ঘনরাম চক্রবর্তী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(Ghanaram Chakrabarty থেকে পুনর্নির্দেশিত)
ঘনরাম চক্রবর্তী
জন্ম১৬৬৯
কৃষ্ণপুর বর্ধমান
পরিচিতির কারণকবি

ঘনরাম চক্রবর্তী(১৬৬৯ - ?) মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ধর্মমঙ্গল শাখার এক অন্যতম কবি। তাঁর সুবৃহৎ ধর্মমঙ্গল কাব্যটি তিনি ১৭১১ সালে রচনা করেন।

জন্ম[সম্পাদনা]

তিনি পূর্ব বর্ধমান জেলার খণ্ডঘোষ থানার কৃষ্ণপুর কুকুরা গ্রামে ব্রাহ্মণবংশে ১৬৬৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম গৌরীকান্ত এবং মাতার নাম সীতাদেবী। রামবটি গ্রামের ভট্টাচার্য মহাশয়ের চতুষ্পাঠীতে সংস্কৃত শিক্ষা নেন। ছাত্রবস্থায় কবিতা রচনার জন্য গুরু তাকে 'কবিরত্ন' উপাধি দেন।[১] তৎকালীন বর্ধমানরাজ কীর্তিচন্দ্রের সমসাময়িক ছিলেন তিনি। তার কাব্যমধ্যে বহু জায়গায় তাঁর নাম উচ্চারিত হয়েছে। কবি যে রামভক্ত ছিলেন তার পরিচয় মেলে তাঁর অনেক ভণিতার মধ্যে। তাঁর কাব্যভাষায় রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের পূর্বাভাস লক্ষ্য করা যায়। ঘনরামের কাব্যের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য সে সময়ের সমাজে হিন্দু, মুসলিম সম্প্রীতিকে লিপিবদ্ধ করার মধ্যে রয়েছে। ধর্মমঙ্গলে হিন্দু, মুসলমানের একত্রে রুটি ভাগ করে খাওয়ারও বর্ণনা রয়েছে। গরিব মুসলমানের কাছেও ধর্মদেবতা সে যুগে ক্রমশ আরাধ্য হয়ে উঠেছিল বলে তিনি দেখিয়েছেন।[২] সুগায়ক ও কবি ঘনরাম চক্রবর্তী রচিত একটি সত্যনারায়ণ পাঁচালী আছে। বংশপরম্পরায় চক্রবর্তী উপাধি লাভ করেন।[১]

বংশ পরিচয়[সম্পাদনা]

পশ্চিমবঙ্গে ঘনরাম আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন। একুশ শতকের সূচনালগ্নে ঘনরাম চক্রবর্তীর বংশধরদের হাত ধরে কৃষ্ণপুরে তৈরী হয় ‘কবি ঘনরাম স্মৃতিরক্ষা কমিটি’। এরাই প্রতি বছর ঘনরামের স্মৃতিতে ঘনরাম মেলার সূচনা করে এবং এদের উদ্যোগে প্রতি বছর মেলার আয়োজন করা হয়। ঘনরামের পুঁথি তার গ্রামেই সংরক্ষিত ছিল পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় ছেপে প্রকাশ করে। [২]

কবির প্রতিভা[সম্পাদনা]

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসআর্য-অনার্য সংস্কৃতির মিলনে দেব-দেবীকে কেন্দ্র করে যে আখ্যান কাব্য রচিত হয়েছে তাকে বলা হয় মঙ্গল কাব্য। এই মঙ্গল কাব্য মূলত তিনটি। এগুলি হলো- ১. পঞ্চদশ শতাব্দীতে রচিত মনসামঙ্গল কাব্য। ২. ষোড়শ শতকে রচিত চণ্ডীমঙ্গল কাব্য। ২. অষ্টাদশ শতাব্দীতে রচিত ধর্মমঙ্গল কাব্য। এই ধর্মমঙ্গল কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি হলেন ঘনরাম চক্রবর্তী কারণ তার লেখাটি প্রথম ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।

নিচে কবি প্রতিভার অংশ হিসেবে কবির বৈশিষ্ট্য, কাব্যের উৎস, রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য, রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য, চরিত্র চিত্তনে দক্ষতা ইত্যাদি আলোচনা করা হয়েছে

কবির বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

কবির বৈশিষ্ট্য ঘনরাম চক্রবর্তীর বৈশিষ্ট্য গুলি হল-

ক) মানবতা: মধ্যযুগের সাহিত্য পরিমণ্ডল ছিল দেববাদের পরিপূর্ণ তাই সর্বত্র দেববাদের জয় গান সূচিত হয়েছিল এই দেববাদের পরিমণ্ডলে থেকেও সর্বপ্রথম মানবতার পরিচয় দিলেন কবি।

খ) পাণ্ডিত্য: ঘনরাম চক্রবর্তী ছিলেন জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব। সংস্কৃত সাহিত্য ও অলংকারের পাশাপাশি বিভিন্ন দেশীয় ভাষার ক্ষেত্রেও তিনি অসামান্য জ্ঞান ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তার এই জ্ঞান এই ধর্মমঙ্গল কাব্যেও প্রতিফলিত হয়

কবি প্রতিভার স্বাতন্ত্র[সম্পাদনা]

ঘনরাম মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। কবি পথম তার কাব্যে একজন মায়ের আর্তনাদকে তুলে ধরেছেন। যদিও সাহিত্য- শিল্লের বিচারে তাঁর পাঁচালি প্রধান কাব্য তেমন কিছু মহৎ সৃষ্টি নয়- তবুও সমকালীন মঙ্গলকাব্যের নির্দিষ্ট কাঠামাের মধ্যে বিচিত্র কল্লনার বর্ণ সমাবেশে জীবনাদ্শণগত উচ্চকোটির ভাবকল্লনায় তিনি এক উল্লেখযােগ্য কবি।

চরিত্র চিত্তনে দক্ষতা:[সম্পাদনা]

(a) লাউসেনঃ লাউসেন ধর্মের প্রডাবপুষ্ট। এই দৈবানুকুল্যের কথা বাদ দিলে এই চরিত্রটি মানবিক গুণে পুণ্য । পিতামাতার প্রতি ভক্তি, ধর্মীয় প্রথানুসরণ, নির্ভীকতা ও অসামান্য বীরত্বের জাজ্বল্য মুতি লাউসেন।

(b) রঞ্জাবতীঃ সন্তানবংসল মাতুহ্দয়ের শাশ্বত-রমণীয় রূপটি ঘনরামের কাব্যে বিশিষ্টরপে রঞ্জাবতী চরিত্রটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। রঞ্জাবতী স্বর্গের শাপত্রষ্ট নর্তকী হলেও স্নেহময়ী, সরবদা পুত্রচিন্তায় অধীর মাতুত্বের চিরন্তনী প্রতিমূর্তি।

(C) মহামদ: ভিলেন বা খলচরিত্র হিসেবে মহামদ চরিত্রটি ঘনরামের অনবদ্য সৃষ্টি। শঠতা, তুরতা ও প্রতিহিংসা পরায়ণতায় মহামদ খুবই স্বাডাবিক ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

কাব্যের উৎস[সম্পাদনা]

ঘনরামের কাব্যের নাম অনাদিমঙ্গল। তবে অনেক ক্ষেত্রে শ্রীধর্মসঙ্গীত', "মধুরভারতী' প্রভূতি নামও ব্যবহার করেছেন কবি। তিনি কাব্য রচনায় দেবতার স্বপ্নাদেশের কোন বিবরণ উল্লেখ করেন নি। তানেই মনে করা হয় গুরুর অদেশেই তনি কাব্য রচনা করেন। তবে কোথাও তিনি গুরু নাম উল্লেখ করেন নি।

রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্য:[সম্পাদনা]

ডঃ সুনীতি কুমার চটোপাধ্যায় ধর্মমঙ্গল কাব্যকে রাঢ় দেশের জাতীয় মহাকাব্য নামে অভিহিত করেছেন । কারণ, ধর্মমন্গলের প্রধান ঘটনা রাচ়ভূমিকে কেন্র করেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই কাব্যে রাঢ় দেশের নিম্নশ্রেণীর জাতিদের চরিত্রের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। এই কাব্যের পটভূমিতে রাঢ়বঙ্গের ইতিহাস, সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবনের চিত্র ফুটেছে।

ধর্মমঙ্গল কাব্যের কাহিনী এক নজরে[সম্পাদনা]

ধর্মঠাকুরের কৃপায় রঞ্জাবতী পুত্রসন্তান লাভ করলে সেই পুত্রের নাম রাখা হয় লাউসেন। মহামদ যুবক লাউসেনের ক্ষতি করার জন্য বারবার তাকে বিভিন্ন ঝুঁকিবহুল যুদ্ধে পাঠাবার চক্রান্ত করলেও তিনি ধর্মঠাকুরের কৃপায় সর্বত্রই জয়লাভ করেন। ধর্মঠাকুরের কৃপায় যুদ্ধে নিহত হন ইছাই ঘােষ। তারপরেও মহামদের প্ররােচনায় গৌড়ের রাজা লাউসেন ধর্মঠাকুরের প্রকৃত ভক্ত কি না তাতে সন্দেহ প্রকাশ করেন। তিনি লাউসেনকে পশ্চিম দিকে সূর্যোদয় ঘটিয়ে ধর্মঠাকুরের ভক্ত হওয়ার প্রমাণ দিতে বলেন। 'হাকন্দ নামে একটি জায়গায় লাউসেন এই অসাধ্য সাধন করেন। লাউসেন যখন তপস্যারত, তখন সেই সুযােগে মহামদ ময়নাগড় আক্রমণ করেন। নিহত হন কালু ডােম এবং লাউসেনের প্রথমা স্ত্রী কলিঙ্গা। লাউসেন ময়নাগড়ে ফিরে ধর্মঠাকুরের স্তব শুরু করলে সকলেই বেঁচে ওঠে। মহাপাপের জন্য মহামদ কুষ্ঠরােগে আক্রান্ত হলে লাউসেন ধর্মঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করায় তিনি রােগমুক্ত হন। এভাবে ধর্মঠাকুরের পূজা প্রচার করে লাউসেন তাঁর পুত্র চিত্রসেনের হাতে রাজ্যভার দিয়ে যথাসময়ে স্বর্গারােহণ করেন।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬ পৃষ্ঠা ২০৯, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  2. "ঘনরামের 'ধর্মমঙ্গল'-এ সমাজ জীবনের ছবি"anandabazar.com। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-১০-২৬ 
  1. বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস- অসিত কুমার সেন