীতি আছে; উদাহরণস্বরূপ, এটি পারিবারিক উত্তরাধিকারের একটি প্রশ্ন হতে পারে, অথবা কে এধরণের রীতিনীতি নিযুক্ত হতে পারে সেটার ওপর লিঙ্গভিত্তিক বিধিনিষেধ থাকতে পারে।[২৪১] ব্যাক্তিগত বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন প্রকার জাদুর ক্ষমতা প্রদানের সাথে সংযুক্ত করা যায়, এবং প্রায়শয়ই এগুলোকে পৃথিবীতে একটি অসাধারণ জন্মের সাথে সম্পর্কিত হয়।[৭৭] উদাহরণস্বরূপ, হাঙ্গেরিতে বিশ্বাস করা হত যে একজন ট্যালতস দাঁতসহ বা একটি অতিরিক্ত আঙ্গুলসহ জন্মগ্রহণ করতে পারে।[২৪৩] ইউরোপের বিভিন্ন অংশে, এটি বিশ্বাস করা হত যে কাউল-সহ জন্মগ্রহণ করলে শিশুটিকে অতিপ্রাকৃত ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত করবে। কিছুক্ষেত্রে, এধরণের চর্চায় বিশেষজ্ঞের ভূমিকা গ্রহণের পূর্বে একটি রীতিনীতি প্রবর্তনার প্রয়োজন, এবং অন্যক্ষেত্রে এটি আশা করা হয়যে একজন ব্যক্তি অন্য একজন বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে বিদ্যার্জন করবে।[২৪৪]

ডেভিস উল্লেখ করেন যে "জাদুবিদ্যার বিশেষজ্ঞদের ধর্মীয় এবং সাধারণ প্রকারে অমার্জিতভাবে বিভক্ত করা" সম্ভব।[২৪৫] তিনি উল্লেখ করেন যে উদাহরণস্বরূপ রোমান ক্যাথলিক পাদ্রীরা অশুভ আত্মা তাড়ানোর নিজেদের রীতিনীতি, এবং পবিত্র পানি আর বরকতময় ভেষজসহ, জাদুবিদ্যার চর্চাকারী হিসেবে বিবেচিত হতে পারেন।[২৪৬] ঐতিহ্যগতভাবে, জাদুবিদ্যা চর্চাকারীদের সাধারণ মানুষদের থেকে চিহ্নিত, পার্থক্য, এবং স্থাপন করার সবচেয়ে সাধারণ পদ্ধতি হচ্ছে দীক্ষা। রীতিনীতির মাধ্যমে আধিভৌতিকের সাথে জাদুকরের সম্পর্ক এবং একটি রুদ্ধ পেশাদার শ্রেণিতে প্রবেশ স্থাপিত হয় (প্রায়শয়ই একটি নতুন জীবনে মৃত্যু এবং পুনর্জন্মকে অনুকরণ করতে পারে এমন রীতিনীতির মাধ্যমে)।[২৪৭] যাইহোক, নব্যপৌত্তলিকতার উত্থাপনের সাথে সাথে, বারজার এবং এজ্জি ব্যাখ্যা করেন যে, "যেহেতু সত্যতা যাচাইয়ের জন্যে কোন কেন্দ্রীয় আমলাতন্ত্র বা ধর্মমত নেই, একজন ব্যাক্তির একজন ডাকিনী, জাদুকর, পৌত্তলিক, বা নব্যপৌত্তলিক হিসেবে আত্ম-সঙ্কল্প সাধারণত আক্ষরিকভাবে নেওয়া হয়।"[৭৮] এজ্জি বলেন যে চর্চাকারীর পৃথিবীর ধারণা অসংখ্য সমাজবিদ্যাগত এবং নৃতত্ত্বগত অধ্যয়নে উপেক্ষিত হয়েছে এবং এটি হয়েছে কারণ "জাদুবিদ্যার বিশ্বাসকে অবমূল্যায়ন করে বিজ্ঞান সম্পর্কে এমন সংকীর্ণ সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি"[৭৯]

মাউস তর্ক করেন যে বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ উভয় প্রকারের জাদুকরদের ক্ষমতা উৎস সম্পর্কিত সাংস্কৃতিকভাবে গৃহীত মানদণ্ড এবং জাদুবিদ্যার প্রসার দ্বারা নিরূপিতঃ একজন জাদুকর সাদামাটাভাবে নতুন জাদু উদ্ভাবন বা দাবি করতে পারেন না। অভ্যাসগতভাবে, জাদুকরটি ততটুকুই শক্তিশালী যতটুকু তার সহকর্মীরা বিশ্বাস করে তার ক্ষমতা আছে ততটুকুই।[২৫০]

লিপিভুক্ত ইতিহাসের পাতা জুড়ে, জাদুকরেরা প্রায়শয়ই তাদের অতিরঞ্জিত ক্ষমতা এবং সামর্থ্যের ব্যাপারে সংশয়ের স্বীকার হন।[২৫১] উদাহরণস্বরূপ, ষোড়শ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে, লেখক রেজিনাল্ড স্কট দ্যা ডিসকাভারি অফ উইচক্র্যাফট রচনা করেন, যাতে তিনি যুক্তি দেখান যে ডাকিনীবিদ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত বা অন্যথায় জাদু ক্ষমতার অধিকারী বলে দাবীকৃত ব্যক্তিদের অনেকেই জনগণকে বিভ্রম ব্যবহার করে বোকা বানাতেন।[২৫২]

আরো দেখুন

  • আলোক দেহ
  • ক্লার্কের তিনটি নীতি
  • আইজ্যাক নিউটনের অতিপ্রাকৃত অধ্যয়ন
  • জুজু
  • অতিপ্রাকৃত শব্দের তালিকা
  • অতিপ্রাকৃত লেখকদের তালিকা
  • অতিপ্রাকৃতবিদদের তালিকা
  • আধ্যাত্মিক ক্ষমতার তালিকা
  • জাদুবিদ্যা (মায়াবিদ্যা)
  • কল্পকাহিনীতে জাদুবিদ্যা
  • জাদুবিদ্যার সংগঠন
  • সাইওনিকস
  • রুনিক জাদুবিদ্যা
  • স্ক্রাইইং
  • মুসলিম সম্প্রদায়ে কুসংস্কার
  • অলৌকিক সাধনা

আরও পড়ুন

বহিঃলিঙ্ক

  • উইকিউক্তিতে Magic সম্পর্কিত উক্তি পড়ুন।</img> উইকিকোট
  • উইকিমিডিয়া কমন্সে জাদু (মায়াবিদ্যা) সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।

</img>

টেমপ্লেট:Witchcraft

  1. Larin, Alexander V.; Meurice, Nathalie; Leherte, Laurence; Rajzmann, Michel; Vercauteren, Daniel P.; Trubnikov, Dmitrii N. (২০০১)। Theoretical Analysis of Hydrolysis of Sulfur Fluorides SFn (n = 3 - 6) in the Gas Phase। Boston, MA: Springer US। পৃষ্ঠা 425–430। আইএসবিএন 978-1-4613-5143-6