রূপবিকার (প্রকৌশল)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সংকোচক পীড়নজনিত বিকৃতির কারণে বস্তুর দৈর্ঘ্য হ্রাস পায় কিন্তু একই সাথে এটি বাইরের দিকে প্রসারিত হয়। চিত্রে সংকোচক ভারপ্রয়োগের কারণে (তীরচিহ্ন দিয়ে নির্দেশিত) বেলন বা সিলিন্ডার আকৃতির বস্তুটির রূপবিকার ঘটেছে, ফলে এর আদি আকৃতি (বিচ্ছিন্ন রেখা দ্বারা নির্দেশিত) পরিবর্তিত হয়ে অর্থাৎ রূপবিকার সাধিত হয়ে সেটি খাটো হয়ে পাশের দিকে ফুলে উঠেছে। এই পার্শ্বিক স্ফীতির কারণ হল এই যে, উপাদান পদার্থটি ফেটে বা ভেঙে যাওয়া ঠেকাতে যথেষ্ট সামর্থ্য রাখলেও পরিবর্তিত না হয়ে ভার বহন করতে সমর্থ নয়, ফলে সেটি পাশের দিকে বেরিয়ে এসেছে। রূপবিকারের সাথে সমকোণে অবস্থিত অভ্যন্তরীণ বলগুলি প্রযুক্ত ভারকে আংশিক প্রতিরোধ করছে।

প্রকৌশলশাস্ত্রে রূপবিকার বা বিরূপণ (ইংরেজি Deformation) পরিভাষাটি দিয়ে বহিঃস্থ কোনও যান্ত্রিক বল বা ভার প্রযুক্ত হবার কারণে কোনও বস্তুর আকার-আকৃতিতে পরিবর্তনের ঘটনাটিকে নির্দেশ করা হয়। আকারের পরিবর্তনকে বিস্তারণ (Dilation) বলে, যা প্রসারণ (Expansion) অপেক্ষা ভিন্ন; আকৃতির পরিবর্তনকে আকৃতি-বিকার (Distortion) বলে। আন্তর্জাতিক পরিমাপ পদ্ধতিতে রূপবিকারের একক মিটার

বর্ণনা[সম্পাদনা]

বলবিজ্ঞান শাস্ত্রে প্রযুক্ত একটি বল-সমষ্টির ক্রিয়ার অধীনে কোনও কণা বা বস্তুর গতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। কণা হল একটি বিন্দুতে সীমাবদ্ধ ভরবিশিষ্ট পদার্থ। বস্তু হল একটি নির্দিষ্ট আকার দ্বারা পরিবদ্ধ অনেকগুলি কণার সমষ্টি, যেগুলি ঐ বস্তুর ভেতরে জ্যামিতিকভাবে বিতরণকৃত থাকে। যদি কোনও বস্তু গতিশীল হলে সেটির ভেতরের কণাগুলির পারস্পরিক আপেক্ষিক দূরত্ব সামগ্রিকভাবে সর্বদা একই থাকে, তাহলে সেটিকে একটি দৃঢ় বস্তু (Rigid body) বলে। আর যদি বস্তুর ভেতরের কণাগুলির পারস্পরিক দূরত্ব পরিবর্তিত হয়, তাহলে বস্তুর রূপের পরিবর্তন ঘটে, এবং বলা হয় যে বস্তুটির রূপবিকার তথা বিরূপণ (deformation) ঘটেছে এবং বস্তুটি বিরূপণীয় (deformable)। তবে সমস্ত বস্তুই শেষ বিচারে বিরূপণীয়, দৃঢ় বস্তু একটি আদর্শ ধারণামাত্র।[১]

কোনও বস্তুর উপরে বাইরে থেকে যখন কোনও বল প্রযুক্ত হয়, তখন সেই বস্তুর অভ্যন্তরস্থ বিন্দুগুলির অবস্থানের পরিবর্তন ঘটে, যাকে ঐসব বিন্দুর সরণ (Displacement) বলে। বাইরে থেকে প্রযুক্ত বলের কারণে যদি সমগ্র বস্তুটি স্থান পরিবর্তন করে বা সেটির ঘূর্ণন হয়, তাহলে সেটির অভ্যন্তরের বিন্দুগুলির যে সরণ হয়, সেই সরণের সাথে বস্তুর রূপবিকারের কোনও সম্পর্ক নেই। বলা হয় ঐসব বিন্দুর স্থানবিচ্যুতি (Deflection) ঘটেছে। কিন্তু বাইরে থেকে প্রযুক্ত বলের (যেমন পেষা, চাপা, মোচড়ানো, টানা, ছেঁড়া, কৃন্তন) কারণে যদি বস্তুটি স্থান পরিবর্তন না করেই হ্রস্ব-দীর্ঘ হয়ে যায়, বেঁকে যায়, স্ফীত বা সরু হয়ে যায়, কিংবা মোচড় খায়, তাহলে একে অপরের সাপেক্ষে এর অভ্যন্তরের বিন্দুগুলির আপেক্ষিক সরণ হয়। এই শেষোক্ত আপেক্ষিক সরণকেই রূপবিকার বলা হয়। স্থানবিচ্যুতি ও রূপবিকার একে অপরের থেকে স্বাধীন দুইটি ঘটনা।

রূপবিকারের পরিমাণ বস্তুর উপাদান, বস্তুর উপরে প্রযুক্ত পীড়ন এবং বস্তুর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা ইত্যাদি মাত্রার উপর নির্ভর করে। একই দৈর্ঘ্যের ও একই উপাদানের দুইটি বস্তুর মধ্যে একটির উপর দ্বিগুণ পীড়ন প্রযুক্ত হলে সেটির রূপবিকারের পরিমাণ প্রথমটির তুলনায় দ্বিগুণ হবে। কিন্তু দ্বিতীয় বস্তুটি একই উপাদানের অথচ অর্ধেক দৈর্ঘ্যের হলে প্রথম বস্তুটির তুলনায় দ্বিগুণ পীড়ন প্রযুক্ত হলেও এর রূপবিকারের পরিমাণ প্রথম বস্তুটির সমান হবে।

বস্তুটির উপরে প্রতি একক ক্ষেত্রফলে যে বল প্রযুক্ত হয়, তাকে পীড়ন (Stress) বলে। প্রতি একক আদি দৈর্ঘ্যের সাপেক্ষে যে পরিমাণ রূপবিকার ঘটে, তাকে বিকৃতি (Strain) বলে। বিকৃতির কোনও একক নেই, কেননা এটি আদি দৈর্ঘ্য (মিটার একক) ও রূপবিকারের (মিটার) অনুপাত। সময়ের সাপেক্ষে কত দ্রুত বিকৃতি ঘটে, সে ব্যাপারটিকে বিকৃতির হার (Rate of strain) বলে। অপেক্ষাকৃত অনুপুঙ্খ একটি সংজ্ঞানুযায়ী পীড়নের কারণে কোনও বস্তুর উপাদানের একটি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ক্ষুদ্র ঘনকের আকৃতির আপেক্ষিক অভ্যন্তরীণ পরিবর্তনকে বিকৃতি (Strain) বলে। এটিকে ঘনকটির দৈর্ঘ্য বা কোণের মাত্রাবিহীন পরিবর্তন হিসেবে প্রকাশ করা যায়। পীড়নের সাথে বিকৃতির সম্পর্কটিকে একটি পীড়ন-বিকৃতি বক্ররেখা (Stress-strain curve) দ্বারা উপস্থাপন করা হয়। একটি উপাদান পদার্থের জন্য পীড়ন ও বিকৃতির সম্পর্ক সাধারণত একটি নতি বিন্দু (Yield point) পর্যন্ত রৈখিক ও প্রত্যাবর্তী হয়, অর্থাৎ এ সময় উপাদানটি স্থিতিস্থাপকতা (Elasticity) প্রদর্শন করে এবং বলা হয় উপাদানটির স্থিতিস্থাপক রূপবিকার (Elastic deformation) ঘটেছে। যখন রূপবিকার হয়, তখন উপাদান পদার্থের ভেতরের পরমাণুগুলি তাদের ভারসাম্যাবস্থার আন্তঃপারমাণবিক দূরত্ব থেকে সরে যায়, এবং এর ফলে পদার্থের অভ্যন্তরে আন্তঃপারমাণবিক আকর্ষণ বল (টানজাত বলের ক্ষেত্রে) বা আন্তঃপারমাণবিক বিকর্ষণ বল (সংকোচক বলের ক্ষেত্রে) সৃষ্টি হয়, যা বাইরের প্রযুক্ত বলের বিরুদ্ধে কাজ করে। যদি বাইরে থেকে প্রযুক্ত বলটি বেশি বড় না হয়, তাহলে আন্তঃপারমাণবিক বলগুলি বহিঃস্থ বলকে সম্পূর্ণ নাকচ করার জন্য যথেষ্ট হয় এবং পদার্থটির স্থিতিস্থাপক রূপবিকার ঘটে। বহিঃস্থ বল বা প্রযুক্ত ভার সম্পূর্ণ অপসারণের সাথে সাথে উপাদানটি তার আদি অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে।

কিন্তু প্রযুক্ত পীড়ন নতি বিন্দুকে অতিক্রম করলে বল বা ভার সরিয়ে নেবার পরেও বস্তুতে বা উপাদানে কিছু স্থায়ী ও অপ্রত্যাবর্তী রূপবিকার অবশিষ্ট থেকে যায়, অর্থাৎ উপাদানটি অস্থিতিস্থাপকতা (Plasticity) প্রদর্শন করে ও বলা হয় যে উপাদানটিতে অস্থিতিস্থাপক রূপবিকার (Plastic deformation) ঘটেছে। এভাবে ভার বা প্রযুক্ত বল বাড়াতে থাকলে এক পর্যায়ে বস্তুটিতে ফাটল (Crack) ও শেষ পর্যন্ত ভাঙন (Fracture) সৃষ্টি হয় ও বস্তুটি একাধিক টুকরায় ভেঙে পড়ে।[২]

কোনও কঠিন পদার্থের অভ্যন্তরের পীড়ন ও উপাদানের দৃঢ়তা (Strength of material) অধ্যয়নকারী বিজ্ঞান ক্ষেত্রে এবং কোনও কাঠামোর পীড়ন ও বিকৃতি কাঠামোগত বিশ্লেষণ (Structural analysis) ক্ষেত্রটিতে নির্ণয় করা হয়। যদি বস্তুর রূপবিকার নগণ্য হয়, তখন সেটিকে নমনীয় বস্তু হিসেবে গণ্য না করে দৃঢ় বস্তু (Rigid body) হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রকৌশল শাস্ত্রে কোনও বস্তু বা কাঠামোর ভাঙন, এমনকি সেটির স্থিতিস্থাপক বা অস্থিতিস্থাপক রূপবিকারও অনভিপ্রেত এবং এক ধরনের বৈকল্য বা ব্যর্থতা হিসেবে গণ্য করা হয়। রূপবিকারের কারণে কোনও কাঠামো তার উদ্দিষ্ট কর্মসাধনে ব্যর্থ হতে পারে তথা অকেজো হয়ে যেতে পারে এবং অদূর বা দূর ভবিষ্যতে এটি সম্পূর্ণ ভেঙে বা ধসে পড়ার ঝুঁকি থাকে।[৩] যদি বস্তুর আকারে কোনও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন না ঘটে, তাহলে আসন্ন মান হিসেবে বস্তুর উপরে প্রযুক্ত প্রকৌশলীয় পীড়ন (Engineering stress) ও এর ফলে বস্তুতে উৎপন্ন প্রকৌশলীয় বিকৃতি (Engineering strain) গণনায় ব্যবহৃত হয়। যখন বস্তুর আকারে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে, তখন বস্তুর তাৎক্ষণিক আকার থেকে প্রকৃত পীড়ন (True stress) ও প্রকৃত বিকৃতি (True strain) বের করে গণনায় ব্যবহার করা হয়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Abdel-Rahman A. Ragab; Salah Eldin Ahm Bayoumi (১৯৯৮), Engineering Solid Mechanics: Fundamentals and Applications, CRC Press, পৃষ্ঠা 1 
  2. Richard W. Hertzberg; Richard P. Vinci; Jason L. Hertzberg (২০২০), Deformation and Fracture Mechanics of Engineering Materials, John Wiley & Sons, পৃষ্ঠা 3 
  3. Richard W. Hertzberg; Richard P. Vinci; Jason L. Hertzberg (২০২০), Deformation and Fracture Mechanics of Engineering Materials, John Wiley & Sons, পৃষ্ঠা 4