ভূত্বক বিবর্তন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
সমুদ্রের ভূত্বক পৃষ্ঠের মানচিত্র, যেখানে দেখা যাচ্ছে নবীন (লাল) ভূত্বকের উৎপাদন এবং সঙ্গে প্রাচীন (নীল) ভূত্বকের ধ্বংস। এটি ভূত্বকীয় পাত সংস্থান তত্ত্ব দ্বারা নির্ধারিত পৃথিবীর পৃষ্ঠের ত্বকীয় স্থানিক বিবর্তনকে স্পষ্ট করে।

ভূত্বক বিবর্তন হল পৃথিবী পৃষ্ঠের বহিস্থ পাথুরে ত্বকের গঠন, ধ্বংস এবং পুনর্নবীকরণ।

পৃথিবীর ভূত্বকে উপাদানের বৈচিত্র অন্যান্য শিলাময় গ্রহের চেয়ে অনেক বেশি। মঙ্গল, শুক্র, বুধ এবং অন্যান্য মহাজাগতিক বস্তুর ভূত্বক তুলনামূলকভাবে অভিন্ন। একমাত্র পৃথিবীতে সামুদ্রিক এবং মহাদেশীয় উভয় ধরনের ভূত্বক রয়েছে।[১] এই অনন্য বৈশিষ্ট,- গ্রহের ইতিহাস জুড়ে ঘটে যাওয়া ভূ-ত্বকীয় প্রক্রিয়াগুলির জটিল পরিবর্তনগুলিকে প্রতিফলিত করে, এর মধ্যে ভূত্বকীয় পাত সংস্থান তত্ত্বের চলমান প্রক্রিয়াটিও আছে।

পৃথিবীর ভূত্বকীয় বিবর্তন সম্পর্কিত প্রস্তাবিত পদ্ধতিগুলি সবই তত্ত্ব-ভিত্তিক পদ্ধতি। কিছু খণ্ডিত ভূতাত্ত্বিক প্রমাণ এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রাথমিক অবস্থা সম্পর্কিত সমস্যাগুলির অনুমানমূলক সমাধান পাবার চেষ্টা করা হয়েছে। অতএব, এই তত্ত্বগুলির সংমিশ্রণ করে বর্তমান অবস্থা বোঝার চেষ্টা হয়েছে এবং একই সঙ্গে ভবিষ্যত অধ্যয়নের একটা ভিত্তি তৈরি করা হয়েছে।

প্রাথমিক ভূত্বক[সম্পাদনা]

প্রথম দিকে ভূত্বক গঠনের প্রক্রিয়া[সম্পাদনা]

সৃষ্টির প্রাথমিক অবস্থায় পৃথিবী পুরোপুরি গলিত ছিল। এটি হয়েছিল তৈরি হওয়া উচ্চ তাপমাত্রার ফলে এবং নিম্নোক্ত প্রক্রিয়াগুলির ফলে এই অবস্থা অনেকদিন চলেছিল:

  • প্রথম বায়ুমণ্ডলের সংকোচন
  • দ্রুত অক্ষীয় ঘূর্ণন
  • পার্শ্ববর্তী শিশুগ্রহগুলির সাথে নিয়মিত সংঘর্ষ[২]
ম্যান্টলে ক্রমশ ঘনীভবনের একটি পর্যায় চিত্র, যার পরে প্রারম্ভিক ভূত্বক গঠিত হয়েছিল। অ্যাডিয়াবেটিক প্রক্রিয়ার অর্থ পরিচলন পদ্ধতিতে কোন তাপ নষ্ট না হয়ে চাপের সাথে তাপমাত্রার পরিবর্তন। প্রাথমিক ম্যান্টলের অ্যাডিয়াবেটিক প্রক্রিয়া থেকে বোঝা যাচ্ছে, তলদেশ থেকে ঘনীভবন শুরু হয়েছিল; প্রায় ২৫  গিগা পাস্কালের উপরে চাপে পেরভস্কাইট জমতে শুরু করেছিল (ম্যান্টলের গভীর তলদেশ), ২৫ গিগা পাস্কালের নিচের চাপে অলিভাইন জমা শুরু হয়েছিল (ম্যান্টলের ওপরের অংশে)।

পুরো আর্কিয়ান সময় জুড়ে ম্যান্টল অংশ আধুনিক দিনের তাপমাত্রার চেয়ে বেশি গরম ছিল। [৩] সময়ের সাথে সাথে পৃথিবী শীতল হতে শুরু করায় বিবৃদ্ধি ধীর হয়ে যায় এবং ম্যাগমা সমুদ্রের মধ্যে সঞ্চিত তাপ বিকিরণের মাধ্যমে মহাশূন্যে হারিয়ে যায়।

ম্যাগমা দৃঢ়ীকরণের সূচনা বোঝাতে একটি তত্ত্বে বলা হয়েছে যে, যথেষ্ট শীতল হয়ে যাবার পর, ম্যাগমা সমুদ্রের শীতল ভূমি অংশ প্রথমে কঠিন হতে শুরু করে ছিল। এর কারণ হল তলদেশে ২৫ গিগা পাস্কাল চাপ সলিডাস বা তাপমাত্রার অবস্থান বিন্দু কে নামিয়ে দিয়েছিল।[৪] একদম উপর পৃষ্ঠে একটি পাতলা 'শীতল ভূত্বক' গঠিত হয়ে নিচের অগভীর তলার অংশের জন্য তাপ নিরোধক হিসেবে কাজ করেছিল। এর ফলে গভীর ম্যাগমা মহাসাগর থেকে কঠিনীভবন প্রক্রিয়াটি বজায় রাখার জন্য যথেষ্ট উত্তাপ এর মধ্যে ছিল।[৪]

ম্যাগমা সমুদ্রের কঠিনীভবনের সময় উৎপাদিত কঠিনবস্তুগুলি বিভিন্ন গভীরতায় বিভিন্ন রকম ছিল। পেরিডোটাইট ম্যাগমার গলন নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা গেছে যে (>≈৭০০ মি) গভীরতায়, প্রধান খনিজ পাওয়া যায় ম্যাগনেসিয়াম - পেরভস্কাইট, যেখানে অলিভাইন পাওয়া যাবে অগভীর অংশে এবং এর সঙ্গে থাকে এর উচ্চ চাপেরবহুরূপতা, উদাহরণস্বরূপ গারনেট এবং মেজরাইট[৫]

প্রথম মহাদেশীয় ভূত্বক গঠনে অবদানকারী তত্ত্বের মধ্যে আছে আগ্নেয়গিরির মাধ্যমে প্লুটনের বাইরে বেরিয়ে আসা। এই বিস্ফোরণে একটি গরম, ঘন অশ্মমণ্ডল তৈরি হয়েছিল যেটি ম্যান্টলের সাথে চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছিল।[৬] এই আগ্নেয়গিরি থেকে মুক্তি পাওয়া তাপ, এবং এর সাথে ম্যান্টল পরিচলনের ফলে প্রারম্ভিক ভূত্বকের ভূতাপীয় নতিমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল।[৭]

ভূত্বকীয় দ্বৈতত্ত্ব[সম্পাদনা]

সমুদ্র এবং মহাদেশীয় ভূত্বকের রচনা এবং প্রকৃতিতে বিশেষ বৈপরীত্য, এই দুটি মিলে সামগ্রিক ভূত্বক গঠন করে। এটি পৃথিবীর ভূত্বকের দ্বৈতত্ত্ব।

কালনির্ণয়[সম্পাদনা]

মহাসাগরীয় এবং মহাদেশীয় ভূত্বকগুলি বর্তমানে ভূত্বকীয় পাত সংস্থান তত্ত্ব প্রক্রিয়াগুলির মাধ্যমে উৎপাদিত এবং রক্ষিত হয়ে চলেছে। তবে প্রাথমিক অশ্মমণ্ডলের উৎপাদনে ভূত্বকীয় দ্বৈতত্ত্ব হবার ক্ষেত্রে একই প্রক্রিয়া হবার সম্ভাবনা কম। এই ধারণার ভিত্তি হল, পাতলা, কম ঘনত্বের মহাদেশীয় অশ্মমণ্ডল যেটি প্রথমে এই গ্রহকে ঢেকে রেখেছিল, তাদের পার্শ্বীয় বা উল্লম্ব চলন (সাবডাকশান) ছিলনা। তখন একটি পাত অন্যটির ওপর উঠে যেতনা।।[৮]

ফলতঃ, ভূত্বকীয় দ্বৈতত্ত্বের প্রস্তাবিত আপেক্ষিক সময়কে সামনে রেখে বলা হয়েছে যে বিশ্বব্যাপী ভূত্বকীয় পাত সংস্থান তত্ত্ব শুরুর আগে দ্বৈতত্ত্ব শুরু হয়েছিল। তাই বলা যায়, ভূত্বকের ঘনত্বের মধ্যে পার্থক্য থাকার জন্য ভূত্বকীয় পাতের সাবডাকশন হয়। [৮]

গঠন[সম্পাদনা]

পৃথিবীর পৃষ্ঠের উপর একটি আগ্নেয়গিরির মুখের তৈরি হওয়া। দেখা যাচ্ছে ম্যান্টলের আংশিক গলিত ব্যাসাল্ট দিয়ে ভরাট হচ্ছে। এটি জমে গিয়ে প্রাথমিক সামুদ্রিক ভূত্বক তৈরি হয়েছিল।

অভিঘাত খাদের সৃষ্টি[সম্পাদনা]

সারা সৌরজগত জুড়ে মহাকর্ষীয় বস্তুগুলিতে বৃহৎ এবং অসংখ্য অভিঘাত খাদ দেখতে পাওয়া যায়। মনে করা হয় যে সময় শিলাময় গ্রহগুলির সাথে গ্রহাণুগুলির প্রচুর মাত্রায় এবং তীব্রতার সাথে অভিঘাত হত, তখন এই খাদগুলির সৃষ্টি হয়েছে। এই ঘটনার নাম দেওয়া হয়েছে আদ্য প্রচণ্ড সংঘর্ষ, এটি প্রায় ৪০০ কোটি বছর আগে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।[৯] মনে করা হয় সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহের মত পৃথিবীও একই রকম তীব্রতার অভিঘাত সহ্য করেছিল। কিন্তু কেবলমাত্র পৃথিবীর উচ্চ মাত্রায় ক্ষয় এবং প্রতিনিয়ত ভূত্বকীয় পাত সংস্থান তত্ত্বের কারণে আজকের দিনে এই খাদগুলি আর দৃশ্যমান নেই। পৃথিবীর আকারের সাথে মানিয়ে নেওয়ার জন্য চাঁদে দেখতে পাওয়া অভিঘাত খাদের সংখ্যা এবং আকার আনুপাতিক হারে বাড়িয়ে, বলা হয়েছে যে পৃথিবীর কমপক্ষে ৫০% অভিঘাত খাদ অভিঘাত অববাহিকায় আচ্ছাদিত ছিল।[৮] এই অনুমানটি, পৃথিবীর উপরিভাগে কম করে কত খাদ সৃষ্টি হয়েছিল, তা বলে।

প্রভাব[সম্পাদনা]

প্রারম্ভিক অশ্মমণ্ডলে খাদ সৃষ্টি হওয়ার মূল প্রভাবগুলি ছিল:

  • বড় খাদ গঠন। সমস্থিতি প্রতিক্ষেপণ খাদগুলির গভীরতা বিন্যস্ত করেছিল, যার ফলে ব্যাসের তুলনায় সেগুলি তুলনামূলকভাবে অগভীর ছিল;[১০] কিছু খাদ ৪ কিমি গভীর এবং ১০০০ ব্যাস যুক্ত ছিল।[৮]
  • নিচু অভিঘাত অববাহিকা এবং এখন উত্তোলিত পৃষ্ঠের স্থলাকৃতির বিভেদ[৯]
  • অতিরিক্ত পরিমাণে ভারকে অপসারিত করে পৃষ্ঠের চাপে মুক্তি। এর ফলে পৃষ্ঠের নীচে গভীরতার সঙ্গে অতিরিক্ত মাত্রায় তাপমাত্রায় বৃদ্ধি ঘটে। পৃষ্ঠের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ম্যান্টলে আংশিক গলন দেখা গিয়েছিল, যা সবেগে উৎক্ষিপ্ত হয়ে ভূপৃষ্ঠের অববাহিকায় জমা হয়েছিল। পাইরোলাইট ম্যান্টল আংশিক গলিত বেসাল্ট তৈরি করতে পারত যা বর্তমানের সিয়াল ভূত্বকের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।[৮]

এই প্রভাবগুলির মাত্রা ব্যাখ্যা করা হয়, যদিও অনেকটাই অনিশ্চিত ভাবে, 'মহাদেশীয়' ভূত্বকের প্রায় অর্ধেক অংশ শিলাময় চান্দ্র সাগরে রূপান্তরিত হয়েছে,[১১] এর মাধ্যমে, আজ যেমন দেখা যায়, সেই ভূত্বকীয় বিভাজন গঠনের তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা যায়।[১০]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Albarède, Francis; Blichert-Toft, Janne (২০০৭-১২-১৯)। "The split fate of the early Earth, Mars, Venus, and Moon"Geochemistry (Cosmochemistry)339 (14–15): 917–927। ডিওআই:10.1016/j.crte.2007.09.006বিবকোড:2007CRGeo.339..917A 
  2. Erickson, Jon (২০১৪-০৫-১৪)। Historical Geology: Understanding Our Planet's Past। Infobase Publishing। আইএসবিএন 9781438109640 
  3. Condie, Kent C.; Aster, Richard C.; Van Hunen, Jeroen (২০১৬-০৭-০১)। "A great thermal divergence in the mantle beginning 2.5 Ga: Geochemical constraints from greenstone basalts and komatiites"। Geoscience Frontiers7 (4): 543–553। আইএসএসএন 1674-9871ডিওআই:10.1016/j.gsf.2016.01.006অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  4. "Early Earth differentiation"। Earth and Planetary Science Letters225 (3–4): 253–269। ২০০৪-০৯-১৫। আইএসএসএন 0012-821Xডিওআই:10.1016/j.epsl.2004.07.008 
  5. Ito, E.; Kubo, A.; Katsura, T.; Walter, M.J (২০০৪-০৬-১৫)। "Melting experiments of mantle materials under lower mantle conditions with implications for magma ocean differentiation"। Physics of the Earth and Planetary Interiors। 143–144: 397–406। আইএসএসএন 0031-9201ডিওআই:10.1016/j.pepi.2003.09.016বিবকোড:2004PEPI..143..397I 
  6. Sizova, E.; Gerya, T.; Stüwe, K.; Brown, M. (২০১৫-১২-০১)। "Generation of felsic crust in the Archean: A geodynamic modeling perspective"। Precambrian Research271: 198–224। আইএসএসএন 0301-9268ডিওআই:10.1016/j.precamres.2015.10.005বিবকোড:2015PreR..271..198S 
  7. Fischer, R.; Gerya, T. (২০১৬-১০-০১)। "Early Earth plume-lid tectonics: A high-resolution 3D numerical modelling approach"। Journal of Geodynamics100: 198–214। আইএসএসএন 0264-3707ডিওআই:10.1016/j.jog.2016.03.004বিবকোড:2016JGeo..100..198F 
  8. Frey, Herbert (১৯৮০-০২-০১)। "Crustal evolution of the early earth: The role of major impacts"। Precambrian Research10 (3–4): 195–216। hdl:2060/19790015389অবাধে প্রবেশযোগ্যআইএসএসএন 0301-9268ডিওআই:10.1016/0301-9268(80)90012-1বিবকোড:1980PreR...10..195F 
  9. "Bombardment of the early Solar System : Nature Geoscience"www.nature.com। সংগ্রহের তারিখ ২০১৮-১০-০১ 
  10. Frey, Herbert (১৯৭৭-১০-০১)। "Origin of the Earth's ocean basins"। Icarus32 (2): 235–250। আইএসএসএন 0019-1035ডিওআই:10.1016/0019-1035(77)90064-1বিবকোড:1977Icar...32..235F 
  11. Taylor, Stuart Ross (১৯৮৯-০৪-২০)। "Growth of planetary crusts"। Tectonophysics161 (3–4): 147–156। আইএসএসএন 0040-1951ডিওআই:10.1016/0040-1951(89)90151-0বিবকোড:1989Tectp.161..147T