বিষয়বস্তুতে চলুন

গেফালেন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
লেখক টমাস মান - ছবিটি ১৯০০ সাল নাগাদ তোলা (গেফালেন গল্পটি লেখা হয়েছিল ১৮৯৪ সালে)।

গেফালেন (জার্মান - Gefallen; গেফালেন; অর্থ - পতিত) হল বিখ্যাত জার্মান সাহিত্যিক টমাস মানের লেখা একটি বড়গল্প। এটিকেই তার লেখা প্রথম বড়গল্পের (নভেলা) মর্যাদা দেওয়া হয়ে থাকে। ১৮৯৪ সালের অক্টোবর মাসে গল্পটি মিউনিখ (München) থেকে ডি গেজেলশাফট (Die Geselischaft) নামক সাময়িকীতে প্রথম প্রকাশিত হয়।[][] প্রকাশের সাথে সাথেই গল্পটি যথেষ্ট সাড়া ফেলে ও মিউনিখের সাহিত্যিক মহলের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই গল্পটির সাফল্য থেকে মান আত্মবিশ্বাস অর্জন করেন এবং লেখালেখি ও সাহিত্যকর্মকেই জীবিকা হিসেবে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।[]

কাহিনীসংক্ষেপ

[সম্পাদনা]

শিল্পী মাইজেনবার্গের স্টুডিওতে এক সান্ধ্যকালীন আড্ডায় নারীমুক্তি ও নারীদের অধিকার নিয়ে আলোচনা চলছিল। সেখানে জড়ো হয়েছিল চারজনের একটি দল - মাউজেনবার্গ নিজে, লাউবে নামে এক তরুণ উদারনৈতিক অর্থনীতিবিদ, কঠোর বাস্তববাদী এক ডাক্তার ডঃ জেলটেন এবং গল্পকথক; শেষের জনের কোনও পরিচয় আমরা গল্পে পাই না, যদিও তার মুখ দিয়েই গল্পটি আমরা শুনি। আলোচনা ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে উঠলে রক্তগরম, আদর্শবাদী, হলুদচুলের তরুণ লাউবে প্রশ্ন তোলে, কোনও তথাকথিত অবৈধ মিলনের ক্ষেত্রে যেখানে পুরুষটিকে সমাজে 'আকর্ষক', 'স্মার্ট', 'চালাক ছেলে', প্রভৃতি বিশেষণ দিয়ে পরোক্ষে উৎসাহিত করা হয়, তখন সেই একই ক্ষেত্রে যুক্ত মেয়েটিকে কেন সমাজ "সমাজ থেকে বিচ্যূত" এমনকী 'পতিতা' বা 'নষ্টা' আখ্যা দিয়ে থাকে। সকলেই প্রবল উত্তেজিত হয়ে আলোচনায় অংশ নিতে শুরু করে। আড্ডায় উপস্থিত তরুণদের মধ্যে বয়সে সবচেয়ে বড়, প্রায় ৩০ বছর বয়সী ডঃ জেলটেন তখন বিষয়টির উপর একটি গল্প বলতে শুরু করেন।

তার গল্পের নায়ক ১৯-২০ বছরের উত্তর জার্মানির এক তরুণ, তার নামটি ইচ্ছে করেই অনুল্লেখিত রাখা হয়। সে সবদিক দিয়েই খুব ভালো ছেলে, কোনওদিন কোনও মহিলাকে সে ছুঁয়েও দেখেনি। দক্ষিণ জার্মানির এক ইউনিভার্সিটি-শহর 'প_'তে সে চিকিৎসাবিদ্যা পড়তে আসে। কিন্তু এখানে এসে সে খুব দ্রুত একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় অভিনেত্রী ইরমা ভেলটনার-এর প্রেমে পড়ে যায়। ইরমারও চরিত্র ছিল নিস্কলঙ্ক। তার উপর সে ছিল খুবই সুন্দরী - একজন প্রায় কিশোরীর মতো কোমল তার গড়ন, ঝকঝকে নীলচে ধূসর দুই চোখ; অসম্ভব সুন্দর হাতদু'টো এত ফরসা যে পাতলা চামড়ার নিচে নীলচে ধমনীগুলোও টের পাওয়া যায়; ধর্মেও তার যথেষ্ট মতি। প্রথমদিকে ছেলেটি দূর থেকে নির্ণিমেষ নয়নে শুধু মেয়েটির দিকে চেয়ে থাকত - প্রতি সন্ধ্যেয় শহরের পার্কেট প্লাৎসে গ্যোটে থিয়েটারের মঞ্চে, আর ঘুমহীন রাতের পর রাতে বিছানায় দু' চোখ ভরে সে কেবল তাকেই দেখত।

তার কিছুটা নাক উঁচু কিন্তু প্রিয় বন্ধু র‍্যোলিং-এর পরামর্শে সে শেষপর্যন্ত একটি ফুলের বোকে'র মধ্যে করে তার স্বপ্নের সেই নায়িকাকে একটি চিঠি পাঠায়। সে চিঠির ভাষা ছিল খুবই আবেগময়, কিন্তু একেবারেই নির্দোষ। কিন্তু বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করেও কোনও উত্তর না পেয়ে শেষপর্যন্ত সে মে মাসের এক লাইলাক ফোটা সকালবেলায় নিজেই মরিয়া হয়ে ইরমার সামনে উপস্থিত হয়। ইরমা তাকে ভালোভাবেই গ্রহণ করে ও তাদের মধ্যে একধরনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তবে ইরমার হাসির মধ্যে যেন কোথায় একটা একটু নাটকের আভাস খেলে যায়।

কিছুদিন পর দু'জনের মধ্যে সম্পর্ক অনেকটা গাঢ় হয়ে ওঠে। সে মাঝেমাঝেই ইরমার কাছে যেতে শুরু করে। ইরমাও তাতে কোনও আপত্তি করে না। ধীরে ধীরে সে সবসময় ইরমার কাছে কাছে থাকতে শুরু করে, ইরমার প্রতিটি খামখেয়ালও যথাসাধ্য মেটানোর চেষ্টা করতে থাকে। এই প্রায় সমবয়সী মেয়েটির সান্নিধ্য ধীরে ধীরে তাকে এমন ঘিরে ফেলতে শুরু করে যে, তাকে কেন্দ্র করে একটা নৈতিক বৈকল্য তাকে পেয়ে বসতে শুরু করে; প্রথম প্রথম এমন একটি প্রতিশ্রুতিবিহীন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার জন্য সে মানসিক পীড়ায় কষ্ট পেত, নিজেকে তার একটা 'স্কাউন্ড্রেল' মনে হত বটে, কিন্তু যত দিন যেতে থাকে, গোলাপী রঙের পারফিউমের মেঘ আর নানা রোকোকো গড়নের চিত্র ও ভাস্কর্যের আড়ালে হারিয়ে যায় তার প্রায় সারা বিশ্বই; সপ্তাহের পর সপ্তাহ একরকম মোহগ্রস্তের মতো সে সেই বিশ্বেই বুঁদ হয়ে থাকে; তার আবেগ প্রকাশ পায় তার লেখা বেশ কয়েকটি সেন্টিমেন্টাল কবিতায়, আর বাড়িতে পাঠানো তার চিঠিতে। তাদের এই সম্পর্ক নিয়ে সারা শহরে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেলে তার বন্ধু র‍্যোলিং একদিন তাকে ডেকে যথেষ্ট তিরস্কার করে বলে, সে এখন স্রেফ ইরমার পায়ের জুতোয় পরিণত হয়েছে।

একদিন হঠাৎ সে ইরমাকে কাঁদতে দেখতে পায়। এরপর আগে থেকে না বলে হঠাৎ এসে পড়ে তার সাথে দেখা হয়ে যায় বরফের মতো সাদা দাড়ির এক বৃদ্ধের সাথে। কিছুটা অপ্রস্তুত ও হতভম্ব হয়ে সে তার পরিচয় দিতে গেলে বৃদ্ধ অত্যন্ত অভদ্র ভাষায় চিৎকার করে ওঠে। তার চেহারা, হাবভাব, কথাবার্তা - কোনও কিছুকে এতটুকু পাত্তাও না দিয়ে সে তাকে একটা মাথামোটা ছোকরা বলে গালাগালি দেয়। ইরমাও একেবারে অপ্রস্তুত হয়ে চুপ করে থাকে। ফলে নায়ককে রীতিমতো অপমানিত হয়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসতে হয়। বেরিয়ে আসার পূর্বমুহূর্তে টেবিলের উপর এক বাণ্ডিল নোট দেখতে পেলে সমস্ত বিষয়টা তার কাছে একমুহূর্তেই পরিষ্কার হয়ে যায়। একটা গা-ঘিনঘিনে অনুভূতি তার মধ্যে মাথা তোলে, ঘাড় ধরে তাকে বের করে আনে। বেরনোর আগে তার ঝোড়ো প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে ইরমা শুধু বলতে পারে, পবিত্রতার যে রূপ নাটকে দেখতে পাওয়া যায়, বাস্তবে তা হয় না; ধনীদের সেখানে জায়গা ছাড়তেই হয়। বাইরে থেকে জানলা দিয়ে লাইলাক ফুলের গন্ধ ভেসে আসে।

লাইলাক ফুলের গন্ধ ভেসে আসে তাদের আড্ডাতেও, মাইজেনবার্গের স্টুডিওয়। তবে সেই গন্ধের উৎস বাইরের খোলা বাগানের কোনও গাছে ফোটা ফুল নয়, স্টুডিওয় সাজানো একটি ফুলদানিতে রাখা কিছু ফুল। লাউবে এই গল্পে কীভাবে তার দেওয়া নারীমুক্তির সপক্ষে যুক্তিগুলো খারিজ হয়ে যায়, তাই নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ডঃ জেলটেন শুধু বলেন, যদি কোনও মহিলার আজ ভালোবাসার মূল্যে পতন ঘটে, কাল টাকার মূল্যেও তার পতন ঘটতেই পারে। তারপর তিনি পরিচয় ভাঙেন তার নায়কের, বলেন তিনি নিজেই সেই নায়ক। এ তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।[]

বিশ্লেষণ ও সমালোচনা

[সম্পাদনা]

টমাস মানের এটি একেবারে প্রথমদিকে লেখা গল্প। ফলে পরবর্তী মানের পরিণতমনস্কতা এই গল্পে স্বাভাবিকভাবেই ততটা পরিস্ফূট নয়। তবে প্রকাশিত হবার পরেই গল্পটি যথেষ্ট সমাদৃত হয়, সমালোচকমহলও তারপর থেকে নানাদিক থেকে তাকে বিশ্লেষণ করে দেখান -

শিরোনাম

[সম্পাদনা]

সমালোচকদের মতে গল্পের শিরোনামটি ছোট্ট, কিন্তু দ্বিস্তরীয় ও একাধিক অর্থব্যঞ্জক। এখানে গেফালেন শব্দটির মূল হচ্ছে একটি বিশেষ্য - "ফাল" (জার্মান - Fall), যার অর্থ 'পতন'। গল্পে দেখা যায় শব্দটি এ' সমাজে নারীদের অবস্থানের সাপেক্ষে ভীষণভাবেই প্রাসঙ্গিক - ভালোবাসার কারণেই হোক বা টাকা, 'পতন' তাদের নিয়তি। আবার ডঃ জেলটেনেরও তার তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে 'পতন' ঘটে, তার যৌবনের আদর্শবাদ এসে আছাড় খেয়ে পড়ে কঠোর বাস্তবের কর্দমাক্ত ভূমিতে। গল্পটি পড়তে গিয়ে পাঠকও একাধিক স্তরে 'পতন'এর সম্মুখীন হয় - প্রথমে সে অনভিজ্ঞ ডঃ জেলটেনের ইরমার প্রেমে একরকম নিরুপায় 'পতন' প্রত্যক্ষ করে; এর পরবর্তী স্তরে পতন ঘটে ইরমার, তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থানই তাকে যে পতনের দিকে ঠেলে দেয় ("... ধনীদের সেখানে জায়গা ছাড়তেই হয়।") ও তার মধ্য দিয়ে পতন ঘটে অনভিজ্ঞ নায়কেরও - আদর্শবাদী উচ্চতা থেকে বাস্তবের তিক্ত রুক্ষ ভূমিতে। গল্পটি পড়ার অভিজ্ঞতা পাঠককেও একই রকমের এক 'পতন'এর অভিজ্ঞতার শরিক করে তোলে - আদর্শবাদ ও সুমিষ্ট প্রেমের উচ্চতা থেকে এক হতাশ ও তিক্ত বাস্তবতার গর্ভে।

চরিত্রদের নাম

[সম্পাদনা]

ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায়, গল্পটির মূল চরিত্রগুলির নামও যথেষ্ট অর্থবহ। যুবক ডঃ জেলটেন প্রথমে ছিলেন কিছুটা লাজুক, চাপা ও সতর্ক স্বভাবের, অসম্ভব সৎ এক তরুণ - বাস্তবে বেশিরভাগ তরুণের স্বভাব ঠিক যার উলটো। কিন্তু রূঢ় বাস্তবের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বর্তমানে তাকে আমরা যে রকম তিক্ত বাস্তববাদীরূপে প্রত্যক্ষ করি, সে'রকম চরিত্রের দেখাও আমাদের চারপাশে কখনওসখনওই মেলে। সে অর্থে জেলটেন (জার্মান - Selten; অর্থ - 'কখনওসখনও') শব্দটি তার নাম হিসেবে একেবারেই যথার্থ; ইরমা ভেলটনারএর পদবী 'ভেলটনার'এর প্রথম অংশ ভেল্ট (Welt; অর্থ - 'পৃথিবী'); আবার ইরমা শব্দটিও এসেছে পুরনো হাইজার্মান শব্দ irmin (ইরমিন) থেকে, যার মানেও পৃথিবী; গল্পে আমরা দেখি পেশার কারণে ইরমাকে বাইরের পৃথিবীর জন্যই বেশি সময় ব্যয় করতে হয়; মঞ্চে যে পাটাতনে দাঁড়িয়ে সে অভিনয় করে - তাও পৃথিবীরই ইঙ্গিতবাহী,আবার তার হাত ধরেই আদর্শবাদ ও প্রেমের সুউচ্চ শিখর থেকে বাস্তবের পৃথিবীতে পতন ঘটে নায়কের। লাউবে (Laube) কথাটির আক্ষরিক অর্থ কাঠের তৈরি একটি ছোট্ট বাগানবাড়ি, যা সমাজের জটিলতা ও পঙ্কিলতা থেকে বহুদূরে প্রকৃতির কোলে একেবারে বিচ্ছিন্ন একধরনের আদর্শবাদেরই ইঙ্গিতবাহী। আবার লাউবে নামটি আমাদের সেইসময়ের সদ্যপ্রয়াত এক বিখ্যাত আদর্শবাদী লেখক হাইনরিখ রুডলফ লাউবের (১৮০৬ - ১৮৮৪) কথাও মনে পড়িয়ে দেয়।[] গল্পে লাউবের কথাবার্তা ও যুক্তিপ্রবাহ সেইধরনের এক আদর্শবাদের কথাই তুলে ধরে।

গল্পকথন

[সম্পাদনা]

এই গল্পটির কথনের ক্ষেত্রে মান দু'জন গল্পকথককে ব্যবহার করেছেন। গল্পটি "গল্পের মধ্যে গল্প" পদ্ধতিতে লেখা। এক্ষেত্রে মানের লেখার মধ্যে পূর্ববর্তী জার্মান লেখক টেওডর স্টর্ম (১৮১৭ - ১৮৮৮) ও সুইস লেখক কনরাড ফার্ডিনান্ড মাইয়ারের লেখার ধরনের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়।[] নামহীন গল্পকথক প্রথমে আমাদের মাইজেনবার্গের স্টুডিও ও সেখানে জড়ো হওয়া কিছু মানুষের সাথে পরিচয় ঘটায়, যারা সবাই জার্মান শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অঙ্গ ও সেখানে প্রাসঙ্গিক নানা ধরনের চিন্তাভাবনা ও আদর্শবাদ তাদের মধ্যেও ক্রিয়াশীল। মূল গল্পের ক্ষেত্রে এটি একটি ফ্রেমের কাজ করে, মূল গল্পটিকে চারিদিক থেকে ঘিরে রাখে। আর এর মধ্যে দাঁড়িয়ে মূল গল্পটি ডঃ জেলটেনের মুখ দিয়ে বলানো হয়।[] ফলে পাঠকের সাথে মূল গল্পের গল্পকথকের একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এই দূরত্বটি তৈরি হওয়ার ফলেই পাঠকমন মূল গল্পের সাথে পুরোপুরি একাত্ম হয়ে পড়ে না, বরং কিছুটা দূরে থেকে তাকে বিচার করতে ও ঘটনাবলী সম্পর্কে মূল গল্পকথকের থেকে পৃথক দৃষ্টিভঙ্গী পোষণ করতে সক্ষম হয়। সেই কারণেই গল্পের উপসংহারে পৌঁছে মূল গল্পকথক ডঃ জেলটেন তার নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ তিক্ত বাস্তববোধ থেকে যখন বলে ওঠেন, যদি কোনও মহিলার আজ ভালোবাসার মূল্যে পতন ঘটে, কাল টাকার মূল্যেও তার পতন ঘটবে ( „Wenn eine Frau heute aus Liebe fällt, fällt sie morgen um Geld“[]) - লাউবের মতো পাঠকমননও তার সেই মতের সাথে একমত হয় না, বরং সম্পূর্ণ অন্য ক'টি বিষয়, যেমন - আদর্শবাদ ও বাস্তবের সাথে তার দ্বন্দ্ব, রোমান্টিক ভালোবাসার বাস্তব সম্ভাব্যতা, সমাজে নারীর অবস্থান, আধুনিক মধ্যবিত্ত তথাকথিত প্রগতিশীল জগতের দ্বৈতাচার, প্রভৃতিই তার চিন্তাজগতে মূলত প্রভাব বিস্তার করে।

বিষয়বস্তু

[সম্পাদনা]

টমাস মানের লেখা এই বড় গল্পটির বিষয়বস্তু আপাতদৃষ্টিতে নারীর স্বাধীনতা ও তার যৌনতার অধিকার হলেও তার পিছনে লুকিয়ে থাকে দু'টি সম্পূর্ণ বিপরীত বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীর মুখোমুখি সংঘাত। এদের মধ্যে একটি হল রোমান্টিক আদর্শবাদ ও অন্যটি হল চূড়ান্ত বাস্তববাদ, যা প্রায় নৈরাজ্যবাদের সীমা ছুঁয়ে ফেলে। এখানে মুখোমুখি হয় একদিকে লাউবের মতো চূড়ান্ত আদর্শবাদী চরিত্র ও অন্যদিকে ডঃ জেলটেনের মতো চরিত্র, জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা যাকে একধরনের নাকউঁচু ও সন্দেহবাতিক (সিনিক) বাস্তববাদী করে তুলেছে।

গল্পের শুরুতেই আমাদের সাথে পরিচয় ঘটে লাউবের আদর্শবাদের। নারীমুক্তি নিয়ে তার তোলা প্রশ্ন একেবারে শুরুতেই সুর বেঁধে দেয় সমগ্র গল্পটিরই। এরপরে শুরু হয় তারই পরিপ্রেক্ষিতে ডঃ জেলটেনের বলা গল্পের মধ্যে গল্পটি। সেখানে শুরুতে বিষয়বস্তু হিসেবে উঠে আসে অপূর্ণ প্রেম ও তাইজনিত হতাশা। কিন্তু নামহীন নায়কের মধ্যে এইভাবে এক অভিনেত্রীর সাথে কোনওরকম পরিণতির প্রতিশ্রুতিহীন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া নিয়ে যে নৈতিক দ্বন্দ্ব ক্রিয়া করতে থাকে (নিজেকে তার মনে হতে শুরু করে 'স্কাউন্ড্রেল'[]), তাতে বিষয়বস্তুতে সামাজিক নৈতিকতার দিকটাও সামনে চলে আসে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তার প্রেম একধরনের ঘৃণা ও সিনিসিজমে পরিণত হয়। আমরা জানতে পারি, সেই নামহীন যুবকই আজকের ডঃ জেলটেন।

এখানে ডঃ জেলটেনের মাধ্যমে আসলে মান বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সুবিধাবাদী দ্বিমুখী চরিত্রের এক বৈশিষ্ট্যেরই মুখোশ উদ্ঘাটন করেন। সে নারী স্বাধীনতার পক্ষে, কিন্তু তা ততক্ষণই, যতক্ষণ তার সুফল তার নিজের জোটে। একেবারে পুরুষতান্ত্রিক ভঙ্গিমাতেই তার আচরণ দাবি করে তার ভালোবাসার নারীটির শুধুমাত্র তারই সম্পত্তি হওয়া উচিত, অথচ সেই পুরুষতন্ত্র নির্ধারিত চিন্তা থেকে মুক্তি না ঘটলে ইরমা ভেলটনারের সাথে তার সম্পর্কটাই সম্ভব হত না। গল্পের শেষে সে নারীদের সম্পর্কে তার নিজস্ব যে সিদ্ধান্তে পৌঁছয় (... যদি কোনও মহিলার আজ ভালোবাসার মূল্যে পতন ঘটে, কাল টাকার মূল্যেও তার পতন ঘটবে), গল্পেরই বিভিন্ন কোণ থেকে উঠে আসে তার অসাড়তার প্রমাণ। ইরমার নিজের বক্তব্যে উঠে আসে সমাজে ধনীদের আধিপত্য ও শোষণের অর্থনৈতিক ভিত্তির কথা (এ' সমাজে কেবল ধনীরাই নৈতিকতা বজায় রাখতে পারে; ... ... ধনীদের সেখানে জায়গা ছাড়তেই হয়; „...das müssten sie den reichen Leuten überlassen"[])

গল্পটি তবে পাঠকের মনে নারীদের যৌনস্বাধীনতার প্রশ্নে কী বার্তা প্রেরণ করে? একদিকে লাউবের আবেগপ্রবণ যুক্তিপ্রবাহ ও অন্যদিকে ইরমার জীবনলব্ধ মতামত যখন এর পক্ষে মত প্রকাশ করে ড জেলটেনের তিক্ত বিরুদ্ধ মতামতকে খারিজ করে দেয়, গল্পে কিন্তু তখন এইবিষয়ে কোনও নির্দিষ্ট মতের প্রতি পুরোপুরি সমর্থন গড়ে ওঠে না; বরং তা পাঠকের মনে এই বিষয়ে বিতর্ককেই জাগিয়ে তোলে, পাঠকমন আলোড়িত হয়ে ওঠে এই প্রশ্নে, হয়ে ওঠে সক্রিয়।[] আবার একইসময়ে আরও কতগুলি বিষয়ও উঠে আসে গল্পের বিষয়বস্তু হিসেবে, যেমন - মধ্যবিত্ত সমাজের আপাত বুদ্ধিবৃত্তির তলায় লুকিয়ে থাকা দ্বিচারিতা। ডঃ জেলটেনের বক্তব্য, চরিত্র ও অভিজ্ঞতা যেখানে পরতে পরতে এই দ্বিচারিতাকে উন্মোচন করে দেখায়, ইরমার বাড়িতে দেখতে পাওয়া সাদাচুলের বৃদ্ধের আচরণ সেখানে উন্মোচন করে তার এক নিকৃষ্ট রূপ, যা দেখে নায়কের সাথেই ঘৃণায় শিউড়ে ওঠে পাঠকমনও।

লিখনশৈলী

[সম্পাদনা]

গল্পটি গল্পের মধ্যে গল্প শৈলীতে লেখা। এখানে নামহীন গল্পকথকের মুখে আমরা পাই শিল্পী মাইজেনবার্গের স্টুডিওর বর্ণনা ও সেখানে উপস্থিত বিভিন্ন চরিত্রগুলির চিত্রণ। মূল গল্পের ফ্রেম হিসেবে এর গুরুত্বও সমগ্র গল্পটির সাপেক্ষে অনস্বীকার্য।

লিখন ও প্রকাশনার ইতিহাস

[সম্পাদনা]

১৮৯৪ সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে টমাস মান ল্যুবেক থেকে মিউনিখ আসেন। এখানে এপ্রিল মাসে তিনি একটি ফায়ার ইনসিওরেন্স কোম্পানিতে ট্রেনি এজেন্ট হিসেবে যোগ দেন। এই কোম্পানিতে তিনি আগস্ট পর্যন্ত কাজ করেছিলেন। এইসময়েই তিনি গেফালেন গল্পটি লেখেন। তবে গল্পটির আইডিয়া তিনি যখন ল্যুবেক জিমনাসিয়ুমে ছিলেন, সেই সময়কারই।

আরও দেখুন

[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Mann, Viktor. Wir waren fünf. S. Fischer Verlage. আইএসবিএন ৯৭৮-৩-৫৯৬-১২২৭৫-২
  2. "Thomas Mann". Literaturportal Bayern. সংগৃহীত ১২ ডিসেম্বর, ২০১৫।
  3. Thomas Mann: Gesammelte Werke in Dreizehn Bänden. Band 8.
  4. Mundt, Hannelore. Understanding Thomas Mann. Columbia: University of South Carolina Press, 2004. আইএসবিএন ১-৫৭০০৩-৫৩৭-৭. পৃঃ - ২৩।
  5. Thomas Mann: Gesammelte Werke in Dreizehn Bänden. অষ্টম খণ্ড. পৃঃ - ৪২।
  6. Thomas Mann: Gesammelte Werke in Dreizehn Bänden. অষ্টম খণ্ড. পৃঃ - ৩০।
  7. Thomas Mann: Gesammelte Werke in Dreizehn Bänden. অষ্টম খণ্ড. পৃঃ - ৪০।
  8. Mundt, Hannelore. Understanding Thomas Mann. Columbia: University of South Carolina Press, 2004. আইএসবিএন ১-৫৭০০৩-৫৩৭-৭. পৃঃ - ২৪।

গ্রন্থপঞ্জি

[সম্পাদনা]