ব্যবহারকারী আলাপ:ড.রমজান আলি

পাতাটির বিষয়বস্তু অন্যান্য ভাষায় নেই।
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

ধবনী গাঁয়ের নীলকণ্ঠ মাস্টার

       --- ড. রমজান আলি

'মাস্টার ' বলতে শিক্ষক বা টিচার নন, যাত্রার মাস্টার। লোকসমাজে মাস্টারই বলে। লোকায়ত মানুষের জীবনচর্যার উৎকর্ষ ধরা পড়ে জাতির নিজস্ব সংস্কৃতিতে। লোককবিরা মুখে মুখে যে সাহিত্য রচনা করেন তা অভিধানে ' লোকসাহিত্য ' শব্দে আভাসিত হয়েছে। লোকসাহিত্যের একটা ভাগ লোকনাট্য। লোকনাট্য শব্দটির তাত্ত্বিক আলোচনায় বলা হয়েছে -- "লোকনাট্য লোক জীবনের কাহিনীর উপর ভিত্তি করে মুখে মুখে রচিত এবং অভিনীত নাটক। " কিন্তু আমরা শব্দটির অর্থকে আরো প্রসারিত করে বলতে পারি, নাটক যা লোকায়ত সমাজের আমোদ-প্রমোদের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। দীর্ঘদিন ধরে একেই আমরা যাত্রা বলে আসছি।

      ঊনবিংশ শতাব্দীর  দ্বিতীয়ার্ধে ১৮৫২ সালে বাঙালির লেখা নাটক যখন পেতে শুরু করেছি তখন গাঁয়ের মানুষ  নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় (জন্ম-১৮৪২-মৃত‍্যু-১৯১১) 'কৃষ্ণযাত্রা'র মধ্য দিয়ে জনপ্রিয় লোকনাট্য-এর সূচনা করেন। এ প্রসঙ্গে ভব রায় জানিয়েছেন ---" আঠারো-উনিশ শতকের সন্ধিক্ষণে নীলকন্ঠ মুখোপাধ্যায়, বদন অধিকারী প্রমূখ শিল্পীদের উদ্যোগে 'কৃষ্ণযাত্রা' নামে যে সর্বজনপ্রিয় লোকনাট্যের সূত্রপাত ঘটেছিল ; তার পরিপূরক হিসাবে এসেছিল 'বিদ্যাসুন্দর ঘরানা'  বা গোপাল উড়ের  যাত্রা। " কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় সাতটি যাত্রাপালা  ( যযাতির যজ্ঞ, চণ্ডালিনী উদ্ধার, মান , মাথুর, প্রভাসযজ্ঞ , কংসবধ,  কলঙ্কভজন)  রচনা করলেও 'সংসদ বাংলা নাট্য অভিধান'-এ সম্পাদক বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় আমাদের এই পশ্চিম বর্ধমানের ধোয়াবনি বা

ধবানী গ্রামের লোক নাট্যকার নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় কে দু-কলম জমিন দিতে পারেননি। তবে পন্ডিত মহলে তেমনভাবে চর্চিত না হলেও অনেকটা আঞ্চলিক ভাবনায় আর গবেষকের অনুসন্ধানে হঠাৎ হঠাৎ তার নাম এসে পড়ে । যেমন করে অল্পবিস্তর দুর্গাপুরে তিনি আজ চর্চিত হচ্ছেন ।

      এক সময় গ্রামে-গঞ্জের সংস্কৃতিতে আমোদ-প্রমোদ বলতে ' কৃষ্ণযাত্রা, রামযাত্রা,  তার সঙ্গে আলকাপ, লেটো ইত্যাদি নিয়ে ভাদ্র-আশ্বিন বা ফাগুনে   মেতে থাকতো । প্রাচীন যাত্রা বা লোকনাট্য বলতে কোন ধর্ম উৎসবকে কেন্দ্র করে লোকভাষায় রচিত দেব-দেবী লীলা বিষয়ক গীতিময় আবেগপূর্ণ সংলাপবদ্ধ  রচনাকেই বোঝাতো। কারণ  আধুনিক যুগে যাত্রাপালার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে । তবে প্রাচীন হোক আর আধুনিক হোক লোকায়ত  সমাজে এর আবেদন আজও অক্ষুণ্ণ আছে।  অনেকটা নৃত্যগীত বাদ্যের জন্যই সাধারণ মানুষের কাছে এর সমাদর বেশি। বিদেশে এখনো অপেরা   খুব জনপ্রিয়।  তত্ত্ব ও প্রয়োগের দিক থেকে অপেরার  সঙ্গে যাত্রার একটা পার্থক্য আছে । যাত্রা অভিনীত হয় চারিদিক খোলা মঞ্চে অর্থাৎ আসরে আর অপেরা অভিনীত হয় রঙ্গালয়ে বা অপেরা হাউসে।  সূচনাকালে এগুলি দু'চারটে সংলাপ আর গীতিতে ভরা থাকত । গ্রিস দেশে নাট্য সূচনা কোরাস বা সম্মেলক সঙ্গীতেই চলতো। সেদেশে  প্রথম নাট্যকার হিসেবে থেসপিস মঞ্চে একজন আঙ্গিক ও বাচিক অভিনেতার প্রবেশ ঘটিয়েছিলেন । তবে ওই একক অভিনেতা অবশ্যই আমাদের বিবেক চরিত্র নন।
    ভবভূতির মালতিমাধবে "ভগবান্ কালপ্রিয়নাথের যাত্রাভিনয় ' থেকে শুরু করে আজকের 'মুখ্যমন্ত্রীর মা'  পর্যন্ত বিভিন্ন যাত্রাপালা তার আঙ্গিক ও বিষয়ের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে নিজের বিভাগটিকে ধরে রাখতে পারলেও মাটির সঙ্গে যুক্ত এই লোকনাট্য ধারাটি অনেকটাই বিলুপ্ত হতে বসেছে।  সংস্কৃতির অন্যতম বাহক নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়পর মতো মানুষেরা বেশি বেশি আলোচিত ও চর্চিত হলে লোক-সংস্কৃতিরই সার্বিক মঙ্গল। 
    নীলকন্ঠের গুরু ছিলেন হুগলি জেলার কৃষ্ণনগর জাঙ্গিপাড়ার নিবাসী গোবিন্দ অধিকারী । গুরুর  মৃত্যুর পর গুরুর দলে নীলকন্ঠ ও তার আরেক শিষ্য  নারায়ণের ব্যক্তিত্বের লড়াইয়ে দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে । পরে নারায়ণের মৃত্যু ঘটলে নীলকণ্ঠ আবার দলের অভিনেতা গায়ক এবং প্রধান অধিকারীতে পরিণত হন।  অনেকের মতে কাশীপুর রাজার আর্থিক সাহায্য নিয়েই তিনি যাত্রাদল করেছিলেন।  সুন্দর কন্ঠের অধিকারী ছিলেন বলেই তাকে 'কন্ঠকবি' নামে অভিহিত করা হয়।  কেশবচন্দ্র সেন , রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং স্বয়ং রামকৃষ্ণ তাঁর গানে মুগ্ধ ছিলেন।
     লোকশিক্ষার মাধ্যমকে বেছে নেওয়ার জন্য গিরিশচন্দ্রের মতো তিনিও ঠাকুর রামকৃষ্ণের আশীর্বাদ পেয়েছিলেন।  গিরিশচন্দ্র পেয়েছিলেন 'চৈতন্যলীলা' করে আর নীলকন্ঠ পেয়েছিলেন দক্ষিণেশ্বরে নবীন নিয়োগীর বাড়িতে পালাগান করে । গিরিশকে আলিঙ্গন করে অমূল্যরতন দিয়েছিলেন। আর নীলকন্ঠ কে 'অমূল্যরতন' হিসাবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন।  রামকৃষ্ণের কাছ থেকে আরো কিছু পেতে চাইলে তিনি কা-এর উপর আ-কার দিয়ে অতিরিক্ত ভার বাড়াতে চান নি।  ঠাকুর রামকৃষ্ণের কোনো গণসংগঠন গড়ার ইচ্ছা ছিল কিনা জানিনা, কিন্তু তিনি গণ সচেতকদের আন্তরিক অভিনন্দন জানাতে কার্পণ্য করেননি।
   জার্মান নাট্যকার ব্রেশট  'অ‍্যালিয়েনেশন '  তত্ত্ব যাকে বিচ্ছিন্নতা তত্ত্ব বলা হয়  তার প্রয়োগ আমাদের যাত্রায় অাগেই  হয়েছে।  পাশ্চাত্য নাটক থেকে ধার করার দরকার নেই।   যাত্রায়  যখন অভিনেতা বিড়ি-সিগরেট খান কিংবা আগেকার যুগে হ‍্যাচাকে পাম বা  হাওয়া দেওয়ার জন্য যাত্রা যখন বন্ধ রাখা হতো তখন স্বাভাবিক নিয়মেই দর্শক-শ্রোতা আবেগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। তাও তো অ‍্যালিয়েনেশন।  সেই একই কারণেও রামকৃষ্ণ যাত্রা পালা থেকে লোকশিক্ষার কথাটা মজবুত করেছিলেন। 
     ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিশেষ করে নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন এরপর রাধা কৃষ্ণের প্রেম ভাবনা আবার লৌকিকতাকে অবলম্বন করেছিল । আর এই সহজ বিষয়কে নিয়েই যাত্রার মতো নাটকও রচিত হচ্ছিল।  কবিগানের মধ্যেও আমরা সেই সত্যাসত্য অনুধাবন করতে পারি । লোক-নাট্যকার নীলকণ্ঠ সাতটি  যাত্রাপালা ছাড়াও পাঁচালীর অনুসরণে হেতমপুর এর রাজা রামরঞ্জন চক্রবর্তী কে নিয়ে একটি ' বাল্য-কাহিনী'  রচনা করেছিলেন।  তাছাড়া শেষ জীবনে 'ব্রজলীলা' নামের একটি পালা লিখতে আরম্ভ করেন কিন্তু শেষ করতে পারেননি । গোপ সমাজকে গুরুত্ব দেওয়ার আরেকটা কারণ বোধহয় একসময় রাঢ়বঙ্গের একটা বড় অংশ গোপভূমি নামে পরিচিত ছিল।
    সংলাপ রচনায় নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায় সিদ্ধহস্ত ছিলেন।  তাঁর 'মাথুর ' পালা থেকে দু-একটা সংলাপের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।  যেমন-- বৃন্দে । " তোমার মত একটি লোককে দেখেছিলাম বৃন্দাবনে । / সে চরাইতো চোরা ধেনু বেড়াইত বনে বনে।।"  তা শুনে কৃষ্ণ বলছে -- ' তার বর্ণ কেমন? '  বৃন্দে । "এমনই বরণ কালো ভঙ্গি বাঁকা কপাল জুড়ে তিলক  আঁকা , তার চূড়ার  উপর ময়ূর পাখা উড়াইত পবনে।। " কৃষ্ণ । "সে বাজাতো কি ? "

বৃন্দে । "সে বাজাইত বংশী-বেনু/ মাখাতো গায় রাঙ্গা রেনু ,/ তার সামান্যতে ভাসতো তনু রবির কিরণে।" এইসব সংলাপে একটা কাব্যিকতা বজায় ছিল । কিন্তু সংলাপের গতি কোথাও ব্যাঘাত ঘটেনি । ক্রিয়াপদের স্বচ্ছন্দ ব্যবহারে তাঁর নাটকে আছে --- বাজাত , বইত রইত ইত্যাদি লোকায়ত ক্রিয়াপদ তিনি তাঁর নাটকে ব্যবহার করেছেন। পদ‍্যছন্দে কিছু সংলাপ রচিত হলেও তিনি একটা বাক্যের কাঠামোকে মেনে চলেছেন। যে বাক্য অতিসাধারণ গঠন পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে রচিত। শব্দ ব্যবহারে আরবি ,ফারসি, ইংরেজি, দেশি ,আঞ্চলিক ইত্যাদি শব্দ প্রয়োগের কৌশলটিও তাঁর করায়ত্ত ছিল । রাঢ়বঙ্গের সাধারণ লোক মুখের ভাষা ,সমাজ, প্রকৃতি-পরিবেশ কে তিনি তাঁর পালায় ও গানে ব্যবহার করেছেন। তাঁর রাধার বারোমাস্যা বর্ণনায় রাঢ়বঙ্গের প্রকৃতির ছবি পাওয়া যায়। যেমন চৈত্র মাসে গ্রাম বাংলার মাঠে চাতক পাখির ফটিকজল বা পিয়া রব, অঘ্রাণে আমন ধান উঠলে নবান্ন উৎসব , আমন ধান উঠার সময় রসময় কৃষ্ণ রাধার ঘরে নেই । ---এসব একান্তভাবেই বাংলাদেশের ছবি।

    কিংবা পৌষে পরম সুখে গুড় দিয়ে পিঠে খাওয়ার স্বাদ গোপভূমের  মানুষরাই জানেন।  সে দিক থেকে তার কৃষ্ণ যাত্রয় তিনি মূল বিষয়কে অনেকটাই   প্রাদেশিকীকরণ করেছেন।  শ্রীমৎভাগবত,  বিষ্ণুপুরাণ, ব্রহ্মবৈবর্ত ,হরিবংশ ইত্যাদি পুরাণ থেকে কাহিনি গ্রহণ করলেও তিনি জন্মভূমি বর্ধমানের পরিবেশ, বর্ধমানের সমাজভাষাকে ভুলতে পারেননি । সেজন্য তিনি লোকায়ত ।  এই সূত্রেই তিনি লোকশিল্পী।

বাংলা উইকিপিডিয়ায় স্বাগতম[সম্পাদনা]

একাধিক একাউন্টের ব্যবহার[সম্পাদনা]

হ্যালো, ড.রমজান আলি, উইকিপিডিয়ায় স্বাগতমআপনার অবদানের জন্য ধন্যবাদ। আপনার সম্পাদনার ধরনের মাধ্যমে বুঝা যাচ্ছে যে, আপনি উইকিপিডিয়ায় একাধিক একাউন্ট ব্যবহার অথবা উইকিপিডিয়া বহির্ভূত ব্যক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করতেছেন। আমাদের নীতিমালায় উইকিপিডিয়া একাধিক একাউন্ট ব্যবহার সম্পর্কিত আপনার কাজটি সচরাচর সমর্থন করে না। যদি আপনি সরাসরি একাধিক একাউন্ট পরিচালনা অথবা অন্য ব্যক্তির সহায়তায় কাজটি করে থাকেন, অনুগ্রহ করে তা করা থেকে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে।আল রিয়াজ উদ্দীন (আলাপ) ১১:৩৫, ১৩ মে ২০২০ (ইউটিসি)[উত্তর দিন]