বিষয়বস্তুতে চলুন

মুসলিম ইবনে আল-হাজ্জাজ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(মুসলিম বিন হাজ্জাজ থেকে পুনর্নির্দেশিত)
মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ
مسلم بن الحجاج
উপাধিইমাম মুসলিম
জন্ম৮১৫ পরে
নিশাপুর, খোরাসান
(বর্তমান ইরান)
মৃত্যুমে ৮৭৫
সমাধি স্থাননাসারাবাদ
(নিশাপুরের একটি শহর)
যুগইসলামের স্বর্ণযুগ
আব্বাসিয় খিলাফতকাল
পেশামুসলমান আলিম, হাদিস সংকলনকারী
সম্প্রদায়সুন্নী মুসলমান
মূল আগ্রহহাদিসশাস্ত্র
লক্ষণীয় কাজসহীহ মুসলিম
যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন

আবুল হুসাইন মুসলিম ইবনুল হাজ্জাজ আল–কুশায়রী আন-নিশাপুরী ( আরবি: أبو الحسين مسلم بن الحجاج القشيري النيسابوري ; জন্ম: ২০২/৮১৭ অথবা ২০৬/৮২১ বা ২০৪/৮১৯ হি.) ছিলেন একজন বিখ্যাত আলেম, হাদিসবিশারদ ও শাস্ত্রজ্ঞ। তিনি আল-ইমাম, আল-হাফেজ, হুজ্জাতুল ইসলাম ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত ছিলেন। তিনি খুরাসানের অন্তর্গত নায়সাবুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নির্ভেজাল আরব বংশজাত । তার পরিবারের আদি বাসস্থান নায়সাবুর। শৈশবকাল হতেই তিনি হাদীস শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো সহীহ মুসলিম শরীফ রচনা করা, যা সিহাহ সিত্তার অন্তর্ভুক্ত এবং হাদিসে সনদের মান বিবেচনায় সহীহ বুখারীর পরেই তার স্থান।

সফরসমূহ

[সম্পাদনা]

হাদীস শিক্ষার উদ্দেশে তৎকালীন মুসলিম জাহানের সবগুলি কেন্দ্রেই গমন করেন । বিশেষতঃ ইরাক, হিজায, মিশর প্রভৃতি অঞ্চল ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করে তথায় অবস্থানকারী হাদীসের শ্রেষ্ঠ উস্তাদ ও মুহাদ্দিসের নিকট হতে হাদীস শিক্ষা ও সংগ্রহ করেন । তিনি এ সকল স্থানের ইমাম বুখারীর (মৃত্যুঃ ২৫৬ হিঃ) অনেক উস্তাদ এবং অন্যদের নিকট থেকেও হাদিস শ্রবণ ও গ্রহণ করেন । ইমাম মুসলিম সর্বপ্রথম ২১৮/৮১৩ সনে হাদিসের দারসে বসতে শুরু করেন । ইয়াহইয়া আত-তামীমী আন-নায়সাবুরী, আল-কা’নাবী, আহমাদ ইবনে ইউনুস, ইসমা’ঈল ইবনে আবী উইয়াস, সা’ঈদ ইবনে মানসূর, আউন ইবনে সাল্লাম, আহমাদ ইবনে হাম্বল – এ সকল প্রখ্যাত হাদিসবিদ ছাড়া আরও অনেকের নিকট তিনি হাদিসের পাঠ গ্রহণ করতেন । তাছাড়া ইমাম শাফি’ঈ-এর শাগরিদ হারমালা এবং প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ইসহাক ইবনে রাহুইয়াহ-র নিকট থেকেও তিনি হাদিস শোনেন । তিনি একাধিকবার বাগদাদ সফর করেন । তাঁর সর্বশেষ বাগদাদ সফর ছিল হিজরী ২৫৯ সনে । বাগদাদের হাদিসবিদরা তাঁর নিকট থেকে শ্রুত হাদিস বর্ণনা করেছেন।

উস্তাদ ইমাম বুখারী

[সম্পাদনা]

ইমাম বুখারী নায়সাবুরে আসলে ইমাম মুসলিম তাঁকে উস্তাদ হিসেবে বরণ করে নেন । তাঁর হাদিস বিষয়ক বিশাল জ্ঞানভান্ডার হতে মুসলিম যথেষ্ট মাত্রায় গ্রহণ করেন । এই শহরে এক সময় ইমাম বুখারীর বিরুদ্ধে প্রবল প্রচারণা শুরু হয় । ইমাম মুসলিম তখন বুখারির পক্ষ অবলম্বন করেন । এ প্রসঙ্গে একটি বিশেষ ঘটনার কথা বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে । ‘‘একদিন মুসলিম তাঁর হাদিসের উস্তাদ মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহইয়ার দারসে অন্যান্য শিক্ষার্থীদের সাথে উপস্থিত আছেন । সহসা উস্তাদ ঘোষণা করেন, ‘বিশেষ একটি মাসয়ালায় যে ব্যক্তি বুখারির মতের সাথে একমত তাঁর উচিত আমার মজলিস ত্যাগ করা’ । ইমাম মুসলিম সাথে সাথে মজলিস ত্যাগ করে ঘরে চলে আসেন এবং এই উস্তাদের নিকট হতে শ্রুত ও গৃহীত হাদিসসমূহের পাণ্ডুলিপি ফেরত পাঠিয়ে দেন । তিনি এই উস্তাদের সূত্রে হাদিস বর্ণনা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করেন’’।

শাগরিদগণ

[সম্পাদনা]

মুসলিম ছিলেন ‘উলূমে হাদিসের এক বিশাল সাগর’ । বিশ্বের সকল হাদিস বিশারদ তাকে এ বিষয়ের একজন শ্রেষ্ঠ ইমাম বলে ঐকমত্য পোষণ করেছেন । তার যুগের বড় বড় মুহাদ্দিসগণ তার নিকট হাদিস শিক্ষা করেছেন । তার প্রখ্যাত শাগরিদদের মধ্যে

  1. ইবরাহীম ইবনে আবী তালিব,
  2. ইবনে খুজায়মা,
  3. সাররাজ,
  4. আবু আওয়ানা,
  5. আবু হামেদ ইবনে শারকী,
  6. আবু হামেদ আহমাদ ইবনে হামাদান,
  7. ইবরাহীম ইবনে মুহাম্মাদ,
  8. মাককী ইবনে আবাদান,
  9. আব্দুর রাহমান ইবনে আবি হাতেম,
  10. মুহাম্মাদ ইবনে মাখলাদ,
  11. মুহাম্মাদ ইবনে ঈসা আত-তিরমিজি,
  12. মুসা ইবনে হারুন,
  13. আহমেদ ইবনে সালমা,
  14. ইয়াহইয়া ইবনে সায়েদ

প্রমুখের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য । তারা সকলে হাদিস শাস্ত্রে মুসলিমের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে তার সূত্রে হাদিস বর্ণনা করেছেন । অবশ্য ইমাম তিরমিযী মুসলিমের সূত্রের মাত্র একটি হাদিস বর্ণনা করেছেন।

ইমাম মুসলিম রচিত গ্রন্থসমূহ

[সম্পাদনা]
ইমাম মুসলিম লিখিত কিতাব সহিহ মুসলিম শরীফের কভার পেইজ।

ইমাম মুসলিমের মহামূল্য রচনাবলীও তার পাণ্ডিত্যের কথা অকাঠ্যভাবে প্রমাণ করে। তার রচিত গ্রন্থাবলীর অধিকাংশই হাদিস ও তৎসম্পর্কিত বিষয়ে প্রণীত।

ইমাম মুসলিম রচিত গ্রন্থসমূহ:

তার বিখ্যাত হাদিস সংকলণ সহীহ মুসলিম ছাড়াও নিম্নলিখিত গ্রন্থাবলীর কথা ইতিহাসে পাওয়া যায়ঃ-

১. আল-মুসনাদ আল-কাবীর

২. কিতাব আল-জামি ‘আলা আল-আবওয়াব

৩. কিতাব আল-আসমা’ ওয়া আল-কুনা’

৪. কিতাব আল-তাময়ীয

৫. কিতাব আল-ইফরাদ

৬. কিতাব আল-আকরান

৭. কিতাবু সুওয়ালাতিহি আহমাদ ইবনে হাম্বল

৮. কিতাব আল ‘ইলাল ওয়া কিতাব আল-ওয়াহদান

৯. কিতাবু হাদিসে ‘আমার ইবনে শূ’আইব

১০. কিতাব আল-ইনতিফা বি-উহুব আল-সিবা’

১১. কিতাবু মাশায়িখ শু’বা

১২. কিতাবু মাশায়িখ মালিক ওয়া কিতাবু মাশায়িখ আল-সাওরী

১৩. কিতাবু মান লায়সা লাহু ইল্লা রব্বিন ওয়াহিদ

১৪. কিতাব আল-মুখাদরামিন

১৫. কিতাব আওলাদ আল-সাহাবা

১৬. কিতাবু আওহাম আল-মুহাদ্দিসীন

১৭. কিতাব আল-তাবাকাত

১৮. কিতাবু আফরাদ আল-শামিয়্যীন ।

তিনি সাহাবীদের জীবনী বিষয়ক “আল-মুসনাদ আল-কাবীর” রচনায় হাত দিলেও তা সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি। একমাত্র ‘সহীহ মুসলিম ছাড়া তার রচনার আর কোনটিই বর্তমান পাওয়া যায় না ।

মৃত্যু

[সম্পাদনা]

ইমাম মুসলিম ২৬১/৮৭৫ সনের ২৫শে রজব রোববার নায়সাবূরে মৃত্যুবরণ করেন । নায়সাবূরের শহরতলী নাসরাবাদে ২৬শে রজব সোমবার তাকে দাফন করা হয় । তার জন্মের সন সম্পর্কে মতভেদ থাকায় মৃত্যুকালে তার সঠিক বয়স সম্পর্কেও মতপার্থক্য দেখা যায় । ইবনে হাজার আসকালানি মুসলিমের মৃত্যুর কারণ সম্বন্ধে একটি বিবরণ প্রদান করেছেন । মুসলিমের জন্য হাদিস বিষয়ক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করা হয় । সেই মজলিসে একটি হাদিস আলোচিত হয় । হাদিসটি মুসলিমের জানা ছিল না । মজলিস শেষে বাড়ি ফিরে রাতে এক ঝুরি খুরমা সামনে নিয়ে হাদিসটি তালাশ করতে বসেন । একটি একটি করে খুরমা মুখে দিচ্ছেন আর হাদিসটি অনুসন্ধান করছেন । এভাবে সকাল হয়ে যায়, খুরমাও শেষ হয় এবং হাদিসটিও তিনি পেয়ে যান । এই অতিরিক্ত খুরমা ভক্ষণই তার মৃত্যুর বাহ্যিক কারণ ।

ইমাম মুসলিম সম্বন্ধে অন্যান্য মুসলিম মনিষীর বক্তব্য

[সম্পাদনা]

১। হাকেম বলেন, ‘মুসলিম ছিলেন দীর্ঘাকৃতির। মাথার চুল ও দাড়ি ছিল সাদা। পাগড়ির একটি দিক দু’কাধের মাঝখানে ছেড়ে দিতেন। তিনি ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী’। ইমাম মুসলিমের প্রতিভা ও যোগ্যতার অকপট স্বীকৃতি দিয়েছেন তার যুগের ও পরের বহু মনীষী।

২। মুসলিমের উস্তাদ মুহাম্মাদ ইবনে আবদিল ওয়াহহাব আল-ফাররা বলেনঃ ‘মুসলিম মানব জাতির মধ্যে অন্যতম আলিম ও ইলমের সংরক্ষণকারী। আমি তাঁর সম্পর্কে শুধু ভাল ছাড়া আর কিছু জানি না।’

৩। আবু বাকর আল-জারূদি ও ঠিক একই মন্তব্য করেছেন।

৪। মাসলামা ইবনে কাসিম বলেন, ‘অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য উঁচু মর্যাদার একজন ইমাম তিনি’।

৫। ইবনে আবী হাতেম বলেন, ‘আমি তাঁর সূত্রে হাদিস লিখেছি। তিনি অন্যতম বিশ্বস্ত হাফেজে হাদিস। হাদিস বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞান। আমার পিতাকে তাঁর সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেনঃ ‘অত্যন্ত সত্যবাদী’। তিনি আরও বলেছেনঃ ‘হাফেজে হাদিস বলতে চারজনকেই বুঝায়। তারা হলেনঃ আবু যূর’আ, মুহাম্মাদ ইবনে ইসমা’ঈল, আদ-দারিমী ও মুসলিম’।

৬। ইবনুল আখরাম বলেন, ‘আমাদের এই শহর তিনজন হাদিস বিশারদ সৃষ্টি করেছেঃ তাঁরা হলেনঃ মুহাম্মাদ ইবনে ইয়াহইয়া, ইব্রাহীম ইবনে আবী তালিব ও মুসলিম’।

৭। ইসহাক ইবনে মানসূর একবার মুসলিমকে লক্ষ্য করে বলেন, ‘যতদিন আল্লাহ্‌ তা’আলা আপনাকে মুসলমানদের জন্য জীবিত রাখবেন আমরা কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হবো না’।

৮। আহমাদ ইবনে সালমা বলেন, ‘আমি আবু যুর’আ আবু হাতেমকে হাদিসের বিশুদ্ধতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে তাদের যুগের অন্যান্য মাশায়েখদের ওপর মুসলিমকে প্রাধান্য দিতে দেখেছি’।

৮। হাফেজ আবু কুরাইশ বলেছেন, ‘পৃথিবীতে হাফেজে হাদিস মাত্র চারজন। মুসলিম তাদের একজন’।

৯। ইবনে খাল্লিকান মুসলিমকে ‘সাহিহ গ্রন্থের অধিকারী, হাদিসের অন্যতম ইমাম ও হাফেজ এবং মুহাদ্দিসকুলের এক প্রধান স্তম্ভ বলে উল্লেখ করেছেন’।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Ibn Rāhwayh, Isḥāq (১৯৯০), Balūshī, ʻAbd al-Ghafūr ʻAbd al-Ḥaqq Ḥusayn, সম্পাদক, Musnad Isḥāq ibn Rāhwayh (1st সংস্করণ), Tawzīʻ Maktabat al-Īmān, পৃষ্ঠা 150–165 
  2. منهج الإمام مسلم بن الحجاج