হিন্দু প্যাট্রিয়ট
ধরন | সাপ্তাহিক (১৮৫৩–১৮৯২) দৈনিক (১৮৯২–১৯২৪) |
---|---|
মালিক | মধুসূদন রায়(১৮৫৩–৫৪) গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৫৪–৫৬) (১৮৫৬–৬১) কালীপ্রসন্ন সিংহ (১৮৬১) ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮৬১–৬২) পরিচালকমণ্ডলী(১৮৬২–১৯২৪) |
সম্পাদক | গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৫৩–৫৫) হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় (১৮৫৫–৬১) গিরিশচন্দ্র ঘোষ (১৮৬১) কৃষ্ণদাস পাল (১৮৬১–১৮৮৪) রাজকুমার সর্বাধিকারী (১৮৮৪ –১৯১১) |
প্রতিষ্ঠাকাল | ১৮৫৩ |
সদর দপ্তর | কলকাতা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত |
প্রচলন | আনু. ২০০ (১৮৫৭-পূর্ব)[১] |
হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা ছিল ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে অবিভক্ত বাংলায় কলকাতা হতে ইংরাজী ভাষায় প্রকাশিত সংবাদ সাপ্তাহিক। সমকালীন বাংলার সমাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্বের সম্পাদনায় নির্ভীক ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জনসমক্ষে পরিবেশিত হত।
ইতিহাস
১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে মধুসূদন রায় নামের এক ব্যাঙ্কব্যবসায়ী 'বেঙ্গল রেকর্ডার' -এর প্রতিষ্ঠাতা শ্রীনাথ ঘোষ ও তার ভাই গিরিশচন্দ্র ঘোষকে একটি ইংরাজী সংবাদ পত্র প্রকাশের জন্য প্রস্তাব দেন। স্থির হয় 'বেঙ্গল রেকর্ডার' বন্ধ করা হবে এবং নতুন সংবাদপত্রটির নাম হবে "হিন্দু প্যাট্রিয়ট"। নামটি সম্ভবত গিরিশচন্দ্র ঘোষের দেওয়া। কিন্তু "রেইস ও রায়য়েট" নামক পত্রিকা সূত্রে জানা যায় যে, নামটি ঘোষেদের সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা ক্ষেত্রচন্দ্র ঘোষই দিয়েছিলেন। তদানীন্তন প্রখ্যাত সাংবাদিক কৃষ্ণদাস পালের মতে যিনি পত্রিকার ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে এর সম্পাদক হয়েছিলেন, নামটি হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের দেওয়া। কিন্তু গিরিশচন্দ্র ঘোষের জীবনীকার ও পৌত্র মন্মথনাথ ঘোষ কৃষ্ণদাস পালের মত খন্ডন করেন, মধুসূদন রায়ের সিদ্ধান্ত অনুসারে "হিন্দু প্যাট্রিয়ট" নামটি গিরিশচন্দ্র ঘোষের নিজের দেওয়া এবং এও উল্লেখ করেন যে, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় অনেক পরে এবং প্রথমদিকে এক অধীনস্থ কর্মী হিসাবে যোগ দেন।[২]
হিন্দু প্যাট্রিয়ট ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের ৬ ই জানুয়ারি গিরিশচন্দ্র ঘোষের সম্পাদনায় মধুসূদন রায় প্রকাশ করেন এবং এটি প্রতি বৃহস্পতিবার তার কলাকার স্ট্রিটস্থিত প্রেস হতে প্রকাশ হতে থাকে।[৩] ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে কিছুদিন কাশীতলা হতে মুদ্রিত হয়। সেসময়ের 'বেঙ্গল রেকর্ডার' -এর সংবাদদাতা হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় হিন্দু প্যাট্রিয়টে যোগদেন এবং ক্রমে সম্পাদকীয় বোর্ডে উন্নীত হন। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি হিন্দু প্যাট্রিয়টের মুখ্য সম্পাদক হন। এক বছর পর তিনি তার দাদা হারাণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নামে স্বত্ব কেনেন ও সংবাদপত্রটির পূর্ণ মালিকানা গিরিশচন্দ্র ঘোষের থেকে তার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা হারানচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নামে পরিবর্তিত হয়। কিন্তু গিরিশচন্দ্র ঘোষ ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত লিখতে থাকেন। তারপর হিন্দু প্যাট্রিয়ট ছেড়ে "দি বেঙ্গলি" নামে ইংরাজী সংবাদপত্র শুরু করেন।[২]
১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই জুন হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের অকাল মৃত্যুতে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা আর্থিক দুরবস্থায় পড়ে। কালীপ্রসন্ন সিংহের আর্থিক সহায়তায় রক্ষা পায়।[৪] গিরিশচন্দ্র ঘোষ তিন বৎসর আগে হিন্দু প্যাট্রিয়টের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করলেও, তিনি হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের শোকাহত মা ও অসহায় বিধবা পত্নীর জন্য পুনরায় সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পুনরায় ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে তিনি হিন্দু প্যাট্রিয়ট ত্যাগ করলে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সংবাদপত্রের মালিকানা নেন এবং কৃষ্ণদাস পাল (১৮৩৮ - ১৮৮৪) সম্পাদক হন।[৫]
১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে কিশোরীচাঁদ মিত্র প্রতিষ্ঠিত "ইন্ডিয়ান ফিল্ড" নামের ইংরাজী সংবাদ সাপ্তাহিকটি ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে "হিন্দু প্যাট্রিয়ট" এর সাথে মিশে যায়[৬] ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণদাস পালের মৃত্যুর পর লখনউ-এর দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় প্রতিষ্ঠিত লখনউ টাইমস্-এর সম্পাদক রায়বাহাদুর রাজকুমার সর্বাধিকারী (১৮৩৯-১৯১১) এর সম্পাদক হন। পত্রিকাটি ৭১ বৎসর চলেছিল। ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে এর প্রকাশনা বন্ধ হয়।
ভূমিকা ও প্রভাব
আদর্শগত ভাবে জাতীয়তাবাদের প্রচারে হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
১৮৫৭ বিদ্রোহ
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের সময় হিন্দু প্যাট্রিয়ট বিদ্রোহের যাবতীয় খবর গুরুত্ব সহকারে নিয়মিত প্রকাশ করত। পত্রিকার তৎকালীন সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হয়েছিল যে, বিদ্রোহীরা মুঘলদের নেতৃত্বের উপর আস্থা রেখে প্রকৃতই নিজেদের ক্ষতিই হয়েছিল। তাঁতীয়া টোপিকে যখন ফাঁসি দেওয়া হয় হিন্দু প্যাট্রিয়ট তাঁকে শহীদের শ্রদ্ধা জানায় এবং লক্ষ্মীবাঈ এবং কুঁয়র সিং প্রচেষ্টার জন্যও তাঁদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে।[৭]
নীল বিদ্রোহ
হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের সক্ষম ও বলিষ্ঠ সম্পাদনায় মূলত "হিন্দু প্যাট্রিয়ট" শাসকের অন্যায় আচরণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রধান মুখপত্র হয়ে ওঠে। পঞ্চাশের দশকের শেষদিকে "হিন্দু প্যাট্রিয়ট"-এই নীলকর সাহেবদের দ্বারা ভারতীয় নীলচাষিদের উপরে উৎপীড়ন ও অকথ্য অত্যাচারের বিরুদ্ধে সরব হন। বাংলার উচ্চশ্রেণীর মানুষদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানাতেন।
১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা হাইকোর্টের লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল জগদানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে প্রিন্স অব ওয়েলস পদার্পণ করলে, বাড়ির মহিলারা তাঁকে ভারতীয় প্রথায় শঙ্খধ্বনি ও উলুধ্বনিতে বরণ করে। এই ঘটনাটি জাতীয়স্তরে যে ক্ষোভের সঞ্চার করে, তার উপর হিন্দু প্যাট্রিয়ট যথাযথ মন্তব্য করে।[৮]
গিরিশচন্দ্র ঘোষ ও হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের প্রথমদিকের সম্পাদনার পর কৃষ্ণদাস পাল একাধিক্রমে তেইশ বছর সম্পাদনায় তৎকালীন রাজনীতিতে তার প্রভাব বিস্তার করে। 'ইলবার্ট বিল', 'ইমিগ্রেশন বিল', 'ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট' ইত্যাদি আইন প্রনয়ণের সময় হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায় চা-শ্রমিকদের পক্ষে, সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়ে ও দেশীয় ডেপুটি ম্যাজিসেট্রটদের সপক্ষে বিস্তর প্রবন্ধ রচনা করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন। তিনি 'ইমিগ্রেশন বিল' দ্বারা চা-শ্রমিকদের নির্যাতন ব্যবস্থার প্রতিবাদে কৃষ্ণদাস এই বিলকে "ভারতের ক্রীতদাস আইন" বলে অভিহিত করেন।[৫]
তথ্যসূত্র
- ↑ ভট্টাচার্য, মাইনি (২২ এপ্রিল ২০০৭)। "1857 And The Hindoo Patriot"। পিপলস ডেমোক্রেসি (ইংরেজি ভাষায়)। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)। XXXI (১৬)। ১৫ মার্চ ২০১২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ এপ্রিল ২০১১।
- ↑ ক খ ঘোষাল, মমথনাথ (১৯১১)। The life of Grish Chunder Ghose, the founder and first editor of "The Hindoo patriot" and "The Bengalee," (ইংরেজি ভাষায়)। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার। আর. ক্যাম্ব্রি। পৃষ্ঠা ৭৮–৮০।
- ↑ ভেঙ্কটেশন, ভি. (১৪ আগস্ট ২০১০)। "India & two revolts" (ইংরেজি ভাষায়)। দ্য হিন্দু গ্রুপ। সংগ্রহের তারিখ ৫ এপ্রিল ২০১১।
- ↑ রয়, সামারেন (১৯৯৯)। The Bengalees: Glimpses of History and Culture (ইংরেজি ভাষায়)। অ্যালাইড পাবলিশার্স। পৃষ্ঠা ১৭৯। আইএসবিএন 81-7023-981-8। সংগ্রহের তারিখ ৫ এপ্রিল ২০১১।
- ↑ ক খ সেনগুপ্ত, সুবোধ বসু; বসু, অঞ্জলি, সম্পাদকগণ (জানুয়ারি ২০০২)। "কৃষ্ণদাস পাল"। সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান। ১ (৪র্থ সংস্করণ)। কলকাতা: শিশু সাহিত্য সংসদ। পৃষ্ঠা ১০৪। আইএসবিএন 81-85626-65-0।
- ↑ সিরাজুল ইসলাম (২০১২)। "মিত্র, কিশোরীচাঁদ"। ইসলাম, সিরাজুল; মিয়া, সাজাহান; খানম, মাহফুজা; আহমেদ, সাব্বীর। বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় বিশ্বকোষ (২য় সংস্করণ)। ঢাকা, বাংলাদেশ: বাংলাপিডিয়া ট্রাস্ট, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি। আইএসবিএন 9843205901। ওএল 30677644M। ওসিএলসি 883871743।
- ↑ চট্টোপাধ্যায়, মঞ্জু (১৯৮৫)। Petition to Agitation, Bengal, 1857–1885 (ইংরেজি ভাষায়)। কে.পি. বাগচি।
- ↑ ভাটিয়া, নন্দী (২০০৪)। Acts of Authority/Acts of Resistance: Theater and Politics in Colonial and Postcolonial India (ইংরেজি ভাষায়)। মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় প্রেস। পৃষ্ঠা ৪১। আইএসবিএন 0-472-11263-5। সংগ্রহের তারিখ ৫ এপ্রিল ২০১১।