রুবাইয়াত-ই-আরেফীন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
রুবাইয়াত-ই-আরেফীন
পুস্তক প্রচ্ছদ
পুস্তক প্রচ্ছদ
লেখকশামসুল আরেফীন
মূল শিরোনামরুবাইয়াত-ই-আরেফীন
দেশবাংলাদেশ
ভাষাবাংলা
প্রকাশকবলাকা
প্রকাশনার তারিখ
ফেব্রুয়ারি ২০১৪
পৃষ্ঠাসংখ্যা৬৪
আইএসবিএন৯৭৮৯৮৪৯০৬৭৯৭৯

রুবাইয়াত-ই-আরেফীন বাংলা ভাষায় রচিত একটি কাব্যগ্রন্থ। ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে চট্টগ্রামের বলাকা প্রকাশন থেকে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির রচয়িতা শামসুল আরেফীন।গ্রন্থটিতে ২৫৯টি রুবাই উপস্থাপন করা হয়েছে।[১][২]

ছন্দ[সম্পাদনা]

ফার্সি সাহিত্যে, সারা সেন আক্রমণের পূর্বে,‘রিবাই’ নামে একধরনের ছন্দে কবিতা রচনা করা হতো।প্রাচীন আরবি সাহিত্যের ‘দুবাই’ ছন্দ এই ‘রিবাই’ ছন্দকে পরিবর্তন করে। রোবাঈ বা রুবাই হলো এই পরিবর্তিত রূপ। ফার্সি কাব্য সাহিত্যে রুবাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, সনেট যেমন গুরুত্বপূর্ণ ইতালি কাব্য সাহিত্যে। রুবাইকে ইংরেজি 'Epigram' জাতীয় কবিতা বলা হয়। একে চতুষ্পদী কবিতাও বলা হয়, যেহেতু তাতে চার চরণের মধ্যে হৃদয়গ্রাহী করে একটিমাত্র ভাবকে প্রকাশ করা হয়। চার চরণের মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও চতুর্থ চরণে অন্ত্যমিল থাকে। তৃতীয় চরণ অন্যান্য চরণের ব্যতিক্রম হয়।`রুবাইয়াত-ই-আরেফীন’ গ্রন্থে এভাবে অন্ত্যমিল ব্যবহার করে রচিত রুবাই উপস্থাপন করা হয়েছে।[৩][৪]

বিষয়বস্তু[সম্পাদনা]

বাংলা ভাষায় রুবাই রচয়িতা কম নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে এখানে যেসব রুবাই রচয়িতার আবির্ভাব ঘটেছে, তাদের মেজাজ-মর্জিতে আজও রাজকীয় অথবা মোঘলীয় ঘরানার চিন্তা-চেতনা দৃশ্যমান। এই চিন্তা-চেতনা আজকের জীবন-যাপন ও মননের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। স্থান ও সময় সম্পর্কে সচেতনতাহীন শিল্পীদের শিল্পসাধনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবেই।এ ক্ষেত্রে ‘রুবাইয়াত-ই-আরেফীন’ গ্রন্থে কবিকে স্থান ও সময় চিহ্নিত করে অগ্রসর হতে দেখা। রুবাইগুলোতে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক শব্দের প্রয়োগ, এ অঞ্চলের পরিচিত স্থান, লোককাহিনী ও মিথিকাল চরিত্রের ব্যবহারের মধ্য দিয়ে রুবাই-এর বিষয়বস্তুর পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। পদ্মাবতী, মানিকরাজ, বাদনখালি, মলকাবানু, মনুমিয়া,বাঁশবনিয়া, আংগারাণ, লখাই, বেহুলা, হোয়া, বেয়ান প্রভৃতি আঞ্চলিক শব্দ, মিথিকাল চরিত্র ও স্থান-নামের ব্যবহারের মাধ্যমে রুবাইগুলোতে বিবিধ ভাবনা পরিচালিত হয়েছে।[৫] এটা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে ভাষাকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক যুদ্ধ। রুবাইগুলোতে দক্ষিণ চট্টগ্রামের ক্ষমতাহীন ভাষার অংশ বিশেষকে কিয়ৎ পরিমাণে হলেও ক্ষমতাপূর্ণ বাংলা ভাষার কাব্যিক অঙ্গে পরিণত করা হয়েছে।[৬][৭]

গ্রামে হাজির হওয়া ধনতন্ত্রের শকটের (মুক্তবাজার অর্থনীতির আওতায় যা পশ্চিমা পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের বাহন) মুখে স্থানিক সংস্কৃতির ক্রম অবলোপনে ‘রুবাইয়াত-ই-আরেফীন’ গ্রন্থের কবি বেদনার্ত হয়ে লোকশ্রুতি-বিশ্বাস-পুরাণের বিস্তর অনুষঙ্গ ব্যবহার করে তিন পর্বে সজ্জিত রুবাইয়াতে হাহাকার উপস্থাপনকরেছেন। এসব অনুষঙ্গের রূপকেও তিনি স্থানীয় ও জাতীয় নানান হৃতাবস্থার অনুবাদ সম্পন্ন করেছেন এবংব্যঙ্গ-পরিহাসযোগে অসঙ্গতি নির্দেশ করেছেন।[৮] [৯] গ্রন্থটির তিনটি রুবাই [১০] [১১]

(১)

শঙ্খ থেকে এক বেয়ালে নিয়েছিলাম এক ঘটি জল;

সুদ-আসলে সেই যে দেনা হয়েছিল ওই হিমাচল।

শঙ্খ হঠাৎ চাইলে তাহা, আমি দিতে ব্যর্থ হলে,

দখল করে নিয়েছিল আমার পুরো কদম্বতল।

(২)

হাজার চাঁপা চুমু খেল চান্নিভরা এই অধরে

তবু আমি হইনি মাতাল, বলছি দারুণ সত্যি করে।

পদ্মাবতী চুমুর আশে যেই চেয়েছে অধরপানে,

উথাল-পাথাল ঘটে গেছে বক্ষ-ডলুর বালুচরে।

(৩)

সেই যে ধৃতরাষ্ট্র-রাজা হাজার হাজার বছর পরে

ফিরে এলো অশ্বে বসে সুনামপুরের কালনীচরে।

লাভ হলো না কালনীচরের; শকুনি ও রাজপুতেরা

রাজ-অমতে কালনীচরের ভাঙলো মাজা ভয়াল ঝড়ে।

গ্রন্থটির ‘রক্ত ঝরার কাল এসেছে’ শীর্ষক প্রথম পর্বে যেসব বিষয় ফুটে উঠেছে, সেসবের মধ্যে রয়েছে ধর্মাশ্রয়ী সংস্কৃতির ইন্দ্রিয়বিলাসে বদল, শহরে গ্রামের প্রবেশ, শ্রেণীশোষণ, উচ্চবিত্তের স্ফীতি, সর্বহারার পেশা পরিবর্তন ও হরণ, অসাম্প্রদায়িকতার মৃত্যু, গণতান্ত্রিক আন্দোলন, বিদেশী সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, দেশীয় সংঘাতময় ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতি, কবির অকিঞ্চিৎকরতা প্রভৃতি। ‘সোনাই বিবির সোনার দেশে’ শীর্ষক দ্বিতীয় পর্বে ইন্দ্রিয়বিলাসের ধর্ম-অতিক্রমী সামাজিকতা, পরকীয়ার দুঃখ, প্রেমে প্রত্যাখ্যান লাভ, মুক্ত প্রেমানুভূতি, কামচেতনা, বিরহ, ভিলেনের আবির্ভাব প্রভৃতি বিষয় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। ‘মন তো আমার কৃষিভূমি’ শীর্ষক শেষ পর্বে শাসন-শোষণের ধারাবাহিকতা ও পুঁজির প্রভাবে গ্রামীণজনের একাংশের উচ্চভাবসহ কিছু পরিবর্তমান বাস্তবতার দেখা পাওয়া যায়। লোকসাহিত্য বা লোকসংস্কৃতির পরিচিত মননশূন্যতা বিষয়ে ‘রুবাইয়াত-ই-আরেফীন’ কাব্যের কবি সচেতন ও সজাগ।এভাবে সজাগ থেকেই তিনি কাব্যটিতে লোকজ অনুষঙ্গ ব্যবহারে প্রাণিত থেকেছেন। [১২] [১৩] খৈয়াম এবং হাফিজের ঘরানাকে অস্বীকার করে বাংলার লোকঐতিহ্য ও মিথ প্রভৃতি ব্যবহার করে এই কাব্য রচনা করা হয়েছে। কাব্যটির প্রতিটি রুবাইয়ে ছন্দ, অন্ত্যমিলও একেবারে নির্ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। রুবাইগুলোতে জীবন ও জগতের অজস্র দিক উন্মোচিত হয়েছে এবং কাব্যটি বাংলা সাহিত্য-পরিমণ্ডলে নবদিগন্তের সূচনা করেছে। [১৪]

কাব্যটিতে মানবতাবাদের পদস্খলনের কথা বিশেষভাবে পরিস্ফুট হয়েছে ‘রক্তঝরার কাল এসেছে’ পর্বে। যেমন রামু ট্র্যাজেডির কথা বলা হয়েছে। এক মধু পূর্ণিমার পূর্বের রাতে বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও প্যাগোডার ওপর মুখচেনা সন্ত্রাসীরা ভয়াবহ হামলা করেছিল প্রায় এক যুগ আগে। তারিখটা ছিল ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। তখন কক্সবাজারের উখিয়া, চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার লাখেরা ও কোলাগাঁও এলাকাতেও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের প্যাগোডায় আঘাত করা হয়। রামুতে ৪০টির অধিক বাড়ি, অনেকগুলো বৌদ্ধবিহার ও স্থাপনা ধংস করা হয়। এছাড়া লুট করা হয় স্বর্ণ-রৌপ্যের বৌদ্ধমূর্তি, অর্থ ও নানা মূল্যবান সামগ্রি। অসংখ্য বৌদ্ধ নর-নারী-শিশু আহাজারি-আর্তনাদ করেছিল সেদিন। এই সহিংসতায় রামুর ক্ষতি সাধারণ ক্ষতি ছিল না। শত শত বছরের মধ্যে এমন সহিংসতার নজির বাংলাদেশে আর নেই বললেই চলে। কাব্যটিতে রামু ট্রাজেডি ও মানবতাই কেবল নয়, সমকালীন দেশীয় ও বৈশ্বিক রাজনৈতিক বাস্তবতার অনেক কিছুও স্থান পেয়েছে।[১৫] [১৬]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "লোকগবেষণায় শামসুল আরেফীনের অবদান অমর-অক্ষয় হয়ে থাকবে"। আলমগীর হোসেন। banglanews24। সংগ্রহের তারিখ ২০১৭-১১-০৯ 
  2. "তারুণ্য : শামসুল আরেফীন বিস্মৃত লোককবির গবেষক"। এ. কে. আজাদ। দৈনিক সমকাল। ১৩ মে ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৬ মে ২০১৮ 
  3. "শামসুল আরেফীনের রুবাই: উত্তর-ঔপনিবেশিক চেতনায় বহমান"। জুয়েল মাজহার। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। Archived from the original on ২০১৯-০৯-২৩। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-০৭-১০ 
  4. "রুবাইয়াৎ-ই সৈয়দ আজিজ"। শামসুল হুদা, এফসিএ। dailynayadiganta। সংগ্রহের তারিখ ৩১ জানুয়ারি ২০২০ 
  5. "শামসুল আরেফীনের রুবাই: উত্তর-ঔপনিবেশিক চেতনায় বহমান"banglanews24.com। সম্পাদক : জুয়েল মাজহার। Archived from the original on ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 
  6. "শামসুল আরেফীনের রুবাইয়াত-ই-আরেফীন"। জুয়েল মাজহার। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। নভেম্বর ৯, ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 
  7. "শামসুল আরেফীনের নতুন রুবাই"। রুশো মাহমুদ। সুপ্রভাত বাংলাদেশ। ডিসেম্বর ৪, ২০১৫। Archived from the original on ৩ মে ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 
  8. "শামসুল আরেফীনের রুবাইয়াত-ই-আরেফীন"। জুয়েল মাজহার। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। নভেম্বর ৯, ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 
  9. "শামসুল আরেফীনের রুবাইয়াত-ই-আরেফীন"। জুয়েল মাজহার। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। নভেম্বর ৯, ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 
  10. "শামসুল আরেফীনের রুবাইয়াত-ই-আরেফীন"। জুয়েল মাজহার। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। নভেম্বর ৯, ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 
  11. "শামসুল আরেফীনের নতুন রুবাই"। রুশো মাহমুদ। সুপ্রভাত বাংলাদেশ। ডিসেম্বর ৪, ২০১৫। Archived from the original on ৩ মে ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 
  12. "শামসুল আরেফীনের রুবাইয়াত-ই-আরেফীন"। জুয়েল মাজহার। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। নভেম্বর ৯, ২০২০। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 
  13. "শামসুল আরেফীনের নতুন রুবাই"। রুশো মাহমুদ। সুপ্রভাত বাংলাদেশ। ডিসেম্বর ৪, ২০১৫। Archived from the original on ৩ মে ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 
  14. "বিলুপ্ত-বিস্মৃত লোককবির খোঁজে শামসুল আরেফীন"। ইমদাদুল হক মিলন। কালের কণ্ঠ। ২৫ এপ্রিল ২০১৮। Archived from the original on ২৬ এপ্রিল ২০১৮। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 
  15. "রুবাইয়াত-ই-আরেফীন: রামু ট্রাজেডি ও মানবতা"। জুয়েল মাজহার। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম। জুলাই ১৪, ২০১৯। Archived from the original on ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ 
  16. "রুবাইয়াত-ই-আরেফীন : রামু ট্র্যাজেডি ও মানবতা"। সাবের হোসেন চৌধুরী। ভোরের কাগজ। ১৪ জুন ২০১৯। Archived from the original on ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৯। সংগ্রহের তারিখ ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪