রামধন তর্কবাগীশ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

রামধন তর্কবাগীশ ছিলেন ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধের একজন বাঙালি পুরাণ কথক এবং সংস্কৃত পদাবলীকার। বাংলায় কথকতার যে লৌকিক পদ্ধতি, তার প্রধান উদ্ভাবক ছিলেন তিনি৷ রামধনের কনিষ্ঠ পুত্র শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সহযোগিতায় প্রথম বিধবা বিবাহ করেছিলেন।[১]

পরিচয়[সম্পাদনা]

রামধন ছিলেন অধুনা পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার গোবরডাঙা-খাঁটুরা-ইছাপুর ( প্রাচীন কুশদ্বীপ বা কুশদহ পরগনা) অঞ্চলের সংস্কৃত পণ্ডিতসমাজের একজন প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত। হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীর কথকতাকে তিনি জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেন। তার দুই পুত্র: গণেশচন্দ্র ও শ্রীশচন্দ্র। কনিষ্ঠ শ্রীশচন্দ্র কলকাতার সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করে 'বিদ্যারত্ন' উপাধি পান এবং প্রথম বিধবা বিবাহ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় প্রবর্তিত বিধবা বিবাহ আইন সামাজিক ক্ষেত্রে প্রচলন করেন। শ্রীশচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত খাঁটুরার বামোড়-তীরের ঘাট ও পোড়ামাটির ভাস্কর্যের দুটি শিবমন্দির এখনো বিদ্যমান। ঊনবিংশ শতকের বিখ্যাত নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র রামধন তর্কবাগীশকে স্মরণ করে লিখেছিলেন:[১]

এই স্থানে রাম ধন কথক রতন
কলকণ্ঠ কলে কল করিত কলন।
সুললিত পদাবলী বিরচিত তাঁর,
সকল কথক সুরে করিছে বিহার।।

প্রতিভা[সম্পাদনা]

খাঁটুরা অঞ্চলে রামধনের কথকতার পাণ্ডিত্য মাধুর্য সুললিত ভঙ্গি সম্বন্ধে অনেক কাহিনী প্রচলিত আছে। শোনা যায়, একবার ভট্টপল্লীতে ( এখনকার ভাটপাড়া) রামধন সাধারণ মানুষদের দিকে লক্ষ্য রেখে সহজভাষায় পুরাণ ব্যাখ্যা করছিলেন; পাঠশেষে সেখানকার পণ্ডিতরা তার পাণ্ডিত্য নিয়ে বিদ্রূপ করে। ক্ষুব্ধ রামধন পণ্ডিতদের মনোভাব বুঝতে পেরে পরদিন থেকে পুরো একপক্ষকাল কথকতার আসরে অনর্গল সংস্কৃতে কথা বলেন; পণ্ডিতেরা বিস্মিত হয়ে তাদের মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। কথকতাবৃত্তি থেকে রামধন প্রচুর অর্থ উপার্জন করেন। তিনি সহজভাষায় কিছু উৎকৃষ্ট মানের পদাবলীও রচনা করেছেন:[১]

কেশব কৃপানিধান। করুনাবলোকয় কুরু
করুনাং ময়ি দীনহীন জনে। তব পদ ভজন
যজন যাজন পূজন বন্দন মননবিহীনে।।

পীত বসন বনচারী। সুললিত নটবর রাস-
বিহারী। রমণীমথকৃত মুরলী কূজিত গোপিত
গোপীসত প্রেম বিতারি।।

উত্তরাধিকার[সম্পাদনা]

রামধনের ভ্রাতুষ্পুত্র ধরনীধর কথক, পরিবারের এই কথকতার উত্তরাধিকার আজীবন যোগ্যতার সাথে বহন করেছিলেন; পুরাণপাঠে ও পদাবলী সঙ্গীতে তিনি রামধনের রচিত পদাবলীই ব্যবহার করতেন। শোনা যায়, বর্ধমান রাজবাড়িতে তিনি বছরে পাঁচ হাজার টাকা পেতেন। কথকতা ব্যবসায়ে তিনি এত অর্থ উপার্জন করেছিলেন যে, প্রচুর ব্যয় ও দান করেও মৃত্যুকালে তিনি লক্ষাধিক টাকা রেখে গিয়েছিলেন।[১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ২১০-২১২