বিষয়বস্তুতে চলুন

সাধনানন্দ মহাস্থবির

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

সাধনানন্দ মহাস্থবির (৮ জানুয়ারি ১৯২০ - ৩০ জানুয়ারি ২০১২) ছিলেন একজন বৌদ্ধ ধর্মীয় আধ্যাত্মিক গুরু। তিনি বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের কাছে বনভান্তে নামে অধিক পরিচিত। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বৌদ্ধ ভিক্ষু।[]

১৯২০ : জন্ম ১৯২০ সালের ৮ জানুয়ারি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি শৈলশহর রাঙামাটির ৬ মাইল দক্ষিণে ১১৫ নং মগবান মৌজার মোরঘোনা নামক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত চাকমা বৌদ্ধ পরিবারে। তাঁর পিতার নাম হারুমোহন চাকমা, মাতার নাম বীরপুদি চাকমা। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় ‘রথীন্দ্র লাল চাকমা’। পিতামাতার ৬ সন্তানের মধ্যে তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন। তাঁর (রথীন্দ্র) শিক্ষাজীবন সম্পর্কে যতদূর জানা যায়-তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ আমলে মিডল ইংলিশ স্কুলে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে জীবনের তাগিদে ব্যবসায় আত্মনিয়োজিত হন।

প্রব্রজ্যা গ্রহণ

[সম্পাদনা]

১৯৪৯: ১৯৪৯ সালে পটিয়ার নাইখাইন গ্রামের অধিবাসী বাবু গজেন্দ্র লাল বড়ুয়ার সহযোগিতায় ২৯ বছর বয়সে ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে তিনি চট্টগ্রামস্থ নন্দনকানন বৌদ্ধ বিহারের তৎকালীন অধ্যক্ষ ভদন্ত দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান মহাস্থবির (বিএ) এর নিকট প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। তখন গৃহী নামের সাথে মিল রেখে তাঁর নাম ‘রথীন্দ্র শ্রামণ’ রাখা হয়।

ভিক্ষু-উপসম্পদা লাভ

[সম্পাদনা]

১৯৬১: বার্মাফেরত চাকমা রাজগুরু ভদন্ত অগ্রবংশ স্থবির ও ভদন্ত জ্ঞানশ্রী ভিক্ষু মহোদয়ের অনুপ্রেরণায় ও সার্বিক সহযোগিতায় ২৭ জুন ১৯৬১ সালে ২৫০৫ বুদ্ধবর্ষের জ্যৈষ্ঠ পূর্ণিমা তিথিতে বোয়ালখালী মাইনী (নদীর) উদক সীমায় তৎকালীন ২য় সংঘরাজ ভদন্ত গুণালংকার মহাথের মহোদয়ের উপাধ্যায়ত্বে উপসম্পদা লাভ করেন। তিনি ধ্যান-সাধনায় সর্বদা নিরত থাকতে আনন্দ পেতেন বিধায় ভিক্ষু-উপসম্পদা লাভ করার পর তাঁর উপাধ্যায় তাঁর নাম রাখলেন ‘সাধনানন্দ’ ভিক্ষু । তবে তিনি (প্রায় ২৮ বছর) বনে-জঙ্গলে ধ্যান-সাধনা করেছিলেন বিধায় ভক্তবৃন্দের কাছে ‘বনভান্তে’ নামেই সমধিক পরিচিত হয়েছিলেন।

কঠিন চীবরদানোৎসব প্রচলন

[সম্পাদনা]

১৯৭৩: ১৯৭৩ সালের ৫ ও ৬ নভেম্বর তারিখে লংগদুর তিনটিলায় বনভান্তে এদেশে প্রথম চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তুলা থেকে সুতা কেটে রং করে কাপড় বুনে সেলাই করে ‘দানোত্তম কঠিন চীবরদান’ করার রীতি প্রবর্তন করেন। কঠিন চীবরদানোৎসব বনভান্তের এক অনন্য অবদান।

১৯৭৪: চাকমা রাজ পরিবার ও রাঙামাটির গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের সাদর আমন্ত্রণে ১৯৭৪ সালের ২৭ ও ২৮ নভেম্বর রাজ বিহারে অনুষ্ঠিত দানোত্তম কঠিন চীবরদানে বনভান্তে যোগদান করেন। এ সালে চাকমা রাজ পরিবার ও রাঙামাটির বিশিষ্ট উপাসক-উপাসিকাদের প্রার্থনায় তিনি তিনটিলা থেকে রাঙামাটিতে স্থায়ীভাবে অবস্থান করার সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করলে রাজবাড়ির অনতিদূরে রাজ পরিবারের দানকৃত ভূমিতে ‘রাঙামাটি রাজবন বিহার’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ১৯৭৫ সালে রাজবন বিহারে সর্বপ্রথম বর্ষাব্রত পালন করেন ভদন্ত নন্দপাল ভিক্ষু ও ভদন্ত উত্তমানন্দ ভিক্ষু।

রাজবন বিহারে গমন

[সম্পাদনা]

১৯৭৬ সালে প্রথমবার বনভান্তে রাজবন বিহার রাঙ্গামাটিতে দক্ষিণ হস্ততুল্য ভদন্ত নন্দপাল ভিক্ষুকে সাথে নিয়ে বর্ষাব্রত যাপনের পর আবার লংগদু ফিরে যান তবে বর্ষাব্রত সমাগত হলে রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে চলে আসেন। আবার ১৯৭৭ সালে নন্দপাল ভিক্ষু বন্দুকভাঙ্গার খারিখ্যং শাক্য বনবিহারে একাকী বর্ষাব্রত পালন করেন। তারপর ১৯৭৮ থেকে ১৯৮২ সাল পর্য্যন্ত একনাগাড়ে ৫ বছর বনভান্তে ও নন্দপাল ভান্তে গুরুশিষ্য একসাথে রাজবন বিহারে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান ও পালন করেন।

রাজবন বিহারে স্থায়ীভাবে অবস্থান

[সম্পাদনা]

১৯৭৭: প্রায় ছয় বছর লংগদুর তিনটিলায় অবস্থান করার পর ১৯৭৭ সালে সশিষ্যে রাঙামাটির রাজবন বিহারে এসে স্থায়ীভাবে অবস্থান করেন।

১৯৭৮: রাজমাতা বিনীতা রায় (বুড়ারাণী), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা থাকাকালীন সরকারি অনুদানে ও সর্বসাধারণের শ্রদ্ধাদানে পুরাতন টিনশেড দেশনালয় নির্মিত হয়। বর্তমান পাকা দেশনালয়টি নির্মিত হওয়ার আগ পর্যন্ত বনভান্তে পুরাতন টিনশেড দেশনালয়ে বসে দীর্ঘদিন ভক্তদের উদ্দেশ্যে সদ্ধর্ম দেশনা করতেন।

১৯৭৯: ডা. হিমাংশু বিমল দেওয়ান পাঁচ কক্ষবিশিষ্ট একটি মাটির ঘর (উত্তর গুদাম) ও তৎসংলগ্ন চংক্রমণ ঘর দান করেন। ভান্তে এই উত্তর গুদামে বেশ কিছুকাল অবস্থান করেছিলেন।

মহাস্থবির পদ অর্জন

[সম্পাদনা]

১৯৮১: এ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারী শুভ মাঘী পূর্ণিমা তিথিতে রাজবন বিহারে ভিক্ষুসীমা ঘর (ঘ্যাং ঘর) স্থাপন করা হয়। উক্ত তারিখে নবপ্রতিষ্ঠিত সেই ঘ্যাং ঘরে বনভান্তেকে ‘মহাস্থবির বরণ’ করা হয়। বনভান্তের ‘মহাস্থবিরবরণ’ অনুষ্ঠানে শ্রীলঙ্কা সরকার কর্তৃক (উপহার হিসেবে) প্রদত্ত বোধিবৃক্ষ চারা উক্ত ঘ্যাং ঘরের পাশে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন ধর্মমন্ত্রী নিজ হাতে রোপণ করেন। এ অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন শ্রীলঙ্কার হাই কমিশনার চরিতা রানা সিংহা (সস্ত্রীক), বার্মার (বর্তমানে মায়ানমার) রাষ্ট্রদূত (সস্ত্রীক), এবং ভারতের হাই কমিশনার মুচকুন্দ দুবে। ম্যাজিস্ট্রেট প্রকৃতি রঞ্জন চাকমা কর্তৃক ভারতের বুদ্ধগয়া হতে সংগৃহীত ‘বোধিবৃক্ষ চারা’ শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে ভান্তে নিজ হাতে রোপন করেন।

অবদান

[সম্পাদনা]

১৯৮৭: বনভান্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অবদান সুত্তপিটকের অন্তর্গত খুদ্দক নিকায়ের সুত্ত নিপাত গ্রন্থটির অনুবাদ। এটি ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটি বিজ্ঞমহলে যথেষ্ট সমাদর লাভ করে। পরবর্তীকালে উক্ত গ্রন্থটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যলিয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এম,এ শ্রেণীর পাঠ্য-তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ত্রিপিটক শাস্ত্র অধ্যায়নকারী অভিজ্ঞ হিসেবে বইটি প্রুফ সংশোধন করেন ভদন্ত নন্দপাল ভিক্ষু। তিনি পালি এবং বার্মিস অক্ষরে লিখিত সুত্রের সাথে অনুবাদের সামঞ্জস্য নিরীক্ষা করেন।

১৯৯৩: ৫ মার্চ রাজবন বিহারে বনভান্তের নির্দেশনায় বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম দেশীয় প্রযুক্তিতে অষ্টধাতুর দুটি বুদ্ধমূর্তি রাজবন বিহারে তৈরী করা হয়। বুদ্ধমূর্তি দুটির নাম যথাক্রমে গৌতমমুনি বুদ্ধমূর্তি ও শাক্যমুনি বুদ্ধমূর্তি। বুদ্ধমূর্তি দুটির উচ্চতা ও ওজন যথাক্রমে ৫ ফিট, ১০ মণ ১১ কেজি এবং ৫ ফিট, ১০ মণ ১০ কেজি। সেই সাথে দেড় ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট একটি উপগুপ্ত মহাথের মূর্তি নির্মাণ করা হয়, যার ওজন ৩৫ কেজি।

২০০৪ সালের ২৯ জুলাই বনভান্তের উৎসাহে ও পরামর্শে তাঁর শিষ্যসংঘ কর্তৃক রাজবন বিহারে একটি ‘আধুনিক অফসেট প্রেস’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অদ্যাবধি প্রায় শতাধিক মূল পিটকীয় গ্রন্থসহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যা এদেশে বুদ্ধধর্ম প্রচার-প্রসার ও স্থিতিকল্পে এক যুগান্তকারী অবদান রাখে।

পরিনির্বাণ

[সম্পাদনা]

২৬ জানুয়ারিতে বনভান্তের শারীরিক অবস্থা ভীষণভাবে অবনতি হওয়ায় এক জরুরি আলোচনা আহ্বান করা হয়। উক্ত সভায় ভান্তের শিষ্যসংঘ, মেডিকেল বোর্ডের ডাক্তাররা ও চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায়সহ উপস্থিত গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ কর্তৃক সর্বসম্মতিক্রমে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে রাজধানী ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২৭ জানুয়ারি ভান্তেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দেওয়া হয়। তিনি বিগত বেশ কিছুদিন ধরে ডায়াবেটিস, নিউমোনিয়া, কিডনী ও লিভারের জটিল সমস্যায় ভুগছিলেন। ৩০ জানুয়ারি বিকাল ৪ ঘটিকায় বনভান্তে পরিনির্বাণ লাভ করেন/দেহত্যাগ করেন।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. "মহাস্থবির, সাধনানন্দ"বাংলাপিডিয়া। সংগ্রহের তারিখ ২০ ডিসেম্বর ২০১৯

[][][][][]

[][]

বহিঃসংযোগ

[সম্পাদনা]
  1. প্রতিবেদক, নিজস্ব (৮ জানুয়ারি ২০১৯)। "বনভান্তের শততম জন্মদিনে"দৈনিক প্রথম আলো। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মে ২০২৩
  2. "রাঙ্গামাটিতে বনভান্তের জন্মোৎসবে মুখর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা"www.jugantor.com (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মে ২০২৩
  3. "বনভান্তের জন্মদিন আজ, রাঙামাটিতে নানা আয়োজন"SAMAKAL (ইংরেজি ভাষায়)। ২৬ মে ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মে ২০২৩
  4. 0111 (৮ জানুয়ারি ২০২৩)। "রাঙ্গামাটিতে বনভান্তের ১০৪তম জন্মদিন উদযাপন"চট্টগ্রাম নিউজ (মার্কিন ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মে ২০২৩ {{ওয়েব উদ্ধৃতি}}: |শেষাংশ=-এ সাংখ্যিক নাম রয়েছে (সাহায্য)
  5. "বনভান্তের জন্মদিন উপলক্ষ্যে রাঙামাটিতে সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান | PaharBarta.com"। ২০২২-০১-০২T১৮:৩১:০২+০৬:০০। সংগ্রহের তারিখ 2023-05-26 {{ওয়েব উদ্ধৃতি}}: |তারিখ= এর মান পরীক্ষা করুন (সাহায্য)
  6. admin। "শ্রাবকবুদ্ধ বনভান্তের সংক্ষিপ্ত জীবনী" (মার্কিন ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মে ২০২৩
  7. ডটকম, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর। "বৌদ্ধ ধর্মগুরু বনভান্তে আর নেই"বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ২৬ মে ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভকৃত। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মে ২০২৩