সংকেত (যোগাযোগ ব্যবস্থা)
সাধারণ অর্থে যা কিছু কোনও প্রেরক থেকে কোনও প্রাপকের কাছে এক স্থান থেকে অন্য একটি স্থানে কাঙ্ক্ষিত ও প্রাসঙ্গিক কোনও তথ্য বা উপাত্ত বহন করে, তাকে সংকেত (ইংরেজি পরিভাষায় সিগন্যাল Signal) বলে।[১]
যোগাযোগ প্রযুক্তির দৃষ্টিকোণ থেকে প্রেরক কর্তৃক প্রাপকের কাছে সংকেত প্রেরণ করার প্রক্রিয়াটিকে সম্প্রচার বলে। সিগন্যাল তথা সংকেতকে তাই তথ্য-উপাত্তের সম্প্রচারিত রূপ হিসেবে গণ্য করা যায়। যা কিছুর মধ্য দিয়ে কোনও সংকেত প্রেরক থেকে প্রাপকের কাছে পৌঁছায়, তাকে সম্প্রচার মাধ্যম বলে। একজন প্রেরক যে সরঞ্জাম বা উপকরণের সাহায্যে সংকেত প্রেরণ করে, তাকে সম্প্রচারক বলে। অপর প্রান্তে প্রাপক যে সরঞ্জাম বা উপকরণের সাহায্যে সংকেত গ্রহণ করে, তাকে গ্রাহক বা সংবেদক বলে। প্রাপক যখন প্রেরকের পাঠানো সংকেত গ্রহণ করে, তখন বলা হয় ঐ দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে।
আবার গাণিতিক দৃষ্টিকোণ থেকে সংকেত হল কোনও স্বাধীন চলরাশির সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল এমন আরেকটি গাণিতিক রাশি বা অপেক্ষক (ফাংশন), যার মান পরিমাপ করা যায় এবং যা কোনও বিশ্লেষণযোগ্য তথ্য বা উপাত্ত বহন করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সময়কে স্বাধীন চলরাশি হিসেবে গণ্য করা হয়, কেননা সময় অন্য কোনও কিছুর সাপেক্ষে পরিবর্তনশীল নয়। যেমন কোনও বস্তুর তাপমাত্রার মানকে ঐ বস্তু কর্তৃক প্রেরিত একটি সংকেত হিসেবে গণ্য করা যায়। বস্তুর তাপমাত্রার মান সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়; অন্য ভাষায়, তাপমাত্রা সময়ের একটি ফাংশন। এটিকে তাপমানযন্ত্রের সাহায্যে পরিমাপ করা যায় এবং এটি আমাদেরকে (আমরা হলাম প্রাপক) উষ্ণতা সম্পর্কিত কাঙ্ক্ষিত, প্রাসঙ্গিক তথ্য দেয়, যে তথ্য বিশ্লেষণ বা প্রক্রিয়াকরণ করে আমরা কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পারি। সুতরাং এটি একটি সংকেত।[১]
সংকেতের উদাহরণ
[সম্পাদনা]মানবনির্মিত কৃত্রিম সংকেত
[সম্পাদনা]আধুনিক বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থাগুলিতে মানুষ বিভিন্ন ধরনের তথ্য দ্রুত আদান-প্রদানের জন্য কৃত্রিম মানবনির্মিত সংকেতের আশ্রয় নিয়ে থাকে।
তারের টেলিফোন ব্যবস্থাতে স্থানীয় টেলিফোন কার্যালয় থেকে গ্রাহকের বাসস্থানে প্রেরিত এবং তামার তারের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত সময়ের সাপেক্ষে বৈদ্যুতিক বিভবের ভিন্ন ভিন্ন মান প্রবাহিত হয়, যা একটি বৈদ্যুতিক সংকেত। এই বৈদ্যুতিক সংকেতটি শাব্দিক তথ্য বহন করে।
তারহীন ভ্রাম্যমাণ টেলিফোন তথা মোবাইল টেলিফোন ব্যবস্থার বুরূজ বা টাওয়ার থেকে সেবাগ্রহীতার মোবাইল ফোনে প্রেরিত ও শূন্যস্থানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গের বিস্তারের ভিন্নতা (মডুলেশন) এক ধরনের তড়িৎ-চুম্বকীয় সংকেত। এই তড়িৎ-চুম্বকীয় সংকেত শাব্দিক তথ্য ও পাঠ্যতথ্য বহন করে। আধুনিক নতুন প্রজন্মের ভ্রাম্যমাণ তথা মোবাইল টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায় তথাকথিত "বুদ্ধিমান ফোন" তথা স্মার্টফোনে ছবি, ভিডিও, কম্পিউটার প্রোগ্রাম বা অ্যাপ, ইত্যাদিও তড়িৎ-চুম্বকীয় সংকেত দিয়ে প্রেরণ করা হয়।
ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে গ্রাহকের কাছে প্রেরিত এবং আলোকীয় তন্তুর তারের (ফাইবার অপটিক কেবল) মধ্য দিয়ে প্রবাহিত আলোর স্পন্দনের ধারা এক ধরনের আলোকীয় সংকেত। এই আলোকীয় সংকেত কম্পিউটারে প্রক্রিয়াকরণযোগ্য বিভিন্ন ধরনের তথ্য (পাঠ্যবস্তু তথা টেক্সট, শব্দ, ছবি, চলছবি তথা ভিডিও) বহন করে।
মাত্রা অনুযায়ী সংকেতের প্রকারভেদ
[সম্পাদনা]স্বাধীন চলরাশি সময়ের সাপেক্ষে যদি একটিমাত্র রাশি পরিবর্তিত হয়, তাহলে তাকে একমাত্রিক সংকেত বলে। যেমন শব্দ এক ধরনের একমাত্রিক সংকেত, কেননা সময়ের সাথে সাথে বাতাসের চাপের মানের পরিবর্তনই হল শব্দ। শব্দ যখন মানুষের কানের পর্দায় এসে পৌঁছায়, তখন বাতাসের চাপ কানের পর্দাকে একই অক্ষের উপরে সামনে-পেছনে নাড়ায়; তাই শব্দ-সংকেত একমাত্রিক। অন্যদিকে সময়ের সাপেক্ষে যদি দুইটি রাশি পরিবর্তিত হয়, তাহলে তাকে দ্বি-মাত্রিক সংকেত বলে। যেমন ছবি বা চিত্র হল এক ধরনের দ্বিমাত্রিক সংকেত।
দৃশ্যমান গাণিতিক-জ্যামিতিক উপস্থাপন অনুযায়ী সংকেতের প্রকারভেদ
[সম্পাদনা]একমাত্রিক সংকেতকে জ্যামিতিকভাবে একটি তরঙ্গ-সদৃশ দ্বিমাত্রিক লেখচিত্র আকারে প্রকাশ করা যায়, যেখানে আনুভূমিক অক্ষটি সময় নির্দেশ করে এবং উল্লম্ব অক্ষটি পরিবর্তনশীল মানবিশিষ্ট ভৌত রাশি নির্দেশ করে। সময়ের প্রতি এককের জন্য ভৌত রাশির নির্দিষ্ট মানকে ঐ সংকেতের বিস্তার (Amplitude) বলে।[২]
যেসব সংকেতে সময়কে অবিচ্ছিন্ন চলরাশি (অর্থাৎ অসীম সংখ্যক বাস্তব সংখ্যার মান ধারণ করতে পারে এমন রাশি) হিসেবে গণনা করা হয় এবং সময়ের সাপেক্ষে অন্য একটি অধীন রাশি বা ফাংশনের মানকেও (অর্থাৎ সংকেতের বিস্তারকেও) অবিচ্ছিন্ন চলরাশি হিসেবে গণনা করা হয়, সেগুলিকে অবিচ্ছিন্ন-সময় অবিচ্ছিন্ন-বিস্তার সংকেত (Continuous-Time Continuous-Amplitude signal সংক্ষেপে CTCA Signal)।[২] এই ধরনের সংকেত ভৌত, বাস্তব বিশ্বের কোনও বস্তু, প্রক্রিয়া বা ব্যবস্থার কোনও পরিবর্তনশীল ভৌত বৈশিষ্ট্যকে প্রতিনিধিত্বকারী চলরাশির অনুরূপ বা সদৃশ একটি গাণিতিক চলরাশি হয় বলে একে "অনুরূপ সংকেত" (অ্যানালগ সিগন্যাল Analog signal) নামে ডাকা হয়। যেমন একটি বৈদ্যুতিক অনুরূপ শব্দ সংকেত (Electrical Analog Audio signal) ভৌত শব্দতরঙ্গের কারণে বাতাসের চাপের হ্রাস-বৃদ্ধিকে তাৎক্ষণিকভাবে বৈদ্যুতিক বিভব বা ভোল্টেজের ওঠা-নামার মাধ্যমে একটি অবিচ্ছিন্ন চলরাশি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে, যার কারণে বৈদ্যুতিক ভোল্টেজ-ভিত্তিক এই সংকেতটি মূল ভৌত ঘটনার (শব্দতরঙ্গের) খুবই কাছাকাছি বা "অনুরূপ" একটি প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করে; তাই এ ধরনের সংকেতকে "অনুরূপ সংকেত" বলা হয়।
যেসব সংকেতে সময়কে বিচ্ছিন্ন চলরাশি (অর্থাৎ কেবল সসীম সংখ্যক পূর্ণসংখ্যার মান ধারণ করতে পারে এমন রাশি) হিসেবে গণ্য করা হয়, কিন্তু সময়ের সাপেক্ষে অন্য একটি অধীন রাশি বা ফাংশনের মানকে (অর্থাৎ সংকেতের বিস্তারকে) অবিচ্ছিন্ন চলরাশি (অর্থাৎ অসীম সংখ্যক বাস্তব সংখ্যার মান ধারণ করতে পারে এমন রাশি) হিসেবে গণ্য করা হয়, সেগুলিকে বিচ্ছিন্ন-সময় অবিচ্ছিন্ন-বিস্তার সংকেত (Discrete-Time Continuous-Amplitude signal সংক্ষেপে DTCA Signal) বলে।[২]
যেসব সংকেতে সময়কে বিচ্ছিন্ন চলরাশি (অর্থাৎ কেবল সসীম সংখ্যক পূর্ণসংখ্যার মান ধারণ করতে পারে এমন রাশি) হিসেবে গণ্য করা হয়, এবং সময়ের সাপেক্ষে অন্য একটি অধীন রাশি বা ফাংশনের মানকেও বিচ্ছিন্ন চলরাশি হিসেবে গণ্য করা হয় সেগুলিকে বিচ্ছিন্ন-সময় বিচ্ছিন্ন-বিস্তার সংকেত (Discrete-Time Discrete-Amplitude signal সংক্ষেপে DTDA Signal) বা সংক্ষেপে ডিজিটাল সংকেত (Digital signal) বলে।[২] উল্লেখ্য যে, ইলেকট্রনিক্স বিদ্যাতে ডিজিটাল সংকেত বলতে সাধারণত বাইনারি (বা দুই-ভিত্তিক) যৌক্তিক সংকেত (Logical signal) বোঝায়।