হৃদয়বিহীন হরিণ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

হৃদয়বিহীন হরিণ একটি প্রাচীন উপকথা, যেটি এসেছে ইউরোপে ঈশপের গল্প থেকে। এটি পেরি সূচকে ৩৩৬ নম্বরে রয়েছে।[১] এটি একটি হরিণের (অথবা প্রাচ্যের সংস্করণে একটি গাধা) গল্প, যাকে একটি বুদ্ধিমান শিয়াল দুবার প্ররোচিত করেছিল অসুস্থ সিংহের সাথে দেখা করতে যাবার জন্য। সিংহটি হরিণকে মেরে ফেলার পর, শিয়াল চুরি করে হরিণের হৃদয় খেয়ে ফেলে। সিংহ হরিণের হৃদয় দেখতে না পেয়ে সেটি কোথায় জিজ্ঞাসা করলে, শেয়াল যুক্তি দিয়েছিল যে, একটি প্রাণী এতটা বোকা, যে সিংহের গুহায় তার সাথে দেখা করতে যায়, তার হৃদয় থাকতে পারেনা। এই যুক্তিটি প্রাচীন বিশ্বাসকে প্রতিফলিত করে যে হৃদয় ছিল চিন্তা ও বুদ্ধির আসন। গল্পটি আরনে-থম্পসন শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতিতে শ্রেণী ৫২ হিসাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।[২]

প্রাচ্যের গল্প[সম্পাদনা]

পঞ্চতন্ত্রের ১৫ শতকের ফার্সি অনুবাদ অনুযায়ী শিয়াল সিংহকে তথ্য দেয়

ভারতীয় পঞ্চতন্ত্রে পাওয়া গল্পের সংস্করণটি একটি সিংহের সাথে সম্পর্কিত। তার অসুস্থতার নিরাময় হল একটি গাধার কান এবং হৃদয়। তার ভৃত্য শিয়াল একটি গাধাকে তার সাথে যেতে রাজি করায় কিন্তু সিংহটি খুবই দুর্বল থাকায় প্রথম প্রচেষ্টায় গাধাটিকে মেরে ফেলতে পারেনি। শেয়ালকে আবার কৌশল করে গাধাকে ফিরিয়ে আনতে হয়। পরে শিয়াল ক্ষুধার্ত সিংহকে প্ররোচিত করে তাকে (শিয়াল) মৃত গাধার সাথে ছেড়ে দিতে। সে নিজের জন্য কান ও হৃদয় নিয়ে নেয়। কান ও হৃদয় না থাকা নিয়ে শিয়ালের ব্যাখ্যা হল যে এত নির্বোধ একটি প্রাণীর শোনার বা চিন্তা করার জন্য কিছু থাকতে পারে না।[৩]

গল্পটি একাধিক অনুবাদ এবং অভিযোজনের মাধ্যমে পাশ্চাত্যে ভ্রমণ করে এবং অবশেষে আরবদের মধ্য দিয়ে করে স্পেনের দিকে যায়। এই সময়ের মধ্যে গল্পের বিবরণ যথেষ্ট পরিবর্তিত হয়েছিল। একটি আরব সংস্করণে একটি গাধা সিংহের কাছে উপশুল্ক দাবি করে এবং এই ঔদ্ধত্যের জন্য গাধাকে হত্যা করা হয়। হৃৎপিণ্ডটি একটি শিয়াল খেয়ে ফেলে বলে যে, এটি এত বোকা প্রাণীর মধ্যে কখনও থাকতে পারে না।[৪] গল্পের ইহুদি সংস্করণও রয়েছে, যার একটিতে গাধাটিকে টোল-রক্ষক হিসাবে দেখানো হয়েছে এবং অন্যটিতে জাহাজে চড়ার ভাড়া দাবি করা হয়েছে।[৫]

পাশ্চাত্যের গল্প[সম্পাদনা]

"সিংহ, শিয়াল এবং হরিণ" গল্পটি একটি প্রাচীন গল্প যা প্রথম আর্কিলোকাসের কবিতায় পাওয়া গিয়েছিল এবং বাব্রিউসের সংগ্রহে ব্যাপকভাবে বলা হয়েছিল। এতে শিয়াল দুবার হরিণকে প্ররোচিত করে একটি সিংহের ডেরায় যাবার জন্য। খুবই অসুস্থ থাকায় সিংহ শিকারে অক্ষম ছিল। প্রথমবার হরিণ একটি আহত কান নিয়ে পালিয়ে যায়; শিয়াল এটিকে একটি কড়া স্নেহ হিসাবে ব্যাখ্যা করে এবং হরিণটিকে আবার সিংহের গুহায় পাঠায়।[৬] এটি শুধুমাত্র গ্রীক ভাষায় নথিবদ্ধ করা হয়েছিল, যাতে মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় রূপগুলি পশ্চিমী উৎসের পরিবর্তে প্রাচ্যের হতে পারে। এইভাবে মারি ডি ফ্রান্সের বক্তব্যে, পঞ্চতন্ত্রে যেমন আছে, সিংহের অসুস্থতার নিরাময় হিসাবে হরিণের হৃদয় প্রয়োজন।[৭]

মারির সমসাময়িক, বেরেচিয়াহ হা-নাকদানের "ফক্স ফেবেলস"-এ এর একেবারে ভিন্ন একটি সংস্করণ পেরি সূচকে ৫৮৩ নম্বরে আছে। মনে করা হয় সেই গল্পটি অ্যাভিয়ানাসের একটি ল্যাটিন কবিতা থেকে কিছুটা নেওয়া। এতে একটি শুয়োর জমিদারির মাঠে ঘোরাঘুরি করেছে বলে শাস্তি হিসেবে তার কান কেটে দেওয়া হয়। পরে জীবন দিয়ে তাকে এর মূল্য দিতে হয়। একজন তস্কর কৃষক স্বাভাবিক উপায়ে তার মনিবের কাছে হারিয়ে যাওয়া হৃদয় ব্যাখ্যা করে।[৮] কিন্তু বেরেচিয়ার গল্পে রাজকীয় সিংহের বাগানে এক বন্য শুয়োর সীমালঙ্ঘন করে। শাস্তি হিসেবে তার কান এবং চোখ নিয়ে নেওয়া হয়। অবশেষে সে নিহত হয় এবং শিয়াল তার হৃদয় চুরি করে।[৯] এই চূড়ান্ত বিবরণগুলি উপকথার অন্যান্য সংস্করণগুলির সাথে একটি সংশ্লেষণ প্রদর্শন করে, যার মধ্যে এই সময়ের অনেকগুলি থাকতে পারে।[১০] জুয়ান রুইজের একটি পরবর্তী স্প্যানীয় সংস্করণে, একটি সঙ্গীতজ্ঞ গাধা আছে, যে সিংহকে তার অসংগত সঙ্গীতের মাধ্যমে জাগিয়ে রাখে এবং এই ক্ষেত্রে সে নেকড়ের কাছে তার হৃদয় এবং কান হারায়।[১১]

আধুনিক যুগে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলতে থাকে। স্টুয়ার্ট ক্রফটের ১২ মিনিটের চলচ্চিত্র দ্য স্ট্যাগ উইদাউট এ হার্ট (২০০৯ / ১০)-এ একটি অবিরাম বৃত্তাকার সংস্করণে গল্প পুনরাবৃত্ত হয়, যাতে শিয়াল হরিণের মধ্যে চুরি করা হৃদয়টিকে প্রতিস্থাপন করে এবং এটি একটি উপায় হয়ে দাঁড়ায় সিংহের উপস্থিতিতে ফিরে যেতে তাকে প্ররোচিত করার জন্য।[১২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Aesopica
  2. Hasan M. El-Shamy, Types of the Folktale in the Arab World: A Demographically Oriented Tale-type Index, Indiana University 2004, pp.19-20
  3. Panchatantra, trans. Arthur W. Ryder, "Flop-Ear and Dusty"
  4. Histoire économique et sociale de l'Empire ottoman et de la Turquie (1326-1960), Leuven 1995, p.256
  5. Israel Abrahams, The Book of Delight and Other Papers, “The Fox’s Heart”
  6. F.R.Adrados History of the Graeco-Latin Fable vol.3, Leiden NL 2003, vol.3, p.438
  7. The fables of Marie de France, Birmingham AL 1988, pp.181-3
  8. F.R.Adrados History of the Graeco-Latin Fable vol.3, Leiden NL 2003, p.559
  9. Fables of a Jewish Aesop, Jaffrey NH 03452 2001 story 105
  10. S.Thompson, Motif-index of folk-literature, K402.3
  11. Louise Mirrer, Women, Jews, and Muslims in the texts of reconquest Castile, University of Michigan 1996, p.134
  12. "Version online"। ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১০ মার্চ ২০২৪ 

টেমপ্লেট:Aesopটেমপ্লেট:Panchatantra