ব্যবহারকারী:Syed shohag islam/খেলাঘর

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
মীর মুহাম্মদ সৈয়দ (মীর জুমলা) (দ্বিতীয়)(Mir Jumla II)
জন্ম
মীর মুহাম্মদ সৈয়দ আর্দেস্তানি

১৫৯১
আর্দিস্তান, ইস্পাহান
মৃত্যু৩০ মার্চ ১৬৬৩
খিজিরপুর
সমাধিগারো পাহাড়, মেঘালয়
সন্তানসৈয়দ মুহাম্মদ আমিন
পাগলা সেতু (১৮১৭), সেতুটি মীর জুমলা ১৬৬০ সালে নির্মাণ করেছিলেন বলে জানা যায়।

মীর জুমলা (১৫৯১ - ১৬৬৩) তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় ভারতের বাংলার (বঙ্গ) নামকরা সুবাদার ছিলেন। তিনি ছিলেন মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রতিনিধি।


মীর জুমলার প্রথম জীবন[সম্পাদনা]

মীর জুমলার প্রথম জীবনঃ পারস্য থেকে গোলাকুণ্ডা

১। মীর মহম্মদের পারস্য থেকে প্রস্থান প্রাচীন কাল থেকেই বিদেশের ভাগ্য সন্ধানী এবং অভিযাত্রীদের প্রিয় দেশ ভারতবর্ষ। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শত থেকে সপ্তম শত পর্যন্ত ইসলাম পূর্ব সময়ে পারসিকেরা ভারতে এসেছেন কেউ বাস করতে, কেউ সুফি হিসেবে, কেউ জয় করতে, কেউ জ্ঞান অর্জন করতে বা বিতরণ করতে, কেউবা প্রশাসনিক কাজে, কেউ সেনা হিসেবে, কেউ বা রাজত্ব কায়েম করতে। পারস্য যখন বৃহত্তর সাধারণ ইসলামি আন্দোলনের অংশ হয়, তখন এই প্রবণতাটা আরও বাড়তে থাকে। মধ্য যুগে পারস্য ছিল এশিয় সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অংশ; স্বাভাবিকভাবেই পারস্য থেকে প্রখ্যাত ব্যক্তিরা ভারতে এসে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। এই বিখ্যাতদের মধ্যে মহম্মদ গাওয়ান, মীর্জা গিয়াস বেগ, ইতিমদ্দৌলা, মীর্জা রুস্তম সাফাভি, মীর জুমলা অন্যতম। বহুকাল ধরে দাক্ষিণাত্যে সুলতানি রাজত্বের সঙ্গে ইরাণ, পারস্যের গভীর, নিবিড় সম্পর্ক ছিল। এমন কি এই সব দেশের মানুষ সেই রাজত্বের সর্বোচ্চ পদে আসীনও হয়েছেন। অথচ হিন্দুস্তানে ঠিক উল্টো। পারসিকেরা সেখানে সাধারণত সেনাবাহিনীতে এবং অসামরিক প্রশাসনে অংশ নিতেনমাত্র, তাঁদের পক্ষে সহজে ক্ষমতার উচ্চতমপদে ওঠা সম্ভব ছিল না। মীর মহম্মদ সৈয়দ মীর জুমলার ক্ষেত্রে এই ঘটনার ব্যতিক্রম হয়েছিল; তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক সিঁড়িতে আরোহন করে উজির বা দেওয়ানিকুল পদে আসীন হয়েছেন, এবং পারসিকদের ক্ষেত্রে সাধারণ এই নিয়মের ব্যতিক্রম হিসেবে তাঁকে উচ্চতম পদের উপাধিও দিয়েছিল মুঘল সাম্রাজ্য।

বড় হয়ে পরিবারের দারিদ্র তাকে নতুন পথ বেছে নিতে উৎসাহ দেয়। সে সময়ে পারস্যে শেইখইইসলামের দরুণ আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছিল। তাঁর সময়ের বহু শিয়ার মত তিনিও তাঁর জন্মভূমি ছাড়তে বাধ্য হন। পারস্যের উজির খালিফইসুলতানকে লেখা এক চিঠিতে আগামী দিনের মীর জুমলা, ছোট বেলার মীর মহম্মদ লিখলেন, তিনি দেশ ছাড়তে চান কেননা, ১) নিজের জীবনধারণ সহজে সম্পন্ন করতে, ২) তাঁর পরিবারের বয়স্ক আর বৃদ্ধ আত্মীয়স্বজনের মুখে খাদ্য তুলে দিতে, ৩) এবং পারসিক শেখউলইসলামের অত্যাচার থেকে মুক্ত করতে। তিনি আরও লিখলেন ‘গরীব, অনাথ, অসহায়দের সম্পত্তি দখলের জন্য পারসিক শেখউলইসলামের অত্যাচার এবং জুলমএর মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়া কাহিনী দুর্ভাগ্যক্রমে সত্য হয়ে দেখা দিচ্ছে। সুন্নিরা এখানে(ভারত) শাহজাহানের রাজসভায় এসে সেই দুর্দশা সম্বন্ধে অভিযোগ করেছে, তারা উত্তর পেয়েছে, এই গোষ্ঠীদের এই একই সাজাই হওয়া উচিত। প্রশাসনিক টালমাটাল অবস্থা দেখে বহু বিদেশি বণিক পারস্যে পণ্য পাঠানো বন্ধ করে দিচ্ছে। অন্যান্যরা মনে করছে হিন্দোস্তান, ইরাণের তুলনায় শান্তি আর সমৃদ্ধির দেশ, তারা যতদূর সম্ভব তাদের পণ্য ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছে। যখন উচ্চপদের বসে থাকা বিচারপতি দেশে এ ধরণের দুর্যোগ বয়ে নিয়ে আসে, তখন সে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর যে ধরণের অরাজক অবস্থা নেমে আসে, তা বিশদে না বর্ণনা না করলেও চলে। ভারত সে সময় শরিয়তি আইন অনুসরণ করছিল। অথচ ইরান যেখানে এই ধর্মের, বিচারের এবং সমৃদ্ধির জন্ম স্থান, সে কিন্তু সত্যের পথ ভুলে গিয়েছে’।

মীর মহম্মদ তাঁর জ্ঞান সম্বল করে পারস্যের ব্যবসায়ীর দপ্তরে কাজ গ্রহণ করেন। তাঁর মালিক পারস্য থেকে কিছু ঘোড়া বহন করে গোলকুণ্ডার রাজাকে বিক্রি করার জন্য মনস্থ করেছিলেন। সে সময় পশ্চিম এশিয়, বিশেষ করে পার্সিদের চোখে গোলকুণ্ডা ছিল ভারতের এল ডোরাডো। কোন তারিখে তিনি গোলকুণ্ডায় পৌছে ছিলেন তা বলা না গেলেও, তিনি অবশ্যই ১৬৩০ সালের পূর্বেই সেখানে আসেন। আর মীর মহম্মদ সেখানে পৌছে কি করেছিলেন সে সম্বন্ধেও আমরা কিছুই জানতে পারি নি। বিদেশি পর্যটকেদের পরস্পর বিরোধী মন্তব্যে কোন সিদ্ধান্তে পোঁছন যায় না। যেমন মানুচি আর বার্নিয়ে বলছেন তিনি ঘোড়া ব্যবসায়ীর সঙ্গী হয়ে রাজকীয় পরিবারের জন্য আনা ঘোড়ার তদারক করছিলেন। আবার মানুচিরই সূত্রে পাচ্ছি তিনি বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘরে ঘোড়া বিক্রি করছিলেন। কোনটা সত্য তা নির্ধারন করা মুশকিল। তবে তিনি যে সরাসরি তাঁর ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে গোলকুণ্ডায় পৌছচ্ছেন। তাঁর উত্থান ঘটছে এটা নিশ্চিত হয় গোলকুণ্ডাতেই।

মীর জুমলার বংশ পরিচয়[সম্পাদনা]

মীর মহম্মদ সৈয়দ আর্দিস্তানিকে আমরা সক্কলে চিনি মীর জুমলা নামে, যেটি আদতে একটি উপাধি; এছাড়াও তাঁকে ইতিহাস চেনে মুয়াজ্জম খাঁ, খাঁইখানান, সিপাহসালার এবং য়ারইওফাদার মত উপাধিদার হিসেবে। পারস্যের ইস্পাহানের আর্দিস্তান নামক শহরে এক অভাবী সৈয়দ পরিবারে তাঁর জন্ম, ১৫৯১ সালে। ইসপাহান একদা ইরাণের রাজধানী ছিল। তাঁর পিতার নাম মির্জা হাজারু, আর্দিস্তানের তেল ব্যবসায়ী। পরিবারের নিদারুণ গরীবি সত্ত্বেও ছোটবেলায় মীর জুমলা পড়াশোনা আর যথেষ্ট জ্ঞানার্জন করতে পেরেছিলেন। এই জ্ঞানার্জনের দাক্ষিণ্যে তিনি এক হিরে ব্যবসায়ীর দপ্তরে কাজ পান। সেই ব্যবসায়ির সঙ্গে সরাসরি গোলকুণ্ডার যোগাযোগ ছিল। তাঁর প্রথম জীবনে হিরে ব্যবসায়ে গভীর জ্ঞান, তাঁর জীবনে উঁচুতে উঠতে সাহায্য করেছে।

গোলকুণ্ডায় কর্ম জীবন আরম্ভ[সম্পাদনা]

ভাগ্য দেবতার প্রিয় পাত্র ছিলেন মীর মহম্মদ। যদিও তাঁর বংশ গৌরব খুব বলার কিছু নয়, কিন্তু তাঁর দক্ষতা ছিল ক্ষুরধার, আশা আকাশ্চুম্বী এবং ব্যবসায় অদ্ভুত জ্ঞান-সম্পন্ন অভিজ্ঞতা তাকে সাফল্য দিয়েছিল। যেহেতু সম্পদই বাস্তবে স্বাধীনতা আর ক্ষমতার বাহক, তিনি সম্পদ আহরণে উদ্যমী হলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্য গোলকুণ্ডার এক ব্যবসায়ীর দপ্তরে হিরে ব্যবসায় শিক্ষা নবীশ রূপে কাজ পেলেন। কিন্তু বেশি দিন তিনি সেই কাজ করেন নি। ক্রমশঃ তিনি নিজের হিরে ব্যবসা গড়ে তুলতে লাগলেন। বেনামিতে কয়েকটি হিরের খনি নিজের আওতায় নিয়ে এসে দক্ষতায় এবং পরিশ্রমে সেগুলিকে ব্যবসায়িকভাবে কার্যকর করে গড়ে তুলে হিরে ব্যবসায়ে সফলতার স্বাদ পেতে শুরু করলেন। বিশ্ব জোড়া হিরে বাণিজ্যে অংশগ্রহনে তাঁর সমৃদ্ধির সূত্রপাত। সমুদ্র বাণিজ্যে অংশ নিয়ে ক্রমশঃ তিনি সেই রাজ্যের বড় ব্যবসায়ীদের অন্যতম রূপে গণ্য হতে শুরু করলেন। তাঁর ব্যবসা কর্মে বহু জাহাজ অংশ নিত। রাজনৈতিক জীবনে আরও বড় হতে চেয়ে তাঁর হিরে ব্যবসার সমৃদ্ধির সম্পদ কাজে লাগিয়ে তিনি কুতুব শাহের রাজসভার কাছে একটি প্রাসাদ খরিদ করেন। তাঁর ব্যবহার আর খরুচে স্বাভাবে মুগ্ধ হয়ে রাজপ্রাসাদের সভাসদেরা মীরের রাজনৈতিক উচ্চাশা পরিপূর্ণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিন্তু ইংরেজদের কুঠির তথ্য বলছে ১৬৩৪ সাল পর্যন্ত গোলকুণ্ডায় তাঁর নাম খুব বড় ব্যবসায়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় নি। অন্তত ১৬৩৫-৩৬ সালে শরইদপ্তরশাহীতে(রাজকীয় নথি রক্ষক) তিনি সাধারণ একজন শিল্লাদাররূপে কাজ করছেন। ক্রমশ তিনি রাজকীয় প্রসাসনে ওপরে ওঠা শুরু করলেন, সুলতান নবাব আল্লামি ফাহামি শেখ মুহম্মদিবিন খাতুন তাঁকে মীর জুমলা উপাধি দেবেন রাজ্যের পেশোয়ার দপ্তর দেখা শোনার জন্য। পেশোয়া পদটি কূটনৈতিক পদের কাজের জন্য নির্ধারিত যেমন কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগায়োগ, তদের কথাবার্তা জানা শোনা ইত্যাদি। এছাড়াও প্রশাসনিক নানান কাজ যেমন মামলা করা, চাষের জমির এলাকা বাড়ানো, জনগণের জীবনের মানোন্নয়ন করা ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত থাকতে হত পেশোয়াকে।

নবাব আলামি নিজে খুব বড় প্রশাসক, তিনি ক্ষমতায় আসার আজে রাজ্যর প্রশাসনে এবং সেনা বাহিনীতে যে বিশৃঙ্খলা চলত তা তিনি নির্মূল করার চেষ্টা করেছেন। তাঁর প্রশাসনিক সময়ে একটা তত্ত্ব প্রমানিত হয়, যে রাজত্বে প্রশাসন যখন অদক্ষ, তখন রাজ্য জুড়ে স্বজন পোষণ আর দুর্ণীতি বেড়ে চলে, সেই অবস্থার সুয়োগ নিয়ে কোন যোগ্য ব্যক্তি সুলতানের কাছাকাছি পৌঁছে গুরুত্ব অর্জন করে বিপুল ক্ষমতা দখল করতে পারেন। একই সময়ে সেই ব্যক্তির এই ওপরে ওঠার উচ্চাশা এবং হঠাত পাওয়া প্রতিপত্তিতে অসন্তুষ্ট হয়ে কিছু মানুষ তাঁর বিরুদ্ধে রাজসভায় সুলতানের কান ভারি করার চক্রান্ত করা শুরু করেন, যাতে সুলতান তাঁর প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে পড়েন। এই তত্ত্ব মীর জুমলার জীবনে বহুবার ঘটেছে। সে সময় প্রশাসনিক এবং সামরিক প্রশাসন খুব ভালভাবে চলছিল না। ১৬২৬ সালে ক্ষমতায় এসে আবদুল্লা কুতুব সাহ, এই বিশৃঙ্খলা রোধ করার উদ্যোগ নিলেন। তিনি রাজ্যের প্রশাসনে এবং সেনাবাহিনীতে আইনের শাসন প্রয়োগ করতে একজন পেশোয়া এবং এবং একজন মীর জুমলাকে দায়িত্ব দেন। তারা রাজধানীতেই দপ্তর পেলেন এবং তাঁর দুটি স্তম্ভ হয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। নবাব আল্লামি মীর মুহম্মদ মুমিন পেশোয়ার ১৬২৪ সালে এন্তেকালের পর এবং সুলতানের শাসনকালের শেষ সময়ের দিকে পেশোয়া পদটির অস্তিত্ব ছিল কিন্তু সেই পদে কোন আমলা অভিষিক্ত ছিল না। পেশোয়ার কাজ সুলতান নিজে দেখাশোনা করতেন। বারো বছরের সুলতান আবদুল্লা কুতুব শাহ সিংহাসনে আরোহন করার পর তাঁর মা হায়াত বকশি বেগম জামাই শাহ মুহম্মদকে পেশোয়া পদে বসালেন। কিন্তু শাহ মুহম্মদ অযোগ্য প্রমানিত হলেন। শাহজাহানের দুই দূত আদিল সাহ আর নিজাম শাহ তাঁর অযোগ্যতা প্রমান করে দেন। একই সাথে তিনি বেশ কিছু আর্থিক দুর্ণীতিতেও জড়িয়ে পড়েন। সুলতান তাকে পদচ্যুত করে এক যোগ্য পেশোয়া নায়েব পেশোয়া শেখ মুহম্মদ যার বংশত উপাধি ইবনইখাতুন, পেশোয়াইকুল পদবি দিয়ে কাজে নিয়োগ করেন(১৬২৯, ২২ এপ্রিল, রমজান ৯ ১০৩৮ হিজরা)। সুলতান মনসুর খাঁ হাবসিকে আইনিমূলককে পদন্নোতি দিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত দেহরক্ষীদের (লস্করিরিকাব) হাবিলদার রূপে নিয়োগ করেন মীর জুমলা দপ্তরে। তিনি অসামরিক প্রশাসনের কাজকর্ম দেখা শোনা করার থেকে সামরিক বাহিনীর ভালমন্দ নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। সুলতান লিখতে পারতেন না, সরকারি প্রশাসনেও খুব একটা দক্ষ ছিলেন না, ফলে অধস্তন ব্রাহ্মণদের এই করণিকের কাজে নিযুক্ত করেন। তারা তখন ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসে। গরীব চাষীদের অভাব অভিযোগ তিনি শুনতেন না, যারা তাঁর রাজ্যেকে বাঁচিয়ে রেখেছে তাঁদের স্বার্থ দেখা জরুরি মনে করতেন না। সেনা প্রশাসন অযোগ্য স্বজন পোষিত কর্মচারীতে ভরে গিয়েছিল। স্বার্থান্বেষী মানুষদের কান ভাঙ্গানিতে উত্তেজিত হয়ে তিনি পুরোনো কিছু যোগ্য এবং তাঁর গুণগ্রাহী আধিকারিককে বরখাস্ত করেন এবং নতুন কিছু আধিকারিককে নিযুক্ত করেন। মনসুরের মত অযোগ্য মানুষের কথায় প্রভাবিত হয়ে অন্যান্য যোগ্য আধিকারিককে হেনস্থা করতে শুরু করেন।

১৬২৮সালের অক্টোবরে মনসুর খাঁয়ের মৃত্যুর পরে মীর জুমলা পদটি ফাঁকাই পড়েছিল।১৬৩৪ সাল পর্যন্ত সরইকাহিল দপ্তরের আধিকারিক এই পদএর কাজকর্ম দেখাশোনা করতে থাকেন। ১৬৩১ সালে কিছু মাসের জন্য শেখ মুহম্মদ পেশোয়া দেওয়ান হিসেবে কাজ সামলান। কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ, তাঁর পিছনে ষড়যন্ত্র রচনা করলেও তিনি সেই সব অদক্ষ ষড়িদের জাল কেটে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হন। সুলতান তাকে নতুন করে পেশোয়া পদে নিযুক্ত করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন, কিন্তু তিনি অস্বীকার করলে তাঁকে মীর জুমলা(জুমলাতুল মুলকি) পদে নিযুক্ত করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন, যেটি আসলে সুলতানের পরামর্শদাতার পদ। বহু অনুনয় বিনয়ের পর ৯ শাওয়াল ১০৪৩, ২৯ মার্চ ১৬৩৪ সালে তিনি পদে আরোহন করেন এবং তাঁর ভাইপো শেখ মুহম্মদ তাহিরকে তাঁর অধস্তনরূপে(পদটির নাম সরইকাহিল, তাঁর আগে পদে ছিলেন মীর ফাসিউদ্দিন) নিয়োগ করা হয়। প্রশাসনের রশি এবার থেকে তাঁর হাতে সমর্পিত হয়। অসামরিক প্রশাসন এবং সামরিক প্রশাসনে আইনের শাসন বলবত করার চেষ্টা শুরু করা হয়। প্রত্যেক দপ্তরের জন্য বিশদে নীতি প্রণীত হয়। মোটামুটি দেখা যাচ্ছে তিনি কিছুটা হলেও দক্ষ আধিকারিক

নবাব আল্লামি শেখ মুহম্মদ তাঁর নিজের দায়িত্ব ছাড়াও মীর জুমলা(মৌখিক নাম। পদটির সরকারি নাম জুমালাতুল মুলকি) পদের দায়িত্ব সামলাতে থাকলেন। সঙ্গে চলতে থাকল পেশোয়া পদের বিপুল দায় দায়িত্ব নির্বাহ করা। কূটনৈতিক দায় পালনের সম্মানে পেশোয়া পদের জন্য তিনি নববর্ষের আংরাখা খেলাত পেলেন, পেলেন দুটি ইরাকি ঘোড়া এবং তিনি যাতে সসম্মানে রাজ সন্নিধানে পালকিতে আসতে পারেন সেই সম্মানও তাঁকে দেওয়া হল(১৭ রজব ১০৪৫, ১৭ ডিসেম্বর, ১৬৩৫)। সব্বাইকে নির্দেশ দেওয়া হল, রাজ্যের সব ধরণের মামলা তার দপ্তরই সামলাবে।

সুলতান যে তাঁর ওপরে আস্থা পেশ করছেন, এই বিষয়টা দায়িত্ব পালনে তাঁকে আরও উদ্বুদ্ধ করে তুলল। নিজামুদ্দিন মুহম্মদ লিখছেন, জনগনের জীবনের মান উন্নয়নের, চাষের বিকাশে এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে আরও উন্মুখ হয়ে উঠলেন।

নবাব আল্লামি ফাহামির হাতে প্রভূত সরকারি ক্ষমতা আসায় তিনি নিজে রাজকাজে নিযুক্ত কর্মদক্ষ সঠিক মানুষকে প্রশাসনের সঠিক কাজে লাগাবার উদ্যোগী হলেন। অভিজ্ঞতা, দক্ষতা আর প্রজ্ঞা বিচার করে বহু শিল্লাদারকে মজলিস (পরামর্শ সভা) পদে, কাউকে তিনি মহাল পদে, কাউকে আবার আমিল বা হাকিম পদে উন্নীত করলেন। আগেই বলেছি, আমাদের বীর, মীর মুহম্মদ শিল্লাদার পদে কাজ করতেন, তখন তিনি হয়ে উঠেছেন সুলতানের অন্যতম প্রিয় কর্মী। ১০৪৫/১৬৩৫-৩৬ সালে তাঁকে মছলিপত্তনম হাবিলদার পদে নিয়োগ করা হল। ভারতের ইতিহাসে প্রভাবের নিরিখে এটাই হয়ত গুরুত্বতম পদোন্নতি বলা চলে।

গোলকুণ্ডা রাজ্যে মূল বন্দর ছিল মছলিপত্তনম। সেই বন্দরে প্রচুর কর্মী কাজ করত, দক্ষিণী চিন্টজ আর ক্যালিকো কাপড় রপ্তানিতে মছলিপত্তনমএর সুনাম ছিল। কাপড়গুলি হয় স্থানীয় তাঁতিরা তৈরি করত বা আসত সেন্ট জর্জ থেকে। ভারতে যত চিন্টজ তৈরি হত সেগুলির মধ্যে দক্ষিণের চিন্টজ আর ক্যালিকো ছিল সূক্ষ্মতম এবং রংদার। পূর্ব উপকূল সূতি বস্ত্র উতপাদকেদের রপ্তানির মূল কেন্দ্র ছিল। এখান থেকে সূতি বস্ত্র ব্যান্টাম এবং মধ্য প্রাচ্য যেত; এছাড়াও এই এলাকার সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল সুরাট, বন্দর আব্বাস(গমব্রুম)এর মত পশ্চিমি বন্দর বা পূর্বে পেগুর সঙ্গে। নিজামুদ্দিন আহমদ লিখেছেন, ‘জাহাজগুলি দক্ষিণের দেশে (জেরবাদ) এবং উত্তরের দেশে(বালাবাদ) যেত, আর যেত আরব এবং আজমের বন্দরের পানে। সারা বছর ধরে এই বন্দরে জাহাজ আসত এবং ছেড়ে যেত। এটাই ছিল এই বন্দরের বিশেষত্ব’। থেভেনট(Thevenot) লিখছেন, ‘তটটি অসাধারণ, প্রায় সব ধরণের দেশ থেকে জাহাজ আসতেও পারে, যেতেও পারে। আমি সেখানে কোচিনি চিনা, সিয়ামের, পেগুর এবং পূর্ব দেশের বহু দেশের মানুষ দেখেছি।’

বহু বছর আগে এই রাজমুকুটসম বন্দরটির পরিচালন ব্যবস্থা ভাল ছিল না। যদিও এটির রক্ষণাবেক্ষণে সর্বক্ষণের এক হাবিলদারের দায়িত্বে থাকত, আর থাকত সেই রাজ্যের(মুস্তাফানগর) প্রধান পদাধিকার সর সিমতো আর বন্দরের জন্য ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক শাহবান্দারও। কিন্তু বন্দর পরিচালনায় সর্বস্তরে দুর্ণীতি বন্দরের পতনের বার্তা বয়ে নিয়ে এসেছিল, রাজ্যের উন্নতির দিকে না তাকিয়ে ব্যক্তিগত স্বার্থ আর লাভের জন্য প্রশাসকেরা প্রচুর শুল্ক আদায় করতেন। ব্রিটিশ কুঠির তথ্য থেকে পরিষ্কার যে মছলিপত্তনমের প্রশাসন দুজন হাবিলদার – মুল্লা মুহম্মদ টাকি তাকরিশি এবং তাঁর উত্তরাধিকারী মীর ফাসিউদ্দিন মুহম্মদ তাকিরিশির ওপর ন্যস্ত ছিল। এদের খারাপ ব্যবহারের দরুণ ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের প্রশাসনের সঙ্গে বিরোধ হচ্ছিল। মীরপাস(মীর ফাসিউদ্দিন)কে লেখা চিঠিতে কুঠিয়ালরা জানাচ্ছে, তাঁর সঙ্গে বিবাদের কারণ হল তাঁর পূর্বসূরী মামাটুকি (মুহম্মদ টাকি) এবং কোন রকম পরিবর্তন না করেই তাঁর পূর্বসূরী অনুসৃত নীতিগুলি প্রয়োগ করা হচ্ছে। ফলে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে মছলিপত্তনম থেকে চলে গিয়ে আরামগাঁওতে(চন্দ্রাগিরির নায়েকের প্রশাসনের অধীনে) কুঠি বানানোর।

কয়েক বছর পরে(১৬৩০-৩২) এই জেলার প্রশাসক হয়ে এলেন মির্জা রোজবিহানী ইসপাহানি। ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের নথিতে যিনি মীর্জা রসবাহান নামে পরিচিত। তারা তাকে বড় গভর্নর হিসেবেই দেখত; তিনি সামগ্রিকভাবে কাপড়ের শুল্ক অনাদায়ে, বন্দরের কর না দেওয়ায়, ব্রিটিশদের পেটাপল্লি থেকে জাহাজে কাপড় তুলতে দেননি। ফলে কুঠিয়াল মছলিপত্তনমের প্রশসাকের সঙ্গে দেখা করে(২২ নভেম্বর ১৬৩০), সস্তুষ্ট করে, দুটি ব্রড ক্লথ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জাহাজ ছাড়েন। যতদূর সম্ভব এই মানুষটি ছিলেন সেই এলাকার হাবিলদার। বাটাভিয়ার ডচেদের দাগ রেজিস্টারে তাকে মছলিপত্তনমের প্রশাসক, গভর্নর হিসেবে দেখানো হয়েছে। ২৯ আগস্ট, ১৬৩২ সালে লেখা মছলিপত্তনমের একটা চিঠি থেকে জানতে পারি তিনি সেই এলাকার চাষী এবং গোলকুণ্ডার প্রশাসক(সরইখাহিল) ছিলেন।

যাইহোক, মছলিপত্তনম বন্দর হিসেবে এতই গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরাও কিছুদিনের জন্য(১৬২৮-৩০) নিজেদের সরয়ে নিলেও ১৬৩০ সালে ফিরে এসে গোলকুণ্ডার সুলতানের থেকে ১৬৩৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ব্যবসার ছাড়পত্রের নির্দেশপত্র স্বর্ণ-ফার্মান অধিকার করল। কুঠির তথ্যাবলী থেকে পরিষ্কার, ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের পাওয়া এই ব্যবসায়িক ছাড়ে উদ্বিগ্ন বন্দর প্রশাসকদের মনে হল, রাজ্য প্রচুর অর্থ রাজস্ব হারাবে। তারা ডাচেদের সঙ্গী করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সুলতানের কাছে ফরমান অপব্যবহারের অভিযোগ আনল। এর ফলে সরইখাহিল(আবদুল্লা খাঁ মাজানদারানি) এবং দবির(মুল্লা ওয়ায়িস, মুন্সিউলমামালিক) ব্রিটিশ কুঠিয়াল রজার্সএর থেকে বাতসরিক ছাড়ের শুল্ক দাবি করল।

বন্দরের প্রশাসনিক অবস্থা স্বাভাবিক করতে আমাদের নায়ক মীর মহম্মদ খুব চেষ্টা করেছেন। নিজামুদ্দিন আহমদ তাঁর চাকরির সময়ের নথি দেখে লিখছেন, হাবিলদার পদে মীর তাঁর প্রশাসনিক দক্ষতা প্রমান করেন। তাঁর অসীম দক্ষতা আর পুত চরিত্র তাকে প্রশাসনের সিঁড়িতে চড়তে সাহায্য করেছিল। এক বছর হাবিলদারের পদে কাজ করার পর (১৬৩৭) তিনি তেলেঙ্গানার মুস্তাফানগরের (কোণ্ডাপল্লি)) একটি বিশাল দুর্গ মহলের হাবিলদার নিযুক্ত হলেন। তিনি দুর্গের প্রশাসন ঢেলে সাজালেন এবং তাঁর সম্পদ নতুন করে আদায়ের ব্যবস্থা করলেন। তাঁর বক্তৃতা এবং কর্মদক্ষতা রাজধানীর প্রত্যেক মানুষের পছন্দ ছিল। তিনি সুলতানের স্বার্থের জন্য রোদেপুড়ে কাজ করে তাঁর উচ্চাসনে ওঠার পথ পাকা করেন। মছলিপত্তনম আর মুস্তাফানগরের হাবিলদারি তাঁকে সরইখাহিল পদে আরহণ করতে সাহায্য করল। সরইখাহিল শব্দের আক্ষরিক অর্থ ঘোড়ার প্রধান, বা দলের প্রধান। বাস্তবে এই পদের দায়িত্ব অনেকটা মীর জুমলা পদের অনুরূপ – সেনাবাহিনীর দায় ছাড়াও এই পদাধিকারীকে রাজ্য জোড়া অসামরিক রাজস্ব আদায়ের কাজ করতে হত। গোলকুণ্ডা রাজ্যে এই পদটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল, রাজত্বের ভাল খারাপ হওয়া এই পদে থাকা মানুষটির ওপর অনেকটা নির্ভর করত। আধিকারিক যদি অদক্ষ ব্যক্তিত্বহীন হত তাহলে করণিক ব্রাহ্মণেরা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত, তহবিল তছরূপ এবং আত্মসাত করার প্রবণতা বেড়ে যেত এবং রাজস্বের ক্ষতি হত। তাই প্রধান রাজস্ব আধিকারিক হিসেবে তিনি পূর্ব উপকূলের ব্যবসায় নিজের দপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করলেন। দেওয়ান মীর জুমলা মনসুর খাঁ হাবসি, মুল্লা মুহম্মদ তাকি তাকরিশিকে বহু মানুষের মধ্যে থেকে বেছে নিয়ে সরইখাহিল(আসলে মীর জুমলা) পদে নিযুক্ত করেন ২৩ সফর ১০৩৮, ১২ অক্টোবর ১৬২৮ সালে। তিনি তাঁর দায়িত্ব এতই দক্ষ ভাবে পালন করেন যে মহালের দুর্নীতিপূর্ণ আধিকারিক এবং মাথায় চড়ে বসা ব্রাহ্মণেরা কর্তৃত্ব হারিয়ে ফেলে; তহবিল তছরূপ এবং আত্মসাতের প্রবণতা বন্ধ হয়ে যায়, রাজস্ব আদায় বাড়তে তাকে। জমিদার নারায়ণ রাওয়ের(মজমুদার) থেকে ১৩০০০০ হুন আদায় হয় এবং ট্রেজারিতে জমা হয়। বিভিন্ন বাগী চৌধুরীকে হত্যা এবং তাঁদের সম্পত্তি রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। সুলতান মুহম্মদ টাকিকে সারিফুলমুল্ক উপাধিতে ভূষিত করে তাকে সোনার জলে কারুকার্য করা কলমদানি উপহার দেন। তিনি এই উপহার মির্জা মুহম্মদ আমিন মীর জুমলা ছাড়া অন্য কোন অধিকারিককে উপহার দেন নি।

এই পদের বিশদ বর্ণনা এই জন্য দিলাম এটাই বার্তা দিতে যে সরইখাহিল আর মীর জুমলা এই দুটি পদ এর পর থেকে একজনই(মুহম্মদ টাকি) সামলাবেন এবং দেওয়ানির অর্থ মূলত রাজস্ব আদায়, এই দুই পদাধিকারিকের ওপর ন্যস্ত ছিল।

নিরবিচ্ছিন্ন দুবছর সাত মাস দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে, শাওয়াল ১৯, ১০৪০, ১১ মে ১৬৩১ সালে সরফইমুল্ক, সরইখহিল এবং সদর মুহম্মদ টাকি তাক্রিশির এন্তেকাল হয়। তাঁর পরের ছয় বছর এদিকওদিক করে, একের পর এক ক্ষণস্থায়ী পদাধিকারী বসিয়ে দপ্তরটি চালানো হয়, কিন্তু টাকি যে উচ্চতায় দপ্তরটিকে পো্ঁছে দিয়ে যান, সেই দক্ষতা দপ্তরের হারিয়ে যায়। পেশোয়া পদের অধিকন্তু পদ হিসেবে, প্রথমে নবাব আল্লামি ফাহিমি শেখ মহম্মদ ইবনে খাতুন দেওয়ান পদ দেখাশোনা করতেন। এই পদের দায়িত্ব পাওয়ার পর তিনি তাঁর সাবেক দেওয়ান দপ্তরের কাজকর্ম দেখাশোনা করতে দেন মীর কাশিম নাজিরউলমুল্ক, মীর মুইজ্জুদ্দিন মুহম্মদ মুশারফ এবং নারায়ণ রাও মজমুদার এবং অন্যান্য আধিকারিককে - যাদের কাজ ছিল যথাক্রমে রাজকীয় রসুইখানা, হাতিসাল, ঘোড়াশালের ব্যবস্থাপনা করা।

খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং বাড়তে থাকা খরচে নাজেহাল দেওয়ানির দৈনন্দিন কাজকর্ম বেহাল হতে থাকে। বহু কাজ বন্ধ হয়ে যায়, বিভিন্ন মহাল থেকে অভিযোগের পর অভিযোগ আসতে থাকে। বাস্তবিকভাবে এই ক্ষণস্থায়ী পদক্ষেপগুলি ঠিক মত কাজ করে নি। ২৪ জিলহিজ্বা ১০৪৯, ১৪ জুলাই ১৬৩১ মীর্জা আস্তরাবাদী, সরইখাহিল পদে নিযুক্ত হলেন। মীর্জা বিশ্বস্ত এবং সৎ হলেও, হিসেব রাখা এবং প্রশাসনিক কাজে অনভিজ্ঞতার দরুণ তাঁর পদের প্রতি সুবিচার করতে পারেন নি। এই সুযোগে ব্রাহ্মণেরা মাথায় চড়ে বসতে থাকে। বাউতাত বাড়ি আর মহালগুলি থেকে এতই অভিযোগ আসতে থাকে যে সুলতান নিজে কারখানার কাজকর্ম দেখতে শুরু করেন। নবাব আল্লামির পরামর্শে সুলতান মীর্জা রোজবিহানী ইসপাহানিকে ৩ রাবিউসসানি ১০৪১, ১৯ অক্টোবর ১৬৩১ সালে এই পদে নিযুক্ত করেন। সৎ এবং সত্যবাদী হওয়া সত্ত্বেও তাঁরও কাজ সুলতানের অপছন্দ হল। তাকে বরখাস্ত করে সুলতানের প্রধান নৃত্য সহায়ক মীর ফাসিউদ্দিন তাকরিশি সোনার কারুকার্য করা কলমদানি উপহার দিয়ে এই পদে বহাল হন। কিন্তু তারও চাকরি বেশি দিন রইল না, শেষমেশ সুলতান নবাব আল্লামিকে মীর জুমলা পদে নিয়োগ করেন ৯ শাওয়াল ১০৪৩, ২৯ মার্চ ১৬৩৪ সালে। আগেই বলেছি তাঁর সঙ্গে তাঁর ভাইপো মুহম্মদ তাহির সরইখাহিল হিসেবে তাঁর সহকারীর পদে নিযুক্ত হন। মীর জুমলা পদ সামলানো ছাড়াও নবাব আল্লামি পেশোয়া পদের খেলাত পেলে(১৭ রজব ১০৪৫, ১৭ লিসেম্বর ১৬৩৫), সরইখাহিল তিন মাসের জন্য খালি পড়ে থাকে। নবাব আল্লামির পরামর্শে, কাশিমকোট এবং কলংএর সরইলস্কর আবদুল্লা খাঁ মাজানদারানি সরইখাহিল পদে নিযুক্ত হলেন ১৯ শাওয়াল ১০৪৫, ১৭ মার্চ ১৬৩৬। আমরা দেখলাম ১৬৩১এর পর থেকে কিছু দিন অন্তর এই গুরুত্বপূর্ণ পদে আধিকারিক বদলাতে হয়েছে এবং সেই পরীক্ষা নিরীক্ষা সফল হয় নি, একের পর এক সরইখাহিল পদে আধিকারিক পরিবর্তিত হতে থাকে যতক্ষণনা আমাদের বীর মীর মুহম্মদ এই পদের আধিকারিক হিসেবে মনোনীত হচ্ছেন।

১০৪৭ হিজরাব্দে এক রাজকীয় আদেশে(ফর্মান) মীর মহম্মদকে রাজসভায় লেকে পাঠানো হয়। তাঁকে ৭ সফর ২১ জুন ১৬৩৭ সালে এক রাজকীয় অনুষ্ঠানে ভাল জাতের হাতি, ইওরোপিয় ও চিনা কাপড় উপহার দিয়ে সম্মান জানানো হয়। সুলতান তাঁকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেন এবং ‘জ্ঞানী আর দক্ষতার সংমিশ্রণ’ রূপে অভিহিত করলেন। সফর ৯এর রাতে ২৩ জুন ১৬৩৭ সালে সৈয়দ আবদুল্লা খাঁ মাজানদারানির উত্তরসূরীরূপে পুরোনো মহালকে উকিলদের হাতে ছেড়ে মীর মহম্মদ নতুন পদে অভিষিক্ত হলেন।

গোলকুণ্ডার উজির মীর মহম্মদ[সম্পাদনা]

মীর মহম্মদের প্রতি আসাফ জাহি(আসফের মত জ্ঞানী)র মত উদেদেশ্যপূর্ণ গুণবাচক বিশেষণ - আসফ মঞ্জিলাত এবং আসফ মরতাবাত প্রয়োগ করে নিজামুদ্দিন আহমদ বলছেন, ‘সুগভীর জ্ঞানে আর সেবায় সম্পাদিত সুলতানি কাজকর্ম, নানান ধার্মিক দায়িত্ব পালন আর রাজকীয় সমৃদ্ধি বৃদ্ধিতে সফল হওয়ায় ধীরে ধীরে তিনি সুলতানের কাছাকাছি আসতে থাকেন। তাঁর ভাগ্য আর জ্ঞানের বলে তিনি শীঘ্রই প্রশাসনিক সংক্রান্ত ব্যবস্থার(অম্র হুকুমত) চরমতম দক্ষ ক্ষমতাশালী পণ্ডিতে(ইস্তাকাল) পরিণত হলেন। তিনি জোর করে অনৈতিকভাবে অর্থ আদায়কারী(আরবাবইদাখিল)দের রোজগারের রাস্তা বন্ধ করেন। অধস্তন কর্মী(উম্মাল) আর ব্রাহ্মণ করণিকদের থেকে বিপুল পরিমান অর্থ উদ্ধার করে সুলতানের কোষাগার বৃদ্ধি করলেন’। সুলতান এই কাজে সন্তষ্ট হয়ে তাকে একটা রত্ন খচিত কলমদানি(কলমদানিইমুরাসসা) উপহার দিলেন। সঙ্গে দিলেন বছরে ৩০০০০ হুন রাজস্ব বিশিষ্ট একটি পরগণাও, যাতে তিনি বেশ কিছু আরবি সৈন্য রাখতে পারেন। এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ১০০ আরবি, ইসপাহানি সৈন্য নিয়োগ করেন সুলতানের শিল্লাদার রূপে। মাতা-সাম্রাজ্ঞীর বেশ কিছু কাজ সম্মানজনকভাবে সম্পন্ন করায়, রাজকীয় মাতা তাঁকে প্রচুর উপহার দেন, যার মধ্যে রয়েছে একটি কোমরবন্ধ, রত্নখচিত তরোয়াল (শামশিরইমুরাসসা), ঘোড়া আর হাতি।

এর পরে আরও কিছু জটিল কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় দায়িত্বও তিনি পালন করেন। এই দায়িত্বে তাঁর অতুলনীয় সাংগঠনিক ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া গেল। সুলতানের মাতা-সাম্রাজ্ঞীর রাজধানীতে একটিও প্রাসাদ জেনানা-মহলের জন্য পছন্দ না হওয়ায়, মীর মহম্মদের ওপর দায়িত্ব পড়ে মাত্র একবছরেরও কম সময়ের মধ্যে (রবিউলআওয়াল ১০৪৮, জুলাই ১৬৩৮এর মধ্যেই) চার তলা প্রাসাদ হায়াত মঞ্জিল বানিয়ে দেওয়ার। সেই উদ্দেশ্যে একটি স্থান নির্বাচন করে প্রাসাদ পরিকল্পনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হাবিলদার মালিক আলমাসের তত্ত্বাবধানে একটি স্থাপত্যের পরিকল্পনা তৈরি করেন মীর। সেই পরিকল্পনাটি সুলতান কিছুটা সংস্কার করে দিলেন; চারতম তলার চারদিকে, চারটি বিশাল জানালা যুক্ত সুউচ্চ মিনার সংযোজিত হল। প্রাসাদের সাজসজ্জা নিখুঁততম এবং বিশদে তৈরি করতে মীর মহম্মদ রাজ্যের এবং দেশের প্রচুর জ্যামিতিবিদ এবং কারু শিল্পী নিযুক্ত করে, নিজে সারাদিন প্রায় অভুক্ত থেকে স্থপতি এবং কারিগরদের সঙ্গে কাজ করে এটি রূপায়িত করেন। চতুর্থ তলার ছাদের চারটি মিনারের মাঝখানে চাঁদনি (পোর্টিকো), দেহলি(টেরেস), বসার যায়গার সঙ্গে একটি গ্রীষ্ম-ঘর আর একটি গোসলখানা নির্মান করেন; সুলতানের নির্দেশ অনুযায়ী দেওয়ালের বিশেষ চিহ্নআঁকযুক্ত সাজসজ্জাকে বাস্তবে রূপায়িত করার ব্যবস্থা করেন। ঘরের দেওয়ালে ইরাণ আর হিন্দোস্তানের শিল্পীদের দিয়ে আঁকানো হয় রাজসভা, শিকার এবং যুদ্ধের রঙ্গিন চিত্রাবলী। কাজটি এতই সুসম্পন্ন করে সম্পাদিত করা হয় যে নিজামুদ্দিন এই রাজপ্রাসাদকে এরম বা ইডেনের সঙ্গে তুলনা করেন।

মাত্র কয়েক দিন পরেই রবিউলআওয়ালের শেষের দিকে(১ আগস্ট, ১৬৩৮) তাঁর প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা প্রয়োগ এবং সর্বসমক্ষে প্রয়োগ এবং উপস্থিত করলেন, সকলে তাঁর দক্ষতার মুগ্ধ হয়ে গেল। প্রাসাদ উদ্বোধনে আসবেন সুলতান, উজির, আমীর হাজারো আধিকারিক। মাতা-রাজ্ঞীর ইচ্ছে অনুযায়ী সেই বর্ণাঢ্য, সম্পদশালী উদ্বোধন অনুষ্ঠানের সমস্ত ছোট ছোট খুঁটিনাটি পরিকল্পনা নিজের কর্মচারীর সঙ্গে মিলে রূপায়িত করলেন মীর মহম্মদ। প্রাসাদের সামনে যে মাঠটি রয়েছে, সেটি পরিষ্কার করে আরশির মত চকচকে করে ফেলা হল। সরনৌবত (সেনা বাহিনী না নহবত?) তাঁদের কাজ দেখাতে এল। মাতা-রাজ্ঞীর বিশেষ দূতের সাহায্যে মীর মহম্মদ ভেলভেটের গালিচা পাতা ১০০০ গজ দীর্ঘ রাস্তা জুড়ে সোনার শিকলি আর ঝালর দিয়ে সাজিয়ে দেওয়া হল। এই রাস্তায় মোট আটটা বড় বড় তোরণ তৈরি করা হয়। গরীবদের জন্য বিপুল খাদ্য বিতরণ করা হয়। অতিথিদের অভ্যর্থনার জন্য রাস্তায় সার দিয়ে দাঁড়িয়েছিল হাতি, ঘোড়া, উট আর দাস-দাসী। হাতে রত্ন খচিত সোনার বারকোষ(ট্রে)এ বহুমূল্য রত্নরাজি, বস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে ১২টি হারেমের আহুদাদার আর মালিকেরা দাঁড়ানোয় সমগ্র উদ্বোধন অনুষ্ঠানের জাঁকজমক আরও বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। এই রত্ন খচিত অনুষ্ঠান চলাকালীন তাঁর বিশালত্ব নিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে সুলতান প্রত্যেকটি তোরণ পার হচ্ছেন, আর তাকে নানানভাবে অভ্যর্থনা জানানো হচ্ছে, শেষে তিনি সিঁড়ি চড়ে সব থেকে উঁচু আসনে বসলেন। উচ্চপদস্থ আমলারা তাঁকে নানান ধরণের পেশকাশ দিয়ে চলেছেন এবং তিনি তাঁদের স্বাগত জানাচ্ছেন। মাতা-রাজ্ঞী সুলতানকে একটি সোনার ঝালর এবং শৃঙ্খলে মোড়া একটি হাতি, দুটি ঘোড়া, ইরাকের রত্নখচিত শৃঙ্খল, ইওরোপের ভেলভেট, চৌদ্দটি সোনায় কারুকাজ এবং মোড়া করা সূক্ষ্ম বস্ত্র যার প্রান্তটি রেশমের সুতো দিয়ে সেলাই করা সহ প্রচুর সামগ্রী উপহার দিলেন।

বিপুল সম্পদের অধিকারী মীর মহম্মদ সৈয়দ সোনায় অসাধারণ কারুকাজ করা নানান আনুষঙ্গিক উপকরণে সজ্জিত ১২ মন ওজনের সোনার পালঙ্ক উপহার দিলেন। এছাড়াও দিলেন সোনার গোলক, সোনার তৈজসপত্র, সোনার পাত্র, সূক্ষ্ম বস্ত্র এবং তাঁর রুচি মত অন্যান্য উপহার। মীর মহম্মদের সাম্প্রতিক সেবায় খুশি হয়ে মাতাসাম্রাজ্ঞী তাকে বিশেষভাবে উপহার দিলেন সোনার শৃঙ্খলে মোড়া একটি ঘোড়া, একটি হাতি, একটি কোমর বন্ধনী, এবং একটি রত্নখচিত তরোয়াল।

আরও কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা মীর মহম্মদের ভবিষ্যতের উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের দিকে এগিয়ে দিল। যারা তাঁর পথে কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁদের বিরোধিতাকে চূর্ণ করে আরও গর্বিত দর্পে তিনি এগিয়ে চললেন। তাঁর জ্ঞান, দক্ষতা, প্রজ্ঞা, মুল্লা ওয়ায়েজ যিনি দবির এবং মুনসিওউলমামালুকের মত পদে থেকেছেন, ঈর্ষার কারণ হয়েছে। সুলতানের নেক দৃষ্টির সুযোগ নিয়ে সমস্ত শোভনতা এবং বাস্তব বিচারবুদ্ধ নাশ করে সরইখাহিল দপ্তরের কাজকর্মে দাখিলা দেওয়া শুরু করলেন মুল্লা। এমন কি পেশোয়া দপ্তরে বা সব কয়জন মনসবদারের সঙ্গে তিনি এমন ব্যবহার করা শুরু করলেন যেন তারা তাঁর অধস্তন কর্মচারী। তাঁর এই বেয়াদপি দেখে, বুঝেও সুলতান নানা কারণে তাকে নিবৃত্ত করেন নি। সরইখাহিল দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত আধিকারিক মীর মহম্মদও সুলতানের অতিশয় প্রিয়পাত্র ছিলেন। এবং তিনি তাঁর প্রতি ন্যস্ত নানা অসামরিক এবং দেওয়ানির রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত দায়িত্ব তাঁর মত করে নিজস্ব যোগ্যতায় পালন করার চেষ্টা করছেন। তিনি স্বাভাবিকভাবেই তাঁর দপ্তরে অযাচিতভাবে মুল্লা ওয়ায়েজএর মাথা গলানো পছন্দ করেন নি, এবং সুলতানের প্রতি দায়বদ্ধ নন, এমন অভিয়োগ তিনি দৃঢভাবে খণ্ডণ করে চিঠি লেখেন। মীরের ক্ষমতার ডানা ছাঁটতে না পেরে ওয়ায়েজ তাঁর পদত্যাগ পত্র সুলতানের কাছে পাঠিয়ে দিলে সুলতান তেলেবেগুণে জ্বলে ওঠেন। শেষ পর্যন্ত রবিউল্লাওয়ালএ(জুলাই ১৬৩৮)) মুল্লাকে পদচ্যুত করিয়ে তাঁর বাড়িতে নজরবন্দী করে রাখা হয়, এবং উজিরের পদটি নিয়ে আবার অপপ্রয়োগ হতে থাকে। মীর মহম্মদকে এবারে নিজের ১০০ জনকে দেখতে বলা হয় এবং বলা হয় তাকে যে জায়গির দেওয়া হয়েছে, সেখানের রাজস্ব থেকেই তাঁদের বেতন উদ্ধার করতে হবে। মুল্লার দবির দপ্তরটি ২৬ শাওয়ালে, ২০ ফেব্রুয়ারি ১৬৩৯তে মির্জা টাকি নিশাপুরিকে দেওয়া হয়। উজিরাত পদটিকে দেওয়া হয় কাশমকোটা থেকে ডেকে আনিয়ে মির্জা রুস্তমকে। মুল্লার বাহিনীটি মালিক অম্বরের দায়িত্বে ছিল, তিনি সেটি মীর মহম্মদকে অর্পণ করেন। মালিক অম্বর, মীর মহম্মদকে বর্ণনা করেন ‘আধুনিক যুগের আসফ’ রূপে।

ক্রমশ মীর্জার দক্ষতার পরিচিতি এবং ক্ষমতার বিস্তৃতি ঘটতে লাগল। দাদমহলের ময়দানে তাঁর ইরাকি সেনা, সুসজ্জিত শিক্ষিত হাতি এবং ঘোড়ার কুচকাওয়াজ দেখিয়ে তিনি কোমর বন্ধনীর সঙ্গে ‘সরইখাহিলএর মত উচ্চপদের সঙ্গে উজিরাতের দায়িত্ব’ও লাভ করলেন। রাজধানীতে উজির পদের একটা নিয়মিতান্ত্রিক কাজ ছিল, উজির যদি রাজধানীতে উপস্থিত থাকেন, তাহলে সপ্তাহে একদিন সারা রাত এবং পরের দিন সক্কালের নদীর ওপারে(রুদ খানা)র নদী মহলের সৈন্য, হাতি, ঘোড়ার কুচকাওয়াজ দেখবেন। তার দেখার পরে সেই কুচ যাবে দাদমহলের ময়দানে সুলতানের নজরদারির উদ্দেশ্যে। সাধারণত রাজত্বে ১২ জন উজির থাকেন। এদের মধ্যে এক থেকে তিনজন উজিরকে একসঙ্গে বসে সারারাত রোজকার সৈন্যের কুচকাওয়াজ দেখতে হবে।

কুতুব শাহের মছলিপত্তনম যাত্রা[সম্পাদনা]

মীর মহম্মদের দক্ষতা, সংগঠনের প্রজ্ঞা, কাজের দূরদর্শিতার প্রতি সুলতানের ধারণা আরও গভীর হল, তিনি যখন রাজধানী থেকে মছলিপত্তনমের (বন্দরইমুবারক) দিকে যাত্রার সমস্ত ব্যবস্থা তাঁকে করতে বললেন(২৯ অক্টোবর থেকে ২৭ ডিসেম্বর ১৬৩৯)।

উপকূলের দিকে যাত্রা করবেন এই সদিচ্ছায় সুলতান, জনাব আসফদৌরান মীর মহম্মদকে নির্দেশ দিলেন যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় যত কিছু কারখানা থেকে সংগ্রহ করার এবং রাস্তায় এবং ছাউনিতে অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র জোগাড় করা এবং যাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ঝামেলা মেটানোর জন্য। এই যাত্রার জন্য রাস্তা তৈরি করা, জঙ্গল কাটা, যাত্রাপথের মধ্যবর্তী চৌদ্দটি স্থানে শিবির ফেলার কাজ করতে হবে। মহল আর বাউতাতের(বাড়ির) সুবিধের জন্য, তিনি সমগ্র বিষয়টি মানসিকভাবে ছকে নিয়ে তিনি খুব ছোট বড় সব ধরণের ঝমেলা ছকে মিটিয়ে ফেললেন। সুলতান সরইখাহিলকে নির্দেশ দিলেন, তিনি যেন রাজপথের মহালদের নির্দেশ দেন, তাঁর যাত্রা কালে রাজধানী থেকে মছলিপত্তনম পর্যন্ত রাস্তায় যেন পর্যাপ্ত খাবার এবং বিচালি যোগাড় ও সঞ্চয় করা থাকে। সোনার সিংহাসনে চড়ে তিনি তাঁর মা, মহিলারা, পেশোয়া, উজির, পরামর্শদাতারা এবং অভিজাতরা, ইরাণ এবং ভারতের নানান এলাকার বিদেশি রাজদূত(হাজিব), বিভিন্ন সেনা – পদাতিক, গোলান্দাজ, ঘোড়সওয়ার, হাতিসওয়ারদের নিয়ে উপকূলের উদ্দেশ্যে যাবেন। মীর মহম্মদকে একটা ফর্মান দিয়ে রাজধানী ত্যাগ করে যাওয়া ইরাণের রাজদূত ইমাম কুলি বেগকে ফিরিয়ে আনতে পাঠানো হল। এই বিপুলাকায়, যাত্রার দুটি লুকোনো উদ্দেশ্য ছিল, প্রথমত বাগী জমিদারদের সুলতানের ক্ষমতা সম্বন্ধে সচেতন করানো, দ্বিতীয়ত বিদেশি ব্যবসায়ীদের একটু সমঝে দেওয়া।

সম্রাটের চাহিদা মত মীর মহম্মদের সমস্ত পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ইরাণি এক জোতির্বিদ জানালেন ১২ রজম মঙ্গলবার, ২৯ অক্টোবর ১৬৩৯ দিনটি শুভ। এই ঘটনার সময় হায়াতাবাদএ(হায়াতনগর, ১-৯ নভেম্বর) উপস্থিত থাকা ঐতিহাসিক নিজামুদ্দিন আহমদ শিরাজি, মীর মহম্মদের সংগঠনের দক্ষতা সম্পর্কে খুব উচ্চ ধারণা পোষণ করেছেন। তাঁর বর্ণনায় সেনা ও অসামরিক মানুষ নিয়ে কাফেলায় থাকা ৫০০০ মানুষ তাঁদের চাহিদামত খাদ্য, পণ্য এবং প্রয়োজনীয় সেবা পেয়েছেন – এবং এ সবই হয়েছে আসফজাইর সাংগঠনিক প্রতিভায়। মুনাগালা কসবার হাবিলদার (১৫ নভেম্বর) সৈয়দ মীর রুস্তম এই বিপুল বাহিনীর খোরাক পৌছে দিয়েছেন নবাব আল্লামি, মীর মহম্মদ আর হাকিমুল মুল্ককে। পরের দিন নবাব সেখান থেকে পাহাড়ি দুর্গ অনন্তগিরিতে পৌঁছে, চূড়ায় ওঠেন মীর মহম্মদ, হাকিমুল মুল্ক এবং অন্যান্যদের নিয়ে।

মুস্তাফানগর(কোণ্ডাপল্লি, ১৯ নভেম্বর) মীরের নিজের প্রশাসনিক তালুক। সেখানে তিনি নানান সেবা আরও সুখকরভাবে সামলেছেন। পরের দিন পাহাড়ের ওপরের প্রাসাদে মীর দেখতে গেলেন, দুর্গের প্রাসাদটি সত্যিই সুলতানের পক্ষে বাসযোগ্য আছে কি না। এবং নবাব আল্লামি আর হাকিমউলমুল্ককে নির্দেশ দিলেন সুলতান সত্যিই পাহাড় থেকে নিরাপদভাবে নামতে পারবেন কি না তা দেখার। তিনি সুলতানের জন্য জাঁকজমকপূর্ণ আমন্ত্রণী জলসার ব্যবস্থা করলেন। ২১ তারিখ পাহাড় থেকে মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে নেমে সুলতান দুর্গটি তাঁর অন্তরঙ্গ সভাসদ আর অমাত্যদের(মাকারবানইআজম) নিয়ে পাক দিয়ে দেখতে শুরু করলেন। নিরাপত্তার জন্য সুলতান নির্দেশ দিলেন হাজারো বন্দুকচি, নাইকার এবং কোতোয়ালকে তৈরি রাখতে হবে; পাহাড় প্রমান খাদ্য তৈরি করতে হবে; তোপখানা নতুন করে গড়তে হবে; রাতের সময় খাসাইখাইলের ফৌজ, ক্রীতদাস এবং নাইকরেরা বন্দুকবাজদের সঙ্গে শ্বাপদ সঙ্কুল জঙ্গলের আশেপাশে জেগে থাকবে, যাতে কোন রকম উতপাত না হয়। সুলতানের সঙ্গে আসা আমীরেরাও রাত পাহারা দেবে। এমতাবস্থায় মীর মহম্মদ সৈয়দকে সারা দিন রাত তৎপর থেকে সুলতানের চাহিদার দিকে নজর রাখতে হয়েছে।

বেজোয়াদায়(২২ নভেম্বর) তিনটি ইওরোপিয় কম্পানি – ব্রিটিশ, ডাচ এবং ডেনের কুঠিয়ালেরা তাঁদের অনুচর নিয়ে মছলিপত্তনম থেকে উপস্থিত হলেন। তারা সুলতানের অনুমতিতে ব্যবসা করছেন। তারা সুলতানের সঙ্গে কথা বললেন।

ওয়েয়ুরে(২৪ নভেম্বর) পৌঁছে সুলতান মীর মহম্মদকে নির্দেশ দিলেন, ফারাকসানার ওহুদাদার চতুর খাঁকে এবং অন্যান্যদের সঙ্গে নিয়ে বন্দর শহর ইনগণ্ডুর(এনগোডুর)এ শিবির ফেলতে হবে। যেহেতু বন্দরটি মীরের প্রশাসনের অধিকারে ছিল, সেহেতু তিনি পোর্টের দরজা থেকে ব্যাঙ্কসাল পর্যন্ত রাস্তার সমস্ত ব্যবস্থাপনা এবং নীতি নির্ধারণ করলেন(কেন? যাতে মিছিলটা ভাল হয়?)। বন্দরে বণিকদের বাড়িঘরগুলি কাপড় এবং অন্যান্য নানান দ্রব্য দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। মীরকে পাশে নিয়ে হাতিতে চড়ে সুলতান ব্যাঙ্কশালের দিকে এগোতে থাকলে, মীর, সুলতানের সমস্ত প্রশ্ন মর্যাদা সহকারে উত্তর দিতে থাকলেন। ব্যাঙ্কশাল বাড়িতে বিশেষ একটি মজলিস(ব্যক্তিগত বন্ধুদের নিয়ে সভা) শেষ করে সুলতান বন্দরটি ঘুরে দেখলেন, সমুদ্রে ধোবিঘাটের দিকে এগোতে শুরু করলেন।

২৭ তারিখ সুলতান আবার বন্দরের দিকে গেলেন এবং পরের দিন ইওরোপিয় কুঠিগুলি ঘুরে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। ইচ্ছে হয়ত সেখানের বণিকেরা তাঁর সঙ্গে থাকা মহিলাদের কাপড় এবং সারাদেশ থেকে জোগাড় করা নানান পণ্য দেখাক। কুঠিওয়ালাদের সুলতান বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধে দিলেন। ২৯ তারিখ সুলতান মহিলা, বিদেশি ব্যবসায়ীদের বাড়িঘরদোর দেখতে গেলেন। তিনি সেখানে আন্তরিকভাবে কাজ করা আমলাদের অনেক প্রশ্রয় এবং সুযোগ দিলেন এবং সরইসিমতকেও বেশ কিছু সুবিধে দেওয়ার কথা বললেন। ৩ ডিসেম্বর ধোবিঘাটে মীর মহম্মদ সম্রাট আর তাঁর সঙ্গীদের আমোদ দিলেন সমুদ্রে মাছ ধরা দেখিয়ে। দেখা গেল একজোট হওয়া ধীবরেরা তাঁদের জালে প্রচুর ছোট বড় মাছ ধরেছেন।

পরের দিন পেশকাশের সময় মীর মহম্মদ সৈয়দ সুলতানকে বন্দরের এবং এখানকার আধিবাসীদের অবস্থা অবগত করান। তিনি সেখানে থাকা বিভিন্ন দেশের ব্যবসায়িকে নানান সুযোগ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন – ১) বন্দরের গেটে প্রত্যেক পণ্যের জন্য জাকাত দেওয়া থেকে, দেশি বিদেশি সব ধরণের ব্যবসায়ীদের মুক্তি দিলেন, ২) এছাড়া গয়নাগাটির জন্য ব্যবসায়ীদের থেকে যে বিপুল পরিমানে রাজস্ব নেওয়া হয়, তাতেও তিনি ছাড় দিলেন। সুলতানের জাকাত সংক্রান্ত নির্দেশ (ফর্মান) একটা শিলালিপিতে লিখে বন্দরের জামা মসজিদে টাঙ্গিয়ে দেওয়া হল, যাতে আগামী দিনের হাকিম আর আমিলেরা এ ধরণের কর আদায় এবং তাঁর জন্য সর্বশক্তিমানের অভিশাপ পাওয়া থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখবে। এছাড়া যে সব ব্যবসায়ী পেগু থেকে রুবি আমদানি করে, তাদেরও ছাড় দেওয়া হল।সুলতানের এই সুবিধে দানের খবর দ্রুতগতিতে বালাবাদ আর জেরবাদে ছড়িয়ে গেল এবং এতে স্থানীয় ব্যবসায়ী আর রত্নকারেরা খুশি বোধ করলেন।

সাধারণ মানুষের অবস্থার উন্নতির জন্য বহু নতুন পুরোনো বাসিন্দা নির্বিশেষে অভাবি মানুষ, সৈয়দ, আলিম, ধর্মপ্রান ব্যক্তি, জীবিত কবিদের মাসোহারা এবং দান দেওয়ার, জমি অথবা আর্থিক ভর্তুকি দেওয়ার কথা বললেন। এছাড়াও সুলতান ওয়াজিফা থেকে শুরু করে সৈয়দদের, বিশেষ করে মীর মৈনুদ্দিন মহম্মদ শিরাজি এবং মীর মহম্মদ হুসেইনকে যে দান দেওয়া হচ্ছে, তা চালিয়ে যাবার প্রতিশ্রুতি দিলেন। শেষে মীর মহম্মদ সুলতানের প্রশস্তি গাইলেন এবং সুলতানের মহত্ত্বের জন্য তাকে ধন্যবাদ জানালেন। সুলতান পেশকাশ গ্রহণ করে স্থানীয় একটি লবন কারখানা ঘুরতে গেলেন।

বন্দর ছাড়ার দিন(৭ ডিসেম্বর), সুলতান মীর মহম্মদকে নিজের গলা থেকে চাদর খুলে এবং চার-কোব(এক ধরণের জামা) পরিয়ে সম্মান জানালেন। এই সম্মান জানানো হয় সেই ব্যক্তিকে যিনি সরইখাহিল দপ্তর থেকে বিদায় নিচ্ছেন। এছাড়াও তাকে একটা রত্ন খচিত খাপওয়ালা তরোয়াল, একটি রূপোর জালে মোড়া যুদ্ধ হাতি, একটি রূপোর জালে মোড়া, অন্যটিতে রত্নখচিত জিন, লাগাম আর জাল দিয়ে মোড়া দুটি ইরাকি ঘোড়া দিয়ে সম্মান জানালেন সুলতান। এছাড়াও রাজ্যকে সেবা করে যে সব ইওরোপিয় সাহায্য করেছেন, তাদেরও সুলতান সম্মান জানান|

গোলকুণ্ডা রাজ্যে মীর মহম্মদের প্রভাব[সম্পাদনা]

এইভাবে মীর জুমলা বিভিন্ন সম্ভ্রান্ত দপ্তরে কাজ করেছেন, ‘এবং প্রায় সব ক’টায়’, মানুচি বলছেন, ‘তাঁর নিজের ছাপ ছেড়ে গিয়েছেন।’ ক্রমশঃ তাঁর রাজনৈতিক প্রভাব বাড়তে থাকে। প্রথম জীবনে পাওয়া ‘নবাব’ উপাধি পাওয়া সূত্র একটা ব্রিটিশ কুঠির তথ্যে পাচ্ছি ২৮ মে, ১৬৩৮ সালে, তাঁর দশ দিন আগে তিনি সরইখাহিল পদে ছিলেন। নিজামুদ্দিন আহমেদ বলছেন, তাঁর প্রত্যেক পদক্ষেপে মীর মহম্মদ, সুলতানের মঙ্গল চাইতেন, এবং ফলে তাঁর প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন। মুঘল ঐতিহাসিকেরা সক্কলে প্রায় মীরের ক্ষমতার দক্ষতা এবং প্রভাবিত করার যোগ্যতা নিয়ে বিন্দুমাত্র সংশয় প্রকাশ করেন নি। ওয়ারিস বলছেন, মীর জুমলা আটক ও ফাটকের(মানে খোলা ও বন্ধ) যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন, অর্থাৎ তিনি কুতুব শাহের সমস্ত বিষয় নিয়ন্ত্রণ করতেন। আকিল শাহ বলছেন, ‘গোলকুণ্ডা রাজ্যের সর্বেসর্বা’ ছিলেন মীর জুমলা। কোন কিছুই তাঁর অনুমতি ছাড়া করা যেত না। তিনি সুলতান আর ইওরোপিয় কুঠিয়ালদের মধ্যে সংযোগসূত্র ছিলেন। তাভার্নিয়ে গোলকুণ্ডার সুলতান আবদুল্লা কুতুবশাহকে কিছু মুক্তো আর গয়না বিক্রি করতে চাইলে তাকে মছলিপত্তনম থেকে মীর জুমলার সঙ্গে দেখা করতে গোলকুণ্ডায় যেতে হয়েছিল। কেননা, ‘কোন ব্যতিক্রমী বা দামি কিছু কিনতে চাইলে, সুলতান মীর জুমলার সম্মতি ব্যতীত কোন পদক্ষেপই নিতেন না’(জুলাই ১৬৫২)। গোলকুণ্ডার আভ্যন্তরীণ প্রশাসনে তাঁর অবিসংবাদী প্রভাব এবং তাঁর বিপুল ব্যবসার জাল দেখে বিদেশিদের মনে হত রাজ্যে তাঁর ক্ষমতাই চূড়ান্ত। ঠিক এই জন্য মছলিপত্তনমে এক ব্রিটিশ কুঠিয়াল তাঁর পারস্যের এক কুঠিয়াল সতীর্থকে লিখেছিলেন, ‘সম্রাটের বকলমে সরইখাহিল সারা রাজ্য শাসন করে’। গোলকুণ্ডায় আসা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দূত এন্ড্রু কোগু(১৬৩৯) জানাচ্ছেন, ‘(এটা)সত্যি যে সরইখাহিলই সারা রাজ্য শাসন করেন’। শেখ মহম্মদ ইবনইখাতুন মীর জুমলা পদ ছাড়ার পর মীর মহম্মদ মীর জুমলা পদে আসীন হন। কিন্তু কোন তারিখে সেটা জানা যাচ্ছে না। ফলে মীর মহম্মদের মীর জুমলায় রূপান্তরের তারিখটি আমাদের অজানা থেকে যাবে। অধ্যাপক শেরওয়ানির ধারণা বিজয়নগরের অন্যতম প্রধান দূর্গ, উদয়গিরি জয় করার খবর ১৮ জুন, ১৬৪৩ সালে যখন সুলতানের কাছে আসে, তখনই তিনি তাঁকে মীর জুমলা পদবী দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্যই এটি একটি উপযুক্ত সময় নতুন পদে আসীন হওয়ার। ১৬৪৩০-৪৪ সালে সোয়ালি কুঠি ওয়ালাদের তাঁর সম্বন্ধে মন্তব্য, 'ক্ষমতায় থাকা সরইখাহিল বা উজির, সরকারকে চালায় এবং দেশটা নিয়ন্ত্রণ করে', এ তথ্যটা কিন্তু মাথায় রাখা দরকার। তবে প্রশাসনে তিনি কুশলী ছিলেন, সরকারে ছিলেন প্রভাবশালী। কিন্তু মীর জুমলা যুদ্ধেও যে খুব দক্ষ ছিলেন, তা প্রমান হয় তাঁর পূর্ব কর্ণাটক দখল করায়, যেখানে তিনি ১৬৪২ সালে সুলতানেরও বিরোধিতা করেছিলেন। সেই ঘটনাটা পরবর্তী অধ্যায়ে বিস্তৃতাকারে বলব। তাঁর সম্মান এতই ছিল যে সুলতান তাঁর দুই মন্ত্রী সুজাউলমুল্ক এবং উলচি বেগকে তাঁর সঙ্গী হতে নির্দেশ দেন।

কর্ণাটক এবং কর্ণাটকে মুসলমান উপস্থিতির ইতিহাস[সম্পাদনা]

কর্ণাটকে মীর জুমলা প্রথম পর্ব

কর্ণাটক এবং কর্ণাটকে মুসলমান উপস্থিতির ইতিহাস কর্ণাটক বা কর্ণাট শব্দটা প্রাথমিকভাবে ব্যবহার হয়েছিল সাধারণভাবে তেলুগু আর কানাড়ি জনগণ, তাঁদের ভাষা ইত্যাদি বোঝাতে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই শব্দের ব্যবহার সংকুচিত হয়ে শুধু বোঝাতে থাকে কানাড়ি জনগণ আর ভাষাকে। ‘কর্ণাটক দেশ’ বলতে আক্ষরিকভাবে শুধু বোঝায় উত্তরভূমি বা বালাঘাট। মুসলমান শক্তি দক্ষিণভারতে প্রথমে পৌঁছায় ঘাট, মহীশূর, তেলেঙ্গানার অংশ যার নাম কর্ণাটা অঞ্চলে। কিন্তু যখন বিজয়নগর রাজ্য, পূর্বের তামিল আর তেলুগু এলাকার দিকে সরে যেতে বাধ্য হল, সে সময় কর্ণাট শব্দটা পূর্বের সমতল দেশ বা পণঘাট নামে চিহ্নিত হল। পূর্বতন বিজয়নগর রাজ্য, দাক্ষিণাত্যের সুলতানি সাম্রাজ্যের দুই অংশে বিভক্ত হল, উত্তরে তুঙ্গভদ্রাকে সীমারেখা করে বালাঘাট আর পণঘাট নিয়ে বীজাপুরি কর্ণাটক আর হায়দ্রাবাদী কর্ণাটকরূপে। ব্রিটিশেরা কর্ণাট শব্দটা ব্যবহার করল ঘাটের নিচের অংশটা, যার মধ্যে রয়েছে মাদ্রাজ, তামিলনাড়ুর নেল্লোর, এবং কর্ণাটকের নবাবের প্রশাসনিক এলাকাগুলি। ফলে মহীশূর দেশ যদিও আদতে সত্যিকারের কর্ণাটক, যাকে আজ আর কর্ণাটক বলা হয় না, বরং আধুনিক ভূগোলে যে কর্ণাটক দেখানো হয় সেটা হল মাদ্রাজের নিচু জমি বা করমণ্ডল উপকূল, যা ইতিহাস দ্বারা বিন্দুমাত্র সিদ্ধ নয়।

কানাড়ি দেশ অতীত থেকেই তাঁর উর্বর জমি, ধাতু, হাতি এবং ধনসম্পদের জন্য প্রখ্যাত ছিল। কিন্তু মাদ্রাজের সমুদ্র উপকূল আর পূর্ব ঘাটের মধ্যে যে পূর্ব কর্ণাটক বা পণঘাট, সেটি পশ্চিম কর্ণাটিক বা বিজাপুরী কর্ণাটকের থেকে হাজার গুণে জনবলী, সম্পদশালী এবং উর্বর। এর হিরের খণি, উর্বর জমি, পুরোনো হিন্দু সাম্রাজ্যের লুকোনো সম্পদের আকর্ষণে আওরঙ্গজেব কর্ণাটক দখল করতে উৎসাহিত হয়েছিলেন। শাহজাহানকে লেখা একটি চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘এটি গোলকুণ্ডার মত বড় এবং ধনশালী রাজ্য’। দাক্ষিণাত্যের দুটি বিভাগ মুলুন্দ আর কর্ণাটক ছিল ধনী এবং উর্বর দেশ। মহামেডাননামার লেখক, ঝাউরইবনঝাউরি লিখছেন, এর জলবায়ূ মনোরম, আর বাতাস সুখকর। বর্ষা যথেষ্ট হয়। সপ্তদশ শতে চাষে সে সিরিয়া আর মিশরের থেকেও এগিয়েছিল। তার ‘শস্যাগার যেন আকাশকে চুম্বন করত’। ছোট ছোট কসবাগুলি জনবসতিতে পূর্ণ এবং সাধারণ জনগণ সমৃদ্ধশালী। প্রত্যেকটি পরিবার যেন ইরাণের ফরিদুন এলাকার মত সমৃদ্ধশালী। এমন কোন দিন যায় নি, যে দিন কোন চাষী তাঁর জমির উদ্বৃত্ত, ভিক্ষা দিত না। সোনালী আকাশ ছোঁয়া গাছগুলি গোলাপজাম, ডালিম, এবং আঙ্গুরের মত সুস্বাদু ফলদায়ী – এতই মিষ্ট আম খুব দুর্লভ। এই দেশ তার অধিবাসী তাঁর ভ্রমনকারীকে প্রকৃতি সম্পদ ঢেলে সাজিয়ে দিয়েছে, ফুলে, পাখির ডাকে সাজানো বাগানে। থেভনট আরও বলছেন, এই অঞ্চলে নানান ধরণের সস্তার কিন্তু গুণমানে সমৃদ্ধ পণ্য, ছাগল, ভেড়া, মোরগ সহজেই পাওয়া যায়। উপকূলের বিকশিত গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য শহরগুলির মধ্যে নেগাপত্তনম, ত্রিবাঙ্কুর, মায়াল্পুর এবং সান থোম প্রখ্যাত।

এই ধরণের সম্পদশলী দেশ তার প্রতিবেশী বিজাপুর বা গোলকুণ্ডা বা পরের দিকে মুঘল সাম্রাজ্যের ঈর্ষা উদ্রেক করবেই। সে ক্রমশ ভিতর থেকে ক্ষয়ে গিয়ে, নিজেকে বৈদেশিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারল না। ১৬৩৬ সালের মে-জুন মাসের শাহজাহান, আদিল শাহ আর কুতুব শাহের মধ্যে যে চুক্তি হয়, তাতে দুটি দক্ষিণী রাজ্য সেই সুযোগে কৃষ্ণা আর তুঙ্গভদ্রার তীর ছাড়িয়ে মহীশূর এবং মাদ্রাজ-কর্ণাটকের হাজারো পরস্পরের সঙ্গে যুদ্ধ করা ছোট ছোট রাজ্যগুলি এবং কাবেরী ছাড়িয়ে কৃষ্ণা নদী থেকে তাঞ্জোর পর্যন্ত হতোদ্যম বিজয়নগর সাম্রাজ্য দিকে হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করল। বিজাপুরের আদিল শাহ দারুলহাব কর্ণাটক গড়ে তুলতে মুলুন্দ অর্থাৎ বেন্দুর, আর মহীশূরের এবং তাঁর পরে কানাড়ি দেশ অর্থাৎ পূর্ব কর্ণাটকের মাদ্রাজের সমতল থেকে ভেল্লোর, জিঞ্জি এবং তাঞ্জোরের কাছের ভালিকাণ্ডাপুরম পর্যন্ত এলাকা দখল করে। অন্যদিকে গোলকুণ্ডার কুতুব শাহ, দক্ষিণ আর দক্ষিণপূর্বের হিন্দু রাজ্যগুলি অর্থাৎ বিজাপুরী দখলিকৃত এলাকার কৃষ্ণার উত্তরপূর্বের অঞ্চল অধিগ্রহণ করে। জোড়া ফলার মত আক্রমণে বিধ্বস্ত হয়ে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের শেষ বাতিটি পূর্বে নেল্লোর থেকে পুদিচ্চেরি পর্যন্ত এলাকা আর পশ্চিমে মহীশূর সীমান্তে একটুরো একলা নিয়ে চন্দ্রগিরি রাজ্য টিকে রইল। নিজেদের রাজ্যে সিংহাসন নিয়ে কামড়াকামড়ি, হতবিধ্বস্ত রাজ্যের ক্ষমতার সুযোগ নিয়ে মাদুরা, জিঞ্জি এবং তাঞ্জোরের নায়কেরা নিজেদের স্বাধীন ঘোষণা করলেন এবং বহুদিনের শত্রুর মত তামিল আর কর্ণাটকিরা এমন লড়াই শুরু করল যে বহিঃশত্রুর আক্রমনে চন্দ্রগিরি এক মন এক প্রাণ হয়ে দাঁড়াতেই পারল না। রায়াল প্রত্যাঘাত করলেও, হতাশ হয়ে দেখলেন, একের পর এক এলাকা তাঁর কবল থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই সব কটি ঐতিহাসিক বিষয়, বিশেষ করে রয়াল আর নায়েকদের মধ্যে সম্পর্ক এমন জটিলভাবে পেকে আর বিষিয়ে উঠল, যে আক্রমণকারীদের কাছে দাক্ষিণাত্য দখল করা শুধু সময়ের অপেক্ষা হয়ে উঠল।

দ্বিতীয় অধ্যায় কর্ণাটকে মীর জুমলা[সম্পাদনা]

প্রথম পর্ব ক। বীজাপুর মহীশুরের উপত্যকায় বেশ কিছু হিন্দু রাজ্য যেমন ইক্কেরি, সেরা, ব্যাঙ্গালোর আর কুর্নুলকে ১৬২২-২৩ এবং তাঁর পরে ১৬৩৬-৪৮ সালে নিজের অধীনে নিয়ে আসে বীজাপুরের সুলতান। মাত্র সাত বছরে ১৬৩৭ থেকে ১৬৪৪এর মধ্যে তাঁর সেনাপতি (সরইলস্কর বা সিপাহসালার), রণদৌলা খাঁ(রুস্তমইজামান), আফজল খাঁ, মুস্তাফা খাঁ এবং খান মহম্মদ একে একে বেন্দুর আর মহীশূরের একাংশ এলাকা দখল করেন। ১৬৩৭-৪১ সালের প্রথম সেনাপতি রণদৌলা(রুস্তম) মালান্দ আর কর্ণাটক দখল করতে সক্ষম হয় সেনা পরাক্রমে আর কূটনীতিক চাতুর্যে। ত্রিকের আর বাসবপত্তনের রাজা কেং নায়ক (কেঙ্গে হানুয়া)র বেন্দুর দখল করে কানাড়ায় সেনা অভিযান শুরু হয়। রয়াল বিরুদ্ধে নায়েকদের বিদ্রোহের সুযোগ নিয়ে তিনি রয়ালের সঙ্গে একটা চুক্তি করেন, তিনি তাঁর বিজিত এলাকার সম্পদ বিজাপুরে নেবেন এবং শুধু খালি দুর্গটা দখল করে রাখবেন তৃতীয় ভেঙ্কট। প্রাথমিকভাবে রুস্তমের প্রস্তাবে ভেঙ্কট রাজি হলেও পরে তিনি বাস্তব অবস্থা বুঝে পিছিয়ে যান। রুস্তম তখন ভেঙ্কটের বিদ্রোহী ভাইপো শ্রী রঙ্গর সঙ্গে সন্ধি করলেন। রাজ্যের ভেতর থেকে সাহায্যের সূত্র পেয়ে রুস্তম, কেং নায়কের সাহায্যে ইক্কেরির রাজা বীরভদ্রের রাজত্ব অধিকার করলেন(নাগর তারিখ ৩০ ডিসেম্বর ১৬৩৭)। তারপর তুঙ্গভদ্রা নদী পেরিয়ে তিনি বর্তমান অনন্তপুর জেলার গাণ্ডিকোটার প্রামাসানি প্রধানের এলাকা তাদপার্তি অভিযানের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু পরিকল্পনা পালটে তিনি তাঁর সহকারী সেনাপতি আফজল খাঁকে নিয়ে, কেঙ্গে হানুয়ার পরামর্শে এবং শ্রী রঙ্গার বিদ্রোহের সুযোগে কেম্প গোণ্ডা(কেম্পে গৌড়া)র অধিকারে থাকা ব্যাঙ্গালোরের দিকে যাত্রা শুরু করেন(১৬৩৮)। সেরা(কস্তুরি রঙ্গার নিয়ন্ত্রণে টুঙ্কুর) দখল করে এটিকে সাহজী ভোঁসলেকে দিয়ে রুস্তম কান্তিরাভা নারাসা(রাজা কান্তি রাই)র দুর্গ দখল করে ৫ লাখ হুন ক্ষতিপূরণ নিয়ে বিজাপুর ফিরে এলেন (১৬৩৮-৩৯)। ফলে এর পর থেকে বিজাপুর মহিশূরের বিশাল অংশ দখল করল। বিজাপুরের বিরুদ্ধে রাজা নায়কের বিদ্রোহ আর কানাড়ি এলাকায় হিন্দু রাজাদের উত্থানে আবার রুস্তম ফিরে আসতে বাধ্য হলেন। ডিসেম্বর ১৬৩৮ সালে তিনি ইক্কেরির রাজার সাহায্যে তারিকারে-বাসবপত্তন দখল করেন। নায়কদের সেনা বাহিনীর সাহায্যে ভেঙ্কট লড়াই করলেন জুলাই ১৬৩৯ পর্যন্ত। কিন্তু নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাঙ্গালোর দখল করতে পারলেন না। টুঙ্কুরের রাজা চিক-নায়কন-হাল্লির বিদ্রোহের খবরে রুস্তম সেটি দমন করতে আফজল খাঁকে পাঠালেন। তিনি বেল্লুর (তৃতীয় ভেঙ্কটের দখলে থাকা), টুঙ্কুর, বালাপুর আর কুনিগালও দখল করলেন। ১৬৪১এর মে-আগস্টে শ্রী রঙ্গার সঙ্গে হাত মিলিয়ে রুস্তম তৃতীয় ভেঙ্কটের বিরুদ্ধে ভেলোরে লড়াই করলেও মাদুরা, জিঞ্জি আর তাঞ্জোরের যুক্ত সেনাদলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে না পেরে ফিরে এলেন। চন্দ্রগিরির শ্রী রঙ্গা(তৃতীয় রঙ্গা) বিজাপুরের সঙ্গে চুক্তি করলেন (মার্চ ১৬৪৪) তাঁদের বিজয়ে তিনি সাথী হবেন, সেই দুর্গের লুঠ করা সমস্ত ধনসম্পত্তি বিজাপুর নিয়ে যাক কিন্তু শর্ত হল দুর্গটির অধিকার রয়্যালকে দিতে হবে। তাকে পাদশাহী চাদর দিয়ে সম্মান জানানো হয়। কিন্তু খুব শীঘ্রই রয়্যাল এই চুক্তি থেকে বেরিয়ে এসে বিজাপুরের বিরুদ্ধে হিন্দু জোট গড়ে তুলতে চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কোন কিছুই রুস্তমকে দমাতে পারা গেল না, তিনি একের পর এক দুর্গ, এলাকা দখল করতে শুরু করলেন। পরে রয়্যালকে মাফ করার শর্তে রয়্যাল ৫০ লক্ষ হুন ক্ষতিপূরণ/পেশকাশরূপে হিসেবে দিতে বাধ্য হল। রুস্তমের পরের দখলি এলাকা হল বালাপুর আর কুলিহাল(কুনিগাল?, রয়্যালকে দেওয়া)। ১৬৪৪এ ইক্কেরির দুর্গ দখল হলের বেন্দুরের শিভাপ্পা নায়েকের কাছে হারলেও পরে তা খান মহমুদের চেষ্টায় দখলে আসে। তিনি সেই লড়াইতে পেন্নার থেকে কৃষ্ণা-তুঙ্গভদ্রার মধ্যে নান্দিয়াল, শ্রীভেল্লা এবং কানিগিরি(১৬৪৫)র মত প্রচুর দুর্গ দখল করলেন। ১৬৪৫এর মধ্যে বিজাপুর পশ্চিম, কর্ণাটকের বিপুল এলাকা দখলে আনতে পারল।

খ) গোলকুণ্ডা ১৬৪৫এর আগেই বিজাপুর যত তাড়াতাড়ি পশ্চিম কর্ণাটক দখল করতে পেরেছিল, ঠিক সেই দ্রুততায় গোলকুণ্ডা পূর্ব কর্ণাটকের উচ্চ এলাকা(বালাঘাট) দখল করতে পারে নি। ১৬৪২ সাল পর্যন্ত কুডাপ্পার জেলার উত্তর-পূর্ব দিকের শুধু কাম্বমই দখল করতে পেরেছিল গোলকুণ্ডা। দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যেতে বেশ সময় লেগেছিল।

কর্ণাটক দখলের লড়াইতে পেছনে পড়ে থাকতে ইচ্ছুক ছিলেন না সুলতান আবদুল্লা কুতুব শা, তিনি এই কাজে তার সরইকাহিল মীর মহম্মদকে অবস্থা বদলাবার দায়িত্ব দিলেন। মীর মহম্মদ বললেন তিনি সম্পূর্ণ অবস্থার পরিবর্তন করে দেখিয়ে দেবেন। ওয়ারিস জানাচ্ছেন, ‘কুতুবউলমুল্কের একজন নায়েকও এক একর জমি দখল করতে না পারলেও মীর জুমলা বিশাল বিশাল দুর্গ দখল করতে সক্ষম হয়েছিলেন’।

২। মীর জুমলার প্রথম যুদ্ধযাত্রা বিজয়নগরের অবস্থা এওই দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে সুলতানের স্বপ্ন শুধু সাকার হওয়া সময়ের অপেক্ষা ছিল মাত্র। এর রাজা ভেঙ্কটপতি বা তৃতীয় ভেঙ্কট(১৬৩০-৪২) তার প্রথম পাঁচ বছরের রাজত্ব কালে তার রাজ্যের মধ্যেই বিদ্রোহের আঁচ পাচ্ছিলেন। জিঞ্জির নায়কের সঙ্গে তাঁর চুক্তির প্রভাবে অসস্তুষ্ট হয়ে তাঞ্জোর আর মাদুরার নায়েক ১৬৩৭ সালে তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেলেন। এর আগে উপর্যুপরি বীজাপুরী আক্রমনে রয়্যালদের সম্পদ আর আত্মরক্ষার দক্ষতা ভেতর থেকে ক্ষয়ে গিয়েছিল। এর পর মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিল নিজের পরিবারের মধ্যে দ্বন্দ্ব। তাঁর ভাইপো শ্রী রঙ্গ কাকার সঙ্গ ছেড়ে বীজাপুরের পক্ষে যোগ দেয়। ফলে তৃতীয় ভেঙ্কট মাদ্রাজপত্তম আর পুনামাল্লির (৪০০০০ সেনা বাহিনীর) প্রধান ভেলুগতি তিম্মা, দামরালা ভেঙ্কটার সাহায্য সত্ত্বেও খুব বেশি লড়াই দিতে পারেন নি।

১৫০২/১৬৪২এর এপ্রিলে ৪০০০০ পদাতিক, ৪০০০ ঘোড়সওয়ার আর গোলান্দাজ, আলি রাজা খাঁ(কোন্ডাভিডুর সরইলস্কর, রাজাকীয় বাহিনীর প্রধান), গাজি আলি বেগ(মারাঠা অশ্বারোহী বাহিনীর প্রধান), আলম খাঁ পাঠান, আইনুল মুল্ক, সুজাউলমুল্ক, দাদাজী কান্তিয়া এবং আসির রাও, ভেঙ্কটা রেড্ডি এবং অন্যান্য নাইকোয়ারের মত বেশ কিছু হিন্দু এবং মুসলমান সেনাপতি নিয়ে এগিয়ে চললেন। বাজার দরে খাবার কেনা হল, খবর চালাচালির জন্য রাজসভার সঙ্গে বিভিন্ন একালায়(ডাকচৌকি)পায়রার ডাকের ব্যবস্থা করা হল।

উপকূলের সেনা শিবির কোণ্ডাইভু থেকে থেকে সৈন্য নিয়ে মীর মহম্মদ নেল্লোরের সমতলে কোন বড় প্রতিরোধ ছাড়াই পৌঁছলেন এবং স্থানীয় দুর্গের সেনাদের আক্রমণ রুখে আটটা বড় দুর্গ দখল করতে সক্ষম হলেন। এর পরে আরও দক্ষিণের দিকে আসবেন মনস্থ করলেন। কিন্তু তাঁর জন্য চাই রাজধানী থেকে দক্ষ সুড়ঙ্গ খোঁড়ার কর্মী। বিশেষ করে যদি সেই অঞ্চলের সুরক্ষিততম দুর্গ ডুম্বুরু(বা দান্দারুলু) দখল করতে হয়। ২০-১-১০৫২/১১ এপ্রিল ১৬৪২ সালে দুর্গের ট্রেঞ্চ খোঁড়া শুরু হল। তারপরে তিনি আরমাগাঁও আর পুলিকটের মধ্যের শ্রীহরিকোটা দ্বীপ এবং ২১ এপ্রিল ১৬৪২ সালে আরও কিছু দুর্গ দখল করলেন রয়্যাল, টিম্মা আর দামারলা ভেঙ্কটের যৌথ বাহিনীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে। ভেঙ্গে পড়ে রয়্যাল চিত্তোরের পাহাড়ে আশ্রয় নিলেন এবং ছ মাসের মধ্যে, ১০ অক্টোবর ১৬৪২ সালে মারা গেলেন। তাঁর উত্তরাধিকারী হিওসেবে শ্রী রঙ্গ সিংহাসনে আরোহন করলেন তৃতীয় শ্রী রঙ্গ রূপে ২৯ অক্টোবর ১৬৪২-১৬৮১।

শ্রীহরিকোটা দখল আসলে মীর জুমলার রণনীতর চাতুর্য প্রমান করে। শ্রীহরিকোটা উত্তরে আরমাগাঁও এবং দক্ষিণে পুলিকটের মধ্যে গোঁজ হয়ে রইল। ফলে খুব তাড়াতাড়ি তিনি আরমাগাঁওএর আশেপাশের এলাকা দখল করতে পারলেন। যদিও একটা বড় অংশ তখনও শ্রীরঙ্গ’র আয়ত্তে ছিল – তিনি বিপুল পরিমান সৈন্যদল ভেঙ্কটগিরি আর আরমাগাঁওতে তেরি রেখেছিলেন। ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের নথির মন্তব্য সূত্রে পাচ্ছি, আরমাগাঁও এলাকার নায়েকদের ‘দেশ থেকে তাড়া খেয়ে বেড়াতে হচ্ছে, একদিকে রয়্যাল অন্য দিকে সুলতানি সেনার চাপে তারা ব্যতিব্যস্ত। মুসলমানেরা চাওলা গেলডানকেতে মূল শিবির তৈরি করেছে’। তাঁদের বিশ্বাস হচ্ছিল যে খুব কম সময়ের মধ্যে এলাকাটি মুসলমান শাসনের আওতায় চলে আসবে। তারা রঙ্গ করে লিখল, ‘একদিকে গোলকুণ্ডার রাজা, অন্যদিকে বিজাপুরের রাজার শাঁড়াশি আক্রমন, অথচ দেশিয়রা(জেন্টুজ) নিজেদের মধ্যে বিভেদের খেলায় মত্ত। ফলে তারা আর তাঁদের দেশের শাসন ধরে রাখতে পারবে না।’

নেল্লোরকে মূল ঘাঁটি করে বর্ষার পরপরই গোলকুণ্ডার সেনা বাহিনী ঝটিতি আক্রমণ করে নাকবাত, রাপুর (১৯.১০.১০৫২/৩১ ডিসেম্বর ১৬৪২) কাল্লুর(২৪.১০.১০৫২/৪.১.১৬৪৩) দুর্গ দখল করে ফেলল। প্রথম দুর্গটির সেনাবাহিনী আক্রমনকারীদের কথা শুনে পালিয়ে গেল। আর দ্বিতীয় দুর্গের লড়াইতে গোলকুণ্ডা ১০-১২ হাজার ঘোড়সয়ারওয়ালা আদিবাদী সাংগ্রেজরাজকে বিশাল জঙ্গলের মাঝে ফেলে হারাল। জঙ্গল পরিষ্কার করে আক্রমণকারীরা সেখানে মীর মহম্মদের নেতৃত্বে দুটো ছোট দূর্গ তৈরি করল। মুসলমান সেনা নেতার অধীনে ছিলেন যেমন দুজন মুসলমান নেতা খাইরাত খাঁ এবং সৈয়দ মহম্মদ মাজানদারানি ছিলেন, তেমনি ছিলেন দুজন রেড্ডি ভাই ভেঙ্কট আর তিম্মা আর রাওয়াজী কান্তিয়া। কুল্লুরের দুর্গ দখলের যুদ্ধ প্রায় একমাস স্থায়ী হয়(২৪-১০-৫২/৪-১-৪৩ শেষ শাওয়াল ১০৫২ জানুয়ারি ১৬৪৩)। রয়্যাল বিশাল সেনা বাহিনী নিয়ে তিরুপতিতে অপেক্ষা করছিলেন(মার্চ এপ্রিল ১৬৪৩)।কিন্তু তাঁর বাহিনীর বিপক্ষের জোরদার যুদ্ধের এবং অস্ত্রশস্ত্রের খবর আর বাহনীর মধ্যেই অসন্তোষ যেমন কালাহস্তির দামারালা ভেঙ্কটা এবং টুপাক্কি কৃষ্ণাপ্পা, কুতুবশাহীদের মনোবল বাড়িয়ে ভেল্লোরে চলে গেলেন। অন্যদিকে মীর মহম্মদ তাঁকে জোরজার না করে উদয়গিরিতে পৌঁছে গেলেন। উদয়গিরি তখন দুই শক্তির মধ্যে নিষ্পেষিত হচ্ছে। এটি ভালিকোণ্ডা পাহাড়ে অবস্থিত এবং এটি প্রায় অগম্য, শুধু একটি ঢোকার রাস্তাওয়ালা দুর্গ। মীর মহম্মদ মাল্লাইয়া নামক হিন্দু সেনাপতিকে প্রচুর সোনা ঘুষ দিয়ে, তাঁর থেকে গুপ্ত প্রবেশ পথ জেনে নেন(জুনের মাঝামাঝি, ১৬৪৩)। একের পর এক দুর্গের পতনের খবরের সঙ্গে প্রায় অজেয় দুর্গ উদয়গিরি পতনের খবর এল সুলতানের কাছে, ১০.৪.১০৫৩/১৮ জুনে ১৬৪৩, তিনি বিজয়ী সরইখাহিলকে মীর জুমলা পদের অভিষিক্ত করেন। তিনি রাজসভায় গিয়ে বিজয় উপহার দেন সুলতানকে এবং বেশ কিছু কাল তিনি সেই সভায় থাকেন।

১৬৪২ আর ১৬৪৩ সালে মীর জুমলার বীরত্বে পুলিকটের উত্তরের উপকূল এলাকার অধিকাংশই দখলে নিয়ে আসতে পারলেন সুলতান কুতুব শাহ। যে অসম্ভবকে সম্ভব করলেন মীর, তা হতে পারল তাঁর সামরিক বীরত্ব আর কূটনৈতিক চাতুর্যের দ্বারা, এবং বিজয়নগরের রাজপরিবারে দুটি অদক্ষ রাজা তৃতীয় ভেঙ্কট আর তৃতীয় রঙ্গ’র মধ্যে বিভেদ বীজে। ভেঙ্কটের অসুবিধেগুলো আগেই আলোচনা করা হয়েছে, আর শ্রী রঙ্গর সঙ্গে ভেঙ্কটের বিপুল ঝগড়ার জন্র শ্রী রঙ্গের সিংহাসনে আরোহন উনিশ দিন পিছিয়ে যায়। এই অবস্থা ব্যবহার করে গোলকুণ্ডা। নতুন রাজাকে অভিজাতদের অধিকাংশরই পছন্দ হয় নি বিশেষ করে কালাহস্তির ভেলুগতি ভায়েদের(দামারালা ভেঙ্কটাদ্রি বা ভেঙ্কটা এবং আয়াপ্পা)। এরা দুইভাই আগের রাজত্বে মোটামুটি রাজ্য পরিচালনা করত। এই বিক্ষুদ্ধরা জুটল গিয়ে গোলকুণ্ডার দলে। তাঁর ভেঙ্গে পড়া রাজত্বে শ্রী রঙ্গা কখোনো গোপনে কখোনো সরাসরি গিরগিটির মত মত, রঙ, আনুগত্য বদল করা অভিজাতদের মুখোমুখি হলেন। এর পাসাপাশি তাকে দু’দিকে চেপে ধরল বিদেশি সেনাবাহিনী, কখোনো যৌথভাবে কখোনো একা।

গাজি আলির সেনাপতিত্বে কুতুব শাহি বিপর্যয়[সম্পাদনা]

মীর জুমলা কর্ণাটক থেকে গোলকুণ্ডা রাজসভায় যাওয়ার পর্বে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব পেলেন গাজি আল বেগ। নেতৃত্ব আরও জোরদার করতে সুলতান তাঁকে পাঠালেন সৈয়দ মুজফফর, শাহ গজনফর খান, বিজাপুরের রুস্তমইজামানের জামাই এবং অন্যান্য সেনা আধিকারিককে। কিন্তু সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের পরিবর্তন গোলকুণ্ডার রাজ্যজয়ের পক্ষে শুভ হল না।

শ্রী রঙ্গ প্রাণপনে চেষ্টা করছিলেন গোলকুণ্ডার বিরুদ্ধে রণনীতির গুটিগুলি সাজানোর। বিজয় নগরের শেষ প্রভাবশালী নরপতি শ্রী রঙ্গ’র ছিল অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তিনি ক্রমশঃ মীর জুমলার আক্রমণের প্রাবল্য থেকে সেরে উঠছিলেন। যুবরাজ থাকাকালীন তিনি নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের বিরুদ্ধে বিজাপুরী হানাদারদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। কিন্তু ক্ষমতা হাতে পেয়ে তিনি তাঁর পূর্বের অবস্থান থেকে সম্পূর্ণ ঘুরে গিয়ে মুসলমান আক্রমনকারীর বিরুদ্ধে দক্ষিণের হিন্দু রাজাদের একজোট করতে সচেষ্ট হলেন, এমনকি ডাচেদের সাহায্যও প্রার্থনা করলেন। প্রাথমিকভাবে শ্রী রঙ্গ তাঁর সভার ষড়যন্ত্রীদের খতম করলেন। তারপর তাঁর কাছাকাছি মাদুরার তিরুমালা নায়েককে ধ্বংস করতে উদ্যমী হলেন। কিন্তু তিরুমালার নায়েক তাঞ্জোর আর জিঞ্জির নায়েকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাঁদের যৌথ শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুললেন। শ্রী রঙ্গ জিঞ্জির নায়কের বিরুদ্ধে বিপুল সেনাবাহিনী নিয়ে লড়তে গেলেন। তিরুমালার নায়েক বৃহত্তর দেশভক্তিকে চুলোয় দিয়ে শ্রী রঙ্গর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে গোপনে গোলকুণ্ডার সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন, উত্তর দিক থেকে সুলতানকে, শ্রী রঙ্গর রাজধানী ভেলোর আক্রমণ করতে প্ররোচিত করে। এই সংবাদের শ্রী রঙ্গ জিঞ্জি থেকে তাঁর রাজ্যে ফিরে যেতে বাধ্য হন এবং তাঁর সঙ্গে হাত মেলায় পশ্চিম উপকূলের ইক্কেরির নায়ক। কিন্তু শ্রী রঙ্গ তাঁর রাজধানীতে ঢুকে লুঠেরা গোলকুণ্ডার সেনা (১৬৪৩-৪৪)কে রাজধানী ছাড়া করে। দামরালা ভেঙ্কটাপ্পাকে গোলকুণ্ডার সঙ্গে হাত মেলাবার আগেই তিনি গ্রেপ্তার করেন। মীর জুমলা, বিজাপুরী সেনাপতিদের ১৫ লক্ষ প্যাগোডা এবং ১৫টি হাতি দিয়ে কিনে নিয়ে অভেদ্য উদয়গিরি দখল করার কাণ্ডে মানসিকভাবে ক্ষতবিক্ষত আদিল সাহের ঈর্ষা আরও বেশি জ্বালিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন শ্রী রঙ্গ। কর্ণাটকের বালাঘাটে তখন ছিল বিজাপুরী ৬০০০ গোলান্দাজ আর ২০০০০ পদাতিক সেনা। রয়্যাল তাঁদের আক্রমন করে সেখান থেকে কুতুবশাহী সেনাকে উতখাত করলেন(জানুয়ারি ১৬৪৪)। তিনি এবারে তাঁর অভিজাতদের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ নিতে শুরু করলেন – জিঞ্জি, তাঞ্জোর আর মাদুরার নায়েকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিপুল অর্থ দাবি করে বিজাপুরকে সেই অর্থ দিয়ে পাশে দাঁড়ানোর ঋণ শোধ করলেন আর জিঞ্জির হাত থেকে আর্নি দখল নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন।

কিন্তু শ্রী রঙ্গর পক্ষে একই সঙ্গে তাঁর রাজ্যের ভেতর আর বাইরের, দু ধরণের শত্রু বিরুদ্ধে লড়া খুব সহজ হল না। নিজের রাজ্যে ক্ষমতায় থাকা তাঁর আত্মীয় আয়াপ্পা দারমালার আক্রমনের ধাক্কায় দারমালা ভেঙ্কটাপ্পাকে মুক্তি দিতে হল এবং তাঁদের ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে হল। অন্যদিকে যে কোন মুহূর্তে ভেঙ্কটগিরি দখল করে রাখা গোলকুণ্ডা সেনা বাহিনীর আক্রমনের আশংকাও তিনি করছিলেন।

৬৪৪এর ১৪জুলালাইএর মাঝামাঝি কুতুব শাহী সেনাবাহিনী কাসি আলি(গাজি আলি)র নেতৃত্বে কোন বাধা ছাড়াই পুলিকটের কাছাকাছির শহরগুলি শহর দখল করে। এবং আরও অগ্রসর হয়ে ডাচেদের বাণিজ্য সুবিধা রেখেই তাঁদের আত্মসমর্পণ করতে নির্দেশ দেয়। ব্রিটিশেরা আশঙ্কা করছিল সেন্ট জর্জেও গোলকুণ্ডার আক্রমন আসতে পারে। কিন্তু আক্রমণকারীরা ডাচ সেনাপতি হিউসেনের জবরদস্ত প্রতিরোধ ভেঙ্গে গড়টি দখল করতে পারল না। উল্টোদিকে জিঞ্জির বিদ্রোহী নায়েক, গাজি আলির আক্রমনের আগেই রয়্যালকে আক্রমনের পরিকল্পনা করছিল পিছন থেকে। খবর পেয়ে রয়্যাল জিঞ্জির সঙ্গে চুক্তি করে হিন্দু সেনাপতি কিস্টাপ্পা নায়েককে তুলে নেন এবং চিন্নানা(মালাইয়া)কে আবার ক্ষমতায় বসান। কিস্টাপ্পা এবং ভেলুগতি শিঙ্গা হঠাৎ করে মুসলমান বাহিনীকে ভেঙ্গাল্লু হ্রদের সামনে(২১ আগস্ট ১৬৪৪) আক্রমন করে। গোলকুণ্ডার সেনাবাহিনীর প্রভূত ক্ষতি হয়। যৌথ বাহিনী তাদের আরমাগাঁও থেকে উদয়গিরি ছাড়িয়ে তাড়িয়ে দিয়ে আসে। মীর জুমলার বীরত্বপূর্ণ কাজ ধুলিতে মিশে গেল।

কর্ণাটকে নীর জুমলার দ্বিতীয়বার অভিযান[সম্পাদনা]

পূর্ব কর্ণাটক জয়ের সুলতানি গোলকুণ্ডার প্রচেষ্টা এক ধাক্কায় ধুলিতে মিশে গেল। মীর মহম্মদের অনুপস্থিতিতে গাজি আলির অযোগ্য নেতৃত্ব যে গোলকুণ্ডা বাহিনীর সাময়িক পশ্চাদপসরণ হয় সেটা নিশ্চিত। সেই মুহূর্তে গোলকুণ্ডার বাহিনী এতই হতচকিত হয়ে পড়ে যে ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন করে আক্রমন শানাবার কথা তাঁদের মনে আসে নি। একদিকে কুতব শাহকে চেষ্টা করতে হচ্ছিল তাঁদের পশ্চাদপসরেণের সুযোগে যেন বিজাপুর কোন জমি দখল না নিতে পারে, অন্য দিকে কর্ণাটকের যতটুকু জমি তাঁদের দখলে রয়েছে, তা ধরে রাখতে নিজের বাহিনীর জন্য সম্পদ আর অতিরিক্ত বাহিনী পাঠানোর ব্যবস্থা করা। ১৬৪৪এর শেষে এবং ১৬৪৫এর প্রথম পাদে গোলকুণ্ডাকে, ছোট ছোট রাজা নিয়ে জোট করা রয়্যালের সঙ্গে যুদ্ধ সাময়িকভাবে থামিয়ে দিয়ে শান্তি চুক্তি করতে হয়। কুতুব শাহী কূটনীতি পিছু হঠলমাত্র। কিন্তু নায়কেরা দুই সুলতানের সাহায্য চেয়ে বসায় তাঁর পররাজ্য আক্রমনের বাসনা আবার জেগে উঠল। সুলতান নতুন করে মীর মহম্মদ, বর্তমানের মীর জুমলার জয়ের আস্বাদ মিটে যেতে না যেতেই দ্বিতীয়বার রাজ্য জয়ে পাঠালেন।

সময়টা যেন মীর জুমলার নতুন অভিযানের জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল। কর্ণাটক যুদ্ধে যুদ্ধে আর দুর্ভাগ্যের ভারে ক্ষতবিক্ষত। রয়্যালও সমস্যার ভারে বিপর্যস্ত। গোলকুণ্ডার চাপে ডাচেরা তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে, ১২ আগস্ট ১৬৪৫ থেকে সুরক্ষিত পুলিকট ডাচ কুঠি তাঁর হাতে রুদ্ধ। অন্য দিকে গৃহযুদ্ধ লেগেছে - তাঞ্জোর, মাদুরা এবং সিনসিদার(জিঞ্জি)এর নায়কদের সঙ্গেও লড়াই চলছে সমানতালে। ১৬৪৫ সালের ডিসেম্বরে নায়কদের যৌথ বাহিনী রয়্যালের সেনাবাহিনীকে হারিয়ে দেয়। ফলে পুলিকটের অবরোধকে জোরদার করতে রয়্যাল চাহিদার ভগ্নাংশ মাত্র ৪০০০ পদাতিক আর কিছু খাবারদাবার আর গোলাবারুদ পাঠাতে পেরেছে। বিজাপুরের রয়্যাল রাজ্য আক্রমণের খবর গোলকুণ্ডার হর্ষ বৃদ্ধি করল। ১৬৪৬ সালের শুরুতে আদিল শাহি সেনাপতি মুজফফরউদ্দিন খান মহম্মদ, খানইখানান, কুর্নুলের নান্দিয়ালসহ অঞ্চলের আটটি দুর্গ দখল করে সেই বছরের বসন্তে পশ্চিম দিক থেকে অগ্রসর হয়ে কর্ণাটক বালাঘাট দখল করেন। ব্রিটিশেরা অবস্থা বুঝে তাঁদের নথিতে মন্তব্য করল, ‘মুসলমানের নতুন করে ছেড়ে যাওয়া এলাকা দখল করতে শুরু করেছে’।

এই সব একসঙ্গে ঘটে যাওয়া চলচ্চিত্রসম ঘটনার সুযোগে সুসজ্জিত এবং চরম দক্ষ ইওরোপিয় গোলান্দাজ এবং বন্দুকচি বাহিনী নিয়ে মীর জুমলা উত্তর আর পূর্ব দিক থেকে রয়্যালের এলাকা আক্রমন করে। দামরালার সিংহাসনে মাল্লাইয়া (চিন্নানা)কে বসান রয়্যাল। তাঁর ছিল ৫০ হাজার সেনা। তিনি চেষ্টা করছিলেন আক্রমনকারী মুসলমান বাহিনীকে তাঁর রাজ্য থেকে দূরে রাখার। গোলকুণ্ডার আক্রমনের সামনে পড়ে ডাচেদের অবরোধ থেকে বিপুল সংখ্যক বাহিনী তুলে নেওয়া হয়। মাত্র হাজার খানেক সেনার অবরোধ ভাঙতে ডাচেরা নতুন করে আক্রমন শানায় কিন্তু রয়্যালের খুব কম ক্ষতি হয়। অবরোধ চলতে থাকে। রাজা ডাচেদের থেকে বিপুল অঙ্কের ক্ষতিপূরণ চেয়ে বসে; না পেলে অবরোধ তুলতে রাজি নন জানিয়ে দিলেন।

কিন্তু ডাচেদের বিরুদ্ধে রয়্যালের সাফল্য মীর জুমলার আক্রমণে ছিন্নভন্ন হয়ে গেল। পাঁচ মাসের মধ্যে কৃষ্ণা নদী পেরিয়ে কুর্নুল জেলার কাম্বামে পৌঁছে এরাগোন্দাপালেমের প্রায় অজেয় দুর্গ দাদ্দানালা দখল করলেন। নায়ক নিহত হলেও এখানে আবার মীর জুমলা তাঁর ফলিত কূটনীতি অবলম্বন করে নিহত নায়েকের পুত্রকে নগদ ৫০ লক্ষ প্যাগোডা আর বছরে এক লক্ষ প্যাগোডার বিনিময়ে দুর্গটির স্বত্ব অর্পণ করে যান। রয়্যাল রাজত্বের পূর্বাঞ্চলের মুকুট রাজধানী উদয়গিরি মীর দখল করলেন। ব্রিটিশ সূত্রে জানতে পারছি ২১ জানুয়ারি আর ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে মুসলমান সেনানায়ক রয়্যালের রক্ষণের তিনটে গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ দখল করলেন। উদয়গিরি দখল হল বিশ্বাসঘাতকতায়। ডাচেদের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রায় জিততে বসা রয়্যালের সেনানায়ক মাল্লাইয়ার দুর্গ ঘিরে রাখে মীর জুমলা। ৫০ হাজার সেনা থাকা সত্ত্বেও সে মীর জুমলার সঙ্গে বোঝাপড়া করে, নিজে আর তাঁর সৈন্যের স্বাধীনতার আশ্বাস নিয়ে দুর্গটা তুলে দেয় গোলকুণ্ডার দখলে।

উদয়গিরি দখল করে মীর জুমলা পশ্চিমের পানে যেতে যেতে কুডাপ্পা জেলার চিট্টিভেলির ছটা দুর্গ দখল করেন। মালটি সমাজে প্রধান দ্বিতীয় অনন্ত শুধু যে তাঁর রাজ্য হারালেন তাই নয়, তাকে বিপুল অর্থ ক্ষতিপূরণ দিতে হল।

বীজাপুর গোলকুণ্ডার কর্ণাটক ভাগাভাগি চুক্তি[সম্পাদনা]

কর্ণাটক দখলের দুই দক্ষিণী সুলতানি রাজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বিতার আবহে, আহমদনগর দখলের পর প্রায় পঁচিশ বছর ধরে মুঘল পাদসাহ শাহজাহান দাক্ষিণাত্য বিজয়ের দীর্ঘস্থায়ী একটা অশুভ খেলা খেলতে থাকেন। এই বিজয় মুঘল সাম্রাজ্যের সামরিক বলে করতে হয় নি, বরং দুই সুলতানি রাজ্যের মধ্যে যে কূটনৈতিক লড়াই চলছিল, তাকে ব্যবহার করে মুঘলেরা চতুরতায় কাজটি হাসিল করে। এটি ঘটতে পেরেছিল অনেকটা ইনকিয়াদনামা(আত্মসমর্পণের ইচ্ছে) বা আহদনামা বা তা’হাহুদনামা(চুক্তি)র জন্য আর ১৬৩৬ সালের এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে হওয়া সীমান্ত চুক্তি এবং মুঘল সাম্রাজ্যের ভয় দেখানোর রণনীতি আর দুই সুলতানি রাজ্যের মোঘল সাম্রাজ্য সম্বন্ধে অযথা ভয়ের পরিবেশ তেরি হয়ে যাওয়ার জন্য। দুটি রাজ্যের বৈদেশিক নীতি তৈরি হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদী নীতি অনুসরণে এবং ঠিক সেই জন্যই দুটি রাজত্বের স্বাধীনতা পরাধীনতায় পরিণত হল। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রীয় নীতির মদতে তারা আরও বড় রাজ্য জয়ের পথে যেতে পারল না বলেই তাঁদের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হল। কর্ণাটকে সীমান্ত নীতির ফলে তারা উত্তরের দিকে রাজত্ব জয়ের অভিযানে যেতে পারল না, তাঁদের অভিযানগুলি দক্ষিণের দিকে নিয়ে যেতে বাধ্য হল, যার জন্য তাঁদের রয়াল আর তাঁর নায়কদের লড়াইয়ের মাঝে পড়ে বিজয়নগর দখল করতে হল।

গোলকুণ্ডা এবং বীজাপুরকে পুর্ব এবং পশ্চিম কর্ণাটক দখলের নীতি প্রণয়নে মুঘলেরা যে প্ররোচনা দিয়েছিল, তার হাজারো পরোক্ষ সূত্র ছড়িয়ে রয়েছে সে সময়ের মুঘল ইতিহাস আর নথিতে। যদিও সরাসরি মুঘল সূত্র এই তত্ত্ব স্বীকার করে না। কর্ণাটকীয় আগ্রাসন সংক্রান্ত বিভিন্ন তেলুগু নথিতে মুঘল সম্রাট বলতে শাহজাহানকে না তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে দাক্ষিণাত্যে মুঘল সুবাদার আলমগিরকে বোঝানো হয়েছে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট বিভ্রান্তি রয়েছে। কিন্তু গাণ্ডিকোটা কৈফিয়িত নামক নথিতে পাচ্ছি, মুঘল সম্রাটের সরাসরি প্ররোচনায় গোলকুণ্ডা কর্ণাটক জয়ে উৎসাহিত হয়ে, ‘পাদশার উজির মীর জুমলা, আলমগীরের পক্ষে দক্ষিণে আসেন...’। মুঘল হস্তক্ষেপের একটা লেখর প্রমান রয়েছে। গুটি তালুকে উদ্ধার হওয়া তাম্র প্রশস্তিতে পাওয়া যাচ্ছে, পাদশা(পাচ্চায়ি)র হয়ে গোলকুণ্ডা কর্ণাটক এবং গুটি দখল করে।

কুতুবশাহী আক্রমন সংক্রান্ত নথিপত্রেও একই তত্ত্ব সমর্থনের তথ্য পাচ্ছি অর্থাৎ নীতি নির্ধারণে মুঘল সাম্রাজ্যের লুকোনো হাতের অস্তিত্ব, যাদের প্ররোচনায় সুলতান তাঁর সৈন্য নিয়ে কর্ণাটক আক্রমন করেন। পাদশাহ শাহজাহানকে লেখা আবদুল্লা কুতুব শাহ এক চক্রান্ত-পত্রেও এ ধরণের ধারনার প্রমান পাওয়া যায়,

১) কর্ণাটক রাজ্য থেকে লুঠ করা সম্পদের দুই তৃতীয়াংশ সম্রাটকে দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়;

২) রয়াল এবং তাঁর নায়কদের মধ্যে বিভেদ ঘটিয়ে যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হবে, সে সময়ে পাদশাহের একজন আধিকারিক থাকবেন ঠিক হয়;

এরই সঙ্গে শাহজাদা দারার কাছে কুতুব শাহ, নিজেকে তাঁর আজন্ম শিষ্য(মুরিদ) হিসেবে উল্লেখ করে আর্জি পেশ করে (আর্জদস্ত) অনুরোধ করেন দাক্ষিণাত্যের গণ্ডগোলে তিনি যেন মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেন।

অন্য দিকে এই তত্ত্বের পক্ষে সরাসরি সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে ডাচেদের পক্ষ থেকে; ডাচ সূত্রে জানা যাচ্ছে, কর্ণাটক ‘আক্রমন করে, সেটিকে নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা’ করে নেওয়ার ‘নির্দেশ’ দুই সুলতানকে দিয়েছিল মুঘলেরা। যখন সাম্রাজ্যবাদী নিয়ন্ত্রণে, দুই সুলতানের একের পর এক আক্রমনে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেছে কর্ণাটকের রয়াল রাজ্য, সে সময় পরস্পর সুলতানের বিরুদ্ধতা কাজে লাগাতে চেষ্টা করেন রয়াল। এক সুলতানের সেনার পক্ষ নিয়ে অন্য সুলতানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কাজে লাগাতে রয়াল একজনকে অর্থ, হাতি আর অন্যান্য উপঢৌকন দিয়ে বশ করে। এটা খুব কঠিন কাজ ছিল না, কেননা সেই দুই সুলতানের পরস্পরের মধ্যে গভীর ঈর্ষা আর অবিশ্বাসের বাতাবরণকে কাজে লাগানো হয়েছিলমাত্র। ফলে ইসলামিক আগ্রাসনের প্রাবল্যের গতি কিছুটা হলেও কমে গিয়েছিল সেই পদক্ষেপে।

শনৈ শনৈ দুই সুলতানের কাছে এই তথ্য পরিষ্কার হয়ে গেল যে দুজনের মিলিত আক্রমনের উদ্যোগ ছাড়া কর্ণাটক বিজয় সম্পন্ন হবে না, এবং অবিশ্বাসীর গাছটি(ট্রি অব দ্য ইনফিদেল)র শেকড় উপড়ে ফেলা যাবে না। আদিল শাহ বুঝতে পারলেন, ‘কুতুব শাহের সাহায্য ছাড়া রয়াল বিরুদ্ধে সফলভাবে যুদ্ধ করে জেতা যাবে না; ফলে তিনি কর্ণাটক দ্বিখণ্ডী করণের কুতুব শাহী প্রস্তাব মেনে নিয়ে রয়াল এবং অন্যান্য জমিদারের বিরুদ্ধে ধ্বংসক্রিয়ায় তাকে সামিল করে নিলেন’। ১৬৪৬ সালের মার্চ-এপ্রিলে দুই সুলতান ঠিক করলেন হিন্দু কর্ণাটকের রাজা শ্রী রঙ্গ’র রয়ালের রাজ্য, যুদ্ধের সামগ্রী, পণ্য, সোনাদানারত্নরাজি এবং নগদ অর্থ আলোচয়া সাপেক্ষে বিজাপুর আর গোলকুণ্ডার মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে, যার মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ পাবেন আদিল শাহ আর এক তৃতীয়াংশ পাবেন কুতুব শাহ।

সেই সময়ে এই সীমান্ত এবং রাজ্যভাগ চুক্তি দুই সুলতানি রাজ্যের পক্ষে খুবই সুখকর ঠেকল। বিজিত আদিল শাহী উজির নবাব মুস্তাফা খান কানাড়ি দেশ এবং কুতুব শাহী উজির মীর জুমলা পূর্ব কর্ণাটকের দিকে এগোতে থাকলেন। ১৬৬৪এর জুন মাসে বিজাপুরী সেনাধ্যক্ষ, মুলুন্দের দিকে এগোলেন। ব্যাঙ্গালোর জেলায় তাঁর সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হল মাদুরা, তাঞ্জোর আর জিঞ্জি ইত্যাদির নায়েক, দেশাই এবং আরও অন্যান্যদের। সেখান থেকে তারা রয়াল রাজধানী ভেলোরের দিকে এগোবেন। একই সঙ্গে কুর্নুলে থাকা খান মহম্মদকেও মূল বাহিনী অনুসরণ করতে নির্দেশ দিলেন। চলতি অবস্থা শ্রী রঙ্গর পক্ষে খুব মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠল। যে মানিওয়ারেরা(নায়েক) এক সময় তাঁর অধীন ছিল আজ তাঁর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, এবং তাঁদের উকিল আর অন্যান্য পেশাদারদেরকে মুস্তাফা খানের কাছে পাঠিয়েছে আদিল শাহী সুলতানির পক্ষে আইনি আধীনতার জন্য কাগজপত্র তেরি করতে। চিন্তিত হয়ে রয়াল ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার ঘোড়সওয়ার, এক লাখ পদাতিক এবং ১০০ হাতি পাঠালেন নায়কদের ভয় দেখাতে। জিঞ্জির রূপ নায়েক ভয় পেয়ে সরে দাঁড়ালেন। তাঞ্জোরের নায়েক বিজয়ার্গভ আর মাদুরার নায়েক তিরুমালা খালপত্তনমে(কয়ালপত্তনম)হাজারো রত্নখণি নিয়ন্ত্রণ করতেন; তারা রয়ালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পরিকল্পনায় এড়ে রইলেন। রয়াল বুঝলেন তারা মুস্তাফার সঙ্গে যোগ দিয়ে তার রাজত্ব দখল করবেই। রয়াল শান্তি প্রস্তাব দিয়ে ভেলোরের কাছে কানোয়ি পাসে তাঁর ব্রাহ্মণ গুরু ভেঙ্কান্না সোমাইয়াজী(সোমাজী)কে নবাব মুস্তাফার সঙ্গে সাক্ষাত করতে পাঠালেন। নবাবের শান্তি শর্ত(নায়েকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিকল্পনা থেকে রয়ালকে সরে আসতে হবে, এবং পিছিয়ে ভেলোরে চলে যেতে হবে) শুনে ফিরে এসে রয়ালকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে পরামর্শ দিলেন, গুরু। মুস্তাফা খান তখন জগদেব দেশ জয় করতে গেলেন।

একই সময়ে নবাব মীর জুমলা উদয়গিরি দখল করে গোটা পূর্ব উপকূল, নেলোরের দক্ষিণ এবং সেন্ট জর্জ দুর্গের আশেপাশের অঞ্চল দখল করতে উঠেপড়ে লাগলেন। উত্তর আর্কোটের টোন্ডামানাদ, তিরুপ্তি এবং চন্দ্রগিরি ১৬৪৬এর এপ্রিল মাসের আগেই দখল হয়ে গিয়েছে। ১১ ডিসেম্বর পুলিকটের আশেপাশে থাকার সময় ডাচেরা অগ্রগামী গোলকুণ্ডা বাহিনীর আলোচনা সুরু করে বশ্যতা স্বীকার করল। তিনি ডাচ দুর্গের সুরক্ষার ব্যবস্থা দেখে খুবই প্রভাবিত হলেন। যুদ্ধের আবহেই প্রচুর আলোচনার টানাপোড়েনের পর তিনি ডাচেদের এলাকায় কাসিম মাজানদারিনিকে থানাদার নিয়োগ করেন। তিনি শুধু পুলিকটই নয়, স্যান থোমেরও প্রশাসন হাতে নিয়ে রাজ্যজুড়ে শান্তি বজায় রাখায় ব্যবস্থা করে হিন্দু শক্তি দমনের দিকে এগোলেন। মীর জুমলা পুলিকট থেকে এগোবার পথে সমস্ত রাস্তা জুড়ে বাড়ি ঘরদোর পুড়িয়ে মানুষ খুন করে, বিপুল ধ্বংসলীলা চালাতে থাকেন। স্থানীয় অভিজাতরা তাঁর সঙ্গে যোগ দেয়। এলাকার পর এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। তাঁর পৌঁছবার আগেই পোন্নারি, পূনামালি, কাঞ্চি(কাঞ্চিভরম), এবং চিঙ্গিলপুট(যেটি সপ্তম স্বর্গের সঙ্গে তুলনীয়)র পতন হতে থাকল একের পর এক, জনশূন্য এলাকা দখল করতে করতে এগোতে লাগলেন। ৪ জানুয়ারি ১৬৪৭এ জানা গেল রাজার সকাশে(ভেলোর) পৌঁছবার জন্য মাত্র দু দিন হাতে রয়েছে। দেশজুড়ে বিপুল মন্বন্তর নেমে এল, কেউ মীর জুমলার বিরোধিতা করতে এগিয়ে এলেন না।

বিজাপুরী আর কুতুব শাহী সেনার হাতে ভেলোরে হিন্দু সেনাপতি ভাইলুয়ারের চরম বিপর্যয়ের পর রয়াল আত্মসমর্পনের অঙ্গীকার করেন এবং যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫০ লক্ষ হুণ আর ১৫০টি হাতি দিতে বাধ্য হন(এপ্রিল, ১৬৪৭)। বিজাপুরের আত্মসমর্পণের শর্ত কুতুব শাহ মেনে নেন না। যদিও নায়কেরা নতুন করে রয়ালের পাশে দাঁড়াবার অঙ্গীকার করতে থাকেন, এবং দেশের স্বাধীনতার পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরার নিশ্চয়তা দিতে থাকেন, কিন্তু ততদিনে বহু দেরি হয়ে গিয়েছে। নায়কদের মধ্য কলহ তাদের পতনের কারণ হল। তাঞ্জোর আর জিঞ্জির সামরিক ক্ষমতা এতই সীমিত ছিল যে তারা আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে কোনই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে নি। মহীশূর আর মাদুরার যৌথ সেনা দল বিজাপুরের মুস্তাফা খানের সাহায্যে ওয়ান্ডিওয়াসে মীর জুমলার বিরুদ্ধে দাঁড়ালেও, মীর জুমলা কয়েকজন হিন্দু সেনাপতি যেমন ভেলুগতির প্রধানকে সঙ্গে নিয়ে তাদের সমস্ত প্রতিরোধ উপড়ে ফেলেন।

১৬৪৭ সালে মাদ্রাজে ব্রিটিশদের সঙ্গে সন্ধি করায় মীর জুমলা পিতলের বন্দুক পেলেন। তাঁর বদলে বাণিজ্য সুবিধা দিলেন। অক্টোবরে ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা সমীক্ষা পত্র পাঠিয়ে জানাল যে গোলকুণ্ডার রাজা মোটামুটি সমগ্র রাজত্ব জয় করে নিয়েছেন, এবং আনাবব(নবাব) উপাধিতে দেশ শাসন করছেন।

জিঞ্জি[সম্পাদনা]

ব্রিটিশদের সঙ্গে মাদ্রাজে সন্ধি করে ১৬৪৭-৪৮এর শীতে মীর জুমলার নেতৃত্বে কুতুব শাহী বাহিনী চলল উত্তর থেকে জিঞ্জির দিকে। সেনাবাহিনী যতই এগিয়ে আসতে থাকে, বিপদের আশংকায় তাঞ্জোরের নায়ক থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে মীর জুমলার সঙ্গে সন্ধি করে নিলেন। মীর জুমলার পরিকল্পনা ছিল জিঞ্জিকে উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমন করা। তিনি দক্ষিণ আর্কট জেলার তাঞ্জোরের তাণ্ডিভরম আর আসিউর(আলিউর?) দখল করলেন। মাদুরার তিরুমালার নায়ককে একদা তাঞ্জোরের নায়ক বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। তিনি এবারে শোধ নিতে বদ্ধ পরিকর হয়ে আদিল শাহকে তাঁর দূত পাঠিয়ে সমস্ত সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিলেন। আদিল শাহ জিঞ্জি দখল করার মনস্থ করেছিলেন, কিন্তু জিঞ্জি গোলকুণ্ডার আশ্রয় চাইল। কুতুব শাহ শাহজাহানকে লিখে জানালেন জিঞ্জি আর তাঞ্জোরের জমিদার তাঁর নিরাপদ আশ্রয়ে রয়েছে। আদিল শাহ এই জোটের পূর্বলক্ষ্মণ হয়ত দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বুঝলেন মীর জুমলার কূটনীতিতে এই দুই নায়ক তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। ফলে তিনি কুতুব শাহের প্রতি বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠে মুজফফরাউদ্দিন খান মহম্মদ, খানইখানানকে রাজসভায় ডেকে গোলকুণ্ডা রাজ্য লুঠ আর দুর্গকে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। কিন্তু তাঁর এই আভিযান করতে কিছুটা দেরি করতে হল। শাহজাহানের দূত হামিম মহম্মদ হুসেইন আদিল শাহের রাজসভায় বললেন কুতুব শাহের নির্দেশে মীর জুমলা এই কাজটি করেছেন, এবং তিনি(দূত) দেখবেন যাতে আদিল শাহ যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ পান। তারপর আদিল শাহ শাহজাহানকে অনুরোধ করেন এই এক তৃতীয়াংশ দুই তৃতীয়াংশ আহদনামার ভাগাভাগির বখরার, এবং এই পেশকাশ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হোক।

কিন্তু ১০ জানুয়ারি ১৬৪৮এ দেখা গেল এই ভাগাভাগিতে আদিল শাহ খুশি হননি। তিনি কুলবর্গার মুস্তাফা খানকে নির্দেশ দিলেন তুরুমালার নায়ককে নিয়ে জিঞ্জি দখল করার। তাঁর শেষ এবং সব থেকে বড় সৈন্য সজ্জা – ১৭০০০ ঘোড়া, ২০-৩০ হাজার পদাতিক সৈন্য তাঁর সঙ্গে ৩০ হাজার তিরুমালার সৈন্য(সঠিক যুদ্ধাস্ত্র বিহীন অনিয়মিত সেনা দল) যোগ করে মুস্তাফা খান এগিয়ে চললেন। হয়ত ঘটনার এই অগ্রগতি দেখে মীর জুমলা মার্চের ১৬৪৮এর বর্ষায় কাঞ্জিভরমের দিকে এগোলেন। দূরদৃষ্টিতে তিনি বুঝলেন ব্যপ্ত মাদুরা এবং মহিশূরের যৌথ বাহিনী নিয়ে আদিল শাহ ওয়ান্ডিওয়াশের দিকে এগোচ্ছেন। ভেলুগতির মত হিন্দু সেনানায়ক আর তাঁর গোলান্দাজ বাহিনী নিয়ে মীর জুমলা মুস্তাফার আগেই জিঞ্জি পৌঁছবার চেষ্টা করলেন, যাতে জিঞ্জি বীজাপুরের হাতে না পড়ে। বীজাপুরী ঐতিহাসিক জহুরি লিখছেন স্বাভাবিকভাবে মীর জুমলা ‘কিছুটা গণ্ডগোল পাকাতে চাইছিলেন’। জিঞ্জি রাজা এগিয়ে এসে মীর জুমলাকে স্বাগত জানিয়ে তিনি যে চুক্তি পালন করবেন, এবং বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না, জানালেন। তখন দুটিই সুলতানি বাহিনী মাত্র ১০ মাইল দূরত্বে অবস্থান করছে। রাজা তখন মীর জুমলার বাহিনীর ২ মাইল আগে শিবির ফেলেছেন। মীর জুমলা খুব তাড়াতাড়ি রাজার সঙ্গে যোগ দিলেন। দুটি বাহিনীর মধ্যে এখন তফাত মাত্র আট মাইলের। মুস্তাফা বুঝলেন এই যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে তাঁর আক্রমন কার্যকারী হবে না। তিনি আদিল শাহকে খুব তাড়াতাড়ি আরও বাহিনী পাঠাতে অনুরোধ করলেন। আদিল শাহ, ৭-৮০০০ সেনা বাহিনীর নায়ক সেনাপতি ইখলাস খান, রুস্তমইজামান, আফজল খাঁকে মুস্তাফা খাঁয়ের সাহায্যের জন্য পাঠাবেন ঠিক হল। অন্যদিকে কুতুব শাহ মনে করছিলেন আদিল শা রুস্তমকে পাঠিয়েছেন তাঁর হাত থেকে জিঞ্জি আর তাঞ্জোর দখল করার জন্য, তিনি শাহজাহানকে বিজাপুরের এই চুক্তি ভাঙ্গার ঘটনা বিবৃত করে পাঠালেন এবং মীর জুমলাকে কিছু দিন অপেক্ষা করতে নির্দেশ দিলেন। কেননা তাঁর বিশ্বসা পাদশাহ তাঁর পক্ষেই রায় দেবেন।

দুটি সেনা বাহিনী কোন ঘটনা ছাড়াই পরস্পরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি বসে রইল। জিঞ্জি কার দখলে থাকবে, এই সিদ্ধান্ত কয়েক দিনের মধ্যেই দুপক্ষের বিরোধে পরিষ্কার হয়ে যাবে। কিন্তু বিজাপুর থেকে বাহিনী আসাতে দেরি হওয়ায় এবং আদিল শাহী সেনা বাহিনীতে সেনাপতিদের মধ্যে মতভেদ বাড়তে থাকায় মুস্তাফার ধারণা হল যে আপাতত কিছু দিনের জন্য দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ বিরতির চুক্তি হোক। মীর জুমলা মুস্তাফার নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ সেনাপতিদের সঙ্গে তলে তলে যোগাযোগ করতে শুরু করে দিলেন। তাদের ইচ্ছে কুতুব শাহী বাহিনীর সঙ্গে চুক্তি বদ্ধ হওয়া।

যত দিন যেতে থাকে জিঞ্জির ভাগ্য কি হবে তা নিয়ে কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিরোধ বাড়তেই থাকল। চুক্তিতে ঠিক হল জিঞ্জি জয়ের পরে মুস্তাফা খান জিঞ্জিতে থাকবে আর মীর জুমলা ফিরে যাবেন গোলকুণ্ডায়। দুজনই প্রকাশ্যে পরস্পরকে সাহায্যের কথা জানাতে থাকলেন। খানইখানান কিছুটা পিছিয়ে রায়চূরে শিবির গাড়লেন। অন্যদিকে মুস্তাফা জিঞ্জির দিকে আগ্রসর হয়ে ত্রিণোমালে চঙ্গম দুর্গ দখল করে রাখলেন। মীর জুমলা জিঞ্জির ৩০ মাইল দূরে তাঁর ভেলোরের আশ্রিত রাজ্য স্বারিগুন্টার শিবিরে ফিরে গেলেন, যেখান থেকে তিনি কুতুব শাহের পক্ষ থেকে প্রশাসন চালাচ্ছিলেন।

৩ জিকাদ ১০৫৮/৯ নভেম্বর ১৬৪৮ সালে মুস্তাফা খান মারা যাওয়ায় সীমান্ত চুক্তিতে ধাক্কা লাগার আশংকা দেখা দিল। প্রতিস্থাপিত সেনাপতিত্বের যায়গায় খান মহম্মদ আসার আগেই জিঞ্জির আবরোধ মালিক রাইহানের নেতৃত্বে হতে শুরু করল। খান মহম্মদ তখন নান্দিয়ালে তাদপার্তি দুর্গ দখলের লড়াই করছিলেন। রাইহান সেনাদের ২৫০০ হুন মাইনে দিয়ে অবরোধ আরও জোরদার করলেন। এই সুযোগ নিয়ে মীর জুমলা একাই জিঞ্জি দখল করার পরিকল্পনা করলেন। তাঁর ধারণা ছিল মুস্তাফা এবং খারিয়িত খান মারা গিয়েছে, তাদের সেনা বাহিনী ছন্নছাড়া হয়ে রয়েছে, সাহজী নিজে মানসিকভাবে দুমড়ে মুচড়ে রয়েছেন, মালিক রাইহান জিঞ্জি দখলের আগেই তিনি জিঞ্জি দখল নেবেন। মীর জুমলার অভিযানের পরিকল্পনার খবর পেয়ে মালিক রাইহান একটা কড়া বার্তা পাঠালেন, ‘আপনি দুর্গের এত কাছে আছেন, তাই আপনার এই কাজ আমাদের স্বার্থের বিরোধী। দুর্গের আধিবাসীরা আপনার সাহায্য চায়। আমার মনে হয় আপনি একটু দূরে গিয়েই অপেক্ষা করুণ। আদিল শাহী সেনার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে নেই। যদি কিছু ঘটে যায় তাহলে তাঁর দায়িত্ব আমি নেব না। মুস্তাফা খান হয়ত মারা গিয়েছেন, কিন্তু আমি এখনও জীবিত রয়েছি। আমি শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই করে যাব।’ মীর জুমলাকে স্তব্ধ হতে হল। তিনি ভেলোরের ৪২ মাইল দূরে আরও উত্তরে কুডাপ্পা জয় করতে গেলেন। খান মহম্মদ সরকারি নির্দেশে তাদপার্তি থেকে অবরোধ জোরদার করতে এলেন।

কিন্তু মীর জুমলা জিঞ্জি দখলের সিদ্ধন্ত থেকে সরলেন না। শুরুর দিকে নায়কেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে তিনি ১৬৪৬এর সীমান্ত চুক্তি এবং ১৬৪৮এর মুস্তাফার সঙ্গে চুক্তি সত্ত্বেও তাদের বিজাপুরের বিরুদ্ধে উস্কাতে শুরু করলেন। বিজাপুরের রাজকীয় ঐতিহাসিক ঝাউরিইবনঝাউরি লিখছেন, ‘বিশ্বাসঘাতক, দুর্মতি আবদাল্লা, যাকে রয়াল যুদ্ধে হারিয়ে দিয়েছিল, যে বিজাপুরের সমর্থন ছাড়া এক ইঞ্চিও কর্ণাটকের জমিও দখল করতে পারত না, সে অবিশ্বাসীর(রয়াল) সঙ্গে গোপন চুক্তি করে তাঁর সেনাপতি মীর জুমলাকে পাঠিয়ে হিন্দুর সহায়তায় হিন্দু রাজাদের খেপিয়ে জিঞ্জির সুরক্ষা করতে গেল।’ অনেক দূর থেকে মীর জুমলা খুব দেরি করে এসে পৌছলেন, ততক্ষণে একদিনেই খানইখানান জিঞ্জি দখল করে নিয়েছেন। তাঁর চুক্তি পালন না করে তিনি গোলকুণ্ডার দিকে পালিয়ে গেলেন। জিঞ্জির পতনের পরেই বিজাপুরী সেনা হাতে তাঞ্জোর আর মাদুরার নায়কেরও পতন হল এবং তেগনাপত্তনমের মত সমুদ্রের আশেপাশের এলাকাগুলো লুঠ, খুনের অত্যাচার চলল। হিন্দু রাজারা রাজস্ব দিতে প্রতিশ্রুত হলেন। ডাচ নথি অবলম্বন করে ফস্টার লিখছেন, ‘ভারতের পূর্বাংশে... মুসলমান শক্তি কানাড়িদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলল। বিজাপুরী সেনা, প্রখ্যাত দুর্গ জিঞ্জিকে কেন্দ্রকরে সমগ্র জেলা দখল করল। তেগনাপত্তনমের প্রশাসক করা হল মলয়াকে’। অখুশি রয়াল মহীশূরের মায়কের আশ্রয়ে থাকতে থাকতে বিজাপুরের সঙ্গে যুদ্ধ প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকলেন। জেসুইট ধর্মপ্রচারকেদের বক্তব্য, ‘আদিল শাহী সেনা দুটি ক্ষমতাশালী রাজাকে হারিয়ে, অভূতপূর্ব পরিমানে সম্পদ দখল করে, একটাও যুদ্ধ না করে, একটাও সৈন্য না খুইয়ে বিপুল দেশটি জয় করে বিজাপুরে ফিরে যায়’।

কুতুব শাহ আদিল শাহকে অভিবাদন জানিয়ে চিঠি লেখে, সঙ্গে ৪ লাখ হুণ এবং জিঞ্জি পতনের সময় মুঘলদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য চারটি রত্ন উপহারস্বরূপ পাঠায়। তাঁর প্রস্তাব ছিল কর্ণাট আর মুলুন্দএর জঙ্গলটি কারোর অধিকারে নেই, সেটি কুতিব শাহ নিজের অধিকারে নিতে চান, যাতে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আদিল শাহ এতে রাজি হন, গোন্ডিকোটা দুর্গ এবং গোটা কোক্কানুর কুতুব শাহকে দখলের জন্য দিলেন। যাইহোক, সামগ্রিকভাবে দেখা গেল, চুক্তি ভঙ্গ হতে হতে শেষ পর্যন্ত সীমান্ত চুক্তি সেই সময়ের জন্য পালিত হল।

সিধোউত(siddhout বা সিদ্ধবাতম)[সম্পাদনা]

১৬৪৮এ জিঞ্জি আর পরের বছরে তাঞ্জোরের পতনের পর দুই সুলতানি রাজ্য বাকি থাকা ক'একটা হিন্দু রাজ্য দখলের জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করল। বিজাপুর দক্ষিণে আর গোলকুণ্ডা শক্তির সেনাপতি মীর জুমলা উত্তর দিকে নজর দিলেন নতুন করে। বিজাপুর, বিজয়নগরের পশ্চিমের তেলুগু আর পূর্বের তামিল পশ্চাদভাগের অংশটার পাশাপাশি পেনুকোণ্ডা এবং বাসবপত্তনম, বেলোর, জিঞ্জি এবং আর্নি দখলে রেখেছে। মীর জুমলা দখল করতে লাগলেন উত্তরের siddhout, গাণ্ডিকোটা এবং গুটি আর দক্ষিণের উপকূলভাগ। কার পরে কোনটা দখল করেছেন মীর জুমলা, সেই ক্রম বোঝা দুষ্কর বিভিন্ন ডাচ, পারসি, তেলুগু, তামিল, ব্রিটিশ পরস্পর বিরোধী সূত্রে। তবুও আমরা তেলুগু সূত্র, সাহিত্যিক এবং লেখমালা আর ভৌগোলিক অঞ্চলের সূত্র তুল্যমূল্য বিচার করে ধরে মীর জুমলার বিজয় পথ নির্ধারণ করতে চেষ্টা করতে পারি। মীর জুমলার পরের নজর ছিল কুডাপ্পা জেলার siddhout বা সিদ্ধবাতম। ১৬৪৬ সালে তিনি উদয়গিরি নতুন করে দখল করে চিট্টিভেলির একাংশ কবলে নিয়ে আসেন। কিন্তু এই জেলারই, বালাঘাট কর্ণাটকের খুব গুরুত্বপূর্ণ অংশ শাসন করছেন কুলাপ্পা জেলার পূর্বাংশের মাতলি সমাজের নায়ক দ্বিতীয় কুমার অনন্তের পালিত পুত্র, অনন্তরাজা দেবছোড়া মহারাজা যার রাজধানী সিদ্ধবাতম। তেলুগু সূত্রে জানতে পারছি, যুদ্ধে তিনি মীর জুমলার দুই মুসলমান আধিকারিক (সর্দার)এর মাথা কেটে নেন এবং ব্রাহ্মণ বক্সী ত্রিম্বকম রাউ(ত্রিম্বক রাও) পালিয়ে বাঁচেন(শক ১৫৭১ বিকৃতি, ১৬৪৯-৫০)। তবে পরের দিকে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যাবে না বুঝেই তাঁর কাকা এলামারাজা এবং অন্যান্য আধিকারিকের সঙ্গে আলোচনা করে মহিলা, অন্যান্য আত্মীয়স্বজন ইত্যাদি নিয়ে ইক্কেরি বাসবপুরমে পালিয়ে যান(১৬৫০)। সিদ্ধবাতমকে মীর জুমলা সেনা ঘাঁটি বানান এবং এখানে ত্রিম্বক রাও শঙ্করজী পন্তকে শাসনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

৮। গাণ্ডিকোটা আধুনিক মাদ্রাজের কুডাপ্পা আর অনন্তপুর জেলার গাণ্ডিকোটার রাজা ছিলেন তিম্মা নায়ার(তেলুগু সূত্রে প্রেমাসানি চিনা(চিন্না), তিম্মা নায়ডু)। তিনি বিজয়নগরের এবং জিল্লালার রেড্ডিদের করদ রাজা ছিলেন। পেন্নার উপত্যকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা গাণ্ডিকোটা। এর দুর্গ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তাভার্নিয়ে বলেছেন, এটি গোলকুণ্ডার অন্যতম শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। কুডাপ্পা জেলার য়ারামালাই পাহাড়ের ওপর সমুদ্র তল থেকে ১৬৭০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। পাহাড়ের পাদদেশেই শহরটি। দুই সাম্রাজ্যবাদী সুলতানি রণনীতিতেই এই অঞ্চল্টাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। গোলকুণ্ডা কয়েকবার চেষ্টা করেও গাণ্ডিকোটার রাজাকে দমন করতে পারে নি।

বিজাপুরের ইক্কেরি দখলের সমসময়ে(১০৪৭/১৬৩৮) খান মহম্মদ, মালিক রাইহান, আলি খুদাবন্দ খান এবং অন্যান্য বিজাপুরী উজির এটি অবরোধ করে। কিন্তু সাহজী ভোঁসলা আর আসদ খানের বাহিনীকে (১০৫৭/১৬৪৮ সালে) ভিল্ভুয়ার আর কৃষ্ণা তুপাক্কির নেতৃত্বে রয়ালের বাহিনী হারিয়ে দিলে, আদিল শাহের নির্দেশ সেই অবরোধ তুলে নিয়ে মুস্তাফা খাঁয়ের বাহিনীর শক্তিকে জোরদার করতে যোগ দিতে হয়। আন্দাজ করা হচ্ছে এই সময় বিজাপুর শক্তি জিল্লালা দখল এবং রেড্ডিদের বন্দী করে। রেড্ডিরা পালিয়ে গিয়ে তিম্মা নায়ারের সাহায্যে তাদের রাজ্য আর নান্দিয়ালের দু/তিনটি গ্রাম দখল করে। খান মহম্মদ তিম্মা নায়ারের সঙ্গে চুক্তি করে দখলি গ্রামের জন্য ক্ষতিপূরণ জোগাড় করেন। কিন্তু সীমান্ত চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত, বিজাপুরের মনে হয়েছে এই এলাকাগুলি তাঁর দখলে আসা দরকার এবং চুক্তির পরে এর আশেপাশের এলাকাগুলি কুতুব শাহের জন্য ছেড়ে রাখে তারা, তাঁর জন্য কুতুব শাহ বেশ ভাল রকমের ক্ষতিপূরণ দেন (১৬৪৯)।

১৫১৭র ভিক্রি শকে মীর জুমলা গোলকুণ্ডা থেকে গান্ডিকোটার দিকে বিপুল বাহিনী নিয়ে এগোতে এগোতে জাম্বুলামাদক তালুকের মাইলাবর্ণ গ্রামে উপস্থিত হন। সেখান থেকে মাত্র একটাই রাস্তা দিয়ে দুর্গ পর্যন্ত পৌঁছনো যায়। রাস্তাটির সব থেকে চওড়া অংশ ২০ থেকে ২৫ ফুট আর সব থেকে ন্যারো অংশ ৭-৮ ফুট। থেভেনটের মতে গুঁড়ি দিয়ে সে দুর্গে পৌঁছতে হয়। পাশেই খাড়া পাহাড় তাঁর পাশে দুটি খরস্রোতা নদী। পাহাড়ের মাথায় একটা ছোট সমতল ভূমি - সেখানে ছোট ছোট ঝর্ণার জলে ধান আর বজরা চাষ হয়। তাভার্নিয়ে লিখছেন, ‘দক্ষিণের সমতলে এই শহরটা এমন একভাবে তৈরি করা হয়েছে যে এক দিকে খাড়া পাহাড় আর দুটি নদী, তিনদিকের বিশাল পাথরের দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। শহরে ঢোকার জন্য সমতলের দিকে রয়েছে একটিই দরজা আর তাঁর পাশে পরিখা কাটা। দুর্গে মাত্র দুটি কামান রয়েছে, একটি ১২ পাউণ্ডের(নাম রামাবনম), দরজার সামনে বসানো, অন্যটি ৭-৮ পাউণ্ডের কামান দুর্গ প্রাচীরের মত জায়গায় বসানো।’ এর রাজা তিম্মা নায়ার এই এলাকার মধ্যে সুকৌশলী সেনা নায়কদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর পাশে ছিল রেড্ডি রাজারা। ঘেরাও হলে ১২ বছরের খাদ্য পানীয়ের সমস্যা হবে না এমন অবস্থা তৈরি করে রাজা মীর জুমলার বশ্যতা অস্বীকার এবং যুদ্ধে আহ্বান করেন। ছোট ছোট আক্রমনে স্থানীয়েরা আক্রমণকারীদের বিপুল ক্ষতি করতে থাকেন এবং এক সময় দেখা যায় মীর জুমলার ৩০০০ সেনা নিহত হয়। ফলে মীর জুমলাকে তাঁর শিবির পিছিয়ে গুদেমচেরুভু আর গোরিগানুরুতে নিয়ে যেতে হয়। থেভেনট আবদুল্লার সময় গোলকুণ্ডা এসেছিলেন তাঁর লেখনী আর তেলুগু সূত্র থেকে পরিষ্কার মীর জুমলার জয় বাহুবলে হয় নি, বরং ছলে-কৌশলে হয়। তাভার্নিয়ে বলছেন, শেষ পর্যন্ত মীর জুমলা পাহাড়ের চূড়ার উচ্চতা পর্যন্ত কামান বয়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি রাজার ফরাসী গোলান্দাজদের চার মাসের সাধারণ বেতনের তুলনায় অনেক বেশি বেতনের অর্থ দক্ষিণার টোপ দিয়ে কাজটি করাতে পেরেছিলেন। চারটি কামান উচ্চতায় তুলে দুর্গটিতে গোলা দাগা হতে থাকলে সদর দরজার কাছে থাকা কামানটিকেও অকেজো করে দেওয়া হয়। সুরক্ষিত দরজাটি প্রায় ধ্বংস হয়ে পড়ছে দেখে দুর্গের অধিবাসীরা নিজেদের সুরক্ষার শর্তে দুর্গ ছেড়ে চলে যায়। তাভার্নিয়ে বলছেন, গাণ্ডিকোটায় মীর জুমলা সফল হয়েছেন ফরাসী গোলান্দাজদের দক্ষতার জন্য, খারাপ ব্যবহার পেয়ে এরা ডাচেদের ছেড়ে এসেছিল। তাদের সঙ্গে ব্রিটিশ আর ডাচ এবং ২/৩ জন ইতালির গোলান্দাজও ছিল। আবার তেলুগু সূত্র বলছে – বহিদিন ধরে অবরোধ করেও যখন দুর্গটি দখল করা সম্ভব হল না, তখন মীর জুমলা প্রস্তাব দিলেন তাদের গুটি দুর্গের সঙ্গে এই দুর্গটি বদল করার। কিফায়তিতে যে কারণ দেওয়া হয়েছে তা যদিও হয়ত সত্য নাও হয়, কিন্তু মীর জুমলার কূটনৈতিক চাল যে কাজ করেছে তার উদাহরণ পাই থেভার্নের কথায়, ‘মীর জেমলা বল প্রয়োগে দুর্গটি দখল করতে না পেরে কৌশল আর অর্থ বলে(শান্তি আলোচনায় তাঁর সকাশে আসা নায়েককে) রাজাকে দুর্গের বাইরে বের করে নিয়ে এসে, তাকে দেওয়া শর্ত ভঙ্গ করে তাকে নজরবন্দী করে রেখে গাণ্ডিকোটা দুর্গ দখল করেন।’ তাভার্নিয়ের এই বর্ণনার সঙ্গে মীর জুমলার ঘুষের বর্ণনা খাপ খেয়ে যাচ্ছে।

কর্ণাটকের অভেদ্য এই দুর্গটি পতন মীর জুমলার জীবনে বড় প্রাপ্তি।

কিন্তু বিজাপুরী ঐতিহাসিক ঝাউর, এই জয়ে মীর জুমলার কোন কৌশলকেই বিন্দুমাত্র গুরুত্ব দিতে নারাজ, ‘দুর্গের রাজা বিপুল রত্নরাজি আর সম্পত্তি গর্বে অন্ধ হয়ে মীর জুমলার আক্রমনকে মরুভূমিতে মরীচিকার ছোট করে দেখেছিল। যখন মীর জুমলা আক্রমন করা শুরু করে, তাকে প্রতিহত করার কোন প্রচেষ্টাই তিনি করেন নি। দুর্গেই তিনি বসে ছিলেন। মীর জুমলা দুর্গের কাছাকাছি এসে দুর্গটি ঘিরে ফেলে। প্রতিরোধের চেষ্টা করলে হয়ত রাজা সফল হতেন, কিন্তু ভিষগের হাতের তলায় যেমন রোগীর নাড়ি ফড়ফড়ায়, আদিল শাহের নাম শুনে কোন প্রতিরোধ ছাড়াই রাজা মীর জুমলার হাতে পরাজয় মেনে নেন। আর যেহেতু তাঁর আশেপাশের সব রাজাই আদিল শাহের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন, সেহেতু তিনিও তা ছাড়া কোন পথ দেখলেন না।’

মীর জুমলার এই জয়ে কুতুব শাহ তাকে নওরোজইখিলাত উপাধি দেন। তখন মীর জুমলা মধ্য বয়সে পৌছেছেন, যুদ্ধের ধকলে তিনি প্রচুর শক্তিও ক্ষয় করেছেন, এছাড়াও তাঁর দৈহিক অসুস্থতা(শিকস্তগি)ও সারানোর দরকার ছিল। তিনি সুলতানের কাছে মক্কা যাবার ছাড়পত্র চাইলেন। কুতুব শাহ যুদ্ধের আগে তাকে উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এছাড়াও দীর্ঘ ২০ দিন ধরে অজীর্ণতা, নিদ্রাহীনতায় ক্রমাগত বমি করেছেন। বিগত পাঁচ বছরের নিত্যদিনের যুদ্ধে যাওয়ার কারণে তাঁর দীর্ঘ একতা রেস্ট এবং রোগ সারানোর দরকার ছিল।

গোলকুণ্ডা থেকে নতুন করে ৬০ মাইল দূরে উত্তর-পূর্বে অনন্তপুর জেলায় মীর জুমলা গুটি দুর্গ দখল করেন। সঠিক তারিখ জানা যায় না। প্রেমাদুর স্মৃতি কথায় জানা যাচ্ছে এটির পতন হয়েছিল ১৬৪৬ সালে। কিন্তু ১৫৭২ শক বা ১৬৫০ সালের তেলুগু লেখ সূত্রে জানা এটি মীর জুমলা শাসন করেছিলেন(হাজারাতি নবাবৌ বা রাজাধিরাজা রাজাপরমেশ্বর), অন্য দিকে তাভার্ণিয়ের ১৬৫২ সালের গাণ্ডিকোটা ভ্রমণ সূত্রে জানা যাচ্ছে, মীর জুমলা গুটি তালুকের বজ্রকোটির হীরে খনির মালিক ছিলেন।

গুটি থেকে মীর জুমলা, রাচুতি হয়ে দক্ষিণ পূর্বের দিকে আগ্রসর হয়ে গুরুমকোণ্ডা দখল করেন। সেই দিকে আরও এগিয়ে গিয়ে উত্তর আর্কোট জেলার চন্দ্রগিরি এবং তিরুপতি পর্যন্ত ঢুকে যান। ৬০০ ফুট উঁচু ওপরে তিরুমালা পাহাড়ের দক্ষিণ দিকে গ্রানাইট পাথরে তৈরি চন্দ্রগিরি দুর্গ যাদবদের তৈরি জোরদার দেওয়ালে(১০০০ সালে তৈরি) এবং একটি পরিখায় সুরক্ষিত। তাভার্নিয়ে সেখানে দেখেছেন প্রচুর সেনা যেতে। এবং পরে সেখানে তিনি গিয়ে মীর জুমলার সঙ্গে দেখা কররেন এবং দেখেন তিনি অভিজাতদের সঙ্গে শিবিরে আলাপচারিতায় রত।

১০। কর্ণাটক ভাগাভাগি নিয়ে যুদ্ধ ফলে এটা বোঝাই যাচ্ছিল যে সীমান্ত বা ভাগাভাগি চুক্তি হয়েছে সেটি শুধু যে চন্দরগিরির রাজার বিপক্ষে গিয়েছে তাই নয়, এই চুক্তিতে আদিল শাহের থেকে বেশি লাভ হয়েছে কুতুব শাহএর – বা এই ধারণাটা আদিল শাহের মনে গেঁথে গিয়েছে। অস্থায়িত্বই ছিল চুক্তির চরিত্র। সে সময়ের দাক্ষিণাত্যের রাজনীতি কোন নির্দিষ্ট খাতে না বয়ে এলোমেলোভাবে চলেছে; বিশেষ করে দাক্ষিণাত্যের দুই সুলতানি রাজ্যের মধ্যে। যে গভীর অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল বহু কাল ধরে, তা এই চুক্তিতে ওপড়ানো সম্ভব ছিল না। দুই সুলতানই প্রত্যেকে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে অবিশ্বাসের আঙ্গুল তুলতে থাকেন। জিঞ্জি অবরোধের সময় আবদুল্লা, পাদশাহকে একটা নাকি সুরে লেখা কান্না ভরা চিঠিতে বলেছিলেন, ‘আদিল শাহ কিন্তু তাঁর চরিত্র অনুযায়ী সম্রাটের তৈরি করা চুক্তির নির্দেশ মানবে না এবং যে ভাগাভাগির শর্ত হয়েছে তাও উল্লঙ্ঘন করবে।’

কুতুব শাহ তাঁর দিল্লির উকিল(এজেন্ট) ফাসিউদ্দিন মহম্মদকে বললেন, পাদশাহ যাতে দুজন আমিন – একজনকে বিজাপুর অন্যজনকে গোলকূণ্ডায়য় নিযুক্ত করেন, অথবা তিনি যেন গোলকুণ্ডায় আওরঙ্গজেবের দূত মীর মহম্মদ তাহিরকে সঠিকভাবে তদন্ত করে বিষয়টির সমাধান করান, সে বিষয়টি পাদশাহের সভায় গিয়ে জোর দিয়ে বলেন। সুলতান যুদ্ধের (জিঞ্জি ঘেরাওয়ের আগে) আগে একজন আমিন চাইলেন, যাতে আদিল শাহ কোন গণ্ডগোল না করতে পারে। অন্য আরেকটি চিঠিতে কুতুব শাহ পাদশাহকে অভিযোগ করে লিখলেন, বিজাপুর যে চুক্তি ভঙ্গ করেছে, সেটি ইসলাম খান জানেন, এবং ভেতরে ভেতরে বিভেদ যাতে আরও বাড়ে তাঁর ব্যবস্থা করছেন। কুতুব শাহ তাই চুক্তির কতগুলি বিষয় পুনর্বিবেচনা করতে অনুরোধ করেন, ১) রাজপরিবার, নায়কদের লুঠে যে নগদ, গয়না-রত্ন, হাতি এবং জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছে, সেগুলির ভাগাভাগির পুনর্মূল্যায়ন করা, এবং কুতুব শাহ উদার মনে চান আদিল শাহ নিজে এগুলি মূল্যায়ন করুণ; ২) কর্ণাটকে কুতুবশাহী দখল করা অঞ্চল অর্ধেক করে বাঁটোয়ারা করার কথা চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এই চুক্তি পাদশাহ দ্বারা প্রত্যায়িত নয়। তিনি আরও অভিযোগ করেন, কুতুব শাহ অভিযোগ করেন ইসলাম খাঁ প্রাথমিক চুক্তি জানতেন, কিন্তু তাঁর মৃত্যুর(নভেম্বর ১৬৪৭) সুযোগ নিয়ে আদিল শাহ শাহজীর অধীনে বহু উজির পাঠিয়ে কর্ণাটকের হিন্দুদের সাহায্য করেন, বিশেষ করে রয়াল এবং অন্যান্য জমিদারকে; কিন্তু মীর জুমলা সক্কল শত্রু পরাজিত করে বিজাপুরীদের বিদরের সীমান্তে তাড়িয়ে দেন; এবং আদিল শাহ নিজে বিদরে আসেন, যেটা আসলে যৌথ সীমান্ত; তিনি তাঁর চুক্তি এবং প্রতিশ্রুতি অমান্য করে জোর খাটিয়ে কুতুব শাহের অধিকৃত জায়গা দখল করেছেন, তাঁর অভিযোগ। আদিল শাহের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ যে তিনি হড়বড় করে তাঁর দুই-তৃতীয়াংশ ভাগ নিয়ে নিতে চেয়েছেন, অথচ কুতুব শাহের পাওনা(তিনি যে পাদশাহকে এ বিষয়ে অভিযোগ করেছেন তা না জেনেই)আটকে দিয়েছেন এবং তাঁর যা পাওনা তাঁর থেকেও বেশি তিনি কেড়ে নিয়েছেন। ব্রিটিশ সূত্র এই তথ্য প্রমান করে যে ভেলোর(১৬৪৭) দখলের সমস্ত ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্ত অর্থ বিজাপুর নিয়েছে।

দুই সুলতানি রাজ্যের মুখোমুখি দ্বন্দ্ব খুব পুরোনো নয়, কিন্তু গভীর। সেটি শুরু হয়েছে জিঞ্জি অবরোধের সূত্রে – যদিও মুস্তাফা আর মীর জুমলা এই চুক্তি সম্পাদন করেন, কিন্তু আবিশ্বাসের মাত্রা এতই কড়া ছিল যে, সেই চুক্তির বোঝাপড়া এড়িয়ে নতুন গোলযোগ পেকে উঠতে শুরু করেছে। এবারে গোলকুণ্ডার বিরুদ্ধে বিজাপুরী উজির খান মহম্মদের অভিযোগ, সম্পর্ক ভাঙ্গার। পাদশাহকে আদিল শাহ লিখলেন, তাঁর নির্দেশ ছাড়াই এবং তাকে অন্ধকারে রেখেই কুতুব শাহ গোন্ডিকোড়া দখল করেছেন। তাঁর আরও অভিযোগ মীর জুমলা যুদ্ধে সাফল্য পেয়ে কুতুব শাহকে জানিয়েই বিজাপুরের বিরুদ্ধে অস্ত্র শানাতে শুরু করেছেন। ঝাউর লিখছেন ‘দুটি-তিনটি জয়ের পর(ভুল বোঝাবুঝির জন্য হয়েছিল), যা আসলে হাজারটা পরাজয়ের থেকেও কলঙ্কের, মীর জুমলা তাঁর কাজ কর্ম গোলকুণ্ডার সুলতানকে না জানিয়েই সম্পাদন করতে শুরু করে। এই শয়তানি যুদ্ধ তাঁর প্রভুর নির্দেশের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে করতে করতে সে এলাকা দখল করতে আদিল শাহের এলাকায় ঢুকে আসত। কুতুব শাহ কাজকর্মের সুতো একজন ভয়ানক মানুষেরর হাতে ছেড়ে দিয়েছেন দেখে আদিল শাহ মুচকি হেসেছেন এবং মীর জুমলার কাজগুলিকে ক্ষমা করে দিয়েছেন।’ বিজাপুরী ঐতিহাসিকদের অভিযোগের মূল সূত্রটা হল মীর জুমলা মুলুন্দ আর কর্ণাটকে গিয়ে গোলযোগ সৃষ্টি করছেন। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছেন, গোণ্ডিকটার বিজয় ঘটেছে আদিল শাহের সেটি ছেড়ে যাওয়ার জন্য। এছাড়াও বিজাপুর কুতুব শাহের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আদিল শাহ যে ক্ষমা প্রদর্শন করেছেন, সেই কাজ কুতুব শাহ করেন নি – বিশেষ করে জিল্লালা এবং নান্দিয়ালের দুটি গ্রাম দখল বিষয়ে, গোয়েন্দাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহারে আর সর্বশেষ অভিযোগ, গুটি দখল করায় গোলকুণ্ডার সঙ্গে তাদের বিরোধ বেড়েছে| অন্যদিকে কুতুব শাহ দিল্লিতে তাঁর দূত মুল্লা আবদুস সামাদকে পাদশাহের রাজসভায় গিয়ে জানাতে বলেন, আদিল শাহের সমস্ত অভিযোগ মিথ্যে, গান্ডিকোটা দখল গোলকুণ্ডার চুক্তি অনুযায়ী হয়েছে, সেটা ক্ষমতা প্রদর্শন নয়। আদিল শাহ মীর জুমলার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ অশালীন। তাতে তাঁর সেনাপতির সম্মান হানি হয়েছে। তিনি তাঁর দূতকে আরও অভিযোগ করতে বলেন, কুতুব শাহ, আদিল শাহকে বার বার বলেছিলেন যদি কোন মতবিরোধ হয় তাহলে তিনি যেন তা পাদশাহের কাছে জানিয়ে তাঁর থেকে পরিষ্কার করে ভবিষ্যতের কৃত কর্তব্য জেনে নেন। তিনি আদিল শাহের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য শয়তানি চাল(হরকৎ নাহানজার) চালার অভিযোগ আনেন এবং বলেন যে যে আদিল শাহ গোপনে কর্ণুলের সিদ্দি ঝাউহরকে দিয়ে গাণ্ডিকোটা আর গুটি এবং তাঁর আশেপাশের এলাকায় অভিযান চালাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এমন কি এই কাজের বিরুদ্ধে তিনি তার বোন বড়ি সাহেবাকে(আদিল শাহের স্ত্রী)র মধ্যস্থতা চেয়েছিলেন। কুতুব শাহ, তাঁর বিজাপুরী দূত হাজি নাসিরাকে নির্দেশ দেন, তিনি যেন সুলতানকে চাপ দিয়ে ঝাউহরকে নিবৃত্ত করেন এবং এবং যদি প্রয়োজন হয় তাহলে তাকে হুমকি দেন; যে কোন ভাবে তাকে চাপে রাখতে তাকে বলেন সুলতান। তিনি স্বীকার করেন, আদিল শাহের সঙ্গে তাঁর এই বিরোধ তাদের যৌথ স্বার্থের বিরোধী, এবং তাঁর ফলে হয়ত তাদের শক্তিশালী শত্রুর হাতকেই শক্ত করা হবে, যারা এ ধরণের ঘটনা ঘটার জন্য অপেক্ষা করে রয়েছে। মীর জুমলা নিজে খান মহম্মদ ইখলাস খান এবং কুর্ণুলের সুবাদার সিদ্দি আবদুল ওয়াহবকে কে চিঠি লিখে সমস্ত ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।

কথার যুদ্ধের পর শস্ত্রের যুদ্ধ লেগে গেল দুপক্ষের মধ্যে। এই ঘটনা ১৪ জানুয়ারি ১৬৫২ সালের সেন্ট জর্জের একটা চিঠি থেকে আমরা জানতে পারি, ‘গোলকুণ্ডা আর ভিজাপুরের মুর(মুসলমান)দের মধ্যে যুদ্ধ লেগেছে, দূর থেকে জেন্টু (রয়াল) রাজা সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে, যাতে সে তাঁর দুরবস্থা বদলাতে পারে...’ আদিল শাহ খনইখানান, খান মহম্মদকে মীর জুমলার অধিকার করা দুর্গ দখলের জন্য পাঠায়। গাণ্ডিকোটায় যাওয়ার পথে চন্দ্রগতিতে একটা দুর্গ দখল করেন। আক্রমণকারীরা বাইরে থেকে কামান দাগে আর দুর্গের বাসিন্দারাও তাঁর জবাব দেয়। কিন্তু আদিল শাহের পক্ষে এত পরিমান গোলা বর্ষণ করা হয় যে দুর্গের আর কেউ বেঁচে ছিল না। এরপর তারা দুর্গ ছেড়ে এগিয়ে গিয়ে মীর জুমলার গাণ্ডিকোটায় আক্রমনের জন্য অভিযান শুরু করে। তাদের পরিকল্পনা ছিল দুর্গ আর গোটা গ্রামকে ধুলায় মিশিয়ে দেওয়া।

মীর জুমলার সেনাবাহিনীতে ছিল মুঘল, আফগান, পাঠান এবং রাজপুতদের বিশাল ফৌজ। তিনি বহু কষ্টে তাদের সংগ্রহ করেছেন এবং তাদের দক্ষতার জন্য তিনি খুব গর্বিতও ছিলেন। এই বিশাল বাহিনী নিয়ে তিনি খানইখানানের বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়ালেন। দুর্গের পিছনের দিকে গিয়ে বাহিনীকে তিনি কয়েকটা টুকরো করে ভাগ করলেন নানান কৌশলগত যায়গায় রাখলেন। তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি মহম্মদ খান লোদি একটি গাড়িতে তুলে তাঁর পিছিনে বিশাল বাহিনী জড়ো করা হল। যুদ্ধে তাঁর মুখোমুখি হলেন বীজাপুরি সেনাপতি বাজি ঘোরপাড়ে(মুঢৌলএর)। যুদ্ধ শুরু হতে না হতেই বিজাপুরী অশ্বারোহী বাহিনী বিপক্ষের অশ্বারোহী বাহিনীকে বল্লম নিয়ে দুপাশ থেকে আক্রমন করে, প্রচুর হতাহত হয়।

মুহম্মদ খান লোদি ঘোড়া থেকে পড়ে যান এবং তাঁর মাথা থেঁতলে যায় সেনাবাহিনীর মধ্যে পড়ে গিয়ে, তাঁর মধ্যেই প্রচুর সেনা নিহত হল। গাণ্ডিকোটা থেকে বাজি ঘোড়পাড়ে মীর জুমলাকে বহিষ্কার করল। দুর্গের অধিবাসীরা দূরের জঙ্গল আর পাহাড়ে গিয়ে লুকোল। বিজাপুরী ঐতিহাসিক বিজয় গর্বে লিখছেন, ‘কুতুব শাহের সেনাবাহিনীতে মীর জুমলার মত শক্তিশালী সেনানায়য়ক, সাধারণ একজন উজির বাজি ঘোরপাড়ের হাতে পরাজয় স্বীকার করলেন, এবং মুঠি খোলা ধুলোর মত মিলিয়ে গেলেন।’ এই অপমান জনক হারের পর মীর জুমলা তাঁর উকিলের মার্ফৎ খান মহম্মদের সঙ্গে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব পাঠালেন এই শর্তে, ১) দু লাখ পঞ্চাশ হাজার হুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, যতক্ষণনা এই অর্থ পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ কিছু ঘোড়সওয়ার বন্দী থাকবে, ২) গোণ্ডিকোটা এবং কোক্কানুর দেশটি মীর জুমলার হাতে অর্পণ করতে হবে।

আদিল শাহ শান্তি চাওয়ায় খান, মীর জুমলার উকিলকে সম্মান জানালেন, এই শর্ত তারা মেনে নিচ্ছেন এই কারণে যে, দুর্গের এবং দুই পক্ষের ক্ষতির অর্থ দুর্গে রক্ষিত অমেয় পরিমাণ সম্পদের বিনাশ সাধন। আদিল শাহ এই চুক্তি মেনে নিলেন। স্বাক্ষর হল ১৬৫২ সালের ১৪ জানুয়ারি থেকে ১২ ফেব্রুয়ারির মধ্যের কোন এক সময়ে – শর্ত হল – ১) মীর জুমলা যে গোণ্ডিকোটা আর কোক্কানুর দেশ দখল করে ছিলেন সেটি তাঁর দখলে থাকবে; ২) খান মহম্মদ পেল ৫ লাখ ৫০ হাজার হুণ অর্থ এবং মণিকারের চোখ ছানাবড়া হওয়ার মত বিশালাকার চারটি হীরে, এগুলি সব আদিল শাহের সভায় পাঠানো হল।

হারের পর মীর জুমলা আর বীজাপুরী সেনানায়ক খান মহম্মদ যৌথ বাহিনী নিয়ে কর্ণাটক উচ্চভূমির রাজধানী পেনুকোণ্ডা। যদিও সিদ্দি রাইহান শোলাপুরী(যার অভিভাভক, অম্বর কালা সুলতানের নির্দেশে নিহত হয়) সেরায় স্থানীয় রাজাদের সঙ্গে মিলে বিদ্রোহী হয়েছিলেন – বিশেষ করে মহীশূরের রাজা, যিনি জগদেব দেশ দখল করেন, এবং কর্ণাটক আর মুলুন্দে ইনকিলাব আনেন, এবং তার বাহিনীতে ৪ লক্ষ পদতিক, ৪০০০০ হাতি ছিল। খান মহম্মদ এ সব নিয়ে চিন্তা করতে রাজি ছিলেন না। পেনুকোণ্ডা আক্রমন করেন এবং রাজা শান্তি চুক্তি চান এবং দুর্গ পরিত্যাগ করে কান্দর্পিতে চলে যান, পেণ্ডুকোটার নাম হয় তাখাতইমুবারক। কিন্তু কর্ণাটকে যুদ্ধ থামার কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না। আগের মতই দুর্দমভাবে চলতে লাগল। খান মহম্মদ সভায় ফিরে এসে আক্রমনে বিরতি দিলে শ্রী সঙ্গ রয়াল মহীশূরের রাজার সঙ্গে হাত মিলিয়ে হারানো গড় ফিরে পেতে চাইলেন। তিনি কুতুব শাহী বাহিনীকে ঠেকিয়ে দিলেন। কিন্তু মহীশূরের বাড়বাড়ন্তিকে ছেঁটে দিতে প্রথমে জগদেব দেশ, তারপর কৃষ্ণগিরি দুর্গ দখল করে মহীশূরের দুর্গ অবরোধ করলেন এবং শেষ পর্যন্ত রাজার চারটি দুর্গ নিজের আয়ত্ত্বে আনলেন। জিঞ্জির দিকে যেতে গিয়ে, গোলকুণ্ডার অধিকৃত এলাকা পার হতে বিজাপুরী সেনানায়ক, মীর জুমলার অনুমতি চাইলেন। বিজাপুরীদের কর্ণাটকের বিভিন্ন অঞ্চলে অগ্রগতিতে শঙ্কিত হলেন মীর জুমলা কেননা তাতে তাঁর আধিপত্যের, ক্ষমতা ধরে রাখার পরিকল্পনায় আঘাত লাগতে পারে। তিনি বিভিন্ন নায়ককে এবং কর্ণাটকের রাজাকেও উসকাতে শুরু করলেন। মহীশুরের নায়ক, বিজাপুরী বিদ্রোহী, সিদ্দি রাইহানের সঙ্গে হাত মেলালেন, সিদ্দি সম্প্রতি মুস্তাফার দখল করা দুর্গগুলি দখল করেছেন। মীর জুমলার আশ্বাসে শ্রী রঙ্গ রয়াল ভেলোরে ফিরে এসে লড়াই দেওয়ার জন্য বড় সেনা তৈরি করার চেষ্টা করতে লাগলেন। বিজাপুরের ঐতিহাসিক লখছেন, ‘আদিল শাহ নির্দেশ দিলেন শ্রী রঙ্গ ঝামেলা শুরু করে দিয়েছে, এবং উকিলের মাধ্যমে মীর জুমলার সঙ্গে কথা বার্তা চলছে। তারা ৫০ লাখ হুন আর ৪৫ টা হাতি মুঘলদের দিতে রাজি। এই বাবদে মীর জুমলা দায়িত্ব নিয়েছে। সে মুঘলদের প্ররোচিত করছে রাজাকে সাহায্যের জন্য এগোতে।’

মীর জুমলার কূটনীতি বিজাপুরের রণনীতিতে পরিবর্তন ঘটাতে বাধ্য করল। খান মহম্মদ তাঁর সব বিজিত ভূমি দুর্গ ইত্যাদি পিছনে ফেলে মহিশূরের নায়কের সঙ্গে যুদ্ধ করতে এগিয়ে গেল। বিজাপুরের সুলতান, খান মহম্মদকে নির্দেশ দিলেন প্রথমে রয়াল রাজ্যকে আক্রমন করার, যাতে সে মীর জুমলার সঙ্গে যোগাযোগ না করতে পারে। ১৬৫৪ সালের ৭ নভে বিজাপুরী সেনা ভেলোর দখল করে। রয়াল খান মহম্মদের সঙ্গে রাজস্ব বাঁটোয়ারা এবং চন্দ্রাগিরি হাত বদল করার চুক্তি করে। রয়াল উত্তর তাঞ্জোরের আকল নায়েকের জঙ্গলে পালিয়ে যান। রাজত্ব ছাড়া রাজা গভীর জঙ্গলে চরম দারিদ্রে দিন কাটাতে থাকলেন। শেষে একদা তাঁর অধীনস্থ মহীশূরের রাজার আশ্রয়ে থাকলেন।

চন্দ্রগিরি আর মহীশূরের দুই রাজা গোলকুণ্ডা বাহিনী যে সব এলাকা দখল করেছিল সেগুলি তারা দখল করতে চাইল। কিন্তু মাদুরার নায়ক তাদের সাহায্য না করে খান মহম্মদকে মহীশূর বাহিনীকে তাড়াবার এবং পাহাড়ি রাস্তা খুলে দেওয়ার জন্য আবেদন করলেন। আতুর থেকে মাদুরা পর্যন্ত তিনি লুঠ করলেন। মহীশূরের রাজা বালাজী হইবত রাওকে পাঠালেন খান মহম্মদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে। তিনি সিদ্দি মাদুদকে পাঠিয়ে ফিরে গেলেন। সিদ্দি, বালাজীর মাথা কেটে নেন। রাজা ক্ষমা প্রার্থনা করেন। মাদুরার রাজা তাঁর শত্রুকে ধ্বংস করার জন্য খান মহম্মদকে নগদ অর্থ, ৫০টা হাতি, বিপুল রাজস্বর প্রতিশ্রুতি দিলেন। শ্রী রঙ্গ তাঁর শেষ বন্ধুও হারালেন।

১৬৫৩ সালে দাক্ষিণাত্যের শেষ হিন্দু রাজ্যগুলি নিজের দুর্বলতা, ব্যক্তিগত অসূয়ার জন্য মানচিত্র থেকে উধাও হয়ে যায়। তবে মহীশূর আর মাদুরা কিছু দিন লড়াই করে। বিজয়নগর রাজ্য মুছে ফেলার একটা বড় কাজ করেছেন আর্দিস্তানি মীর জুমলা, তাঁর কূটনৈতিক দক্ষতা প্রয়োগ করে।

তৃতীয় অধ্যায় কর্ণাটকে মীর জুমলার প্রশাসন[সম্পাদনা]

১। কর্ণাটক বিজয়ে মীর জুমলার আবিসংবাদী আধিপত্য অসম্ভব বীরত্ব, অসাধারণ শক্তি স্ফূর্তি, এবং গভীর কূটনৈতিক দক্ষতা, বিশাল প্রশিক্ষিত বাহিনী এবং ইওরোপিয় গোলান্দাজদের সহায়তায় মীর জুমলা পূর্ব উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকা – মাদ্রাজ এবং পূর্ব কর্ণাটকই দখলই শুধু করেন নি, বিজাপুরি কর্ণাটকেও তাঁর দাঁত ফুটিয়েছিলেন। তাত্ত্বিকভাবে ৩০০ মাইল লম্বা আর ৪০ থেকে ২০০ মাইল চওড়া বহু হিরের খনির, বছরে ৪৩ লক্ষ টাকা রাজস্বের, বহু সুরক্ষিত গড়ের এই অঞ্চল আবদাল্লা কুতুব শাহের হাতে এসে পড়ল। স্বাভাবিক ভাবেই তিনি তাঁর নতুন প্রাপ্তিতে খুবই উচ্ছসিত হয়ে, বিশেষ করে গণ্ডিকোটা দখল করার পর তাঁর মূল সেনাপতিকে নওরোজইখিলাত উপাধি দেন তা আগের অধ্যায়ে বলেছি। এ ছাড়াও তিনি কর্ণাটকের বহু ওয়াকফ গ্রামের মুতাওয়ালি তাঁকে দান করেন। তিনি তাঁর সেনাপতির ক্ষমতায় এতই বিশ্বাস করতেন যে তিনি মীর জুমলাকে কর্ণাটক সরকারের তরফদারের পদটিও দান করেন। অন্তত কয়েক কাল ধরে মীর জুমলার আচরণ ছিল যেন সরইলস্কর বা সুলতানের সেনাধ্যক্ষ। তিনি সুলতানকে লিখলেন, ‘প্রায় সব উজির জমিদার, মানিওয়ার এবং সর্দার এবং মধ্যসত্ত্বভোগী এই অভিযানে তাদের শেষ ক্ষমতা টুকু দিয়েছেন। আপনি যে উপহারগুলি পাঠিয়েছেন, তাঁর সবইটাই তাদের দিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তারা আপনার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেছেন। প্রত্যেকেই আপনার কৃপাদৃষ্টি অর্জন করতে চায়, এবং প্রত্যেকজন যুদ্ধের মাঠে তার ক্ষমতা দেখিয়ে সেই কৃপাদৃষ্টির যোগ্য হয়ে উঠুক। আর আমার বিষয় নিয়ে বলি, আমি এই অঞ্চলের প্রশাসন, তাকে গড়ে তোলা, ছোট থেকে বড় সকলের ভালবাসা অর্জন, সেনার সুখ আর প্রজাদের শান্তি প্রদান এবং শত্রুকে পরাজিত করার কাজে ক্ষান্তি দেব না। আমি আমার ক্ষমতার সব কিছু উজাড় করে দিয়েছি। আমার বিনীত প্রার্থনা, আপনি আমায় সবসময় পথ প্রদর্শন করুণ।’ ১৭ জানুয়ারি ১৬৫১ সালের ব্রিটিশ কোম্পানি ওয়াল্টার লিটন আর ভেঙ্কট ব্রাহ্মণকে নবাবের কাছে দৌত্যে পাঠিয়েছিল। তারা সেখানে আবিষ্কার করে, নবাব(মীর জুমলা)বছরে ২০ লক্ষ প্যাগোডা পরিমান রাজস্ব রাজার (সুলতান) কাছে পাঠাচ্ছে। কূটনৈতিক দক্ষতায় এবং সুতচুর পদক্ষেপে মীর জুমলা ক্রমে ক্রমে বিজিত এলাকার সমস্ত ক্ষমতার দখল নিজের তাঁবেতে নিয়ে আসেন। সেন্ট জর্জ দুর্গের কুঠিয়াল দেখছেন(৪ জানুয়ারি, ১৬৪৭)), ‘যুদ্ধ পরবর্তী মন্বন্তর এই এলাকায় গেড়ে বসেছে। আনা বব(নবাব) মীর জুমলা পুলিকান(পুলিকট) আর সেন্ট থোম দখল করে সারা দেশ কব্জা করে নিয়েছে...’। আদতে এটা কুতুব শাহের কূটনৈতিক চাল। তিনি পুলিকটে ডাচেদের নির্দেশ(হাসবুল হুকুম) দিয়ে বলেন মীর জুমলার সাথে সম্পাদিত চুক্তি পালিন করতে হবে, ‘যাতে তিনি কসবা, গড়টি আর পুলিকট বন্দরটি তার প্রশাসনের আওতায় নিয়ে আসতে পারেন।’ মীর জুমলা মাদ্রাজের ওপর ব্রিটিশদের দখলের ১৬৩৯ সালে দেওয়া দারমালা ভাইদের আর ১৬৪৫ সালের দেওয়া শ্রী রঙ্গার পাট্টা বজায় রাখলেন। সুলতানের সঙ্গে তার সেনাপতির অদর্শনে বিচ্ছেদ বাড়তে থাকায়, মীর জুমলা নিজে কর্ণাটককে নিজের খাস তালুক বানাতে নতুন করে যুদ্ধে যাওয়ার উদ্যোগ নিলেন। পারস্যের উজির খালিফাইসুলতানকে লেখা এক চিঠিতে মীর জুমলা লিখছেন, ‘এই অঞ্চলের(অর্থাৎ কর্ণাটকের) সব রাজা, বিদ্রোহী আমার আওতায় এসেছে।’ দেখা যাচ্ছে, চন্দ্রগিরির রাজ মুকুট প্রথমে কুতুব শাহ নিজের মাথায় তুলে নিলেও, তা পরে স্বেচ্ছায় এবং চাতুর্যের সঙ্গে মীর জুমলা নিজের মাথায় পরাচ্ছেন।

২। মীর জুমলার প্রশাসন মীর জুমলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা তার রাজত্বের দ্বৈতসত্ত্বা চরিত্রের প্রকাশ। তিনি পূর্ব কর্ণাটকের প্রাক্তন বিজয়নগর রাজ্যের প্রধান হয়ে উঠেছিলেন, এবং সেই রাজ্যের এবং নায়কদের যে প্রশাসন তিনি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন, তাতে তিনি কিছুটা পরিবর্তন আনেন – রাজা পরিবর্তন হলে প্রশাসনের চরিত্র ও কর্মশক্তিরও বদল হয়। এছাড়াও কুতুব শাহী জায়গিরের প্রধান হওয়ায় তিনি সেগুলিকে স্বাধীন রাজ্যে রূপান্তরিত করেন এবং গোলকুণ্ডায় যে প্রশাসনের স্বাদ তিনি পেয়েছিলেন, সেটি সেখানে প্রয়োগ করার উদ্যোগ নিলেন। এখানে বিশদে আর গভীরে গিয়ে কর্ণাটকে মীর জুমলার প্রশাসনিক ব্যবস্থার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া এখানে সম্ভব নয়, এছাড়াও সেখানে থাকার তার সময় এত বেশি ছিল না যে তিনি তার অনপণেয় দক্ষতার ছাপ সেখানকার প্রশাসনে ছেড়ে আসতে পারেন। তিনি কোন দিনই থিতু হওয়ার সময় পাননি- সারাক্ষণ খুবই ব্যস্ত ছিলেন, একদিকে যুদ্ধের পর যুদ্ধ করে দেশ জয়ের পরিকল্পনা, তার পরে গোলকুণ্ডা সুলতানির সংগে তার ক্রমাগত বিরোধ এবগ সম্পর্কের অবনতি এবং সব শেষে কর্ণাটক ছেড়ে মুঘল সাম্রাজ্যের কাজে যোগ দেওয়া।

আমাদের ধারণা মীর জুমলা বিজয়নগর সাম্রাজ্যের গ্রামীন সংগঠনের ধারাটি গ্রহন করেছেন, কেননা বহু ইওরোপিয় নথিতে বিজয়নগর রাজ্যের প্রশাসনের যে সব পদের নাম পাওয়া যায় – যেমন নটবর বা নাড়ু বা কয়েকটি গ্রামের প্রধান, বা কারনাম বা কাণক্কপিল্লাই বা হিসেব রক্ষক, তালয়ারি(স্থলওয়ার) বা টুকরি বা গ্রাম রক্ষক, পোলিগার বা পুলিশ প্রধান, ইত্যাদি, সেগুলি তার প্রশাসনেও ব্যবহার করেছেন তিনি।

গোলকুণ্ডা ছিল মীরজুমলার প্রশাসনের মূল কেন্দ্র। এক দিকে হায়দারাবাদ (কাম্বম, মাছরেলা, দাবারকোণ্ডা এবং হায়াতনগর হয়ে) পর্যন্ত অন্যদিকে মাদ্রাজ পর্যন্ত। ছড়িয়ে থাকা ব্রিটিশ কুঠি নথি সূত্রে আন্দাজ করে নেওয়া যায় যে, যে সব এলাকা মীর জুমলা দখল করেছেন, বিশেষ করে মাদ্রাজের আশেপাশের এলাকা, সেগুলিকে কতগুলি ছোট ছোট প্রশাসনিক এলাকায় ভাগ করেছিলেন এবং প্রত্যেক এলাকায় প্রশাসক(গভরণর) নিযুক্ত করেন।

ব্রিটিশ নথি সূত্রে পাচ্ছি, মাল্লাপ্পা, সৈয়দ ইব্রাহিম তিম্মাজি বালা রাউ এবং মীর সৈয়দ আলি মীর জুমলার পক্ষ থেকে ১৬৫৫-৫৮ সালে ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। উইলিয়ম ফস্টার এবং মিস্টার লাভ, মাল্লাপ্পা আর তিম্মাজির সম্পর্কে লিখেছেন, মাদ্রাজ কুঠিতে(চোল্ট্রি) তারা ছিলেন নবাবের আদিগর বা প্রতিনিধি। কিন্তু এটাও মনে হয় মাল্লাপ্পা শুধু যে মাদ্রাজে নবাবের আদিগরের কাজ করতেন তাই নয়, তিনি পুনামাল্লিতে প্রশাসকরূপেও দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। ১৬৪৭ সালের জুন মাসে ব্রিটিশদের শ্রী রঙ্গ বাণিজ্য সুবিধে দেওয়ার পরে মীর জুমলা মাল্লাপ্পা এবং ব্রিটিশ কুঠিয়ালকে মাদ্রাজে পাঠিয়েছিলেন তার প্রশাসনের দেখাশোনা করতে। মাল্লাপ্পা সেখানে পূর্বের প্রশাসকের চরিত্রের মতই সাত বছর ধরে প্রশাসন কার্য পরিচালনা করেন। সৈয়দ ইব্রাহিম, মাল্লাপ্পার স্থলে পুনামাল্লিতে প্রশাসক নিযুক্ত হলেন, এবং তিনি তিম্মাজীকে নবাবের আদিগর হিসেবে মাদ্রাজে পাঠালেন। ১৬৫৩ সালে জুলফিকার আস্তারাবাদীর পুত্র রুস্তম বেগ, পুনামাল্লির হাবিলদার নিযুক্ত করেন।

মীর জুমলা যে শুধু ভাল দেশ নায়ক ছিলেন তাই নয়, তিনি ভাল আর্থিক প্রশাসকও ছিলেন। তিনি কর্ণাটকের আর্থিক শৃঙ্খলার ভার গোলকুণ্ডা নিয়োগী নামক ব্রাহ্মণ প্রশাসাকদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। কর্ণাটক থেকে সারা বছরে তিনি ৪৩ লক্ষ টাকা রাজস্ব তুলতেন। তার রাজত্বের আয়ের জায়গাগুলি ছিল ১) ভূমি রাজস্ব। ২) কর্ণাটক জোড়া লুঠ, ৩) হীরের খনি, ৪) একচেটিয়া ব্যবসা সহ রাজত্বের উতপাদনের ওপর আর ব্যবসা থেকে আয়, ৫) আমদানি-রপ্তানি শুল্ক, ৬) পথ কর, ৭)দাস ব্যবসা চালানোর পঞ্জিকরণ, 8) উপহার সামগ্রী, ৯) আদায়(ইম্পোজিসন্স)।

তার ভূমি রাজস্বএর প্রশাসন, চাষ থেকে আদায়ের ওপর জোর দিয়েছিলেন। ইসলামি আইনে জমি আর জমির সঙ্গে জুড়ে থাকা মানুষের চরিত্র আর শ্রেণী বদলে গেল, ফলে জমির পরিমাণ অনুযায়ী গ্রামের সম্পত্তি আর জমির রাজস্ব নির্ধারণ করা হল।

তিনি দুর্গ দখল, অঞ্চল লুঠ, বিভিন্ন মন্দিরের সিন্দুক লুঠ করে বিপুল পরিমান সঞ্চয়ে থাকা সম্পত্তি, লুকোনো ধনসম্পদ উদ্ধার করেন। কারটু বলছেন, কর্ণাটকী সম্পদশালীদের প্রত্যেকের বাড়িতে যা সোনা দানা রত্নরাজি যা আছে সেগুলি তাকে দিতে তিনি বাধ্য করেছিলেন। এবং যারা রত্নরাজি জমির ভিতরে লুকিয়ে রেখেছিলেন, সেগুলি উদ্ধার করে দেশের তাদের আইন অনুযায়ী তাদের চাবুক মারা হত। থেভেনট বলছেন মীরজুমলা, একজন রাজার মত সম্পত্তি দখল করেছিলেন, তার ছিল কর্ণাটক লুঠ করে উদ্ধার হওয়া ২০ মনের হিরে।

গোলকুণ্ডার বিশ্ব খ্যাতি ছিল তার হীরের জন্য। সেখানে শুধু হীরের খনিই ছিল না, সেগুলি পালিস করা আর কাটার কাজও সেখানে হত। এই কাজ থেকে রাষ্ট্র বিপুল প্রমান রাজস্ব উদ্ধার করত। কর্ণাটকে হিরের খনি রয়েছে, এই খবর পেয়ে মীর জুমলা সে দেশ আক্রমন করার এক বছর আগেই বারো হাজার শক্তপোক্ত চুক্তিভূক্ত কৃষি শ্রমিককে সেই অঞ্চলের খনিগুলিতে পাঠান হিরে তোলার কাজ করতে এবং যখন এক বছর পরে সেখান থেকে পাঁচটা ছোট থলে ভরা হিরে পেলেন, তাতে তার মন ভরল না, তার আফসোস হল, তিনি প্রত্যেককে ক্ষতিপূরণ দিয়ে কৃষিকাজে পাঠিয়ে দিলেন। গোলকুণ্ডার কৃষ্ণা নদীর তীরে সব থেকে বড় হিরে তোলার কুল্লার খনি তার প্রশাসনিক ব্যবস্থার মধ্যেই ছিল, সেগুলি তাকে ধনীতম ব্যবসায়ী বানিয়েছিল। সেগুলি তিনি তার আত্মীয় আর বন্ধুদের মধ্যে বেঁটে দিয়েছিলেন, কিন্তু সব থেকে বড় আর সব থেকে কাজের খনিটি নিজের জন্য রেখেছিলেন। তার খনিতে ৬০ হাজার বাচ্চা, পুরুষ আর নারী কাজ করত, যে পাথরগুলি উঠত তার ওজন ছিল ৪০ থেকে ৯০০ ক্যারট। তার হীরে ব্যবসার প্রশাসনটা বীজাপুরী কর্ণাটকের রাওলকোডা খনির মত করে চলত – মধ্যস্থরা হিরের খনির জন্য ২ শতাংশ এড ভ্যালোরেম ট্যাক্স দিতে হত সরকারকে। আমরা জানি না মীর জুমলার খনি হিরে ছাড়া গন্ধর্বমণি(এগেট), পদ্মরাগমণি/নীলকান্তমণি(আমেথিস্ট), পোখরাজ(টোপাজ)এর মত দামি রত্ন উঠত কি না। তবে তিনি পারস্য উপসাগর থেকে মুক্তো আমদানি করে তা রপ্তানি করতেন। তাভার্নিয়ে যখন প্রথম গোলকুণ্ডা আসেন(১৬৫২) তিনি মীর জুমলাকে এই ধরণের মুক্তো বিক্রি করতে চেয়েছিলেন। হীরে ছাড়া মীর জুমলার কর্ণাটকে বিজোয়ার(bezoar??), লোহা-ইস্পাত, সোরা উতপাদন হপ্ত। মীর জুমলা বিপুল পরিমান সোরা উতপাদন এবং সংগ্রহ করতেন প্রতি বছর।

মীর জুমলার খুব বড় এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনাযুক্ত ব্যবসা দেশ এবং বিদেশে ছড়ানো ছিল। এই ব্যবসাও তার নিজের আর রাজত্বের রাজস্বের বড় উৎস ছিল। এছাড়াও তার অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা ছিল একচেটিয়া চরিত্রের। তিনি পণ্যের একচেটিয়া দাম ধার্য করতেন এবং উতপাদন নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি বিজিত এলাকাগুলিতে কোরা(ব্রাউন, ব্লিচ না করা) কাপড়ের উতপাদনের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন এবং ২০% লাভে সেগুলি বিক্রি করতেন। এছাড়াও দানা শস্যের ব্যবসাতেও তার দখল ছিল। ধান এবং অন্যান্য শস্য, মাদ্রাজে তার প্রশাসনের আওতায় এলে তাকে আমদানি শুল্ক দিতে হত, এবং বাজারের দামের তুলনায় শহরে ধান ২৫% বেশি দামে বিক্রি হত। ব্রিটিশদের, নবাবের ঠিক করে দেওয়া নির্দিষ্ট কৃষক থেকে দ্রব্য কিনতে হত, এবং তা তার প্রতিবেশীর কৃষকের তুলনায় ৫০% বেশি দামে। সব ধরণের আমদানি দ্রব্যের ওপর তিনি একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেছিলেন। অথচ তার পণ্যগুলি পারস্য এবং পেগুতে যেত কোন রপ্তানি শুল্ক ছাড়াই।

তার আমদানি রপ্তানি প্রশাসন ছিল কুতুবশাহী আর বিজয়নগরীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থার জোড়াতালি। সুলতান, ব্রিটিশদের ১৬৩৪ সালে যে বাণিজ্য স্বর্ণ ফরমান দেন, তিনি তার শর্তগুলি কড়া হাতে প্রয়োগ করেন। দ্বিতীয়ত হিন্দু রাজা শ্রী রঙ্গের উত্তরাধিকারী হিসেবে মাদ্রাজ শহর আর মাদ্রাজপত্তনম বন্দরের অর্ধেক শুল্ক নিজে নিতেন। মাদ্রাজ, স্যান থোম, মাইলাপুর এবং অন্যান্য এলাকায় এই শুল্ক সংগ্রহ করার জন্য নবাব তার কর্মচারী (আদিগর বা আধিকারিক) নিয়োগ করেছিলেন। এই কর্মচারীদের সঠিকভাবে কাজ করিয়ে নেওয়া তার প্রশাসনের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল, কেননা শুল্ক ফাঁকির, লুঠের প্রবণতা সর্বব্যপ্ত ছিল। মাদ্রাজের প্রশাসক(আদিগর) মাল্লাপ্পা নিজে থেকে ব্রিটিশ চোল্ট্রিতে দাঁড়িয়ে থেকে দেখতেন যাতে সঠিক শুল্কের অংশ মীর জুমলার কাছে সঠিকভাবে পৌঁছয়।

ব্রিটিশদের আপত্তি সত্ত্বেও পথ কর লাগু ছিল। এছাড়া দাসেদের পঞ্জীকরণ করানোর জন্য অর্ধেক টাকা নবাব নিতেন। পাট্টাপল্লীর ব্রিটিশ কুঠিয়াল, জন লে’কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মাদ্রাজের চোল্ট্রিতে এক হপ্তা অন্তর বিচার করার, তিনি লিখছেন, ‘১৮ ডলারের শুল্কের অর্ধেক তারা(শুল্ক আদায়কারী আধিকারিকরা) পেতেন বাকি অর্ধেক নবাব।’ মীর জুমলাকে বিভিন্ন কোম্পানির দেওয়া উপহার তার বড় রোজগার ছিল। প্রয়োজনে, অতিরিক্ত অর্থ চেয়ে নেওয়া হত।

তার অপরাধ বিচার ছিল ত্বড়িতগতির এবং নির্মম। ১৬৫২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর তাভার্নিয়ে লিখছেন, ‘কাউকে জেলে বন্দী করে রাখার নীতি ছিল না। কেউ যদি অপরাধে অভিযুক্ত হত তাকে ধরে এনে সঙ্গে সঙ্গে বিচার করা হত। সে যদি নির্দোষ হত তাকে সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া হত। বিচার হত অপরাধের চরিত্র অনুযায়ী।’ একদিন তিনি এই ধরণের বিচারে ছিলেন, ‘...পরের দিন গিয়ে দেখলাম চার জন তার তাঁবুর বাইরে দাঁড়িয়েছিল। তিনি প্রায় আধ ঘন্টা চুপচাপ রইলেন; তিনি এবং তাঁর সহকারী লিখেই যেতে লাগলেন; হঠাত তিনি চারজনকে ভেতরে নিয়ে আসতে বললেন; চার জন এলে, তিনি তাদের মুখ থেকে অপরাধের স্বীকারোক্তি করিয়ে নিলেন, তার পর একঘন্টা চুপকরে থেকে নিজে আর তার সহকারী সচিব আরও কিছু লিখে চললেন।’ কয়েকজন সেনা আধিকারিক ঘরে ঢুকে এসে তাকে অভিবাদন করে দাঁড়াল, তিনি তার মাথা নামিয়ে উত্তর দিলেন শুধু। এক জন অভিযুক্ত, যে একটা ঘরে ঢুকে মা আর তার তিন শিশুকে খুন করেছিল, তার হাত পা কেটে তাকে মাঠে ছুঁড়ে ফেলে দিতে, একজন যে চুরি করেছিল, তার পাকস্থলি কেটে বার করে রাস্তায় ফেলে দিতে বললেন, অন্য দু জনের অপরাধ আর শাস্তি না শুনেই তাভার্নিয়ে পালিয়ে যান।

ওপরের চোখে দেখা ঘটনার বর্ণনা থেকে আমরা বুঝতে পাচ্ছি যে, কিভাবে মীর জুমলা তার প্রশাসন চালাতেন। তাভার্নিয়ের আরও একটা বর্ণনা থেকে তুলে দেওয়া যাক আরেকটি উদাহরণ, ’১৫ সেপ্টেম্বর সাতটায় নবাবের কাছে গেলাম। তিনি আমাদের তাঁবুতে ঢুকতে বললেন। দেখলাম সেখানে তিনি তার দুজন সচিবকে নিয়ে বসে রয়েছেন। ভারত আর পারস্যের রাজসভার রীতি অনুযায়ী নবাবের কাছে যেতে হয় খালি পায়ে মোজা ছাড়া শুধু একটা চপ্পল পরে, কেননা আমাদের মাটিতে গালিচার ওপরে বসতে হবে। এছাড়াও যেভাবে আমাদের দেশের দর্জিরা(মাটিতে বসে) কাজ করে, দেখা গেল নবাবের বাঁ হাতে আর পায়ে ধরা রয়েছে প্রচুর চিঠির গোছা। সেই চিঠিগুলিতে তিনি হয়ত কখনো সখনো পায়ে ছবি আঁকেন, কখনো আবার হাতে, এবং তার দুজন সচিবকে দিয়ে লেখাচ্ছেন, কখনো তিনিও লিখছেন। এরপর চিঠিগুলি প্রাপকদের কাছে পৌছন হয়।’ মীর জুমলা দুজন সহকারীকে চিঠিগুলি জোরে পড়তে বলে, নিজে হাতে নেন এবং নিজের হাতে সেগুলি সিলমোহর করেন। কিছু চিঠি যায় রাণার মার্ফত আর কিছু যায় ঘোড়সওয়ার মার্ফত।

খবর আদান প্রদানের জন্য হায়দ্রাবাদ কর্ণাটকের মধ্যে ডাকচৌকি স্থাপন করেছিলেন। এই চৌকিগুলোর কাজ তাভার্নিয়েকে যথেষ্ট প্রভাবিত করেছিল। সেগুলিরই অসামান্য বিশদ বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, ‘প্রত্যেক দু লিগ(১১ কিমি) অন্তর একটি করে ছোট চৌকি(কুঁড়ে ঘর)তে রয়েছে, দু থেকে তিন জন রাণার। কোন রাণার দৌড়ে চিঠি নিয়ে কোন একটা চৌকিতে পৌছলে, চৌকিতে বসে থাকা একজনের সামনে সেটি ছুঁড়ে দেন, তিনি সেই চিঠিটি কুড়িয়ে নিয়ে বিদ্যুতগতিতে ছুটে বেরিয়ে যান। কোন রাণারকে চিঠি হাতে দেওয়া প্রথা ছিল না – অমঙ্গল হিসেবে ধরা হত, সেটি তাঁর পায়ের কাছে ছুঁড়ে দেওয়া হত। অন্য জন সেটি কুড়িয়ে বেরিয়ে যেতেন।’ তাভার্নিয়ে বলছেন ঘোড়ার ডাকের তুলনায় রাণারদের ডাক খুব দ্রুতগামী ছিল, সেই জন্য সারা দেশে রাণার ডাকচৌকি বসানো ছিল। তাভার্নিয়ের আর তার দলবল যখন গোলকুণ্ডা থেকে ১৩ লিগ(প্রায় ৭০ কিমি) সীমান্তের কোন এক নদীর দিকে যাচ্ছিলেন, তখন মীর জুমলা তাদের ১৬ ঘোড়ার পথপ্রদর্শনকারী দল দিয়েছিলেন পথ দেখাবার জন্য।

পথের পথিক আর বণিকদের নিরাপত্তার একটা ব্যবস্থা ছিল সেই সময়। মীর জুমলার কর্ণাটক আর গুটির রাজত্বের (১৬৫০) সময় বণিকদের পথে পণ্য লুঠ হয়ে যাওয়ার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার উদাহরণ পাওয়া যচ্ছে সে সময়ের লেখগুলি থেকে। এটা ধরে নেওয়া যায় তার আগের হিন্দু প্রশাসনেও এটিই নীতি ছিল। পাটাকোট্টাচেরুভুর এক নায়েকের প্রশাসনিক এলাকায় ব্যবসায়ীদের পণ্য লুঠ হয়ে গেলে তাকে শুধু ক্ষতিপূরণ দিতেই হয় নি, তাকে বহু ঝামেলা পোয়াতেও হয়েছিল। মীর জুমলা এ সম্বন্ধে একটি পরওয়ানাও জারি করেন, ‘ওপরে উল্লিখিত গ্রামের কাছাকাছির এলাকায় কিছু ব্যবসায়ীর পণ্য লুঠ হয়েছে, যদিও গ্রামের মানুষেরা এটিকে তাদের এলাকার জমি বলতে নারাজ। এই পণ্যগুলি অন্য গ্রামের(নাক্কাডোডি) দুই ভাই পেড্ডা-তিম্মা আর চিন্না-তিম্মার, তাই পূর্বের গ্রামবাসীরা তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হয়েছে।

সেনা বাহিনী ব্যবস্থাপনা[সম্পাদনা]

৩। সেনা বাহিনী ব্যবস্থাপনা

কর্ণাটকের সুলতান আবদুল্লা কুতুব শাহের অধীনে কাজ করার সময়, বিপুল সুলতানি সেনা বাহিনী ছাড়াও, মীরের নিজস্ব সেনা বাহিনীর বহরও খুব কম ছিল না। আওরঙ্গজেবের বাখানে আমরা জানতে পারছি, মীর জুমলা তার বিপুল বাহিনীকে কর্ণাটকে পাঠিয়েছিলেন। বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ায় বিশাল পরিমান এলাকা দখল, দেখাশোনা এবং সেনা বাহিনী বজায় রাখা সহজ হয়ে গিয়েছিল মীর জুমলার পক্ষে। ওয়াল্টার লিটন এবং ভেঙ্কট ব্রাহ্মণ(১৭ জানুয়ারি ১৬৫১) সূত্রে জানছি যে মীর জুমলার বাহিনীতে ছিল ৩০০ হাতি, ৪০০-৫০০ উট এবং ১০,০০০ যাঁড়(অক্সেন)। ১৬৫২ সালের বিজাপুরের সেনা অভিযানে তিনি উদ্যম নিয়ে মুঘল, আফগান, পাঠান এবং রাজপুত সেনা সংগ্রহ করে বিপুল বাহিনী তৈরি করেন এবং তার জন্য তিনি গর্বিতও ছিলেন। ক্রমে ক্রমে নিজেকে জোরদার এবং আত্মনির্ভর করে গড়ে তুলে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে তিনি কুতুবশাহী সেনাবাহিনীর বহু সেনা নায়ককে(সেনাপতি) ‘অপূর্ব অমায়িক ব্যবহার এবং আনুকূল্য’ প্রদর্শন করে নিজের দিকে টেনে এনে পুরোনো অভিজ্ঞ শাহী সেনার মত সেনা বাহিনী গঠন করেন। মীর জুমলার কাজ সম্বন্ধে সংবাদ সংগ্রহ করতে আওরঙ্গজেব মহম্মদ মুনিমকে পাঠিয়েছিলেন(১৬৫৩-৫৪) – তার বক্তব্য ছিল, মীর জুমলার বাহিনীতে রিসালা (ঘোড় সওয়ার) ছিল ৯০০০ - যার মধ্যে ৫০০০ নিজের আর ৪০০০ কুতুব শাহীর, পদাতিক ছিল ২০০০০ – এ ছাড়াও তার বাহিনীতে সম্পদ হিসেবে ছিল নগদ অর্থ, মনমুগ্ধকর অলঙ্কার, প্রশিক্ষিত হাতি, ইরাকি আর আরবি ঘোড়া, এছাড়াও আত্মমর্যাদা, গৌরব আর সম্মান বৃদ্ধির জন্য যা যা কিছু লাগে সব এবং সেই সেনা বাহিনী তাদের সামরিক দক্ষতার চূড়ান্তে পৌঁছেছিল।

দক্ষ সেনানায়ক মীর জুমলার সেনা বাহিনীর খুঁটিনাটির দিকে প্রভূত নজর ছিল। ১৬৪২ সালে তিনি সেনাবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিন্ত করেন। তিনি শুধু যে সেনার বা পশুর খাবার মছলিপত্তনম, কোণ্ডাপল্লী এবং কোণ্ডাভিডু থেকে বাজার দরে কেনার উদ্যোগ নেন তাই নয়, তিনি শস্যের দালালদের সেনা বাহিনীর সঙ্গে জুড়ে নিয়েছিলেন, যাতে বাহিনীর পণ্য সরবরাহে কোন ছেদ না পড়ে। এছাড়াও তিনি চিঠিপত্রের আদানপ্রদান দ্রুত করতে নিয়মিত ডাকচৌকি স্থাপন করেছিলেন; যাতে সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাজসভার মধ্যে রোজ খবর আদান প্রদান হয়, তাঁর জন্য কবুতর এবং ডাকহরকরা নিয়োগ করেছিলেন। যুদ্ধের আক্রমণাত্মক অস্ত্রশস্ত্রের বিষয়ে তাভার্নিয়ের সূত্রে জানতে পারছি, মাথায় ঝুঁটি বাঁধা পদাতিকেরা কোমরে সুইসদের মত চওড়া তরোয়াল বহন করত, ভালতম ফরাসি কামানের থেকেও মীর জুমলার কামানগুলির মুখ ছিল চওড়া, আরও পোক্ত এবং কামান তৈরিতে সব ভাল লোহা ব্যবহার হত। ঘোড়সওয়ারদের পিঠে তীর ধনুক, যুদ্ধ কুঠার, আর ঢাল থাকত। এবং আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবে থাকত বর্ম, শিরস্ত্রাণ, কাঁধে ঝোলানো লোহার বর্ম-জ্যাকেট, বাহুবন্ধ এবং বর্মের মত করে সারা দেহে আবরণ। কিন্তু সাধারণ পদাতিকেদের ৫ গজের মত কাপড় পরানো হত, যা দিয়ে তাদের সামনে বা পিছন কোনটাই ঢাকত না।

গোলান্দাজদের সঙ্গে ছিল কামান আর গুলতি – যা দিয়ে বিশাল বিশাল আগুণের গোলা বিপক্ষের দিকে ছোঁড়া যায় আর ছিল কামানের জন্য গোলার বড় ভাণ্ডার। মীর জুমলার এই বিভাগটা দেখত ফরাসি আর অন্যান্য খ্রিস্টান এবং বার্ণিয়ে বলছেন তাদের দক্ষতা চূড়ান্ত ছিল।

তাঁর বাহিনীতে বহু ইওরোপিয়, ফরাসী, ব্রিটিশ, পর্তুগিজ, ইটালিয় সেনা চাকরি করত – বিশেষ করে গোলান্দাজ বাহিনীর নানান পদেতে। ১৬৫০-৫২ সালে ব্রিটিশরা তাঁকে ৬জন গোলান্দাজ – জেরিমি রুট, হিউ ডিক্সন, রিচার্ড এমার্সন, জন কাউহিল, রবার্ট ব্রিংবোর্ণ এবং রিচার্ড হলকে ধার দিয়েছিল। সেন্ট ফোর্ট জর্জের গোলান্দাজ সেনাপতি জেরিমি রুটকে মীর জুমলা খুব গুরুত্ব দিতেন। ১৬৫৩ সালে আরও দুজন গোলান্দাজ সেনা সেন্ট জর্জ থেকে মীর জুমলার বাহিনীতে যোগ দেয়। এছাড়াও বহু গোলান্দাজ সেন্ট জর্জ থেকে পালিয়ে তাঁর বাহিনীতে যোগ দিতে আসত এবং তিনি তাদের সুরক্ষা দিতেন – এ মর্মে বহু চিঠচাপাটি উদ্ধার করা হয়েছে। ১৬৫২ সালে গোণ্ডিকোটায় মীর জুমলার বাহিনী দেখতে এসে তাভার্নিয়ে এবং তাঁর বন্ধুর(দু জার্ডিন) সঙ্গে একজন ব্রিটিশ গোলান্দাজ আর তাঁর ইতালিয় বন্ধু, নৈশভোজে যোগ দিয়েছিল। একজন ফরাসি কামান তৈরির জন্য খ্যাত গোলান্দাজ, শল্যচিকিতসক, ক্লদ মিলে, মীর জুমলার গোণ্ডিকোটার দুর্গের জন্য ১০টি ৪৮ পাউণ্ডের এবং ১০টি ২৪ পাউণ্ডের কামান তৈরি করছিলেন। বিভিন্ন যায়গা থেকে তামা যোগাড় করে এবং গাণ্ডিকোটার মন্দিরগুলির মধ্যে মাত্র ছটি বিখ্যাত মন্দিরের মূর্তি বাদ দিয়ে, সবগুলি গলিয়ে তামা জোগাড় হল। কিন্তু তিনি একটাও কামান তৈরি করতে পারলেন না এবং নবাবের সেনা বাহিনী ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন। শ্রীরঙ্গ, দামরালা ভেঙ্কটাপ্পাকে পদচ্যুত করায়, মীর জুমলার বাহিনীতে যোগ দেয়। কর্ণাটকের হিন্দু বিদ্রোহের সময় জিঞ্জির টুপাক্কি কৃষ্ণাপ্পা নায়ক, মীরের সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর বাহিনীর আর এক হিন্দু সেনাপতির নাম ছিল ছিন্নাতাম্বি মুদালিয়ার।

বিভিন্ন জাতি সমন্বয়ে গঠিত তাঁর বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে মীর জুমলা সতর্ক থাকতেন। ১৬৫২ সালের ১ সেপ্টেম্বর তাভার্নিয়ে দেখলেন পেন্নার নদীর তীরে মীর জুমলার সমগ্র বাহিনী পাহাড়ের তলায় সমবেত হয়েছে, এবং ঘোড়সওয়ার নজরদারি সবে শেষ হয়েছে এবং তাঁকে বেশ চৌখস(স্মার্ট) লাগছে। পরের নজরদারির তারিখ ঠিক হল ঐ মাসের ১৪ তারিখে।

বেতনের বিষয়ে কিছুটা সামন্ততান্ত্রিক পদ্ধতিতে এবং কিছুটা নগদে বিদায়ের প্রথা ছিল। প্রথমটির উদাহরণ পাওয়া যায় মুকাসদার বা জায়গির দেওয়ার প্রথায়, যারা সেই জায়গির থেকে রোজগারের টাকায় বেতন দিত। তারা সেনা সরবরাহ করত কি না জানা যায় না। পেশাদার সেনাদের সেনাপতি মার্ফত রাষ্ট্র নগদে বেতন দিত। তাভার্নিয়ে বলছেন, ১১ সেপ্টেম্বর ১৬৫২ সালে ফরাসী গোলান্দাজেরা মীর জুমলার তাঁবুতে গিয়ে তাদের চার মাসের বকেয়া দাবির জন্য বিক্ষোভ প্রদর্শন করছিল, না পেলে তারা তাকে ছেড়ে চলে যাবে, হুমকিও দিয়েছিল। নবাব তাদের পরের দিন আসতে বললেন, তিন মাসের বাকি দিলেন এবং এক মাসের বাকিটা মাসের শেষে দিয়ে দেওয়া হবে আশ্বাস দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই টাকার অর্ধেক তারা নাচনেওয়ালি এনে আমোদ ফুর্তি করতে উড়য়ে দিল।

পাহাড়ি দুর্গ ছাড়াও, আমরা জনতে পারছি জিঞ্জি গাণ্ডিকোটা, উদয়গিরি পাহাড়ের শীর্ষের দুর্গ আর রায়পুর ছিল বন ঘেরা দুর্গ। এছাড়া নেল্লোর দুর্গ ছিল সমতলে অবস্থিত।

মীর জুমলার বৈদেশিক বাণিজ্য[সম্পাদনা]

৪। মীর জুমলার বৈদেশিক বাণিজ্য

দৈনন্দিন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ডুবে থেকেও মীর জুমলা তাঁর অমিত সম্পদ, তাঁর সমৃদ্ধি, তাঁর ক্ষমতার উৎস - বৈদেশিক বাণিজ্যের দিকে নজর দিতে ভুলে যান নি। প্রাথমিকভাবে খুব ছোট্ট করে শুরু করেছিলেন তাঁর ব্যবসা। ১৬৫০এর শেষের দিকে সেই দেশিয় এবং বৈদেশিক ব্যবসা বিপুল কলেবর লাভ করে। ১৬৫১সালের জানুয়ারির হিসেবে তাঁর ব্যবসায় কাজ লাগত ৪০০-৫০০ উট, ৪০০০ ঘোড়া এবং ৩০০টি হাতি আর ১০,০০০ যাঁড়। এই ব্যবসা-বাহিনী তাঁর পণ্য গোলকুণ্ডা এবং বিজাপুরে এমনকি মুঘল সাম্রাজ্যে পৌঁছে দিতে সাহায্য করত। প্রায় প্রত্যেক(ব্যবসায়িক) যায়গায় তাঁর নিজস্ব দালাল এবং নিজস্ব ব্যবসায়ী বসানো ছিল। এছাড়াও তিনি বাণিজ্য করতেন ১) বর্মা – আরাকান, পেগু, টেনাসেরিম(মারগুই দ্বীপপুঞ্জ), ২) আচে, পেরুক, মাকাসসার এবং মালদ্বীপ, ৩) পারস্য এবং আরব, ৪) বাঙলার সঙে। তাঁর সামুদ্রিক বাণিজ্যের জাহাজ ছিল ১০টি, এবং ক্রমশঃ তার সংখ্যা তিনি বাড়াতে থাকেন, পূর্ব উপকূলের নর্সাপুরে তাঁর বিপুলাকায় জাহাজগুলি তৈরি হত। ১৬৩৮ সালের জুলাই মাসে ৮০০ টনের একটি বিশাল জাহাজ (জাঙ্ক) তৈরি করেন পারস্য বা মোকায় পণ্য রপ্তানি করার জন্য এবং তাঁর কারখানার চিঠিচাপাটিতে এই জাহাজটির নাম উল্লিখিত ছিল সর-ই-খাহিলের ‘বিশাল’ জাহাজ হিসেবে।

যেহেতু তাঁর ধারণা ছিল বিজয়নগরের নাবিকেরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে জন্য তিনি তাঁর জাহাজে ব্রিটিশ আর ডাচ নাবিক নিযুক্ত করেছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল, রজার এডামস(১৬৪২), রিচার্ড ওয়ালউইন(১৬৪৭), জন গাইটন(১৬৪৬), টমাস বোস্টক(১৬৫০)। কিছু মুসলমান নাবিকও ছিল – মুবারক টুকিল জাহাজের নেতৃত্বে ছিল মুহম্মদ বেগ পেগু যেতেন, ছিল নাখুদা নুরা, যেতেন আচে, নাখুদা মুল্লা হাসান যেতেন গম্ব্রুন।

সামুদ্রিক সওদাগরি ক্রমশ বাড়তে থাকা সত্ত্বেও সব থেকে বড় দুর্বলতা ছিল, সমুদ্র সেনাবাহিনীর অভাব এবং নির্ভর করতে হত ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির ছাড়পত্রের ওপর। ১৬৫১ সালে মীর জুমলা এবং গোলকুণ্ডার সুলতান পর্তুগিজদের থেকে সামুদ্রিক ছাড়পত্র নেওয়া বন্ধ করে দিলেও মাদ্রাজ ঘেরাওয়ের সময়ে(১৬৫৭, সেপ্ট – ১৬৫৯ এপ্রিল), মীর জুমলা নিজের সমুদ্রগামী জাহাজের জন্য ছাড়পত্র চাইলে ব্রিটিশেরা তা দিতে অস্বীকার করে।

মীর জুমলা বার্মার সঙ্গে বড় করে ব্যবসা করতে চাইতেন। বার্মাতে ছিল সারাবিশ্বের চাহিদাবন্ত সব থেকে ভাল চুণি আর নীলকান্তমণি। বার্মার গালা(গামল্যাক)র গুণমান ভারতের তুলনায় উচ্চশ্রেণীর ছিল। মারটাবান জার, সোনা, তামা, টিন, কুইকসিলভার, গানজা(কাঁসা) এবং বেনজয়েন(লাবান?) এখানে পাওয়া যেত। গোলকুণ্ডার মন্ত্রী থাকার সময় তিনি হাসান খানকে পেগু পাঠিয়েছিলেন শ্বেত হাতির দেশের রাজার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য। পরের দিকে তিনি বার্মার রাজাকে অনুরোধ করেন, গোলকুণ্ডার নাবিক, মুহম্মদ বেগ এবং তাঁর নিজের জাহাজকে পেগুতে বাৎসরিক ব্যবসার সুযোগ দিতে। মীর জুমলা অনেক সময় ব্রিটিশ ব্যক্তিগত ব্যবসায়ী(১৬৪৭ সালে রিচার্ড কোগান)দের পেগুতে তাঁর হয়ে ব্যবসা করার জন্য নিযুক্ত করতেন, যা ব্রিটিশদের ব্যবসার থেকে অনেক বেশি লাভজনক ছিল। মীর জুমলার নিজস্ব অতিকায় জাহাজ মছলিপত্তনম থেকে নিয়মিত পেগুতে যেত এবং তাঁর কর্মচারী এবং দালালেরা অনেকসময় ডাচেদের জাহাজে(১৬৫৩) যাতায়াত করে পেগুর সঙে ব্যবসায়িক সম্বন্ধ বজায় রাখত। ১৬৫১ সালে পেগু চিনা আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে গেলে মীর জুমলা আর ডাচেদের বিপুলভাবে ব্যবসা মার খায়। ১৬৫৩ সালে পেগুর রাজা অচেনা(বিদেশি?)দের টিন আর হাতির দাঁত বিক্রি বন্ধ এবং কাঁসা রপ্তানি ব্যবসা কতিপয় ব্যবসায়িদের দখলে দিয়ে দেন।

আরাকান হাতির জন্য বিখ্যাত ছিল। মীর জুমলা আরাকান রাজ, ধর্মরাজকে অনুরোধ করেন তাঁর কর্মচারীদের আবাধে ব্যবসার সুযোগ দেওয়ার জন্য। তাঁর বিশেষ অনুরোধে রাজা, শাহজাহানের চর সন্দেহে কারাগারে বন্দী সাত ইরাকিকে ছেড়ে দেন। এছাড়াও দীর্ঘদিন আরাকানের কারাগারে কিছু মুঘল বন্দীকে ছেড়ে দেওয়ারও এবং আরাকানকে মুক্ত বাণিজ্যের নীতি লাগু করতে অনুরোধ করেন। তাঁর যুক্তি তা হলেই আরাকান বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠতে পারে। মীর জুমলা পূর্ব উপকূলে পাঠানো সে দেশের চারটি হাতি কেনেন এবং তাঁর সঙ্গে রাজার পাঠানো একটি অতরিক্ত হাতিও উপহার পান।

পূর্ব উপকূলের ক্যালিকোর বদলে মীর জুমলা ইস্ট ইন্ডিজের মশলা, দাস, মাকাসসারের চাল, পেরুকের টিন এবং মালদ্বীপের কড়ি সংগ্রহ করতেন। তাঁর বাণিজ্যের শৃংখলে পারস্য খুব বড় অংশ ছিল। প্রত্যেক বছর বিভিন্ন আকারের জাহাজে তিনি বিপুল পরিমানে পণ্য ভারতের পূর্ব উপকূল থেকে পারস্যের পানে পাঠাতেন। যতক্ষণনা সর-ই-খাহিল বা উজিরের সব ক’টি জাহাজ পণ্যে পূর্ণ না হচ্ছে, ততক্ষণ কোন জাহাজেরই বন্দরে ভেড়ার নির্দেশ দেওয়া হত না। গোলকুণ্ডার মন্ত্রীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের জেরে তিনি বহু সময়ে ব্রিটিশ কোম্পানির বহু জাহাজ, কোন রকম কর আর শুল্ক না দিয়েই পারসিক ব্যবসার কাজে (যেমন ১৬৩৭, এবং ৪০ সালে চিনি পাঠানো) ব্যবহার করতেন। ১৬৫১-৫২ সালে একটি জাহাজ মছলিপত্তনম থেকে মারাকান উপকূলের গদর বন্দর হয়ে গম্ব্রুন পৌঁছয় এবং সেই জাহাজে কোম্পানির পণ্যের সঙে তাঁরও শুল্ক মুক্ত ২০০ টুনাম পরিমান পণ্য ছিল। ১৬৫৩ সালে গাম্ব্রুনে ব্রিটিশ ফ্যাক্টরেরা আশংকা করলেন, তাঁর শুল্ক মুক্ত দুই বেল গাঁটরির খবর যদি শাহবান্দার পায় তাহলে ঝামেলা হতে পারে – কেন না শাহবান্দারের দায়িত্ব ছিল, তাদের দেশে মুসলমানেদের পাঠানো গাঁঠরি খুলে তল্লাসি করা। মাদ্রাজের ফ্যাক্টরেরা ব্রিটিশ বণিকদের জানালেন, যদি এই দেশে যদি তাদের কাজ করতে হয়, বাণিজ্য সুবিধে পেতে হয়, তাহলে তাদের মীর জুমলার মতানুযায়ী কাজ করতে হবে। মীর জুমলা বাঙলার সুবাদার হয়েও এই ভাবেই শুল্কমুক্ত পণ্য পাঠাতেন বিদেশে।

১৬৪২, ৪৬ এবং ৪৮ সালে ব্রিটিশ নাবিকের নেতৃত্বে তাঁর জাহাজ মোকায় ব্যবসা করতে গিয়েছিল।

বিজয়নগর সাম্রাজ্যের ব্যবসার পতনের ফলে মীর জুমলা ক্রমশ তাঁর বিদেশি ব্যবসার বহর বাড়িয়ে তাদের ছেড়ে যাওয়া বৈদেশিক ব্যবসার দেশগুলি – আরাকান, পেগু, টেনাসরিম, মালয় উপদ্বীপ, পারস্য এবং আরব বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে ওঠেন। ষোড়শ শতে পর্তুগিজেরা আরবি বণিকদের সমুদ্র বাণিজ্য কর্ম থেকে হঠিয়ে দিতে থাকে। সপ্তদশ শতের প্রথমার্ধে পর্তুগিজ এবং বিজয়নগরের বাণিজ্যকর্মের পতন ঘটতে থাকায়, এই শূন্যস্থান পূরণ করতে উদ্যমী হয়ে ওঠেন মীর জুমলা। এর সঙে যুক্ত হয় ব্রিটিশ এবং ডাচেদের পারস্পরিক লড়াই এবং প্রত্যেকেই তাঁর আনুকূল্য চাইতে থাকায়, তাঁর ব্যবসা ফুলে ফেঁপে ওঠতে থাকে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পারসিক এবং বার্মা বাণিজ্যেরও প্রতিযোগীরূপে নিজেকে উপস্থিত করতে থাকলেন মীর জুমলা। মছলিপত্তনম থেকে মীর জুমলার পারস্য বাণিজ্যে পাঠানো শুল্কমুক্ত পণ্য থেকে ব্রিটিশেরা কিছুতেই শুল্ক নিতে পারছিল না, ফলে তারা বঙ্গোপসাগরীয় অন্যান্য বাণিজ্য কেন্দ্র থেকে যতটা পারা যায় শুল্ক আদায় করত। এছাড়াও পেগু এবং বার্মা সমুদ্রেও যতটা পারা যায় ব্যবসা মুনাফা নিংড়ে নেওয়ার চেষ্টা করত।

মীর জুমলার কর্ণাটক দখলে ধর্মীয় প্রভাব[সম্পাদনা]

৫। মীর জুমলার কর্ণাটক দখলে ধর্মীয় প্রভাব

কুতুব শাহ মীর জুমলাকে একটি চিঠিতে লিখলেন, ‘হিন্দু কর্ণাটক অঞ্চলের গ্রাম থেকে দূর্গ পর্বত আমার শাসনাধীন। মুসলমান ধর্মের প্রচার সেখানে শুরু হয়েছে। ধর্মাচারের জন্য মন্দির, মূর্তি ইত্যাদি সব ইসলামি রীতি অনুযায়ী পাল্টানো আর বিশ্বাসীদের ধর্মাচারণের সুযোগ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। একটি শহরের অধীনে তিনিটি কুইট(?) গ্রাম শারিয়িতি আইনের অধীনে আনা এবং নজফের অধিবাসীদের বাসের জন্য আলাদা করে রাখা হয়েছে। এই এলাকাটি যেহেতু মীর জুমলার উদ্যোগে অধিকৃত হয়েছে তাই তাঁর এবং তাঁর পরিবারের অধীনে অঞ্চলের গ্রামগুলির অসীম সময়ের জন্য মোতোয়ালি দেওয়া হল। এই অঞ্চলের মোট রোজগার নজফে পাঠাতে হবে। আমার উত্তরাধিকারীদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছি এই নির্দেশের কোন ব্যত্যয় যেন না হয়’।

কর্ণাটকের বিজয়ের পরে মীর জুমলা পারস্যের উজির নবাব খলিফাইসুলতানকে লিখলেন, ‘সর্বশক্তিমানের সদিচ্ছায় এবং পাদসাহীর ভাগ্যক্রমে এই অবিশ্বাসীদের দেশ কর্ণাটকে ইসলামের পতাকা উড্ডীন হয়েছে এবং হিন্দুস্তানও একদিন পদানত হবে... ইসলামের বাণী এবং সুফিদের কাজকর্ম এখানে প্রতিভাত হচ্ছে।’ ধর্মীয় স্থান মন্দির থেকে মসজিদে রূপান্তরিত করার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক, ১৬৫৩ সালে হাবিলদার রুস্তম বেগ, পুনামাল্লি দূর্গের মাথার মন্দিরটির ওপরের অংশটি ভেঙ্গে ফেলে মসজিদে রূপান্তরিত করে।

মীর জুমলা মন্দিরগুলি লুণ্ঠন করে তাঁর মূর্তি, সোনাদানা, রূপা, তামা ইত্যাদি সংগ্রহ করে কামান বানানোর কাজে লাগিয়ে দেন।

অন্যদিকে লিপিসূত্রে(এপিগ্রাফিক) জানা যাচ্ছে, হিন্দুরা ভগবান এবং পুরোহিতকে কিন্তু তাঁর পরেও দান দিতে থাকেন। তেলুগুতে পাথরলেখতে জানা যাচ্ছে ১৫৭২ শকে/১৬৫০ সালে গ্রামের বৈশ্য, নাগর এবং গ্রামের অন্যান্য জাতিরা ভগবান গোপালস্বামী এবং হনুমন্তরায়া আর পুরোহিত গোপালভট্টকে নানান দান দিয়ে গিয়েছেন।

৬। মীর জুমলার অবস্থা দৃঢ হল পক্ষপাতহীন লেখক বিশেষ করে বিদেশি বণিকেরা মীর জুমলার ক্ষমতা আর তাঁর সম্পদের ভার দেখে অবাক হয়ে গিয়েছেন। ওল্টার লিটন এবং ভেঙ্কট ব্রাহ্মণকে ব্রিটিশেরা তাদের স্বার্থ দেখতে নবাবের কাছে পাঠিয়েছিল(জানু ১৬৫১)। তারা লিখছেন, ‘সমগ্র গোলকুণ্ডা রাজ্যটা তিনিই শাসন করেন। রাজার সামনে যেমন করে ভয়ে মানুষ উঠে দাঁড়ায়, সেই ঘটনাটি ঘটত ঠিক তাঁর রাজ্যতেও।’ ১৬৫৪ সালে এমনকি আওরঙ্গজেবও সম্রাটকে লিখলেন, ‘মীর জুমলা দূর্গ, বন্দর এবং খনি সমৃদ্ধ মাঝারি গোছের জনবহুল রাজ্যের নিয়ন্ত্রক। তাঁর ব্যবহার আরামদায়ক এবং সুন্দর, তিনি জ্ঞানী এবং সুন্দর মুখাবয়বযুক্ত, ইঙ্গিতেই বুঝতে পেরে যাওয়ার ক্ষমতাযুক্ত। তাঁর মত দক্ষ মানুষের নিয়ন্ত্রণে বহু উপযুক্ত কর্মচারী রয়েছে। ছোট করে বললে, যদিও মীর জুমলার অবস্থানটা অনেকটা অভিজাতদের স্তরেই, কিন্তু ক্ষমতা, সম্পদ এবং প্রাচুর্যে তিনি যে কোন শাহজাদার সমতুল’। হায়দ্রাবাদে মুঘল অভিযানে মীর জুমলার বিদ্রোহ, এবং মুঘল প্রধান রূপে তাঁর প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল কর্ণাটক দখলের পরবর্তী ঘটনাবলী রূপেই।

ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির সঙ্গে সম্পর্ক(১৬৫৫ পর্যন্ত)[সম্পাদনা]

১। তাঁর নিজের পদের ভারকে কূটনীতির কাজে ব্যবহার

১৬৩৫-৩৬ পর্যন্ত মছলিপত্তনমের প্রশাসক হিসেবে মীর জুমলা ব্রিটিশেরা যে ব্যবসার সুযোগ লাভ করেছে তা উতসাহী হয়ে নজর করতেন। ১৬৩৪ সালের স্বর্ণ ফর্মান অনুযায়ী, কয়েকটি শর্তে গোলকুণ্ডা রাজ্যের সমস্ত কাস্টমস শুল্ক ছাড়ের অনুমতি পেয়েছিল তারা। এই ঘাটতি উসুল করতে মছলিপত্তনমের কৃষকদের পণ্য রপ্তানি করতে বছরে ৮০০ প্যাগোডা (৪০০ ডলার) দিতে হত। তি৮নি জানতেন এই ফর্মানটি অকার্যকর হতে পারে যদি ব্রিটিশদের ৮০০ প্যাগোডার বেশি দেয় শুল্ক হয়। তো স্বর্ণ ফর্মান হাতে নিয়ে বিনা শুল্কে ব্যবসা চালানো কোম্পানি আর তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মীর জুমলা পদক্ষেপ নিতে শুরু করলেন। তিনি ডাচেদের সঙ্গে নিয়ে এই ফর্মান অপব্যবহারের দায়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু করলেন গোলকূণ্ডা রাজদরবারের সরইখাহিল আবদুল্লা খান মুজানদারানি এবং দবীর, মুল্লা ওয়ায়িসের আদালতে। তাঁর অভিযোগ ব্রিটিশদের ব্যবসাজাত কর বছরে ৮০০ প্যাগোডার বেশি। অথচ তারা ফার্মানের সুযোগ নিয়ে তা তারা দিচ্ছে না।

১৬৩৭ সালে গোলকুণ্ডার সরইখাহিল হিসেবে তাঁর রাজ্যের এই ক্ষতি পূরণের উদ্যোগ নিয়ে কঠোরভাবে স্বর্ণ ফরমানে নজরদারি চালানোর ব্যবস্থা করলেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী বাস্তব এবং যুক্তি সম্মত। কিন্তু তাঁর উদ্যোগে মিশেছিল নিজের স্বার্থ সাধন, সে উদ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষতি করে হলেও। গোলকুণ্ডার আধিকারিকদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও ফর্মান নিয়ে দুর্নীতি চালিয়ে গেল ব্রিটিশেরা। এই অবস্থায় দুপক্ষই অনৈতিক এবং অসাধুভাবে নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে উদ্যোগী হল। কিন্তু এই অবস্থায় লাভ করলেন সব থেকে বেশি মীর জুমলাই। তাঁর সর্বময় ক্ষমতা বেআইনিভাবে প্রয়োগ করে, মীর জুমলা ব্রিটিশদের হুঁশিয়ারি দিতে শুরু করলেন, এবং ব্রিটিশেরাও বুঝতে পারল(১৬৩৮, ১৮ মে) যে তিনি সেটি করছেন শুধুই অর্থ লালসায়।

ডেনেরা সরইখাহিল মীর জুমলার বাণিজ্য জাহাজ দখল করে। তাঁর প্রতিশোধ হিসেবে ১৬৪১এর সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর মাস ধরে, মছলিপত্তনমের প্রশাসক সমস্ত ব্রিটিশ জাহাজ বন্দরে ভেড়ার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করল। ১৬৪২ সালের জানুয়ারি মাসে তাদের চাহিদা পূরণ হয়ে যাওয়ায় ডেনেরা তাঁর জাহাজ ছেড়ে দিলে মছলিপত্তনমে প্রবেশ করার মীর জুমলার নিষেধাজ্ঞা উঠে যায়। ডাচেরা এ ধরণের অবস্থা ঘটতে পারে ধারনা করেই, সবসময় নিজেদের পণ্য জাহাজঘাটায় তৈরি রাখত এবং ছোট ছোট ছিপে করে সেগুলি নিয়ে গিয়ে জাহাজ ভরত বা পাড়ে তুলত। সেন্ট ফোর্ট জর্জের কুঠিয়ালরা (সেপ্ট ১৬৪২)পরবর্তীকালে এ ধরণের ব্যবস্থা নিতে শুরু করে।

ক্রমে ক্রমে মীর জুমলা রাজ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী হিসেবে পরিগণিত হতে শুরু করলেন, যার বন্ধুত্ব আর সাহায্য যেমন ব্যবসার ক্ষেত্রে সমৃদ্ধির সূচক আবার তাঁর ক্রোধ ঠিক বিপরীত ক্রিয়ারও জন্ম দিতে পারে – ঠিক সেই জন্যই ইওরোপিয় কুঠিয়ালরা তাকে খুসী রাখলে যে রাজনৈতিকভাবে এবং ব্যবসায়িকভাবে ফায়দা হতে পারে তা বুঝতে পারল। ১৬৪২ সালে মীর জুমলা ডাচেদের কুঠির কাজকর্ম বন্ধ করে দেন, তাদের মশলা বিক্রি বন্ধ হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও তারা তাকে ৯জন নাবিক এবং দুটি কামান, এবং গোলকুণ্ডা রাজসভাকে ৮০০০০ রিয়াল দিল তাঁর জাহাজকে পরস্য ব্যবসার জন্য। তাঁর উত্তরে ব্রিটিশেরা তাঁর জাহাজের জন্য বিভিন্ন ধরণের পেশাদার এবং তাঁর পণ্য বিনা শুল্কে বয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। মীর জুমলা তাঁর পক্ষ থেকে তাদের বহু সময়ে নানান ধরণের সাহায্য করেছেন, কখনো অর্থ ধার দিয়েছেন, কখনো তাদের সুযোগ সুবিধে প্রত্যয়িত করেছেন, এবং কখনো কখনো তাঁর নিজের জাহাজ ব্যবহার করতে দিয়ে তিনি যে তাদের প্রতি সদয় সেই বার্তা দিতে চেয়েছেন। এইভাবে তিনি তাঁর পদকে নিজের ব্যবসার কাজে লাগিয়েছেন বিদেশিদের থেকে অনেক বেশি সুবিধে নেওয়ার জন্য।

২। ব্রিটিশদের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক

মীর জুমলা কখোনো কখোন ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের থেকে অর্থ ধার করতেন, নিজের ব্যবসার ঘাটতি পূরণ করতে(যেমন হিরের খনির কাজে, ব্যবসার জন্য, জাহাজ তৈরির জন্য ইত্যাদি) এবং তাঁর নিজের জোরদার সেনা বাহিনী তৈরির স্বপ্ন সার্থক করতে। ধার উদ্ধার করা ব্রিটিশদের পক্ষে খুব একটা সহজ কাজ ছিল না। ১৬৩৮র শুরুর সময় থেকে ব্রিটিশেরা মীর জুমলার থেকে ৩০০০ প্যাগোডা বা ১০৫০০ টাকা পেত। ১৬৩৯ সালের আগস্ট মাসে মছলিপত্তনমের কুঠিয়াল, গোলকুণ্ডার কুঠিয়াল এন্ড্রু কোগানকে বকেয়া উদ্ধার করতে চাপ দেয়। কোগানের বিশ্বাস ছিল নবাবকে এটি আইন মোতাবেক ধার দেওলয়া হয়েছে, যথা সময়েই পাওয়া যাবে। ১৬৪০ সালের নভেম্বরে, মীর জুমলা ধারের বন্ধক স্বরূপ তিনিটি দামি গয়না পেলেন, ২০৯৯ প্যাগোদা ধারের মধ্যে ১৯১৯ প্যাগোডা ধার শুধতে অস্বীকার করলেন।

অন্য দিকে তাঁর সম্পদের ভাণ্ডার ঠিকঠাক থাকলে মীর জুমলা ব্রিটিশদের ধার দিতে কসুর করতেন না। ১৬৪২-৪৩ সালে মীর জুমলার একচেটিয়া কারবারের দরুণ মছলিপত্তনমের ধারের বাজার প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল, তখন ব্রিটিশেরা সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা গোলকুণ্ডায় মীর জুমলার দপ্তর থেকে ৪ থেকে ৫ হাজার প্যাগোডা ধার নেবে ১ থেকে ২ শতাংশ সুদে এবং এটি তারা নভেম্বর নাগাদ ফিরিয়ে দেবে। তিনি মাদ্রাজে ব্রিটিশদের, ৯ মার্চ, ১৬৪৬ থেকে, ১০০০০ নতুন প্যাগোডা ধার দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, সম্ভবত এটি কর্ণাটক লুঠের সম্পদ। ১৬৪৭ সালের ২৯ জুনের আগে তারা সেটা শোধ করতে পারে নি, কিন্তু তাঁর পরে শোধ দিলে তিনি কিছু সুদ মাফ করে দেন এবং তাদের থেকে ৬৪১ প্যাগোডা দামের কাঁসার বন্দুকের মত কিছু উপহারও পান।

৩। মীর জুমলার সঙ্গে ব্রিটিশদের ঝগড়া

মীর জুমলার সঙ্গে ব্রিটিশদের সম্পর্ক শুধু উত্তমর্ণ-অধমর্ণের সম্পর্কে আবদ্ধ ছিল না। মীর জুমলা যেহেতু কর্ণাটক রাজ্যের সর্বোচ্চ প্রশাসক ছিলেন, সেহেতু ব্রিটিশেরা মনে করত স্থানীয়দের থেকে ধারগুলি উসুল করতে ঝামেলা পোয়াতে হবে। তারা তা উসুল করতে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৬৪০ সালে গোলকুণ্ডা এবং ভিরাভাসরম থেকে দেয় ১০০০০ প্যাগোডা উদ্ধার না হওয়ার দায় চাপায় মীর জুমলার ওপর। মছলিপত্তনমের কুঠিয়ালেরা তাঁর ওপর পরোক্ষ চাপ সৃষ্টি করতে তাঁর জাহাজ দখল করারও পরিকল্পনা নিয়ে ফেলেছিল।

মীর জুমলার সঙ্গে ওপর ওপর সুন্দর ব্যবহার করলেও তারা মনে মনে মীর জুমলাকে ঘৃণা করত এবং তিনি যে তাদের ওপর সরাসরি চাপ দিয়ে তার কাজ উসুল করে নিতে পারেন, তাও তারা বুঝত। গোলকুণ্ডার কর্মচারীরা ব্রিটিশদের স্থানীয় উতপাদকের কাছ থেকে চুক্তি মত দাদন দেওয়া পণ্য কিনতে বাধা দিত এবং এই দীর্ঘকালীন বিবাদ তিক্ততা এবং প্রায় হাতাহাতিতে গিয়ে থামত। গোলকুণ্ডার কুঠিয়াল এবং মাল্লুভুল শহরের কিছু বিষয় নিয়ে মছলিপত্তনমের কুঠিয়ালের সঙ্গে মীর জুমলার বিরোধ ঘটে(ফেব্রুয়ারি ১৬৩৮)। ব্রিটিশদের সব অভিয়োগ যে খুব একটা যুক্তিযুক্ত ছিল তা নয়। মছলিপত্তনমের কুঠিয়ালের অভিযোগ ছিল যে মীর জুমলা শহরের প্রশাসককে(জুলাই ১৬৩৮) কোর্টিন এসোসিয়েশনের ক্যাপ্টেন ওয়েডেল এবং মন্টিনির বিরুদ্ধে খেপিয়ে তুলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আদতে ব্রিটিশদের দাবি ছিল স্থানীয় প্রশাসন তাদের তটভূমি দখলে বাধা দেওয়ায়, তারা যে কামান দিয়ে সেই প্রশাসনের সদর দপ্তরে হানা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেই কামানের গোলা মছলিপত্তনমে আমদানির ওপরে তাদের ছাড় দেওয়া হোক।

অবস্থা সামাল দিতে কোম্পানির চেষ্টা[সম্পাদনা]

৪। অবস্থা সামাল দিতে কোম্পানির চেষ্টা মছলিপত্তনমের হতবুদ্ধিকর অবস্থা সামাল দিতে বিজয়নগর রাজ্যের তটের আরও দক্ষিণের নিরাপদ এলাকায় দিকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ব্রিটিশেরা এবং তাঁর জন্য প্রয়োজন সুলতানের থেকে নতুন করে ফর্মান সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত হল, যাতে তারা নতুন এলাকায় অবাধে ব্যবসার সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। এর প্রথম পদক্ষেপ হল ফোর্ট জর্জের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনা এবং দ্বিতীয়টি, সুরাট থেকে গোলকুণ্ডায় এন্ড্রু কোগানের আগমন।

এন্ড্রু কোগানকে যথেষ্ট সম্মান দেখিয়ে নানানভাবে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন মীর জুমলা, সরইখাহিল। মীর জুমলার এই চরিত্র কোগানের কাছে নতুনভাবে প্রতিভাত হল; বিশেষ করে মছলিপত্তনমের কুঠিয়ালেরা তাঁর চরিত্র সম্বন্ধে এত দিন তাঁকে যা জানিয়েছিল, তিনি দেখলেন মীর জুমলা তার বিপরীত চরিত্রের। কোগান, মীর জুমলাকে একটা দামি রত্ন দিলেন(আম্বারগিজ) এবং বিরক্ত হয়ে লিখলেন(বান্টামকে ৩ সেপ্টে ১৬৩৯) কোন দিন যদি কোম্পানির সরইখাহিলকে দরকার পড়ে তাহলে তিনি(মীর) তাদের হয়ে কথা কইবেন। মীর জুমলা মছলিপত্তনমের প্রশাসককে একটি বিশেষ পত্র লিখলেন এবং কোগানকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করার আদেশ দিলেন।

৫। কর্ণাটক দখলের পরে ইওরোপিয়দের সঙ্গে মীর জুমলার সম্পর্ক কর্ণাটক দখলের পরে পূর্ব উপকূলের ইওরোপিয় বণিকদের সঙ্গে মীর জুমলার সম্পর্কের চরিত্রের পরিবর্তন ঘটে। ব্রিটিশেরা হঠাই দেখল এতদিন যে ব্যক্তি তাদের প্রশাসক এবং বাণিজ্য প্রতিযোগী ছিল, তিনি হঠাতই তাদের রাজা হয়ে বসেছেন। মীর জুমলার ভয়ে এবং তাঁর মন্ত্রীদের ঘন ঘন নজরদারির ফলে তারা ঠিক করল সেন্ট জর্জের প্রতিরক্ষা বাড়ানোর দরকার। কিন্তু মীর জুমলা তক্ষুনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কোন আক্রমনের ইঙ্গিত না দেখিয়ে তাদের প্রতি বন্ধু ভাবাপন্ন মনোভাব দেখালেন। ব্রিটিশদের পক্ষেও মীরের পক্ষ্মপুটে আশ্রয় নেওয়া জরুরি ছিল। অতীতের হিন্দু শক্তি তাদের যে সব ব্যবসায়িক সুযোগ সুবিধে দিত, সেগুল্কি নতুন সরকার তাদের দেবে কিনা এই প্রশ্নে তারা খুবই চিন্তিত ছিল। যুদ্ধের মধ্যেই বোঝা যাচ্ছিল যে কর্ণাটকে ক্ষমতার ভার কেন্দ্র বিজয়নগর থেকে গোলকুণ্ডায় স্থানান্তরিত হতে যাচ্ছে এবং সেই তত্ত্ব বুঝেই মাদ্রাজে ব্রিটিশ দূত আইভি(আগস্ট ১৬৪৪-সেপ্ট ১৬৪৮), তড়িঘড়ি ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চাইলেন। ১৬৪৬ সালে মীর জুমলা যখন মাদ্রাজের কাছে স্যান থোম অবরোধ করেছেন তখন ব্রিটিশেরা তাকে গোলান্দাজ এবং পদাতিক সেনা দিয়ে সাহায্য করে। প্রতিসৌজন্যে মীর জুমলা গোলকুণ্ডার সুলতানের পক্ষ থেকে বর্তমান কাউল(মাদ্রাজ দখল রাখার ফর্মান) এবং অন্যান্য সাহায্য দেওয়ার ঘোষণা করেন(জুন ১৬৪৭)।

পুলিকটের ডাচেরা তাদের বাণিজ্য সুবিধে বজায় রাখল মীরেরে নতুন আমলে সঙ্গে অতিরিক্ত হিসেবে পেল আররও বেশি কিছু অর্থের সুযোগ সুবিধে। আর হিন্দু রাজত্বের তুলনায় তাঁর সময়ে পর্তুগিজেরাও অতিরিক্ত কিছু সুযোগ পায়। ১৬৪৮ সালে মছলিপত্তনমে মীর জুমলার একটি জাহাজ ঝড়ে ভেঙ্গে পরায় তিনি ব্রিটিশ বা ডাচ জাহাজগুলিকে তাঁর ব্যবসায় কাজে লাগাতে উদ্গ্রীব ছিলেন।

৬। মীর জুমলার কাছে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির দৌত্য ১৬৫০-৫১ সালের কাছাকাছির সময়ে তিনি নিজের বস্ত্রের একচেটিয়া বাণিজ্য সফল করতে গিয়ে ডাচেদের নাছোড় বাণিজ্য প্রতিযোগিতায় বিরক্ত হয়ে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তিতে উপনীত হলেন। ঠিক হল এবার থেকে ব্রিটিশ কোম্পানি তাঁর দালাল মার্ফত বস্ত্র কিনে পারস্য এবং অন্যান্য এলাকায় বাণিজ্য করে তাঁর সঙ্গে লভ্যাংশ ভাগ করে নেবে।

গাণ্ডিকোটায় মীর জুমলা ১৬৫০ সালে ডাচ দূতের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন; কিন্তু ভেঙ্কট ব্রাহ্মণের ব্রিটিশ দৌত্য স্বীকার করলেন। তিনি ব্রিটিশদের বললেন তাঁর সঙ্গে বাণিজ্যের হাত বাড়ালে ব্যাপক লাভ করতে পারবে এবং সমগ্র বাণিজ্যকেও খবরদারি করতে পারবে – অর্থাৎ সেভাবে তিনি এলাকার সমগ্র বস্ত্র উতপাদন নিজের আওতায় নিয়ে এসেছেন, দাম এবং উতপাদন নিয়ন্ত্রণ করে, ঠিক সেইভাবেই ব্রিটিশেরা তাঁর গুদাম থেকে কাপড় নিয়ে একচেটিয়াভাবে সেই কাপড় উপকূল জুড়ে ব্যবসা করতে পারে। এ ছাড়াও তিনি সূক্ষ্মভাবে ব্রিটিশদের সঙ্গে ডাচেদের লড়িয়ে দিতে বললেন, ডাচেরা করমণ্ডলের বস্ত্র উতপাদনের পুরোটা কিনে নিয়ে এবং সেগুলি কম বিক্রি করে ব্রিটিশদের ভাতে মারতে চাইছে। কুঠিয়াল গ্রেনহিল মীর জুমলার উত্তরে একই দূত ভেঙ্কট ব্রাহ্মণকে এবং আরও একটা দৌত্যে ওয়াল্টার লিটলটনকে পাঠালেন ১৬৫০এর ডিসেম্বরে। তাদের যৌথ সমীক্ষায়(১৭ জানু, ১৬৫১) অঙ্গীকার করে জানালেন যে মীর জুমলার ব্রিটিশদের প্রতি আগ্রহ, ভালবাসা আন্তরিক, এবং ব্রিটিশদের সঙ্গে তিনি দীর্ঘকালীন চুক্তিতে যেতে চান। এবং কোম্পানির ব্যবসাকে সুদ-মুক্ত অর্থ ধার(৫০ থেকে ৬০ হাজার প্যাগোডা) দিয়ে সাহায্য করতে চান। তাদের ধারণা হল মীর জুমলার সঙ্গে এই চুক্তিতে যাওয়া ব্রিটিশ কোম্পানির পক্ষে শুভকর হবে এবং ডাচেদের বাণিজ্য উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্দেশ্যে লেখা একটি চিঠি এবং উপহারস্বরূপ ৩০০টি লং ক্লথ এবং সালামপুর কাপড় দূতেদের দেন।

এতদিন ডাচেদের ব্যবসা সঙ্গ করে হঠাতই তিনি সিদ্ধন্ত নিলেন ব্যবসায় ব্রিটিশদের হাত ধরার। কর্ণাটক লুঠের সম্পদে তিনি এখন ব্রিটিশদের সহজ শর্তে ঋণ দিতে পারেন, যা তাকে আরও বেশি লাভের মুখ দেখতে সাহায্য করবে। এবং এইভাবে তিনি কোম্পানিকে বোঝাতে পারবেন তিনি তাদের শুভ চিন্তক এবং কোন ঝামেলায় পড়লে তিনি তাদের আনুগত্য ব্যবহারও করতে পারবেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৬৫১ সালে দূত এবং কাউন্সিল উভয়েই মীর জুমলার উদ্দেশ্য, চুক্তি সম্বন্ধে খুব বেশি উচ্ছ্বসিত হতে পারল না। তারা সিদ্ধান্ত করল, তারা শুধু একটি বিষয়ে মীর জুমলার সঙ্গে একমত হচ্ছে, দাম পরে ঠিক করার শর্তে ইওরোপ থেকে আসা সব পণ্য মীর জুমলা নিলে তাঁর বদলে তাঁর গুদামের কাপড় ব্রিটিশ কিনবে। তবে যত দিন না প্রেসিডেন্ট বেকার সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, ততদিন তাঁরা কোন চরম সিদ্ধান্তে উপনীত হবে না। এবং যদি কোম্পানি মীর জুমলার প্রস্তাবে সম্মত হয়, তাহলে তারা চাইবে কোম্পানি দূত এবং প্রেসিডেন্টকে নবাবের সঙ্গে চুক্তি করার ক্ষমতা অর্পন করুক। ১৬৫১ সালের জানুয়ারিতেই গোলকুণ্ডায় নবাবের সঙ্গে আরেকটা দৌত্যে পাঠানো হল ভেঙ্কট ব্রাহ্মণকে দুটি তথ্য জানতে যে পরের জাহাজে নবাব কি ধরণের ইওরোপিয় পণ্য চাইছেন এবং মীর জুমলা যে কাপড় কোম্পানিকে দিয়েছেন, তাঁর দাম কি হতে পারে।

কোম্পানির জবাব এক এক বছর পর। জাজানো হল মীর জুমলার দালালদের থেকে সমগ্র দ্রব্য কেনার প্রশ্নে তারা কোন প্রতিশ্রুতি দিতে অপারগ। তবুও তারা মীর জুমলার দাদলদের থেকে গুরুত্ব দিয়ে বস্ত্র কেনার সুযোগ খুলে রাখছে, কিন্তু এর জন্য তারা কোন ছাড় দতে রাজি নয়। ১৬৫২র গ্রীষ্মে, লিটলটন এবং ভেঙ্কট আবার দৌত্যে গেলেন মীর জুমলার সভায় যতদূর সম্ভব কোম্পানির উত্তর নিয়ে, এবং সেখানে তারা বন্ধুত্বপূর্ণ সদ্ভাব পেল। তারা জানাল কুঠিয়ালেরা মীর জুমলার দালালদের যে ছাড়গুলি দিয়েছিল, কোম্পানি সেগুলি বাতিল করেছে। কিন্তু মীর জুমলার অনুরোধ যেহেতু তাদের কাছে আদেশের সমান, আগামী দিনে তাদের সমস্ত ভুলগুলিকে সংশোধন করে পুরোনো দামে উপনীত হওয়া যায় কি না সে সিদ্ধন্তে তারা উপনীত হতে চাইছে।

১৬৫১-৫২ সালে ডাচেরা ড্রিক স্টুয়ারের দৌত্যে একলপ্তে বিপুল পরিমান অর্থ দিয়ে নতুন কিছু শহর ভাড়ায় তাদের আওতায় আনা যায় কি না, বাণিজ্যে তাদের আরও ছাড় দেওয়া যায় কি না এবং আগামী দিনে তাদের বাণিজ্যে কাস্টম শুল্ক ছাড় দেওয়া যায় কি না সেবিষয়ে তাঁর সঙ্গে আলোচনা চালাতে আসে। মীর জুমলা নিজে কোন সিদ্ধন্ত না নিয়ে সে সময়ে গাণ্ডিকোটায় থাকা সুলতানের দরবারে তাদের সমস্ত আবেদন বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু একই সঙ্গে পুলিকটে আরও বেশি সুরক্ষা বাড়ানোর প্রশ্নে সটান না করে দিলেন। অথচ তিনি ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের সেন্ট জর্জকে আরও সুরক্ষিত করার সম্মতিও দিলেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁর দৃষ্টিও থাকল ব্রিটিশরা যাতে তার ক্ষমতাকে প্রতিস্পর্ধা দেখানোর মত করে বেড়ে উঠতে না পারে। এর প্রতিফলন ঘটল তাদের ব্যাঙ্কশাল তৈরির জরিমানায়। যদিও ব্রিটিশদের মীর জুমলা খড়ের বদলে চুনা পাথরের ব্যাঙ্কশাল করতে অনুমতি দিয়েছিলেন এবং তারা তা করেও ফেলেছিল, সেই জন্য তাদের তিনি ২০০ প্যাগোডার মত বড় জরিমানা করেন। প্রথম এংলো-ডাচ যুদ্ধে, পারস্যে, বাংলায়, জাপানে ডাচেদের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। ১৬৫৪ সালে তিনি ডাচেদের ছাড়পত্র ছাড়াই ভারতীয় জাহাজ শ্রীলংকা, আচে এবং অন্যান্য এলাকায়, যেখানে ডাচেরা প্রায় একচেটিয়া ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা করে যাচ্ছে, পাঠানোর উদ্যম নিলেন। ডাচেরা পর্তুগিজ নিরাপত্তায় যাওয়া তাঁর একটি জাহাজ দখল করে। ডাচেদের সঙ্গে মীর জুমলার এবং মাকাসসারের রাজার সম্পরক দূষিত হয়ে পড়ে(এপ্রিল ১৬৫৪)। তাঁর জাহাজ ছাড়া না হলে তিনি পুলিকট আক্রমণ করার হুঁশিয়ারি দিলেন। তারা তাঁর জাহাজ ছেড়ে দিলে এবং অন্যান্য এলাকায় ভারতীয় জাহাজ যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তাঁর রাগ বিন্দুমাত্র পড়ে নি। পারস্যের ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা কোম্পানিকে পারস্যে আরও বড় জাহাজ পাঠিয়ে ডাচেদের বাজার মারার অনুরোধ করল।

অন্যান্য ইওরোপিয়দের সঙ্গে মীর জুমলার সম্পর্ক এতটা তিক্ত ছিল না। তাভার্নিয়ে এবং তাঁর দলবল গাণ্ডিকোটায় মীর জুমলার সঙ্গে দেখা করেন ১৬৫২ সালের সেপ্টেম্বরে, সুলতানকে কিছু রত্ন বেচার জন্য। উলটে মীর বলেন তাঁর পাঁচটি রত্নভরা পুঁটলি কি ইওরোপে তাভার্নিয়ে বেচে দিতে পারবেন? এবং তিনি তাদের হয়ে গোলকুণ্ডায় তাঁর পুত্রকে চিঠ লিখে দেন।

১৬৫৩-৫৫ সালে সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার সময় তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক হন নি। বরং তাদের সঙ্গে ব্যবসা করে তাঁর নিজস্ব ব্যবসাজাত সম্পদ বাড়ানোর কাজ করে গিয়েছেন। একই সঙ্গে জাতপাত নিয়ে কোম্পানির আভ্যন্তরীন দ্বন্দ্ব তৈরি হল(এপ্রিল ১৬৫৫) সেখানে প্রথমে তিনি প্রবেশ করতে চাননি, এমন কি তারা তাঁর সাহায্য চাইলেও তিনি সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অস্বীকার করেন; আবার মাদ্রাজ কাউন্সিলে কোম্পানির মধ্যে এই বিষয় নিয়ে মতদ্বৈধ তৈরি হলে, তাকে তিনি কাজে লাগিয়ে ব্রিটিশেরা যাতে চন্দ্রাগিরির রাজাকে সাহায্য না করতে পারে, সে বিষয়ে তিনি উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। আদতে তিনি নিজের এবং গোলকুণ্ডার সুলতানের অবস্থাকে আরও দৃঢ করতে চাইছিলেন। ব্রিটিশ আর মীর জুমলার মধ্যে এই যে ছোট ফাটল তৈরি হল তা আগামী দিনে চওড়া ফাটলের রূপ পরিগ্রহ করবে।

৭। পর্তুগিজদের সঙ্গে সম্পর্ক কর্ণাটকে থাকাকালীন মীর জুমলার সঙ্গে গোয়ার পর্তুগিজ শাসক দোম ফিলিপি ম্যাস্কারহান্সের(১৬৪৫-৫১) সম্পর্ক ‘অসাধারণ বন্ধুত্বপূর্ণ’ ছিল। তাদের মধ্যে চিঠি চালাচালি এবং নিয়মিত উপহার আদান প্রদান হত। তাকে দেওয়া পর্তুগিজ হস্তাবরণ, বক্ষাবরণী বা শিরস্ত্রাণের উচ্ছসিত প্রশংসা করতেন মীর জুমলা এবং যুদ্ধে তিনি প্রায়শই সেগুলি ব্যবহারও করতেন। তাঁর বিনিময়ে তিনি কর্ণাটকের হিরের খনি থেকে তোলা ভাল হিরেগুলি পর্তুগিজ প্রশাসককে পাঠাতেন, এমন কি তিনি তাঁর কাছে তাঁর শ্রেষ্ঠ রত্নগুলির কিছু বিক্রিও করেছেন। তাঁর শাসন কালে মীর জুমলা পর্তুগিজদের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছেন, যাতে প্রয়োজনে ভবিষ্যতে তাদের শক্তি তিনি ব্যবহার করতে পারেন।

কিন্তু কর্ণাটক বিজয় যাত্রায় পর্তুগিজ উপনিবেশ স্যান থোমকে কিন্তু মীর জুমলা ছেড়ে কথা বলেন নি। তিনি সেই শহরটি অবরোধ করে রাখেন বহু দিন এবং তাঁর কর্মচারীরা শহরের বাইরের বহু বাগান এবং জমি দখল করে তাদের প্রভুকে না দেওয়া খাজনা উসুল করে নেয়। ১৬৫১ সালের জানুয়ারি মাসে ভেঙ্গে দেওয়া পর্তুগিজ চার্চ বানিয়ে দেন কিন্তু তাঁর রাজস্ব বছরে ২০০০ রিয়াল আদায়ের সিদ্ধান্ত বজায় রাখে। ব্রিটিশদের বিশ্বাস ছিল, বহুকাল ধরে চলা, চার্চের বাইরে হিন্দু কোন মূর্তির শোভাযাত্রা বন্ধ করে দেওয়ায় তিনি এই জরিমানা করেন।


তৃতীয় অধ্যায় মীর জুমলার বিদ্রোহ[সম্পাদনা]

১। মীর জুমলা এবং কুতুব শাহের মধ্যে বিরোধের কারণ কর্ণাটক বিজয়ে মীর জুমলার চরিত্র বদল ঘটল। এর আগে তিনি ছিলেন এক ক্ষমতাহীন সুলতানের সভাসদ এবং কর্মচারী মাত্র – কিন্তু বিজয়ের পরে তাঁর প্রভুর থেকে যথেষ্ট দূরত্বে থেকে এই কর্মচারীই হয়ে উঠলেন স্বাধীন এবং ক্ষমতাবান শাসক। বার্নিয়ে সূত্র ধরে বলা যায় তাঁর কর্মচারীর প্রতি সুলতানের স্বাভাবিক ঈর্ষা বরাবরই জগ্রত ছিল। ইওরোপিয় ঐতিহাসিকদের বক্তব্য কুতুব শাহ ক্রমশঃ তাঁর উজিরের ক্ষমতা এবং অবস্থায় চিন্তিত হয়ে উঠছিলেন। কিন্তু এটা বলা বোধহয় ঠিক হবে না যে সুলতান, কর্ণাটক জয়ের পর তাঁর উজিরের ক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রথমে নিজের ক্ষমতা হ্রাস বিষয়ে চিন্তিত এবং উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন।

আমরা আগেই দেখেছি, মীর জুমলার সাফল্যে উত্তেজিত হয়ে তাঁর প্রতি সমস্ত রকমের সুযোগ সুবিধে বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বহু পরের দিকে পারস্যের সুলতানকে লেখা এক চিঠিতে গোলকুণ্ডার সুলতান আক্ষেপ করে লিখছেন, তিনি যে চারাগাছটি, দুঃসাহসিক অভিযাত্রী মীর মহম্মদ সঈদ রূপে রোপণ করেছেন, সেটি এখন বিপুল বিশাল মহীরুহ হিসেবে গোলকুণ্ডার উজির মীর জুমলায় পরিণত হয়েছে – এবং তিনি অবাক হয়ে যাচ্ছেন যে তাঁর বিরুদ্ধে মীর জুমলা বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করছেন। উজিরের প্রতি সুলতানের যে অবিশ্বাস তৈরি হয়েছিল, তা যে খুব স্বাভাবিক ছিল এবং মীর জুমলার উচ্চাকাংখাই যে তাকে এই ঈর্ষার দিকে ঠেলে দিয়েছিল তা বলা যাবে না। বরং মীর জুমলার অমেয় সম্পদ, ক্ষমতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে, তাঁর স্তরের সভাসদেদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারে ক্ষিপ্ত হয়ে দাক্ষিণাত্যের বেশ কিছু সভাসদ সুলতানের কান ভারি করতে থাকেন যে মীর জুমলা তাঁর ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী হয়ে উঠতে চাইছেন। যদিও মীর জুমলা স্বাভাবত দুর্বিনীত চরিত্রের মানুষ ছিলেন না, কিন্তু তাঁর ক্ষমতায় আরোহনের দরুণ তিনি কিছুটা নিজের খোলসে ঢুকে পড়তে থাকেন এবং তাঁর জন্য তাকে তাঁর স্তরের মানুষেরা মনে করতে থাকেন তিনি তাদের এড়িয়ে চলছেন।

মীর জুমলার ক্ষমতায় হিংসয় জ্বলেপুড়ে তাঁর বিরোধীরা, তাঁর অনুপস্থিতিতে সুলতানের কানে তাঁর উজিরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরণের কল্পনামূলক কাহিনী রচনা করে তাঁর মন বিষিয়ে দিতে থাকেন। সেই সময়ে ভারত ভ্রমণে আসা কিছু ইওরোপিয় লেখক সূত্রে জানা যায় যে মীর জুমলা এবং সুলতানের মা হায়াত বক্সী বেগমের অস্বাভাবিক সম্পর্ক নৈকট্য সুলতান খুব স্বাভাবিকভাবে নেন নি, এবং একে তিনি তাঁর পরিবারের সম্মান হানিরূপে গণ্য করেছিলেন এবং এই জন্য ক্রমশঃ তিনি তাঁর উজিরের থেকে দূরে সরে গিয়ে থাকতে পারেন। হাদিকতউসসুলতানের লেখক নিজামুদ্দিন আহমদ সিরাজি লক্ষ্য করছেন যে সুলতানের মায়ের বেশ কিছু ব্যক্তিগত এবং প্রয়োজনীয় কাজকর্ম সরইখাহিল সম্পাদন করে দেওয়ায় প্রায়ই তাঁকে তিনি বহুমূল্য উপহারে সজ্জিত করতেন এবং তাঁর উত্তরে তিনিও কিছু উপহার পাঠাতেন সুলতানের মায়ের উদ্দেশ্যে। এই উপহার দেওয়া নেওয়া গোপনে না হওয়ায় এই দেওয়া নেওয়ার ওপরে জনগণের দৃষ্টি নিবদ্ধ হতে থাকে এবং এই সম্পর্কটি যে খুব স্বাভাবিক নয় এমনভাবে দেখা হতে থাকে। দুজনেই তখন মধ্য বয়স পেরিয়ে গিয়েছেন। আর মীর জুমলা সভা থেকে দূরেই থাকতেন। এবং মীর জুমলার ব্যক্তিগত চরিত্র এই ঘটনার সঙ্গে খাপ খায় না। এবং এটির সপক্ষে কোন উপযুক্ত প্রমানও পাওয়া যায় নি, অতএব, একে আমরা কুৎসাকারীদের স্বকপোলকল্পিত গুজব রটনা হিসেবেই দেখতে পারি, এর বেশি কিছু নয়। বাস্তবে মীর জুমলা এবং সুলতানের দুজনের সম্পর্ক জড়িয়ে যে কুতসার বাতাবরণ গড়ে উঠেছিল, তা সে সময়কার ঈর্ষান্বিত সভাসদেদের উতসাহী রটনা ছাড়া আর কিছুই নয়। তাভার্নিয়ে সূত্রে জানছি, ঈর্ষান্বিত সভাসদের সুলতানকে বললেন, ‘মীর জুমলা যে ধরণের ক্ষমতা কেন্দ্রিভূত করছেন, তাতে যে কোন সময়ে তিনি সুলতানের সিংহাসন কেড়ে নিতে পারেন এবং গোলকুণ্ডা রাজত্বে সুলতানকে হঠিয়ে মীর জুমলা তাঁর পুত্রকে বসিয়ে দিতে চাইছেন, এবং তাই সুলতানের পক্ষে শেষ দিনের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকা দুর্ভাগ্যকে সসম্মানে ডেকে আনার মত হবে এবং সেই দিনের দিকে তাকয়ে তিনি যেন অপেক্ষা করে বসে না থাকেন – কেননা সর্বোচ্চ ক্ষমতায় ওঠার সব থেকে ছোট্ট রাস্তা হল শুধু সুলতানকেই সরিয়ে দেওয়া।’

মুঘল সম্রাটের উজির পদে বৃত হওয়ার পর পাদশাহ শাহজাহান কুতুব শাহকে যে চিঠিটি লেখেন তাতে মীর জুমলার বিদ্রোহের কারণের সমস্ত ইঙ্গিত ধরা রয়েছে এবং এই চিঠিতে সম্রাট, এ ধরণের যোগ্য শাসককে দূরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কুতুব শাহের মুর্খতা এবং তাঁর প্রজ্ঞাকে পরোক্ষাভাবে দোষী ঠাউরেছেন। সম্রাট লিখছেন, ‘আজকের দিনে অভিজ্ঞ এবং কর্মক্ষম কর্মচারী পাওয়া খুব কঠিন বিষয়, বিশেষ করে মুয়াজ্জম খাঁয়ের মত, যিনি যে কোন দক্ষতম উজিরের মত আমার সভা উজ্জ্বল করতে পারেন। তাঁর দক্ষতা স্বীকার করা এবং মেনে নেওয়া অতীব প্রয়োজন।’ শাহজাহান আরও লিখছেন, ‘স্বউদ্যমী মানুষের পক্ষে শত্রুদের পরামর্শে কান দেওয়া অনুচিত বলে আমি মনে করি, কেননা ভুল পরামর্শ দাতারা তার ফলে প্রভুর কোন উপকার করতে পারে না এবং তাকে ভালও রাখতে পারে না, শুধু তারা স্বস্বার্থ সম্পাদনে লেগে থেকে বন্ধুদের শত্রুতে পরিণত করে, ফলে (এই মানুষদের থেকে দূরে থেকে) নিজের জীবন, পরিবার, সমাজের সম্মান রক্ষা সক্কলের সামূহিক কর্তব্য।’

মীর জুমলার গাণ্ডিকোটা দখলের(১৬৫০) পরই প্রথম সুলতান এবং উজিরের মতপার্থক্য সর্বসমক্ষে চলে এল। কর্ণাটক দখল এবং ভাগ করা নিয়ে দুই সুলতানের মধ্যেকার যুদ্ধে(১৬৫১-৫২) মীর জুমলার হার এবং গাণ্ডিকোটার নিয়ন্ত্রণকে কুতুব শাহের হাতে না দিয়ে আদিল শাহের হাতে দেওয়ার সিদ্ধান্তেই গোলকুণ্ডার সুলতানের সঙ্গে তাঁর উজিরের প্রথম সম্পর্কের মধ্যে ফাটল হিসেবে ধরা যায়। স্যার যদুনাথ সঠিকভাবেই এই সূত্রটি সম্বন্ধে বলছেন, ‘উজিরের জয়ের ফসল তুলতে চেয়েছিলেন স্বাভাবিকভাবেই কুতুব শাহ। কর্ণাটক দখলে এই দুজন পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে কাজ করেছেন। কিন্তু তারা জয়ের পরে লাভের অঙ্ক নিয়ে ঝগড়ায় জড়িয়ে পরলেন। কুতুব শাহ, মীর জুমলাকে সাধারণ কর্মচারীর মত বিচার করতে চাইলেন। এবং মীর জুমলার বিজয় করা অঞ্চলকে দখল করতে চাইছেন সুলতান এমন একটা ধারণা তৈরি হল। অন্য দিকে মীর জুমলা জানেন, যে সুলতানের অধীনে কাজ করছেন, তিনি কত দুর্বল এবং ক্ষমতাহীন, এবং যে যুদ্ধটি তিনি জিতেছেন সেটি সম্পূর্ণভাবে তাঁর নিজের কৃতিত্ব এবং সেই ফল তিনি নিজেই ভোগ করবেন। কর্ণাটকে প্রায় স্বাধীন জীবনযাপন করার পরে সুলতানের সভাসদ হিসেবে ফিরে যাওয়া খুব সম্মানের কাজ ছিল না।’ তাঁর কর্মের প্রতিফল হিসেবে যে পদ তাকে দেওয়া হল, তাতে তিনি মনঃক্ষুণ্ণ হলেন এবং জয় করা এলাকা ফিরিয়ে দিতে চাইলেন। ইংরেজ কুঠিয়াল লিখছেন, তিনি চাইলেই প্রকৃতপক্ষে মহান রাজা হতে পারতেন। ক্ষিপ্ত সুলতান মীর জুমলার পাঠানো জয়ের চিঠিকে তার উজিরেরই কৃতিত্ব বুঝে, তাঁর কর্ণাটকীয় স্বাধীনতার ভিত্তি কেড়ে নিতে উদ্যোগী হলেন। লিখিত সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে, ১৬৫৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চিঠি চালাচালি সূত্রে কিন্তু সুলতান এবং মীর জুমলার মধ্যে কোন বিরোধের সূত্র পাওয়া যাচ্ছে না বরং মীর জুমলাকে বলা হচ্ছে সুলতানের কর্মচারী(এজেন্ট)। কিন্তু এক বছরের মধ্যেই সেন্ট জর্জের কুঠিয়ালেদের লেখায় দেখা যাচ্ছে যে সুলতানের বিরুদ্ধে মীর জুমলা অস্ত্র তুলে নিয়েছেন।

তাঁর ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী হিসেবে মীর জুমলাকে চিহ্নিত করে কুতুব শাহ তাঁর উজিরকে তাঁর বিশ্বস্ত কর্মচারীরূপে নয়, তাঁর প্রতিস্পর্ধী রূপে চিহ্নিত করলেন এবং উন্মুখ হয়ে নিরবে তাকে ধ্বংস করার এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার উদ্যোগ নিলেন। তাঁর সঙ্গে ঘৃতাহূতি পড়ল তাঁর সভাসদেদের বারে বারে তাঁর শয়তান প্রতিস্পর্ধীকে, দেরি না করে সমূলে ক্ষমতাচ্যুত করার উত্যক্ত মন্ত্রণা। তাঁর পাশে উজিরের শুভচিন্তকরা যেহেতু সর্বক্ষণ ঘিরে থাকে, তাই সুলতান মীর জুমলা বিরোধী মনোভাব লুকিয়ে চলতে লাগলেন, কিন্তু মাঝে মাঝে হঠাত হঠাত করে তাঁর বিরুদ্ধে তাঁর রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটত। কর্ণাটকে বসে থাকা মীর জুমলাকে স্বয়ং তাঁর নিজের এবং তাঁর স্ত্রীয়ের পরিবারের আত্মীয় এবং সভায় তাঁর শুভার্থীদের অবস্থা জানানো হল।

কুতুব শাহের কবল থেকে মীর জুমলার মুক্তির অবস্থার সঙ্গে তুলনা করা যায় শিবাজীর বিজাপুর উদ্ধারের ভাবনাকে। তবে এটা কতটা তুলনীয় তা বলা কঠিন। শিবাজীরকে চেষ্টা ছিল জাতীয় স্তরের স্বাধীনতা আনয়ন করা এবং ঐতিহাসিকতায় পরিপূর্ণ, উল্টো দিকে মীর জুমলার স্বাধীনতার উদ্যম কিন্তু নিজের, ব্যক্তিগত; এটা মন্তব্যই করা যায়।

২। মীর জুমলার কূটনৈতিক উদ্যম

সুলতানের ক্রোধান্বিত অবস্থা আন্দাজ করে, মূল ঘটনা ঘটার বহু আগে থেকেই মীর জুমলা নিজের সুরক্ষা বলয় তৈরি করার উদ্যম নিলেন। কর্ণাটকে তোলা কোন রাজস্বই তিনি কুতুব শাহকে দিতে অস্বীকার করলেন, কেননা তিনি ‘তাকে আর সুলতান মানেন না, বরং তাঁর চরমতম শত্রু হিসেবে গণ্য করেন’। কুতুব শাহের মনোভাব পরিবর্তন হবে আন্দাজ করেই তিনি তাঁর দূরদৃষ্টি অবলম্বন করে ঠিক করলেন যে তাঁর মাতৃভূমিতে তিনি ফিরে যাবেন এবং ইরাণের সম্রাটের দরবারে তিনি সব কথা বলে তাঁর মন জয় করার চেষ্টা করবেন। ১৬৫৩ সালে তিনি, পারস্যের উজির, খালিফাইসুলতানকে দুটি বন্ধুত্বপূর্ণ চিঠি পেশ করে বললেন যে তাদের মধ্যে যে সাংস্কৃতিক বন্ধন রয়েছে তা যেন বজায় থাকে এবং তিনি অতীতের মতই আগামী দিনে শাহের সেবার জন্য প্রস্তুত। তাঁর পূর্ব সেবার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে তিনি স্বয়ং পারস্যের দ্বিতীয় আব্বাস শাহকে চিঠি লিখে আবেদন করলেন, কর্ণাটকের রাজনৈতিক অবস্থা তাঁর টিকে থাকার যদি জন্য খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তাহলে তিনি তাঁর সমস্ত সম্পত্তি নিয়ে পারস্যে চলে যেতে ইচ্ছুক। উত্তরে শাহ জানালেন যে তাঁর সব স্মরণ রয়েছে এবং উপযুক্ত সময় এলে তিনি তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবেন। কিন্তু বাস্তবে ইরাণের শাহ, কুতুব শাহের বিরুদ্ধে মীর জুমলার যাওয়া সমর্থন করলেন না এবং তিনি মনে করলেন যে কুতুব শাহের সঙ্গে মীর জুমলা যেন সমস্ত বিরোধ মিটিয়ে নেন।

মীর জুমলার কাছে শাহের উত্তর অনেক পরে এল এবং এই ভাসা ভাসা উত্তর দেওয়ায় চিঠিটির বক্তব্য তাঁর মনোমত হল না। তাঁর ধারণা হচ্ছিল যে পারস্য থেকে ঠিক সময়ে তাঁর জন্য সাহায্য আসবে না। তিনি কোন ধন্ধে না থেকে তাঁর আশেপাশের পরিবেশ থেকে সুরক্ষা খুঁজতে শুরু করলেন। প্রথমে তাঁর প্রভুর একদা শত্রু রয়ালের বন্ধুত্ব চাইলেন। তিনি মনে করলেন তাঁর ঠিক পাশের শাসকই তাঁর সুরক্ষার সত্যিকারের উৎস হতে পারেন – সেজন্য তিনি যে কোন আক্রমনের হাত থেকে তাকে বাঁচাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সমর্থন আদায় করলেন। ইতিমধ্যে কুতুবের বিরোধিতার অবস্থা আন্দাজ করে, বেশ কিছু যোগ্য সুলতানি সেনাপতিকে তিনি নিজের দিকে টেনে নিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বিজাপুরের আদিল শাহকে জানালেন যে তিনি তাকে কর্ণাটক উপহার হিসেবে তুলে দিতে চান। আদিল শাহ স্বপ্নেও ভাবেন নি, মালিক অম্বরের মত যোগ্য সেনানায়কের পরে দাক্ষিণাত্য এ ধরণের উপযুক্ত দক্ষ কর্মচারী পাবে।

এই ধরণের কুশলী কূটনৈতিক চালে তিনি সুলতানের হাত থেকে প্রাথমিকভাবে নিজেকে বাঁচাবার ব্যবস্থা করলেন যাতে নতুন ধরণের একটা স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করে তুলতে পারেন। তিনি গোপনে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করলেন। তিনি যদি আগেই উতসাহী হতেন তাহলে হয়ত তাকে সাহায্যের জন্য মুঘলেরা উতসাহী হয়ে উঠতে পারত। আওরঙ্গজেব ভাবলেন মীর জুমলার মত উপযুক্ত মন্ত্রী যদি তাঁর অধীনে চলে আসে, তাহলে এই সম্পদশালী রাজ্যটি দখলের তাঁর সুপ্ত বাসনা বাস্তবে রূপ পেতে পারে। ওয়ান্ডিওয়াস দখলের সময়েই তিনি মীর জুমলাকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, পাশে পেতে। মীর জুমলা এই বার্তা অবলম্বন করে আওরঙ্গজেবের দূতকে জানালেন ‘যোগাযোগ, বন্ধুত্ব এবং ভালবাসার সমস্ত দরজা খোলা থাকবে’।

সুলতান এবং উজিরের লড়াইএর অবস্থা অনুধাবন করে আওরঙ্গজেব গোলকুণ্ডায় মুঘল হাজিব মুইজ্জুলমুলকের ভাই আব্দুল লতিফকে বাস্তব অবস্থা অবস্থা বুঝতে গোপনে চিঠি লিখলেন। মীর জুমলা তাঁর এতদিনের রক্ষণাত্মক অবস্থার মোড়ক ভেঙ্গে, সাম্প্রতিক শত্রুদের বিরুদ্ধে কূটনৈতিভাবে আক্রমণাত্ম হওয়ার পরিকল্পনার ছক তৈরি করলেন। আদিল শাহের হাতে নিদারুণ হার, এবং গাণ্ডিকোটা উপহারের ফলে লুটোনো সম্মান উদ্ধারের হাতিয়ার হল চরম কূটনৈতিক চাল। বিজাপুরী সেনানায়ক খান মহম্মদকে জিঞ্জির হয়ে যাওয়ার অনুমতি না দেওয়া, মহীশূরের সঙ্গে চক্রান্ত করা এবং রয়ালের সঙ্গে যেচে বন্ধুত্ব এই সবই তাঁর কূটনৈতিক চাল হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। তবে তাঁর সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক পদক্ষেপটি হল রয়ালের হয়ে আওরঙ্গজেবের মার্ফত গোপনে মুঘল শক্তির সঙ্গে সমঝোতার রাস্তা খোলার কাজ। যাহুর লিখছেন, ‘ভেল্লোর দূর্গে শ্রীরঙ্গ ঝামেলা তৈরি করলেন, এবং তিনি মীর জুমলার সঙ্গে চিঠি আদানপ্রদান করে ঠিক করলেন যে তিনি এবং তাঁর উকিল মার্ফত মুঘলদের --- পেশকাশ দেবেন। এই বিষয়ের সমস্ত দায় সামলানোর ভার মীর জুমলা নিজের কাঁধে তুলে নিলেন। তিনি রাজার হয়ে মুঘলদের সমস্ত রকম প্ররোচনা দিতে শুরু করলেন।’ ১৬৫৩ সালে মীর জুমলার মন্ত্রণায় রয়াল, গোপনে তাঁর ব্রাহ্মণ দূত শ্রীনিবাসকে আওরঙ্গজেবের হয়ে পাদশাহের উদ্দেশ্যে চিঠি লিখে পাঠালেন এই সমঝোতায় যে তিনি শুধু যে ইসলাম গ্রহণ করবেন তাই নয়, বছরে ৫০ লক্ষ হুণ, ২০০টি হাতি এবং কিছু দামি অলঙ্কার উপঢৌকন হিসেবে দেবেন, তাঁর বদলে তিনি সুলতানের থেকে সুরক্ষা দাবি করেন।

এই পদক্ষেপে মীর জুমলা যে তাঁর দুর্দিনে শুধু রয়ালের আনুগত্য অর্জন করলেন তাই নয়, তিনি আদিল শাহ এবং তাঁর নিজের সুলতান কুতুব শাহের বিরুদ্ধেও কূটনৈতিকভাবে কয়েক কদম এগিয়ে গেলেন। মীর জুমলার মধ্যস্থতার দৌত্য আওরঙ্গজেবের কাছে দাক্ষিণাত্যে নতুন সম্ভাবনা দ্বার উন্মুক্ত করে দিল। রয়ালের ইসলামে রূপান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব যেমন আওরঙ্গজেবকে সাহায্য করল দক্ষিণে আরও বড় করে ইসলামের ছত্র বিস্তারের কাজে তেমনি কর্ণাটকের যুদ্ধের লুঠতরাজের পরে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দুই সুলতানের ওপর চাপ সৃষ্টি করার কাজ করল যাতে তারা তাকে এত দিন না দেওয়া পেশকাশ ঠিকঠাক পরিমানে দেন। মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে রয়ালের প্রস্তাব মেনে নেওয়ার মানে, শুধু যে ইসলামের বিস্তার তাই নয়, বিপুল সম্পদ অর্জনের পথ খোলা। এ ছাড়াও নিজের দিকে মীর জুমলাকে টেনে আনার সুযোগও তৈরি হল।

আওরঙ্গজেব তাঁর হাজিবকে মীর জুমলার – যিনি বরাবরই মুঘল সাম্রাজ্যের সভায় আনুগত্য দেখিয়েছেন, সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য দায়িত্ব দিলেন, এবং নির্দেশ দিলেন প্রয়োজনে বদান্যতা প্রদর্শন করতে, যাতে মীর জুমলা সাম্রাজ্যের সেনা বাহিনীর অংশ হয়ে ওঠেন। এর সঙ্গে তিনি মীর জুমলার সম্পদ এবং তাঁর বাহিনীর বিষয়ে সমীক্ষাপত্র পেশ করতে নির্দেশ দিলেন। তিনি চেষ্টা চালালেন যাতে পাদশাহ নিজে মীর জুমলাকে নিজের দিকে আনার জন্য উতসাহী হন। কেননা পাদশাহের হাত বাঁধা ১৬৩৬ সালের আহদ(চুক্তি) অনুযায়ী, যে চুক্তিবলে তাঁর পক্ষে সুলতানের কোন আধিকারিককে সাম্রাজ্যের কাজে(ফুসলে) নেওয়ার সুযোগ ছিল না। দারাও মীর জুমলাকে মুঘল বাহিনীতে নেওয়ার বিরোধী মত প্রকাশ করে। আওরঙ্গজেবের যুক্তি ছিল মীর জুমলা গোপনে বহুবার তাঁর আবেদন পেশ করেছেন যাতে তাকে সাম্রাজ্যের অংশ করে নেওয়া হয় এবং তিনি তাঁর প্রাণ দিয়ে সাম্রাজ্যের সেবা করবেন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর আগেও যতদূর সম্ভব মীর জুমলার দূত ঈমান ওয়ার্দি বেগ সম্রাটের কাছে একই আবেদন পেশ করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মীর জুমলার সাম্রাজ্যের প্রতি আত্মনিবেদনে সন্তুষ্ট হয়ে সম্রাট তাকে সান্ত্বনা দিয়ে আওরঙ্গজেবকে নির্দেশ দিলেন যে তাঁর জন্য যা কিছু করার দরকার, করতে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত সরাসরি পাদশাহ মীর জুমলাকে সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীতে নেওয়ার কোন প্রতিশ্রুতি দেননি। সম্রাটের বার্তা পেয়ে তৎক্ষণাৎ আওরঙ্গজেব মীর জুমলার সাহায্য এবং সুরক্ষার জন্য একটি শক্তিশালী মুঘল বাহিনী পাঠিয়ে দেন এবং নিশ্চিত করেন কোনভাবেই যেন সুলতান তাকে মুঘল পক্ষে যোগ দিতে বাধা সৃষ্টি না করতে পারেন।

এদিকে গোলকুণ্ডায় ঘটনাপ্রবাহ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে, যার বলে আওরঙ্গজেবের পক্ষে সেই ঘটনায় আরও তাড়াতাড়ি অংশগ্রহণ করার সুযোগ এসে যায়। কুতুব শাহের সঙ্গে মীর জুমলার মতবিরোধ যখন তুঙ্গে, সুলতান তাকে চক্রান্ত করে গোলকুণ্ডায় ডেকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। পুত্রের সহায়তায় নিজেকে অস্ত্রের সাহায্যর মুক্ত করে মীর জুমলা সশরীরে কর্ণাটকে ফিরে যান এবং আর কোন দিন গোলকুণ্ডায় ফিরে যাবেন না সিদ্ধান্ত নেন। তাঁর গোপন সিদ্ধান্ত বুঝে তাকে বার বার গোলকুণ্ডায় আনানোর চেষ্টা করতে থাকেন সুলতান। এই সবেতেই সুলতানের উজিরের সন্দেহ আরও বাড়তে থাকে এবং তিনি গোলকুণ্ডায় না যাওয়ার সিদ্ধন্তে অনড় থাকেন। শেষ পর্যন্ত সুলতানের ভালমানুষির মুখোশ খুলে যায় এবং তিনি মীর জুমলাকে গ্রেপ্তার করে তাকে ধ্বংস করার সিদ্ধন্ত নিয়ে ফেলেন।

পাদশাহ বুঝলেন মীর জুমলার সঙ্গে ঠিক মত ব্যবহার করা হয় নি। এবং অবস্থা অনুধাবন করে আওরঙ্গজেব মার্ফত খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করলেন কেন মীর জুমলা কর্ণাটকে ফিরে গেলেন। আওরঙ্গজেব সমস্ত অবস্থা পর্যালোচনা করলেন, এবং সম্রাটকে বোঝালেন মীর জুমলা বাধ্য হয়েছেন কর্ণাটকে ফিরে যেতে, কেননা মুঘল সাহায্য তাঁর কাছে আসে নি। আর তাঁর মুঘল বাহিনীতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্তে বাধা দেওয়ার কেউ নেই বর্তমানে; যত তাড়াতাড়ি তাকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া যাবে তত শীঘ্র যোগ দেওয়ার জন্য ইচ্ছুক হয়ে রয়েছে। শুধু মাত্র মৌখিক সমঝোতার প্রতিশ্রুতিতে কোন কাজ হয় না। আওরঙ্গজেব অনুভব করলেন খুব শীঘ্রই তাকে কাজে নামতে হবে এবং তাঁর আধিকারিক সঈদ আহমেদ মার্ফত তিনি মীর জুমলাকে একটি চিঠি লিখলেন এই মর্মে যে তিনি যেন খোলাখুলিভাবে মুঘল সাম্রাজ্যে যোগ দেন এবং তিনি দায়িত্ব নিচ্ছেন যে তিনি নিজে পাদশাহের সঙ্গে দেখা করে তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার ব্যবস্থা করবেন। এছাড়াও পাদশাহ মহম্মদ মুনিমকে সাম্রাজ্যের পক্ষে, সাম্রাজ্যের ফার্মান নিয়ে তাঁর নিজের হয়ে শ্রীরঙ্গর সঙ্গে এবং সরাসরি মীর জুমলার সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দিলেন। মীর জুমলা একজন সাম্রাজ্যিক মধ্যস্থতার জন্য দূত প্রার্থনা করে সম্রাটের কাছে আবেদন পাঠালেন এবং সেটি প্রত্যায়িত করে দিলেন আওরঙ্গজেব নিজে।

৩। মহম্মদ মুমিন দৌত্য এত দিনে, ১৬৫৩-৫৪ সালে শ্রীরঙ্গর ইসলামে পরিবর্তিত হওয়ার আবেদনের খবর এবং মুঘল রাজসভায় তাঁর হয়ে একজন প্রাজ্ঞ মুঘল কূটনীতিবিদ মহম্মদ মুনিম সফদরখানির দৌত্যের খবর পৌছল সুলতানদের কানে। তাঁদের আশংকা হল যে তারা কর্ণাটক হারাবেন। ‘আদিল শাহ মনে করলেন এত দিন তারা কর্ণাটকে যা ভোগ করে এসেছেন, তা মুঘলেরা দখল করে নিতে পারে, তিনি মীর জুমলার বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অন্য দিকে কুতুব শাহ মীর জুমলাকে বাবা বাছা করে শান্ত করে তাঁর পুরোনো পদ এবং মহাল দেওয়ার সিদ্ধন্ত নিলেন। কিন্তু ততদিনে খুব দেরি হয়ে গিয়েছে। যদিও মুঘলেরা তার সঙ্গে যোগাযোগ করা শুরু করেছে, কিন্তু শিরদাঁড়া সোজা রাখা উজির, মীর জুমলা ঠিক করেই নিয়েছেন, যে দু বছর পেরিয়ে গেলেই তিনি হয় কুতুব শাহের দরবারে উপস্থিত হবেন, না হয় তীর্থে চলে যাবেন।’ মহম্মদ আমিন হায়দ্রাবাদের মীর জুমলার পুত্র, এবং তাঁর অধীনস্থ আধিকারিক, মহম্মদ আমিন নিজেদের কুতুব শাহের অধীনে থাকাকে খুব একটা সুরক্ষিত বোধ করছিলেন না, এবং সুলতানকে দিয়ে ওপরে বর্ণিত শান্তি চুক্তি করে সাময়িকভাবে সুরক্ষিত বোধ করলেন। এই ঘটনাপ্রবাহে উদ্বিগ্ন আওরঙ্গজেব সম্রাটকে আবেদন করে বললেন যে সাম্রাজ্য যেন মীর জুমলাকে সরাসরি সাহায্য করবে এমন একটা প্রকাশ্য ইঙ্গিত দিক এবং তিনি যেন যে কোন মুহূর্তে সেনাবাহিনীতে যোগদান করতে পারেন সে ব্যবস্থাও করা হোক।

আওরঙ্গজেব যা চেয়েছিলেন তা রূপায়ন করা বাস্তবে খুব সহজ কাজ হল না। কুতুব শাহকে ঠেকিয়ে রাখার যে কূটনীতি নিয়েছিলেন মীর জুমলা, ঠিক সেই নীতি তিনি নিলেন আওরঙ্গজেবের সঙ্গেও। আওরঙ্গজেব মহম্মদ মুনীমকে তাঁর সঙ্গে আলোচনা চালাবার জন্য দায়িত্ব দিলেন এবং নির্দেশ দিলেন তাঁর সঙ্গে কথা বলে যেতে যতক্ষণনা তিনি মুঘল বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পাকা সিদ্ধন্ত নিচ্ছেন। আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে ইতোমধ্যে চিঠি লিখেছেন এবং সঈদ আহমেদকে কাজে লাগিয়েছেন এবং তাঁর বিশ্বাসের প্রশংসা করেছেন এবং সুলতান যে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন, তাও সেই চিঠিতে তিনি নিন্দা করেছেন। তিনি লিখলেন তাঁর বিশ্বাস বাইরের সব ঝঞ্ঝাট মিটে যাবে এবং মীর জুমলা যেন সাম্রাজ্যে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করেন, কেননা তাকে সেই সিদ্ধান্ত লাভবান করাবে। তিনি বললেন মীর জুমলা যেন তাঁর দূতের কাছে নিজের মনের কথা খুলে বলেন এবং সাম্রাজ্যে উঁচু পদ লাভের সুযোগ না হারান। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে দুজন সুলতান জোর বদ্ধ হয়েছে; তাই সম্রাটের থেকে সঠিক প্রতিশ্রুতি না পেয়ে, মীর জুমলা দূতের কাছে মুখ খুললেন না। মুনিম তাঁর সঙ্গে দেখা করার পর তিনি আওরঙ্গজেবের মার্ফত সুলতানকে একটা আবেদন পেশ করলেন। আওরঙ্গজেব সম্রাটকে জানালেন, যতক্ষণতা সাম্রাজ্য মীর জুমলার সুরক্ষা বিষয়ে কোন স্থায়ী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে ততদিন মীর জুমলা কোন স্থায়ী সিদ্ধন্ত নেবে না, এবং সেই জন্য তিনি চাকরির শর্ত – যেমন তাঁর পদ বৃত্তান্ত, তাকে রক্ষার জন্য নিরাপত্তার বিষয় এবং সেই জন্য অতিরিক্ত সেনাবাহিনী বরাদ্দ করার ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নিতে। কিন্তু তবুও শাহজাহান সিদ্ধন্ত নিতে না পারায় মীর জুমলা সতর্ক হয়ে গেলেন এবং তিনি পাদশাহের মনোভাব বিষয়ে শংকিত হয়ে পড়লেন। ফলে আওরঙ্গজেব চেষ্টা চালালেন তাঁর আশংকা দূর করার। দূত মার্ফত গোপন কথাবার্তা বিনিময় হতে থাকল। মীর জুমলাকে শান্ত করতে আওরঙ্গজেবের পক্ষ থেকে নিশান পাঠানো হল। কুড়ি দিন পরে মীর জুমলা দুজন সেনাদূত মার্ফত একটি চিঠি পালটা আওরঙ্গজেবকে পাঠালেন। আওরঙ্গজেব সেটি সম্রাটের বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে দেন এবং মীর জুমলাকে লেখেন, মীর জুমলা যেন তাঁর জীবনের সব থেকে বড় চমক পুরষ্কার স্বরূপ পাওয়ার জন্য ভবিষ্যতের দিকে লক্ষ্য রাখেন।

১৬৫৪ সালে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে, আওরঙ্গজেবের নাছোড়বান্দা মনোভাবে প্রভাবিত হয়ে অবশেষে পাদশাহ মীর জুমলাকে আওরঙ্গজেবের সুরক্ষায়, এবং একমাত্র আওরঙ্গজেবের উপস্থিতিতে রাজধানীতে আনার সম্মতি দিলেন। তিনি দুটি ফর্মান জারির প্রস্তাব দিলেন একটি গোপনে মীর জুমলাকে তাঁর সামনে আসার অন্যটি কুতুব শাহকে লেখেন যাতে তিনি তাঁর উজির এবং পুত্রকে মুঘল সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে বাধা না হয়ে দাঁড়ান।

মীর জুমলা ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে হঠাতই এক বছর সময় চাইলেন। উদ্দেশ্য বিভিন্ন বন্দরে ছড়িয়ে থাকা তাঁর সম্পদ উদ্ধার করা। এবং তিনি তাঁর প্রাক্তন চাকুরিদাতার সঙ্গেও কথা বলার সিদ্ধান্ত নিলেন যাতে তারা তাঁর বিরুদ্ধে না যান এবং মুঘলদের সঙ্গে তাঁর চুক্তি যাতে গোপন থাকে এই প্রস্তাবও দিলেন। মীর জুমলার মনোভাবে আওরঙ্গজেব সম্রাটকে জানালেন এক্ষুনি তাঁর উদ্দদেশ্যে কোন দূত না পাঠাতে এবং মহম্মদ মুনিমের ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে। মুনিম ফিরে গিয়ে মীর জুমলার এই অবস্থা সম্রাটকে বর্ণনা করবেন। তিনি সম্রাটকে এই আলোচনা বা পদক্ষেপ গোপন রখতে অনুরোধ করলেন, কারণ দুজন সুলতান যদি মীর জুমলার উদ্দেশ্য জানতে পারেন, তাহলে তারা যে কোন ছলে বলে কৌশলে এই উচ্চপদ পাওয়া থেকে বাধা দেবে(অর্থাৎ মেরে ফেলা) এবং তখন সুলতানদের বাধা দেওয়া অতীব অসুবিধে হবে কেননা এই বিষয়ে দু জন একমত হয়েছেন। সেই সঙ্গে তিনি মীর জুমলাকে বললেন(১৩ জানুয়ারি ১৬৫৫) তাঁর বকেয়া কাজগুলি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্পাদন করতে এবং মন থেকে সাম্রাজ্যের সেবায় যোগ দেওয়া সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা না করতে।

রাজধানীর পথে যাওয়া মুহম্মদ মুনিমের হাত দিয়ে আওরঙ্গজেব সম্রাটকে লিখলেন, ‘বাস্তব হল মীর জুমলার আর সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীতে না এসে গতি নেই। সেটা সে আমায় জানিয়েছে। সম্পত্তি উদ্ধার করা তাঁর প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এখন সে যে প্রকাশ্য কূটনৈতিক চাল চেলেছে সেটা তাঁর মনের কথা নয়। দূর্গ, বন্দর এবং খনি সমৃদ্ধ এই জনাকীর্ণ রাজ্যে(জোরদার সেনাবাহিনী, আতুল ঐশ্বর্য এবং কার্যকরী আধিকারিক সমৃদ্ধ) সে তাঁর সম্পদ উদ্ধার পুরোনো আশ্রয়দাতা বিজাপুরের সুলতানের কাছে ফিরে না গিয়ে মুঘল বাহিনীতে যোগ দেবে। সাম্রাজ্যের রাজসভায় যোগ দেওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। বর্তমানেরটি কূটনৈতিক চাল এবং ততক্ষণ সে দুই সুলতানকে চটাতে চাইছে না তাঁর নিরাপত্তার জন্য... এবং সেজন্য সে এখুনি এই দেশ ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে চাইছে না... সুন্দর ব্যবহার এবং ছলে বলে কর্ণাটকের জমিদারদের বশ্যতা অর্জন করে এবং ইখলাস হাবসির বন্ধুত্ব অর্জন করে... মীর জুমলা সুচতুরভাবে শুধু সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করছে।

বাস্তবে মীর জুমলা কিন্তু কূটনৈতিকভাবে জোরালো অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। আওরঙ্গজেব বিষয়টা সম্যকভাবে বুঝেছিলেন এবং তিনি এই অবস্থাটি পাদশাহকে বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন। মহম্মদ মুনিমের ফেরার পরেও মীর জুমলার সঙ্গে তাঁর চিঠি চাপাটিতে বোঝা যাচ্ছে ক্ষুরবুদ্ধি উজিরকে তিনি খুব সহজে বশ করতে পারেন নি এবং মুঘলদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে মীর জুমলা কিছুটা ইতস্ততও করছিলেন, বিষয়টা ঝুলিয়ে রাখছিলেন। আওরঙ্গজেব তাঁকে লিখলেন, ‘(সাম্রাজ্যকে)সেবা করার ইচ্ছের ওপর জোর রেখে নিজের ওপর আস্থা বজায় রাখ, এবং মনে রাখ তোমার জন্য অনন্ত ভাগ্যবান ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে (দৌলত সরমাদল(না সারমাদি?))।’

৪। ইখলাস খান, শাহজী ভোঁসলে এবং রয়াল ত্রয়ীর সঙ্গে মীর জুমলার কূটনৈতিক সম্পর্ক মীর জুমলার জোরদার কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বল করতে দুই সুলতান মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে আলাপ আলোচনা শুরু করলেন। শাওয়াল ১০৬৪(১৬ আগস্ট-১২ সেপ্ট ১৬৫৪)এ আওরঙ্গজেব, মুনিমকে নির্দেশ দিলেন যেহেতু কুতুব শাহ পুরোনো চুক্তি নবীকরণ করতে চাইছে, তাঁর সঙ্গে আলোচনা শুরু করা যাক। বীজাপুরও এই ভাবে মুঘলদের সঙ্গে দরকষাকষি, গা ঘষাঘষি সুরু করল। পাদশাহ যাতে রয়ালকে নিরাপত্তা না দেন তাঁর জন্য তাকে প্রচুর পরিমানে উপঢৌকন দেওয়া হল। সুলতানদের বিরুদ্ধে যত চক্রান্ত হবে, সেটি তত মীর জুমলার পক্ষে যাবে এটা তিনি বুঝলেন। এই উদ্দেশ্যে বাধ্য হয়ে মীর জুমলা তাঁর কূটনৈতিক চক্রের জাল আরও বেশি এলাকায় বিছোনোর কাজ শুরু করলেন। আদিল শাহের বিরোধিতার ধার নষ্ট করতে বিজাপুরী কর্ণাটকের হাবসি প্রশাসক ইখলাস শাহের সঙ্গে দহরম মহরম শুরু করতে দুজনের মধ্যে আশ্চর্য জনক কিছু চিঠ চাপাটি আদান প্রদান শুরু হল। এছাড়াও তিনি আদিল শাহের বিরোধী মারাঠি নেতা শাহজী ভোঁসলার বন্ধুত্বও চেয়ে বসলেন আওরঙ্গজেবের পক্ষ থেকে। আওরঙ্গজেবের ইচ্ছে তাকে বীজাপুরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা, তাই তিনি মীর জুমলার এই পদক্ষেপকে জোরদার সমর্থন জানালেন এবং মীর জুমলার থেকে জানতে চাইলেন শাহজীর মনোভাব, যাতে তাকেও তিনি এই শিবিরে নিয়ে আসতে পারেন। মীর জুমলা মুঘলদের সঙ্গে রয়ালের হয়ে দৌত্য আর বন্ধুত্ব পাতিয়েছিলেন, তার দীর্ঘদিনের বিজাপুর আর গোলকুণ্ডার বিরোধিতাকে ধুনো দিতে এবং নিজের অবস্থাকে আরও দৃঢ করতে। কিন্তু আমরা আগেই দেখেছি সম্রাট রয়ালকে নিরাপত্তা দিতে আস্বীকার করলেন। তাই মীর জুমলা তাঁর সুরক্ষার স্বিতীয় স্তর গড়ে তুলতে দ্বিতীয়বারের জন্য রয়ালের হৃদয় জিততে চেষ্টা চালালেন। তিনি আওরঙ্গজেবকে বললেন রয়াল কিন্তু তাঁর মতিতে স্থির রয়েছে এবং তাকে রয়ালের বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আওরঙ্গজেব উত্তর দিলেন যেহেতু মীর জুমলা এর আগে রয়ালের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন, তাই তাকে নতুন করে পাদশাহের সামনে বিষয়টা পেশ করতে হবে।

৫। আওরঙ্গজেবের গোলকুণ্ডা অভিযানের পরিকল্পনা মুঘলদের সঙ্গে গোপনে চলতে থাকা তাঁর দীর্ঘ কূটনৈতিক আলাপ আলোচনা সত্ত্বেও কিন্তু শেষ পর্যন্ত মীর জুমলা বাধ্যবাধকতাটাকে ঠেকিয়ে রাখতে পারলেন না। মুঘল সম্রাটের সঙ্গে যে তিনি আলাপালোচনা চালাচ্ছেন, সেই খবর প্রকাশ হয়ে পড়ল। সুলতানেরা তাঁর বিরুদ্ধে যৌথ সেনাবাহিনী পাঠানোর পরিকল্পনা করতে লাগলেন। তাঁরা দুজনেই চাইছিলেন না যে মীর জুমলা তাঁর ব্যাপক সম্পদ এবং এই এলাকা সম্বন্ধে খুঁটিনাটি জ্ঞান নিয়ে যেন কোনভাবেই সম্রাটের সেনা বাহিনীতে যোগ দিতে পারেন। এই গোপন আলোচনা প্রকাশ্যে আসায় চূড়ান্তভাবে বেশি অস্থির হয়ে চূড়ান্ত পদক্ষেপ নিয়ে ফেললেন সুলতান আবদাল্লা কুতুব শাহ। ২১ নভেম্বর ১৬৫৫ সালে তিনি তাঁর অনুপস্থিত আমীরের পুত্র মহম্মদ আমিন, তাঁর মা আর বোনকে গ্রাফতার করে, তাদের সব সম্পদ ছিনিয়ে নিয়ে গোলকুণ্ডার অনতিদূরে কোভিলকোণ্ডা দুর্গে বন্দী করে রাখলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি আওরঙ্গজেব সম্রাটের কর্ণগোচর করলেন এবং বললেন এই খবরে মীর জুমলা উত্তেজিত হয়ে পড়বেন এবং দূরদৃষ্টিবিহীন কুতবুলমুলক মীর জুমলার পুত্রকে হত্যাও করতে পারে, তাই তাকে নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ করার অনুমতি দেওয়া হোক’।

এই ঘটনায় মুঘলদের প্রতি যে দ্বিধান্বিত অবস্থা ছিল মীর জুমলার সেটি চকিতে উধাও হয়ে গেল। মীর জুমলার ইচ্ছে গোলকুণ্ডার সুলতান তো পূরণ করেনই নি বরং তাঁর পরিবারের সদস্যদের বন্দী করে রেখে তাঁর হতাশা আরও বাড়িয়ে দিয়ে তাকে সত্যিকারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঠেকে দিলেন। তিনি সুলতানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলেন। তাঁর নিজের সেনা বাহিনী দুই সুলতানের বাহিনীর সঙ্গে জুঝতে পারবে না, তাই তিনি সরাসরি আওরঙ্গজেবের শরণাপন্ন হলেন, বললেন তিনি সাম্রাজ্যের অন্যতম একনিষ্ঠ সেবক এবং তিনি মহান সম্রাটের কাছে সাহায্য ভিক্ষা করছেন। স্বীকার করলেন তাঁর একার বাহিনী দিয়ে এই অবস্থার সমাধান হবে না, সুলতানদের বিরুদ্ধে সম্রাটের সরাসরি সাহায্য দরকার। তাঁর চিঠি অনুবাদ সম্রাটের কাছে পাঠিয়ে আওরঙ্গজেব সরাসরি তাঁর পিতাকে চাপ দিলেন কোন নির্দিষ্ট পদক্ষেপ করার। আয়ুত সম্পদে ধনী গোলকুণ্ডাকে দখল করার এই যে অবস্থা আওরঙ্গজেবের সামনে উপস্থিত হয়েছে সেই অবস্থাটি এইভাবে তিলে তিলে পেকে উঠুক, সেই মনোভাব বহুকাল ধরে আওরঙ্গজেব পোষণ করছিলেন। এখন তাঁর সাম্রাজ্যবাদী সত্ত্বা শুধু গোলকুণ্ডা দখল করে শান্ত থাকল না, এর সঙ্গে কর্ণাটকের দিকেও নজর পড়ল। পিতাকে তিনি লিখলেন এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না, কেননা গোলকুণ্ডা এবং তাদের হয়ে মীর জুমলা কর্ণাটক দখল করেছে। এই দুটি অঞ্চল সম্পদে অমিত ধনী, নানান ধরণের দুষ্প্রাপ্য পণ্য রয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে, আরও যে কত কি লুকিয়ে আছে তা জানার বাইরে, আর রয়েছে বিশ্বশ্রুত খনি – এত কিছুর সঙ্গে সম্রাটের হাতে এসে পড়বে কর্মক্ষম কিছু অভিজাত যা সম্রাটের সাম্রাজ্যকে শুধু ঐহিক নয় পারমার্থিক বুদ্ধিবৃত্তিতেও ধনী করবে।

১৬৫৫ সালের ৩ ডিসেম্বর সম্রাট শাহজাহান মীর জুমলার আবেদন শুনলেন এবং আওরঙ্গজেবের অনুরোধক্রমে কাজি মহম্মদ আরিফ কাশ্মীরী(আহদির দ্বিতীয় বক্সী)র মার্ফত মীর জুমলাকে মুঘল সেনাবাহিনীর ৫ হাজারি জাট এবং ৫ হাজার সওয়ার এবং তাঁর পুত্রকে ২ হাজার জাট এবং ২ হাজার সওয়ার পদে নিয়োগ করে অসাধারণ সুন্দর কারুকার্যময় একটি চিঠি এবং খিলাত পাঠিয়ে রাজসভায় হাজির হতে নির্দেশ দিলেন। একই সঙ্গে কুতুব শাহকে একটি চিঠি লিখে মীর জুমলা আর তাঁর পুত্রকে রাজসভায় আসতে বাধা না দেওয়ার এবং তাদের কোন সম্পত্তি অধিকার না করার এবং পরিবারের কাউকে হেনস্থা না করারও নির্দেশ দিলেন। ১৬৫৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর এই চিঠি দুটি আওরঙ্গজেবকে দেন মহম্মদ শরিফ ইসাওয়াল। আওরঙ্গজেব কুতুব শাহকে চিঠি লিখে জানালেন উক্ত দিন থেকে মীর জুমলা এবং তাঁর পুত্র রাজকীয় সেবায় নিযুক্ত হয়েছেন ফলে কুতুব শাহ হয় তাঁর পুত্রকে ছেড়ে দিক না হয় যথোপযুক্ত অবস্থার মুখোমুখি হতে প্রস্তুত থাকুক। এরই সঙ্গে আওরঙ্গজেব রাজস্ব বাকি পড়ার অজুহাতে হায়দারাবাদ অভিযানেরও নির্দেশ দিলেন।

এই ঘটনায় দুইজন প্রধান চক্রান্তকারী, প্রথমজন দাক্ষিণাত্যের উচ্চাকাঙ্ক্ষী মুঘল সুবাদার অন্যজন প্রত্যাঘাত করতে চাওয়া গোলকুণ্ডার পারসিক উজির। এই দুজনে মিলে ব্যক্তিগত দূত মহম্মদ আরফকে দিয়ে ইঙ্গিতে পাঠানো উভয় পক্ষেরে মৌখিক আলাপ এবং গোপন চিঠি চাপাটি মার্ফত গোলকুণ্ডা দখলের অবস্থা তৈরি করেছিলেন। মীর জুমলার আন্তরিকতা এবং বিশ্বাসের প্রতি দাদ দিয়ে তাকে আওরঙ্গজেব লিখলেন, দুমুখোটি(কুতুব শা) উচিত শাস্তি পাবে... তাকে আমি সঠিক সময়ে তোমার সঠিক পরামর্শ নিয়ে সমূলে উচ্ছেদ করব। মীর জুমলাকে বলা হল কুতুব শাহের সরইলস্কর এবং অন্যান্য সেনাপতির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ভড়কাতে, কেননা তাদের সঙ্গে জোট বাঁধা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হবে। এবং মীর জুমলা যখন কর্ণাটক ছাড়বেন, তখন যেন তিনি রয়ালকে তাঁর পক্ষে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। ছোট করে আররঙ্গজেব লিখলেন, ‘যে কোন মূল্যে শত্রুর থেকে তোমার সব ক’টি পদক্ষেপ গোপন রাখ। বিভিন্ন অঞ্চলে যা সব ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে তা সংগ্রহ কর। তোমার যে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার ২/৩ মাস আগে থেকে আমায় সতর্ক কোরো এবং খুব বেশি দেরি কোর না।’ তিনি আরও লিখলেন, ‘আমি চাই লোকে দেখুক আমি তোমায় কতটা বিশ্বাস এবং পক্ষপাত করছি আর তারা ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে মরুক।’ মীর তাঁর পক্ষ থেকে আওরঙ্গজেবকে জানালেন যে তিনি যেন গোলকুণ্ডা আক্রমণ করেন, সেখানকার প্রধান অমাত্য বা দবীর তাঁর আত্মীয় এবং আক্রমণকারী সেনাকে দৈনিক ৫০০০০ টাকা ভর্তুকি দিতে প্রস্তুত।

চক্রান্তীদের যে পরিকল্পনা তৈরি হল তা এইঃ ১) কুতুব শাহকে মীর জুমলার ছেলেকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে, সে যদি অমান্য করে, ২) মহম্মদ সুলতান হায়দ্রাবাদে গিয়ে বন্দীদের শক্তি প্রয়োগ করে মুক্ত করবে, প্রয়োজনে মীর জুমলার জন্য অপেক্ষা করবে সেখানে, ৩) যদি আদিল শাহ, কুতুব শাহকে আমিনকে ছাড়ানোর বিরোধিতা করতে (সামরিক )সাহায্য করতে আসে তাহলে ব্যক্তিগতভাবে আওরঙ্গজেব সেখানে যাবেন, ৪) মীর জুমলা কর্ণাটকে তাঁর সব বাকি কাজ শেষ করে ফেলবেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, তাঁর বিশ্বস্ত প্রশাসকেদের বাকি কাজের দায়িত্ব দিয়ে তিনি গোলকুণ্ডার দিকে তাঁর সাঁজোয়া সেনাসহ কাজ উদ্ধারে(আসল মকসদ), গোলকুণ্ডা দখল করতে রওনা হবেন।

গোলকুণ্ডা দখলে মীর জুমলা এবং আওরঙ্গজেব শাঁড়াশি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন – মীর জুমলা দক্ষিণ থেকে এবং আওরঙ্গজেব উত্তর থেকে। তিনি মীর জুমলাকে লিখলেন, ‘আমার মনে হয় তাঁর রাজধানী ছিনিয়ে নেওয়ার এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না।’ সত্যকারের আওরঙ্গজেব যেভাবে পাদশাহকে লিখেছিলেন, সুসজ্জিত হয়ে রণনিপুন পদাতিক, বিপুল হস্তি বাহিনী এবং সাঁজোয়া গোলান্দাজ সেনা নিয়ে মীর জুমলা যদি কর্ণাটক গোলকুণ্ডা থেকে আক্রমণ করেন, সেটা বোধহয় হবে সোনালি সুযোগ, যা আর দ্বিতীয়বার আয়োজিত করা যাবে না। আর এই পরিকল্পনার সাফল্য নির্ভর করছিল দুই বাহিনীর দু দিক থেকে মুহুর্মুহু দ্বিধা হীন আক্রমন করার ওপর, এবং সেই জন্য বার বার আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে বলেছেন যে, সময় এবং অবস্থার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে এবং কোন রকম দেরি ছাড়া এগিয়ে যেতে আর তাঁর সমস্ত পদক্ষেপ আওরঙ্গজেবকে জানাতে এমন কি কবে - কোন তারিখে তিনি হায়দ্রাবাদের পৌঁছতে পারবেন তাও অগ্রিমভাবে জানাতে।

পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার দায় গিয়ে পড়ল আওরঙ্গজেবের ওপর। ১৬৫৫ সালের ২০ ডিসেম্বর তিনি, সমস্ত নীতি ও আনুগত্য বর্হিভূত হয়ে মহম্মদ আমিনকে গ্রেফতারের দায়ে দায়ি করে কুতুব শাহকে একটি নিশান পাঠিয়ে তাঁকে এবং তাঁর পরিবারবর্গকে মুক্ত করার, বাজেয়াপ্ত সম্পদ তাঁর দূত মীর আবদুল কাশেমের (সাজোঁয়া বাহিনীর পরিদর্শক) এবং নিশান বাহক সঈদ আলির হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেন। তিনি সাবধান করে বললেন, এই আদেশ আমান্য করলেই শাহজাদা মহম্মদ গোলকুণ্ডা আক্রমন করতে বাধ্য হবেন। কুতুব শাহ, আদিল শাহের সঙ্গে চুক্তির বলে, মদ্যপান জনিত কারণে এবং প্রবল আত্মঅভিমানে সম্রাটের ৩ ডিসেম্বরের ফর্মান এবং আওরঙ্গজেবের ২০ ডিসেম্বরের নিশান অগ্রাহ্য করলেন। এছাড়াও তিনি নিজের দুর্বুদ্ধিতায় হায়দারাবাদ এবং ইন্দৌরের সীমান্তে গন্ডগোল লাগিয়ে দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব ২৬ ডিসেম্বর মহম্মদ সুলতানকে পাঠালেন গোলকুণ্ডার উদ্দেশ্যে এবং তেলেঙ্গানার উপপ্রশাসক হাদিদাদ খাঁকে নান্দেরে ১০০০০ পদাতিক নিয়ে তাঁর সঙ্গে জমায়েত হতে নির্দেশ দিলেন। মীর ফজলুল্লার সন্তান আসাদুল্লাকে চান্দার জমিদারের উদ্দেশ্যে ৫০০ ঘোড়সওয়ার নিয়ে পাঠিয়ে তাঁর সঙ্গে সীমান্তে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দিলেন এবং মীর জুমলা যদি সেই পথে আসেন তাহলে তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে রাজধানীতে যেতে বললেন। আদিল শাহ যদি কোন গন্ডগোল না করেন, তা হলে আওরঙ্গজেবের অঙ্ক হল এই ঘটনাটা খুব সহজেই মিটিয়ে নেওয়ার। কিন্তু এদিকে সরাসরি জানাগেল আদিল শাহ, কুতুব শাহকে সাহায্য করার জন্য তোড়জোড় করা শুরু করেছেন, ফলে আওরঙ্গজেব সম্রাটের কাছ থেকে নির্দেশ চাইলেন যাতে তিনি তাঁর গোলকুণ্ডা অভিযানের পরিকল্পনা অবিলম্বে মঞ্জুর করেন এই যুক্তিতে যে কুতুব শাহ সম্রাটের নির্দেশ সত্ত্বেও আমিনকে চাড়ে নি।

এ দিকে মহম্মদ আমিনের গ্রেফতারির খবর পেয়ে শাহজাহান কুতুব শাহকে একটি জরুরি চিঠি লিখে আমিনকে ২/৩ দিনের মধ্যে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। ২৯ ডিসেম্বর সম্রাট আওরঙ্গজেবকে জানান যে তাঁর বিশ্বাস কুতুব শাহ আমিনকে ছেড়ে দেবে, কিন্তু তিনি তার পুত্রকে বলেন সব ধরণের সিদ্ধান্তের পথ খোলা রাখতে এবং আওরঙ্গজেবকে শান্ত করতে তিনি বলেন যদি দেখা যায় গোলকুণ্ডা তাঁর নির্দেশ অমান্য করছে তাহলেই কেবল মাত্র তিনি যেন আক্রমণের পথ ধরেন। কুতুব শাহ মীর জুমলাকে যে কোন মূল্যে ধরতে চাইলেন। এদিকে মালওয়ার প্রশাসক শায়েস্তা খাঁকে তাঁর মনসবদারদের নিয়ে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যোগ দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হল। দুটো চিঠিই আওরঙ্গজেবের হাতে পৌঁছল ৭ জানুয়ারি, ১৬৫৬। তিনি তুলির আঁচড়ে গোলকুণ্ডা ধ্বংস করতে উদ্যোগী হলেন। শাহজাহানের ২৪ তারিখের বন্দী মুক্তির চিঠি কুতুব শাহের হাতে পড়ার জন্য অপেক্ষা না করেই ৩ ডিসেম্বরের সম্রাটের চিঠি অমান্য করায় শাহেনশাহের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়েছে ফলে তাঁর আর গোলকুণ্ডা আক্রমণ করা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই বলে কুতুব শাকে জানালেন। মীর জুমলাকে বললেন, সুলতান যদি নিজের হাতে বন্দীদের মুক্ত না করে, আওরঙ্গজেব নিজে গিয়ে বন্দীদের মুক্ত করাবেন। তিনি নিজের অভিযান বন্ধ করে তাঁর পুত্রকে হায়দারাবাদের দিকে কুচ, এবং যদি তারা বন্দী থাকেন তাহলে তাদের অবিলম্বে মুক্ত করার নির্দেশ দিলেন।


৬। মীর জুমলার পুত্রের এবং সম্পত্তির মুক্তি ৭ জানুয়ারি নান্দেরে শাহজাদা মহম্মদের সসৈন্যে উপস্থিত হওয়ার সংবাদ পাওয়া সত্ত্বেও মহম্মদ আমীনকে মুক্তি দেননি গোলকুণ্ডার সুলতান। ২৪ তারিখের সম্রাটের কঠোর শব্দে লেখা ফার্মান এবং শাহজাদার হায়দ্রাবাদের দুই স্তর আগে পৌছোনোর সংবাদে হঠাতই যেন ঘুমের ঘোর থেকে জেগে উঠলেন তিনি। মহম্মদ আমীনকে এবং তাঁর পরিবারকে গোলকুণ্ডার মুঘল হাজিব, আব্দুল লতিফ এবং আওরঙ্গজেবের দূত আবদুল কাশেম আর সঈদ আলির হাতে সসম্মানে মুক্তি দিয়ে নিয়াজ বেগ আর আজিজ বেগ মার্ফত সম্রাটকে মুক্তিদানের দেরির জন্য কৈফিয়ত দিয়ে পাঠালেন। ২১ জানুয়ারি, হায়দ্রাবাদ থেকে ২১ কোস দূরে মহম্মদ আমিন তাঁর ‘সাহায্যকারী’ শাহজাহার সঙ্গে দেখা করলেন, তিনি আমীনকে বললেন রণনৈতিকভাবে সঠিক সময় না আসা পর্যন্ত যেন তিনি মীর জুমলার জন্য অপেক্ষা করেন। যেহেতু কুতুব শাহ তাঁর পরিবারের সম্পত্তি হস্তান্তর করে নি, সেই অজুহাতে শাহজাহা সেনা নিয়ে হায়দারাবাদের দিকে এগিয়েই চললেন। ২২ জানুয়ারি এই সংবাদে সুলতান তড়িঘড়ি নিরাপদে আশ্রয় নিলেন তাঁর মহম্মদনগরের(গোলকুণ্ডার) প্রাসাদে। হায়দ্রাবাদের ৫ মাইল দূরে হুসেন শাহ হ্রদের পাশে উপস্থিত হয়ে শাহজাদা পরিখা খোঁড়ার এবং গোলকুণ্ডা দুর্গের সামনে মাইন পোঁতার নির্দেশ দিলেন। যদিও সেনাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল শহরের সাধারণ মানুষের ক্ষতি না করার, কিন্তু ২৪ তারিখে হায়দ্রাবাজ জুড়ে লুঠতরাজ চলল। বিজাপুরি সেনাপতি আফজল খাঁ হায়দ্রাবাদের ৪০ মাইল জুড়ে সেনা মোতায়েন করেছিলেন, তাই আর দেরি করা বিপজ্জনক হয়ে যাবে চিন্তা করে নান্দের থেকে অভিযান শুরু করে ১৮ জানুয়ারি গোলকুণ্ডায় পৌছলেন আওরঙ্গজেব। তিনি অপেক্ষা করছিলেন মীর জুমলার আগমনের জন্য। তাঁর মতলব, যদি সম্রাট শাহজাহান অনুমতি দেন তাহলে গোলকুণ্ডা দখল করবেন, না হলে মীর জুমলার দখল করা সম্পত্তি এখন যেটি গোলকুণ্ডা রাষ্ট্রের দখলে সেটি উদ্ধার করবেন এবং পরিশোধ না করা পেশকাশও উদ্ধার করবেন এবং কুতুব শাহের থেকে উজ্জ্বল কোন উপহার বাগাবেন। হতবুদ্ধি, কিংকর্তব্যবিমূঢতার ভোগা কুতুব শাহ এখন আওরঙ্গজেবকে যে কোন প্রকারে শান্ত করতে তীব্রউতসুক হয়ে মীর ফরাসের তত্ত্বাবধানে সোনায় মোড়া হাতি, ঘোড়া, চারটি পুঁটলি হিরেজহরতসহ গয়না পাঠালেন, এবং তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ জানালেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব সেই প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করলেন। সুলতানের দূত মোল্লা আব্বাস সাইহানদ, এমন কি দারা এবং জাহানারা মার্ফতও শাহজাহানের কাছে রাহতের আবেদন করলেন। আওরঙ্গজেবের ধারণা হল সম্রাট তাঁর আবেদন মেনে নেবেন এবং প্রকারন্তরে সুলতানকে কর্ণাটক দখলের অনুমতিও দিয়ে দেবেন – অথচ এই বিস্তৃত, সম্পদশালী, চোখে দেখা যায় না এমন সম্পদে ভরপুর, দূর্গ এবং ধনীদের অধ্যুষিত অঞ্চলটি মীর জুমলা স্থানীয় জমিদারদের থেকে জয় করেছিলেন। কোন কারণে সম্রাট তাকে মাফ করে দিলে আওরঙ্গজেবের পায়ের তলার মাটি সরে যাবে। মীর জুমলার আসার গুরুত্বটাই হারিয়ে যাবে। তাঁর আশংকা হল, এই সাজিয়েগুজিয়ে তোলা ঘটনাপ্রবাহটি হাতের বাইরে চলে যাবে। তাই তিনি পাদশাহের কাছে প্রার্থনা করে জানালেন, যতক্ষণনা মীর জুমলার সন্তান সেখানে পৌঁছচ্ছে, ততক্ষণ যেন পাদশাহ কুতুব শাহের কোন প্রার্থনারই উত্তর না দেন, বিশেষ করে কুতুব শাহের দূত রাজধানীতে পৌছনোর আগেই মীর জুমলা হায়দ্রাবাদের পৌঁছে যাবেন।

হায়দ্রাবাদের লুঠতরাজের সময় মীর জুমলার পুত্রকে শাহজাদা মহম্মদ সুলতান দায়িত্ব দিয়েছিলেন, কুতুব শাহের সম্পত্তি এবং আসবাবপত্র রক্ষার। কুতুব শাহের দূত হাকিম নিজামুদ্দিন আহমদকে মুঘল শিবিরে নজরদারিতে রাখা হল, এই অভিযোগে যে সুলতান মীর জুমলার সম্পত্তি হস্তান্তর করতে দেরি করেছেন। শেষ পর্যন্ত ২৯ জানুয়ারি ১৬৫৬ কুতুব শাহ মীর জুমলার ১১টি হাতি, ৬০টা ঘোড়া এবং অন্যান্য জব্দ করা সম্পত্তি মহম্মদ সুলতানের নজরদারিতে ফিরিয়ে দিলেন।

৭। আওরঙ্গজেবের শিবিরে মীর জুমলার আগমন গোলকুণ্ডা ঘেরাও করে রাখার মাসগুলি ধরে আওরঙ্গজেব মীর জুমলার আগমনের প্রতীক্ষা করছিলেন। একের পর এক গোপনীত বার্তা পাঠিয়ে তাকে বলা হচ্ছিল এই সোনালি সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যেতে চলেছে, তাই যততাড়াতাড়ি সম্ভব তিনি যেন এসে আওরঙ্গজেবের শিবিরে যোগ দেন। কিন্তু মীর জুমলা নিজের ঘর না গুছিয়ে অর্থাৎ বিজিত কর্ণাটকের প্রশাসন না সামলে এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সব সম্পদ না গুছিয়ে আসতে পারছিলেন না। খ্বাজা আরিফ মহম্মদকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মীর জুমলাকে কর্ণাটক থেকে রওনা করিয়ে দেওয়ার – কিন্তু তিনি বিফল হলেন। ১৬৫৬ সালে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে জানালেন তার দেরির কারণ, এবং অনুরোধ করলেন তাঁর বক্তব্য যেন সম্রাটকে জানানো হয়। ১০ জানুয়ারি তিনি মীর জুমলাকে একবার তাঁর ভবিষ্যিত পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন অর্থাৎ ১৮ তারিখে মহম্মদ সুলতান হায়দ্রাবাদ পৌঁছবে এবং যতদূর সম্ভব তিনি পৌঁছবেন ২০ তারিখে। তিনি লিখলেন, ‘আমার সমস্ত চেষ্টা হবে যেভাবে কুতুবুউলমুলক মহম্মদ আমীনকে গোলকুণ্ডায় গ্রেফতার করেছে, আমি ঠিক সেইভাবেই তাকে গ্রেফতার করব। তুমি দূর্গ এবং নিজের সম্পত্তি আগলানোর ব্যবস্থা করছ ভাল কথা, কিন্তু সব কিছু ফেলে রেখে এবং সময়ের দিকে নজর রেখে যত তাড়াতাড়ি হায়দ্রাবাদে পৌছনোর চেষ্টা কর’। কুতুব শাহ তাঁর পুত্রকে মুক্তি দিলেও আওরঙ্গজেব তাঁর পরিকল্পনা থেকে সরতে রাজি ছিলেন না, এবং বললেন খুব শীঘ্র এসে এই বিশদ পরিকল্পনাটি রূপায়িত কর, এবং মহম্মদ মুমিনকে তাকে আনতে পাঠালেন। মীর জুমলাকে আবার লিখলেন, ‘এই ঘটনার শেষ ফলের প্রতি উদাসীন থেকো না, এবং এক মুহূর্তও অপব্যয় কর না।’ তাঁর অনুরোধে তিনি ১১ ফেব্রুয়ারি ২০০০ ঘোড়সওয়ার বাহিত হয়ে আবার আবদুল লতিফকে পাঠালেন মীর জুমলাকে আনতে। কিন্তু মীর জুমলার পথে দেরি ঘটল তাঁর সাঁজোয়া বাহিনীর শ্লথ গতির জন্য। দিনের পর দিন যায় মীর জুমলা আর আসেন না। দিন যায় আওরঙ্গজেব জিততে থাকেন ততবেশি কুতুব শাহ শাহেনশাহর প্রতি করে মার্জনা ও শান্তি ভিক্ষা করতে থাকেন এবং এই বার্তা আওরঙ্গজেবের কাছে আসতে থাকে নিয়মিত। জেতার মুহূর্তে যখন তাঁর আশা ফলবতী হতে চলেছে অথচ মীর জুমলা পৌছচ্ছেন না, তখন হতোদ্যম হয়ে এবং প্রায় হতাশায় ডুবে পড়ে সুবাদার তাঁর সাথীকে মার্চ মাসে লিখলেন, ‘আমি তাকে(সুলতান) নগ্ন করে দিতে পারি, আমার বিশ্বাস তুমি রাস্তায় আছ... কুতুব শাহ এখন ক্ষমা ভিক্ষা করছে... তাঁর জামাই মীর আহমদকে আমার কাছে পাঠিয়েছে এই বলে যে আমার জন্য তাঁর মা অপেক্ষা করছেন, যেন আমার পুত্র তাঁর কন্যাকে বিবাহ করে... কিন্তু আমি তাকে শান্তিতে থাকতে দেব না... আমার উচ্চাশার আকাশ্চুম্বী, আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।’

অবশেষে আওরঙ্গজেবের অপেক্ষার অন্তহীন অপেক্ষার সময় শেষ হল। ৮ মার্চ মীর জুমলা কৃষ্ণা পার হয়ে ১৮ মার্চ তাঁর শিবিরে উপস্থিত হলেন। সেটি হাসান সাগর হ্রদের ৮ মাইল দূরে অবস্থিত ছিল। তাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য সাম্রাজ্যের ফার্মান আর খিলাত নিয়ে খ্বাজা আরিফ কৃষ্ণার তীরে পৌঁছলেন।

৬০০০ ঘোড়সওয়ার, ১৫০০০ পদাতিক, ১৫০টা হাতি এবং বিশাল সাঁজোয়া বাহিনীর সম্পদ, নগদ অর্থ, সোনায় মোড়া অস্ত্রশস্ত্র, হিরে নীলকান্ত মণি, জহরত, পণ্য, আসবাব ইত্যাদি নিয়ে মীর জুমলা, আওরঙ্গজেবের শিবিরের দিকে চললেন। তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন মালিনজী, নাসিরি খান, এবং তাকে আনতে পাঠানো মীর সামসুদ্দিন। হায়দ্রাবাদে শাহজাদা সকাশে তিনি আবির্ভূত হলেন অভিজাত নন, শাহজাদারূপে। ২০ মার্চের জ্যোতির্বিদের গণনা করা শুভ মুহূর্তে তিনি শাহজাদার সঙ্গে দেখা করার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন তাঁর শিবিরে, যার ‘পরিচর্যা আর অবধানে’ তিনি দুর্ভাগ্য থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি, তাকে ৩০০০ ইব্রাহিম পেশকাশ দিলেন, এবং প্রত্যুত্তরে কিছু উপহারও পেলেন। আওরঙ্গজেব তাঁকে খিলাকতখানায় নিয়ে গেলেন, এবং যেন সেখানে মীর জুমলা নতুন জীবন লাভ করলেন। গোলকুণ্ডার সঙ্গে শান্তি চুক্তির পক্ষকাল পরে, ১৪ এপ্রিল আওরঙ্গজেব মীর জুমলার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। মীর জুমলা তাঁকে আর তাঁর পুত্রকে কয়েক লক্ষ টাকার উপঢৌকন দিলেন। (তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত)

চতুর্থ অধ্যায় মুঘল উজির রূপে মীর জুমলা[সম্পাদনা]

প্রথম ভাগ

আওরঙ্গজেবের দূত হিসেবে উজিরিকর্ম ১৬ এপ্রিল হায়দ্রাবাদ থেকে বেরিয়ে পড়ে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে ইন্দৌর গেলেন ২ মে। প্রায় একসঙ্গে একপক্ষকাল কাটিয়ে তাঁরা দুজনে আগামী ভবিষ্যতের কাজকর্ম নিয়ে বিশদে আলোচনা করলেন, বিশেষ করে রাজধানীর সিংহাসনের দিকে নজর রেখে আগামী দিনের রণসজ্জা কিভাবে সামলানো যায় সে ভাবনা ভাবতে শুরু করলেন। তাঁকে গোপনে শুভেচ্ছা এবং তাঁর বন্ধুত্বের প্রতিশ্রুতি দিলেন মীর জুমলা। ইন্দৌর থেকে আওরঙ্গজেব তাকে আর তাঁর পুত্রকে নিয়ে কাজি আরিফের সমবিব্যহারে রাজধানী যাবার নির্দেশ দিলেন, সেটা ৩ মে। ন্যায়দণ্ডধারী মহম্মদ বেগ ১০ এপ্রিলের ফর্মান অনুযায়ী মীর জুমলাকে মুয়াজ্জম খান(মহিমান্বিত বন্ধু) উপাধি এবং রণবাদ্য সহ অনেক কিছু উপহার দিলেন।

দিল্লিতে ডেকে পাঠানোর চিঠির প্রতিক্রিয়ায় তিনি ইন্দোর ছাড়লেন ৭ মে। রাস্তাতেও তিনি আওরঙ্গজেবের সঙ্গে নিয়মিত চিঠির মাধ্যমে যোগাযোগ রেখে গিয়েছেন। সম্মান পাওয়ায় সংবাদে আওরঙ্গজেব তাকে অভিনন্দন জানালেন, এবং সম্রাটের ডাকের প্রতিক্রিয়ায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দিল্লি পৌঁছনর বার্তা দিলেন, আর বললেন, পথে নান্দেরে তাঁর সঙ্গে খ্বজা আহমেদ আরিফ যোগ দেবেন। তিনি আরও জানতে চাইছিলেন মীর জুমলা মহম্মদ আমীনকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন, না কি তাকে ইন্দোরে রেখে গিয়েছেন। এছাড়াও কর্ণাটকের জমিদারদের মন জয় করতে পেরেছেন কিনা তাও প্রশ্ন করলেন। উত্তরে জানালেন, মীর মহম্মদ আমীন বুরহানপুর পর্যন্ত এসে প্রচণ্ড বর্ষায় আর এগোতে পারেন নি। ২৭ জুন আওরঙ্গজেব খবর পেলেন যে মীর জুমলা পাদশাহের থেকে ব্যক্তিগত চিঠি পেয়েছেন। এই খবরে আওরঙ্গজেব ভীষণ খুশি হয়ে মীর জুমলাকে লিখলেন, ‘...আমার মন ভাগ্যের ঘোমটা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি দেখতে চাই তোমার সব পরিকল্পনা সফল হচ্ছে। আমি কিন্তু তোমার বর্তমানের ছোটখাট সম্মান পাওয়ায় খুব একটা প্রীত হচ্ছি না। আমি জানি তুমি আরও ওপরের দিকে তাকয়ে রয়েছ, সেটা তোমার অধরা থাকবে না। তা খুব তাড়াতাড়ি বাস্তবে রূপ পাবেই, যদিও তাতে শত্রুদের চরম ঈর্ষা আর হাহাকার বন্ধ হবে না। (কবিতা) অপেক্ষা কর কখন তোমার ভবিষ্যতের ভোর হবে, এটাই শেষ প্রহর।’

আওরঙ্গজেব সাদুল্লা খানের মৃত্যুতে একজন সহযোদ্ধা হারিয়েছিলেন, তাই তিনি সাম্রাজ্যের বাহিনীতে মীর জুমলার মত দক্ষ মানুষ চাইছিলেন অধীর আগ্রহে। তিনি মীর জুমলাকে সরিয়ে রেখে(বাফার এজেন্ট) দারার বিরুদ্ধে ঘুটি সাজাবার পরিকল্পনা করছিলেন। আওরঙ্গজেব শাহ্নওয়াজ খানকে লিখলেন, ‘সাদুল্লা খানের মৃত্যুতে আমি এক শুভচিন্তককে হারিয়েছি। এখন মুয়াজ্জম খান আমার শুভাকাঙ্ক্ষী এবং বিশ্বাসী আমার ইচ্ছেয় এগোতে শুরু করেছে, আবার ধারণা এ বিষয়ে সর্বশক্তিমান আমাদের সঙ্গে আছেন’। উল্টো দিকে দারা, মীর জুমলাকে সামরিক বাহিনীতে নেওয়ার তীব্র বিরোধিতা করেন। দারার শিবিরের সমস্ত বিরোধিতা সরিয়ে রেখে, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের যে গোলযোগ চলছে, তা মেটাতে পাদশাহ, মীর জুমলার ওপরেই আস্থা পেশ করার সিদ্ধন্ত নিলেন; তাঁর স্থির নিশ্চয় ছিল যে পারসিকদের থেকে কান্দাহার উদ্ধার করার ক্ষমতা একমাত্র মীর জুমলারই রয়েছে।

রাজধানীর দিকে সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে গৌরবময় মীর জুমলার যাত্রা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। দিল্লিতে থাকা মানুচি লিখছেন, ‘যে অঞ্চল হয়ে তিনি যাচ্ছেন, সেখানের প্রশাসক তাকে সম্মান জানাচ্ছেন উপঢৌকন পাঠিয়ে... দিল্লির কাছাকাছি আসতে সম্রাট সব সব থেকে বড় সেনানায়ক পাঠিয়ে সসম্মানে নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করেন। রাজা গেলে রাস্তা এবং তাঁর পাশের দোকানগুলি যেমন সজ্জিত করা হয়, সম্রাটের নির্দেশ ছিল, মীর জুমলার যাত্রাপথেও ঠিক তেমনি সজ্জা করার।’ ২৫ রমজান ১০৬৭, ৭ জুলাই ১৬৫৬, মীর জুমলার দিল্লির কাছাকাছি আসার সংবাদ পেয়ে সম্রাট মীর আতিশ কাশিম খান এবং দানিশমন্দ খান বক্সীকে শহরের বাইরে গিয়ে তাকে অভ্যর্থনার নির্দেশ দিলেন। শুভ দিনে তিনি সম্রাটের সঙ্গে দেখা করলেন এবং সভায় সভাসদেদের মধ্যে তাঁকে সব থেকে উঁচু আসনে বসার সম্মান দিলেন পাদশাহ।

সম্রাটকে তিনি ১০০০ মোহর এবং কিছু দামি গয়নাগাঁটি নজর হিসেবে দিলেন যার মধ্যে ছিল কর্ণাটকের হিরের খনির কিছু বাছাই করা হিরে। সেদিন সম্রাট তাঁকে আরও একটি বিশেষ খিলাত দিলেন এবং তাঁর পদ মর্যাদা হাজারি হাজার সওয়ারে বৃদ্ধি করলেন, এবার থেকে তিনি ৬০০০ জাত এবং ৬০০০ সওয়ারের পদে বৃত হলেন। ৭ এপ্রিল ১৬৫৬ সালে প্রধানমন্ত্রী সাদুল্লা খানের দেহান্ত হয়। সম্রাট তাঁর মৃত প্রধানমন্ত্রীর পদ, সমগ্র সাম্রাজ্যের দিওয়ানিকুল বা দিওয়ানিআলম অর্থাৎ দিওয়ানের প্রধানমন্ত্রীর পদে বরণ করলেন মীর জুমলাকে। এছাড়াও তাঁকে একটি বহুমূল্যের রত্নে সুসজ্জিত কলমদানি, বিশেষ হাতিশাল থেকে ১০টা হাতি, ঘোড়াশাল থেকে ২০০ ঘোড়া, একটি মাদি হাতি, ৫ লাখ টাকা উপহার হিসেবে দিলেন। মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে তাঁর পাওয়া সম্মান এবং উপহার সম্বন্ধে জানালে, উচ্ছ্বসিত শাহজাদা লিখলেন, ‘আশাকরি সর্বশক্তিমান তোমায় পাদশাহকে খুসি করার মন্ত্র উপহার দিক, যার ফলে তুমি আদতে সর্বশক্তিমানকেই আরাধনা করছ।’ শাহজাহান কুতুব সাহকে লিখলেন, ‘দৈনিক উপহারে উপহারে সম্মানে সম্মানে মীর জুমলার আভিজাত্য যেন বেড়েই চলেছে।’ এছাড়া উপহার স্বরূপ পাদশাহ মীর জুমলাকে রাজস্বমুক্ত কর্ণাটক শাসনের অনুমতি দিলেন।

১৬৫৫-৫৬ বছরটি মীর জুমলার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। গোলকুণ্ডার অশক্ত সুলতানের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়াই শুধু নয়, মীর জুমলা কর্ণাটক নিজের তাঁবে রাখলেন তাই নয়, সম্রাটের আন্তরিক ইচ্ছেয় তাঁর নিজের জাগির হল সেই এলাকাটি। এছাড়াও তাঁর শত্রু হয়ে ওঠা পুরোনো প্রভুর হাত থেকে সাম্রাজ্যের পক্ষ্মপুটে শেষমেশ নিরাপদ আশ্রয়ও পেলেন। তাঁর দীর্ঘ সফল রাজনৈতিক জীবনের শিক্ষা নবিশীর দিন শেষ হল এই বছরেই। ভাগ্য তাকে আগামী দিনে ঝড়ঝঞ্ঝ্বাময় ভবিষ্যৎ সামলানোর রণপরীক্ষার দিকে ঠেলে দিল এত দিনে।

২। রাজস্ব প্রশাসন এবং আর্থিক বিষয়

দেওয়ানি দপ্তর মীর জুমলা সামলেছিলেন ১৫ মাসের কাছাকাছি সময় ধরে – ১৭ জুলাই তাঁর পদ পাওয়ার দিন থেকে ১৬৫৭র সেপ্টেম্বরের পদচ্যুতির দিন পর্যন্ত। ওই সময়ে তিনি পাঁচ মাস দিল্লিতে কাটান, বাকি দশ মাস তাঁর কাটে বিজাপুরের বিরুদ্ধে অভিযানে। উজির পদে কাটানোর সময় – সে রাজধানিতেই হোক বা যুদ্ধ ক্ষেত্রেই হোক, মীর জুমলা কিন্তু যুদ্ধে বা প্রশাসনে তাঁর বন্ধু, দার্শনিক এবং পথ নির্দেশক, যিনি তাঁর নিরাপত্তার ভার নিয়েছিলেন, আওরঙ্গজেবের হয়ে কাজ করার এবং তাঁর মাহাত্ম্য প্রচার করার ভূমিকাই পালন করে গিয়েছেন।

মীর জুমলার যে প্রশাসনিক ঝামেলার ব্যবস্থাপনার মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেই অসুবিধেগুলি কি ছিল আর এখন বিশদে জানা যায় না। আদাবইআলমগিরিতে কয়েকটা রাজস্ব এবং আর্থিক ঘটনার কথা বলা হয়েছে তা মূলত দাক্ষিণাত্যের। এর থেকে পরিষ্কার যে আওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন মীর জুমলা তাঁর পক্ষের সওয়াল স্বয়ং পাদশাহের সামনে করুণ। তিনি মীর জুমলাকে বলেন যে রামগীর(আজকের মানেকদুর্গ এবং চিন্নুর) এলাকার রোজগার হিসেবে, মুঘল হাজিব কাবাদ বেগের সামনে কুতুব শাহ বলেছিলেন মহম্মদ নাসির ১,২০,০০০ হুণ রাজস্ব দেবেন, সেই তথ্যটা বিলকুল সত্য নয়, সেটা অর্ধেক, ৮০,০০০ হুণ হবে; কুতুব শাহের হিসেব সর্বৈব মিথ্যা।

দাক্ষিণাত্যের আর্থিক বিষয়ে আওরঙ্গজেব খুব আর্থিক টালমাটাল অবস্থার মধ্যে পড়েছিলেন। সেই সঙ্কট আরও বেড়ে গিয়েছিল সম্রাটের সঙ্গে মতবিরোধের কারণে। জাগিরের মূল্য থেকে মাত্র একাংশ উদ্ধার হচ্ছিল সাম্রাজ্যের। বছরের ক্ষতি বেড়েই চলছিল, যা জাগিরদারদের আঘাত করছিল ফলে দাক্ষিণাত্যের সেনা বাহিনীর অবস্থা চরম দুর্দশার মধ্যে অতিবাহিত হচ্ছিল। আওরঙ্গজেবের একটা প্রস্তাব ছিল যে জাগিরের একাংশ তাকে এবং অন্য প্রদেশের সর্বোচ্চ আধিকারিককে দেওয়া হোক, সেটা সম্রাট মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় প্রস্তাবটা, তাঁর বেতনের নগদটি মালওয়া আর সুরাট থেকে দেওয়া হোক, সেই প্রস্তাবটি কিন্তু তিনি মানেন নি। ব্যাপক যুদ্ধ চলতে থাকায় কৃষি জোর মার খেল, জনসংখ্যা কমল আর স্থানীয় প্রতিশোধের সংঘর্ষ বাড়ল। শাহজাহান আওরঙ্গজেবের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেন কৃষকদের এবং কৃষির অবস্থা উন্নতির জন্য সচেষ্ট হতে।

দাক্ষিণাত্যের খুব কুশলী দেওয়ান মুর্শিদকুলি, কেন্দ্রকে লিখে জানালেন যে জুলুসের ২৮ তম বছরে(১৬৫৫) বীর পরগণাটি বাতসরিক রোজগারের দুই-তৃতীয়াংশ আয় দিচ্ছে এবং তিনি আশা করছেন, পরের বছরে এই পরিমানটি বাড়তে পারে। এই পরগণার আওরঙ্গজেবের উকিলের বেতন বছরে ২ কোটি দাম, এটিকে তাদের জাগিরের মধ্যে ধরেন নি, কিন্তু মালুজি এবং অন্যান্য জাগিরের হিসেব বিবেচনা করেছেন এবং আশা করছেন ছাড়(তাখফিফ) দেওয়ার পরে সেই পরিমান ছমাসের মধ্যে উদ্ধার হবে। সম্রাট মীর জুমলাকে প্রশ্ন করলেন মুর্শিদ কুলির রাজস্ব সমীক্ষা সত্যি কি না, এবং শাহ বেগ খান বীর না নিয়ে অন্য পরগণা কেন নিলেন এবং তিনি মুর্শিদের সততা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে এই বিষয়টি পরিষ্কার করে দিতে বললেন, কেন শাহ বেগ খান বীর নিল না। উত্তরে আওরঙ্গজেব সেই বছরের এবং আগের বছরের আয়ের উতপাদনের বিস্তৃত সংখ্যাতত্ত্ব পাঠালেন, যাতে মীর জুমলা এই বিষয়ে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করতে পারেন। তিনি জানালেন শাহ বেগ বীর নেন নি বীরের দুর্দশা বা কৃষির অব্যবস্থার(খারাবি ও বিরাণি) কারণে নয় বরং অন্য কোন কারণের জন্য। গোলকুণ্ডা দখলের লড়াইতে শাহ বেগ খানকে আহমদ নগর থেকে ডেকে পাঠানো হল। তিনি তাঁর পরিবারের জন্য আলাদা আলাদা ছড়য়ে ছিটিয়ে থাকা জাগির না দিয়ে ঠিকঠাক একটি পরগণা চাইছিলেন যেখান থেকে তিনি রোজগার করতে পারবেন। আওরঙ্গজেব তাকে ঐ পরগণাটি দিলেন বার্ষিক সাড়ে তিন কোটি দামের বিনিময়ে, যেটি খতিয়ানে(লেজারশিট বা আফ্রাদিতাউজি) দেখানো ছিল। গোলকুণ্ডা থেকে ফিরে আওরঙ্গজেব দেখলেন বীর পরগনা জুড়ে দিয়ে তাঁর মনসব বাড়ানোর প্রস্তাব সম্রাট অনুমোদন দেন নি। ফলে এটি তিনি শাহ বেগের থেকে কেড়ে নেওয়া যুক্তিযুক্ত বলে মনে করলেন না। মুর্শিদ কুলি খানের সম্বন্ধে শাহজাহানের মনে ওঠা কোন রকম দ্বিধা দূর করতে তিনি মীর জুমলাকে লিখলেন, ‘মুর্শিদ কুলি একজন শিরদাঁড়া সোজা আর কর্মদক্ষ (রাস্তওদুরস্তি অস্ত) আমলা। তিনি এই মিথ্যে সমীক্ষা লিখতে পারেন না। তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন, তার সপক্ষে বলার কোন প্রয়োজন পড়ে না। তিনি সেবাপরায়ণ(কর-আমাদান) আধিকারিক। যদি তাকে না বসিয়ে দিয়ে সাম্রাজ্যের কাজে লাগিয়ে রাখা যায় তাহলে ভাল হয়।’ আওরঙ্গজেব প্রস্তাব দিলেন, তবুও যদি মনে হয় মুর্শিদ কুলির কার্যকলাপে প্রশ্নবোধক চিহ্ন মুছে ফেলা যাচ্ছে না, তাহলে একজন আধিকারিক পাঠিয়ে তাঁর কাজগুলি তদন্ত করে দেখা হোক। তিনি প্রস্তাব দিলেন, ‘পাদশাহকে এটা জানিও... জানিও আমি যেমন করে বিষয়গুলি উপস্থাপন করে ঠিক সেই ভাবে কাজটা কোরো।’

এটা আমরা জেনে গিয়েছি যে উজির মীর জুমলা, খুরদর্দ(তৃতীয় পারসিক মাস) মাস পর্যন্ত ইরাজ খান আর তাঁর ভাইয়ের বেতন নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন এবং আওরঙ্গজেব জানিয়ে দিয়েছিলেন এই ব্যবস্থা আগামী দিনেও কার্যকর হবে। আগামী দিনের ভর্তুকির অর্থনীতিটি সামলাতে সম্রাটের নির্দেশে ‘মীর জুমলা জুমলাতউলমুলক’ দাক্ষিণাত্যের করণিকদের(মুতসুদ্দি) লিখলেন, যাদের মনসব বাড়ানোর দরকার হয়ে পড়েছে, আর যারা নতুন মনসব পাবে, তাদের জাগিরের বেতন অর্ধেক হয়ে যাবে এবং সাম্রাজ্যের সনদের সঙ্গে সঙ্গে তাদের বেতন পৌঁছবে, তাঁর আগে নয়। এই নির্দেশের পরে দাক্ষিণাত্যের দেওয়ানেরা এটি বাস্তবায়িত করার জন্য উদ্যোগী হলেন। কিন্তু এই বেতন পাওয়ার সময় দীর্ঘায়িত করার নির্দেশে দাক্ষিণাত্যের মনসবদারেরা সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হলেন এবং যতদূর সম্ভব পাদশাহকে আবেদন করলেন এবং বললেন যে, তারা এতই গরীব তাঁদের পক্ষে একজন করে উকিল পাঠিয়ে তাদের বিষয়টা সম্রাটের সভায় তোলার সামর্থ নেই। অবস্থা বিগড়োচ্ছে দেখে আওরঙ্গজেব তাদের অভিযোগ সংবাদচিঠিতে জুড়ে সম্রাটের বিবেচনার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। এটির প্রতিক্রিয়ায় সম্রাট নির্দেশটি বদলে বললেন যে সনদ যাওয়া পর্যন্ত বেতন বাকি থাকবে না। সিদ্ধান্ত হল যে দাক্ষিণাত্যের রাজস্ব আধিকারিককে বক্সী মার্ফত এই অনুমোদিত নির্দেশটি পাঠানো হবে, তখনই অর্ধেক বেতনটি পাওয়া যাবে এবং সনদ স্থানীয়ভাবেই প্রচার করা হবে।

দাক্ষিণাত্যে আওরঙ্গজেবের সময়ে যে সব মনসবদার প্রথমবার পদনিয়োগ পেয়েছেন, বা যাদের মনসব বেড়েছে, এবং যাদের নাম বক্সী সাফি খান দিল্লিতে আওরঙ্গজেবের উকিলকে পাঠিয়েছেন, তাদের বিষয়ে আওরঙ্গজেব, দিল্লিতে সম্রাট শাহজাহানের বক্সী ইতিকাদ খানকে সাম্রাজ্যের মহাফেজখানার থেকে তাদেরর সক্কলের নাম এবং তথ্য যাচাই করতে অনুরোধ করলেন এবং তাদের দপ্তরে সরাসরি সাম্রাজ্যের অনুমোদন না পাঠিয়ে, তাদের নামের সঙ্গে সাম্রাজ্যের পাঞ্জা বসিয়ে দেওয়া হোক বললেন। তিনি আরও প্রস্তাব করলেন যে, আগামী দিনে এইভাবে প্রত্যেক মাসে আলাদা আলাদা করে হিসেব পাঠিয়ে দেওয়া হোক যাতে সম্রাটের অনুমোদন নিয়ে সেটি অবিলম্বে আওরঙ্গজেবের উকিলের হাতে পৌঁছে যায়। ফলে তিনি চাইলেন ইস্তিয়াক খান এই বিষয়ে হাত ধুয়ে পড়ে থাকুক, কেননা এই বিষয়টি সাম্রাজ্যের স্বার্থে এবং সংহতির জন্য জরুরি এবং এটি মানুষের ক্ষোভ দূর করবে।

৩। মীর জুমলার পৃষ্ঠপোষকতা

সাম্রাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় মীর জুমলা অনুগ্রহ বিতরণের প্রভূত ক্ষমতা অর্জন করেন। তিনি যেহেতু সম্রাটের কৃপাদৃষ্টির ভাগিদার ছিলেন, এবং শাহজাহানের ওপর তাঁর প্রভাব অসীম ছিল, তাই আওরঙ্গজেব চাইতেন তাঁর পছন্দের আমলাদের হয়ে তিনি যেন সম্রাটের সঙ্গে মধ্যস্থতা করেন। দাক্ষিণাত্যের বক্সী, সাফি খানের ওপরে সম্রাট অপ্রসন্ন ছিলেন, তাকে সভায় ডাকিয়ে এনে শাস্তিও দিয়েছিলেন। তাঁর শাস্তির বিষয়টি নিয়ে তিনি মীর জুমলাকে জানান পাদশাহের অপ্রীতির বিষয়টাই ভিত্তিহীন এবং তাঁর শাস্তি অন্যায় অবিচার হয়েছে। তাঁর মত আমলার দক্ষতা প্রশ্নাতীত, তাঁর মত যোগ্য প্রার্থীর জন্য দাক্ষিণাত্যে বক্সী বা ওয়াকিয়ানবিস ছাড়া অন্য পদ নেই। এরকম যোগ্য মানুষকে কোন কারণ ছাড়া শাস্তি দেওয়া এবং অপমান করা হয়েছে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন এবং একটি চিঠি লিখে বলেন, খান, মীর জুমলাকে উঁচু দৃষ্টিতে দেখেন, ফলে তাঁর হয়ে ওকালতি/মধ্যস্থতা করা যুক্তিযুক্ত হবে এবং একই সঙ্গে জুড়লেন, ‘...তোমার দপ্তর থেকেই এই জটিলতা কাটাতে হবে।’ এছাড়াও দাক্ষিণাত্যের দক্ষ এবং অভিজ্ঞ দেওয়ান মুর্শিদকুলির বিষয়টিও মাথায় রাখতে বললেন। এছাড়াও পরলোকগত পয়নঘাটের দেওয়ান আজম খানের পুত্র আহমদ নগরের সার্বিক দায়িত্বে থাকা মুলতাফত খানের(১৬৫৬) বিষয়টিও হিসেবে রাখতে বললেন।

একই সঙ্গে উজিরকে মুনসি কাবলি খান, উপযুক্ত এক আধিকারিক এবং অসাধারণ সেনানী আদম খান খেসগির কথাটাও হিসেবের মধ্যে রাখতে অনুরোধ করলেন। মুরাদকে বহুকাল সেবা করে খেসগি বিজাপুর সরকারে যোগ দিয়েছে এবং সে তার কাজ দায়িত্ব সহকারে সম্পাদন করে। আওরঙ্গজেব তাকে ডেকে পাঠান কিন্তু তাকে সাধারণ ৫০০ জাট এবং ১০০ সওয়ারের মনসব পদ দেন। তিনি এতে সুন্তুষ্ট নন, তাঁর লক্ষ্য সম্রাটের সভা।

৪। আওরঙ্গজেবের অসাধারণ সঙ্গী মীর জুমলা

সম্রাটের দরবারে মীর জুমলার উল্কাস্বরূপ উত্থান আওরঙ্গজেবের নিজের অভিপ্সা এবং উচ্চাশা পূরণের সূচকের সিঁড়ি তৈরি হল বলা যেতে পারে। মীর জুমলার দায়িত্ব এবং তাঁর ভাগ্যের উড়ানে যে প্রতিশ্রুতি আওরঙ্গজেব তাকে দিয়েছিলেন, তা সত্য হওয়ায় তার প্রতি আওরঙ্গজেবের ভালবাসা আরও বাড়ল। আওরঙ্গজেবের শিবির থেকে মীর জুমলা চলে যাওয়ার পর চিঠির পর চিঠিতে দাক্ষিনাত্যের সুবাদার তাঁর প্রতি গভীর ভালবাসা, বন্ধুত্ব আর বন্ধু বিচ্ছেদে তীব্র বেদনার প্রেমানুভূতি - একজন প্রেমিক তাঁর প্রেমিকাকে ছেড়ে গেলে যে ভাব উদয় হয় তা বারবার আকুতি সহকারে জানিয়েছেন। ‘তোমার সঙ্গে থাকার আকুল ইচ্ছে থাকলেও নিষ্ঠুর সময় আমাদের মধ্যে একটা বিচ্ছেদের কঠোর দেওয়াল তুলে দিয়েছে। (কবিতা) সে এল আর গেল। আমার হৃদয়কে সমবেদনা জানাতে কিন্তু সে বেশিক্ষণ বসল না। সর্বশক্তিমান (আমাদের)মিলন ঘটাবার পথ উন্মুক্ত করে দিন...’। আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে বললেন তিনি তাঁর চিরকাল বাধ্য হয়েই থাকবেন। ২৭ জিকাদা/৬ সেপ্টেম্বর ১৬৫৬(?) সালে মীর জুমলার চিঠির উত্তরে তিনি লিখছেন, ‘শুধু সাদায় কালোয়, হৃদয় থেকে উৎসারিত প্রেমানুভূতি আর বন্ধুত্বকে বিচার করা যায় না। যে অকপট উদ্দেশ্য তুমি চিঠিতে প্রকাশ করেছ, এবং আজকাল করে চলেছ, তাতে আমার প্রতি তোমার বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখছি। আমি হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে সেটা অনুভবও করছি। আমি নিশ্চিত জানি, সব পরিকল্পনা ভাবনাচিন্তা রূপায়নে ভাগ্য তোমার সাথে থাকবে। সর্বশক্তিমান তোমায় সেই শক্তি প্রদান করুণ।’ এই উচ্ছ্বসিত ভাবের প্রকাশে একটা বিষয়ই নিশ্চিত করে, উজির মীর জুমলা দাক্ষিণাত্যের দেওয়ানের অমূল্য জোটসঙ্গী ছিলেন।

৫। উজির মীর জুমলার শাহজাদা দারার বিরুদ্ধাচরণ তাঁর নিজের স্বার্থপূরণে উজিরকে ব্যবহার করা আওরঙ্গজেবের মূল উদ্দেশ্য ছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে রাজসভায় দারাকে রুখতে পারলেই একমাত্র তাঁর উচ্চাশা পূরণ হতে পারে। কিন্তু মীর জুমলা সবে দিল্লিতে এসেছেন এবং সঙ্গীসাথী হীন, তাই আওরঙ্গজেব জাহানারাকে অনুরোধ করলেন, মীর জুমলার প্রতি সদয় ব্যবহার করতে এবং তাকে প্রত্যেক বিষয়ে সমর্থন করতে। জাহানারা সম্মতি জানালে তিনি মীর জুমলাকে বললেন অবিলম্বে ঈশা বেগের মাধ্যমে জাহানারাকে ‘অদেখা’ সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ জানানো দরকার এবং তাঁর সমর্থন জোগাড়ের জন্য তাকে বলা, এই রাজসভায় জাহানারা ছাড়া মীর জুমলার অন্য কোন গতি নেই, তিনি তাঁর সম্মান জাহানারার পায়ের কাছে লুটিয়ে দিচ্ছেন। অন্যান্য অভিজাতর সঙ্গে ভাল ব্যবহার করতে পরামর্শ দিলেন, বললেন, জ্ঞানীর থেকে দূরে থাকা জরুরি কাজ নয়।

দিল্লির রাজসভায় মীর জুমলার কূটনৈতিক দক্ষতার প্রভাব দেখা গেল অবিলম্বেই। আমরা আগেই দেখেছি, কর্ণাটকে থাকাকালীন তিনি, বিজাপুরী সুলতানের প্রতি বিদ্বিষ্ট শাহজী ভোঁসলাকে মুঘলদের পাশে দাঁড়াবার জন্য রাজি করেয়েছিলেন। মীর জুমলা শাহজীকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা প্রত্যায়িত করেন আওরঙ্গজেব। রাজসভায় মুঘল উজির হিসেবে এসে দারার ইচ্ছের বিপক্ষে গিয়ে শাহজীর প্রতি পুরোন প্রতিশ্রুতি স্মরণ করে তিনি সম্রাটকে সেই বিষয়ে এগোতে পরামর্শ দিলেন। তাঁর প্রস্তাবে আওরঙ্গজেব সম্মতি দিলেন এবং বললেন, শাহজীর প্রতি যে সব মিথ্যে অভিযোগ এসেছে তা যেন খণ্ডানোর চেষ্টা মীর জুমলা করেন।

বিজাপুরের উপঢৌকনের প্রভাবে দারা যেভাবে সম্রাটকে আওরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে প্রভাবিত করেছিলেন, তাঁর বিরুদ্ধে গিয়ে মীর জুমলা যেভাবে সম্রাটের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আওরঙ্গজেবের পক্ষ ধরে সওয়াল করেন, তা আওরঙ্গজেবের কাছে চিত্তগ্রাহী বিষ্ময় রূপে উপস্থিত হয়েছিল। নিজের উকিলের কাছে সেই সংবাদ জেনে আওরঙ্গজেব, মীরজুমলার মুন্সি কাবলি খানকে তাঁর প্রভু সম্বন্ধে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। ‘আমি এর থেকে বেশি মীর জুমলার থেকে প্রত্যাশা করি (চশমাদস্ত মা আজ ইশান পেশ আজ ইন অস্ত)। আমি জানি আমার ভালর জন্য সে প্রত্যেক পদক্ষেপ করা থেকে নিজেকে বিচ্যুত করবে না। এবং আমি যা বলছি, তাঁর থেকেও বেশি কাজ সে করবে এটা আমার বিশ্বাস। তিনি মীর জুমলাকে জানালেন যে সাম্প্রতিক অতীতে আদিল শাহ সম্রাটকে এমন কিছু চোখ ধাঁধানো পেশকাশ পাঠাতে পারেন নি, পাঠিয়েছেন মাত্র ৪ লাখ টাকা(প্রতিশ্রুত ৯ লাখ টাকার পরিবর্তে) এবং আবুল হাসান এটি সম্রাটের সামনে উপস্থিত করবে। এই বিষয়টি গুরুত্বসহকারে সম্রাটের সামনে উপস্থিত করতে উজিরকে বললেন, এবং যদি এই প্রশ্নটা যদি আবার ওঠে, তাহলে উত্তরটা এমন দিও যাতে শত্রুরা(এক্ষেত্রে দারা) পস্তায়।

৬। উজিরের দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের সঙ্গে সম্রাটের মধ্যস্থতা

গোলকুণ্ডার লুঠের মাল(জিকাদা, ৩০তম জুলুস) নিয়ে সুলতানের সঙ্গে আওরঙ্গজেবের যে বিরোধ ঘটে তার ঘটনাপ্রবাহ থেকে পরিষ্কার যে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের হয়ে কাজ করছিলেন। যেভাবে নিজের কাজকর্ম সমর্থন করে আওরঙ্গজেব পাদশাহকে চিঠি লিখছিলেন তাঁর প্রতি অনাস্থার প্রেক্ষিতে এবং মীর জুমলাকে সম্রাটের সঙ্গে মধ্যস্থতা করতে অনুরোধ করছিলেন, তাঁর থেকে পরিষ্কার, সম্রাট আর তাঁর দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের মধ্যে মীর জুমলা মধ্যস্থতার ভূমিকা পালন করেছেন। সম্রাটের অভিযোগ ছিল গোলকুণ্ডায় কুতুব শাহের থেকে বেশ কিছু দামি রত্ন আওরঙ্গজেব এবং তাঁর পুত্র উপহার স্বরূপ নিয়েছেন তাঁকে না জানিয়ে, এবং সম্রাটের এই ধারণাটি বিরুদ্ধে তিনি মীর জুমলাকে প্রতিবাদ পত্র লেখেন। শায়েস্তা খান এবং মীর নিজে কুতুব শাহের পাঠানো ১ কোটি ১৫ লক্ষ টাকার পেশকাশ নিরীক্ষণ করার পরে স্বয়ং মীর মন্তব্য করেন এই অকিঞ্চিৎকর উপহার সম্রাটের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই উঠছে না। মীর জুমলার কাছে খবর ছিল যে সুলতান, আওরঙ্গজেবের উপস্থিতিতে সম্রাটকে উপহার দিতে চান না। সে ঝগড়ার খবর মীর জানতেন। আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে জানান যে সম্রাট গোটা পেশকাশগুলি এই তাড়াতাড়ি নিজের কব্জায় করতে চাইলেন, যে আওরঙ্গজেবের পক্ষে সুলতানদের থেকে সেই পেশকাশ নিয়ে সম্রাটের কাছে পাঠানোর পরিকল্পনা ভেস্তে গেল। আওরঙ্গজেবের এই বেকায়দা অস্বস্তিতে দুজন সুলতান উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছিলেন, এবং শেষ পর্যন্ত কিভাবে তিনি সেই সমগ্র পেশকাশ, এমনকি তাঁকে আর তাঁর পুত্রকে দেওয়া উপহারটুকু দিল্লিতে সুলতানের দরবারে পাঠিয়েছিলেন, সেই সংবাদ মীর জুমলাকে দিয়েছেন(মীর জুমলা দেখেছেন, সেগুলি ছিল কালো দাগওয়ালা একটি হিরে, একটি চার হাজার টাকাও দাম নয় এমন নীলকান্তমণির আংটি)। তিনি মীর জুমলাকে লেখেন আমার যদি কিছু লুকোনোর থাকত, তাহলে সেগুলি আমি কেন তোমায় দেখাতাম... আর আর আমি মাত্র কয়েকটি হিরে জহরত নিয়ে কি করব যখন আমার সারা জীবন-অলঙ্কারটাই উতসর্গ করে দিয়েছি সম্রাটের পায়ে?

এই বিষয়ে মীর জুমলার উৎসাহ তৈরি করতে আওরঙ্গজেব অভিযোগ করে বলেন যে তাঁর নিজের নগদ সহ যে টাকা সম্রাট নিয়ে নিয়েছেন, তাতে তাঁর নিজের ক্ষতি হয়েছে ২০ লক্ষ টাকা। দক্ষিণী সেনাবাহিনী ৬ মাসের বেতন পায় নি। সেই সুযোগে যদি সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দেয়, তা তাহলে সম্রাট তাকে সাম্রাজ্য রক্ষার যে দায়িত্ব দিয়েছেন, সেটি পালন তো করতে পারবেনই না, এবং মীর জুমলার নিজের রাজ্য কর্ণাটক এবং বিশেষ করে যেখানে আদিল শাহ চেষ্টা করছেন কর্ণাটক দখল নেওয়ার, সেটির সঙ্গে অন্যান্য প্রদেশের শান্তিরক্ষা করা, খুব কঠিন হয়ে যাবে, আর মীর জুমলা নিজে সাম্রাজ্যের বাহিনী এবং দুই সুলতানের মিলিত বাহিনীর আপতিক শক্তি তো জানেনই। আওরঙ্গজেবের মনে হয়েছে গোলকুণ্ডা অভিযান তাঁর এবং তাঁর পুত্রের পক্ষে শুধুমাত্রই অপমান বয়ে এনেছে। তিনি মীর জুমলাকে বললেন এই সমস্ত তথ্য সুযোগ সুবিধে মত সম্রাটের সামনে উপস্থিত করতে। যেহেতু মীর জুমলা নিজে গোলকুণ্ডা বিষয়ে সম্রাট এবং সুবাদার কাবলি খানের খগড়া সম্বন্ধে বিশদে জানেন, ফলে উজির যখন সম্রাটকে তাঁর বক্তব্য পেশ করবেন, তখন সমস্ত দক্ষতা দিয়েই নিশ্চই সেই কাজটি সম্পন্ন করবেন। এর ফলে হয়ত সরাসরি আওরঙ্গজেবের কোন ঐহিক উপকার হবে না, কিন্তু এর মাধ্যমে যদি সম্রাটের মনে যে বিক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেটি দূর হয়ে যায়, সেইটুকুই তাঁর পাওনা হবে।

৭। আওরঙ্গজেব আর মীর জুমলার মধ্যে বিরোধ

দুই সঙ্গীর মধ্যে বেশ কিছু ঘটনার জেরে বিরোধ তৈরি হতে থাকে। আওরঙ্গজেব জানতে পেরে উদ্বিগ্ন হয়েছেন, যে মীর জুমলা সম্রাটকে কুতুব শাহের একটি গোপন আহদানার নকল দেখিয়েছেন, যেখানে তিনি নিজের হাতে লিখে বলেছেন যে তিনি মহম্মদ সুলতানকে নিজের উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যাচ্ছেন।

এর পাশাপাশি মীর জুমলা ক্ষুব্ধ ছিলেন যে আওরঙ্গজেব খাস বা আম দরবার করেন না। অন্যদিকে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে জানিয়েছেন যে তাঁর সম্রাটের ওপর ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে, আর যেহেতু মীর জুমলা রাষ্ট্রের বড় বড় বিষয় নিয়ে বড়ই ব্যস্ত, সেহেতু আওরঙ্গজেবের ব্যক্তিগত জীবনের এইসব ছোটখাট সমস্যা নিয়ে তাঁর মাথা ঘামাবার সময়ই নেই। প্রকাশ্য সভায় না যাওয়ার উতর হিসেবে তিনি বলেন, সেদিন তাঁর উপবাছিল এবং দেওয়ানি আম বা খাস তখনও তৈরি হয় নি।

একই সঙ্গে আওরঙ্গজেব জানতে পারলেন যে মীর জুমলা ওমাদাতুল মুলক খান জাহান(শায়েস্তা খান)এর সঙ্গে মিলে কোন তুচ্ছ বিষয়ে সম্রাটের সঙ্গে কথা বলেছেন। সেটা যদি সম্রাটের কোন নিকটাত্মীয় সম্বন্ধে তাঁর কান ভাঙ্গানোর চেষ্টা হওয়া খুব অসম্ভব। বা আওরঙ্গজেবের পাশের সুবা মালওয়া থেকে শায়েস্তা খানের বদলি হয় তাহলে তা তাঁর পক্ষে যাবে না। কিন্তু যখন মীর জুমলা সহৃদয়ভাবে বিষয়গুলি মিটমাটের চেষ্টা করতে গেলেন, সেই চেষ্টা দেখে আওরঙ্গজেব মন্তব্য করলেন, ‘যদিও মীর জুমলা(রুখউসসুলতানত, সাম্রাজ্যের স্তম্ভ)র পক্ষ থেকে কিছু ত্রুটিবিচ্যুতি ঘটেছে, সেটি মানবিকভাবে দেখতে হবে। সর্বশক্তিমান তাকে সফল হওয়ার মন্ত্র দান করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া ঠিক হবে না। আমাদের বন্ধুত্ব পালনে সে সদা তৎপর। আমাদের উভয়ের বন্ধুত্ব রক্ষা এবং সেটি বিকাশে এগিয়ে আসতে হবে। খানের উকিলকে আমাদের পক্ষে আনতে হবে, যাতে সে অন্যদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়াতে না পারে।’ এই ঘটনা সাময়িকভাবে দুজনের মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছিল, কিন্তু কর্ণাটক নিয়ে এই ভুলবোঝাবুঝি বাড়ল, কেননা মীর জুমলার মনে হল যে আওরঙ্গজেব তাঁর জাগিরগুলি দেখাশোনা করতে খুব একটা উতসাহী নয়। এই মুহূর্তে আওরঙ্গজেব তাঁর উজিরের বিরুদ্ধে যেতে পারেন না, এবং মীর জুমলার মনের দ্বিধা দূর করতে তিনি সব ঘটনা তাকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন।

দ্বিতীয় পর্ব

১। মুঘল সাম্রাজ্যে মীর জুমলার জায়গির হল কর্ণাটক

কুতুব শাহীর বিরুদ্ধে মীর জুমলার বিদ্রোহ শেষ হয়েছে, মুঘল বাহিনী হায়দ্রাবাদে ঢোকা বন্ধ রয়েছে, কুতুব শাহ আর মুঘলদের মধ্যে একটা সমঝোতা হয়ে গিয়েছে, কিন্তু যে অঞ্চলের জন্য এই সব বিবাদ-ঝগড়া, কর্ণাটকের দায়িত্ব কার হাতে থাকবে সেই মূল বিষয়টার কোন সমাধান তখনও হয় নি। সুলতান স্বাভাবিকভাবেই এই সম্পদশালী এলাকাটি নিজের তাঁবেতে রাখতে চাইলেন, কেননা তাঁর কর্মচারী তাঁরই সম্পদে এই এলাকাটি দখলে নিয়েছিল। আগেই আমরা দেখেছি, আওরঙ্গজেবের চোখ কিন্তু কর্ণাটকের ওপরেই নিবদ্ধ ছিল। ১৬৫৬র মার্চে তিনি উজির সাদুল্লা খানকে বলেন, ‘কর্ণাটকের বিষয়ে বলি, মীর জুমলার গোমস্তাদের অধীনে, সেখানে বেশ কিছু হিরের খনি রয়েছে, আর রয়েছে সমুদ্র বন্দরও; এখন সেটি সাম্রাজ্যের সম্পত্তি, সময় এলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ গোলকুণ্ডা থেকে রামগির(পাইনগঙ্গা আর গোদাবরীর মধ্যেকার স্থান – আজকের মানেকদুর্গ আর চিন্নর) দখল করে তেলেঙ্গানাকে উত্তর কর্ণাটকের শাসনে নিয়ে এসেছিলেন আওরঙ্গজেব। এবারে এক দিক থেকে অন্য দিকে যেতে আর গোলকুণ্ডার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হল না – সরাসরি সেনাবাহিনী নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হল। সুলতানকে কর্ণাটক দখলে রাখার সমস্ত রকম পরিকল্পনায় জল ঢালছিলেন তিনি।

মীর জুমলা দিল্লি পৌঁছবার আগেই কুতুব শাহ কর্ণাটক দখলে রাখার চেষ্টার খামতি দেন নি। তিনি কর্ণাটক এবং পৈতৃক রামগীর দুর্গ দখলে রাখতে চেয়ে শাহজাহানকে আবেদন করেন। তাঁর ধারণা ছিল এই প্রস্তাবে আওরঙ্গজেব তাঁকে সায় দেবেন, এমন কি তিনি জাহানারাকে দিয়ে এই প্রস্তাব সম্রাটকে দেওয়ানোর ব্যবস্থাও করেছিলেন। আওরঙ্গজেব সুলতানকে অপেক্ষা করতে বললেন, কেননা ঠিক হয়েছে মুয়াজ্জম খানের পদে যোগ না দেওয়া পর্যন্ত এই বিষয়টি নিয়ে কোন আলোচনাই হবে না। আওরঙ্গজেবের প্রস্তাবে কান না দিয়ে কুতুব শাহের দিল্লির দূত মুল্লা আব্বাস সামাদ, দারার মাধ্যমে সম্রাটকে আবেদন জানান এবং দারা সম্রাটের হৃদয় জয় করতে সমর্থ হলেন। মোটামুটি ঠিক হল পুরোনো রাজ্যের অধিকারের সঙ্গে কর্ণাটকেরও অধিকার থাকবে সুলতানের। সুলতান তাঁকে বা তাঁর উকিলকে এড়িয়ে সরাসরি সম্রাটের কাছে দরবারে চরম প্রকূপিত হয়ে আওরঙ্গজেব সুলতানকে উদ্ধত বললেন এবং জানালেন এটা ঠিক হয়েছিল মীর জুমলা দিল্লি না পৌছলে এটির সমাধান সম্ভব নয়।

মীর জুমলাও সুলতানকে তাঁর গ্রাস কেড়ে নিতে দেবেন না ঠিক করলেন। আওরঙ্গজেব সুলতানের বিরুদ্ধে সম্রাটের কাছে যে আবেদন করবেন ঠিক করেছেন, পরিকল্পনা করলেন সেটি মীর জুমলাকে দিয়েই করাবেন। চিঠির পর চিঠি দিয়ে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে নির্দেশ দিচ্ছেন কিভাবে বাবা বাছা করে সম্রাটকে নিজের মতে নিয়ে আসতে পারেন। দিল্লিতে পৌছনোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে আওরঙ্গজেব নির্দেশ দিলেন যে তিনি যেন সম্রাটের থেকে অবিলম্বে কর্ণাটকের দখলের ফরমান নিয়ে নেন, এবং দারা-মুখী সুলতানের রাজসভার রাজনীতি পরাস্ত করেন। হায়দ্রাবাদ অভিযানের আওরঙ্গজেব সম্রাটকে কর্ণাটকের মত এলাকা কেন দখলে রাখতে হবে সেইটি বুঝিয়েছিলেন। সেটা তাঁকে প্রভাবিত করে নি। কিন্তু এবারে উদয় হয়েছেন মীর জুমলা। আওরঙ্গজেবের সূত্রে জানা যাচ্ছে, মীর জুমলা নিজের বাচনভঙ্গীতে, উপহারে সম্রাটকে কিছুটা হলেও বশ করে ফেললেন। মীর জুমলার হাতে কর্ণাটকের মণিমাণিক্য দেখে লোভাতুর হয়ে সম্রাট সুলতানকে কর্ণাটক দেওয়ার মানসিকতা বদলে ফেললেন, ঠিক হল এটি মীর জুমলাই দখলে রাখবেন(জুলাই, ১৬৫৬) সম্রাটের কাছ থেকে সরাসরি নিয়ে, সাত বছর রাজস্বহীনভাবে তাঁর ব্যক্তিগত জায়গিররূপে। ততদিনে কুতুব শাহের আবেদন নাকচ হয়ে গিয়েছে যদিও তিনি কর্ণাটকের বদলে বছরে ১৫ লক্ষ টাকা পেশকাশ দিতে চেয়েছিলেন। এখন আওরঙ্গজেব, সুলতানের কর্ণাটক দখলের কাতর আবেদন সম্রাটের কাছে পৌঁছতে আস্বীকার করলেন, ব্যঙ্গভরে বললেন দরকার হলে সরাসরি পাঠান। কুতুব শাহ কি করে কর্ণাটকের দখল হারালেন এবং সেটি কি করে মীর জুমলার হাতে, সেটি বিশদে বর্ণনা করে আওরঙ্গজেব আকাশ থেকে পড়া সুলতানকে লিখলেন, ‘হায়দ্রাবাদে সুলতানের সেনা প্রবেশের সময় আমি তোমায় বলেছিলাম, তোমার যে কোন চাহিদা পূরণে সম্রাটকে খুশি করতে তুমি তোমার পছন্দের যত মহামূল্যবান রত্ন রয়েছে সে সব তাঁকে দাও। কিন্তু তুমি আমার কথা শোনো নি। অন্যদিকে মীর জুমলা সম্রাটকে তাঁর পছন্দের হিরে, জহরত এবং মহামূল্যবান গয়না আর অন্যান্য মূল্যবান জিনিস উপহার দিয়ে তাঁর কাজ করিয়ে নিল... আমি তোমায় সব বলেছিলাম। আমার পরামর্শ মত চললে অবস্থা এরকম সঙ্গীন হত না। যারা কথা না শুনে কাজ করে, তাদের কোন কিছু বলাই অপরাধ।’ মীর জুমলা নিজের বাহুবলে যেটি দখল করেছিলেন, সেটি এবারে মুঘল সম্রাট আইন সিদ্ধ করেদিলেন।

২। দাক্ষিণাত্যের ক্ষমতাবানেদের প্রতিক্রিয়া

কর্ণাটক থেকে মীর জুমলার প্রস্থান এবং সেনার পরিমান কমানোয় চরম ঈর্ষায় ভোগা সারা দাক্ষিণাত্যের ক্ষমতাবানদের মধ্যে নতুন করে এই এলাকাটি দখলের চক্রান্ত পেকে উঠতে বসল। যতদূর সম্ভব যৌথভাবে দুই সম্রাট তাদের সেনাবাহিনীকে এই কাজে শনৈঃ শনৈঃ এগিয়ে দিতে থাকেন। আবদুল জব্বার খানের নেতৃত্বে কুতুব শাহ একটি বাহিনী উত্তর কর্ণাটকের অভিযানে পাঠিয়েছিলেন যাতে তিনি তাঁর পুরোনো এলাকা দখলে আনতে পারেন, আদিল শাহ জিঞ্জির কেল্লাদারকে উত্তেজিত করলেন ১৬৫৬র জুনের মধ্যেই মীর জুমলার দখলে থাকা কর্ণাটকের দক্ষিণতম এলাকাটি দখল করতে। চন্দ্রগিরির রাজা তাঁর হারানো জমি উদ্ধারে সৈন্যসাজ করতে শুরু করলেন। যারা মীর জুমলার কাছে নানাভাবে পরাজিত হয়েছিল, স্বার্থবদ্ধ ঈর্ষায় জর্জরিত হয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিলেন।

সব থেকে উদ্যমী হয়ে উঠলেন কুতুব শাহ। বুঝলেন, আলোচনা আর কূটনীতির দিন শেষ, এবার সময় হয়েছে মাঠে নেমে লড়াই করার তাঁর সঙ্গে তো কূটনীতির জাল তো রইলই। দারার প্ররোচনায়, কুতুব শাহ আওরঙ্গজেবের একের পর এক হুঁশিয়ারি উপেক্ষা করে কর্ণাটক আর কাম্বামের দিকে লোভাতুর দৃষ্টি দিলেন, মনে মনে ইচ্ছে বাধা আর ধোঁকা দিয়ে তাঁর উদ্দেশ্য সাধন। সীমান্ত থেকে তাঁর সেনাবাহিনী না সরিয়ে তিনি সেনাপতি আব্দুল জাব্বারকে নির্দেশ দিলেন মীর জুমলার তৈরি করা ডাকচৌকিগুলোতে বাধা দিতে এবং তাঁর ব্যবসায়িক দালালদের সঙ্গে ঝগড়া বাধানোর, যাতে কর্ণাটকের আভ্যন্তরীণ প্রশাসনে গোলযোগ তৈরি হয়। কর্ণাটকে সাম্রাজ্যের আধিকারিক পৌঁছনোর আগেই কুতুব শাহ বেশ কিছু মহালে রাজস্ব তোলার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন।

কুতুব শাহের এই সব ছোটখাট গণ্ডগোলের থেকে আরও বড় সমস্যা দাঁড়াচ্ছিল পুলিকট। স্যান থোম, আর পুনামাল্লির হিন্দু নায়েক, জমিদার, ভিজাদারদের, বা রয়ালের অধীনে থাকা কর্ণাটকে সিপাহীরা যারা যারা মুসলমান শাসনে ছিল, তাদের মাথা খাওয়ার উদ্যম। গাণ্ডিকোটার কিলাদার হাজি সুলেইমান লিখছেন, তারা সক্কলে বিদ্রোহের ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিল, রাস্তা বন্ধ করে দিল এবং হরকরাদের কাজ না করতে হুঁশিয়ারি দিল। এবং শ্রীরঙ্গ যে উচ্চমানের রাষ্ট্র পরিচালনা করে এসেছেন ১৬৫৬ পর্যন্ত, তাঁর উদ্যমে হারানো জমি এবং সম্মান উদ্ধারের চেষ্টা দেখা গেল এই সময়ে। একে শুধু স্থানীয় সামন্তদের হুজ্জুতি-হ্যাঙ্গাম বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। যদিও মীর জুমলা তাঁর শাসন ক্ষমতার প্রমান দিয়ে তার জয় করা অঞ্চলে প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু তিনি স্থানীয় হিন্দু রাজা, জমিদার সামন্তদের স্বাধীনতার ইচ্ছের মাথা একেবারে মুড়িয়ে দিতে পারেন নি বরং তাদের মন্দির ধ্বংস করে মূর্তি দখল নিয়ে মন্দির আর ব্যক্তিগত মানুষের জমানো সোনাদানা দখল করে তাদের বিশ্বাসে ঘা দিয়েছেন। যদিও কর্ণাটক কাজে দাক্ষিণাত্যের দুই সুলতান একটা দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, কিন্তু বড় ভূমিকা পালন করেছেন শ্রীরঙ্গ রয়াল নিজে এবং জমিদারেরা। আবদুল জব্বারের নেতৃত্বে, সুলতানী সেনা বাহিনীর উপস্থিতি তাদের এই বিদ্রোহের পরিবেশ তৈরিতে সাহায্য করেছে। আওরঙ্গজেব, শাহকে হুঁশিয়ারি দিয়ে লিখলেন, ‘তোমার আধিকারিকদের দিয়ে(যাদের নাম এই চিঠির সঙ্গে জুড়ে দিলাম) দেশের জমিদারদের হায়দ্রাবাদে ডাকিয়ে এনে উত্তেজিত করিয়ে তুমি এই অঞ্চলে অব্যবস্থার বীজ বপন করেছ...তুমি ভাগ্যহীন রয়ালের বিশ্বাসও অর্জন করেছ এবং তাঁর হাজিবের সঙ্গে একজন আধিকারিক পাঠিয়েছ, এবং কয়েকটি মহালের(তাঁর বিশদ বিরবরণ দেওয়া হল) খানেদের গোমস্তাদের থেকে অধিকার কেড়ে নিয়েছ। একটি সুশাসিত দেশকে তুমি টালমাটাল করে দিয়েছ।’ চেম্বার্স ন্যারেটিভএ এই মন্তব্যটি পাওয়া যাচ্ছে, ‘গোলকুণ্ডার রাজা কর্ণাটককে রয়ালের হাতে তুলে দিলেন।’

শুরুর দিকে হিন্দুরা সহজেই সাফল্য লাভ করে। রয়াল তিরুপতি দখল করলেন, কাঞ্জিভরম, চিংলেপুট এবং পুলিকট দখল করার পরিকল্পনা করলেন। ১৬৫৬র অক্টোবরে মাদ্রাজের আশেপাশের পুনামাল্লির প্রাসাদ ছাড়া, শ্রীরঙ্গর শ্বশুর ভেঙ্গম রাজার সহায়তায় বহ এলাকা দখল করে নিলেন, এবং ভেঙ্গম রাজা পেড্ডাপোলিয়াম দখল করলেন। মীর সঈদ আলি, মীর জুমলার পুনামাল্লির সুবাদার, পুলিকটে পালিয়ে গেলেন, সেখানেই মীর জুমলার প্রায় সমস্ত সম্পদ রাখা ছিল। এটা নবাবের সেনাবাহিনীকে উত্তেজিত করল। তাল্লিয়ারদের একসঙ্গে করে ভেঙ্গম রাজা পুলিকটের দিকে অভিযান করলেন এবং শ্রীরঙ্গর সেনাপতি কোনারি চেট্টিকে নির্দেশ দিলেন পুনামাল্লি ঘিরে থাকা এলাকার মানুষদের জমায়েত করে গোটা দেশতা দখল করতে। কোনারি, নবাবের স্যান থোম, মায়লাপুর এবং পুনামাল্লির সুবাদার, বালা রাউকে গ্রেফতার করলেন স্যান থোমের কাছে তাল্লিয়ারদের বিশ্বাসঘাতকতায়। তারা মীর জুমলার ২০টি এবং ১৬টি অন্যান্য মুসলমান ব্যবসায়ীর হাতি, দখল করে মাদ্রাজে নিয়ে এল।

এই দুর্ঘটনার খবর পেয়ে নবাবের সেনাপতি টুপাকি কৃষ্ণাপ্পা নায়েক, লিঙ্গম নায়েকের নেতৃত্বে ঘোড়সওয়ার আর পদাতিক বাহিনী পাঠিয়ে কোনারি চেট্টিকে গ্রেফতার করার নির্দেশ দিল। পুনামাল্লির পথে কোনারির সঙ্গে দু দিনে কয়েকবার ছোটখাট লড়াই হল। হিন্দুরা পুনামাল্লি প্রাসাদ দখল না করার কারণ হল কোনারি সেটি দখল করার কাজে অসম্ভব দেরি করে যা বিশ্বাসঘাতকতাও বলা যায় এবং সে মীর জুমলার সেনাকেও দেরি করে আক্রমণ করে, সেই সুযোগে তাদের বিপক্ষ একজোট হয়ে তাদের হারিয়ে দেয়। তাঁর সপক্ষে বলা যায় মুসলমানেদের বিরুদ্ধে হারার পরে পুলিকট ঘিরে বসে থাকা ভেঙ্গম রাজা তাঁর সঙ্গে জুটি বাঁধে কিন্তু তারা লিঙ্গম নায়েককে হারাতে পারে নি। রয়ালের হিন্দু সেনাপতিরা মাদ্রাজের কাছে পেড্ডানাকিপেট্টায় সেনা সহ পালিয়ে গিয়ে সেখানের আশ্রয় চায় কিন্তু মুসলমান বাহিনী তাদের কচুকাটা করে।

বিজাপুরের সহায়তায় কুতুব শাহ মীর জুমলার বাহিনীর ওপর বড় হামলার পরিকল্পনা করে। আওরঙ্গজেব তাঁর বিরুদ্ধে আবারও হুশিয়ারি দিয়ে লেখেন, ‘তুমি বীজাপুরের ধ্বংস চাইছ। কর্ণাটক দখলের হুজুগ তোমার মাথা থেকে এখনও যায় নি। তুমি পাগলের মত কাজ করছ। যখন গোলকুণ্ডা রাজ্য দুদিকে শক্তিশালী সেনাবাহিনী দিয়ে ঘেরা, তুমি তখন তোমার শয়তানি পরিকল্পনা হাসিল করতে কর্ণাটক দখল করতে বাহিনী পাঠাচ্ছ। এর আগে তুমি জমিদারদের খেপিয়ে তুলে গোলযোগ তৈরি করেছ, কখনো তুমি ডাকচৌকিগুলোতে হামলা করেছ। এধরণের কাজ কোর না। বিজাপুরকে বিপথগামী কোর না। দূরদৃষ্টি বজায় রাখ, মনের আয়নায় ঘিরে থাকা কুজ্ঝ্বটিকা সরিয়ে অনেক কিছু দেখতে পারে...’।

জগদীশ নারায়ণ সরকার

৩।নতুন ব্যবস্থায় মীর জুমলার মনোভাব

কর্ণাটকে তাঁর বিজয়ের ফল ধরে রাখতে মীর জুমলা বদ্ধ পরিকর, এখন সেটি মুঘল সাম্রাজ্যের অধীন, তাঁর জায়গির রূপে পরিগণিত। আমর আগেই দেখেছি, কর্ণাটকে নিজের প্রশাসনিক পকড় আরও গভীর করতে, এবং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সম্পদ একত্রিত করতে, আওরঙ্গজেবের গোলকুণ্ডা দখলের ডাকে তিনি কত দেরি করে এসেছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যের উজিরের পদে যোগ দেওয়ার পরেও কর্ণাটকের নানান বিষয়ে তিনি গভীর মনোযোগী ছিলেন। কিন্তু বাস্তবিকভাবে কর্ণাটকের ঘটমান বর্তমান থেকে বহু দূরে ছিলেন তিনি, অথচ তাঁর পুরোনো শত্রুরা নিজেদের কূটনীতি আর পরস্পরের মধ্যে জোট করে দাঁত-নখ শানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল কর্ণাটক দখলে, ফলে সরাসরিভাবে কর্ণাটক দেখভালে, তাঁর ঈর্ষান্বিত জোটবাঁধা শত্রুদের থেকে কর্ণাটক বাঁচাতে তাঁকে সরাসরিভাবে নির্ভর করতে হচ্ছিল আওরঙ্গজেব আর কিছু বিশ্বস্ত কর্মচারীর ওপর। কর্ণাটক যেহেতু এখন মুঘল অঞ্চল, তাঁর মনে হল সেটি মুঘল সেনাবাহিনীর সুরক্ষায় থাকবে। কাবিল শাহের স্তোকবাক্যে তাঁর ধারণা হয়েছিল আওরঙ্গজেবও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। মীর বারবার আওরঙ্গজেবকে তাঁর জায়গির কিভাবে সামলাতে হবে সে বিষয়ে বিশদ নির্দেশনামা পাঠাচ্ছিলেন। বিশেষ করে ডাকচৌকি নিয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন এবং আওরঙ্গজেবের হাজিবকে নির্দেশ দেন এগুলি নতুন করে গড়ে তোলার। আওরঙ্গজেব তাঁর বন্ধুর অনুরোধে সাড়া দিচ্ছিলেন, যদিও কিছু কিছু তাঁর ইচ্ছের বাইরে হছিল, তবুও তাঁকে চিন্তা করতে বারণ করেন। কিন্তু কুতুব শাহের দখলদারি মনোভাব বাড়তে থাকায় মীর জুমলার চিন্তা বাড়ল বই কমল না; ফলে তাঁর মনে হল আওরঙ্গজেব তাঁর নির্দেশ মানছেন না এবং জায়গির নিয়ে তার উৎসাহ কম।

৪। মীর জুমলার সন্দেহ দূর করার উদ্যম নিলেন আওরঙ্গজেব

ফলে আওরঙ্গজেবকে মীর জুমলার সন্দেহ দূর করতে গা ঘামাতে হয়েছিল। যখন তাঁর পিতা সম্বন্ধে আওরঙ্গজেব খুব কড়া মন্তব্য এবং চড়া মনোভাব প্রকাশ করতেন, সেখানে কর্ণাটক বিষয়ে তাঁর পিতার সিদ্ধান্তে তিনি নরম সুর প্রকাশ করায়, কর্ণাটক বিষয়ে তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে মীর জুমলার সন্দেহ জাগে। মীর জুমলাকে আশ্বস্ত করার ভাষাটিও একই নরম সমঝোতার ধরণের বলে মনে করলেন। তিনি তাঁর শত্রুদের প্রতি বিশ্বাসভঙ্গ, পরশ্রীকাতরতা এবং মিথ্যাচারের অভিযোগ আনলেন, বললেন শয়তনি পরিকল্পকদের পরিকল্পনায় কর্ণাটকের কি হাল হয়েছে তা বর্ণনা করলেন এবং বিষয়টা শান্ত রাখতে তাঁকে কোন কোন পদক্ষেপ করতে হয়েছে তাও তিনি বললেন। তাঁর বন্ধুকে উদ্বিগ্নতা থেকে উদ্ধার করতে তিনি গোয়েন্দা সমীক্ষা, আমলা আর অন্যান্য শুভচিন্তকদের দেওয়া অভিযোগপত্র এবং সম্রাটকে পাঠানো তাঁর আবেদনপত্র মীরজুমলাকে লেখা চিঠিতে জুড়ে দিলেন। ১৬৫৬ সালের আগস্ট মাসে উজিরকে তাঁর পদক্ষেপে আস্থা পেশ করতে বলে লিখলেন, ‘সাম্রাজ্যিক সমস্ত কাজে চিন্তামুক্তভাবে জুড়ে থাক, ভেবোনা আমি তোমার ভাল চাই না। (কবিতা) তুমি সকলের হৃদয়ে রয়েছ। কেউ তোমার সমকক্ষ নয়।’

এ ছাড়াও অরেক চিঠিতে তিনি লিখছেন, সম্রাটের তাঁর ওপর অবিশ্বাসে নানান কাজে তাঁর হাত বাঁধা থাকা সত্ত্বেও তিনি কিভাবে সদা সতর্কভাবে, সুচারুরূপে কর্ণাটকে সেনার পরিমান বাড়ানো এবং কিলাদার এবং সীমান্তে থাকা সেনানায়কদের দায়-দায়িত্ব পালন এবং সদা সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়ে গিয়েছেন তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন। বারবার তিনি উজিরকে বলেছেন তিনি কোনভাবেই তাঁর জায়গিরের ব্যবস্থাপনায় ঢিলে দিচ্ছেন না এবং তাঁর শত্রুদের আক্রমণকে তিনি কোঁনভাবেই ছোট করে দেখছেন না, যতটুকু পদক্ষেপ করার করছেন।

৫। মীর জুমলার কর্ণাটক বাঁচানোয় আওরঙ্গজেবের পদক্ষেপ সমূহ

বাস্তবে, মীর জুমলার অনুপস্থিতিতে যে দুর্যোগের পরিবেশ তৈরি হয়েছে কর্ণাটকে তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করার কাজ করেছেন বন্ধু আওরঙ্গজেব। গোলকুণ্ডায় মুঘল হাজিব কাবাদ বেগকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তিনি হায়দ্রাবাদ এবং সিদ্ধাঔতের মধ্যের ডাকচৌকি স্থাপন করেন। দেওয়ান মুর্শিদকুলি খানকে প্রবীন আমলা মহম্মদ তাহিরকে নির্দেশ দিলেন তুহুলদারদের আওতায় থাকা গোমস্তাদের বকেয়া কাজগুলি সম্পাদনে সচেতন করে দেওয়ার। তিনি আগ্রাসী সুতলানকে সরাসরি জানিয়ে দিলেন যে কোনভাবেই যেন বর্তমান স্থিতাবস্থা ভাঙ্গা না হয় এবং মীর জুমলা দিল্লি না পৌছলে কোন প্রশাসনিক রদবদল এবং ডাকচৌকির ওপর হামলাকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে না। সম্রাটের ফরমান ছাড়া সুলতানের কর্ণাটক দখল করা শুধু হঠকারী হবে তাই নয় অপরিণামদর্শীও হবে বলে হুঁশিয়ারি দিলেন। যদি মীর জুমলা তাঁর বিরুদ্ধে সম্রাটের কানে অভিযোগ তোলেন, তাহলে কিন্তু কর্ণাটকে আগুণ জ্বলতে পারে। তিনি সুলতানকে বললেন কর্ণাট সীমান্ত থেকে সেনাবাহিনী সরিয়ে নিয়ে সম্রাটের নির্দেশের অপেক্ষা করুণ। বারংবার আওরঙ্গজেবের হুঁশিয়ারি সত্ত্বেও দারার উস্কানিতে সুলতান ডাকচৌকির ওপর হামলা বন্ধ করলেন না এবং সীমান্ত থেকে আবদুল জব্বারকে সরিয়েও নিলেন না। তখন আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে এই কথাগুলি জানিয়ে তাঁর গভীর চিন্তা প্রকাশ করলেন। মীর জুমলা এই বিষয় নিয়ে সরাসরি সম্রাটের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেই নির্দেশক্রমে আওরঙ্গজেব সুলতানকে জানালেন, কয়েকজনকেমাত্র মহালগুলির প্রশাসনে রেখে তিনি যেন আবদুল জব্বারকে সীমান্ত থেকে তুলে নেন এবং ইসমাইল বেগের নেতৃত্বে বাহিনী পাঠিয়ে ডাকচৌকিগুলি সারানোর ব্যবস্থা করেন। মীর জুমলা সম্রাটের কাছে জোর আর্জি পেশ করেন যে মহম্মদ শরিফকে হায়দ্রাবাদের পাঠিয়ে ডাকচৌকিগুলি সারাবার ব্যবস্থা করা হোক এবং আওরঙ্গজেবকে অনুরোধ করলেন তাঁর দূত মার্ফত সুলতানকে এবিষয়ে চিঠি পাঠাতে। নিজের লেখা চিঠি এবং মহম্মদ শরিফ মার্ফত(আগস্ট ১৬৫৬) আওরঙ্গজেব সুলতানকে হুঁশিয়ারি দিলেন যাতে তিনি সম্রাটের ফরমান অবজ্ঞা না করেন। উদ্বিগ্ন মীর জুমলা কাবাদ বেগকে ডাকচৌকি সারানোর কাজে দেরি হওয়ায় দোষী ঠাওরালেন। এই এবং নানান গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নির্দেশ অমান্য করা অযত্ন, অদক্ষ এবং দীর্ঘসূত্রী মনোভাবের জন্য তাঁকে দায়ি করলেন। মীর জুমলার অনুরোধে তিনি কাবাদ এবং তাঁর হিন্দু বন্ধুদের শাস্তির ব্যবস্থা করলেন যাতে এই উদাহরণে সংশ্লিষ্টদের চৈতন্য হয়। তাঁকে হাজিবের পদ থেকে সরিয়ে আহমদ বেগকে নিয়োগ করা হল এই মনোভাবে যে তিনি নির্দেশ সঠিকভাবে পালন করবেন এবং ঘটনাবলী আর সুলতানের মনোভাব আর চাহিদা সম্বন্ধে সম্রাটকে সঠিক এবং তথ্যসন্ধানী সমীক্ষা পাঠাবেন। ১৬৫৬র শেষের দিকে আওরঙ্গজেব নির্দেশনামা জারি করে বললেন যে খানের(মুয়াজ্জম খান, মীর জুমলা) নামে হায়দ্রাবাদ থেকে কর্ণাটকের মধ্যে যে ক’টি ডাকচৌকি রয়েছে সেগুলি ঠিকঠাক চালাতে এবং তাঁর সুরক্ষা দান করতে সরাসরি সাম্রাজ্যের সেবায় অন্তর্ভূক্ত হল (সরকারইজাহানমদার) এবং কুতুব খানকে এ বিষয়ে সাবধান থাকতে বললেন।

কাম্বামের ব্যাপারটা আওরঙ্গজেব সমাধান করতে গেলে নিজের জামাই মার্ফত আওরঙ্গজেবকে সুলতান অনুরোধ পাঠিয়ে বলেন সেখানে যেন তিনি ইসমাইল বেগকে না পাঠান। শাহজাদা এই চিঠিটা আওরঙ্গজেবকে পাঠিয়ে দিলেন কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুরকে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়ে রাখলেন ‘তাঁর শয়তানি অযত্নের ফল তিনি পাচ্ছেন এবং তাঁর ফলে কর্ণাটকে যদি কোন হানি ঘটে বা গোলযোগ শুরু হয়, তাহলে তাঁর ফল ভোগ করবে আপনার উত্তরাধিকারী(তাজালউল কাওয়াঈদ উইলিয়ত মাউরুসি)’।

আওরঙ্গজেব, সুলতানের হিন্দু বিদ্রোহে উসকানির বিষয়টি নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলেন এবং বললেন, ‘এই বিদ্রোহের কি কারণ আমি বুঝতে পারছি না, যার ফল শুধুই ক্ষতি এবং তুমি আর তোমার জমিদারেরা এই অব্যবস্থা থেকে কোন লাভ পাবে? জমিদারদের সতর্ক করতে চিঠি লেখ, তোমার আধিকারিকদের তুলে নাও নাহলে... তুমি লজ্জায় নিজের দাঁতে নিজের আঙুলই কাটবে।’ যখন শুনলেন যে কর্ণাটকের ভার মীর জুমলার হাতে দেওয়া হয়েছে, তিনি হাজি শফি মার্ফত প্রত্যেককে, বিশেষ করে জমিদারদের, কর্ণাটকে থাকা তাদের সেনাপতিদের, সেখানকার মুঘল আধিকারকদের(কাজি মহম্মদ হাশিম, কৃষ্ণা এবং খ্বাজা মহম্মদ আরিফ কাবাদ বেগ হাজিব) এবং কুতুব শাহকে চিঠি লিখলেন। বিশেষ করে রয়ালকে লেখা চিঠিতে ভয় এবং আশার(বিম ও উমিদ) কথা বললেন। কাজি মহম্মদ হাশিম, কৃষ্ণা এবং অন্যান্যদের নেতৃত্বে একটি মুঘল বাহিনী সিদ্ধাঔতে গিয়ে আবদুল জাব্বারকে পরাজিত করল। কিছু দিনের জন্য হতাশায় এবং ক্ষতিতে সুলতান নিজেকে সংযত রাখলেন। ডাকচৌকি আগের মত কাজ করতে লাগল।

১৬৫৬ সালের শেষের দিকে আওরঙ্গজেব সরাসরি কুতুব শাহকে হুঁশিয়ারি দিলেন যে তিনি যদি জমিদারদের উস্কানি দেওয়া বন্ধ না করেন, এবং যে সব সাম্রাজ্য-নিয়ন্ত্রিত মহাল তারা দখল করেছেন, সেখান থেকে তাঁর সেনা তুলে না নেন, এবং এই কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত কামগার বেগের হাতে (প্রশাসনের ভার) তুলে না দেন তাহলে তিনি তাঁর রাজ্য দখলের অভিযান শুরু করবেন। মহালগুলির যত রাজস্ব সুলতান তুলেছেন সেগুলি নিয়ে কামগারের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতেও নির্দেশ দিলেন তিনি।

বীজাপুরের বিষয়ে ২১ জুন ১৬৫৬ তারিখে মীর জুমলার সুলতানের কাজকর্ম বিষয়ে উল্লেখ করে চিঠিটি পাওয়ার আগে মালুজি - যার ভাই জিঞ্জি দখলে কিলাদারের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল, তাঁর জন্য মীর জুমলা সাম্রাজ্যের কাজে নিয়োগ করারও সুপারিশ করেছিলেন, তাঁর ভাইকে নিজের দেহরক্ষী হতে বললেন। বুঝলেন দিল্লির সভায় বীজাপুরের বিরুদ্ধে আনা কোন আভিযোগ টিঁকবে না, তিনি মীর জুমলাকে তাঁর সাংকেতিক ভাষায় চিঠি লিখতে বললেন এবং সুলতানকে বীজাপুরের মুঘল হাজিব মার্ফতও হুমকি দিলেন।

যদিও আওরঙ্গজেব মীর জুমলা আধিকৃত কর্ণাটকে বিভিন্ন দাক্ষিণাত্যের ক্ষমতাবানদের আভিযানের উৎসাহ নানাভাবে বিশেষ করে হুমকি চিঠি দিয়ে আটকাচ্ছিলেন, কিন্তু তার পাশাপাশি কূটনীতিও প্রয়োগ করতে তিনি ভুল করেন নি। মীর জুমলার নির্দেশে শাহজী ভোঁসলার সঙ্গে বহু চিঠিচাপাটি আদান প্রদান করে তাঁকে আলাপালোচনার গতিপ্রকৃতি জানিয়ে রাখছিলেন। মীর জুমলার কর্ণাটক রক্ষায় শাহজীর সাহায্য তিনি নিয়েছিলেন সুলতানের সঙ্গে দারার চক্রান্ত রুখতে, তার বদলে তিনি তাঁকে বিশেষ কিছু সুবিধেও দিয়েছিলেন। ভবিষ্যতে পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, হিন্দু বিদ্রোহ রুখতে শাহজীকে চিঠি লেখেন আওরঙ্গজেব, প্রয়োজনে মীর জুমলাকেও চিঠি লিখতে অনুরোধ করে বললেন সম্রাটের কাছে শাহজী বিষয়ে যে আবেদনটি পড়ে রয়েছে – যিটি ছিল আদিল শাহের বাহিনীর ওপর শাহজীকে আক্রমণের ছক - সেই পরিকল্পনার ভবিষ্যত দাঁড়াল তা তাঁকে জানানো হোক। তাঁর চিঠিটি শেষ করছেন এই বলে, ‘আদিল শাহের মত অবিশ্বাসী মানুষের ওপর আঘাত করলে কি হতে পারে, সে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই, বরং এটি অতীব প্রয়োজনীয় কর্ম বলে আমি মনে করি। (কবিতা) তোমার যা ভাল, তা আমারও ভাল।’।

৬। আওরঙ্গজেবের প্রতি মীর জুমলার যুক্তিহীন অবিশ্বাস

মীর জুমলার কর্ণাটক বাঁচাতে আওরঙ্গজেব কি কি ভূমিকা নিয়েছিলেন, সে সম্বন্ধে মুন্সি কাবিল খানের যে অসাধারণ বর্ণনা রয়েছে, তাতে প্রমান দাক্ষিণাত্য জয়ের প্রশংসা তাঁর প্রাপ্য। নানান তথ্যের সমাহারে আমরা দেখতে পাচ্ছি, আওরঙ্গজেব কর্ণাটক বাঁচাতে কিছু নিজের বিচারবুদ্ধিমত উদ্যোগ নিয়েছিলেন আর কিছু মীর জুমলার পরামর্শক্রমে নিয়েছিলেন, এবং প্রত্যেকটি পদক্ষেপের যুক্তি বর্ণনা করে মৃদুভাষায় যে সব চিঠি আওরঙ্গজেব আর তাঁর মুন্সি, মীর জুমলাকে লিখেছিলেন, তাতে প্রমান হয় যে মীর জুমলার দখল করা ভূখণ্ডটি রক্ষায় আওরঙ্গজেব যথেষ্ট আন্তরিক ছিলেন; তাই তাঁর প্রতি মীর জুমলার সন্দেহ শুধু ভিত্তিহীন ছিল তাই নয়, আওরঙ্গজেব ভীষণ দুরবস্থার মধ্যে যে সেই কাজটি করেছেন, সেই সম্মানটুকু তাঁর প্রাপ্য ছিল। দূরে বসে খবর পাওয়ার দেরিতে মীর জুমলার মনে ক্ষোভ জমেছে এই অভিযোগ করাই যায়, বিশেষ করে যেভাবে ডাকচৌকিগুলির ওপরে আক্রমণ নেমে আসছিল, সেই সংবাদে মাথা ঠাণ্ডা রাখা খুব কঠিন ঠিকই – কিন্তু আওরঙ্গজেবের ওপর অবিশ্বাস যে খুব একটা ন্যয় সঙ্গত এ কথা মোটেই বলা যাবে না। সে ঘটনাগুলি ঘটেছিল, তা কিন্তু সম্রাট আর তাঁর উজিরের কাজকর্মের নীতিতেই হচ্ছিল। দুজনেই চেয়েছিলেন এলাকায় থাকা আওরঙ্গজেব কর্ণাটকের নিরাপত্তায় দায়িত্ব নিন। কিন্তু অকুস্থলে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি যে রণনীতি আর কূটনীতি অনুসরণ করেছিলেন, তা ছিল তাতক্ষণিক সিদ্ধান্তের ফল। সেগুলি ক্ষতস্থনা হয়ত উপশম করে কিন্তু আরোগ্য করে না। তাঁর হাতে প্রয়োজনীয় সেনাবাহিনীর জোর ছিল না, যথেষ্ট সেনা রাখার অনুমতিই ছিল না। একটা বিষয় পরিষ্কার, যে মীর জুমলা কর্ণাটক থেকে প্রস্থানের পরে সেখানকার বাহিনীর পরিমান কমিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়াও বহু ঘটনা তাঁর নিয়ন্ত্রণের বাইরে থেকে গিয়েছিল। যেমন এর আগে আমরা দেখেছি, দারার উচ্চাশা পুরণের গোপন চক্রান্ত কুতুব শাহের গোঁ বাড়তে এবং আওরঙ্গজেবের বারংবার হুমকিকে উপেক্ষা করতে সাহায্য করেছিল। দারার উতসাহে দুজন দক্ষিণী সুলতানই আওরঙ্গজেবের হুঁশিয়ারি প্রকাশ্যে অমান্য করার সাহস পেয়েছিল এবং তারা বুঝতে পারছিল আওরঙ্গজেবের ওপর শাহেনশার পুরোপুরি বিশ্বাস নেই, এবং সম্রাট তাঁর থেকে বার বার জবাবদিহি চেয়ে পাঠাচ্ছেন, এমন গুজবও কৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছিল। আওরঙ্গজেব প্রকাশ্যেই মীর জুমলাকে বলেছিলেন আমার বক্তব্য বা লেখার কোন প্রভাব পড়ছে না। তিনি উজিরকে বলেন যে ডাকচৌকিগুলি ঠিকঠাক কাজ করা মুশকিল কেননা, ইন্দোর আর বুরহানপুরের জায়গিরের মধ্যেকার ডাকচৌকিগুলিতে থাকা মানুষেরা মন দিয়ে কাজ করছে না।

৭। গোলকুণ্ডা আক্রমণের দ্বিতীয় পরিকল্পনায় বাধ সাধলেন মীর জুমলা

১৬৫৬র মাঝের দিকে মীর জুমলার মনে কর্ণাটক এবং তাঁকে নিয়ে যে সব রটনা ছিল সেগুলি দূর করার চেষ্টা করলেন আওরঙ্গজেব। তাঁর বক্তব্য ছিল সমস্যা সমাধানের সূত্র আসতে হবে দিল্লি থেকেই। দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের ইচ্ছে ছিল যে এই বিষয়ে মীর জুমলা সম্রাটের সামনে তাঁর রাজনীতি সঠিকভাবে প্রয়োগ করুক, যাতে তিনি দুই সুলতানকেই চিঠি লিখে তাদের শয়তানি কাজকর্মে দাঁড়ি টানতে সক্ষম হন। কিন্তু ক্রমশঃ তিনি বুঝছিলেন দাক্ষিণাত্যের অবস্থা শুধু আর হুমকি দিয়ে সামলানো যাচ্ছিল না, প্রয়োজন ছিল সরাসরি মেঠো রণনীতি বিশেষ করে আক্রমণের রাস্তা অবলম্বন করার। দারার চক্রান্ত আর উস্কানি রুখতে তিনি সুলতানি রাজ্য দুটিকে আক্রমন করার প্রস্তাব মীর জুমলাকে দিলেন। ‘’তুমি যদি মনে কর যে আমি তোমার কাজে অবহেলা করছি, তাহলে আমি বলব তোমারও মনে রাখা উচিত এই দুর্বিসহ অবস্থাকে সামলানোর একটা দায় সম্রাটের ওপরও বর্তায়, যাতে কর্ণাটক বিষয়ে(নীতি গ্রহণে) কোন ত্রুটি না থেকে যায়’। তিনি আবারও বললেন, ‘তুমি গোলকুণ্ডার অবস্থা ভালভাবেই জান। এই বিষয়ের তদ্বির নির্ভর করছে সম্রাটের সুখ-ইচ্ছার ওপর, এবং আশাকরব, তুমি বিষয়টি তাঁর সামনে এমনভাবে উপস্থিত করবে যাতে কর্ণাটক বিষয়ে যারা লোভ করছে তাদের বিচ্ছিন্ন ও নির্বিষ করে দেওয়া যায়।’ হিন্দু বিদ্রোহ দমন করতে আওরঙ্গজেব চেয়েছিলেন দিল্লির বাহিনী এসে যেন ‘আমাদের কাজ’ কর্ণাটকের সামনে চোখ রাঙিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা আবদুল জব্বারের নেতৃত্বে কুতিব শাহী বাহিনীকে হঠিয়ে দিক, কেননা এখন আর শুধু চোখ রাঙ্গানিতে কাজ হচ্ছে না। ঘটনা যখন পেকে উঠল, মুঘল দূত হাজি শফি কোন রকমে প্রাণ বাঁচিয়ে কর্ণাটক থেকে বহু কষ্টে ফিরে এলেন, সে সময় আওরঙ্গজেব সরাসরি মীর জুমলাকে প্রস্তাব দিয়ে বললেন অন্তত একবারও যেন খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগে তিনি সম্রাটের অনুমতি নিয়ে দাক্ষিনাত্যে আসেন। দিনের পর দিন অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তুমি যা ভাল মনে কর, কর। তুমি যদি একে সামলাতে চাও তাহলে তাড়াতাড়ি চলে এস, যাতে আমরা দুজন হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করতে পারি। ভবিষ্যতে কিন্তু কোন উদ্যমই যথেষ্ট বলে প্রমাণিত হবে না। আমি জানি তুমি কত বড় সেবার কার্যে আছ, তোমার জ্ঞান প্রজ্ঞা দূরদৃষ্টি অতুলনীয়; তাই তাড়াতাড়ি বিষয়টাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পরিকল্পনা প্রস্তুত কর, অমনযোগী হয়ো না।

আওরঙ্গজেব শেষ পর্যন্ত কুতুব শাহী রাজত্ব উচ্ছেদ এবং তাঁর জন্য একটি বাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে তিনি যেন দিল্লি থেকে চলে আসেন এমনও প্রস্তাবটা দিয়ে ফেললেন মীর জুমলাকে। ‘সুলতানের মনোভাব আর অদূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষদের চক্রান্তের কথা অবিদিত নেই তোমার কাছে। এই জন্য আমি কুতুবউলমুলককে উচ্ছেদ করতে চাই এবং তাঁকে ক্ষমতায় রাখার প্রস্তাব আমাকে কেউ দিক চাই না। কর্ণাটকের ভবিষ্যতের জন্য এবং সময় সারণী দেখে আমার মনে হয়েছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই কাজটা সমাধা করতে ফেলতে হবে। এই বিষয়টা সুলতানকে পাঠানো চিঠিতে বিশদে বলা হয়েছে, এবং চিঠিটির বিষয়টি নিয়ে তুমি নিশ্চই সম্রাটকে বোঝাবে এবং দেখবে এটিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাতে বাস্তবে রূপায়িত করা যায়, এবং তাঁর জন্য দেরি না করে ফর্মান জারি করার ব্যবস্থা করবে।’ ততক্ষণ দাক্ষিনাত্যে তিনি তাঁর বাহিনী বাড়াবার প্রস্তাব দিলেন, বললেন প্রয়োজনে কাজি মহম্মদ হাসানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কর্ণাটক আসার ব্যবস্থা নিতে।

এটা পরিষ্কার যে আওরঙ্গজেব সরাসরি মীর জুমলাকে দাক্ষিনাত্য অভিযানে নেতৃত্ব দিতে বলছেন। ঘটনাগুলি পরিষ্কার করে তাঁর সামনে পেশ করলেন – সুলতানেরা সাম্রাজ্যের নির্দেশিকা, সুবাদারি নিশান এবং হুঁশিয়ারি অমান্য উপেক্ষা করেছেন, সুলতান হিন্দু রাজা জমিদারদের উষ্কানি দিয়েছেন যাতে তারা বিদ্রোহ করে, এবং বীজাপুরের সহায়তায় একটা বড় ধরণের সামরিক অভিযানের পরিকল্পনা করছে সুলতান, এবং এই ছোট বাহিনী নিয়ে তাঁর পক্ষে মীর জুমলার জায়গির বাঁচানো মুশকিল – মীর জুমলাকে তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, হয় তিনি সম্রাটকে রাজি করিয়ে আওরঙ্গজেবের সামরিক অভিযানের অনুমতি নিন, না হয় তাঁর ১২ বছরের শ্রমের ফল দখল রাখার কথা মন থেকে মুছে ফেলুন। দাক্ষিনাত্যের অবস্থা এবং তাঁর সমাধান সম্পর্কে এক মত হয়েও দুজন পরিকল্পক এক মত হতে পারলেন না। আওরঙ্গজেব চাইলেন মীর জুমলা কর্ণাটকের রাজনীতির মাধ্যমে দাক্ষিনাত্যের সমস্যার সমাধান করুণ, আর মীর জুমলা চাইলেন যে এই কাজটা শুরু হোক বীজাপুর দিয়ে। এই বিষয়ে দুজনের মধ্যে ছোটখাট বিরোধ দেখা দিল। উজির দিল্লিতে বসে বুঝতে পারছিলেন না কেন আওরঙ্গজেব তাঁর প্রস্তাবে দ্বিধান্বিত হচ্ছেন এবং সাড়া দিচ্ছেন না। আওরঙ্গজেব জানালেন তিনি অতীতে বারংবার উজিরের প্রস্তাবে কাজ করেছেন - কেন তুমি এখানে আমার অবহেলা দেখছ, যার মূল্য অঙ্কের খাতায় ধরে না? আর এই দেশটার নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতের বাইরে বেরিয়ে যাক, এবং আমাদের শত্রুরা উৎসাহিত হয়ে আমাদের নিয়ে মৃত্যুমিছিল করুক সেই পরিকল্পনায় আমি কি করে সায় দেব? সর্বশক্তিমান না চান, এই চিন্তা আমার মন কুরে কুরে খাচ্ছে। অবাক হয়ে যাচ্ছি তুমি একে বাধ্যতা ধরে নিলে।

কর্ণাটকের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে, এই প্রশ্নে এবং এবং সম্ভাব্য সামরিক অভিযানে যখন সারা দাক্ষিনাত্য উত্তাল, বীজাপুরি সুলতানের হঠাত মৃত্যু দাক্ষিণাত্যের রাজনীতিতে নতুন বাঁকের সৃষ্টি করল এবং বীজাপুরের দিকে সবার নজর ঘুরে গেল।

৮। ১৬৫৭-৫৮ সালে বীজাপুর আক্রমণের সময় কর্ণাটক

বীজাপুর আক্রমনে নিজেকে প্রস্তুত করতে করতে তিনি সম্রাটকে বাধ্য করলেন বেটুল নির্ভর বীর পরগণার শাহ বেগ খানকে তাঁর সহায়ক হিসেবে দিতে, যাতে কর্ণাটকে হিন্দুদের জোরালো প্রভাবশালী বিদ্রোহ দমন করা যায় এবং মীর জুমলাকে আক্রমণে পাঠানো হচ্ছে – সুলতানের মাধ্যমে এই বার্তা দিয়ে তিনি দক্ষিণী সুলতানদের রক্ষণাত্মক খোলসে ঢুকিয়ে অতিরক্ত ভয় দেখাবার ব্যবস্থা করলেন। মীর জুমলার প্ররোচনায় আওরঙ্গজেব গোটা বাহিনী জোগাড়ের জন্য বিন্দুমাত্র দেরি না করে, তক্ষুণি হাতে যে বাহিনী রয়েছে(৫০০০ ঘোড়সওয়ার) তা নিয়েই খানকে অভিযানের নির্দেশ দিলেন এবং রাস্তায় মীর জুমলার গোমস্তা কাজি মহম্মদ মহসিনের সঙ্গে যোগ দিতে বললেন। ১৬৫৬ সালের ৩০ নভেম্বর সরফরাজ খান, যদু রায় এবং তাঁর ভাই, জওহর খান এবং উদাচারম – শাহ বেগ বীর থেকে বের হয়ে ইন্দোরে পৌছলেন ১৫ ডিসেম্বর কুতুব শাহের রায়তদের লুঠ আর মীর জুমলার এলাকাগুলিতে রায়তদের ক্ষতি না করে তাঁর মূল গন্তব্যের দিকে রওনা হলেন। উদ্বিগ্ন উজিরকে শান্ত করতে আওরঙ্গজেব তাঁকে কাজির শেষতম ডাক এবং তাঁর সঙ্গে শাহ বেগ খানকে তাঁর নিজের নির্দেশটি – যাঁর কর্ণাটকে পৌছবার তারিখ ছিল ৭ জানুয়ারি, ১৭৫৭, জুড়ে পাঠালেন। শাহ বেগকে অভিযানে পাঠানো কার্যকর প্রমান হল। আবদুল জাব্বার হায়দ্রাবাদে হঠে এলেন। অভিশপ্ত রয়ালকে আওরঙ্গজেব অকম্মা করে দেন এবং অন্যান্য জমিদার মীর জুমলার কর্ণাটক থেকে বীজাপুরী কর্ণাটকে পালিয়ে গেলেন। কয়েকটি মহালের রাজস্ব তোলা নিয়ে কুতুব শাহ আর মীর জুমলার আধিকারিকদের মধ্যে ঝগড়া, সীমান্ত নিয়ে গোলযোগ পর্যন্ত পৌঁছল। সুলতান সম্রাটকে অভিযোগ করে বললেন, মীর জুমলা হয় তাঁকে প্রতিশ্রুত বছরে দেয় ৪ লাখ হুণ(কুড়ি লাখ টাকা) দিন, না হয় সম্রাট তাঁকে এল্লোর আর রাজামুন্দ্রির মত কৃষ্ণার দক্ষিণের অঞ্চলের তাঁর জায়গির থেকে বকেয়া উদ্ধার করতে সাহায্য করুণ।

মীর জুমলা তখন দিল্লিতে বীজাপুর আভিযানে সম্রাটের অনুমতি নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি তখন(২৬ নভেম্বর ১৬৫৬) উদ্ধার করা পেশকাশের মধ্যে ১৫ লক্ষ টাকা ৯ তাং(২৬ রতি বা ২১৬ সুর্খ) ওজনের বড় হিরে যার দাম ২,১৬,০০০ টাকা সহ অন্যান্য দামি গয়না, ২০টা হাতি – চারটি সোনা আর রূপার শিকলিতে মোড়া উপহার দিলেন। সম্রাট সুলতানকে তাঁর উত্তরাধিকারীদের উদয়গিরি দূর্গ দখল রাখতে নির্দেশ দিলেও মীর জুমলার ক্ষেত্রতে হাত না বাড়াতে নির্দেশ দিলেন। সম্রাট লিখলেন, ‘কর্ণাটকে প্রচুর হিরের খনি রয়েছে... (মুয়াজ্জম)খান আমাকে সেই খনির একটি ৯ তাংএর বড় হিরে উপহার দিয়েছে... তুমি আমায় এ ধরণের পেশকাশ বা উপহার দাও নি। ফলে ঐ এলাকার দায়িত্ব আমি মীর জুমলাকেই দিলাম... তুমি কর্ণাটক আর তাঁর খণিগুলির ওপর তোমার দাবি তুলে নাও। অনভিজ্ঞ মানুষের পক্ষে আদিল শাহ এবং অন্যান্য অবিশ্বাসীর হাত থেকে ঐ এলাকা রক্ষা করা সম্ভব নয়।’ আর যদি সম্রাটের নির্দেশ অমান্য করা হয় তাহলে পাদশাহ প্রস্তাব দিলেন, মুহম্মদ আমিন খানকে বড় বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে তাঁর পিতার জায়গির শাসন এবং জমিদারদের থেকে সেটিকে বাঁচানোর আদেশ দেওয়া হল।

সম্রাটের আদেশে সন্তুষ্ট না হয়ে কুতুব শাহ বীজাপুর অভিযানের সুযোগ নিয়ে কর্ণাটক দখলের পরিকল্পনা করলেন। তিনি আওরঙ্গজেবকে বললেন মীর জুমলার কিছু আধিকারিক কুতুব শাহী এলাকা কাম্বাম এবং উদগির দখল করার চেষ্টা করছে, এবং এই এলাকাগুলি সম্রাট মীর জুমলাকে দিয়েছেন। আওরঙ্গজেব সতর্ক হয়ে শাহ বেগ খানকে বললেন, ১) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কর্ণাটক পৌঁছন এবং মীরের আদেশের জন্য অপেক্ষা করুণ ২) অভিজ্ঞ এবং সৎ বক্সী এবং ওয়াকিয়ানবিশকে বলা এই বিবাদ মিটিয়ে একটা সমীক্ষা পেশ করতে, ৩) কাজি মহম্মদ হাশিমের সাহায্যে বিষয়টার সমাধান খুঁজতে ৪) আর মীর জুমলার ডাকচৌকিগুলি কর্মক্ষম করতে।

কিন্তু এদিকে মীর জুমলা সম্রাটের সামনে অভিযোগ করে বললেন কুতুব শাহের আধিকারিকেরা কাম্বাম এবং উদগিরের মধ্যের এলাকা দখল করে নিয়েছে, এবং মীর জুমলার কর্ণাটকের জায়গিরের ১৬০ মাইল ভেতরে তাদের সীমান্ত টেনিয়ে এসেছে। এই সংবাদ পেয়ে আওরঙ্গজেব শাহ বেগ খানকে নির্দেশ দিলেন আবদুল মোবাদকে না পাঠিয়ে নিজেই তদন্ত করতে। যদি মীর জুমলার অভিযোগ সত্য হয়, শাহ বাগ যে শুধু সুলতানের কর্মীদের ভর্তসনা করবেন তাই নয়, তাদের তাড়িয়ে দিয়ে দেখবেন, যাতে একটাও কোস গ্রাম সুলতানের অধীনে না থেকে যায়।

১৬৫৭র জুলাইতে দেখা গেল সুলতানের অভিযোগ মিথ্যা, শুধু উদগির নয়, একটাও গ্রাম মীর জুমলার অধিকারে আসে নি। সুলতান শুধু এই অঞ্চলটি দখল করতে মিথ্যা অভিযোগ করেছিলেন এবং সম্রাটের নির্দেশনামা উল্লঙ্ঘন করেছেন। এই সংবাদে আওরঙ্গজেব শাহ বেগকে নির্দেশ দিয়ে বললেন শাহী সেনা কত পরিমান রাজস্ব আদায় করেছে সেই পরিমান জানাতে এবং উদগির ছাড়া সেই গ্রামগুলিতে মীর জুমলার বাহিনীকে বসিয়ে দিতে এবং উদগীর দূর্গে শুধু কেল্লাদারকে রেখে শাহী বাহিনীকে সেই এলাকা ছাড়া করতে।

ইতিমধ্যে শাহজী ভোঁসলা বীজাপুর এবং কর্ণাটকে মুঘল দখলের খবরে কুর্ণুলের হাবসি কিলাদার সিদ্দি জৌহরের সহায়তায় কর্ণাটকের কিছু অংশ দখল করে নেন। কিন্তু মুঘলদের বীজাপুর অভিযানের খবর পেয়ে সিদ্দি তাঁর পাশ থেকে সরে যায় এবং শাহজীর মীর জুমলার বাহিনীর হাতে একের পর এক হার হতে থাকে।

বীজাপুর অভিযান মীর জুমলার কর্ণাটকের ওপর অন্য প্রভাব ফেলল। এর ফলে মাদ্রাজের কাছে থাকা তাঁর বাহিনীর কাছে খাদ্য সামগ্রী পৌছনোর কাজে ব্যঘাত ঘটল – সেই এলাকাটি জমিদারেরা দখল করে নিয়ন্ত্রণ করছিল। মীর জুমলার সেনানায়ক টুপাকি কৃষ্ণাপ্পা নায়ক একটি হঠাত আক্রমণ শানিয়ে রয়ালের লুঠেরা বাহিনীকে পরাস্ত করে। এই গেরিলা আক্রমণে ১০০ বেশি নিহত হয় নি, কিন্তু একি পরাজয়ের ফলে হিন্দুদের মনোবলে জোর আঘাত হানে। রয়াল এবং তাঁর সাহায্যকারী শাহজী জিঞ্জির কাছে বড় দুর্গ আর্নির দু মাইল ভেতরে ঢুকে যেতে বাধ্য হন। তাঁরা বীজাপুরীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে বাহিনীর মনোবল বাড়াবার চেষ্টা চালালেও, টুপাকির আবার আক্রমণে তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।

কর্ণাটকের অবস্থা কিছুটা উন্নতি ঘটলে আওরঙ্গজেব শাহ বেগ খানকে ফিরে আসতে নির্দেশ দিলেন। তিনি কোক্কানুর এবং তাঁরই নির্দেশে গোরুমকোণ্ডায় কাজি মহম্মদ হাশিম এবং অন্যান্য সেনানায়কের নেতৃত্বে একটি বাহিনী রেখে এলেন।

আওরঙ্গজেবের কর্ণাটকের নীতি এবং কর্ম নির্ধারণে মীর জুমলার ভূমিকা খুব কম ছিল না। আওরঙ্গজেব সংক্রান্ত ব্যাপারে তিনি বাস্তবিকই স্নায়ুচাঞ্চল্যে ভুগছিলেন – আমরা আগেই দেখেছি, আওরঙ্গজেবের কর্ণাটকের বিষয়ে কর্মসম্পাদনের আন্তরিকতা নিয়ে তাঁর সন্দেহ অমূলক ছিল, কিন্তু সেই চাঞ্চল্য স্বাভাবিকও ছিল। অকুস্থলে দাঁড়িয়ে আওরঙ্গজেবকে প্রত্যেক (দুঃ)ঘটনায় নতুন নতুন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। আওরঙ্গজেব কিন্তু উজিরকে নিয়ে কিছুটা শঙ্কিতই ছিলেন, কিন্তু তাঁর প্রস্তাব বাস্তবের মাটিতে রূপায়িত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধান্বিত হননি। মীর জুমলা তাঁকে প্রয়োজনীয় কূটনীতি(যেমন শাহজীরর সঙ্গে সম্পর্ক) এবং সেনাবাহিনী কিভাবে যাবে, আধিকারিকদের কোথায় বদলি করতে বা শাস্তি দিতে(যেমন কাবাদ বেগ) হবে, সেসব বিষয়ে নিয়ত নির্দেশ দিতেন। যেহেতু প্রত্যেকটার সঙ্গে সম্রাটের নির্দেশ জুড়ে থাকত, ফলে তাঁর পক্ষে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোন সুযোগ ছিল না, বরং মীর জুমলার প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়েছিল যাতে সম্রাটের প্রিয়পাত্র মীর জুমলা, সম্রাটের বিশ্বাসের পাত্র দারাকে কোণঠাসা করে তাঁর দাক্ষিণাত্যে আগ্রাসী নীতি অনুমোদন করিয়ে নিতে পারেন। এই কাজে মীর জুমলার ছিল অসীম ধৈর্য, অসম্ভব কূটনৈতিক দক্ষতা এবং যোগ্যতা, প্রভাবিত করার ক্ষমতা, দাক্ষিণাত্য বিষয়ে সুনির্দিষ্ট জ্ঞান, এবং সব থেকে বড় কথা অসীম সম্পদ ভাণ্ডার – এই সব জড়ো করে তিনি অন্যান্য দক্ষ আধিকারিকদের টপকে সম্রাটের দাক্ষিণাত্য নীতির বিষয়ে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। এইসবগুলি বিবেচনা করে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় ১৬৫৬-৫৭ সালের মুঘল সাম্রাজ্যের দাক্ষিণাত্য নীতির মূল মাথা ছিলেন মীর জুমলা।

৯। দিল্লির সিংহাসন দখলের লড়াইএর সময় এবং তাঁর পরের কর্ণাটক

দিল্লির সিংহাসন পাদশাহ শাহজাহানের কোন পুত্র দখল নেবেন সেই লড়াইএর শুরুতে মীর জুমলাকে দৌলতাবাদে ছদ্ম-গ্রেফতার করেন আওরঙ্গজেব, সেই সঙ্গে তাঁর সম্পত্তি এবং গোলাবারুদ অস্ত্রশস্ত্রও ১৬৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে দখল নেয় আওরঙ্গজেব পাদশাহের প্রশাসন। সেই সঙ্গে তাঁর কর্ণাটক তালুকও সাম্রাজ্যের পক্ষে দখল করেন আওরঙ্গজেব সরকার। কর্ণাটকের রাজনৈতিক অবস্থার এই তাত্ত্বিক পরিবির্তন করা হয়েছিল যাতে তার সঠিক আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধান করা যায়। ফলে ফেব্রুয়ারিতে উত্তরের দিকে সৈন্যবাহিনী নিয়ে এগিয়ে চলা আওরঙ্গজেব তাঁর পূর্বের সহৃদয়তার কথা মনে করিয়ে দিয়ে কুতুব শাহকে হুঁশিয়ারি দিয়ে লিখলেন যে তিনি যেন মানুষ জনকে হেনস্থা না করেন, কৃষকদের দুর্দশায় না ফেলেন, এবং মুঘল সেনা বাহিনীর অবর্তমানে কর্ণাটকে কোন গোলযোগ তৈরি করার চেষ্টা না করেন, এবং চেষ্টা করুণ যাতে কর্ণাটকের প্রশাসন তত্ত্ব থেকে সহজেই প্রায়োগিকতার স্তরে পৌঁছতে পারে। সুলতানের সঙ্গে বন্ধুতের কড়ার করে তিনি লিখলেন, রুঢভাষী এবং দুর্বিনীত দূতের স্থানে মহম্মদ সৈয়দের যায়গায় প্রয়োজনে মৃদুভাষী আবদুল মাবুদকে দূত করার নির্দেশ দিন এবং কর্ণাটকের সীমান্তকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করার উদ্যোগ নিন।

কিন্তু আওরঙ্গজেবের উত্তরের অভিযানের সুযোগে, সেনা বাহিনী হ্রাসের কারণে কুতুব শাহ গোলকুণ্ডা এবং সিদ্ধঔত মীর মিরজুমলার বাহিনীর হাত থেকে ছিনিয়ে নেন ফলে কর্ণাটক নতুন গোলযোগের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়ায়। এবারে দ্বিধাহীনভাবে কর্ণাটকের দিকে নজর দিতে পারলেন আওরঙ্গজেব, নিজেকে হিন্দুস্তানের রাজা হিসেবে ঘোষণা করায়। তিনি কুতুব শাহকে সরাসরি বললেন তাঁর চক্রান্ত এবং হুড়মুড়করে নেওয়া সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে মীর জুমলার দখল করা এলাকা ফিরিয়ে দিয়ে কর্ণাটক্ম থেকে নিজস্ব সেনা বাহিনী তুলে নিতে। ততদিনে তিনি ছদ্ম-কারাগার থেকে মীর জুমলাকে ছেড়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রচনা করে তাঁকে খণ্ডেশের সুবাদার ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। একই সঙ্গে তিনি মীর জুমলা হায়দ্রাবাদ থেকে কর্ণাটক পর্যন্ত যে সব ডাকচৌকি স্থাপন করেছিলেন, সেগুলিকে কোন রকম অব্যবস্থার মধ্যে না ফেলতেও নির্দেশ দিলেন।

তবুও কুতুব শাহ তাঁর আগ্রাসী মনোভাবে এড়ে রইলেন। আগস্ট ১৬৫৬ সালে মীর জুমলার বাহিনী হঠিয়ে পুনামাল্লি দখল নিলেও পরে মীর জুমলার সেনাপতি টুপাকি কৃষ্ণ সেটি দখল করলেও, সেটি ঘিরে থাকা শাহী বাহিনীর আত্মক্ষার্থে আরও বড় বাহিনী পাঠালেন। কৃষ্ণ একই সঙ্গে ডাচেদের পুলিকট এবং ব্রিটিশদের কুঠি অবরোধ করেন। অক্টোবরে গোলকুণ্ডার সেনানায়ক কুতুব বেগ টুপাকিকে শুধু হারলেন তাই নয়, তাঁকে আহত করে গ্রেফতার করলেন মাদ্রাজ এবং স্যান থোমের আশেপকাশের অঞ্চল দখল করলেন।

আজমেড়ে(মার্চ ১৬৫৯) দারার বাহিনীকে হারিয়ে সুজার সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে দাক্ষিণাত্যে সুলতানের দিকে নজর দিলেন আওরঙ্গজেব। এতদিন সাম্রাজ্যের দূত কৃষ্ণ রাওএর সঙ্গে সুলতান, কর্ণাটক নিয়ে কোন কথাই বলেন নি, আলোচনাও করেন নি এবং মীর জুমলার কর্ণাটক দখলের আশাও ছাড়েন নি। সম্রাট আওরঙ্গজেব হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন হিন্দুস্তানের যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলেই, তিনি গোলকুণ্ডা এবং কর্ণাটক দখল করতে দাক্ষিণাত্যের দিকে যাওয়া যে কোন সেনাবাহিনীর নেতা করে দেবেন মীর জুমলাকে। ‘কর্ণাটক মীর জুমলাকে দেওয়া হয়েছে... কোনভাবেই তা ফেরত নেওয়া যায় না... তোমার বাহিনীকে বল দূর্গ আর মহলগুলি মীর জুমলার বাহিনীর হাতে ছেড়ে (গোলকুণ্ডায় সরে)আসতে... কিন্তু তুমি যদি তোমার উদ্দেশ্যপথ না পাল্টাও, তা হলে এই বর্ষার পরে হিন্দুস্তান থেকে শত্রুর নাম মুছে দেব। মীর জুমলা গোলকুণ্ডা আর কর্ণাটক বলপূর্বক দখল করে নেবে... সময় এসেছে তোমায় উপড়ে ফেলার। মুহূর্তের মধ্যে তোমার সম্মান পথের ধূলায় লুটোবে। তোমার দেশ থেকে তোমার সব নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে।’ সুজা রাজমহল ছেড়ে তাণ্ডার দিকে যেতে শুরু করলে, দক্ষিণে মীর জুমলার বাহিনীর সঙ্গে সুলতানের বাহিনীর লড়াই লাগলে আওরঙ্গজেব গোলকুণ্ডার দিকে মীর আহমদ খোয়াফি ওরফে মুস্তাফা খানকে পাঠালেন। আমরা দেখলাম মীর জুমলার কর্ণাটক বিষয়ে আওরঙ্গজেবের প্রতিক্রিয়া তার নিজস্ব চাহিদা, পেশা এবং সিংহাসন দখলের ভাগ্যের ওপরে নির্ভরশীল ছিল।

মীর জুমলা মুঘল উজির এবং তার পরে দাক্ষিণাত্যে গমনে তার কর্মচারী টাপা টাপ(তাবাতাবাই?) গোলকুণ্ডায় তার স্বার্থ এবং সম্পত্তি রক্ষায় গোলকুণ্ডা এবং মছলিপত্তনমে থেকে গেলেন। বন্দরে কুতুব শাহের কর্মচারীরা বন্দরে তার জাহাজের পণ্য বাজেয়াপ্ত করলে টাপা টাপ(তাবাতাবাই?)এর সঙ্গে তাদের সরাসরি বিরোধের অবস্থা তৈরি হয়। এ বিষয়ে পাদশাহের আপত্তি নিয়ে কুতুব লিখলেন, ‘বন্দরের এই সাম্রাজ্যের জাহাজ আটকানোর কোন ক্ষমতা নেই সেখানকার আধিকারিকদের, শুধু জাহাজটিকে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে মাত্র, ১০% শুল্ক দিয়ে দিলে সেটিকে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ তিনি জানালেন শুধু মীর জুমলাই নয়, অন্যান্য জাহাজের পণ্যের ওপর শুল্ক নেওয়া গোলকুণ্ডার বহুদিনের প্রথা।

গোলকুণ্ডাতেও টাপা টাপ, তাঁর কর্মদাতার মৃত্যুর পরও তাঁর সম্পত্তি গোলকুণ্ডার আওরঙ্গজেবের প্রসাসন দখল করে নেওয়া থেকে বাঁচাতে, তাঁর গুদামঘর থেকে বহুমূল্য সম্পদ সরয়ে নিয়েছিলেন। মীর জুমলা নামটা এতই প্রভাবশালী ছিল যে, তাঁর মৃত্যুর চার বছর পরও তাঁর পুত্র মহম্মদ আমিন খুব বিখ্যাত হয়ে যান। এবং তাঁর দালাল মীর মহম্মদ হুসেইন তাফা টাপা বন্দরের কার্যত প্রধান হিসেবে কাজ করেন।

তৃতীয় খণ্ড

বীজাপুর অভিযান ১৬৫৭-৫৮

১। মীর জুমলার বিজাপুর অভিযানের পরিকল্পনা রূপায়ন

মীর জুমলা উজিরের পদে আসীন থাকার সময়ই ১৬৫৭-৫৮ সালে বীজাপুর অভিযানের পরিকল্পনার ভাবনা আসে। আগের বছরের গোলকুণ্ডা অভিযানের মতই মীর জুমলা এবং আওরঙ্গজেব উভয়েই এই পরিকল্পনাটির রচয়িতা। কিন্তু গোলকুণ্ডার ক্ষেত্রে ভাবনাটা যেমন এসেছিল আরঙ্গজেবের মাথা থেকে, বীজাপুর অভিযানের পরিকল্পনাটা সূচিত হয়েছিল মীর জুমলার পক্ষ থেকে। আগের অধ্যায়েই আমরা দেখেছি আওরঙ্গজেব কিভাবে কর্ণাটক বিষয়ে শাহী সুলতান আগ্রাসী মনোভাব নেওয়ার জন্য তাঁকে শাস্তি দিতে এবং গোলকুণ্ডা দখলের গোপন ইচ্ছে পূরণ করতে, কর্ণাটক সমস্যা সমাধানে যেতে এবং সামগ্রিকভাবে দাক্ষিণাত্য অভিযান করতে মীর জুমলাকে সম্রাটের অনুমতি নেওয়ার জন্য চাপ দেন। ঠিক একই সঙ্গে কর্ণাটক সমস্যা সমাধানের জন্য একটা বাহিনী নিয়ে দাক্ষিণাত্য অভিযানের জন্য বারবার এত্তেলা পাঠিয়ে মীর জুমলাকে যে চাপ দেন তা কিন্তু সফল হয় নি। মীর জুমলার ধারণা ছিল কুতুব শাহ আর রয়াল উভয়েই শেষ হয়ে যাওয়া আগ্নেয়গিরি, এদের নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজনই নেই, বরং বীজাপুর শত্রু হিসেবে যথেষ্ট ভীতিপ্রদ এবং খুব তাড়াতাড়ি এই রাজত্বকে ধ্বংস করে ফেলা দরকার তারপরে সুলতানের শাস্তিস্বরূপ কর্ণাটকের নিরাপত্তা এবং দাক্ষিণাত্যের শান্তির কাজে তাঁকে বাধ্য করে কাজে লাগানো যাবে। হয়ত এই কারণেই মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে প্রস্তাব দেন যাতে তিনি দুই সুলতানের আদত উদ্দেশ্য নিয়ে বিস্তারিত তথ্য পাদশাহকে পাঠান, যাতে তিনি নিজে সম্রাটকে দারার শান্তি উদ্যম দমন এবং বীজাপুর অভিযানের জন্য অনুমতি নিয়ে রাখতে পারেন। উজির, নিজের জায়গায় শাহ বেগ খানকে পাঠানোর উদ্দেশ্যটাই ছিল যে নিজেকে বীজাপুর অভিযানের জন্য তুলে রেখে দেওয়া। ১৬৫৭ সালের অক্টোবর মাসে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে লিখছেন, ‘এই বিষয়ের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তোমার নির্দেশে সব কাজ করে গিয়েছি, কোন কাজের বিরুদ্ধতা করি নি, অন্যান্য প্রস্তাবের শুরু থেকেও আমি তোমার ইচ্ছেতেই কাজ করব।’ এবং যেহেতু তাঁর পক্ষে আদিল শাহকে শান্ত রাখা জরুরি হয়ে পড়ছিল, তাই তিনি লিখলেন, মীর জুমলার শয়তানি চক্রান্তে (বাধ্য হয়ে)আমি আপনার এবং গোলকুণ্ডা আক্রমণ করেছি।

বাস্তবে, দুই পরিকল্পক অনতিদূর অতীত থেকেই কুতুব শাহের কর্ণাটক বিষয়ে আগ্রাসী মনোভাবের সুযোগে বীজাপুর দখলের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। মহম্মদ আদিল শাহের মৃত্যুর আগে থেকেই মীর জুমলা আর আওরঙ্গজেব বীজাপুরী আমলা আর সেনা নায়কদের মন কিভাবে জেতা যায় এবং সম্রাটের অনুমতি নেওয়া যায় তার পরিকল্পনা করছিলেন। মীর জুমলা কিভাবে সম্রাটকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন সে গল্পসম ইতিহাস আজ আর পাওয়া যায় না; তবে পারস্যদের কবল থেকে কান্দাহার উদ্ধারের স্বপ্ন বাতিল করে, তার যায়গায় আদিল শাহের মৃত্যুর পরে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে দাক্ষিণাত্যে সেনা বাহিনী পাঠানোর সিদ্ধান্তে সম্রাটকে রাজি করাতে মীর জুমলার অন্তত চার মাস সময় লেগেছিল। এই সংবাদে আওরঙ্গজেব অতীব প্রীত হয়ে মীর জুমলাকে লিখলেন, আমি জানতে পেরেছি, আদিল খানের মৃত্যুর পর তুমি এই দিকে আসার অনুমতি পেয়েছি... আমার বিশ্বাস তুমি এই ঘটনাপ্রবাহের তবদিরে তোমার মানসিক অবস্থা ঠাণ্ডা এবং স্থিতিশীল রাখবে, যাতে এই কাজটি করতে কোন কর্তব্যচ্যুতি দেখা না দেয়। অন্তিম লক্ষ্যর দিনে নজর রেখে একাগ্র হও যাতে পরিপূর্ণ শান্তি আসে এবং তোমার শ্রম নিরর্থক না হয় আর যা চাইছি সেই পথে যেন অভিষ্ট সিদ্ধি হয়।

২। মীর জুমলার সামনে কর্তব্য

৪ নভেম্বর ১৬৫৬ সালে আদিলশাহের মৃত্যুর খবর শুনে বিজাপুরের মুঘল হাজিব ১০ নভেম্বর আদিল-পুত্র মহম্মদ আমনকে দ্বিতীয় আলি আদিল শাহ উপাধি দিয়ে সিংহাসনে অভিষেক করান। এই সংবাদটি আওরঙ্গজেব সম্রাটের কানে পৌঁছে দিয়ে বীজাপুর আক্রমণের অনুমতি চান। এ প্রসঙ্গে মীর জুমলাকে লিখলেন, ‘বিজাপুরের খবরটি যদি ঠিক হয়, এবং সেই রাজ্য সংক্রান্ত বিপুলাকৃতির পরিকল্পনাটিকে যদি আমাদের সফল করাতে হয়, তাহলে তুমি এই বিষয়টি সম্রাটের সামনে পেশ করে যা করার দরকার কোরো।’

মীর জুমলার সামনে দুটি পরিষ্কার কাজ ছিল, দারার উদ্দেশ্য বিফল করতে সম্রাটের থেকে বীজাপুরের অভিযানের পরিকল্পনার সম্মতি সাধন এবং একই সঙ্গে এই পুরো কাজে দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের চাহিদা অনুযায়ী সমগ্র পরিকল্পনা রূপায়নে সেনা আর মালামাল নিয়ন্ত্রণে আওরঙ্গজেবের নিয়ন্ত্রণের সম্মতি নেওয়া। দারার শঙ্কা ছিল, আওরঙ্গজেবের অবস্থান আরও জোরদার হবে যদি মীর জুমলার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যের সেনা বীজাপুরের অভিযানে নামে। তাই দারার প্রস্তাব ছিল দাক্ষিণাত্যে পাদশাহ নিজে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব দিন। শায়েস্তা খানের নিয়ন্ত্রণে থাকা মালওয়ার সেনা বাহিনী নিজের অধিকারে নেওয়ার পরিকল্পনা নেন আওরঙ্গজেব। দারা বোঝে যে এই পরিকল্পনায় আওরঙ্গজেবের হাত শক্ত হবে, এবং সেই পরিকল্পনায় বাদ সাধেন সফলভাবে। আওরঙ্গজেব তখন মীর জুমলাকে অনুরোধ করলেন তিনি যেন স্বতঃপ্রণোদিতভাবে উদ্যোগী হয়ে সম্রাটকে বোঝান যততাড়াতাড়ি সম্ভব মালওয়া সেনা বা তার একটা অংশ মীর জুমলা নিজের অধীনে নিয়ে তার সঙ্গে অবিলম্বে যোগ দেওয়া যায়। তিনি লিখলেন মালওয়ার সেনা নিয়ে আসাটা জরুরি। আমার ডাকে সক্কলে এগিয়ে আসবে না। আর যদি সম্রাট আসেন তাহলে সক্কলে আসবে। তিনি খুব যে উদ্গ্রীব তার প্রকাশ ঘটে উজিরকে লেখা চিঠিতে, এই ঝামেলাটা সামলাতে হবে। কিন্তু তবির ব্যবহার না করে বড় ঝামেলাটা হঠানো খুব বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তুমি কি সেনা বাহিনীতে ঢুকতে পারবে? তোমায় ছাড়া এই কাজে এগোনো এবং সাফল্য পাওয়া খুব মুশকিল।

ফলে আওরঙ্গজেব মনে করলেন, দাক্ষিণাত্য অভিযানের সাফল্যের একমাত্র পূর্ব শর্ত হল মীর জুমলার শীঘ্র উপস্থিতি। চিঠির পর চিঠি লিখে তিনি উজিরকে বোঝাতে চেষ্টা করে গিয়েছেন তার (দাক্ষিণাত্যে)আসা খুব জরুরি এবং দেরি করার অর্থ সুযোগ হাত ছাড়া করা। কাজের তদবিরের সফলতা নির্ভর করছে তোমার যাত্রাকালের সময়ের ওপর। এই দেশের সমস্যাগুলি সম্বন্ধে তোমার পরিচিতি যথেষ্ট; (তোমার আসার পর)আমাদের বৈঠকে তুমি অনেক কথা বলবে, এবং প্রত্যেক পদক্ষেপে কি করা দরকার আমায় জানাবে। আওরঙ্গজেব মনে করলেন মীর জুমলা না এলে আহমদনগরের বাইরে সেনা নিয়ে বেরোনো তার পক্ষে ঠিক হবে না। তিনি লিখলেন, তুমি যদি সত্যিকারে এখানে আসার মন করে থাক তাহলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে এস, সব কিছুই খুব তাড়াতাড়ি সমাধান করতে হবে...। ১৬৫৬র মাঝ বরাবর সময়ে আওরঙ্গজেব আবার মীর জুমলাকে লিখলেন, তোমার সঙ্গে মিলনের ইচ্ছে আর আগ্রহ দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে, তাঁকে তাড়াতে পারছি না। তাড়াতাড়ি চলে এস, সময় বয়ে যায়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাপারটার সুরাহা করতে হবে। তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করাই মঙ্গল। বীজাপুর অভিযানের সাফল্যের দ্বিতীয় শর্ত ছিল, প্রয়োজনমত গোলাবারুদের ব্যবস্থা করা। সম্রাটের নির্দেশে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে জানালেন, দাক্ষিণাত্যের দুর্গগুলি থেকে কিছু পরিমান গোলাবারুদ বীজাপুর সীমান্তে পাঠানো যেতে পারে। মূলত দৌলতাবাদ দুর্গে প্রচুর পরিমান গোলাবারুদ রয়েছে, সাম্রাজ্যের গোলাবারুদ ভাণ্ডারের দারোগা মীর শামসুদ্দিনকে সম্রাট নির্দেশ দিলেন সেই ভাণ্ডারটি নিরীক্ষণ কড়ে সমীক্ষা পেশ করতে। নিরীক্ষণ শেষে আওরঙ্গজেবকে জানালেন, সেখানে শুধু ব্যবহার করার মত একটাই বড় কামান রয়েছে, সেটিকে বয়ে নিয়ে আসা খুব কঠিন, এবং নিয়ে এলেও সেটি যে চাহিদা মত কাজ করতে পারবে কি না সে সম্বন্ধে নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। মুঘল দাক্ষিনাত্যের অন্যান্য দুর্গের গোলাগুলি বা কামান গোলকুণ্ডা এবং অন্যান্য বীজাপুরী দুর্গের সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা বেড়া ভাঙ্গার জন্য যথেষ্ট নয়। আওরঙ্গজেব আবারও লিখলেন, যদি এই বিষয়ে দাক্ষিণাত্যে এসে আরও কিছু দূর এগোতে চাও তাহলে সম্রাটের অনুমতি নিয়েই নিজের গোলাবারুদ নিজের সঙ্গেই এনো। মীর জুমলাকেও বলা হল সম্রাটের এই দৃষ্টিভঙ্গী আওরঙ্গজেবকে জানিয়ে দিতে। উজির মীর জুমলার অতীত যুদ্ধ-সাফল্যে গোলাবারুদ খুব বড় ভূমিকা পালন করেছিল এবং সেই ভাণ্ডার দিল্লিতে নিয়ে আসার পথে সমস্তটাই কিন্তু তখনও নান্দেরেই ছিল। সেখান থেকে সেগুলিকে (আওরঙ্গজেবের সিবিরে)বয়ে নিয়ে যাওয়া খুব বড় কাজ ছিল না। পরে মীর জুমলার এসে পৌঁছনোর খবরে আওরঙ্গজেব তাঁকে সেইগুলি ধারারে পাঠানোর প্রস্তাব দিলেন।

একই সঙ্গে সেনাবাহিনীর মাথাদের মন জেতাটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজ ছিল। আওরঙ্গজেব বুঝলেন কোন জোটই এখন বাস্তবতার অনুকূল নয়, তাই তিনি মীর জুমলাকে বললেন শাহ নওয়াজ খান, মির্জা মহম্মদ মাশাদির মত তাঁর চেনা জানা কয়েকজন আওরঙ্গজেবপন্থী সেনানায়ককে রাজসভায় ডেকে (সম্রাটের)অনুমতি নিয়ে সঙ্গে নিয়ে আসতে। এছাড়াও কারখানা প্রধান, প্রয়াত তারবিয়ত খানের পুত্র দারোগা সইফুদ্দিনকে সঙ্গে নিতে বললেন।

৩। মীর জুমলা এবং আওরঙ্গজেবের বীজাপুরী আমলা ও সেনা নায়কদের প্রলুব্ধ করণ

ইতোমধ্যে আওরঙ্গজেব বীজাপুরি আধিকারিকদের সঙ্গে যোগাযোগের মাত্রাটা বাড়িয়ে দিলেন। যদিও মীর জুমলা তখনও দাক্ষিণাত্যে পৌছন নি, কিন্তু দক্ষিণী রাজসভা বিষয়ে আওরঙ্গজেবের অভিজ্ঞতা তাঁকে এই কাজে কয়েক কদম এগিয়ে রেখেছিল। প্রথমেই বীজাপুরী উজির মুজফফরুদ্দিন ইখলাস খান মানসিকভাবে শিবির বদল করলেন।

কিন্তু বীজাপুরের মুল্লা আহমদ নাটিয়ার সঙ্গে দরকষাকষি জোরদার হয়, প্রমান হল তিনি খুব কঠিন ঠাঁই। তার দৃঢতা ভাঙা আওরঙ্গজেবের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। ১৬৫৬র জুলাইতেই আওরঙ্গজেব, মীর জুমলাকে অনুরোধ করেন দুর্ভেদ্য দুর্গ নাটিয়ার রক্ষণ ভাঙতে। আওরঙ্গজেব জানতে পারলেন অন্যদের সঙ্গে তার সম্পর্কের কথা এবং তিনি নিজের কর্মদাতাকে ভুল বোঝানোর পরেও সুলতানের সঙ্গে মুঘলদের মধ্যে আলাপ আলোচনার ঘোরতর বিরোধিতা করেন। আওরঙ্গজেবের পক্ষে কাবিল খান মীর জুমলাকে জানালেন যে মীরের সঙ্গে যেহেতু নাটিয়ার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সম্পর্ক, এবং সেই সম্পর্ক যদি থেকে থাকে, তাহলে তাঁকে স্বপক্ষে আনা দরকার। না হলে, দেরি না করে মীর জুমলা মুঘলদের তার সম্বন্ধে কিছু ইঙ্গিত দিন, কিভাবে নাটিয়ারের রক্ষণ ভেদ করে তাঁকে ব্যস্ত করে রাখা যায়। মুঘলদের পাশে থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়ে মীর জুমলা কিছু চিঠি মুল্লার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে, তার নকল আওরঙ্গজেবকে পাঠালেন(৫ নভেম্বর ১৬৫৬)। এই কাজের জবাবে আওরঙ্গজেব বীজাপুরের মুঘল হাজিবকে এই চিঠিগুলি পাঠিয়ে সেগুলি হয় চরের মাধ্যেমে গোপনে অথবা প্রকাশ্যে হরকরা মার্ফত একটা জবাবি চিঠি লিখে মুল্লার কাছে পাঠাতে বললেন – যে পদ্ধতিটা মুল্লা পছন্দের। মীর জুমলার চিঠির উত্তরে আওরঙ্গজেব লিখলেন, তিনি(মুল্লা) যদি আমার প্রস্তাবে সম্মত হন, তাহলে ভাল এবং মঙ্গলজনক; না হলে আমাদের নেওয়া পদক্ষেপ সামলাতে তাঁকে চরম ভোগান্তি ভুগতে হবে। মীর জুমলা যেন বাস্তব সম্বন্ধে সচেতন করতে মুল্লাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার কাজটি করেন এবং তাঁদের প্রস্তাবে সম্মত করান। ডিসেম্বরে সমাধান বেরিয়ে এল, আওরঙ্গজেব মুল্লা আহমদকে আশ্বাস দিলেন এবং ইখলাস খানের পরামর্শে মুল্লা বীজাপুরে মুঘল দূতের সঙ্গে দেখা করে আওরঙ্গজেবের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেন। কিন্তু আওরঙ্গজেব তাঁকে সে মুহূর্তে বিশ্বাস করেন নি, মীর জুমলার আগমন পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলেন, তোমার আসার পরেই তোমার মত অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।

এছাড়াও যে কুর্ণুলের সিদ্দি জৌহার মীর জুমলার কর্ণাটকের কিছু গ্রাম(কোক্কানুর আর গোরুমকুণ্ডা?) তছনছ করেছিলেন, তিনিও আওরঙ্গজেবের পক্ষে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিলেন।

১৬৫৬র ডিসেম্বরের শুরুর দিকে শিবাজীকে পক্ষে আনার প্রস্তাব পেশ করলেন মীর জুমলার কাছে। শিবাজীর দূত আওরঙ্গজেবের জন্য অপেক্ষা করে প্রস্তাব দিলেন বর্তমানে শিবাজী বীজাপুরী কোঙ্কণ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁকে যদি ভাল মনসব এবং উপযুক্ত তনখা(বেতন) দেওয়া হয়, তিনি তাহলে সেটি আওরঙ্গজেবকে উপহার দিতে পারেন। আওরঙ্গজেব তাঁকে কিছু শর্তে রাজি হওয়ার আশ্বাস দিলেন এবং শাহজীকে একই শর্ত দিলেন। মীর জুমলাকে জানালেন শিবাজীদের পক্ষ থেকে উত্তর পেলেই তাঁকে জানানো হবে। মীর জুমলাকে তিনি লিখলেন, তারা যদি আমার নির্দেশ মানে তো ভাল, না হলে সাম্রাজ্যের বাহিনীর হাতে অবধারিত শাস্তি লেখা রয়েছে।

মহম্মদ আদিল শাহের মৃত্যুর পর আমলাদের মধ্যে মত বিরোধ দেখা দেয়, তাতে মুঘলেরা সহজেই সেনাবাহিনীকে কব্জা করে নিতে পারার অবস্থায় চলে এল। ২৩ ডিসেম্বরের পরে একটা চিঠিতে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে লিখলেন, আমার সমস্ত উদ্যম, যে কোন উপায়ে বীজাপুর মুঘলদের পক্ষে চলে আসা দেখা, এমন কি প্রখ্যাত সেনায়কেরাও ছোট্ট ধাক্কাতেই নিজেরাই এপক্ষে চলে আসার জন্য উন্মুখ। রণদৌলা খানের পুত্র গাজি খান, আবদুল কাদির ডাকতু, শেখ মুস্তাফা জুনায়েদি, হাজি খান মিয়ানা, যশোবন্ত, মুস্তাফা খান সহ অন্যান্য প্রখ্যাত সেনা নায়ক, মীর জুমলা আসার পরেই তাঁর সাহায্যে তাঁদের সঙ্গে আরও বেশি করে অভিজাত-চাকুরেকে জুটিয়ে আওরঙ্গজেবের পক্ষ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

বিজাপুরিদের স্বপক্ষে এনে সেনাবাহিনীকে এলোমেলো করে দেওয়ার যে পরিকল্পনা রচিত হল, সেটি সফল করতে যে প্রচুর অর্থ বরাদ্দের প্রয়োজন, তার কথাও উঠল। আওরঙ্গজেব বললেন, এটা জরুরি, অর্থ ছাড়া এত বড় ঘটনা ঘটানো যাবেই না, লোভ জাগিয়ে না তুলতে পারলে এই উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের মন জেতা সম্ভব নয়। এই উপলক্ষে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে দাক্ষিণাত্যের রাজকোষের অবস্থা নিয়ে একটা সমীক্ষা পাঠালেন। দৌলতাবাদ এবং আসিফ দুর্গের জন্য রাজকোষ থেকে ২০ কক্ষ টাকার বেশি এবং অন্যান্য দুর্গের জন্য ৩০ লক্ষ টাকার বেশি খরচ করার ক্ষেত্রে সম্রাট যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন, তাতে মুঘল দাক্ষিণাত্যের এক বছরের খরচও চালানো সম্ভব ছিল না। ফলে সুবাদার, এই সব বিষয় তার থেকে বেশি জানা উজিরকে লিখলেন, গোলকুণ্ডার জন্য সম্রাটের থেকে অবিলম্বে ১০ লক্ষ টাকার খেসারত জোগাড় করতে হবে, এবং তার পরে আমরা দৌলতাবাদে বসে ঠিক করব আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ খরচ(আমলাদের ঘুষ দেওয়ার) কিভাবে সামলানো যায়।

৪। মীর জুমলার দাক্ষিণাত্য যাত্রা

দারার সমস্ত বিরোধিতা নিশ্চিহ্ন করে, বিচক্ষণ উজির রাজসভায় আওরঙ্গজেবের নীতিগুলি মনযোগ সহকারে এবং সফলভাবে তোলার কাজ করে চললেন। মাঝেমধ্যে শাহজাহানকে মনমুগ্ধকর উপহার দিয়ে মীর জুমলা সম্রাটকে বুঝিয়ে ছেড়েছিলেন যে দাক্ষিণাত্য অভিযান বাচ্চার হাতের মোয়া এবং এই কাজটি মীর জুমলা স্বয়ং নিজের হাতে করে দেখাবেন। দাক্ষিণাত্যের হিরের খনিগুলি দখলের লোভে দারা আর জাহানারার সক্রিয় বিরোধিতা নস্যাত করে দিলেন সম্রাট। স্বয়ং তিনি অভিযানের নেতৃত্ব দিন, দারার প্রস্তাব বাতিল করে ২৬ নভেম্বর আওরঙ্গজেবের নেতৃত্বে এবং কষা পরিকল্পনায় সামগ্রিক রণসাজে দাক্ষিণাত্যে অভিযানের অনুমতি দিয়ে দিলেন।

মীর জুমলা মালওয়া সেনা না পাঠনোর দারার প্রস্তাব নাকচ করিয়ে আওরঙ্গজেবের শর্তে সম্রাটকে রাজি করিয়ে নিলেন। সম্রাট খান জাহান শায়েস্তা খানকে অবিলম্বে অতিদ্রুত দৌলতাবাদে আওরঙ্গজেব পৌঁছলে, তার সঙ্গে যোগ দিতে নির্দেশ দিলেন।৬০ জন মনসবদারের নেতৃত্বে ২০ হাজার সেনা সুবাদারের হাত শক্ত করতে রওনা হল। যারা তাঁদের বাড়িতে বা তাঁবুতে/শিবিরে আছেন তাঁদের অবিলম্বে আওরঙ্গজেবের সঙ্গে যোগ দিতে সম্রাটের নির্দেশ(ফরমান) পাঠানো হল। উজির, আমীর এবং মনসবদারেরা সরাসরি সম্রাটের থেকে নির্দেশ পেলেন। মীর জুমলা সম্রাটের এই নির্দেশবলে একটি বিশেষ খেলাত, হিরে জহরতে মোড়া একটি ছোরা(খঞ্জর মুরাসসা), সোনা আর রূপোর শৃঙ্খলে মোড়া দুটি ঘোড়া(একটি আরবি, একটি ইরাকি), রূপোর শৃংখলে মোড়া একটি হাতি, রূপোর হাওদাওয়ালা একটি মাদি হাতি এবং অন্যান্য নানান দ্রব্য উপহার পেলেন। প্রথম সাক্ষাৎ থেকে শুরু করে তিনি সম্রাটের থেকে উপহার পেয়েছেন ৭ লক্ষ টাকা যার মধ্যে ৫ লক্ষ নগদে, ঘোড়া, হাতি এবং অন্যান্য রূপো এবং দ্রব্য ২ লক্ষ টাকা। উজিরের পুত্র মহম্মদ আমিনকে তার পিতা ফিরে না আসা পর্যন্ত দেওয়ানি দপ্তরটি দেখাশোনার ভার দেওয়া হল এবং তার পদ(৩০০০ জাট, ১০০০ সওয়ার) বাড়ানো হল ১০০০ জাট হিসেবে।

দারার বিরুদ্ধে মীর জুমলার জিত হল কূটনীতির চরম প্রয়োগে। কিন্তু শাহজাদার শেষ মুহূর্তের প্রতিবাদ জানানো এবং অন্য একটা পদক্ষেপ নেওয়ার সব চেষ্টা বিফল হয়ে গিয়েছিল মীর জুমলার সফলতায়। এবং মানুচির লেখাকে যদি সত্য ধরে নেওয়া হয়, তাহলে দারা শেষ মুহূর্তে মীর জুমলার ৮০ জন ফিরিঙ্গি সাঁজোয়া সেনা কিনে নিয়েছিলেন। উজির তার পুত্র এবং তার সমগ্র পরিবারকে বন্ধক রেখে দাক্ষিণাত্যের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন।

সম্ভবত দারা শেষ মুহূর্তের এই পদক্ষেপেই মীর জুমলার যাত্রা কিছুটা দেরি হয়ে যায়। তিনি সম্রাটের কাছে ২৬ নভেম্বর তারিখ থেকে ছুটি নিয়েছিলেন, কিন্তু দিল্লি থেকে রওনা হলেন ১ ডিসেম্বর ১৬৫৬। গোয়ালিয়র এবং কুলারাস হয়ে দাক্ষিণাত্য যাওয়ার পথে তিনি নিয়মিত আওরঙ্গজেবকে চিঠি লিখতে লিখতে এগিয়ে চললেন সুবাদারের সঙ্গে মিলিত হতে। আওরঙ্গাবাদে পৌছলেন ১৮ জানুয়ারি ১৬৫৭। তার শ্লথ গতির কারণ হল সব মনসবদার রাস্তায় ঠিক সময়ে তার সঙ্গে যোগ দেন নি। কেউ কেউ দারাপন্থী, কেউ কেউ তাঁদের জায়গির ছাড়তে অলসতা করেছে, অনেকের নানান বাস্তব কারণেই দেরি হয়েছে। ১৬৫৬ সালের শেষের দিকে আওরঙ্গজেব মহবত খান, নাজাবত খান এবং মির্জা সুলতানকে বারংবার চিঠি লিখে মীর জুমলার সংগে যোগ দিতে দেরি না করার উপদেশ দিয়েছেন। উজিরকে আশ্বস্ত করে তিনি লিখলেন যারা দেরি করছে, তাঁদের শাস্তি পেতেই হবে। প্রয়োজনে তিনি যেন হরকরাদের মার্ফত সম্রাটকে অভিযোগপত্র পাঠিয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ করে রাখেন। এছাড়াও বললেন, মীর জুমলা যেন উত্তর ভারত থেকে যে সব অস্ত্রশস্ত্র আসার কথা তার জন্য অপেক্ষা না করেন, সেগুলি আওরঙ্গজেবের কাছে আসতে অন্তত ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৬৫৭ পেরিয়ে যাবে।

আওরঙ্গজেব মীরজুমলার দেরিতে অসম্ভব অস্থির হয়ে উঠছিলেন। হয়ত শেষ পর্যন্ত তিনি মীর জুমলার জন্য আর অপেক্ষা করতে পারবেন না, কেননা তা হলে যে সুযোগ এসেছে সেটি হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে – এটি জানিয়ে দিলেন। তবুও আবার তিনি তাঁকে শীঘ্র আসতে অনুরোধ করলেন। ২৪ ডিসেম্বরের মীর জুমলার কুলারাস থেকে পাঠানো চিঠির উত্তরে আওরঙ্গজেব লিখছেন, খুব তাড়াতাড়ি অভিযান শুরু করা দরকার, যাতে বীজাপুর যে দ’য়ে পড়েছে, তার সম্পূর্ণ সুযোগ নিতে পারে মুঘল বাহিনী, ক) খান মহম্মদ, আফজল, ফতে সারনাউবাত, বাহালোলের পুত্রদের মত সাধারণ সেনার মধ্যে অবিশ্বাসের পরিবেশ বেড়ে চলেছে, খ) নিজের ক্ষমতা দেখাতে শাহজী ভোঁসলা বিদ্রোহ করছে এবং তার সঙ্গে জোট গড়তে চলেছে শ্রীরঙ্গ রয়াল এবং তিনি কর্ণাটকের কিছু মহাল দখল করে নেওয়ার পরিকল্পনা করছেন। তিনি লিখলেন আমার আর দেরি করা চলে না, এরকম অবস্থা হয়ত আর আমি পাব না। খুব তাড়াতাড়ি এস, আমরা উভয়ে মিলে এই কাজটি সম্পন্ন করি। এখানে আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি। সত্যিকারের তাই হয়েছিল। তার দেরি দেখে, মীর জুমলা কবে তার সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেন, সেই দিন গুণতে জ্যোতিষীদের আওরঙ্গজেব বসিয়ে দিয়েছিলেন।

৫। মীর জুমলার সঙ্গে আওরঙ্গজেবের রণনীতি বিষয়ে মন্ত্রণা

ঠিক সময়ে উজির দাক্ষিণাত্যে পৌছতে না পারার জন্য দাক্ষিনাত্যের সুবাদারের পক্ষে বীজাপুর অভিযানের সময় সঙ্কুচিত হয়ে আসছিল এবং তিনি আদৌ সম্রাটের নির্দেশ পালন করতে পারবেন কি না সে সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে পড়ছিলেন। আদিল শাহের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর তার দেওয়া জবাব এবং মীর জুমলাকে দাক্ষিণাত্যে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়ার পূর্বে সম্রাটের পরিষ্কার নির্দেশ ছিল, আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে সঙ্গে বীজাপুরের দিকে রওনা হয়ে যাবেন এবং সেই দেশ দখল করে নেবেন। না করতে পারলে আওরঙ্গজেব শুধু নিজামশাহীর(বিজাপুর থেকে ১৫৩৬ সালে আলাদা হওয়া) অধিকারের অংশটুইকুই দখল করবেন, বীজাপুরকে বাৎসরিক রাজস্বের বদলে তার স্বাধীনতা বজায় রাখবেন, সেখান থেকে তিনি গোলকুণ্ডা দখলে যাবেন, যে রাজ্য বীজাপুরের থেকেও সহজে জয় করা যায়। জ্যোতিষীরা আওরঙ্গজেবের বীজাপুরের দিকে যাওয়ার দিনক্ষণ ধার্য করেছিল ৮ জানুয়ারি। কিন্তু ডিসেম্বর পর্যন্ত জানা যায় নি বীজাপুর না গোলকুণ্ডা, কোনটা আগে মীর জুমলা আক্রমণ করতে চাইছেন। সম্রাটের দেওয়া আর আওরঙ্গজেবের চাহিদা মত সময়ে যে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের বাহিনীর সঙ্গে যে মিলতে পারছেন তা পরিষ্কার হয়ে যায়। আওরঙ্গজেবের মনে হচ্ছিল যে দেশ দখলের যে অবশ্যম্ভাবী যোগটা তৈরি হয়েছে সেটা না হাতছাড়া হয়ে যায়। তিনি প্রথমে বীজাপুর দখল করে, কুতুব শাহকে দেখে নেওয়ার পরিকল্পনা করে তার হাত থেকে মীর জুমলার অধিকৃত কর্ণাটক ছিনিয়ে নেওয়ার কথা ভেবেছিলেন। তাঁর মতে গোলকুণ্ডা যে কোন সময়েই দখল নেওয়া যায়। ১১ এবং ১৪ ডিসেম্বরের মীর জুমলার দুটি চিঠির উত্তরে আওরঙ্গজেব লিখলেন, এ বিষয়ে(আক্রমণের রণনীতি) উজিরের মত তিনি জানতে উতসুক, তা তার পরিকল্পনা রূপায়নে সাহায়তা করবে। যদি মীর জুমলা তাঁকে প্রস্তাব দেন যে প্রথমে বীজাপুর অভিযান করে – পুরো বা আংশিক দেশটা দখল করে এবং সুলতানের থেকে বিপুল পরিমান ক্ষতিপূরণ চেয়ে তারপরে গোলকুণ্ডা দখল এবং তার পরে হয় সেই বছরে বা পরের বছরে কর্ণাটকের দিকে এগোনো যাবে – তাহলে আওরঙ্গজেব তার মস্তিষ্ককে বিশ্রাম দিয়ে সঠিক দিনক্ষণ মিলিয়ে বীজাপুরের দিকে অগ্রসর হতে পারেন।

সম্রাটের অনিশ্চয় অবস্থায় যে আওরঙ্গজেব বিপদে পড়েছেন সেটা তিনি মীর জুমলাকে স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তিনি একা এই অভিযানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে চাইছিলেন না। ঠিক করলেন, যতক্ষণ মীর জুমলা এসে না পড়েন, ততক্ষণ তিনি শিকার(বীজাপুর সীমান্তে রামদোয়ায়) করেই বেড়াবেন, এবং সঠিক সময়ে উজির এসে পড়লে অভিযানের দিন ঠিক করবেন। ১৬৫৭ সালের মধ্য জানুয়ারিতে তিনি জানতে পারলেন যে মীর জুমলা ১৮ তারিখে এসে পড়ছেন এবং তিনি এলেই অভিযানের পথ ঠিক হবে। আওরঙ্গজেবের প্রস্তাব ছিল যে তাঁদের মধ্যে প্রথম মোলাকাতের দিনে শিকারে যাওয়া হবে এবং সেই সুযোগে রণনীতিও ঠিক হবে। যদি ঠিক হয় বীজাপুরের দিকে যাওয়া হবে তাহলে তো হয়েই গেল, না হলে গোলকুণ্ডার দিকে যাওয়া হবে।

৬। বীজাপুরী অভিযানে মীর জুমলার ভূমিকা

১৮ জানুয়ারি মীর জুমলা আহমদনগরে পৌঁছেই, সেই দিন আওরঙ্গজেবকে নিয়েই বীজাপুরের দিকে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।বিপুল আস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত সাঁজোয়া বাহিনীর গতি খুবই ধীর ছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারি আন্দুরে পৌঁছে ওয়ালি মহলদার খানকে সেখানের সরবরাহ আর রাস্তার সুরক্ষার জন্য রেখে বিদর দুর্গের কাছে গিয়ে শিবির গাড়লেন।

প্রায় দুর্ভেদ্য বিদর দুর্গ দখল করা দাক্ষিণাত্য এবং কর্ণাতক দখলের অন্যতম প্রধান চাবিকাঠি। সেটির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন প্রবীন কিলাদার সিদ্দি মারজান, ছিল ১০০০ ঘোড়সওয়ার আর ৪০০০ গোলান্দাজ, তুফাং চি, হাউইদার এবং তোপান্দাজ। তিনি কেল্লার সুরক্ষা এবং আক্রমণের রণনীতি নিশ্চিত এবং কেল্লায় ঢোকা বেরোনো নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। আওরঙ্গজেবের সঙ্গে মীর জুমলা দুর্গ নিরীক্ষণ করলেন এবং বাইরে পরিখা(মালছার) কাটা দেখলেন। দুর্গ থেকে নিরন্তর গোলাগুলি চললেও সেই পরিখা ভর্তি করে, দুদিনের মধ্যে কামানগুলি বসাতে সক্ষম হলেন মীর জুমলা এবং তাদের এই কাজে সমুচিত জবাব দিতে থাকল মুঘল বাহিনী। আক্রমন প্রতিআক্রমণে মুঘল বাহিনীর দিকে পাল্লা ভারি হতে থাকল। শেষে মুঘলেরা তাঁদের দুটি কামান ধ্বংস করে, বাইরের দিকের দেওয়ালের নিচের অংশ দুর্বল করে দিতে সক্ষম হয়। ২৯ মার্চ ১৬৫৭ সালে মহম্মদ মুরাদের নেতৃত্বে বানহিনী মীর জুমলার মালছারের উল্টোদিকের দেওয়াল বেয়ে দুর্গ বুরুজে উঠতে সক্ষম হয়। মীর জুমলার বাহিনীর ছোঁড়া হাউইয়ের স্ফুলিঙ্গ বারুদের গুদামে পড়ে বিষ্ফোরণে সিদ্দি আহত হন এবং দুর্গ মুঘলদের হাতে তুলে দেন।

বিদর দখল হওয়ার পরে মহবত খানকে পাঠনো হল বীজাপুর লুঠ আর ছারখার করতে এবং মুঘল বাহিনীর জন্য পথ উন্মুক্ত করতে।২৭ এপ্রিল বিদর থেকে রওনা হয়ে ৩ মে ৪০ মাইল দূরে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের সঙ্গে মিলিত হলেন ৩ মে কল্যাণীতে। ঐদিনই তারা দুর্গের নিরাপত্তা ঘুরে দেখলেন এবং তাঁদের ওপর নিরন্তর গোলাগুলি চললেও, তারা তারা পরিখা উন্নত(ভর্তি) করে দমদমা(বড় ব্যাটারি) রেখে যে কোন উপায়ে দুর্গে পৌছতে দৃঢ সংকল্প করলেন। মুঘলদের প্রত্যাঘাতে শত্রুর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হল। তাঁদের ছোঁড়া টপ আর তুফাং মুঘল সেনানীদেরও প্রচুর ক্ষতি সাধন করল। রাতে পরিখাটি আরও ভরে ফেলার কাজ চলল। ২৩ মে পরিখার ২/৩ অংশ ভরে গেল এবং দুর্গটি দখলে আসা এখন সময়ের অপেক্ষা। বীজাপুরীরা আক্রমণকারীদের নজর তখন ঘুরয়ে দেওয়ার জন্য ব্যস্ত। মুঘল শিবিরের ৪ মাইল দূরে যখন ৩০০০০ বিজাপুরী সেনানী আক্রমণ করতে উপস্থিত, ২৮ মে আওরঙ্গজেব দুর্গের সামনে তাঁবুতে পর্দা ফেলে দিয়ে তাদের দিকে আগ্রসর হলেন। মীর জুমলা, নাজাবত খান, সুজন সিং বুন্দেলা, দিলির খানের নেতৃত্বে মুঘল বাহিনী ভালোলের নেতৃত্বাধীন আদিলশাহী বাহিনীর মুখোমুখি হল। প্রচণ্ড যুদ্ধ চলল। চতুর আদিলশাহী বাহিনী সব দিক থেকে মুঘল বাহিনীকে আক্রমন করেও হঠাতে পারল না। উল্টোদিকে মুঘল অশ্বারোহীরা প্রচণ্ড বেগে বিপক্ষকে আক্রমন করল। ইতিমধ্যে মীর জুমলার সঙ্গে শাহ নাওয়াজ খান, রাও ছত্রশাল, শামসুদ্দিন খোয়েসগি এবং মহাবত খান শত্রুকে চারপাশ থেকে নিপুণ আক্রমন করে পর্যুদস্ত করে ফেলল।

দুর্গের সামনে যে খনন করা পরিখা ভর্তি হয়েছে সেটি সুরক্ষার শর্ত হল সেখানে মুঘলদের অন্তত সন্ধ্যার সময়ে ফিরে যেতে হবে। কিন্তু ততক্ষণে বিপক্ষ শুকনো গাছপালা দিয়ে ভর্তি করা পরিখা ন্যাপথা, বারুদ ইত্যাদি দিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। তাই নতুন করে আবার পরিখা বোজানোর কাজ শুরু হল। ২২ জুলাই ১৬৫৭ মীর জুমলা, নাজাবত খান, রাও ছত্রশাল, মির্জা সুলতান এবং দিলের খানের সঙ্গে তার বড় পুত্রকে পাঠালেন আদিলশাহী বাহিনীকে পরাস্ত করতে। তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল তারা শত্রুর প্রতিরোধ এমনভাবে গুঁড়িয়ে দেবে যাতে তারা না উঠে দাঁড়াতে না পারে। ৪৮ মাইল গিয়ে মুঘল বাহিনী শত্রুর পতাকা দেখতে পেয়েই আলোর গতিতে এমনভাবে শত্রুব্যুহে ঢুকে গিয়ে আক্রমন করল যে শত্রুকে পিছিয়ে যেতে হল; তাতেও রক্ষা নেই, তাদের ৪ মাইল ধাওয়া করে খতম করল। ফেরার সময় তারা রাস্তার দুপাশে সমস্ত এলাকা লুঠ করে পুড়িয়ে দিয়ে দিনের শেষে কুলবর্গার কসবায় পৌছে শুধু সাধু সঈদ গিসে দারাজের মাজারটিকে বাদ দিয়ে লুঠের ঝাড়ু হাতে যেন সারা দেশ সম্পদ শূন্য করে দিল।

শেষে পরিখাটি পাথর আর কাদা দিয়ে পূর্ণ করে মীর জুমলার গোলান্দাজ বাহিনী বিপক্ষের সুরক্ষা কবচ ধ্বংস করে দেয় এবং ২৯ জুলাই আক্রমণকারীরা দুর্গের প্রাকারে উঠে বুরুজ দখল করে নেয়। ৩১ জুলাই দুর্গ রক্ষক দিলাওয়ার হাবসি আত্মসমর্পণ করে এবং ১ আগস্ট তিনি তাদের দুর্গের চাবি তুলে দেন।

সম্রাট আওরঙ্গজেব এবং অন্যান্য সেনানায়ককে উপযুক্তভাবে উপঢৌকন দেন। মীর জুমলাকে বিশেশ আংরাখা দিয়ে সম্মান জানিয়ে তার জন্য কর্ণাটক রাজ্যের ৪ কোটি দামের রাজস্বওয়ালা কয়েকটি মহলের অধীশ্বর(মহলইওয়ালিয়ত) বানানো হয়।

চতুর্থ ভাগ

১। উজিরত পদ থেকে মীর জুমলার বহিষ্কার

দাক্ষিণাত্যে, দাক্ষিণাত্যের সুবাদার আর উজির যখন বীজাপুর দখলের মুখে দাঁড়িয়ে, ঠিক তখন দিল্লির কিছু অশান্ত ঘটনা তাঁদের অগ্রগতিতে সরাসরি আঘাত হানল। মুঘল রাজসভার রাজনীতির খুব তাড়াতাড়ি উত্থানপতন নতুন করে তার মত চলতে শুরু করেছে – বীজাপুরীরা দারাকে আবেদন করল – দারার আওরঙ্গজেবের ঈর্ষা জনিত বিরোধিতা বেড়েই চলছিল – তারা সেটাতে নতুন করে ধুনো দিল। কয়েক মাস আগেই যে সম্রাট বীজাপুর আক্রমণের নির্দেশ দিয়েছিলেন, সেই সম্রাটই দারার প্ররোচনায় মীর জুমলাকে বীজাপুরের সঙ্গে শান্তি আলোচনার নির্দেশ দিলেন। আওরঙ্গজেবের কাছে এই নির্দেশ যেন পৃথিবী দ্বিধা হওয়ার সামিল। যিনি যুদ্ধ জেতার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে অথচ তাঁকে শান্তি চাইতে বলা হচ্ছে। ১৬৫৭র চুক্তি অনুযায়ী বীজাপুরের সুলতান বিপুল অর্থের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পারেন্দা, নিজামশাহী কোঙ্কণ এবং ওয়াঙ্গির মহাল ছেড়ে দিতে সম্মত হলেন। ঠিক হল মীর জুমলা এগুলিতে থানা(সেনা ছাউনি) বসাবেন আর কাজি নিজামা ক্ষতিপূরণ উদ্ধার করলে মীর জুমলা ফিরে যাবেন রাজসভায়। মীর জুমলাকে কোঙ্কণের দুর্গগুলির দায়িত্ব দিয়ে আওরঙ্গজেবকে বিদরে ফিরে যেতে বলা হল।

এর থেকেও খারাপ অবস্থা অপেক্ষা করছিল মীর জুমলার জন্য। শাহজাহান ৬ সেপ্টেম্বরে অসুস্থ হয়ে পড়লেন এবং দারাকে তার উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গেলেন। দারা আর তার উজিরের সঙ্গে আর কোন সম্বন্ধ রাখবেননা ঠিক করলেন। নির্দিষ্ট একটি ফর্মান জারি করে মীর জুমলাকে তার উচ্চপদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। অবর্তমানে তার কাজে নিযুক্ত পুত্রের ওপর উজিরের দপ্তরে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল। মহবত খান বা রাও ছত্রসালের মত আধিকারিকদের সভায় ফিরে আসার নির্দেশ গেলেও মীর জুমলাকে পারেন্দা দখলের কাজ শেষ করে আসার নির্দেশ জারি হল।

২। মীর জুমলাকে পারেন্দায় পাঠানো হল

দারা মীর জুমলাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে পারলেও তার ওপর আওরঙ্গজেবের বিশ্বাস যেমন ছিল তেমনি রয়ে গেল। পরস্পর বিরোধী নানান উদ্যমে প্রায় মাথা ঘুরে বিহ্বল হয়ে যাওয়া আওরঙ্গজেব আরও বেশি করে মীর জুমলার পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন, যেভাবে একজন বৃদ্ধ জরাগ্রস্ত মানুষ তার সাথীর ওপর পুরোপুরি নির্ভর করেন। সম্রাটের নির্দেশে পেশকাশ উদ্ধার করে এবং চুক্তিতে উল্লিখিত দুর্গ আর প্রাসাদ কব্জা করে কল্যানী থেকে বিদরে ফেরার আগে ৪ সেপ্টেম্বর ১৬৫৭তে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে ৩০ সেপ্টেম্বর পারেন্দায় পাঠালেন পেশকাশ নেওয়ার জন্য এবং তাঁকে বললেন, তিনি যেন কাজি নাজিমের বীজাপুরে যুদ্ধ-ক্ষতিপূরণ আদায়ের কাজ দেখা শোনা করেন, এবং প্রথম থেকেই সাম্রাজ্যের পক্ষ থেকে তাঁকে যে সব হাতি বা দামি রত্নরাজি উপহার দেওয়া হয়েছে তার মূল্য নিরূপণ করার কাজ করে রাখেন।

পান্দেরায় যাওয়ার আগে দীর্ঘক্ষণ ধরে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে প্রায় প্রত্যেকটি সম্ভাব্য অঘটনের পূর্বাভাষ করে নানান উপযুক্ত পরামর্শ দিয়ে গেলেন। এমন কি মীর জুমলার চলে যাওয়ার পরেও প্রায় রোজই শেখ মীর আবদুল ফাতা(কাবিল খান) বা মহম্মদ শরিফএর মত বিশ্বস্ত কর্মচারী মার্ফত আওরঙ্গজেব তার সঙ্গে চিঠিতে এবং মৌখিকভাবে পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে যান। আওরঙ্গজেবের ধারণা ছিল পান্দেরা খুব তাড়াতাড়ি কব্জা করা যাবে এবং তিনি মীর জুমলাকে জানালেন যে সেটি দখল নিয়েই তার প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে এবং নাসিরি খান দিল্লি চলে গেলে যে শূন্যতা সৃষ্টি হবে, সেই সুযোগে শিবাজির হঠাত আক্রমণ থেকে বীরকে বাঁচাতে হবে। অক্টোবরের শেষ প্রান্তে শিবাজীর বিরুদ্ধে সেনা পাঠানোর বিষয়ে মীর জুমলার মন্তব্য চেয়ে বসলেন। জুনারের নতুন মুঘল ফৌজদার মহম্মদ য়ুসুফ কল্যাণীর ছাড়িয়ে গিয়ে শিবাজীর জোট সঙ্গী হাবাস খানের মাথা কেটে দিলেও ফাঁকা জুনারে শিবাজীর সেনা ঢুকে পড়তে পারে এই আশংকাও ছিল তাঁর।

পারেন্দা দুর্গ দখল করা যতটা সহজ হবে আওরঙ্গজেব ভেবেছিলেন, মীর জুমলার পক্ষে কাজটা ততটাই কঠিন হয়ে দাঁড়াল। আওরঙ্গজেবের কল্যাণী ছেড়ে চলে আসায় সেই শূন্যস্থানটি বীজাপুর দখল করতে উদ্গ্রীব হয়ে পড়ে এবং ভীমা নদী পার হয়ে কল্যাণী এবং বিদর জেলা দখল করার লক্ষ্যে যাত্রা করা দল বিচ্ছিন্ন মুঘল সেনাপতি আফজল খানকে আক্রমণের পরিকল্পনা করার সুযোগ এনে দেয়। নালদুর্গ মৌজায়, বিশেষ করে মুজামগাঁওতে মুঘল রাজস্ব আদায়কারীদের ওপর স্থানীয় দুর্গের কর্তারা ৮ অক্টোবর হামলা করে। এর পরে আনকালকাটের থানেদার আবদুল হামিদ ডেকানি আলুন্দে এলেন। বীজাপুরীদের এই চলাচল মুঘলদের ভয় পাইয়ে দিল। আওরঙ্গজেব থানাগুলি রক্ষার পক্ষে সায় দিলেন, এবং বললেন মীর জুমলা যেন ইব্রাহিম খান এবং ইখলাস খানকে নির্দেশ দেন যাতে রজস্ব আদায় হওয়ার মধ্যের সময়ে কিছু দিনের জন্য বীজাপুরীদের হামলা আটকানো যায়। যদি মীর জুমলা থানাগুলি রক্ষায় ব্যবস্থা না নেন তাহলে আওরঙ্গজেব সেনাবাহিনী তুলে নেবেন ঠিক করলেন। সঙ্কেতে লেখা মীর জুমলাকে উদ্দেশ্য করে চিঠি এবং সুবাদারের দিল্লির দূতের প্রতি শাহজাহানের স্বাস্থ্য এবং ছোট ভাইদের প্রতি সুজার সম্ভাব্য মনোভাব জিজ্ঞাসা করে লেখা গোপন চিঠি বীজাপুরীরা নানদুর্গে আটকাল। তারা বুঝতে পারল যে আওরঙ্গজেব এখন দিল্লির মসনদ বিষয়ে লড়াইকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন, ফলে তাদের এখন কিছু দিনের জন্য মুক্তি।

গোপন চিঠি ধরা পড়ে যাওয়ায় নিয়মিত খবর আদানপ্রদান করা কঠিন হয়ে গেল। এমন কি মীর জুমলার বার্তাবাহকেরা হয় বোকা, না হয় দূরদৃষ্টিহীন না হয় বিশ্বাসঘাতক বেরোতে থাকল। তাদের নিয়মিত শাস্তি দেওয়া হল। হরকরা মীর গাজি এবং আবদুল হাসানের ওপরে একজন পরিদর্শক বসিয়ে দেওয়া হল এবং তাদের নিয়ন্ত্রণ করা হল। গোপন হরকরার পুত্রকে সেনাবাহিনী থেকে ছাঁটাই করা হল। মীর জুমলার চিঠি আর এখন একজন সরকারি আধিকারিক ছাড়া অন্য কারোর মার্ফত পাঠানো হয় না। এর ফলে খবর আদানপ্রদানে দেরি হতে লাগল। এই সব ঘটনাবলীতে মীর জুমলার পক্ষে শান্তিচুক্তির ধারাগুলি প্রয়োগ করা বড্ড ঝামেলাদার হয়ে দাঁড়ায়। তিনি আওরঙ্গজেবকে অনুরোধ করলেন ডাকচৌকি বসাতে। প্রস্তাব আওরঙ্গজেব অনুমোদন দিলেন, কেননা বর্তমানে আশেপাশের অঞ্চল থেকে আরও বেশি খবর জোগাড় করা জরুরি হয়ে দেখা দিচ্ছিল।

৩। আওরঙ্গজেবের পথপ্রদর্শক রূপে মীর জুমলা

শুধু শান্তিচুক্তি অনুসারে পান্দেরা উদ্ধার করার জন্য আওরঙ্গজেব, মীর জুমলার ওপর নির্ভর করলেন না, তার থেকেও বেশি তিনি দিল্লির মসনদের লড়াইয়ের পরিকল্পনা রূপায়নে মীর জুমলাকে বেশি করে আঁকড়ে ধরলেন। তার ওপর সত্যিকারের নির্ভর করে তিনি কোন দিন কোন বিষয়েই মীর জুমলার প্রস্তাবে না বলেন নি, এবং সিংহাসনের লড়াইতেও তিনি মীর জুমলার পরামর্শ মতই লড়াইটা এগিয়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। বাস্তবিকভাবে আওরঙ্গজেবের মনযোগ এখন দিল্লি এবং পান্দেরা, এই দুইভাগে ভাগ হয়ে পড়েছে, কিন্তু দিল্লি থেকে তার সভাদূত ঈশা বেগের সম্রাটের স্বাস্থ্য নিয়ে নিয়মিত পাঠানো খবরের প্রেক্ষিতে তিনি মীর জুমলাকে স্মরণ করলেন। যদি শাহজাহানের শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়, তাহলে তিনি মীর জুমলাকে পান্দেরা ছেড়ে তক্ষুণি তার সঙ্গে যোগ দিতে বলবেন, আর যদি ভাল হয়ে ওঠে, তাহলে তিনি তাঁকে আরও কিছু দিন পাণ্ডেরায় থেকে যেতে বলতে পারেন। যখন আওরঙ্গজেব কোন খবর পান না, তখন চরম মানসিক উত্তেজনায় থাকেন, মনে হয় খারাপটিই ঘটতে চলেছে। এই সব অবস্থা বিশ্লেষণ করে তিনি মীর জুমলাকে কাছে এসে তাঁকে নিয়মিত পরামর্শ দিতে অনুরোধ করলেন।

১৭ সেপ্ট – ২৫ অক্টো এই ২৫ দিন সময়ের মধ্যে দিল্লির কোন খবর না পেয়ে তার ধারণা হল সম্রাটের এন্তেকাল ঘটেছে এবং তিনি সিংহাসনের লড়াইতে কোন দেরি না করে অবিলম্বে ঝাঁপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে মীর জুমলাকে (অক্টোবরের মাঝামাঝি) জানালেন যে কোন উপায়ে কিলাদারকে হাত করে খুব তাড়াতাড়ি পান্দেরা ছেড়ে চলে আসতে। ১৫ অক্টোবর একজন বিশ্বস্ত নিশানইখাসের থেকে পাওয়া সংবাদে আওরঙ্গজেব বুঝলেন যে শাহজাহানের আর কোন নতুন করে একটাও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নেই। তিনি মীর জুমলাকে দুতিন দিনের বেশি আর দেরি না করে চলে আসতে বললেন, কেননা তার পাশে এখন একজনও নেই যে তাঁকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারে - তুমি যেটা ঠিক করবে সেটাই আমি সর্বান্তকরণে মেনে নেব। নতুন ঘটনাবলীতে উত্তেজিত হয়ে থাকা আওরঙ্গজেবের অবস্থায় মীর জুমলাকে আওরঙ্গজেবের সচিব দিল্লির ঘটনাবলীর বিবর্তন সম্বন্ধে বীজাপুরীদের সামনে মুখ না খুলতে অনুরোধ করলেন। তার আশা আওরঙ্গজেব মীর জুমলার উদ্ধারে সেনাবাহিনী পাঠাবেন। সচিব মীর জুমলাকে বললেন, তুমি যদি মনে কর আওরঙ্গজেবের বিচ্ছেদ তোমার ক্ষেত্রে অসহনীয়, তাহলে ভেবে দেখ আওরঙ্গজেব কতটা মনঃপীড়াতে ভুগছেন, কেননা তিনি জানেন তোমার গুরুত্ব কি...। তার সামনে তোমার উপস্থিতি তাঁকে চাঙ্গা করার জন্য যথেষ্ট। এই মুহূর্তে তুমি ছাড়া তাঁর আর কোন শুভচিন্তক নেই।

৮ অক্টোবর শাহজাহানের স্বাস্থ্য আরও খারাপের সংবাদ পেয়ে হতিবুদ্ধি আওরঙ্গজেব মীর জুমলার পরামর্শে ১৮ তারিখে বিদর ত্যাগ করলেন। বীজাপুরীরা সেই খবর ইতোমধ্যে পেয়েগিয়েছে, তাই তার পরেও সেখানে থাকা আত্মহত্যার শামিল বলে মীর জুমলা মনে করলেন। তাঁকে পাথরি যেতে বললেন মীর জুমলা এবং সেখানে তিনি যেন সম্রাট সম্বন্ধে নতুন খবরের আশায় অপেক্ষা করেন। এক্ষুনি তাঁর বুরহানপুরে যাওয়া অসমীচীন হবে, সম্রাটের মৃত্যুর আগেই মুহম্মদ সুলতানকে দিল্লির উদ্দেশ্যে পাঠানো দরকার বলে মত প্রকাশ করলেন আওরঙ্গজেব। দিল্লির ঘটনায় তার আগ্রহ বেশি আন্দাজ করে দুই সুলতান শান্তিচুন্তি রূপায়ন করতে গড়িমসি করার চেষ্টা করবেন। এই তত্ত্বটি বুঝে, তিনি মীর জুমলাকে আহমদনগরে একজন শাহজাদা পাঠাতে বললেন। হতবুদ্ধি আওরঙ্গজেব আবার তাঁকে(১৯ অক্টোবর) পান্দেরা দুর্গ দখল করতে নির্দেশ দিলেন। আওরঙ্গজেব স্বীকার করলেন তার বুদ্ধিশুদ্ধি সব গুলিয়ে যাচ্ছে, ঘটনার ওপর তার নিজের কোন নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। আমার মন এতই ছড়িয়ে যাচ্ছে যে আমি নিজে কোন কিছুই সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারছি না, কোন পরিকল্পনা কষে উঠতে পারছি না। তুমি ছাড়া আমার কোন বিশ্বাসী বন্ধু এবং পরামর্শদাতা নেই। সর্বশক্তিমানের ইচ্ছেয় তোমার শুভচিন্তা আমায় সঠিক পথে থাকতে সাহায্য করে। প্রত্যেক বিষয়ে আমার পদক্ষেপ কি হওয়া দরকার সে বিষয়ে তুমি আমাকে পরামর্শ দেবে, যাতে আমি সঠিক দিশায় এগোতে পারি। ২১ অক্টোবর সম্রাটের কিছুটা স্বাস্থ্য উন্নতির খবর পেয়ে তিনি মীর জুমলাকে জানালেন পান্দেরা উদ্ধার করেই তিনি তার সঙ্গে যোগ দিন।

অক্টোবরে আগ্রার রাজস্ব আধিকারিকের থেকে খবর পেয়ে তার মনে হল, হয় শাহজাহান মারা গিয়েছেন, না হয় ঘটনাবলীর ওপরে তার আর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। দুটি অবস্থাতেই খুব দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই বড় করে ভাবার সময় এসেছে। তিনি মীর জুমলাকে লিখলেন পান্দেরায় আর দেরি না করে অবিলম্বে পরামর্শের জন্য তার কাছে চলে আসতে, কেননা আর দেরি করলে ঘটনাবলীর প্রবাহটি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। আর যদি শাহজাহান সেরে উঠে (পান্দেরার বিষয়ে )তার কাছে কৈফিয়ত দাবি করেন, তাহলে কেন তিনি পান্দেরা উদ্ধার করতে পারলেন না, সে বিষয়ে উপযুক্ত উত্তর দিতে পারবেন।

২২ অক্টোবর দিল্লিতে দারার ক্ষমতায় আরোহণের সংবাদে তিনি ঠিক করলেন মুহম্মদ সুলতানকে বুরহানপুরে সেনাবাহিনী নিয়ে পাঠাবেন যাতে নাসিরি খানের মত সেনানায়কেরা দিল্লির ফর্মান এলেই স্থানীয় জমিদারদের থেকে সেনা জোগাড় করে উত্তরের দিকে যেতে পা পারেন। কিন্তু এটি সেহেতু সরাসরি সম্রাটের নির্দেশ উল্লঙ্ঘন এবং বিরুদ্ধাচরণ, ফলে সেই বিষয়টা তাঁকে বোঝানো যাবে কি না সে বিষয়ে আওরঙ্গজেব যথেষ্ট সন্দিহান ছিলেন। ফলে বুরহানপুরের দিকে মহম্মদ সুলতানকে পাঠানো উচিত হবে কি না এই প্রশ্নে মীর জুমলার মত জানতে চিঠি দিলেন আওরঙ্গজেব। ... এই বিষয়ে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত, আমি তোমার পরামর্শই নিয়ে চলেছি, এবং তার বাইরে কিছুই করি নি, এর পরের অন্যান্য বিষয়েও তোমার পরামর্শ পেতে অধীর হয়ে উঠেছি, এই খবর(দারার ক্ষমতায় আরোহণ)টা পাওয়ার পরে তুমি যদি পরামর্শ দিতে চাও তাহলে আমি খুশিই হব। পান্দেরা হয়ত হাতছাড়া হবে বীজাপুরীদের আক্রমণে। তুমি কি মনে কর মহম্মদ সুলতানকে বুরহানপুরে পাঠানো উচিত হবে? আমি তাঁকে আহমদনগরেও পাঠাতে পারি, সেখান থেকে সে পান্দেরা পৌঁছে যাবে সহজেই। ঠাণ্ডা লোহায় হাতুড়ি মারার মত ফলহীন কাজ হল পান্দেরাকে রক্ষার চেষ্টা করা, শুধু সময়ের অপচয়, সে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ কর, একটা আহদনামা চুক্তি করে আওরঙ্গাবাদে ফিরে এস, যাতে তোমার সঙ্গে আলোচনা করে বিশালকায় পরিকল্পনাটা আমরা সাজিয়ে নিতে পারি। মহম্মদ সুলতান আমার সেনা নিয়ে পাথরিতে যাচ্ছে। ততদিনে তোমার চিঠির আশা করছি। তুমি রাজি থাকলে মহম্মদ সুলতানকে আহমদনগর পাঠিয়ে আমি আওরঙ্গাবাদে যেতে পারি অথবা তাঁকে বুরহানপুরেও পাঠিয়ে আমি সেখানে তোমার জন্য দিন গুণতে পারি। তাড়াতাড়ি উত্তর দাও, তোমার মত পাঠাও। মহম্মদ সুলতানকে বুরহানপুরে পাঠাবার প্রস্তাবে মীর জুমলা রাজি হলেন না, অবশ্য মীর জুমলার চিঠি আসার আগেই আওরঙ্গজেব স্বয়ং এই পরিকল্পনা বাতিল করে দিয়েছিলেন, যেহেতু সাম্রাজ্যের অভিজাতরা ততদিনে নারবাদা পেরিয়ে গিয়েছিলেন।

৪। পারেনদা জয়ে মীর জুমলার বিফলতা

মীর জুমলার পরামর্শে আওরঙ্গজেবের অগাধ বিশ্বাস এবং প্রতি কাজে তার ওপর নির্ভরতা থাকলেও দুজন বন্ধুর লক্ষ্যের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। আশা, উদ্বেগ, পরিকল্পনা এবং নড়বড়ে চিন্তায়পূর্ণ এই মাসগুলিতে আওরঙ্গজেব কিন্তু পারেনদা দখলকর্ম, তার দিল্লির সিংহাসনের দিকে লক্ষ্যচ্যুতি এবং বড় পরিকল্পনাটা রূপায়নে তার আশা ধ্বংস করুক সেটা চান নি। অন্যদিকে মীর জুমলা অন্যান্য ঝামেলা, অসুবিধে ঝেড়ে ফেলে পারেনদা দখলকেই তার পাখির চোখ করে এগিয়েছেন। তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল পারেনদার কিলাদারকে তার পক্ষে নিয়ে আসা। ১৪ নভেম্বরের মীর জুমলার এই প্রস্তাবে আওরঙ্গজেব কিলাদারকে ১৭ নভেম্বর একটি নিশান লিখে পাঠান, যাতে বলা ছিল যে মীর জুমলার হাতে কোন দেরি না করেই যেন তিনি কেল্লার চাবি তুলে দেন। বিদর ছাড়ার আগেই প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষ মীরজুমলাকে আওরঙ্গজেব লিখে পাঠালেন, যে কোন উপায়ে কিলাদারকে জিতে নিন। মীর জুমলার প্রস্তাবে তিনি বীজাপুরের মুঘল হাজিব মহম্মদ আমনকে একটি নিশান পাঠান এবং একই সঙ্গে মীর জুমলাকে বলেন তিনি কি চান, সেটা বীজাপুরী প্রধানমন্ত্রী ইখলাস খানকে লিখুন।

কিন্তু সোনার চাবির নীতি সফল হল না। মীর জুমলা বাধ্য হয়ে বল প্রয়োগ করলেন। মহম্মদ সুলতানকে বুরহানপুরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত কন্ডেম করে তিনি আওরঙ্গজেবকে বললেন পাথরি থেকে সেনা পারেনদায় পাঠাতে এই আশায় যে বড় শক্তি দেখলে বীজাপুরীরা পিছু হঠতে পারে। কিন্তু আওরঙ্গজেব পালটা প্রশ্ন করলেন সেনা কোথায়? কিছু শাহজাদার সঙ্গে যাবে, আর কিছু আমার সঙ্গে?অবশ্যি যারা এখানে রয়েছে তারা আমার সঙ্গে থাকবে কিনা ঠিক হয় নি, সেটা ঠিক হবে নির্দেশ আসার পরে।মহম্মদ সুলতানের নেতৃত্বে খুব কম পরিমান সেনা তোমার দিকে যাওয়ার প্রস্তাব আমার পছন্দ নয়। আর যারা হিন্দুস্তান যেতে চায়, তাদের ইচ্ছেতেও যদি আমি বাধ সাধি, তাহলেও কি এই ক’টিমাত্র সেনা নিয়ে তোমার ইচ্ছে পূর্ণ করা সম্ভব? তেমন বড় বাহিনী না নিয়ে মহম্মদ সুলতানের পক্ষে তোমার কাছে যাওয়া কতটা সঠিক হবে? যা আছে তা নিয়ে তোমার কাছে গিয়ে কি কোন কাজ হবে? দ্বিতীয়ত, আওরঙ্গজেব মনে করতেন দারা ক্ষমতায় আসায় যে রাজনৈতিক পরিবেশ তার বিরুদ্ধে যাচ্ছে, তাতে বীজাপুরে সেনা মোতায়েন করা কাজের কাজ হবে না। আওরঙ্গজেবের বা মীর জুমলার কোন প্রস্তাবেই সম্রাট কান দেবেন না। গুজরাটের সুবাদারের পদচ্যুতি ঘটেছে। মালওয়ায় শায়েস্তা খানের বদলি অবশ্যম্ভাবী। ফলে আওরঙ্গজেবের একটাই দাওয়াই বিন্দুমাত্র দেরি না করে সিংহাসনের লক্ষ্যে পরিকল্পনা তৈরি করা। তার দাবি যে তার ধারণাটিই ঠিক।

মীর জুমলার প্রস্তাবটাকে দারুণ পরিকল্পনারূপে বর্ণনা করলেও তার ভাবনাটা আওরঙ্গজেবের এক্কেবারেই পছন্দ হয় নি। কিন্তু তাঁকে সান্ত্বনা দিতে ৪ নভেম্বর এধার ওধার থেকে কয়েকজন সৈন্য খাড়া করে মহম্মদ সুলতানকে পারেনদার দিকে পাঠান, এবং ছেলেকে মীর জুমলার নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করতে বলে দেন, কেননা, সেটি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য একান্তই প্রয়োজনীয়। তিনি মীর জুমলাকেও তার পুত্রকে পথ দেখাতে অনুরোধ করলেন।

সম্ভবতঃ ঠিক সময়ে তিনি যে পারেনদা দখল করতে পারেন নি, সে বিষয়ে দিল্লি তার প্রতি অসন্তুষ্ট, এমন একটি ধারণা মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে লিখে পাঠিয়েছিলেন, যার উত্তরে আওরঙ্গজেব তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন বীজাপুরীদের এ বিষয়ে কি মনোভাব এবং কিলাদারের সিদ্ধান্ত না নিতে পারার প্রেক্ষিতের বিষয়টা হয়ত সম্রাট জানেন। দিল্লিতে আধিকারিককে ডেকে পাঠানোর কল্পনায় জল ঢেলে আওরঙ্গজেন লিখলেন, নবাব! তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। দিল্লির ফরমানে যখন অভিজাতরা রাজধানীর দিকে রওনা হয়ে গিয়েছে, তার ফল কি ঘটবে তুমি জান। তারা (বীজাপুরীরা) সর্বশক্তিমানের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করছে যাতে এই ধরণের ঘটনা আরও ঘটে; কিন্তু বার বার আমি তোমায় বলছি, এ সব বিষয়ে মন দিও না আমি সেনা পাঠাচ্ছি যাতে তোমার এত দিনের কাজ নষ্ট না হয়ে যায়, আমি সময় নেব না। এবারে আওরঙ্গজেবের আশা জাগল, মীর জুমলা সব কিছু ছেড়ে তার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।

বলপ্রয়োগ করার মীর জুমলার নীতি বিফল হল। মুহম্মদ সুলতানের পৌঁছবার এক সপ্তাহের মধ্যে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে লেখা এক চিঠিতে(৯ নভেম্বর) তার নীতির ব্যর্থতা স্বীকার করলেন। কাজি নিজামা তখনও বীজাপুরীদের থেকে ক্ষতিপূরণ সংগ্রহ করতে পারেন নি, কেননা তারা তাদের সঙ্গে দারাকে পেয়ে গিয়েছে। সান্ত্বনা দিয়ে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে লিখলেন, বিজাপুরী এবং দিল্লির সিংহাসন দুটোরই কি নীতি হতে পারে তা জানাও, কেননা সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর গুপ্ত তথ্য, স্থানীয় বাহিনীগুলির যাতায়াত, রাজস্বের অবস্থা, শত্রুপক্ষকে আক্রমণের তথ্য, সময়, অবস্থা সব কিছুই তোমার নখদর্পণে রয়েছে। ৫। বীজাপুরীদের সঙ্গে সমঝোতা করে মীর জুমলার পারেনদা ত্যাগ কয়েক মাসের উদ্বেগ, সুশ্চিন্তা, বিফল শ্রম সত্ত্বেও আওরঙ্গজেব দিল্লি, গুজরাট এবং বাঙলার সমস্ত ঘটনা এবং তার নিজস্ব প্রস্তুতির খবর মীর জুমলাকে জানিয়ে গিয়েছেন নিয়মিতভাবে যতে তিনি দ্বিধাহীনভাবে তাঁকে এসব বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে যেতে পারেন। সম্ভবত তিনি আওরঙ্গজেবকে মুরাদ, সুজা বিষয়ে তাঁকে তার ভাবনা বলেছেন, যদিও কি বলেছেন তা এখন আর জানা যায় না।

দাক্ষিণাত্য থেকে অভিজাতদের দিল্লিতে ডেকে নেওয়া, সম্রাট যে দিল্লিতে ঘটে চলা সমস্ত ঘটনা বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তই নিতে পারছেন না এবং সে দায় নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে দারা ক্ষমতায় আরোহণ করেছে এই সংবাদ প্রকাশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আওরঙ্গজেব নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে পারেনদায় বলপ্রয়োগ করেও মীর জুমলা সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না। স্বাভাবিকভাবেই আওরঙ্গজেব কিভাবে দিল্লির রাজসিংহাসন দখল করবেন সে পরিকল্পনা ছকতে এবং সেটি বাস্তবায়নের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এই কাজ যে মীর জুমলাকে সঙ্গে না পেলে কঠিন হয়ে যাবে সেটা তিনি জানতেন। কিন্তু মীর জুমলা মাথা উঁচু করেই পারেনদা ছাড়বেন সেটাও আওরঙ্গজেবের কাছে স্পষ্ট ছিল। তিনি এবারে পারেনদা সমস্যা সমাধান করতে মীর জুমলার পাশে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত নিলেন। যদি পারেনদা সহজে জয় না করা যায়, তাহলে তাহলে অন্তত অবস্থা যা রয়েছে তার থেকে খারাপ হতে দেওয়া যাবে না, অথচ বাস্তবটা অনুধাবন করাও খুব জরুরি, পিছিয়ে আসার সময় মীর জুমলার মাথা উঁচু করে পিছোনোও দরকার। তাই মীর জুমলার প্রাথমিক কাজ হল আওরঙ্গজেবের উত্তরের দিকে রওনা হওয়ার সময় যেন দুই সুলতান দাক্ষিণাত্য জুড়ে কোন বিপদ সৃষ্টি না করেন তা নিশ্চয় করা। ১৬৫৭র অক্টোবরের শেষের দিকে আওরঙ্গজেব এই প্রসঙ্গে লিখলেন দাক্ষিণাত্যে বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করতে দুই সুলতানকে পাশে পাওয়া আর শান্ত রাখা জরুরি। আওরঙ্গজেব আদিল শাহকে চিঠি লিখে বীজাপুর অভিযানের সমস্ত দায় চাপিয়ে দিলেন মীর জুমলার ওপরে, তার শয়তানি প্ররোচনায় আমি বীজাপুর আর গোলকুণ্ডা অভিযান করেছি। তিনি ইচ্ছে প্রকাশ করে বললেন, পারেনদা দুর্গ এবং তার আশেপাশের জায়গাগুলি, কোঙ্কণ এবং ওয়াঙ্গির মহাল যেগুলি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়া হয়েছিল, এবং তার সঙ্গে কিছু দুর্গ এবং মহাল যেগুলি মীর জুমলার অংশ হিসেবে খালসাইসরকারের অন্তর্ভূক্ত করে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলি বাদে গোটা কর্ণাটক তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া হল।

আওরঙ্গজেব বীজাপুর সমস্যা সমাধানের একমাত্র অনুঘটক হতে পারেন মীর জুমলা বুঝেই তাঁকে এই সমস্যা সমাধানের জন্য এগোতে বললেন। তিনি মীর জুমলাকে লিখলেন, সার্বিকভাবে, পেশকাশ সংগ্রহের আর দেশ জয়ের ভাবনা ছেড়ে দাও। শুধু দেখ তারা যেন তোমার দেখানো ভালবাসাকে আঘাত করতে না পারে, তাহলেই আমরা এই ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে পারব। তোমার প্রস্তাব এবং প্রতিশ্রুতিতে প্রভাবিত হয়ে হয়ত বীজাপুরীরা খুব একটা ঝামেলা পাকাবে না। তাহলেই নতুন সেনাবাহিনী তৈরি করা যাবে। জোর করতে গেলে হিতে বিপরীত হবে, তার সময়ও এখন নেই। এই রকম চরম অবস্থায় তোমায় বন্ধুত্বের মুখোশ পরা খুব জরুরি। দেখ বেশি সময় না নিয়ে কত দূর এগোন যায়।

আওরঙ্গজেব যে কর্মপদ্ধতি মীর জুমলাকে বাতালেন সেটি আদতে প্রচ্ছন্ন হুমকি আর কূটনৈতিক সান্ত্বনার কুশলী মিশেল। মীর জুমলা শাহজাদা মহম্মদ সুলতানের আর আওরঙ্গজেবের আবির্ভাবের খবর ছাপিয়ে দিলেন, যাতে বীজাপুরীদের ওপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করা যায়। মুঘল-পন্থী শান্তিবাদী বীজাপুরী প্রধানমন্ত্রী ইখলাস খানের মন জেতার জন্য সমস্ত কূটনৈতিক দাঁওপ্যাঁচ প্রয়োগ করেদিলেন। তাঁকে বীজাপুরীদের বোঝাতে বলা হল যে যুদ্ধটা তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেটি ঘটেছিল সম্রাটের ফরমানে। এখন যেহেতু তিনি রাষ্ট্রের ওপর সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছেন, ফলে সেই যুদ্ধের আর কোন প্রয়োজন নেই। ইখলাস খান এবং মীর জুমলা, আওরঙ্গজেবের সঙ্গে অনাগ্রাসন চুক্তি নিয়ে দরকষাকষি করছেন। মীর জুমলা ক্ষতিপূরণ আর এলাকা দখলের দাবি থেকে সরে আসবেন ঠিকই কিন্তু একই সঙ্গে বীজাপুরকেও চুক্তির মান রাখতে হবে এবং বিদর, কল্যাণী এবং তার সঙ্গে জোড়া অন্যান্য এলাকার দাবি ছাড়তে হবে আর মুঘলদের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করা যাবে না। মীরকে এমনভাবে বিষয়টা বোঝাতে হবে যাতে বীজাপুরীদের মনে হয় তারাই এই ঘটনায় সব থেকে বেশি লাভবান হচ্ছে।

কিন্তু এই পরিকল্পনাও সফল হল না, মুঘল বিরোধী, মুল্লা আহমদ নাটিয়ার প্ররোচনায় খুন হয়ে গেলেন ইখলাস খান ১১ নভেম্বর। ফলে নীতির ঘোমটা সরিয়ে এখন মীর জুমলাকে উদ্ভুত পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিকল্পনা ছকতে হল। তার হাতে এখন নাটিয়াকে পাশে টানা ছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। আওরঙ্গজেবকে এই প্রস্তাব দিয়ে চিঠি লিখলেন এবং সঙ্গে তাঁকে লেখা নাটিয়ার একটি চিঠিও জুড়ে দিলেন। সতর্ক ভাষায় আওরঙ্গজেব মীর জুমলার এই পদক্ষেপকে সমর্থন জানাতে বাধ্য হলেন।

৬। পারেন্দা থেকে মীর জুমলার পশ্চাদপরণ বীজাপুরী সম্ভাব্য আক্রমণের খোরাক হয়ে, শাহজাদার সঙ্গে দুর্গের বাইরে পরিখার ধারে ঘাঁটি গেড়ে থাকা সুবুদ্ধির কর্ম নয় বুঝেই আওরঙ্গজেব, সীমান্ত নির্ধারণের কাজ আগামী দিনে কোন এক সময়ের জন্য মুলতুবি করে মীর জুমলাকে পশ্চাদপসরণের নির্দেশ দিলেন। মীর জুমলাকে প্রলুব্ধ করতে আওরঙ্গজেব প্রস্তাব দিলেন কুতুব শাহের কবল থেকে কাম্বাম দখল করতে একট আভিযানের। যদি মনে হয়, মীর জুমলা মহম্মদ সুলতানকে আহমদনগর পাঠিয়ে দিয়ে কয়েকদিন সেখানে তাকে বসিয়েও রাখতে পারেন।

অন্যদিকে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবকে পালটা প্রস্তাব দিলেন(১৮ নভেম্বর) তার সঙ্গে যোগ দিয়ে বীজাপুরীদের শায়েস্তা করতে। আওরঙ্গজেব বললেন, খান মহম্মদের হত্যার কারণ দেখিয়ে এক্ষুনি তাদের শাস্তি দিতেই পারি, সেটা তাদের জন্য বাকিও আছে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তার সেখানে যাওয়া ঠিক হবে না বলেই মত প্রকাশ করলেন। জীবিত থাকা কালীন খান মম্মকদ আমায় বলেছে, যে বীজাপুরীরা বিশ্বাসঘাতক এবং মিথ্যাচারী। মুল্লা আহমদ সারা বছর ধরে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে, কিন্তু সে সফল হয়নি। এটা এই মুহূর্তে সফল হওয়ার নয়। সেনারা সম্রাটের স্বাস্থ্য ভাঙ্গার খবরে এবং অন্যান্য ঘটনায় হতোদ্যম হয়ে পড়েছে। তারা এতই গোলযোগে পড়ে রয়েছে যে সেটা ব্যখ্যার অতীত। তিনি তাই মীর জুমলাকে বললেন বীর থেকে এই নষ্ট ঘটনায় সময় ক্ষয় না করে সেই মুহূর্তেই ফিরে আসুন। তার চিঠির উত্তর পাওয়ার জন্য পান্দেরায় অপেক্ষা করে থেকে থেকে মীর জুমলা বীরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন মহম্মদ সুলতানকে সংগে নিয়ে। ২৬ নভেম্বরের শাহজাদার চিঠিতে এই সংবাদ পেয়ে লিখলেন, কিছু দিন বীরে থেকে যেতে, যদি তিনি অভিযান শুরু করে থাকেন, আর যদি না করেন তাহলে পারেন্দাতেই এক পক্ষকাল শাহজাদাকে নিয়ে অপেক্ষা করতে।

মীর জুমলার চিঠির উত্তরে সাঙ্কেতিক ভাষায় আওরঙ্গজেব লিখলেন, অসম্ভব মানসিক যন্ত্রণায় তিনি কাটাচ্ছেন এবং কেন মীর জুমলার তার সঙ্গে অবিলম্বে যোগ দেওয়া দরকার সেটাও জানালেন, না হলে তিনি হয়ত সিংহাসন দখলের সুযোগটাই হারাবেন(ইতোমধ্যে সম্রাটের মারা যাওয়ার খবর আসে) যদি বীজাপুর সমস্যা তাদের দুজনকে আরও দীর্ঘকাল ব্যস্ত রাখে আর তার ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সেনাবাহিনীকে তিনি একত্র না করতে পারেন।

৬ ডিসেম্বর নাগাদ পারেন্দা থেকে আওরঙ্গজেব মহম্মদ সুলতানকে ডেকে নেন, বুরহানপুরের জমিদারদের দমন করতে এবং নর্বদা পর্যন্ত এলাকাকে বিদ্রোহী মুক্ত করতে। শাহজাদা মহম্মদ মুয়াজ্জমের সঙ্গে সেনাবাহিনীর একটি অংশ দিয়ে পারেন্দায় পাঠালেন এবং মীর জুমলাকে বললেন বীরে তার সঙ্গ দিতে, যাতে বীজাপুরীদের সবক শেখানো যায়। এখানে মধ্য ডিসেম্বরে মীর জুমলা আওরঙ্গজেবের সচিবের সঙ্গে তিনিটি গোপন বৈঠক করেন।

৭। মীর জুমলাকে দরবারে ডেকে পাঠানো হল

৬ নভেম্বরের মহম্মদ আমীন খানের পাঠানো চিঠির সূত্রে মীর জুমলা ইঙ্গিত পেয়ে গিয়েছিলেন, যে দারা তার বিরুদ্ধে দরবারে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন এবং এই বিষয়ে তিনি তার পুত্রকে চিঠি লেখার আগে আওরঙ্গজেবের পরামর্শ চেয়ে পাঠান। ৯ নভেম্বরের চিঠিতে আওরঙ্গজেব লিখলেন, অজ্ঞকে প্রজ্ঞা শেখানো যায় না। তাকে কিভাবে আঘাত করবে তা তোমার নিজস্ব প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করবে। বড় শাহজাদা(দারা)র নির্দেশের প্রেক্ষিতে তোমার দীর্ঘকালের সঞ্চিত প্রজ্ঞার ওপর নির্ভর করে একটি সুদীর্ঘ ভূমিকা লিখে তার সাজানো মিথ্যাকে খণ্ডন কর। তুমি যা মনে করে সেটাই লেখ।

কিন্তু মীর জুমলা দারার চাল নিষ্ফল করতে পারলেন না। ডিসেম্বর ১৬৫৭র শুরুতেই মুরাদ এবং সুজার সঙ্গে আওরঙ্গজেব হাত মিলিয়েছেন এই খবর দারার কাছে ছিল, শাহজাহানের নাম নিয়ে দারা দাক্ষিণাত্য থেকে মীর জুমলা এবং সেনাপতিদের ডেকে পাঠালেন কেননা তাদের বেশি দিন দাক্ষিণাত্যে থাকা আওরঙ্গজেবের সেনা সাজানোয় সাহায্য করবে এবং তার ভবিষ্যতের পক্ষে আশংকার হবে। ১৯ তারিখ এই ফরমানটি হাতে পেলেন আওরঙ্গজেব। এটি আওরঙ্গজেবকে হতাশার সর্বনিম্ন অতলে ছুঁড়ে ফেলে দিল। মীর জুমলার দাক্ষিণাত্য থেকে প্রস্থান তার পক্ষে সব থেকে অমঙ্গলজনক ইঙ্গিত যেমন, তিনি একই সঙ্গে খবর পাচ্ছেন, দারা সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হচ্ছে। তবে তার সব থেকে বড় সাথী মীর জুমলার দাক্ষিণাত্যে থাকাটা খুব জরুরি বলেই মনে করলেন। ২২ তারিখ হতাশ সুবাদার মীর জুমলাকে একটা চিঠি লিখলেন নিজের হাতে, সাম্রাজ্যের মন্ত্রীকে বন্ধু সম্বোধন করে, সর্বশক্তিমান তোমায় সাহায্য করুণ! আমার নিজের অশান্তি নিয়ে কি আর বলব! আমি জানি দিন কিভাবে কেটে যাচ্ছে! আমার হাতে কোন নিদান নেই। ধৈর্য ধর!

৮। মীর জুমলাকে গ্রেগতার করলেন আওরঙ্গজেব

অবশেষে আওরঙ্গজেব নিজেকে ফিরে পেলেন। অভিজ্ঞ, দক্ষ, বুদ্ধিমান, কুশলী, কূটনীতিতে দক্ষ, অভিজ্ঞ সেনানায়ক, এবং সব থেকে বড় কথা বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী মীর জুমলা যদি ক্ষমতায় থাকা শাহজাদার সঙ্গে যোগদেন, সেটা তার পক্ষে হবে সব থেকে বড় দুর্ভাগ্য আর অভিশাপের কারণ। ফলে দাক্ষিণাত্যের সুবাদারকে সক্রিয় হয়ে শাহজাদার শেষতম অভিসন্ধি বিফল করতে মাঠে নামতেই হল। আওরঙ্গজেব জুমলাতউলমুলক মীর জুমলাকে মহম্মদ মুয়াজ্জমকে নিয়ে বীর ছাড়তে নির্দেশ দিলেন ২৭ ডিসেম্বর। কিন্তু বলে দিলেন, তার সঙ্গে দেখা না করে যেন কেউই দিল্লির পথ না ধরেন। তার জীবনের সব থেকে খোশামুদে চিঠি লিখলেন আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে – তাকে বললেন সব থেকে বড় বন্ধু, আত্মনিবেদনকারী শুভচিন্তক, এবং তার প্রজ্ঞার প্রতি তার আসীম সম্মান রয়েছে। আমি জানি তুমি নিজের কথার ওজনকে সব থেকে বেশি গুরুত্ব দাও। তোমার হিন্দুস্তানে যাওয়া যে আমার ক্ষমতা, শক্তি এবং শৌর্য বাড়াবে তাই নয়, তোমার সফলতা আমার সফলতারূপে চিহ্নিত করবে। আমার হৃদয়ের শুভেচ্ছা রইল। তুমি সাক্ষাতে প্রায়ই বলতে তোমার জীবনে তুমি আমায় সিংহাসনে বসা দেখতে চাও, এবং সেই লক্ষ্য পূরণে তোমার জীবন তোমার সম্পদ সব উতসর্গীকৃত। এখন সময় এসেছে তোমার নিজের কথাকে নিজের নিবেদনকে সত্য প্রমান করার। যতক্ষণ তুমি জীবিত রয়েছে, ততক্ষণ আমি আমার জীবনে কাউকে এত গুরুত্ব দিই না। তোমার প্রতি ভালবাসা, পক্ষপাত দেখাতে কেউ আমায় রুখতে পারবে না। আমার কাছে এস। তোমার পরামর্শক্রমে আমি সিংহাসনের পথে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা রচনা করব।

১৬৫৮ সালের ১ জানুয়ারি মীর জুমলা আহমদনগরে পৌঁছলেন। অবিলম্বে তিনি তাকে গ্রেফতার করে দৌলতাবাদ কারাগারে বন্দী করলেন। তার সব সম্পত্তি, ইওরোপিয়দের ব্যবস্থাপনায় রাখা গোলাবারুদ এখন আওরঙ্গজেবের কবলে পড়ল। যে সময় তার প্রচুর সম্পদ দরকার, সেসময় মীর জুমলার সম্পত্তি তার হাতে এসে পড়ায়, তার লক্ষ্য পূরণ সহজ হয়ে গেল।

৯। এই পর্বে মীর জুমলার ভূমিকা

রাজদরবারে ডেকে পাঠানোর পর্বকে সামলানোর পরিকল্পনা মীর জুমলার কূটনীতিকের জীবনে সব থেকে বড় পরীক্ষা হয়ে দাঁড়াল। তার ক্ষেত্রে এটা হয়ে উঠল দায়িত্ব এবং স্বার্থের চিরকালীন দ্বন্দ্ব। আরও তীক্ষ্ণভাবে বলতে গেলে তার বন্ধু দাক্ষিণাত্যের সুবাদার এবং সম্রাটের মধ্যে যে কোন কাউকে বেছে নেওয়ার পালা। সমস্যার যায়গাটা জটিল হল এইভাবে যে, তার বন্ধু এবং যার সঙ্গে তার জোট, তার প্রতিদ্বন্দ্বী(দারা) সম্রাটকে করায়ত্ত্ব করে রেখেছে। এটা পরিষ্কার যে তার আনুগত্য কিন্তু সবসময়ে ছিল তার চাকুরিদাতা সম্রাটের প্রতি, দাক্ষিণাত্যের সুবাদারের প্রতি, এবং তার পরিবারের প্রতি, সেগুলি তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে এবং সে সমস্যা সহজে সমাধানের নয়। অবশ্যই আওরঙ্গজেবের বন্ধু-জোট পক্ষ হিসেবে সে দরবারে যেতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক ছিল না। আইনত ভাবে সে সাম্রাজ্যের আধিকারিক, তাই কোন সম্ভাব্য যুক্তিপূর্ণ কারণ ছাড়া তার পক্ষে দরবারে না যাওয়াও সম্ভব নয়। দরবারে যোগ দেওয়ার নির্দেশ অমান্য করার অর্থ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ ঘোষণা। এবং তার ফলে দারার রোষে পড়বে দিল্লিতে থাকা তার পরিবার। তার সামনে সমস্যা দেখা দিল যে তার সাম্রাজ্য আনুগত্য বজায় রেখে কি করে সে বন্ধুর সম্মান বজায় রাখতে পারবে আর তার পরিবারকেও সুরক্ষা দিতে পারবে।

তার কূটনীতির চতুরতা তাকে এই দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দিল। ১৬৫৮ সালের ১ জানুয়ারি প্রকাশ্যে ঘোষণা করে দিলেন, সম্রাটের নির্দেশনামা অনুসরণ করে তিনি আগ্রায় যাচ্ছেন। আওরঙ্গজেবের আগ্রাসী পরিকল্পনায় ভীত হয়ে তিনি বললেন, আমার পক্ষে সুবাদারের সঙ্গে দেখা করা অসম্ভব, সম্রাট আমায় আদেশ দিয়েছেন, সেটি মান্য করা ছাড়া আমার সামনে অন্য কোন উপায় খোলা নেই। আওরঙ্গজেব মহম্মদ সুলতানকে মীর জুমলার সঙ্গে থাকতে বলে, বললেন, আকাশে ওড়া সম্পদশালী বাজকে আমার কাছে ধরে নিয়ে এস। তিনি শাহজাদা মার্ফত মীর জুমলাকে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ বার্তা পাঠিয়ে বললেন, তার প্রতি কোন রকম অবিশ্বাস না পোষণ করতে, তিনি তাকে আজও তার শুভচিন্তকই ভাবেন। আগ্রা যাওয়ার আগে তিনি যেন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সমাধান করতে তার সঙ্গে দেখা করেন। আওরঙ্গজেব মীর জুমলা মার্ফত সম্রাটকে একটা মৌখিক বার্তা পাঠাতে চান। শাহজাদা তার প্রতি তথাকথিত শান্তিবার্তাটি মীর জুমলার কাছে পৌঁছে দিয়ে তাকে প্ররোচিত করেন সুবাদারের সঙ্গে দেখা করতে। যেই মুহূর্তে মীর জুমলা আলোচনার জন্য আওরঙ্গজেবের খাস কামরায় (খিলাতগা) প্রবেশ করলেন, তাকে গ্রেফতার করা হল।

আলমগীরনামা সূত্রে জানতে পারছি, আওরঙ্গজেব রাজনৈতিক কারণে মীর জুমলাকে গ্রেফতার করেন, কারণ তার বিশ্বাস ছিল, মীর জুমলা যদি দরবারে যোগ দেন তা হলে তার সিংহাসন দখল এবং তৎসংক্রান্ত রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে পড়বে। অন্যদিকে আরংনামা, বলছে তিনি প্রথমে মীর জুমলাকে দারার বিরুদ্ধ-দলে, তার সঙ্গে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। তার ঠিক পরেই মীর জুমলা বলেন আওরঙ্গজেবের পক্ষে প্রকাশ্যে যোগ দিলে দিল্লিতে তার পরিবারের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়ে যাবে। তিনি বলেন প্রয়োজনে প্রকাশ্যে তাকে গ্রেফতার করে তার সমস্ত সম্পত্তি, গোলাবারুদ সেনা বাহিনী যা কিছু রয়েছে সব দখল নিয়ে মুরাদের সহায়তায় দারার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হ’ন। এই চাতুরতায় একমাত্র আওরঙ্গজেবের আগ্রাসন এবং তার পরিবার রক্ষার মত দুকুলই বজায় থাকবে। আওরঙ্গজেব একজন সঈদকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করার সিদ্ধান্তে কিছুটা ইতস্তত করছিলেন, কিন্তু মীর জুমলা বলেন তিনি স্বইচ্ছেতেই গ্রেফতার হচ্ছেন, এখানে আওরঙ্গজেবের কোন পাপ হবে না। তখন তাকে সরকারিভাবে প্রকাশ্যে গ্রেফতার করা হয়। যতদূর সম্ভব এই সমঝোতা সেই দিন হয় নি, বরং অনেক আগে থেকেই এই নাটকের খসড়া তৈরি করা হচ্ছিল। মীর জুমলা আন্দাজ করছিলেন যে তাকে দরবারে ডেকে পাঠানো সময়ের অপেক্ষামাত্র। তার প্রতি দারার প্রতিকূল মনোভাব তাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন দিল্লিস্থ-পুত্র। মীর জুমলার সঙ্গে আওরঙ্গজেবের বিভিন্ন পত্র বিনিময় এবং ডিসেম্বরে বীরএ আওরঙ্গজেবের সচিবের সঙ্গে তার তিনটে বৈঠক এটা প্রমান করে যে দুই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বহু আগে থেকেই দারার পরিকল্পনা বানচাল করতে ভেতরে ভেতরে পরিকল্পনা সাঁটছিলেন। মীর জুমলার উদ্দেশ্যে কাবিল খানের দৌত্য থেকে জানতে পারি যে তাদের গোপন আলোচনাগুলি সচিব মহোদয় এতই গোপনীয়তায় মুড়ে রেখেছিলেন যে পাঠকের বুঝতে কষ্ট হয় না যে দুজনের মধ্যে কিছু না কিছু চরম গোপনীয় আলোচ্য বিষয়ে রয়েছে এবং এই আলোচনা লিপিবদ্ধও করেন নি কেউই, এবং সেই আলোচনার সারৎসার তিনি আওরঙ্গজেবকে মৌখিকভাবে জানান। এটা পরিষ্কার যে মীর জুমলার গ্রেফতারি হয়েছিল তার নিজেরই সুপারিশে, নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির প্ররোচনায়। হয়ত দুজনের মধ্যে গ্রেফতারির সময় বা স্থান নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে, কিন্তু ঘটনাটা নিয়ে নয়। দারার আশংকা ছিল পারস্পরিক স্বার্থবদ্ধ দুজনেই যৌথভাবে(বর সাজিশ ও ইত্তিফাক) কিছু একটা ঘটাবে। তিনি এই ঘটনাটা সম্রাটকে জানিয়ে মহম্মদ আমিন খান বক্সীকে কোন একটা তুচ্ছ কিছু দায়িত্ব সঠিকভাবে না পালন করার ঝুটা মামলায় ফাঁসিয়ে গ্রেফতার করার অনুমতি নিয়ে নিজের বাড়িতে নজরবন্দী করে রাখেন। শাহজাহান তাকে নির্দোষ জেনে তিন চার দিন বাদে তাকে মুক্ত করার আদেশ দেন।

এটা পরিষ্কার যে মীর জুমলার কূটনীতিক চাল এক্ষেত্রে অসাধারণ সফল হয়েছিল। তিনি গোটা ব্যাপারটা এতই চতুরতায় ঘটিয়েছিলেন যে শাহজাহানের মনে হয়েছিল যে মীর জুমলার প্রতি আওরঙ্গজেব অবিচারই করলেন। অপাপবিদ্ধ সঈয়দীর হয়ে শাহজাহান আওরঙ্গজেবকে একটি চিঠি লেখেন – সে সম্রাটের নির্দেশেই দিল্লি যাচ্ছিল। কর্তব্যবোধে তাদের অনৈতিকভাবে গ্রেফতারির এবং তাদের সম্পত্তি দখল নেওয়ার বিরুদ্ধে সম্রাট সোচ্চার হলেন। তিনি আওরঙ্গজেবকে নির্দেশ দিলেন অবিলম্বে তাদের মুক্তি দেওয়ার।

১০। মীর জুমলার মুক্তি

সাম্রাজ্যের প্রতিবাদপত্র হাতে পাওয়ার আগেই আওরঙ্গজেব সম্রাটকে জানিয়ে দেন যে তার ধারণ হচ্ছিল মীর জুমলা ভেতরে ভেতরে দক্ষিণী সেনানায়কদের সঙ্গে মিলে সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ঘোঁট পাকাচ্ছেন, সেই জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, না হলে তিনি বাগী দক্ষিণী সেনানায়কদের দলে যোগ দিতেন। আওরঙ্গজেব যে যুক্তি দেখিয়েছেন, সেই ধারণাটি আদতে সে সময়ের দাক্ষিণাত্যের জনগণের মুখে মুখে ঘুরত। ২৬ জানুয়ারি ১৬৫৮ একজন ব্রিটিশ কুঠিয়াল মন্তব্য করেছিলেন যে নবাব, গোলকুণ্ডার রাজার সঙ্গে ষড় করে দিল্লির সিংহাসন দখল করার চেষ্টা করছিলেন। সেই জন্য তাকে গ্রেফতার করা হল।

দারার হারের পর যখন সাম্রাজ্য আর ধর্ম সংস্থাপন ঘটল, সরকারি ঐতিহাসিক লিখছেন, তখন আর মীর জুমলাকে গ্রেফতার করে রাখা জরুরি ছিল না। বরং সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে তাকে কাজে লাগানো খুব জরুরি কাজ। আওরঙ্গজেব তাকে ছদ্ম-কারাগার থেকে মুক্তি দিলেন। এই সুযোগে মুন্সী কাবিল খানকে একটি লিখিত কৈফিয়ত প্রকাশ করার দায়িত্ব দেওয়া হল। আওরঙ্গজেব লিখছেন, কোন এক কারণে আমি তোমায় গ্রেফতার করেছিলাম, ...ত্রুটি স্বীকারের সময় এসেছে, তবে তোমার মত বন্ধু, শুভচিন্তকের আমার দরবারে থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য একটি চিঠিতে আওরঙ্গজেব লিখলেন বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তোমায় গ্রেফতার করা হয় নি... তোমার চেহারায় শ্রান্তি ফুটে উঠছিল...অথচ তুমি দরবারে যেতে বদ্ধ পরিকর ছিলে। সেই ভুল সময় দিল্লি যাওয়া তোমার পক্ষে ক্ষতিকর হত। আমি তা হতে দিই নি। আমি তোমায় বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু তুমি বুঝতে চাওনি। ফলে আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে, তোমায় বাধ্য হয়েই গ্রেফতার করতে হয়েছিল। সর্বশক্তিমানের ইচ্ছেয় আমার চাওয়া পূর্ণ হয়েছে, নতুন রাজধানী এবং ধর্মের বাগানে নতুন জীবন যাপন কর। আমার শত্রুরা পরাস্ত হয়েছে। তোমাকে এর বেশি সময় বন্দীরাখা অমানবিক হবে। আমি চাইনা তোমার মত বুদ্ধিমান মানুষ বেকার জীবনযাপন করুক। এই ক্ষমা প্রার্থনা আদতে দুটি মানুষের চক্রান্তের ওপর রঙ্গিন পর্দা ফেলার তাগিদ ছাড়া আর কিছু নয়। মহম্মদ মুয়াজ্জমকে একটি নির্দেশ দিয়ে দৌলতাবাদের কারাগার থেকে মীর জুমলাকে মুক্ত করার নির্দেশ দিলেন আওরঙ্গজেব এবং বুরহানপুরে যা পড়ে রয়েছে সেগুলি তাকে ফিরিয়ে দেওয়ারও নির্দেশ দিলেন তিনি, সঙ্গে প্রশাসনিক কাজ চালানোর জন্য একলাখ টাকা নগদ। বর্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মহম্মদ মুয়াজ্জমকে নির্দেশ দেওয়া হল দৌলতাবাদের মহাকোট দুর্গের প্রাকারের নিচে যে প্রাসাদ রয়েছে সেখানে তার থাকার ব্যবস্থা করতে।

মীর জুমলাকে ২৯ মে, ১৬৫৮ তারিখে তার পুত্রের আসার খবর দেওয়া হল। আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে বললেন, তার প্রতি যে অনুগ্রহ দেখানো হয়েছে তার জন্য কৃতজ্ঞ থাকতে। আগামী দিনে আরও বড় উপহারের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলে তিনি তার সরঞ্জাম সামলানোর জন্য আরও নগদ পঞ্চাশহাজার টাকা দিয়ে মহাকোট থেকে দরবারে আসার নির্দেশ দিলেন। এই কাজ সামলানোর দায়িত্ব দেওয়া হল শাহজাদাকে এবং মীর জুমলাকে দ্রুত আওরঙ্গজেবের সঙ্গে দেখা করতে বলা হল।

ডাক পড়লেও ব্যক্তিগতভাবে মীর জুমলা কর্ণাটকে গিয়ে কুতুব শাহের হাত থেকে তার মহালগুলি উদ্ধারের কথা ভাবছিলেন। তার পুত্রের থেকে মীর জুমলার ইচ্ছের কথা জানতে পেরে আওরঙ্গজেব বললেন, যদি মীর জুমলা বেশ কিছুদিন সেখানে না থাকেন তাহলে সে কাজ তার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তিনি স্বয়ং কুতুবশাহকে সেখান থেকে তার সেনা তুলে নিতে নির্দেশ দিলেন। ১৬৫৮এ অক্টোবরের শেষের দিকে মীর জুমলাকে বুরহানপুরের ৬০০০ জাট ৬০০০ সওয়ারওয়ালা সুবাদার নিযুক্ত করা হল। আওরঙ্গাবাদে বদলি হয়ে যাওয়া ওয়াজির খানের যায়গায় তাকে খণ্ডেশের মহাল জায়গির হিসেবে অর্পণ করা হল। মীর জুমলাকে বলা হল কর্ণাটক, বুরহানপুর এবং অন্যান্য যায়গার সঙ্গে তার হিসাব কিতাব বুঝে নিতে, বিভিন্ন যায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা তার জাহাজ এবং অন্যান্য কিছু সামলাতে, বুরহানপুর এবং কর্ণাটকের মধ্যে ডাকচৌকি নতুন করে স্থাপন করতে, স্থানীয় জমিদার এবং আধিকারিকদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা শুরু করতে, সেনাবাহিনী গড়া এবং সেটি জোরদার করতে আর সব কিছু বিষয়ে তার নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে।

পঞ্চম অধ্যায় সিংহাসন দখলের লড়াই[সম্পাদনা]

প্রথম পর্ব

খ্বোয়াজার লড়াই ১। কোরায় মীর জুমলার আওরঙ্গজেব দর্শন খণ্ডেশ এবং কর্ণাটকের বিষয়গুলি তখন মীর জুমলা সমাধান করার চেষ্টা করছেন। অন্যদকে আওরঙ্গজেব দারার বিরুদ্ধে পূর্ণদ্যমে লড়াই করার পরিকল্পনা রচনা করে দিয়েছেন। ১৬৫৮র সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে আওরঙ্গজেবের যে সব সেনাপতি দারার বিরুদ্ধাচরণ করছিল, তাদের পাঞ্জাব থেকে দিল্লিতে ডেকে নিয়ে আসা হয় সুজার আগ্রগমণ রোধ করার জন্য। মীর জুমলাকে সম্রাট শীঘ্র দিল্লিতে ডেকে পাঠান। তিনি খণ্ডেশের প্রশাসন কিছু বিশ্বস্ত প্রশাসকের হাতে দিয়ে আসেন। সম্রাটের ইচ্ছে বাঙলার নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কাজে মীর জুমলা তাঁকে পরামর্শ দিন, পথ দেখান, এবং জেতার পথ তৈরি করুণ। নভেম্বরের শেষে সুজার পথ রোধ করার জন্য আগ্রা থেকে আওরঙ্গজেব এলাহাবাদের দিকে মহম্মদ সুলতানের নেতৃত্বে একটি বিশাল বাহিনী পাঠান। শাহজাদাকে নির্দেশ দিলেন খুব তাড়াতাড়ি যুদ্ধে না গিয়ে উজির এবং তাঁর আগমণের জন্য অপেক্ষা করতে। পাদশাহ ২১ ডিসেম্বর কামান ইত্যাদি সাঁজোয়া অস্ত্র না নিয়ে ঝাড়া হাতপায়ে বড় বাহিনী নিয়ে শাহজাহার এবং কোরা-গৌতমপুরের সাম্রাজ্যের সৈন্যের খ্বোয়াজার থেকে আট মাইল দূরে ২ জানুয়ারি ১৬৫৯তে যোগ দেন। সুজা সেখানে ৩০ ডিসেম্বর পৌঁছে একটি বড় সমতল এলাকায় হাতে কাটা হ্রদের ধারে তাঁবু ফেলেন তার ইওরোপিয়দের নেতৃত্বের বিপুল দক্ষ গোলান্দাজ বাহিনী নিয়ে। সেখানে খবর পেলেন শাহজাদা তার পথ রোধ করেছেন। মীর জুমলাও খণ্ডেশ থেকে রওনা হন ছোট বাহিনী নিয়ে, পৌঁছন যুদ্ধের দু দিন আগে ৩ জানুয়ারি।

২। খ্বোয়াজায় মীর জুমলা মীর জুমলার আগমণে সাম্রাজ্যের সেনার প্রস্তুতিতে চনমনে ভাব এল। ৩ জানুয়ারি আওরঙ্গজেব সম্ভবত মীর জুমলার পরামর্শে তার তৈরি করে দেওয়া প্রত্যেক বাহিনীর অবস্থান এবং যুদ্ধ সাজের রণনীতি সজ্জা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পরের দিন। পরের দিন সকালবেলা থেকেই ছোটখাট গুলিবারুদ আদানপ্রদান হতে হতেই সুজার গোলান্দাজ বাহিনী তার প্রাথমিক শিবিরের অবস্থান ত্যাগ করে একটু উঁচু যায়গায় উঠে যায়। সেনায়কের মত যুদ্ধের পরিবর্তিত পরিস্থিতি বোঝার মত সহজাত দক্ষতায় সুজার বাহিনীর ছেড়ে যাওয়া স্থানটি দখল করে নেন মীর জুমলা। সেখানে খুব পরিশ্রম করে ৪০টি কামান তুলে নিয়ে শত্রুর সেনার দিকে তাক করে পরের দিনের সকালের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। আওরঙ্গজেব প্রত্যেক সেনানায়ককে তাদের বাহিনী যুদ্ধের জন্য চূড়ান্তভাবে তৈরি রাখার নির্দেশ দিলেন। সন্ধ্যে থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত মীর জুমলা স্বয়ং তাদের সেনা বাহিনীর প্রস্তুতি ঘুরে ঘুরে খুঁটিয়ে দেখেন এবং রক্ষীদের সজাগ থাকার নির্দেশ দিলেন।

৪ তারিখ রাতের যুদ্ধে আওরঙ্গজেবের সেনাবাহিনীর পক্ষে থাকা যশোবন্ত সিং বিশ্বাসঘাতকতা করে সুজার হয়ে আওরঙ্গজেবের বাহিনীর ওপর গোলা ছুঁড়তে শুরু করেন। মানুচি বলছেন, এই বিপদগ্রস্ত সময়ে মীর জুমলা নিজে রণনীতি তৈরি করে নতুন করে সেনা সাজান এবং আওরঙ্গজেবকে পরামর্শ দেন সুজার পরামর্শেদাতা আলবর্দী খানকে ব্যক্তিগত ইঙ্গিতভরা চিঠি লিখে তাকে যুদ্ধের মাঝেই নিজের হাতির হাওদা থেকে নেমে আসার পরামর্শ দিতে, এবং তার জন্য তাঁকে যথেষ্টভাবে পুরষ্কৃত করা হবে। তবে সেই সময়কার কোন পার্সি সূত্র এই তথ্যকে সমর্থন করে না। তবে ভীমসেন বলছেন, যশবন্তএর শিবিরে মীর জুমলা তার পরিকল্পনা নিয়ে স্বয়ং পৌঁছে যেতে সক্ষম হন, এবং একটি ছোট্ট বৈঠকে তাকে রাজি করান এবং ফিরে এসে তাদের কথা আওরঙ্গজেবকে জানান। যাই হক যশোবন্তের বিশ্বাসঘাতকতার ব্যপকতাকে কিছুটা হলেও সামাল দিতে সমর্থ হন মীর জুমলা।

আগের দিনের সেনা সাজানোর পরিকল্পনা একই রেখেশুধু ডান দিকের যশোবন্তের বাহিনীকে নেতৃত্ব দিতে ডাকা হয় ইসলাম খানকে এবং বাহিনীর সামনে নিয়ন্ত্রণহীন খোলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে মোতায়েন করা হয় সঈফ খানকে। তবে আওরঙ্গজেব মীর জুমলাকে ক্ষমতা দিলেন যুদ্ধের অভিমুখ লক্ষ করে সেনাবাহিনীতে যা খুশি পরিবর্তন আনার।

খ্বোয়াজার যুদ্ধ দুপক্ষের মোটামুটি কামান, হাউই, গাদাবন্দুক এবং হাতে ধরা গ্রেনেড সজ্জিত সাঁজোয়া বাহিনীর লড়াই ছিল। দুপক্ষই দুপক্ষকে সমান তালে আক্রমণ করতে থাকে। যুদ্ধের দিনগুলিতে মীর জুমলা নিজেকে সম্রাটের হাতির পিছনের হাতিতে বসে তাঁকে যুদ্ধ চলাকালীন নানা রকম পরামর্শ দিচ্ছিলেন। সুজার বাঁ দিক থেকে তিনটি উন্মত্ত হাতি নিয়ে সাম্রাজ্যের ডানদিকের সৈন্য স্তম্ভে সৈয়দ আলম আক্রমণ করলে দাক্ষিণাত্যের বহু পোড়খাওয়া সেনা নায়কের সেনা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। শত্রু, কেন্দ্রে বসে থাকা সম্রাটকে আক্রমন করে। তাকে পাহারা দিচ্ছিলেন মাত্র ২০০০ সেনা। এটিই ছিল যুদ্ধের নির্ণায়ক সময়। সম্রাটের পালিয়ে যাওয়ার অর্থই হতবুদ্ধি হয়ে পড়া গোটা বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন। বরাবরের মত যুদ্ধে শান্ত, অকুতোভয়, পাহাড়ের মত স্থির হয়ে সম্রাট দাঁড়িয়ে থাকলেন। হাতির পাগুলি দৃঢভাবে জমিতে শৃঙ্খল দিয়ে আটকানোর নির্দেশ দিলেন যাতে সেটি ভড়কে গিয়ে পালিয়ে যেতে না পারে। এইভাবেই তিনি যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। তার পরে সম্রাট ছত্রভঙ্গ হওয়া ডান দিকের সেনাবাহিনীকে দেখলেন এবং নতুন করে সাজানোর নির্দেশ দিলেন অবিকৃত মুখে, যাতে তারা তার আশ্বাসে নতুন করে বল পায়। এরপরেই সম্রাটের ডান, বাম এবং মধ্য – এই তিন দিকের বাহিনী সুজা বাহিনীর কেন্দ্রে গিয়ে আঘাত করে। সুজা তার হাতি থেকে নেমে পড়ে ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র ত্যাগ করে পালিয়ে যায়।

সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিকেরা এই যুদ্ধ জয়ের জন্য সর্বশক্তিমানের হাত দেখেছেন কেননা বহু সময়েই সুজার আক্রমণে আওরঙ্গজেবের বাহিনীর নানান ফাঁকফোকর খুলে হাট হয়ে পড়ছিল। আওরঙ্গজেবের শক্তি ছিল সেনাবাহিনীর প্রাচুর্য। অন্তত দ্বিগুণের বেশি সেনা ছিল আওরঙ্গজেবের বাহিনীতে। এছাড়াও সুজার সেনাপতিদের বিশ্বাসঘাতকতাও একটা বড় ভূমিকা পালন করেছে। কাম্বু বলছেন, মুরাদ কাম সাফাভি(মুকররম খান) এবং আব্দুল রহমান সুলতান(বলখের প্রাক্তন রাজা নজর মহম্মদ খানের পুত্র) পক্ষ পরিবর্তন করে সুজার সেনার দিকে আক্রমণ শানানোটাই সুজার ক্ষেত্রে অবাক হওয়ার মত ঘটনা এবং তার পরেই সুজার সমস্ত প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ে। তবে কোন সরকারি বা অন্যান্য ঐতিহাসিক কেউই মীর জুমলার অবদানের কথা উল্লেখ করেন নি, হয়ত তাদের মনে হয়েছিল তাতে সম্রাটের সম্মান হানি হবে। তবে কিছু পারসিক ইতিহাস এবং মানুচির লেখাতেই মীর জুমলার অবদানের কথা লিখত রয়েছে বিশদে। বিশেষ করে ব্রিটিশ কুঠিয়ালদের সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে সেই যুদ্ধে মীর জুমলা যুদ্ধের গতিবেগ সুজার থেকে আওরঙ্গজেবের দিকে নিয়ে আসতে তার ব্যক্তিগত দক্ষতার স্বাক্ষর পেশ করেছিলেন। মীর জিমলা যেহেতু আওরঙ্গজেবের দক্ষিণ হস্ত ছিলেন ফলে তার নিয়মিত মন্ত্রণাতেই আওরঙ্গজেব নিজের রণনীতি পাল্টেছিলেন, তার কুশলী বাক্য সম্রাটকে জোর দিয়েছিলেন বলা যায়। তবে মীর জুমলার বড় দক্ষতা ছিল সাঁজোয়া বাহিনীর গোলাগুলি ব্যবহারের কুশলতা তৈরি করানোয়। সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিকেরা লিখছেন বাঁশের মধ্যে বারুদ ভরে বিশেষ ধরণের হাউই তৈরি করেছিলেন তিনি। সেটি গ্রনেডের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর ছিল। বালেশ্বরের কুঠিয়াল সুজার হারের নিদান খুঁজেছেন, যে যুদ্ধে সুজা রণনীতির ভুলের জন্য ১২০০০ পদাতিক হারান। কুঠিয়ালের বলা নিদান কাম্বুর দেওয়া সূত্রের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে, সেটি হল হাত হাউই (হুক্কাদারণ) যা বাতাসের মত করে উড়ে গিয়ে পড়ত বিপক্ষের বাহিনীতে আর ছত্রভঙ্গ করে দিত।

দ্বিতীয় খণ্ড বিহারের যুদ্ধ

১। সুজাকে ধাওয়া করলেন মীর জুমলা ৫ জানুয়ারি যুদ্ধে হেরে রণক্লান্ত, বিধ্বস্ত, হতাশ, বিষণ্ণ সুজা বিহারের পানে পালিয়ে গেলেন, যেন তার রেকাবে পা নেই, হৃদয়ে আর শক্তি অবশিষ্ট নেই। সুজাকে নিঃশ্বাস ফেলার সময় না দিয়েই, মীর মহম্মদকে তার পিছনে লাগিয়ে দিলেন আউরঙ্গজেব। নিজে খাজওয়ায় আরও এক সপ্তাহ থেকে গেলেন। মীর জুমলাও সম্রাটের সঙ্গে রইলেন। ১১ জানুয়ারি সম্রাট তাকে ৭ হাজারি মনসবদার রূপে(হফত হাজারি হফত হাজার সওয়ার)সম্মানিত করলেন এবং সঙ্গে আরও কিছু তার পছন্দের উপহারও দিলেন সাম্রাজ্য সেবার জন্য। খ্বয়াজা ফেরার পথে পরের দিন মীর জুমলা সম্রাটের সঙ্গে গঙ্গার দিকে ঘুরতে গেলেন। ১৪ জানুয়ারি দিল্লির পথে রওনা হওয়ার আগে, সম্রাট তাকে তার পলাতক ভাইয়ের খোঁজে এবং স্থানীয়দের হাত থেকে বিহার-বাঙলা উদ্ধারের দায়িত্ব দিলেন। সবথেকে বড় কথা, তার পুত্রের আতালিক(দিগদর্শক) হওয়ার অনুরোধ করলেন। তাত্ত্বিকভাবে মুঘল সেনাবাহিনীর রীতি অনুযায়ী মীর জুমলা এবং শাহজাদাকে মিলিয়ে একটা যৌথ কামান তৈরি হল, কিন্তু বাস্তবিকভাবে মীর জুমলাকেই গোটা সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণের এবং বহাল আর বরখাস্ত করার চূড়ান্ত ক্ষমতা দেওয়া হল। মীর জুমলা নতমস্তকে এই গুরু দায়িত্ব নিজের মাথায় তুলে নিয়ে বললেন তিনি শত্রুর হাত থেকে সিংহাসন এবং রাজমুকুট বাঁচিয়ে তাকে সমুদ্রের জলে ফেলে দেবেন।

১৪ জানুয়ারির কিছু সময় পরে শাহজাদা মহম্মদ সুলতানের বাহিনীকে জোরদার করতে চললেন্ম মীর জুমলা এবং তার যোগ দেওয়ার পরে সেই বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়াল ৩০ হাজার। আলমগীরনামা সূত্রে মীর জুমলার সঙ্গে থাকা ২৭ জন সেনানায়কের নাম পাচ্ছি ১। জুলফিকার খান(তাবরেজি), ২। ইসলাম খান(বাদাকশি), ৩। কুঁয়র রাম সিং, ৪। দাউদ খান(কুরেশি), ৫। ফিদায়ি খান(বাখরাজি), ৬। রাজা ইন্দ্রদুম্ন ধামধেরা, ৭। রাও ভাও সিং হাদা(রাও ছত্রশালের পুত্র), ৮। ইশ্তিশাম খান, ৯। ফতে জং খান(রুহেলা), ১০। রাও অমর সিং চন্দ্রাওয়াত, ১১। ইখলাস খান খোয়েসগি, ১২। খাওয়াস খান, ১৩। এক্ককাতজ খান(আসল নাম আবদুল্লা), ১৪। রশিদ খান (আনসারি), ১৫। লোদি খান, ১৬। সৈয়দ ফিরোজ খান বারহা, ১৭। সৈয়দ শের খান বারহা, ১৮। সৈয়দ মুজাফফির খান বারহা(খানইজাহান), ১৯। জবরদস্ত খান(রুহেলা) ২০। আলি কুলি খান, ২১। কিজিল্বাস খান, ২২। ইস্কন্দর রুহেলা, ২৩। কাকার খান, ২৪। দিলোয়ার খান, ২৫। নেকনাম খান, ২৬। নিয়াজি খান, ২৭। কাদিরদাদ আনসারি এবং অন্যান্য। তিনি মীর জুমলাকে নির্দেশ দিলেন দুর্ধর্ষ রোজবিহানী সেনা – রাসুল, মহম্মদ এবং চিরাগকে সঙ্গে নিতে। তাদের প্রত্যেকেই চরম অভিজ্ঞ, দৌড়বীর, এবং আত্মনিবেদনের মূর্ত প্রতীক। বাদশাহ বললেন আহমদ এবং মহম্মদ মুরাদও খুব সাহসী এবং দাঙ্গাকারী, তাদেও সঙ্গে নিতে।

২। খাজওয়া-পাটনা পলাতক শাহজাদা খাজওয়া থেকে ৩০ মাইল গেলেন চার দিনে। এলাহাবাদে গঙ্গা পেরিয়ে ঝুসিতে শিবির ফেললেন। সাম্রাজ্যের সৈন্য বাহিনী এগিয়ে আসছে খবর পেয়ে একদা এলাহাবাদের দারার সেনানায়ক, পরে সুজার দিল্লি অভিযানের সঙ্গী তাহাওয়ার খান উপাধি ওয়ালা বারহার সৈয়দ, সৈয়দ কাশিম, আওরঙ্গজেবের সেনানায়ক বাহাদুর খানের হাতে নিজের খানইদৌরাণ দুর্গ সঁপে দিলেন ১২ জানুয়ারি। বেনারসের পাঁচ মাইল পূর্বের গঙ্গার তীর বাহাদুরপুরে পৌঁছে বেনারসের তার পূর্ব-শিবিরের জন্য কাটা পরিখা এবং সুরক্ষা দেওয়াল সারালেন, ঢালু যায়গায়(র্যা ম্পার্ট) চুনার থেকে আনা ৭টি কামান বসালেন এবং অন্যান্য দুর্গ থেকে আরও কামান আনার পরিকল্পনা করলেন। তাঁর অনুসরণকারীদের এখানেই জবাব দেওয়ার জন্য মনস্থির করলেন, আর যদি বিপদ ঘণ হয়ে আসে তাহলে গঙ্গায় নোঙ্গর করা ছিপ নৌকোর বহর নিয়ে পালানোর ব্যবস্থা করে রাখলেন।

অন্যদিকে রাস্তায় কোন দেরি না করেই মীর জুমলা এলাহাবাদের মহম্মদ সুলতানের সঙ্গে যোগ দিলেন। শাহজাদার কানে বেনারসে উঁচু স্থানে রাখা ৭টি কামানের সুজার প্রস্তুতির খবর পৌঁছল, কিন্তু এটাও জানাগেল বাহাদুরপুরে তার কাকা ভরা গঙ্গা নদী পার হতে পারেন নি নৌকোর অভাবের জন্য। মীর জুমলা শাহজাদাকে পরামর্শ দিলেন চুনারের দিকে এগোনোর। গঙ্গার ওপরের প্রবাহের দিকে এগিয়ে মীর জুমলার পরামর্শে শাহজাদা এলাহাবাদের হেঁটে হেঁটেই নদী পার হয়ে ৪ দিনের মাথায় খেরি এবং কুন্তিত হয়ে চুনার পৌঁছলেন। সাম্রাজ্যের নির্দেশে অযোধ্যার সুবাদার ফিদায়ি খান গোরখপুর থেকে গঙ্গার উত্তর পাড় ধরে পাটনার দিকে এগোতে শুরু করলেন। শাঁড়াশি আক্রমণের সম্ভাব্যতার আশংকায় সুজা হতাশ হয়ে বাহাদুরপুর থেকে পাটনার পানে রওনা হলেন; শহরে না ঢুকে শহরের বাইর তিনি জাফর খানএর বাগানে উপস্থিত হলেন ১০ ফেব্রুয়ারি ১৬৫৯। শাহজাদা বেনারসের খনন করা পরিখা ঘুরে দেখলেন, দুদিন বিশ্রাম নিয়ে মীর জুমলার পরামর্শে এবং পথ দর্শনে পাটনার দিকে চললেন।

৩। পাটিনা-মুঙ্গের পুত্রের বিয়ে উপলক্ষ্যে সুজা পাটনার পূর্ব দিকের অঞ্চলে বহুদিন নষ্ট করলেও শীঘ্র পাটনার ২০ মাইল পশ্চিমে পৌঁছলেন মীর জুমলার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যের বাহিনী। সামনে বিশাল চওড়া উপত্যাকার নিরাপত্তাহীনতা, সুরক্ষার অভাবে চিন্তিত এবং আশংকিত হয়ে সুজা আরও পূর্বের দিকে সরে গিয়ে মুঙ্গেরে পৌঁছলেন ১৯ ফেব্রুয়ারি এবং তাকে ধাওয়া করা অগ্রগামী সাম্রাজ্যের সেনাবাহিনীর জন্য প্রবল প্রতিরোধ করার জন্য তৈরি হলেন(১৮ ফেব্রুয়ারি-৬ মার্চ)। শহরের নিরাপত্তা খুঁটিয়ে দেখে সেটির সুরক্ষা আরও জোরদার করলেন গঙ্গার তীর আর দক্ষিণের পাহাড়ের নিচের দুর্গের মাঝখানের পুরোনো নড়বড়ে দেওয়াল সারালেন, এবং শহর জুড়ে যে সব উঁচু এলাকা রয়েছে সেখানে আক্রমণাত্মক হাতিয়ার যেমন, কামানের সারি, হাতি-উটের সুভেল(?), হাউইওয়ালা, বন্দুকচি সাজিয়ে বসালেন। বিভিন্ন রণনৈতিক কোণে বিদেশি সেনানায়ক গোলান্দাজদের বসিয়ে পাহাড়ের তলার গুরুত্বপূর্ণ এলাকা(দামিনিকোহ)টি খড়গপুরের রাজা, রাজা বাহারোজের হাতে তুলে দিলেন।

সুজা পাটনা ছেড়ে যাওয়ার ৮ দিনের মাথায় ২২ ফেব্রুয়ারি পাটনায় পৌঁছে অপেক্ষারত ফিদায়ি খানের সেনার সঙ্গে যোগ দিলেন। আটদিন অবস্থান করে চলে যাওয়ার আগে, মীর জুমলা বিহারের সুবাদাররূপে নির্বাচন করলেন দাউদ খানকে। মুঙ্গেরের দিকে রওনা হয়ে যাওয়ার সময় খবর পেলেন জেকপুরায় বিরোধীপক্ষ জোরদার নিরাপত্তার চাদরে শহরটাকে মুড়ে ফেলেছে। মার্চের শুরুর দিকে মুঙ্গেরের পথে প্রচুর বাধা পেয়ে কি ধরণের রণনীতি অবলম্বন করা যায়, সে বিষয়ে শাহজাদা পরামর্শের জন্য মীর জুমলার দ্বারস্থ হলেন। সুজার ছিদ্রহীন নিরাপত্তায় আঘাত না করে মীর জুমলা ঠিক করলেন তার পিছনের সরবরাহের যে শিকলি সুজা তৈরি করেছেন সেটিকে যথা সম্ভব কেটে দেওয়ার। সোনাদানার উপঢৌকন আর হুমকি এবং ‘সঠিক’ পরামর্শে মোড়া চিঠি দিয়ে তিনি রাজা বাহারোজকে হাত করে খড়গপুর পাহাড়জুড়ে রাজমহলের কঠিন পথ চড়াইউতরাই ভরা ঘুরপথে পাহাড়ি হিংস্র জন্তু, পথ রোধ করা দ্রুম, পাহাড়ি সমাজভরা এলাকা, সে সময় যেটির নাম ছিল ‘বাড় জঙ্গল’, নিশানা লাগিয়ে সহজ করে নিলেন। মীর জুমলা শুধু শুধু মুখোমুখি লড়াই এবং অযথা শক্তি ক্ষয় না করে শুধুই পরিকল্পিত রণনীতির মাধ্যমে তার শত্রুর থেকে বহ পথ এগিয়ে গেলেন। জুলফিকার খানকে দিয়ে কাঠুরে লাগিয়ে তিনি পথের বাধা গাছগুলি কাটলেন। দ্রুমভরা পাহাড় পেরিয়ে শাহজাদাকে সঙ্গে নিয়ে এবারে মীর জুমলা মুঙ্গেরের সমতলে পৌছলেন।


৪। মুঙ্গের-গিরিডি বিশ্বস্ত জমিদারের বিশ্বাঘাতকতা এবং সম্রাটের সেনাপতিদের তাদের বাহিনীকে হতবুদ্ধি করে দেওয়া রণনীতির প্রভাবে ৬ মার্চ সুজা পালালেন আবার। আলমগিরনামায় জায়গাটির নাম বলছে, তেলিয়াগিড়ি পেরিয়ে রাঙ্গামাটি। এখানে তিনি ১৫ দিন শিবির ফেলে(১০-২৪ মার্চ) নাওয়ারা(যুদ্ধ নৌকো সম্ভবত) নিয়ে নদী পাহারায় বসালেন এবং গড়ি বা তেলিয়াগড়িতের সুরাক্ষা সাজালেন নতুন করে। তিনি বীরভূম আর ছটনগরের জমিদার খ্বোয়াজা কমল আফগানকে গঙ্গা থেকে বীরভূম পর্যন্ত অঞ্চল রক্ষার দায়িতে দিলেন, যাতে পাহাড় থেকে নেমে আসা মীর জুমলার যে কোন ঝটতি আক্রমন প্রতিরোধ করতে পারেন। মুঙ্গের থেকে ৪০ মাইল পূর্ব পিয়ালাপুরে অবস্থান করার সময়ে শুনলেন যে সুজা আরও পূর্বের দিকে পালিয়ে যাচ্ছেন। মহম্মদ সুলতানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী এই নতুন দখল করা অঞ্চলে রেখে, প্রশাসনিক এবং বাকি সেনা না আসা পর্যন্ত দুর্গের সুরক্ষারভার অস্থায়ীভাবে মহম্মদ হুসেইন সালদুজের ওপর দিয়ে নিজে বাহিনী নিয়ে ছুটলেন সুজার পিছনে। পিয়ালপুরে শুনলেন সুজা গড়িতে তাঁবু ফেলেছেন, সেই মুহূর্তে তিনি সম্রাটের মহম্মদ সুলতানের বিপুল বাহিনী নিয়ে গেলেন রাজমহলে যাতে তিনি সুজার পালিয়ে যাওয়ার রাস্তায় বাধা তৈরি করতে পারেন। গঙ্গা থেকে দক্ষিণের পাহাড় পর্যন্ত সুজার সুরক্ষার ঢাল সাজানো ছিল বিপুল সাঁজোয়া বাহিনী দিয়ে আর গঙ্গার রাস্তা পাহারা দিচ্ছিল নাওয়ারার বিপুল বাহিনী। সেই সিময়ে বাঙলার প্রবেশপথ বলে পরিচির তেলিয়াগড়ি এবং সকরিগলিও এই সুক্ষার মধ্যে জুড়ে নেন সুজা।

সুজার জোরদার সুরক্ষার বহরের খবরে মহম্মদ সুলতান মীর জুমলাকে প্রশ্ন করলেন, তিনি কি সরাসরি গড়িতে সরাসরি গিরিসঙ্কট দিয়ে আক্রমণ করবেন। শোনা যায় মীর জুমলা তাকে কিছুটাই ব্যঙ্গভরে বলেছিলেন, ‘তোমার ক্ষেত্রে এটি অসম্ভব নয় কেননা তুমি প্রখ্যাত তৈমুরের বংশধর, এই কাজে তোলার উপযুক্ত কেউ নেই, কিন্তু, এই ধরণের (গিরি)যুদ্ধে প্রচুর মানবসম্পদ ক্ষয় হয়, ফলে এই যুদ্ধ করা উচিত নয়। যে কাজ কূটনৈতিক এবং কৌশলী কাজে সম্পন্ন করা যায়, সে কাজে কেন লোকক্ষয় করব? ফলে আমার সামনের মূল কাজ, যুদ্ধ না করে প্রজ্ঞা এবং নীতিকৌশলে(তবদির)কাজ উদ্ধার।’

৫। গড়ির কাছে মীর জুমলার রণকৌশল পরিবর্তন মুঙ্গেরে দেখেছি, বর্তমানে এখনও দেখছি, কৌশল আর কূটনীতিকে তাঁর শক্তি বানিয়ে ফেলে কাজ উদ্ধার করে চলছিলেন মীর জুমলা। আবারও তিনি সুজার বিরুদ্ধে রণনীতি হিসেবে পথ ধরলেন সোনা প্রভাব নীতির।বীরভূমের জমিদারকে তিনি স্বপক্ষে নিয়ে এলেন যেভাবে তিনি খড়গপুরের সাম্রাজ্যের পক্ষে রাজাকে নিয়ে এসেছিলেন এবং সেই ভাবেই আগামী দিনের পথের সুরক্ষা অর্জন করলেন। মুঙ্গেরের দক্ষিণ-পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলে যেটি মানুষখেকো হিংস্র শ্বাপদে পরিপূর্ণ, ফলাবনত গাছ এবং নির্ঝঞ্ঝাট খাদ্য এবং পানীয় জল সরবরাহের জন্য চাষের জমিগুলির ক্ষতি না করে তিনি এগিয়ে চলার পরিকল্পনা করলেন। এই দুটি বিষয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি রাজা বাহারোজের পণ্য সরবরাহের দক্ষতার সূত্রটি সঙ্গে নিয়ে ঝাড়খণ্ডের পথে পা বাড়ালেন মীর জুমলা।

তাঁর এগিয়ে চলার রণনীতি হল – স্বয়ং মীর জুমলা এবং জুলফিকারের নেতৃত্বে বিপুল হাতির দল আর বিশাল দ্রুত চলতে পারা ঘোড়া বাহিনীর সাহায্যে কাঠুরে এবং বড় কুঠার হাতে করা পথ দেখানো বেলদারেরা গাছ কেটে পথ তৈরি করে, পথটি বোঝাতে পথের দুপাশে পতাকা পুঁতে দিচ্ছে। সেনাবাহিনীটি নতুন পথে শুধুই দিনের বেলা চলল এবং রাতে বিশ্রাম নিল। ঝাড়খণ্ড হয়ে যে পথ বাংলায় ঢুকেছে সেটির পথ খুব সরু এবং ন্যাড়া পাহাড়ি গিরিসংকটে পরিপূর্ণ এবং ঘাস থেকে গাছ, জীবনের বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। পথটি খুব বেহুদা, কিন্তু যতটা পারা যায় তাড়াতাড়ি মীর জুমলার নেতৃত্ব এবং শৃঙ্খলার জোরে বাহিনীটি দুর্দান্ত গতিতে এগিয়ে চলল – বাহিনীর ডানদিকে ছিল রথ নিয়ে ২০০০ বাহিনীর জুলফিকার, বাঁদিকে ইসলাম খান এবং ফিদায়ি খান ৫০০০ করে সেনা নিয়ে, সামনে ১৫টি ঘোড়ার সুরক্ষায় শাহজাদাকে রেখে মীর জুমলা সহ কুঁয়র রাম সিং, ইখলাস খান খোয়েসগি, রাও ভাও সিং হাদা, সৈয়দ মুজফফর খান। সঙ্গে বাঁদিকের অতিরিক্ত সুরক্ষা হিসেবে ২০০০ বাহিনীর দাউদ খান এবং ডনদিকের ২০০০ বাহিনীর রশিদ খান। গভীর জঙ্গলটি ১২ দিনে অতিক্রম করে দলটি খ্বোয়াজার জমিদারি, উখলা(উখড়া) এবং সিউড়ি পেরিয়ে বীরভূমের সমতলে পৌঁছল ২৮ মার্চ।

৬। মীর জুমলাকে রাজপুতেরা ছেড়ে গেল প্রকৃতির প্রতিবন্ধকতা মীর জুমলা নিজস্ব উদ্যোগে পেরিয়ে আসতে পারেন, কিন্তু মানুষের অবিশ্বাস, স্বার্থবোধ এবং ভিরুতার কোন দাওয়াই তাঁর কাছে ছিল না। অভিযানের শেষের দিকে রাজপুত কুঁয়র রাম সিং(মীর্জা রাজার পুত্র), রাও ভাও সিং(রাজা ছত্রশাল হাদার পুত্র), অমর সিং, চতুর্ভূজ চৌহানের মত সেনা নায়কেরা মীর জুমলাকে ছেড়ে ঝাড়খণ্ডএর পথ বেয়ে আবার আগ্রার পথে রওনা হয়ে গেল। কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনাক্রমের জন্য মীর জুমলার সেনাবাহিনীর তুলনামূলক শক্তি অনেকটা কমে গেল, সেই বর্ণনা একেক জন ঐতিহাসিক একেক রকমভাবে দিয়েছেন। সুজার ঐতিহাসিক মাসুমের বক্তব্য, রাজপুতেরা যে ধরণের আর পরিমান সম্পদের দাবি করেছিলেন মীর জুমলার কাছে, তিনি তা পূরণ করতে পারেন নি। শোনা যায় মীর উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আপনারা সাম্রাজ্যের জায়গিরদার এবং বিপুল পরিমান বেতন পান। (এখন অভিযানের সময়) বেশি সম্পদ খরচ করা যাবে না। কোথা থেকে আপনাদের এত চাহিদা পূরণ করব? যখন দেশটি দখল হবে দারোগা নির্বাচন হবে, একমাত্র তখনই আপনাদের চাহিদা পূরণ করা যাবে।’ মীর জুমলার সঙ্গে থাকা রোজবিহানী দল এটিকে আওরঙ্গজেবের হিন্দু নিপীড়নের ফলশ্রুতি হিসেবে জুড়ে দিয়েছিল। রাম সিং বা ভায়োঁ সিংএর মত রাজপুত শুনেছিলেন আওরঙ্গজেব মন্দির ভেঙ্গে মসজিদ বানাচ্ছেন এবং হিন্দুদেরও ধরে ধরে কতল করবার পরিকল্পনা করেছেন, এবং তারা নিজেদের জীবনটাও নাকি মীর জুমলার অধীনে খুব একটা সুরক্ষিত বোধ করছিলেন না। ফলে তারা সম্রাটের সেনানীকে যৌথভাবে ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু এই ব্যখ্যা কতটা যৌক্তিক তা ভেবে দেখার। মনে রাখা দরকার সব রাজপুত কিন্তু মীর জুমলাকে ছেড়ে যান নি, রাজা ইন্দ্রদুম্ন কিন্তু থেকে যান। দুই পলাতকের সঙ্গে যোগ দেন দুই মুসলমান সেনানী শের বেগ এবং সৈয়দ সুজাত খান। রাজপুতদের চরিত্র বিরোধী এই কাজের মধ্যে রয়েছে শুধু মাত্র আর্থিক নয়, আরও গভীর কোন কারণ। আওরঙ্গজেব এই কাণ্ডটির তদন্তে নামায় আলিকুলি খান এটির সঠিক কারণ খুঁজে বার করেন, এবং সেটি সরকারি ইতিহাস, আলমগীরনামাতেও রয়েছে। আজমেঢে(দেওরাই ১৪-১৪ মার্চ) দারার জেতার মিথ্যা সংবাদ এবং আওরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্যে চলে যাওয়ার খবর আসে পিয়ালপুরে। (এই দুটি খবর জুড়ে দিয়ে একে সম্রাটের পরাজয় ভেবে) সেনাবাহিনীর একটি অংশ হতোদ্যম হয়ে পড়ে। বিশেষ করে রাজপুতেদের মনে হল যে দারা তাদের প্রতি প্রতিহিংসার কাজ করতে পারে রাজপুতানায়। এছাড়াও সুজাকে তাড়া করতে গিয়ে যেভাবে মীর জুমলা ঘুরপথ ধরেছেন, তাতেও তাদের মীর জুমলার উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সন্দেহ জাগে। তাদের মনে হয় দারার জয়ে মীর জুমলা পথ খুঁজছেন আওরঙ্গজেবের পথ ধরে শাহজাদা সুলতান মহম্মদকে সঙ্গে নিয়ে গোপন দাক্ষিণাত্যে পালিয়েও যাওয়ার।

পলাতকেদের বোঝানোর বা শাস্তি দেওয়ার পথে না গিয়ে মীর জুমলার বাহিনী তখনও প্রায় ২৫০০০ পদাতিক সমৃদ্ধ, দারার প্রায় দ্বিগুণ, আরও দুরন্ত গতিতে আঘাত করার পরিকল্পনাকে এগিয়ে চলল।


৭। মীর জুমলার রাজমহল দখল বীরভূমের জমিদারের বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে সাম্রাজ্যের বাহিনীর অগ্রগতির সংবাদ পেয়ে সুজা রাঙ্গামাটি ছেড়ে রাজমহলের দিকে চললেন। এখানে তিনি কিছুদিন আগেই শিবির ফেলেছিলেন। মীর জুমলার নেতৃত্বে বাহিনী সুজার ঢাকা পালিয়ে যাওয়ার পথ রোধ করতে উখরা থেকে উত্তর-পূর্বের দিকে মুর্শিদাবাদের গঙ্গা ধরে সুজার বর্তমানের অবস্থানের ৩০ মাইল কাছে বেলঘাটায় পৌঁছনোয় সুজার দোদুল্যচিত্ত সন্দিহান সঙ্গীরা একে একে তাঁকে ছেড়ে যেতে শুরু করে। সুজার প্রতি বিশ্বস্ত থাকার দুটি অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সুজার বন্ধুরা দেখলেন, বিপুল পরিমান সাম্রাজ্যের বাহিনীর হাতে কচুকাটা হওয়া এবং অথবা অসভ্য আরাকানের দিকে পালিয়ে যাওয়া।

গঙ্গার পর পাড়ে মীর জুমলার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যের বাহিনী শিবির গড়ার খবরে সুজা তাঁর দিকের(পশ্চিম) তীরটিকেও নিরাপদ মনে করলেন না। আলিবর্দি খানের এবং তাঁর নিজের বাহিনী মিলিয়ে যেহেতু ৫-৬ হাজার থেকে খুব বেশি হলে ২০ হাজারের বেশি হবে না, ফলে বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্তে যে বাহিনীতে বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে তা তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। সেনাপতিদের দলের প্রধান মির্জা জান বেগ, যার পদবী খান জামানএর পরামর্শক্রমে সুজা তাঁর শিবির তুলে নিয়ে এলেন তাণ্ডায়, গৌড়ের চার মাইল পশ্চিমে(যেখানে তাঁর নিরাপত্তার জন্য একদিকে রয়েছে গঙ্গা আর অন্যদিকে প্রচুর নালার সমাহার) সাম্রাজ্যবাদী সেনাবাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে এবং নতুন করের নৌবাহিনী তৈরি করে নিজের কমতে থাকা ক্ষমতাকে নতুন করে গড়ে তোলা। আদতে সুজা এই যুদ্ধটা নতুন করে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে চাইলেন নৈবাহিনী এবং গোলান্দাজদের সম্বল করে। ১৬৫৯ সালের ৪ এপ্রিল সুজা রাজমহল ছেড়ে ১৩ মাইল দক্ষিণে দেওগাছিতে গঙ্গা পার হলেন, এবং তাণ্ডায় আসতে তাঁর পরিবার নিয়ে ফিরোজপুরে এলেন। গঙ্গাজুড়ে নৌবাহিনী এবং পরিখা তৈরি করতে আলাপালোচনা শুরু করলেন। সুজার রাজমহল ত্যাগের সঙ্গবাদ পৌঁছল বেলঘাটায় মীর জুমলার শিবিরে। তাঁর ছেড়ে যাওয়া এলাকা দখল করতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে উত্তরের দিকে অভিযান করলেন। ১৩ এপ্রিল তিনি একটি রথে জুলফিকার খান, এবং শাহজাদাকে নিয়ে রাজমহল প্রবেশ করে সেখানকার প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করলেন ৫০০০ বাহিনী নিয়ে জুলফিকার খানকে। তাঁর সঙ্গে সাহায্যকারী হিসেবে দিলেন সৈয়দ ফিরোজ খান, জবরদস্ত খান, রাজা ইন্দ্রদুম্ন এবং দেবী সিংহ। সুজার সেনাবাহিনীর ৪০০০ সেনা তাঁর সঙ্গে গঙ্গা পেরোতে পারে নি, তাঁরা রাজমহলে ফিরে এলে নতুন প্রশাসনে তাদের নিয়ে নেওয়া হয়। আলমগীরনামায় বলা হয়েছে, ছেড়ে যাওয়া এই শহরে তখনও সুজার আধিকারিক এবং তার বাহিনীর নানান ধরণের জিনিসে পরিপূর্ণ ছিল। এবং সুজার বাহিনীকে প্রতিশ্রুতি দিতে হয় যে তারা এই শহর লুঠের চেষ্টা করবে না। সম্রাটের নির্দেশে এতবর খানের তত্ত্বাবধানে তিন বছর ধরে এই শহরের নিরাপত্তাবিধান করা হয়। রাজমহল থেকে হুগলী পর্যন্ত গঙ্গার ডানদিকের তীরের সমগ্র এলাকাটা মীর জুমলা দখল করে নিলেন। ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা তাকে বাঙলার নবাব বলেই মেনে নিল।

তৃতীয় পর্ব গঙ্গায় যুদ্ধ ১। নতুন যুদ্ধ পরিবেশে মীর জুমলার সমস্যা গঙ্গার পশ্চিম পাড়ে সুজা চলে যাওয়ায় যুদ্ধ এক নতুন স্তরে উন্নীত হল। এত দিন ধরে যুদ্ধ স্থলে হচ্ছিল, ফলে তাঁর পদাতিক বাহিনীর পরিমান বাহুল্যে তিনি সুজাকে টেক্কা দিচ্ছিলেন, নিজের নেওয়া অভিনব পরিকল্পনায় সুজাকে বার বার মাত করে দিচ্ছিলেন। ফলে সুজা একদিনও সাম্রাজ্যের বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি হতে সাহস পান নি। কিন্তু মাঝখানে গঙ্গা দুটি বাহিনীকে দুভাগে ভাগ করে দেওয়ায় এখন তাঁর শত্রুদলের থেকে কিছুটা হলেও সুজা রণনীতিতে এগিয়ে রইলেন। প্রথমত বাঙলা নদীমাতৃক দেশ। এখানে বিপুল সংখ্যক নৌবাহিনী রয়েছে। সুজা প্রচুর সাধারণ এবং ডিঙ্গি যুদ্ধ ডিঙ্গি (ফ্লোটিলা) যেমন দখল করলেন তেমনি যাতে অন্যগুলি শত্রুপক্ষের কবলে না পড়ে, তাঁর জন্য তিনি তারও বেশি ডিঙ্গি জলযান ডুবিয়ে পুড়িয়ে দিলেন। উল্টোদিকে মীর জুমলার বাহিনীতে শুধু রয়েছে স্থলে যুদ্ধ করার মত পদাতিক বাহিনী, ব্রিটিশদের ভাষায় ‘উড়ন্ত বাহিনী’। তিনি সঙ্গে নৌসেনা যেমন আনেন নি, তেমনি সুজা যেহেতু তাঁর আগে থেকেই বহু নৌকো দখল এবং ডুবিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে পোড়ামাটির নীতি নিয়ে, সেহেতু তাঁর পক্ষে নতুন করে নৌবাহিনী তৈরি করা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। তাঁর সমস্ত উদ্যম মার খেল যেহেতু তাঁর সঙ্গে কোন নৌ বাহিনী নেই। এছাড়াও তার সঙ্গে বলা মত কোন গোলান্দাজ বাহিনীও ছিল না – তিনি খ্বোয়াজা থেকে মাত্র ৮টা কামান এনেছিলেন সঙ্গে(তাড়াতাড়ি সুজাকে ধরবেন এই রণনীতিতে)। উল্টোদিকে সুজার বাহিনীতে জোরদার ইওরোপিয় গোলান্দাজ বাহিনী ছিল; বিশেষ করে পর্তুগিজদের এবং হুগলী, তমলুক এবং নোয়াখালির দোআঁশলা(মেস্টিকো) গোলান্দাজদের নেতৃত্বে। বিপুল বেতন এবং সুখদ ভবিষ্যতে স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁর বাহিনীতে হাজারো এই ধরণের গোলান্দাজে ভর্তি করান। এই গোলান্দাজেদের অধিকাংশ ডাচেদের হাতে জাফনাপাটন এবং শ্রীলঙ্কা থেকে উতখাত হয়ে ফেরা বাহিনী। তাণ্ডাতে তাঁবু ফেলে বিপুল যুদ্ধ ডিঙ্গি এবং গোলান্দাজ বাহিনী সম্বল করে সুজা সাম্রাজ্যের বাহিনীর ওপর পারের তীরে রাজমহল থেকে বাকারপুর, ফিরোজপুর থেকে সুতি পর্যন্ত এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেললেন। সুজার হাতে থাকা কামান আর যুদ্ধ নৌকো দুয়ে মিলে বিপুক্ষের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠল, যেহেতু গোলান্দাজ বাহিনীকে আর এক জায়গায় বসিয়ে রাখার প্রয়োজন হল না, গোলান্দাজেরা জলে এখন ভেসে বেড়িয়ে যুদ্ধ করতে পারে। খুব কম স্থল বাহিনী নিয়ে তিনি মীর জুমলার মুখোমুখি হতে না পারলেও নৌযুদ্ধে তিনিই সেরা প্রমানিত হলেন। এবং বাঙলার ভৌগোলিক অবস্থা তাকে বিপক্ষের ওপর খবরদারির সুযোগ করে দিল। সুজার রণনীতিতে মীর জুমলার বিশাল বিপুলাকায় বাহিনীর অগ্রগতি থমকে গেল, তাঁর দুঃস্বপ্নের দিন বেড়েই চলল গুণোত্তর প্রগতিতে। বালেশ্বরের কুঠিয়ালেরা মীর জুমলার রণনীতি জানতে পারেন নি, তাদের নিদান ছিল (৩০ এপ্রিল ১৬৫৯) এই বছরে যদি মীর জুমলাকে যুদ্ধ জিততে হয়, তাহলে সেটি করতে হবে বর্ষার আগেই। কিন্তু এই লক্ষ্যটি পূরণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াল মীর জুমলার নৌ এবং গোলান্দাজ বাহিনী অপ্রতুলতার জন্য। নৌসেনা অপ্রতুলতার জন্য তিনি পশ্চিম পাড় থেকে পূর্ব পাড়ে যেতে বিপুলাকায় গঙ্গাই পেরোতে পারলেন না। এমন কি মীর জুমলার হাত থেকে সুজার বাহিনী রাজমহল ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হল। ফলে শত্রু ধাওয়া করার সিদ্ধান্তে বাধ্য হয়ে ছেদ টানলেন।

মীর জুমলার রাজমহল দখল করার ১৩ এপ্রিল ১৬৫৯ থেকে ১২ এপ্রিল ১৬৬০ সুজা ঢাকায় প্রবেশ করার এই এক বছর আদতে মীর জুমলার বিফলতা এবং সুজার চমৎকার রণনীতির কাছে মীর জুমলার হারের সময়, যদিও শেষ পর্যন্ত মীর জুমলার রক্ষণ ভাঙতে সক্ষম হল সেনানী শ্রেষ্ঠ মীর জুমলা। এই নাটকটি তিন অঙ্কে সমাপ্ত হয়, মাঝে মধ্যে ভাগ্যলক্ষ্মী, ঢেঁকির মত কখনো এক পক্ষ কখনো অন্য পক্ষে ঢলে পড়তে থাকেন। প্রথম অঙ্কে সুজা গঙ্গায় আত্মরক্ষামূলক রণনীতি অনুসরণ করতে থাকেন এবং এটি শেষ হয় ১৬৫৯ সালের ৮ জুন শাহজাদা মহম্মদ সুলতান দল বদল করে সুজার দলে চলে যাওয়ার পর। দ্বিতীয় অঙ্ক অনুষ্ঠিত হয় পশ্চিম পাড়ে সুজা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে রাজমহল দখল করে নেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি দখলে রাখতে পারেন নি। তৃতীয় অঙ্কে মীর জুমলা আক্রমনাত্মক হয়ে ওঠেন এবং যুদ্ধের ঢেঁকির এবারে হেলে যায় পশ্চিম পাড়ের দিকে, তিন দিকে আক্রান্ত হয়ে উঠে সুজাকে পূর্ব পাড় চিরতরে ছেড়ে যেতে হয়।


২। মীর জুমলার দোগাছিতে প্রথম প্রত্যাঘাত নতুন যুদ্ধ নাট্যশালায় দুর্বিপাক উপস্থিত দেখে নিশ্চুপ না থেকে মীর জুমলা তাঁর বিরুদ্ধ পরিবেশটি পাল্টানোর চেষ্টা করতে লাগলেন আন্তরিকভাবে। রাজমহল(১৩ এপ্রিল) পুনর্দখল করার পরে তাঁর প্রথম কাজ হল যুদ্ধ নৌকো জোগাড় করার চেষ্টা করা, কেননা জলযান ছাড়া এই পরিস্থিতিতে এক পাও এগোন যাবে না। প্রায় একপক্ষকাল ধরে দূর দূর এলাকায় খোঁজ করে বেশ কিছু জলযান জোগাড় হল।

নৌকো ছাড়া কিছুই করা যাবে না বুঝে, রাজমহলে সময় নষ্ট না করে তিনি আরর ১৩ মাইল দক্ষিণে দোগাছির দিকে এগোলেন শাহজাদাকে নিয়ে ১৪ এপ্রিল। সেখানে তিনি শিবির ফেললেন। সেখানে নদীর মধ্যের চরে শত্রুর বিপক্ষ পাড়ে একটা উঁচু ভূমি ছিল। উল্টো দিকে বাকারপুরে সুজার সেনাপতি সৈয়দ কুলি গোলান্দাজ বাহিনী নিয়ে শিবির করে ছিলেন আর সুজা স্বয়ং নদীতে যুদ্ধ ডিঙ্গি করে টহল দিচ্ছিলেন। তাঁর মনে হল এই এলাকার রণনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম, কিন্তু তাঁর সঙ্গে যেহেতু তখনও কোন ডিঙ্গি নেই, সেহেতু সুজার বাহিনী এক রাতে সেটি দখল করে নিয়ে সেখানে গোলান্দাজ বাহিনী বসিয়ে দিয়ে বিপক্ষের ওপরে গোলাফেলার পরিকল্পনা করতে থাকে।

হাতে কয়েকতা ডিঙ্গি এলে মীর জুমলা সেগুলি নির্ভর করে সেই চরটি দখল করতে সুজার বাহিনীর ওপর আক্রমণ করা, সম্ভব হলে নদী পেরিয়ে সরাসরি সুজার বাহিনীর ওপরে হামলা চালাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। রাত-জুড়ে ছোট ছোট বাহিনীতে ভাগ হয়ে মীর জুমলার দক্ষ ব্যবস্থাপনায় এবং ব্যক্তিগত নির্দেশে নৌকো করে ২০০০ পদাতিক, কিছু সেনানী - জুলফিকার, ফতে জং, রশিদ খান আনসারি, লোদি খান, সুজন সিং বুন্দেলা, তাজ নিয়াজি সহ অন্যান্য অনুগামী ২০০ বেলদার এবং কড়েকটি কামান নিয়ে চরে ঘাঁটি গাড়লেন। পরের দিন সকাল হতে না হতেই সুজার বাহিনী বিপক্ষকে দেখতে পেয়ে জোর আক্রমন চালালেও তাদের ছেড়ে যাওয়া চরে মীর জুমলার বাহিনী ঘাঁটি গাড়তে সক্ষম হয়।

পরের দিক সুজার বাহিনীর সেনানী ফিদায়ি খান তাঁর সমগ্র নৌ বহর নিয়ে মীর জুমলার গোটা বাহিনীর ওপর জোরদার আক্রমন শানান। দুপক্ষের গোলাগুলিতে নদী দুপাশ ধোঁয়ায় ধোঁয়ায় ভরে যায়। ধোঁয়ার আড়ালে তিনি চরের এক দিকে উঠে এলে তাকে আক্রমন শানান তাজ নিয়াজী এবং তাঁর আফগান যোদ্ধারা। কিছু সময়য় ধরে সমানে সমানে তালে তাল ঠোকা চলল দুপক্ষের। তীরে বসে এই হাতাহাতি লড়াই দেখতে দেখতে মীর জুমলা লড়াইয়ের ফল, সর্বশক্তিমানের ইচ্ছের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত সুজার বাহিনী পিছু হঠতে বাধ্য হয় এবং তাদের কয়েকটি ডিঙ্গি ডুবেও যায়। তাঁর পরেও আরও একটি বিশাল যুদ্ধের পর, যেখানে কামানে কামানের গর্জনে জলের মাছগুলিও অস্থির হয়ে উঠছিল, রণকৌশলগত দিক থেকে চরটি মীর জুমলার বাহিনী সুরক্ষিতভাবে দখল করতে সক্ষম হয়।

৩। সুতিতে মীর জুমলার নৌঅভিযান বাস্তবে মীর জুমলার প্রথম আঘাতটি যদিও ডাকাবুকোর মত হয়ত হঠাত হঠকারীর মত মনে হতে পারে কিন্তু গভীরে দেখলে যথেষ্ট পরিকল্পনা মাফিক। তিনি নৌকো জোগাড় করেন প্রায় বিদ্যুতগতিতে। সুজার বিরুদ্ধে তিনি প্রথম লড়াইতে জিতলেন কেননা সুজার নিজের নৌবাহিনীর গরিষ্ঠতা এবং দক্ষতার ওপর আত্মসন্তুষ্টি এবং মীর জুমলার নৌ বাহিনীতে তাচ্ছিল্যের ভাব এসে গিয়েছিল, এবং মীর জুমলার এই হতচকিত আক্রমণকেও বিন্দুমাত্র দূরদৃষ্টিতে দেখতে পান নি সুজা। এই হারে সুজা শিক্ষা নিয়ে নতুন করে আক্রমন শানাতে কোমর বাঁধলেন। তাঁর নৌবহর রাজমহল থেকে দেওগাছির মধ্যে টহল দিলেও, রাজমহলে যেখানে নদী সবথেকে চওড়া, সেই রাজমহলে তিনি সব থেকে বেশি গোলান্দাজ নৌকোর টহল চালালেন। ফলে মীর জুমলা বুঝলেন হাতে মাত্র কয়েকটি নৌকো আর নোকোয় ভাসমান কামান নিয়ে ছোট ছোট বাহিনীতে ভাগ হয়ে ওপারের তীরে গিয়ে সদা জাগ্রত বাহিনীকে গেরিলা আক্রমণের রণনীতি এখন আর সফল হবে না। এবং দীর্ঘ লড়াইএর পরেও বিপক্ষের বাহিনীকে এই ধরণের যুদ্ধে তাঁর পক্ষে হারানো সম্ভব হবে না। ফলে অবশ্যম্ভাবীভাবে মীর জুমলাকে রণনীতি পরিবর্তন করতে হল। তিনি সময় নিলেন। উত্তরে রাজমহল থেকে ২৮ মাইল দক্ষিণ পূর্বে সুতির মধ্যের এলাকাটি কয়েকজন বাছা বাছা সেনা নায়কের হাতে ছেড়ে দিলেন; রাজমহলের দায়িত্ব দিলেন মহম্মদ মুরাদ বেগের হাতে, সুজার শিবিরের উল্টোদিকের দোগাছির নেতৃত্ব দিলেন শাহজাদার সঙ্গে জুলফিকার খান এবং ইসলাম খান এবং বিশাল বাহিনীর অধিকাংশ নিয়ে; আরও আট মাইল দক্ষিণে দুনাপুরে আলিকুলি এবং মীর জুমলা নিজে হাজার সাতেক সেনা নিয়ে সুতিতে শিবির করলেন।

সুতিতে মীর জুমলার নিজের ঘাঁটি গাড়া খুব বড় রণনৈতিক পরিকল্পনা ছিল। তার হাতে যথেষ্ট নৌবহর ছিল না। কিন্তু সুতিতে নদীর পরিসর খুবই সরু। স্থানীয়দের থেকে খবর পেলেন এখানে নদী হেঁটে পারাপার হওয়া যায়। এর আগেও তিনি এই রণনীতিতে জিতে এসেছেন। শাহজাদাও মীরের এই প্রস্তাব মেনে নিলেন যে সুজার বাহিনী আর নৌবহরকে নদী পার হতে দেওয়া যাবে না। সেই জন্য এই রণনীতি সক্কলকে জানিয়েও দিলেন। নদীর সমস্ত ফেরি এবং পারাপার হওয়ার রাস্তা বন্ধ হল। এই নিষেধাজ্ঞা এবং নজরদারি এতই কঠিন এবং কড়া করে লাগু হল যে ছিঁচকে চোরেরাও সেই কয় দিন চুপিসাড়েও নদী পার হতে পারে নি, যদি কেউ ধরা পড়ত তাদের নাক কান কেটে ফেলা হত।

শিবির ফেলার পরের দিন মীর জুমলা নদী পার হওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু নদীর গভীরতা বুঝতে ভুল হয়েছিল তাঁর। তিনি বুঝলেন স্থানীয় মানুষের কথায় তিনি প্রতারিত হয়েছেন। এবং দেখা গেল ১৪ দিন আগে যে জলস্তর ছিল, তা হঠাত বেড়ে গেল। বেশ কিছু ক্ষতি হল, কিন্তু আরও বড় দুর্ঘটনা থেকে অন্তত সেনাবাহিনী বেঁচে গেল।

মীর জুমলা উল্টোদিকে অবস্থান করছে বুঝে সুজা সুতির উল্টোদিকের পাড়ে নুরুল হাসান এবং দুনাপুরের উল্টদিকে ইসফান্দিয়ার মামুরি এবং তাঁর বড় ছেলে জায়িনুদ্দিনকে তাণ্ডায় দায়িত্ব দিলেন, সে তাঁর পরিবারের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে তাদের নিয়ে সেখানে গেল।

মীর জুমলা অতি গোপনে উল্টো দিকের তীরে সেনানী পাঠাবার রণনীতি তৈরি করে যেতে লাগলেন, পরিকল্পনা, কোন একদিন সেখানে গিয়ে তিনি নিজে নেতৃত্ব দেবেন। এই কাজে তাঁর দরকার প্রচুর নৌকো। তিনি পদস্থ আধিকারিকদের হুগলি, কাশিমবাজার বা এই সব এলাকায় যে কোন ধরণের নৌকো – কিস্তি বা ঘুরাবের খোঁজে পাঠালেন। হুঁশিয়ারি দিলেন ব্যর্থ হলে তাঁর পরিবার এমন কি তাঁর দেশকেও তিনি ধুলোয় গুঁড়িয়ে দিতে দ্বিধা করবেন না। হুঁশিয়ারিতে ফল ফলল। ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে তারা শয়ে শয়ে নৌকো জোগাড় করে এনে দিল মীর জুমলাকে। জুলফিকারও তাকে ৪০টি নৌকো দিল। এই নৌকোগুলির সাহায্যে মীর জুমলা সুজার যে কোন আক্রমন আটকাতে পারবেন। ফলে মীর জুমলা পূর্ব তটের ৪০ ৫০ লিগ এলাকা তাঁর নৌবাহিনী নিয়ে টহল দিতে লাগলেন। পশ্চিম পাড় হাতছাড়া হয়ে গেলে সুজা শত্রুর বাহিনী লক্ষ্য করে গোলা দাগতে ৮টি বিশাল কামান বসালেন। অন্যদিকে মীর জুমলা তাদের ওপর আক্রমণ রুখতে এক রাত্রিতে তিনি ১০ টা নৌকো বোঝাই করে বাছাই সেনা পাঠালেন বিপক্ষের কামান দখল করতে। কিন্তু সেটি সফল হল না। তিনি সময় পরিবর্তন করলেন। পরের দিন দিনে দুপুরে ২০ সেনা পাঠানোর পরিকল্পনা করলেন এবং তাঁর এই পরিকল্পনা অযাচিতভাবে সফল হল। বাতাসে অনুকূলে তর তর করে উজিয়ে গিয়ে হঠাত আক্রমনে বিপক্ষকে হতচকিত করে দিয়ে আটটি কামান এবং ব্যাটারিগুলি কোন ক্ষয় ক্ষতি ছাড়াই তুলে নিয়ে এল।

৪। ৩ মে ১৬৫৯, মীর জুমলার হার সাফল্যের আত্মপ্রসাদে মীর জুমলা আরও বড় হামলার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু ততক্ষণে সুজার বাহিনী নিজেদের ঢিলে ঢালা সুরক্ষা কষে বেঁধে নিয়েছে, তিনি সেনানায়ক নুরুল হাসানকে বদল করে দক্ষ সেনানী বারহার সৈয়দ আলম (খানইআলম)কে দায়িত্ব দিয়েছেন। কয়েকটি ব্যাটারি তীরে আলগোছে ফেলে রাখার টোপ দিয়ে পিছনে সৈয়দ আলম এবং মুথাশাম খানের নেতৃত্বে কয়েকটি যুদ্ধ হাতি সম্বলিত বাহিনী লুকিয়ে রাখলেন। ২ মে রাতে মীর জুমলার একটা বাহিনী আক্রমনে গেল কিন্তু সেটা বিফল হল। ৩ তারিখ ভোরে মীর জুমলার ৭৩টি নৌবহর করে কাশিম খান এবং শাহবাজ খানের নেতৃত্বে ২০০০ সেনার বাহিনী উল্টোদিকের তীরে গিয়ে বাধাহীনভাবে উঠে পরিখায় উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে টোপ হিসেবে কয়েকজনকে বসিয়ে রাখা সেনা আক্রমন করে এলাকা দখল নেয়। হঠাতই সুজার বাহিনী যুদ্ধ হাতি নিয়ে রে রে শদে তেড়ে যায় এবং মীর জুমলার ছোট বাহিনীকে ঘিরে ধরে কচুকাটা করতে থাকে। আক্রমনকারীরা প্রবল পরাক্রমে যুদ্ধ করলেও উল্টো দিকে বসে থাকা মীর জুমলা হতাশ এবং আতঙ্কিত অবস্থায় দেখতে থাকেন নিজেদের সেনার ওপরে আক্রমন, এবং সেই আক্রমন ঠেকাতে পারে না। প্রায় অর্ধেক সেনা মারা যায়। ৫০০ গ্রেফতার করে মালদা ফিরোজপুর ও অন্যনায় এলাকায় পাঠানো হয়, কিছুকে মৃত্যু দণ্ড দেওয়া হয়। এই হারের ব্যাপকতা হারের থেকেও বেশি হয়, নৈতিকভাবে মীর জুমলার বাহিনী ভেঙ্গে পড়ে। তিনি নিজেও হতাশ হয়ে পড়েন। এবং এই দুর্বিপাক তাঁর বর্ণময় জীবনে কলঙ্কের দাগ হয়েই রইল। তিনি সব ঝেড়ে উঠে নতুন করে জেতার পরিকল্পনা নিলেন। এই হার তাঁর আগামী দিনের লড়াইতে আশীর্বাদস্বরূপ হয়ে দেখা দিল, এবং তিনি এর পর থেকে সদা সতর্ক হয়েই তাঁর আগামী সব রণনীতি তৈরি করতেন।

সুজার পক্ষের ঐতিহাসিক মাসুম মীর জুমলার হারের কারণ সঠিকভাবেই নিরূপন করেছেন, এই আক্রমন হয়ত সময়োচিত এবং প্রাজ্ঞার প্রকাশ ছিল তিনি শত্রুর বহর না আঁচ করেই বেহুদা আক্রমণ করতে মুয়াজ্জম খান বাহিনী পাঠিয়েছিলেন, আশাছিল তার সেনা আরও একবার বিপক্ষকে বেমওকা পেয়ে যাবে। আদতে মীর জুমলা কিন্তু সত্যিকারের বিপক্ষের ওজন, রণনীতি আঁচ না করেই আক্রমনের পরিকল্পনা রচনা করেছিলেন। নিজের সেনা আর রণনীতির ওপর অত্যধিক আস্থা এবং অহংএর বহিঃপ্রকাশ এই বিফল আক্রমনের জনক। স্যর যদুনাথ সরকার বলেছেন বিপক্ষকে তুচ্ছ করতে গিয়ে মীর জুমলা খুব ক্ষতি ডেকে আনলেন। তাঁর রোজবিহানী অনুগামীদের প্রতি এক স্বগতোক্তি মূলক লেখায় মীর জুমলা বলছেন, আমার বয়স ৭০ বছর। এই পরিণত বয়সে এই রকম হারের মুখোমুখি হলাম! ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা বলছে সাম্রাজ্যবাদীরা ছোট ছোট ডিঙ্গিতে ছিল আর সুজার বাহিনী ছিল জালিয়ার মত বড় নৌকোয়। সুজার বাহিনীতে ছিল প্রচুর গতিশীল কোষা নৌকোর বহর। অথচ মাত্র ৬টি নৌকোয় ১০০০ সেনা এনেছিল মীর জুমলার বাহিনী, তাই তাদের সব নৌকো যে ছোট ছিল একথা সত্যি নয়। তাও বলা যায় সত্যই মীর জুমলা বাহিনীর নৌকগুলি সত্যিকারের ছোট তো ছিলই এবং কিছুটা তাঁর জন্য হার যে হয়েছে তা না স্বীকার করা মুর্খামি। ৫। নতুন আক্রমণের পরিকল্পনায় মীর জুমলা পুরোনো হারের হতাশা ঝেড়ে ফেলে নতুন আক্রমণের দাবার গুটি সাজাতে বসলেন মীর জুমলা। নষ্ট হয়ে যাওয়া নৌকোগুলি তাঁর নতুন পরিকল্পনায় বাধ সাধছিল যেমন, তেমনি নতুন রণনীতি তাঁর চরম একাগ্রতা মনোযোগ দাবি করছিল। হুগলি, মুর্শিদাবাদ এবং বর্ধমান থেকে নৌবহরের আরও সরঞ্জাম জোগাড়ের চেষ্টা করতে লাগলেন। নৌকো কারিগর এবং চলতি নৌকো জোগাড়ে আবার নেমে পড়ল তাঁর বাহিনী। নদীতে চলাচল করা যত বড় নৌকো সব হুকুম দখল নেওয়া হল, মুকসুদাবাদ পেরিয়ে কোন নৌকোই আর আসতে পারছিল না। পর্তুগিজদের বিরুদ্ধে ইওরোপিয় ডাচ বা ব্রিটিশ সেনানীদের জোগাড়ে বিহার বাংলায় মীর জুমলা তাঁর পদমর্যাদা কাজে লাগালেন। কাশিমবাজার থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে থাকায় তিনি ডাচেদের ডাক্তার এবং গোলান্দাজদের তাঁর বাহিনীতে যোগ দিতে বললেন। ব্রিটিশেরা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এল না, কিন্তু ডাচ নির্দেশক ম্যাথায়াস ভ্যান্ডেনব্রোক হুগলী থেকে তাঁর সঙ্গে মোলাকাত করতে এলেন। জনশ্রুতি সাম্রাজ্যের সেনাপ্রধান ডাচেদের সহায়তার বিনিময়ে দুলক্ষ টাকা দেওয়ার নাকি প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর আগে ১৬৫৯ সালের জুলাই মাসে প্রধান নির্দেশক মীর জুমলাকে সব ধরণের সাহায্য এবং তাদের যত শ্লুপে কামান রয়েছে সে সবগুলি মুঘল সাম্রাজ্যের হয়ে নদী পাহারা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন।

মীর জুমলা এত দিনে ওডিসায় আওরঙ্গজেবের শাসন বিস্তৃতির পরিকল্পনা করলেন। সাম্রাজ্যের যুদ্ধকে সাহায্য করার জন্য বালেশ্বর এবং অন্যান্য শহরের প্রশাসনকে দূত এবং নির্দেশ পাঠান। বালেশ্বরে সুজাপক্ষী আধিকারিককে চিঠি লিখে মুহম্মদ সুলতানের সঙ্গে দেখা করার নির্দেশও দেন। কিন্তু তারা তখনও সুজাকে ছাড়তে ভয় পাচ্ছিল, এবং ব্রিটিশদের আশা ছিল মীর জুমলা শীঘ্রই বালেশ্বর দখল করবেন এবং তখন বাধ্য হয়ে প্রশাসকের মীর জুমলার পক্ষে যাওয়ার চিন্তা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না। মীর জুমলা বুঝলেন যতই সামনা সামনি আক্রমন করা যাক, তা দিয়ে নদীর সামনে ঘাঁটি গেড়ে বসা সুজার বাহিনীকে হঠনো যাবে না। সুজার বাহিনীর পিছন দিকে আক্রমন করে তাঁর দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিতে হবে, কায়দা করে সিংহের গুহায় ঢুকতে হবে। তাঁর বাহিনীকে পূর্ব, পশ্চিম এবং উত্তর দিক থেকে আক্রমন করতে হবে। এই পরিকল্পনা রূপায়ণে তাকে বিহারের সুবাদার দাউদ খানের ওপরে নির্ভর করতে হবে।

দাউদ খানকে এক চিঠিতে মীর জুমলা লিখলেন নতুন সেনা জোগাড় করতে। এর সঙ্গে তিনি বললেন রণজয়ী হাদি বা আবদুল মাল আলি খান বা কাকারদের মত আভিজাত এবং তাঁর বাহিনীকে দলে পেতে গেলে তাকে সিন্দুক খুলে দিতে হবে এবং যতগুলি পারা যায় কস্তি এবং ঘুরাব(কামান দাগার নৌকো) সংগ্রহ করতে এবং প্রত্যেক নৌকোয় প্রয়োজনীয় গোলাবারুদকামান দিয়ে সাজিয়ে তুলতে। বন্যার সময়টা এড়াতে তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সেনা নিয়ে চলে আসতে বললেন এবং তাঁর পরে বড় নৌকোগুলো পাঠালেই হবে। কোশি পার হওয়ার সময় তিনি যেন চিরাগ বেগের নেতৃত্বাধীন রোজবিহানী বাহিনী এবং সুতিতে রশীদ আর দেওগাছিতে মহম্মদ সুলতানের সঙ্গে আলোচনা করে নেন। দাউদ খান, রশিদ এবং চিরাগের যুক্ত বাহিনী গঙ্গার বাঁ পাড়ে সুজার বাহিনীকে আক্রমন করবে এবং তার পরেই দাউদের নৌকোগুলি করে মীর জুমলা আক্রমন করে শেষ পেরেকটি মেরে শত্রুর শেকড় উপড়োবার কাজটি শেষ করবেন।

৬। সুজার বাহিনীতে মহম্মদ সুলতানের পলায়ন ৩ মের হারের ক্ষত পূরণ করতে এবং আগামী দিনে যাতে আর নতুন করে আক্রমণের মুখে না পড়তে হয়, সে পরিকল্পনা করতে নতুন করে যখন আক্রমণের ঘুঁটি সাজাতে ব্যস্ত ছিলেন মীর জুমলা, তখনই ৮ মে রাতে তাঁর সহযোগী সেনানায়ক শাহজাদা মহম্মদ সুলতান দেওগাছি ছেড়ে সুজার শিবিরে যোগ দেয়। এই খবর মীর জুমলার কাছে বিনা মেঘে বজ্রাঘাত। এই খবরে হয়ত গোটা মীর জুমলার বাহিনীই ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত, কিন্তু পোড় খাওয়া বহু যুদ্ধের সেনানী মীর জুমলা উপস্থিত বুদ্ধি, সেনানীদের ওপর তাঁর নিয়ন্ত্রণ এবং অপরিসীম সাহসের জন্য সেই বাহিনী টিকে গেল শুধু নয়, নতুন আক্রমণের উদ্যম নিতে শুরু করল। শাহজাদার পালানোটা অবশ্যম্ভাবীই ছিল - সুজার মেয়ের প্রতি তাঁর ভালবাসা, সিংহাসনের প্রতি তাঁর দুর্নিবার আকর্ষণ, এবং তাকে কাকার বারবার লোভ দেখানো ছাড়াও মীর জুমলার নিচে তাঁর থাকা, মীর জুমলার শত্রুদের বারবার কান ভাঙ্গানো, এবং সাম্রাজের নির্দেশে মীর জুমলা তাকে গ্রেফতার করতে পারেন এই ভয়টাও নাকি তাঁর ছিল। সুজাপন্থী ঐতিহাসিকদের বক্তব্য, সম্রাটের প্রতি তাঁর পুত্রের মনোভাব নির্ধারণ করেছিল দুটি বিষয় - প্রথমটি ছিল মীর জুমলা সরাসরি সম্রাটকে চিঠি লিখে জানান যে ৩ তারিখের যে অভিযান হয়, তাঁর পুত্র সে সম্বন্ধে তাঁর লোকদেখানো অজ্ঞতা এবং অবহেলার প্রকাশ করেছেন, যা আসলে সেই অভিযানের ব্যর্থতার অন্যতম কারণ বলে মীর জুমলার ধারণা দ্বিতীয়ত একটি কবিতা সূত্রে জানতে পারা যাচ্ছে সম্রাটের নির্দেশে সেনাবাহিনীর আনুগত্যের পারদ খোঁজ করা নিয়ে দুটি চরের মতের বিরুদ্ধে শাহজাদা উল্টো মত প্রকাশ করেছিলেন। এই ঘটনা সম্বন্ধে সম্রাট মীরকে লেখেন, সাধারন বা বিশেষ, তোমার ওখানে বা এখানে সব ঘটনা তোমার নির্দেশেই পরিচালনা করে থাকি। যদি আমার পুত্র তোমার নির্দেশ পালন না করে আর তুমি যদি মনে কর তোমায় আর তাঁর দরকার নেই তাহলে শীঘ্রই তাকে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। সম্রাটের এই নির্দেশকে চরেরা মনে করছিল বাস্তবিক তাঁর গ্রেফতারি এবং সেই অবস্থায় তাকে দিল্লি পাঠানোর নির্দেশ। শাহজাদা সমস্ত ধৈর্য হারিয়ে সেই রাতেই নদী পেরিয়ে তাঁর কাকার আশ্রয় নেওয়াকেই তাঁর নিশ্চিত নিরাপত্তা রূপে ভাবলেন। সুতিতে থাকা মীর জুমলা এই ঘটনায় হতবাক হয়ে যান। নিজের বাহিনীকে শান্ত করে তিনি পরের সকালেই দেওগাছির পানে রওনা হয়ে যান। রাস্তায় আওরঙ্গজেবের নিযুক্ত চরেদের সঙ্গে দেখা হয়, তারা পলায়ন কাণ্ডে হতবুদ্ধি শাহজাদার রক্ষীদের কবল থেকে পালাতে পেরেছিল। তাদের থেকে আদত খবর পেয়ে তিনি নিশ্চিন্ত হন।

দেওগাছিতে গিয়ে দেখলেন শিবিরের অবস্থা ছিন্নভিন্ন অবস্থায় পড়ে রয়েছে। মীর জুমলা ঘুরে দেখলেন প্রত্যেকেই নির্দেশ অমান্য করতে বসে রয়েছে, শিবির জুড়ে দিশাহীনতা এবং হতাশার পরিবেশ। কিন্তু মীর জুমলা মানুষের জন্ম নেতা। তিনি জানেন এই রকম ছিন্নভিন্ন বাহিনীর মনোবল কিভাবে বাড়ানো যায়। যুদ্ধ সমিতির বৈঠকের আগে প্রত্যেক সেনার সামনে বক্তৃতা দিতে উঠলেন মীর জুমলা মুয়াজ্জম খান। তিনি মনোবল বাড়াবার জন্য রঙ্গিন বক্তৃতা দিলেন।আগামী দিনের যুদ্ধে হারই সম্বল এই মনোভাবের প্রতিবাদ করে তিনি বললেন, শেয়ালের মত পালিয়ে বেড়ানো শত্রুর ভয়ে মরছ? সে আমাদের দেখে পালাচ্ছে, না তার ভয়ে আমরা? তিনি তখন তাদের মনে বিশ্বাস পুরে দিলেন, শত্রুকে আজ মনে হচ্ছে সূর্যের মত উজ্জ্বল কিন্তু তোমরা জান আমিও মেঘ, আমি উজ্জ্বল সূর্যকে ঘিরে ফেলব... আমি তাদের ফিরিঙ্গিদের(পর্তুগিজ) কাছে তাড়িয়ে নিয়ে যাব। শাহজাদার পালিয়ে যাওয়াটা বাস্তবে কোন ঘটনাই নয়, তিনি বললেন, সম্রাট আমার সেনাপতি নির্বাচন করেছেন, তাকে আমার সঙ্গে শুধু পরামর্শ করতে পাঠিয়েছিলেন, এর বেশি কিছুই নয়। এর পরে আগামী দিনের তাদের কর্মপদ্ধতি, তাদের পরিকল্পনা ইত্যাদি আলোচনা করে তাদের মন জিতে নেন আওরঙ্গজেবের সেনাপতি মীর জুমলা।

তাঁর বক্তৃতা, তাঁর রাগের বহিঃপ্রকাশ, আশার চেতনা বয়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তাঁর উদ্দেশ্যপূরণে সহায়ক হল। যারা আগের মুহূর্তেও নড়বড়ে হয়ে বিদ্রোহের তোড়জোড় করছিল, তারা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মীর জুমলাকে তাদের একমাত্র নেতা রূপে বৃত করে নিল। উত্তেজিত মীর জুমলা সেনাপতিদের হয়ে তাদের পদন্নোতি এবং বেতন বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে সম্রাটকে চিঠি লেখার প্রতিশ্রুতি দিলেন। খাজাঞ্চিখানার দারোগাকে সেনাদেরকে তিন মাসের অগ্রিম দিতে নির্দেশও দিলেন।

সেনাদের মন জিতে মীর জুমলা শাহজাদার ছেড়ে যাওয়া মালপত্র নিতে আসা একটা বাহিনীকে তাড়িয়ে দিলেন এবং পলাতক শাহজাদার সম্পত্তিীবং খাজাঞ্চি সম্রাটের নামে ক্রোক করারও নির্দেশ দিয়ে তাঁর সেনাকে সম্রাটের বাহিনীতে অন্তর্ভূক্ত করে নিলেন। ফলে মীর জুমলার নেতৃত্বের গুণে নেতাহীন একটি বাহিনীও মনে নতুন আগুণ জ্বেলে এগোল। এ প্রসঙ্গে আকিল খান মন্তব্য করলেন আমরা একজনশাহজাদাকে মাত্র হারালাম।

ফিদায়ি খানকে সুতি ইসমান খানকে দেওগাছি রেখে এবং জুলফিকারকে রাজমহলে পাঠিয়ে নিজে সুতিতে ফিরে গিয়ে ১০ জুনে রশিদ খানকে দাউদ খানের কাছে এবং তাঁর পরে কাজি কেরিয়ার কাছে পাঠালেন।

বাংলায় তখন পূর্ণ বর্ষা। মীর জুমলা তাঁর বাহিনীকে ছাউনিতে পাঠিয়ে দিলেন। তাঁর রণনীতি হল মনোযোগ এবং প্রত্যাহার। দেওগাছি দুনাপুর এবং সুতি থেকে সেনা তুলে নিয়ে শুধু দুটি জায়গায় সেনা রাখলেন। ১৫০০০ সেনা নিয়ে মাসুমবাজারে(মুর্শিদাবাদে)এ একটি উঁচু জায়গায় রইলেন স্বয়ং তিনি প্রচুর রসদ নিয়ে। রাজমহলে রইলেন জুলফিকার খান, ইসলাম খান, ফিদায়ি খান, সৈয়দ মুজফফর খান, ইখলাস খান, রাজা ইন্দ্রদুম্ন, কিজিলবাস খান এবং অন্যান্যরা।

১। মীর জুমলার বাড়তে থাকা অস্বস্তি শাহজাদার মীর জুমলার শিবির ছেড়ে যাওয়া যুদ্ধের মোড় ঘোরানো ঘটনা ছিল। এত দিন ধরে গঙ্গার যুদ্ধে প্রায় একতরফা আক্রমন করে আসছিলেন মীর জুমলা, আঘাত সামলাচ্ছিল বিপক্ষ দল, বিশেষ করে মীর জুমলার রাজমহল দখল করার পরের সময়ে। এত দিন ধরে সুজা আত্মরক্ষামূলক রণনীতি অনুসরণ করছিলেন। গঙ্গা যুদ্ধের গতি পালটে এই প্রথম অনিচ্ছাকৃতভাবে প্রতিআক্রমনে যেতে শুরু করলেন তিনি এবং শেষ বারের মত। এবার যুদ্ধ নতুন পর্বে প্রবেশ করল তাই নয়, দৃশ্যপটও পরিবর্তন হয়ে গেল। শাহজাদা পশ্চিম পাড় থেকে পূর্ব পাড়ে চলে যাওয়ায় যুদ্ধের প্রকোপটা ছিল গঙ্গার ওপরে, সেটি ঢলে পড়ল পশ্চিম দিকে। সুজা এবারে রাজমহল আক্রমণের সুচিন্তিত প্রস্তুতি শুরু করলেন।

শাহজাদার শিবির পরিবর্তন কিন্তু মীর জুমলার পক্ষে হাজারো বাধা তৈরি করল। অবশই শাহজাদা চলে যাওয়ায় সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা সঙ্কুচিত হয় নি, কিন্তু মনে মনে যে বোঝা যাচ্ছিল যে কোথাও একটা তার কেটে গিয়েছে। আর যেহেতু মীর জুমলার যুদ্ধ সমিতিতে তিনি ছিলেন, তাই তার যুদ্ধ করার পদ্ধতি এবং সেনা বাহিনীর গোপন খবরাখবর দিয়ে সুজাকে যুদ্ধের মাঠে কয়েক কদম এগিয়ে দেবে বলাই বাহুল্য। আর শাহজাদার শুধু উপস্থিতিই সুজার বাহিনীকে এতই চাঙ্গা করে তুলেছিল যে তারা নতুন করে যুদ্ধর শেষ দেখে ছাড়ার পরিকল্পনা করে আক্রমনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। বালেশ্বরের কুঠিয়ালেরা ১৫ ডিসেম্বর চমতকৃত হয়ে দেখল যে, সুজা এখন গঙ্গা যুদ্ধের শেষ পর্ব নিয়ন্ত্রণের অবস্থায় চলে এসেছেন। এবং বর্ষার উতপাতও মীর জুমলাকে কিছুটা পিছিয়ে দিল। বর্ষা, বন্যা শুধু যে দু পক্ষের ৬০ মাইলের অলঙ্ঘ বাধা তৈরি করল তাই নয়, মীড় জুমলার বড় বাহিনীর জন্য কাদা রাস্তাগুলি যাতায়াতের অনুপযুক্ত হয়ে উঠল, এবং মীর জুমলার শিবির আশংকায় থাকল সাম্রাজ্যের বাহিনীর জন্য তেরি রসদ সরবরাহের পথগুলি সুজা কেটে দিতে পারেন।

এই সবক’টি কারণ মিলে আশংকার গহ্বরে ডুবে গেল সাম্রাজ্যের বাহিনী। অন্যদিকে সুজা নতুন উদ্যমে মীর জুমলার বাহিনিকে আক্রমন করার পরিকল্পনা রচনা করা শুরু করে দিলেন। সুজার বাহিনীর কাছে প্রধান প্রশ্ন হল, মুকসুদাবাদ না রাজমহল, কোন শিবিরে সুজা আগে আক্রমন শানাবে। সিদ্ধান্ত হল গঙ্গার পশ্চিম পাড়ের রাজমহল। মুর্শিদাবাদের আক্রমনে অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে। গঙ্গার ওপর থেকে সরাসরি নৌবহর থেকে মুর্শিদাবাদের উঁচু টিলায় বসে থাকা মীর জুমলার বাহিনীর ওপর আক্রমণের অনেক অসুবিধে রয়েছে। সুজার আশংকা ইওরোপয়দের – তার ডাকে তারা সাড়া দেয় নি – এ সময় হুগলী এবং কাশিমবাজারের কুঠিয়ালেরা একসঙ্গে যদি মীর জুমলার পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে যুদ্ধের মোড় ঘুরে যেতে পারে। অন্যদিকে রাজমহলে গঙ্গা থেকে সরাসরি কামান দাগা যেতে পারে। রাজমহল দখল হয়ত যুদ্ধের গতি পাল্টাতে পারবে না, কিন্তু তাদের সম্মান পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করবে। উত্তর-পশ্চিম থেকে দাউদ খান বা দক্ষিণ থেকে মীর জুমলার শিবির থেকে ত্রাণ নিয়ে পৌঁছনো সেখানে মুশকিল হবে। সুজার রণনীতিতে রাজমহল দখল করে সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে মারার সঙ্গে সঙ্গে হুগলী মুর্শিদাবাদের ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির থেকে রসদের যোগান কেটে দিয়ে তাদের ভাতে মারারাও পরিকল্পনা ছিল। মুর্শিদাবাদ থেকে গঙ্গা বক্ষ দিয়ে যে রসদের ভাণ্ডার পাঠানো হচ্ছিল মুর্শিদাবাদে, সেগুলি সুজার বাহিনী দখল নিল। বিহার এবং বাঙলার পশ্চিম অঞ্চলের বহু জমিদারকে নিজের দিকে টেনে এনে সুজা তার নিজস্ব রসদের ভাণ্ডারটি জোরদার করলেন। শুধু গঙ্গাই নয়, রাস্তা ধরে পাঠানো রসদের বহরও দখল করতে শুরু করে সুজার বাহিনী। মাজোয়ার রাজা হরচাঁদকে সুজা প্রলুব্ধ করে সেই অঞ্চলের প্রত্যেক বণিককে গরুর গাড়ি বোঝাই করে খাদ্যশস্য নিজের শিবিরে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। ৫ জুলাইয়ের কাশিমবাজারের জমিদারকে লেখা এক চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে, যে কোন বেনিয়া বা সেনার টাকাকড়ি বা সম্বল লুঠ করার পূর্ণ অধিকার দিয়েছিলেন সুজা এই শর্তে যে তার চাহিদা মত তাকে রসদ পৌঁছতে এবং যুদ্ধ হাতি সরবরাহ করতে হবে। হুগলি আর কাশিমবাজারের মধ্যে এখন একটা ত্রাসের তাজত্ব তৈরি হল, যে কোন বানিয়াই লুঠের আশংকায় তাদের রসদ নিয়ে এমন কি কোন হরকরাও চিঠিপত্র নিয়েও সেই বাধা পার হতে পারল না। ২। সুজার রাজমহল দখল মীর জুমলা রাজমহল উদ্ধারে কিচ্ছু করে উঠতে পারলেন না। নৌবাহিনীর অভাবে দূর থেকে বসে দেখলেন আস্তে আস্তে শত্রুর শক্তিশালী নৌবহরে জলরুদ্ধ হয়ে শহরটা তার হাতছাড়া হয়ে গেল। শহরের বাসিন্দাদের জন্য তিনি যে রসদ ত্রানের জন্য পাঠালেন তা রাস্তাতেই লুঠ হয়ে গেল। ঐতিহাসিক মাসুম রাজমহলের মানুষের তৈরি করা এই মন্বন্তরের চোখে দেখা বিবরণ দিয়েছেন, দানা শস্যের দাম দাঁড়াল সোনার মূল্য। এক টাকায় নষ্ট, দুর্গন্ধ মোটা চাল আর ডালের দাম দাঁড়াল টাকায় ন’সের। ...খাদ্যের অভাবে মানুষ বিষও খেতে শুরু করল। মাংসের দাম প্রতি সের একটাকা হল। গরীবেরা নিজেদের মাংসও চিবিয়ে খেতে শুরু করল। নিজেদের ঠোঁট চেবাতে শুরু করল তারা। মাসুমকে দানা শস্য কেনার জন্য ২০-৩০তাকা খরচ করতে হল। ফাঁকা দোকানের সামনে কুকুর বেড়াল অভুক্ত অবস্থায় বসে। মন্দির মসজিদ জনশূন্য হয়ে পড়ল। মন্বন্তরের লেলিহান শিখা গ্রাস করল রাজমহলকে। মীর জুমলার রোজবিহানী সেনারাও মানল যে রুটির একটা টুকরো যেন জলের মত প্রাণদায়ী মনে হতে লাগল। আকিল খান বলছেন, নিজেদের যকৃতের রক্ত পান করে জলের তেষ্টা মেটাতে লাগল মানুষ। মন্বন্তরের সঙ্গে এল বন্যার হাহাকার। ঘোড়া আর গরুর মরতে থাকল শয়ে শয়ে। রাজমহলে মীর জুমলার বাহিনীর এখন তখন অবস্থা। হতাশ, বিশৃঙ্খলতার ঘড়া কাণায় কাণায় পূর্ণ হয়ে যাওয়ায় সেনাপতিদের রাজমহল ছেড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় দেখা গেল না।

সেই মুহূর্তে সুজা আক্রমণ করলেন। বিপক্ষের বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ না পেয়ে রাজমহলের দক্ষিণে পাটুরা দখল করে সুজার সেনাপতি শেখ আব্বাস রাজমহল দখল করার সাজসজ্জা শুরু করলেন। কিছু সময় পরে সুজা পশ্চিম তীর পার হওয়ার জন্য ছটফট করতে শুরু করলেন। তাণ্ডায় সেরাজুদ্দিন জাবরি, মীর আলাউদ্দিন, দেওয়ান মুহম্মদ জামান এবং মীরইজামানকে রেখে তিনি পাটুরার দিকে রওনা হলেন ১৮ আগস্ট। ২২ আগস্ট তিনি নৌবহর নিয়ে রাজমহল দখল করে বসলেন। সাম্রাজ্যের সেনানীদের মধ্যে উঁচু স্থানে থেকেও অসুস্থ জুলফিকার খান লড়াই দিতে পারলেন না, যতটুকু লড়াই করার রাজা ইন্দ্রদুম্ন করলেন। শহরের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা ইসলাম খান এবং ফিদায়ি খান শত্রুর আক্রমণের সামনে দাঁড়িয়ে হতোদ্যম হয়ে যৌথভাবে আক্রমণ রোখার পরিকল্পনাটাই তৈরি করে উঠতে না পেরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মার খেলেন। সক্কলে মিলে ঠিক করলেন শহর ছেড়ে মুর্শিবাদাদে মীর জুমলার কাছে ফিরে যাওয়ার। পাহাড়ের তলায় নতুন শহরের মধ্যে দিয়ে শত্রুর গোলাগুলির সয়ে সাম্রাজ্যের বাহিনী শহর ছেড়ে রওনা হলেন, যদিও সরকারি ইতিহাসে বলা হয়েছে সেই আক্রমণ যথেষ্ট জোরদার ছিল না। তাদের ছেড়ে আসা সমস্ত কিছু দখল করল সুজার বাহিনী। রাজমহল দখল করে সুজা গঙ্গার পশ্চিম পাড় নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করল। ছত্রভঙ্গ হয়ে সেসে পৌঁছন সেনাবাহিনীকে একহাত নিলেন মীর জুমলা। হতচ্ছাড়া, তোমরা যুদ্ধের উপযোগীই নও। তোমাদের ছেঁড়া খোঁড়া পোষাক, বাগানে বাইজদের সঙ্গে ফুর্তি করার মাতালদের মত চরিত্র নিয়ে তোমরা শত্রুর মুখোমুখি হয়েছিল? পুরুষের মূল্য তার সাহসিকতায়, আর সাহসিকতার নীতি দাঁড়ায় মনুষত্বের মহিমার ওপর নির্ভর করে। তোমাদের মত বুড়ো শেয়ালদের সেই যোগ্যতা নেই। তোমরা সেনাহীন, দক্ষতাহীন উদ্যমহীন বাহিনীর কাছে হেরে পালিয়েছ। সেনানায়কের এই দুর্বাক্যের রকমাত্র প্রতিবাদ করেন জুলফিকার। তিনি বললেন সম্মানিত সেনাপতিদের মুনুষত্বহীন ভীরু বলার অধিকার সেনানায়কের নেই। জুলফিকার নিজে দারা এবং সুজার যশোবন্ত সিংএর বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন, কিন্তু তাকে গোটা সেনাবাহিনী নিয়ে এই যুদ্ধ স্থল ছাড়তে হয়েছে সুজার বাহিনীর পরাক্রমে নয়, তার চতুরতার জন্য এবং রসদের অভাবের জন্য, খালি পেট থাকার জন্য। জুলফিকারের কথার সারবত্তা অনুভব করে মীর জুমলা তাকে সান্ত্বনা দিলেন এবং তার পূর্বের বীরত্বের জন্য এবং মীর জুমলা বললেন, তিনি যে শহর নতুন করে দখল করেছিলেন, সেই শহরটাকে সুজার আক্রমণের সামনে নয়, রসদের অভাবে ছেড়ে আসতে হয়েছে সেই দুঃখ তার চিরকাল থাকবে। তিনি বাকি সেনাদের হতাশ হতে বারণ করলেন এবং রাজমহল উদ্ধারের আশা ছাড়তে বারণ করলেন। এবং তার বিশ্বাস তিনি এই শহর সুজার বাহিনীর হাত থেকে উদ্ধার করেই ছাড়বেন। হঠাত আক্রমন করে বিপক্ষকে হতচকিত করে দিয়ে সুজা রাজমহল দখল করলেন, কিন্তু মীর জুমলার দক্ষিণের রসদের যোগানের রাস্তাটি বন্ধ এবং মীর জুমলাকে একাকী করার কাজ পারলেন না। তাঁর মুর্শিদাবাদের সেনা ছাউনিতে গোটা বর্ষায় মীর জুমলা বিশ্রাম তো নিচ্ছিলেনই না, বরং তার বিপুল সেনাবাহিনীর সংখ্যাধিক্যের জোরে তিনি হুগলী দিকে এবং থেকে দক্ষিণের রাস্তা পরিষ্কার করার কাজ করতে লাগল, বিশেষ করে আবাধে ঘোরাফেরা করা সুজাপন্থী জমিদারদের ওপরে নজরদারির কাজ করতে শুরু করলেন তিনি। জুলাই মাসে তিনি ঘোর একজন ৫০০ ঘোড়ার ফৌজদার (মহম্মদ শরিফ?) নিয়োগ করে কাশিমবাজার থেকে হুগলির মধ্যেকার রাস্তা পরিষার করার কাজে হাত দেওয়ালেন যাতে তিনি হুগলি এবং এমন কি মেদিনীপুরও দখল করতে পারেন। এর উত্তরে সুজা, হিজলির প্রশাসক মির্জা ইসফানদার(ব্রিটিশদের নথিতে মেজর স্পিলন্ডার)কে ৬০০০ পদাতিক এবং ৫০০ ঘোড়সওয়ার আর কিছু গেরিলা (জলবা) বাহিনী নিয়ে হুগলির প্রশাসকের হাত শক্ত করার দায়িত্ব দিলেন। কিন্তু তিনি সঠিক সময়ে সেখানে পৌঁছতে পারেন নি। যদিও কাশিমবাজারের ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরদের আশংকা ছিল যে মীর জুমলার বাহিনীকে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়তে হবে হয়ত, কিন্তু শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে তারা হুগলী দখল নিলেন। সেপ্টেম্বরের শুরুতে যখন মীর জুমলার বাহিনী মেদিনীপুর দখল নিচ্ছে তখনও মেদিনীপুর শহরের ১৭ কিমি দক্ষিণ-পূর্বে নারায়ণগড়ে রয়েছে সুজার বাহিনী।

৩। বেলঘাটা, গিরিয়ার যুদ্ধ রাজমহল দখল করে উজ্জীবিত সুজা তার পরবর্তী পদক্ষেপের কথা ভাবতে শুরু করলেন। তিনি কি রাজমহলের দিকে অভিযান করা দাউদ খানের বিরিদ্ধে অভিযান করবেন না দক্ষিণে মীর জুমলার বাহিনীর ওপর আক্রমন করবেন এই দ্বন্দ্বে পড়লেন। শাহজাদা মহম্মদ আজমের পরামর্শতে বর্ষার ঠিক পরে পরেই তিনি নিজে মীর জুমলা আর তার বিশাল বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ায়ের ময়দানে নামার সিদ্ধান্ত নিলেন, কেননা মীর জুমলাকে হারাতে পারলেই দাউদ খানের অভিযান ব্যর্থ হবে। যদিও তিনি দাউদ খাননের অভিযানকে বিন্দুমাত্র তুচ্ছ করছেন না, তার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী সামলানোর দায়িত্ব দিলেন ফিদায়ি খান এবং খ্বোয়াজা মিশকি(ইতাবর খান)কে। বর্ষা শেষ হতে না হতেই সুজা ৮০০০ বর্ম পরা সেনা নিয়ে খাসা এবং ঘুরাব নিয়ে রাজমহল থেকে দুনাপুর, দোগাছি এবং সুতি হয়ে বেলঘাটা পৌছঁলেন দুমাসের মধ্যে।

ইতোমধ্যে ছাউনিতে থাকা বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য উপযোগী করে ফেলেছেন মীর জুমলা। রথে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জুলফিকার খান, ডানদিকে মুজফফর, বাঁয়ে ফিদায়ি(খান কোকা), গোলান্দাজ বাহিনী মহম্মদ মুরাদ বেগের নেতৃত্বে আর মহম্মদ আঘর(উইঘুর) হারনাওয়াল(?) হিসেবে ছিলেন। মাসুমবাজার থেকে ২০ মাইল দূরে বেলঘাটায় তিনি ভাগীরথীর তীরে ঢুকে যাওয়া একটি গভীর নালাকে পরিখা হিসেবে বেছে নিলেন। একটি বাহিনী মূল বাহিনীর কাছে, অন্য বাহিনীটি এক মাইল দূরে রেখে তিনি তাদের মাথা সুরক্ষা আচ্ছাদনে ঢাকলেন। একতাজ খান বাঁদিকের বাহিনীর হয়ে লড়ায়ের দায়িত্ব পেলেন। সেনাপতিদের পালিয়ে যাওয়া রুখতে হাতির বদলে তিনি ঘোড়া চড়তে নির্দেশ দিলেন। কেউ তার নির্দেশ অমান্য করলে হাতি দিয়ে মাড়িয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে রাখলেন তিনি। মীর জুমলার বাহিনীর অগ্রগমনের সংবাদে সুজার বাহিনীতে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল।

নালা দিয়ে বিভক্ত দুই বাহিনীর মধ্যে প্রথমে গোলার লড়াই শুরু হল ৬ ডিসেম্বর দিনের দেড় পহর(প্রহর? তিন ঘন্টায় এক প্রহর আর যাম হিসেবে ছটায় সকাল ধরলে দুপুর এগারোটা নাগাদ শুরু হল লড়াই - অনুবাদক) থেকে। কয়েকদিন ধরে গোলা বিনিময় এবং খণ্ডযুদ্ধের পর মীর জুমলার বাহিনীকে টেনে আনতে রাজমহলের দিকে পিছু হঠার ভান করল। সেই সুযোগে মীর জুমলার বাহিনী সুজার ছেড়ে যাওয়া যায়গা দখল করে সুজার বাহিনীকে ঘিরে নেওয়ার চেষ্টা করলে সুজার সেনানী মহম্মদ সুলতান মাত্র ৪০০ বাহিনী নিয়ে সামনের দিক পাহারা দেওয়া একতাজ খানের বাহিনী ঘিরে নেয়(১৫ ডিসেম্বর)। মুখ্য পাহারাদার একতাজ, তার বাহিনীর সাহায্যের জন্য মীর জুমলাকে নতুন বাহিনী পাঠাবার অনুরোধ করলেন। মীর জুমলা জুলফিকারকে বললেন আঘার(উইঘুর) এবং রোজবিহানীদের ৭০০০ মেলানো মেশানো বাহিনী পাঠাতে। এবং যদি তারা জয় নিশ্চিত করতে পারে তাহলে যেন তারা শাহজাদার পিছন ধাওয়া করে। কিন্তু বিপক্ষের গোলাগুলিতে আহত একতাজকে সঙ্গে নিয়ে নালার সেতু পেরিয়ে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয় জুলফিকার।

মীর জুমলা নতুন করে দাবার ঘুঁটি সাজাতে বসলেন। সুজার তিনজন সেনানায়কের মধ্যে, এই বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করার অভিজ্ঞতা হয়েছে সামনে লড়াই দেওয়া শাহজাদার যিনি বাঁদিকের সেতু দখলের দিকে এগোচ্ছিলেন। মীর জুমলা পাশ এবং পিছন দিয়ে সুজার বাহিনীকে ঘেরার পরিকল্পনা করলেন স্বভাবসিদ্ধ রণনীতিতে। সামগ্রিক সেনা চালনার দায় জুলফিকার খানকে দিয়ে মীর জুমলা বাঁদিকের সেতু ধরে নালা পেরিয়ে ধীর গতিতে জঙ্গল, কাদা পেরিয়ে গিরিয়ার কাছে ভাগীরথীর তীরে সুজার সেনার পিছনে মীর ইসফানদিয়ার মামুরির বাহিনীর ওপর গোলান্দাজ বাহিনী, হাতি এবং উট হাউই(সুইভেল?) বাহিনী নিয়ে তীব্র আক্রমন শানালেন। মীর জুমলার আক্রমন এতই তীব্র হয়েছিল যে, শাহজাদাকে তার সেনার উদ্ধারে চলে আসতে হল এবং জিতলে হিন্দুস্তানের অর্ধেকটা তাকে উপহারও দেওয়া হবে এমন লোভ দেখালেন। জুলফিকারের বিপক্ষে লড়াইতে গোলাবারুদের দারোগা ইবন হুসেইনকে সামনে রেখে সুজা ছোট কিন্তু দক্ষ সেনা বাহিনী নিয়ে সর্বশক্তিমানের ওপর ভরসা রেখে তাকে বার বার বিপদে ফেলা বৃদ্ধ যোদ্ধা, মীর জুমলাকে শিক্ষা দিতে এলেন।

দিনের তিন পহর পার হয়ে গেলেও সুজা জোরদার যুদ্ধ করলেন। তার পিছনটি সুরক্ষিত একটি গ্রাম এবং সামনে কামানের সারি দিয়ে। মির্জা জান বেগ মীর জুমলার আক্রমণের সামনে পাহাড়ের মত দাঁড়িয়ে থেকে কামান থেকে ১০ থেকে ১৫ সেরের গোলা ছুঁড়ছিলেন। তার পরিকল্পনা প্রায় বিফলে যেতে বসেছিল। কিছু সময় তিনি এগোতেও পারছিলেন না, পিছোতেও পারছিলেন না। আলমগিরনামায় বলা হয়েছে মীর জুমলার বাহিনীর সেনাপতিরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন না। তারা নিজেদের মত আক্রমন সাজাচ্ছিলেন বিচ্ছিন্নভাবে। ফলে কেন্দ্রিভূতভাবে একজন কারোর পক্ষেই নেতৃত্ব দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল ছিল না। দুই পক্ষই রণক্লান্ত হয়ে পড়েছিল।মীর জুমলার গোলা শেষ হয়ে গেল এবং তিনি বিপুল বাহিনী নিয়ে একটি খাঁড়ির মধ্যে আটকে পড়লেও সুজা তার ওপরে খুব বেশি গোলা ছুঁড়ল না। সুজার ঐতিহাসিক বলছেন, তিনি যদি এই আক্রমনটা জোরদার করতে পারতেন, তাহলে হয়ত মীর জুমলার বাহিনীকে হারিয়েও দিতে পারতেন। কিন্তু এই যুক্তিটা খুব সাজানো মনে হল। শেষ দুটি লড়ায়ে একটি বাঁদিকের বাহিনীর ওপরে এবং গিরিয়ায় নিজের বাহিনীর পিছনের অংশে তিনি প্রাথমিক সাফল্য পেয়েছিলেন তার গোলান্দাজির জন্য। মীর্জা জানের বিপুল কামান বাহিনীর গোলার ভাণ্ডার শুন্য হয়ে গিয়েছিল ততক্ষণে। ফলে গোলার সুরক্ষা না নিয়ে তিনি মীর জুমলার বিপুল বাহিনীর সঙ্গে হাতে হাতে যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে চান নি। অন্য দিকে গিরিয়ার যুদ্ধে মীর জুমলা পরিকল্পিত ভাবে আটকে পড়া বাহিনীকে উদ্ধারের কাজ করছিলেন ব্যক্তিগত তদারকিতে। এবং হয়ত তিনি বুঝতে পারেন নি যে সুজার বাহিনীর গোলা ফুরিয়ে গিয়েছে এবং রাতে সুজার গোলার প্রাবল্যের ধাক্কায় তার হতোদ্যম সেনাপতিদের নিয়ে তিনি হয়ত আর যুদ্ধ খুব একটা এগোতে পারতেন না।

তার পূর্ব রণনীতিতে পরিকল্পিত সময়ের পিছনে চলছিলেন মীর জুমলা। বর্ষার শেষে তিনি দাউদ খানকে বলেছেন(তখন মুঙ্গেরে) কোশি পেরিয়ে তাণ্ডার দিকে এগোতে। তিনি প্রত্যেকদিন আশা করছেন, দাউদ খানের বাহিনীর আসার খবর পেয়ে সুজা এই যুদ্ধ ছেড়ে তার শিবির বাঁচাতে কখন দৌড় লাগাবেন। এদিকে সম্রাটের পাঠানো দিলির খানের নেতৃত্বে গোলান্দাজ বাহিনীর অপেক্ষা করছিলেন তিনি, ফলে খালি হাতে লড়ে তার বাহিনীকে আর নষ্ট করতে চাইছিলেন না। ফালে তিনি তাড়াতাড়ি নালা পেরিয়ে মুর্শিদাবাদের দিকে চললেন।

মীর জুমলার পশ্চাদাপসরণ দেখে এবং নিজের পিছনে দাউদ খানের আক্রমণের কথা ভুলে গিয়ে সুজা মীর জুমলাকে মুর্শিদাবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্যম নিলেন। ভাগীরথী পেরিয়ে মীর জুমলার সমান্তরালভাবে মুর্শিদাবাদের উত্তরে নসিপুর (নাসিরপুর) পেরিয়ে আবার নদীর ওপর পারে গিয়ে মীর জুমলার রসদের রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টা চালালেন। বহুদিন ধরে দুইতীরে পরস্পরের মধ্যে গোলান্দাজির প্রতিযোগিতা চলল। ডিসেম্বরের ২৬ তারিখের রাতে যখন সুজা ফেরি পের হচ্ছেন, সেই সময় খবর পেলেন কোশি পেরিয়ে তার সেনানায়ককে হারিয়ে দাউদ খান দ্রুত তাণ্ডার দিকে এগোচ্ছেন।

৪। দাউদ খানের পাটনা থেকে মালদার দিকে আগমন সুজার ভাগ্য পরিবর্তনের বিষয়টা বোঝা যাবে না যদি আমরা মে মাসে সম্রাটের নির্দেশবলে মীর জুমলার চিঠি পাওয়ার পর থেকে দাউদ খানের কর্মপদ্ধতিটি বুঝতে না পারি। মীর জুমলার চিঠি পাওয়ার পরে দাউদ তুরন্ত কাজ করতে শুরু করে দেন। তার সেনানায়ককে তিন মাসের অতিরিক্ত বেতন দিয়ে তিনি সম্রাটের কাজের জন্য নির্দিষ্ট বাহিনীর প্রধান করে দেন। এবং বিশাল সেনা বাহিনী তৈরি করেন। মেশি আর দ্বারভাঙ্গা থেকে দু জন পালোয়ান আর তাদের বাহিনী, অর্থ এবং সম্পদ চাইলেন, মানকালী পরিবার এবং ককর নেতাদের ডাকলেন। তিনি স্থানীয় মাঝিদের থেকে প্রচুর কিস্তি এবং ঘুরাব নৌকো কিনে নেন এবং প্রত্যেকটি নৌকোকে ১০টি গোলান্দাজ বাহিনী এবং গোলাবারুদ দিয়ে সাজিয়ে তোলেন। এই প্রস্তুতি নিয়ে দাউদ তার ভাই শেখ মহম্মদ হায়াতকে তার অধীনে নিয়ে ১৩ মে পাটনা ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন ১৫০০ রিসালা(অশ্বারোহী), ২০০০ পদাতিক নিয়ে। গঙ্গা পেরোলেন নৌকোর সেতুতে এবং তার পরে ভরা বর্ষার সরযূ আর গণ্ডকে শত্রুর নানান বাধা পেরিয়ে ভাগলপুরের উল্টো দিকের গ্রাম কাজি-কেরিয়ায় উপস্থিত হন তিন মাস পরে। রোজবিহানীরা তখন ভাগলপুরে অপেক্ষা করছে, তাদের আনতে ৯০টি নৌকো পাঠালেন। সেখানে আগেই খাসা এবং ঘুরাব যুদ্ধ জাহাজের বিপুল নৌবহর নিয়ে উপস্থিত ছিলেন সুজার সেনানায়ক খ্বোয়াজা মিশকি(ইতিবর খান)। তার সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হয়। প্রথম দিনে যুদ্ধে শুধুই গোলাগুলি চলে, রাতে দাউদ ১০টি কামানে সাজানো নৌকো আর ১০টা সাঁজোয়া নৌকো নদীর সুরক্ষায় সাজিয়ে রাখতে নির্দেশ দিলেন। পরের দিন লড়াইয়ে খ্বোয়াজার হারের পর ১০ জুন মীর জুমলার রশিদ এবং রোজবিহানী সেনাবাহিনী এবং তার নেতৃত্ব চিরাগ দাউদের সঙ্গে দেখা করে সুলতান মহম্মদের পলায়নের খবর দেন এবং বর্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি যেন কাজি-কেরিয়া না ছাড়েন মীর জুমলার এই নির্দেশ পৌঁছে দেন। কোশি, কালিন্দি আর মহানন্দায় বিপুল বন্যার জন্য দাউদকে সেখানেই বসে থাকতে হল। দাউদের নির্দেশে তীর জুড়ে রশিদ নিজের বাহিনী নিয়ে বিপক্ষের গোলান্দাজির নিরাপত্তা বিধান করলেন। পরের দিন দাউদকে আক্রমণে সফল না হয়ে মিশকি ভাগলপুর ফিরে যেতে বাধ্য হয়। সেখানে তিনি মীর জুমলার ফৌজদারকে গ্রেফতার করেন। পরে সুজার দল মীর জুমলার সেনানী আলি কুলির(শামসের) ভাইপোর ১০০ বাহিনীর হাতে হেরে যায়। আলি কুলি ফৌজদারকে ছাড়িয়ে আনেন, যুদ্ধের সঞ্জাম উদ্ধার এবং খরাজ আদায় করে।

ঠিক এই সময়ে ২২ আগস্ট সুজা রাজমহল দখল করেন। সেই উত্তেজনায় তিনি ফিদায়ি খানকে নির্দেশ দেন মুঙ্গেরে গিয়ে ভাগলপুর থেকে সুরাজগঞ্জের মধ্যের এলাকার সম্রাটের বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে নদীপথ, গ্রাম দখল করে নদী পারাপার নিজের সেনা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে। তাকে খ্বোয়াজা মিশিকির সঙ্গে যোগ দিয়ে দাউদকে আক্রমন করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়। দাউদ তখন ভাগলপুর আর কলগঙ্গের মাঝে একটা এলাকায় ছিলেন। আলি কুলির ভাস্তা শামসের বিপক্ষের ফিদায়ি খানের বিপুল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে সরাসরি যায় না, ভাগলপুর থেকে জাহাঙ্গিরা(সুলতানগঞ্জের কাছে)য় উপস্থিত হন। ভাগলপুর থেকে তাড়াতাড়ি দিয়ে শত্রুর ছেড়ে যাওয়া জাহাঙ্গিরা দখল করেন ফিদায়ি ইসমাইলের কবল থেকে, প্রচুর অর্থ এবং রসদ উদ্ধার করেন, প্রত্যেক গ্রামে তরফদার এবং রহদার নিয়োগ করে ফেরি নিয়ন্ত্রণ করে সুজার পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। যুদ্ধে ইসমাইল আহত হন এবং মুঙ্গেরে মারা যান।

দাউদ যতক্ষণ বেঁচে রয়েছেন এবং তার এলাকাটি নিজের নিয়ন্ত্রণে না নিয়ে আসতে পারছেন, ততক্ষণ সুজা নিজেকে নিরাপদ ভাবছেন না। মুঙ্গেরের দুর্গ মহম্মদ হোসেন এবং তার পাঁচ সাথী নিরাপদে রেখেছিলেন। একজন মারা গিয়েছেন ইসমাইল; অন্য চার জন রাসুল, মির্জা, হাসান এবং শামসের তখনও রয়েছেন। তাকে মুঙ্গেরে দিকে না পাঠিয়ে সুজা নির্দেশ দিলেন সব ফেরি দখল নিয়ে সেখান থেকে টাকা তুলতে এবং দাউদের বিরুদ্ধে জলযুদ্ধ যুদ্ধ শুরু করতে। সেই যুদ্ধে জিতলে দাউদ ছাড়া চার ভাইকে হত্যার নির্দেশও দিয়ে তার বাহিনীকে মীর জুমলার সঙ্গে লড়ায়ের কাজে বাংলায় পাঠিয়ে দিতে। ফিদায়ের হাতে জাহাঙ্গিরা ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সময় তিনি তাকে নির্দেশ দিয়ে গেলেন দাউদকে তার বহর দিয়ে ঘিরে ফেলতে।

দাউদের সঙ্গে দ্বিতীয়বারের যুদ্ধ শুরু হল। প্রথম দিনের যুদ্ধে গোলান্দাজির পর দ্বিতীয় দিনে খুব খারাপ টিপ করে সুজার বাহিনী গোলান্দাজি করতে থাকায় দাউদের খুব বেশি ক্ষতি হল না। দাউদের নিষেধ এবং বিপুল গোলান্দাজি সত্ত্বেও বিপক্ষের নৌকোগুলি ক্ষতি করতে নদীতেই প্রচুর ঘোড়া নামিয়ে দেয় রশিদ এবং চিরাগ। সুজার বাহিনী ক্রমে বন্যার প্রকোপে ৭০০ নৌকো নিয়ে জাহাঙ্গিরায় চলে যেতে বাধ্য হয়। এই সংবাদে সুজা হতাশ হয়ে মন্তব্য করলেন ভাগ্যলক্ষ্মী তার প্রতি অপ্রসন্ন হয়েছেন। জাহাঙ্গিরায় মিশকিকে রেখে, মাসুমবাজারে থাকা ফিদায়ি খানকে সুজা নির্দেশ দিলেন সেপ্টেম্বরে(?) মীর জুমলার দখলে থাকা রাজমহল আক্রমন করতে আসা দাউদের অভিযানে নৌকো নিয়ে বাধা সৃষ্টি করতে। এই সময়ে দাউদ আওরঙ্গজেবের থেকে খবর পেলেন মুঙ্গেরে গঙ্গা পার হয়ে দিল্লি থেকে অর্থ, অস্ত্রশস্ত্র এবং রসদ, ১০০০ উইঘুর এবং উজবেগ সেনা, আবু নাবির নেতৃত্বে ৫০ জন রোজবিহানী সেনা নিয়ে আসা ফারহাদ খান আসছেন, তার জন্য অপেক্ষা করতে – এবং সেই অর্থ থেকে সৈনিকদের তিন মাসের অগ্রিম এবং নৌকোয় দিল্লি থেকে আনা ৪০টি কামান বসিয়ে ফিদায়ি এবং মিশিকির প্রতিরোধ গুড়িয়ে দিতে। তারপর দাউদ খানকে মীর জুমলার সাহায্যে পাঠিয়ে তার নির্দেশ অনুসরণ করতে। দাউদ সম্রাটের এই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে জানালেন, পাঁচ মাস ধরে যে নিরবিচ্ছিন্ন যুদ্ধ চলছে, তার জন্য খান সেনাপতিদের কিছু পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া প্রয়োজন। সম্রাট দাউদের এই অনুরোধ মান্য করে সঙ্গে সঙ্গে চিরাগের নেতৃত্বে রোজবিহানী বাহিনীকে পুরষ্কার দিতে নির্দেশ দিলেন এবং স্বয়ং দাউদের পদ মনসবদারি আরও ১০০০ বাড়ল।

কাজি কেরিয়ায় থেকে ডিসেম্বরের শুরুতে অর্ধেক বাহিনী এবং নিজেকে নৌবহরে চাপিয়ে, রশিদকে বাকি অর্ধেক সেনা নিয়ে শীঘ্র ঘোড়ায় চেপে মুঙ্গেরের দিকের গঙ্গার বাঁদিকের তীরে টহল দিতে বললেন, যদি শত্রুপক্ষ তাকে আক্রমন করে বসে। জাহাঙ্গিরায় মিশকি দাউদের অগ্রগমণ রোধ করলেন যতদূর সম্ভব পর্তুগিজ আর মেস্টিকোজদের নেতৃত্বে নিজের নৌবহর নিয়ে। মিশকির আক্রমণ চিরাগ বেগের বাহিনী রুখে দিলে, ৩ রাত ৩ দিনের চেষ্টায় দাউদ মুঙ্গেরের বাঁদিকের তীরে খুব কষ্টে উঠতে সক্ষম হন। দুর্গের হাবিলদার শত্রুর অগ্রগতি গোলান্দাজি এবং চিরাগের নেতৃত্বে ৪০টি নৌকো দিয়ে আটকে দেয়। সুজার বাহিনী ৪০টি কামান ও ১০০০০ রকেট হারিয়ে জাহাঙ্গিরায় পালিয়ে যায়। কিন্তু সেখানেও মুঙ্গের থেকে ঘোড়ায় দাউদ নিজে এবং ৭০০ নৌকোয় দুভাগে বিভক্ত আক্রমন শানিয়ে জাহাঙ্গিরা ছাড়া করেন। দাউদ সেখান থেকে মীর জুমলার বাহিনীকে সাহায্যের জন্য আবুন নবি, হাসান, মির্জা, শামসের এবং মহম্মদ রসুলকে পাঠান। তবে মিশকি মাঝেমধ্যেই দাউদকে আক্রমন করতে থাকে। এর মাঝে মীর জুমলা তাকে নির্দেশ দিলেন গঙ্গা পার হয়ে তাণ্ডায় অভিযান করে শত্রুর ধনসম্পদ দখল করে তার জন্য অপেক্ষা করতে। আর যদি তিনি বাঁদিকের তীর পার হন, তাহলে সুজাকে ধরার কাজ শুরু করতে। এর উত্তরে দাউদ বললেন এই কাজগুলি সম্পাদন করতে তার দেরি হয়ে যাবে। চিরাগের গোয়য়েন্দাদের হাতে খবর পেয়ে ভাগলপুরে সুজার সেনাপতির য়ুসুফ খানের শিবির লুঠের আক্রমন প্রতিহত করেন। মীর জুমলা দাউদের নেতৃত্ব, তার সফলতার প্রশংসা করলেন।

কলগঙ্গে যাবার দিনই দাউদের বাহিনীকে আক্রমন করে মিশকি ৭০০ নৌকো নিয়ে। কিন্তু প্রতিহত হয়ে পালানপুরে পালিয়ে যেতে হয়। তাণ্ডার দিকে যেতে গিয়ে গড়ি(তেলয়াগড়ি)তে দেখলেন রাজমহলের পথ বন্ধ করে দিয়েছে সুজার সেনাপতি বারহার সৈয়দ তাজুদ্দিন, মিশকি এবং জামাল ঘোরি। সেই মুহূর্ত্তে শক্তিশালী বিরোধী পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না করে তিনি বেলদারদের বললেন নদী থেকে একটা খাল কাটতে যাতে তার নৌকো নিয়ে তিনি তাদের কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে পারেন। দুদিক থেকে শত্রুপক্ষ তাড়াতাড়ি এসে পড়লে দাউদের পুত্র হামিদ, কাদির এবং চিরাগের নেতৃত্বে কোশিতে যুদ্ধ শুরু হল। জামাল সেই যুদ্ধে মারা যায়। মিশকি পালিয়ে গিয়ে সমধে(রাজমহলের বিপরীতে) কামান নিয়ে নতুন করে বাধা সৃষ্টি করে। মুঘল, শেখ এবং পাঠানদের নিয়ে দাউদ কোশি পার হলে পুর্ণিয়ার এক ঘোড়সওয়ার তাকে খবর দেয় যে তার বক্সী ফাতাউল্লা ৫০০ জনের বাহিনী নিয়ে পুর্ণিয়ার সুজাপন্থী ফৌজদার থেকে ৩০০০০ দিরহাম, কামান সহ ২০টি কোষা নৌকো, হাতি সুইভেল এবং প্রচুর হাউই উদ্ধার করে সম্রাটের বাহিনীর সেবার জন্য উদ্দিষ্ট করেছেন। এই বিশাল পরিমান রসদ নিয়ে নদী পেরিয়ে দাউদ অপ্রতিহত গতিতে এগোতে থাকলেন। সিক্রিগলির পূর্ব দিকে আকবরপুরে দারাইসিয়া(কালিন্দি) পার হয়ে আরও এগোবার আগে নতুন রসদ আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন।

৫। পূর্ব পাড় থেকে সুজাকে তাড়িয়ে দিলেন মীর জুমলা পালাতে থাকা সুজাপন্থী সেনানায়ক খ্বোয়াজা মিশকি শত্রুপক্ষের হাত থেকে সমধের বড় চর রক্ষার জন্য ঘাঁটি গেড়ে বসলেন। চারদিকে জলে ঘিরে থাকা এই চরটি মোটেই সুরক্ষিত নয়। অথচ এই চরটি সুজার বিরুদ্ধে আসা আক্রমণকারীদের আক্রমণ রোখার শেষতম স্থল। এটি হারানোর অর্থই হল তাণ্ডার উদ্দেশ্যে দাউদের অভিযানের রাস্তা খুলে দেওয়া এবং সেখানে রাখা সম্পদ এবং সুজার পরিবারের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা। উদ্বিগ্ন হয়ে সুজা যুদ্ধ সমিতির বৈঠক ডাকলেন। মিশকির হাত শক্ত করতে চরে বাহিনী পাঠানোর অর্থ বর্তমান যুদ্ধ এলাকায় যুদ্ধদক্ষ সেনা হারানো এবং মীর জুমলার হাতে নিশ্চিত পরাজয় বরণ। তাই সেই মুহূর্তে মীর জুমলার প্রতি সরাসরি আক্রমন না করে ঠিক হল সৈন্য নিয়ে সুজা মালদার উদ্দেশ্যে রওনা হবেন, সমধের সুরক্ষা নিশ্চিত করে দাউদের অভিযান রুখবেন। দীর্ঘকালীন দৃষ্টিতে আন্দাজ করা হল, বর্ষা কালে পূর্ব পাড়ের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে না এবং বর্ষার শেষের আগেই তিনি ফিরে এসে আবার সম্রাটের বাহিনীর মহড়া নিতে পারবেন। শাহজাদার পরামর্শে তার অবর্তমানে সুজা তার বাহিনীর পিছনের অংশটা হাতির বাহিনীর দ্বারা সুরক্ষিত করার পরিকল্পনা করলেন এই হুঁশিয়ারি দিয়েই, যারা পালাবার কথা ভাববে তাদের পরিবারকে মেরে ফেলা হবে এবং পারিবারিক সম্পত্তি কেড়ে নেওয়া হবে। শত্রু যদি এগিয়ে আসে তাহলে কামান দিয়ে তাদের আগ্রগমণ রোধ করা হবে। ২৬ ডিসেম্বরের নসিপুরে গিয়ে সুজা ভাগীরথী পার হলেন তাণ্ডার পথে যেতে সুতি পার হলেন।

কারাওয়াল(চর)দের থেকেই সুজার পশ্চাদপসরণের খবর পেয়ে মীর জুমলা প্রতিআক্রমনে গেলেন। গিরিয়ার অভিজ্ঞতায় তিনি প্রত্যেককে হুঁশিয়ারি দিলেন, যারা ভয়ে পিছনে থেকে যাবে তাদের জন্য কফিনের দরজা খোলা রইল। ২৭ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় তিন মাইল এগিয়ে তিনি বাঙলার সুবাদারকে দেখলেন একটি কাদাওয়ালা জমিতে নালার পিছনে দাঁড়িয়ে তার দুপাশে কামান সাজিয়ে রেখেছেন। এই ধরণের হাওর এলাকায় মীর জুমলার অগ্রগমণ সম্ভব ছিল না। সন্ধ্যে পর্যন্ত আক্রমনের পরিকল্পনা মুলতুবি রেখে আর এগোলেন না, শিবিরে ফিরে এলেন। সম্রাটের রসদের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ২৮ ডিসেম্বর সুজা পালালেন। সকালে সেনাপতিরা দক্ষভাবে নালাটা আর হাওর পেরিয়ে গিয়ে সুজার পিছু নিলেন। চরেরা খবর আনল সুজা তরতিপুরে ফেরি পার হবেন। দুমাইল এগোনোর খবর পেলেন, (এটি ভুল তথ্য) সুজা সুতির দিকে যাচ্ছেন। ইখলাস খান এটি জাচাই করে দেখার পর মীর জুমলা নিজে পলাতক শাহজাদার পিছন ধরলেন। পাঁচ মাইল গিয়ে তিনি ফতেপুরে বিশ্রাম নিলেন। মহম্মদ মুরাদ বেগের কামান বাহিনী রাতে এল। পরের দিন সকালে সুতি পেরিয়ে আধ মাইল গিয়ে চিলমারিতে সুজার মুখোমুখি হলেন মীর জুমলা।

সন্ধ্যে পর্যন্ত গোলান্দাজি করলেন সুজা। সম্রাটের বাহিনীর উদ্দেশ্যে আবদুল মজিদ ডেকানি, পীর মহম্মদ উইঘুর এবং অন্যান্যদের নেতৃত্বে ১০০ জনের একটি ডাকাবুকো বাহিনী তরোয়াল হাতে সুজার বাহিনীর ডানদিকের দেওয়াল ভেদ করে ঢুকে গেল। রাত একটা নাগাদ যুদ্ধ শেষ হল। সুজার পক্ষে আর জেতা নয় বুঝে নুরুল হাসান মীর জুমলার বাহিনীতে যোগ দেন। সুজা বুঝলেন যে তার পক্ষে আক্রমন আর গোলান্দাজি সমানতালে শানানো সম্ভব নয়। মীর জুমলার চেষ্টা হল সেখান থেকে সুজা যাতে নদী পার না হতে পারেন সেটা লক্ষ্য রাখা। রোজ হাতাহাতির অসংখ্য ঘটনা ঘটতে লাগল। সেখানে নদী পার হওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করে সুজা ১ জানুয়ারি ১৬৬০ সালের রাতে উত্তরে দুনাপুরের(দানাপুর?) দিকে পালানোর পরিকল্পনা করলেন। প্রচুর নালা পেরিয়ে নালার ওপর তৈরি সেতু ভেঙ্গে দুনাপুর থেকে দোগাছিতে পালালেন বিপক্ষের দেরি করিয়ে দেওয়ার রণনীতি নিয়ে। মীর জুমলা তার পিছনে পড়ে রইলেন কিন্তু হাওর, নালা আর ভাঙা সেতু তার অগ্রগতি রোধ করছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় দুনাপুরে মীর জুমলা বাহিনী আর গোলান্দাজি বাহিনীকে নালা পেরোতে হয় সেটি কাদা দিয়ে বুজিয়ে এবং খুব ধীরে ধীরে সেই পথে কামানগুলি পার করা হয় সেতু তৈরি করে। এখানে সুজার ছেড়ে যাওয়া কিছু নৌকো, গোলাবারুদ, ১০টি কামান ২০০টি হাউই উদ্ধার করলেন।

দেওগাছিতে মীর জুমলা আত্মরক্ষায় পরিখা কাটলেন। সুজা এর আগে যে সফল যুদ্ধ নীতি নিয়েছিলেন সেটি এবারেও অনুসরণ করার চেষ্টা করতে চাইলেন – দেওগাছি আর গিরিয়ার উল্টোদিকের চর দখল করা। তার বাহিনীকে অযথা গোলা বারুদ নষ্ট না করতে লুকিয়ে থাকতে নির্দেশ দিলেন তিনি, যদি শত্রুরা আক্রমণ করে তাহলেই জবাব দিতে। বিপক্ষের বিচক্ষণ সেনাপতি এই ধরণের চালাকিতে পা দিলেন না, কেননা এই খবরটি তিনি আগেই কারাওয়ালাদের থেকেই পেয়েগিয়েছিলেন। যেহেতু গোলান্দাজিতে তিনি সুজার তুলনায় পিছিয়ে রয়েছেন, সেহেতু সঠিক নজর না করে তিনিও জবাব দিতে উতসুক হলেন না। ফতে জং এবং ইসলাম খান খোঁজ খবর না নিয়ে পথপ্রদর্শকদের নিয়ে দেওগাছির নালার কাছে চলে যায়। সুজার বাহিনী হঠাতই গোলা বর্ষণ শুরু করাতে তারা আর এগোতে পারেন না।

ফিদায়ি খান এবং জুলফিকারকে সঙ্গে নিয়ে মীর জুমলা চাপ দিতে শুরু করলেন এবং চেষ্টা করলেন যদি সুযোগ আসে তো তিনি নালাটা পার হয়ে শুধুই সংখ্যাধিক্যে বিপক্ষের ওপর আক্রমন করার চেষ্টা করবেন এবং পালাবার সমস্ত পথ বন্ধ করে দেবেন। কিন্তু বিপক্ষের গোলান্দাজিতে এই আগ্রগমণ সম্ভব হয় না। তার হাল্কা কামান নিয়ে মীর জুমলা ভারি গোলান্দাজির বিরুদ্ধে দিনের শেষ থেকে মাঝ রাত পর্যন্ত লড়ার যথাযাধ্য চেষ্টা করতে থাকেন কিন্তু প্রচুর ক্ষতি হয়। এতদ সত্ত্বেও মীর জুমলা আক্রমণের ঝাঁঝ বজায় রাখেন শত্রুকে নিশ্বাস নেওয়ার সুযোগ করে দেন না, এবং কোন সুযোগ এলে সেটাও তিনি ছেড়ে দেন নি।

প্রতিদ্বন্দ্বীর গুরুতর আক্রমণের বিরুদ্ধে মীর জুমলার জোরদার প্রতিরোধ সুজাকে এতই হতোদ্যম করে দেয় যে, সে দাঁতে নখ কাটতে শুরু করে। মীর জুমলার পক্ষে ভারি কামান এসে গেলে সেগুলিকে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে যথাযোগ্যভাবে কাজে লাগাবার উদ্যম নেন তিনি এবং সেগুলি সুজার বাহিনীর পক্ষে ঘাতক হয়ে দাঁড়ায়। ফলে হাতাহাতি লড়ায়ের দিন শেষ। মাঝরাতে সুজার গোলান্দাজি বন্ধ হল। মীর জুমলাও বন্ধ করলেও কামানের মুখ শত্রু শিবিরের দিকে তাক করে রাখেন।

২ জানুয়ারি সুজা পূর্ব পাড়ে এবং মীর জুমলা তাকে অনুসরণ করে নালার পশ্চিম পাড় ধরে রাজমহলের দিকে অগ্রসর হলেন। সুজা চিন্তিত হলেন। তীরে শত্রু, ফলে নদী পার হওয়া খুব কঠিন কাজ হল। তিনি যদি নিজে সেনার আগে পার হওয়ার চেষ্টা করেন তাহলে তাকে তার বাহিনী চেড়ে চলে যাবে, আর যদি তার আগে সেনা নদী পার হয়, তাহলে তারা শত্রুর হাতে গ্রেফতার হওয়ার ভয় থাকবে। সুজা এখন তার শিবির ঘিরে গভীর পরিখা কেটে সেখানে কামানের সারি বসিয়ে দিলেন। মহম্মদ সুলতানের মতিগতি তার সন্দেহজনক মনে হওয়ায় তাকে তিনি তাণ্ডায় পাঠিয়ে দিলেন। সুজা নৌকো সেতু গড়ার চেষ্টা করলে মীর জুমলা তার দিকে বৃথা গোলা ছুঁড়তে লাগলেন। ৯ জানুয়ারি ১৬৬০, সেই সেতু করে সুজা নদী পার হয়ে গেলেন

পঞ্চম পর্ব

১। গঙ্গা পারের উদ্যম পশ্চিম পাড় থেকে সুজার পালানো এবং মীর জুমলার রাজমহলের দখল করায় দিল্লির সিংহাসন দখলের লড়ায়ের বাঙলার পর্ব শেষ পর্যায়ে পৌঁছল। পশ্চিম পাড় শত্রু কবল মুক্ত করলেই গঙ্গা পার হওয়ার সম্রাটের নির্দেশ পালন করতে মীর জুমলা বিন্দুমাত্র সময় নষ্ট করলেন না। গঙ্গার ডান দিকের তীরটি শত্রুর হঠাত আক্রমণের থেকে বাঁচাতে তিনি উদ্যোগ নিলেন। ১০ জানুয়ারি দোগাছির আভিজাতদের সঙ্গে তিনি পরামর্শ সভা ডাকলেন। এছাড়াও বহুদিন ধরে শত্রুর আক্রমনে বন্ধ থাকা নদীর ধারের রাঙ্গামাটি থেকে তেলিয়াগড়ি হয়ে মুঙ্গের পর্যন্ত রাস্তা খুলে রাখার জন্য তিনি মহম্মদ মুরাদ বেগের অধীনে ৩০০০ পদাতিক এবং গোলান্দাজ বাহিনী নিযুক্ত করলেন। ১১ তারিখে রাজমহলে দাউদ খানের নৌকোয় গঙ্গা পেরোবার জন্য এগোলেন। রাস্তায় তিনি জানতে পারলেন সম্রাটের নির্দেশে দিলির খান(সঙ্গে ২৫০০ আফগান নিয়ে) আকবরপুরে থাকা দাউদ খানের মার্ফত মীর জুমলার নির্দেশ অনুযায়ী ৯ জানুয়ারি কদমতলা ফেরিতে গঙ্গা পেরিয়েছেন। রাজমহলের প্রশাসনের ভার দেওয়া হল ইসলাম খানকে। তাকে সাহায্যের জন্য কয়েকজন দক্ষ আধিকারিক নিয়োগ করা হল। আর দেওয়া হল ১০০০০ ঘোড়া। একজন করে ফৌজদার এবং কোতোয়ালও নিযুক্ত হল। নদীর পাড় জুড়ে পরিখা খোঁড়া হল এবং শত্রু যাতে অচকিতে আক্রমন না করতে পারে তার জন্য নিয়মিত খবর রাখার চেষ্টা হল। কর্মী এবং আধিকারিকদের চাকলা এবং পরগণায় পাঠানো হল। রাজমহলের থানেদার নিযুক্ত হল রসুল বেগ রোজবিহানী। দোগাছি এবং সুতির মধ্যে অনেকিগুলি থানা তৈরি হল। ৫০০০ সেনা নিয়ে ইসলাম খান দোগাছি পাহারায় রইলেন। দুনাপুরের দায়িত্ব দেওয়া হল আলি কুলি খানকে। রাঙ্গামাটি হয়ে রাজমহল এবং তেলয়াগড়ির মধ্যের বড় জাঙ্গালের নিরাপত্তা দায়িত্ব পেলেন রাজা কোকালত উজ্জয়নিয়া তেলয়াগড়ি এবং মুঙ্গের এলাকা রক্ষার দায়িত্ব পেলেন রাজা বাহারোজ।

খুব তাড়াতাড়ি এই ব্যবস্থাপনা করে মীর জুমলা, জুলফিকার খান, রাজা বাহারোজ, রাজা কোকলত এবং অন্যান্য অভিজাত নিয়ে ১১ জানুয়ারি রাজমহলের উত্তরাঞ্চল, পীরপাহাড়ে শিবির ফেললেন। পরে তিনি কদমতলা(বা দোধা)য় শিবির স্থাপন করেন। মীর জুমলা তার অভিযানের খরচ হিসেবে সৈয়দ নাসিরুদ্দিন খানকে পাঠিয়ে মুঙ্গের থেকে ১৭ লক্ষ টাকা আনানোর দায়িত্ব দিলেন। ১৬৬০ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি তিনি সমধায় ফিরে আসেন সাড়ে চৌদ্দ লক্ষ টাকা নিয়ে।

সুজার সমধা, চৌকি-মীরদাদপুর, তাণ্ডা এবং মালদায় শিবির ভাঙ্গার কাজের দিকে এবারে নজর দিলেন মীর জুমলা – এই পরিকল্পনাটি রূপায়ণ করতে তার লেগেছিল মোট আট মাস।

২। সমধায় মীর জুমলা ১৩ জানুয়ারি দাউদের পুত্র শেখ হামিদ ১৬০টি নৌকোর বহর দোধায়(কদমতলা) নিয়ে এল। এখানে গঙ্গা তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছে। একটি ছোট ধারায় নৌকো সেতু বেয়ে মীর জুমলা পার হলেন ১৫ জানুয়ারি। এবারে সেই নৌকোগুলি রাজমহলের উল্টো দিকের বড় দুটি নদীতে নিয়ে এসে স্থাপন করা হল এমনভাবে যাতে বিপুল পরিমান সেনা ও রসদ নদী পার হয়ে চরে পৌঁছতে পারে। ১৭ জানুয়ারি মীর জুমলা নিজে চরে পৌঁছলেন দ্বিতীয় বড় নদীটি পেরিয়ে।

মীর জুমলার দ্রুত পদচারণ সুজার পরিকল্পনা নষ্ট করে দিল। তিনি প্রস্তাব দিলেন মহম্মদ সুলতানকে কামান এবং নৌকো দিয়ে মহানন্দায় দিলির এবং দাউদ খানের অভিযানে বাধা দান করতে। তিনি নিজের সব নৌকো ডাক দিলেন, শাহজাদার কাছে যেগুলি ছিল সেগুলিও চেয়ে পাঠালেন এবং চরেদের নিয়োগ করলেন সমধার নাবিকদের অপহরণ করতে।

সুজার এই পদক্ষেপ রুখতে মীর জুমলাও পরিকল্পনা ছকতে শুরু করেছেন। যথা শীঘ্র সম্ভব তৃতীয় নদীতে নৌকোর সেতু তৈরি করার উদ্যম নিলেন। সুজার চরেদের আটকানোর ব্যবস্থা করলেন। স্থানীয় মাঝিরা যাতে সুজার পক্ষে যোগ দিতে না পারে তার জন্য তিনি ১০০০ বাহিনীর একটি থানা তৈরি করলেন সমধায়। সমধায় যে দিন মীর জুমলা উপস্থিত, সেই দিন দুপুরেই আকবরপুর(নদীর উলতো দিক থেকে) থেকে দিলির দাউদ এবং রশিদকে ডাকিয়ে এনে বৈঠক হল।

মীর জুমলার সমস্যা যে শুধু সুজার থেকে কম নৌকো তাই নয়, তার বিশাল বাহিনীও এই হাওর, প্রচুর নালা, বিশাল জঙ্গুলে এলাকায় বোঝা হয়ে দাঁড়াল কেননা তারা যে খুব তাড়াতাড়ি চলতে পারছেনা সেটা তার কাছে পরিষ্কার। তিনি মন্তব্য করলেন, এই এলাকা খুবই খারাপ, এরা প্রত্যেক বাঁকে যেন একটা করে নালা গুঁজে রেখেছে।

খোলা মাঠে সাম্রাজ্যের বাহিনীকে তাদের বহরের জোরে পারবেন না বুঝে সুজা তাদের প্রতিরোধের রাস্তা নিলেন মহানন্দা এবং কালিন্দী ধরেই। মীর জুমলার সরাসরি তাণ্ডায় যাওয়া আটকাতে মহানন্দার শাখা কালিন্দিতে তিনি দুই সারি পরিখা খনন করলেন এবং সেটির দায়িত্ব দিলেন সৈয়দ তাজ এবং মিশকিকে। সমধার উল্টো দিকে চৌকি-মীরদাদপুরের ঘাটে মহম্মদ সুলতানের সঙ্গে সুজা স্বয়ং রইলেন।

মীর জুমলাকে হুঁশিয়ার আর সাবধান হয়েই পদক্ষেপ করতে হবে। শত্রুপক্ষ সমধার মাত্র চার মাইল দূরে কালিন্দিতে ভারি কামান সাজিয়ে রেখেছে, ফলে তিনি তক্ষুণি সেখান ছেড়ে আরও পূর্বের দিকে এগোনো সমীচীন বোধ করলেন না। এটি ছেড়ে যাওয়ার অর্থই হল সমধার পতন এবং রাজমহলকে সরাসরি শত্রুর আক্রমনের নিশানায় নিয়ে আসা। তিনি যদিও তৃতীয় ধারাটি তাড়াতাড়ি পেরোতে চাইছিলেন, আগামী কয়েকদিন, অন্তত ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি তার সদরটি সমধায় রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

এ ছাড়াও মীর জুমলার পক্ষে সুজাদের কাটা পরিখা এবং সৈয়দ তাজ এবং মিশকির তৈরি করা নিরাপত্তা ভেদ করা আত্মহত্যার সামিল হবে। প্রথমে তিনি কালিন্দি আর মহানন্দার মোহলায় কালিন্দি পার হওয়ার চেষ্টা করবেন এবং তার পরে অভিজ্ঞ দাউদ এবং দিলিরের পরামর্শ অনুযায়ী মহানন্দা পার হওয়ার চেষ্টা চালাবেন। কিন্তু তার কাজ থেকে শত্রুপক্ষের দৃষ্টি ঘোরাতে তিনি দুজন খানকে নির্দেশ দিলেন শত্রুর মুখোমুখি কোথাও একটা দেখিয়ে দেখিয়ে পরিখা কাটার অভিনয় করবেন।

পরিখা কাটার কাজ চলতে থাকলে সমধায় মীর জুমলা, চৌকি-মীরদাদপুরে থাকা সুজার শিবিরের ওপর গোলান্দাজি চালান। পরিখা কাটা শেষ হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও পরস্পরের ওপর গোলান্দাজি সপ্তাহ কাল ধরে চলতে থাকল। তা সত্ত্বেও দেখা গেল শত্রুর এলাকা ছাড়ার লক্ষ্মণ দেখা যাচ্ছে না, গঙ্গার পূর্বপ্রান্তের এক শাখা নদীতে মীর জুমলা হাঁটু জল খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে গেলেন। পরিখা নিরীক্ষণ করার সময় ডুবুরি দিয়ে গঙ্গার তল খোঁজারও কাজ ব্যক্তিগত উদ্যোগে চালালেন। কিন্তু নদীর তল পাওয়া গেল না।

হঠাতই মীর জুমলার চরেরা মহানন্দার উপরের উচ্চ অববাহিকায় গুণরাখা নামক একটি এলাকায় হাঁটু জলস্তর আবিষ্কারের খবর আনল। সাম্রাজ্যের একটি শিবিরের থেকে ৮ মাইল দূরে, অন্যটির থেকে ৪ মাইল। যাইহোক সামগ্রিক রণনীতিতে এই খবরটির গুরুত্ব অপরিসীম। এলাকাটি জঙ্গলে পরিপূর্ণ, সেই জঙ্গলে বাস করে জংলি কুয়ার গোষ্ঠী এবং সেই এলাকা হেঁটে পার হওয়া সম্ভব। ১৬৬০ সালের ৩১ জানুয়ারির রাতে ফারাদ খানের সঙ্গে কারাওয়াল আর বেলদার দিয়ে নদী পার হয়ে সেখানে পরিখা খোঁড়ার কাজ দিলেন যাতে শত্রু পক্ষ তাদের রাস্তা আটকাতে না পারে। পরের দিন ১ ফেব্রুয়ারি জুলফিকার, ফিদায়ি এবং লোদি খান যুদ্ধ করার ভান করলে মীর জুমলা, মুখলিস খানকে নিয়ে দিনের দেড় প্রহরে নৌকোর সেতু বানিয়ে গঙ্গার পূর্বপ্রান্ত পার হয়ে গেলেন।

এবারে মীর জুমলা হাঁটু জলের এলাকা পার হওয়ার জন্য এগোলেন দিলির, দাউদ, মীর্জা, আর রশিদ খানকে সঙ্গে নিয়ে। মীর জুমলার ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে বেলদার, কারাওয়ালা, উজবেগ এবং নানান রসদ নিয়ে ৫০ গজ চওড়া মহানন্দা পার হলেন ৩ দিনে ১–৩ ফেব্রুয়ারি। ঘোড়াগুলি সাঁতরে পার হল। মীর জুমলার নির্দেশে ৩০টা ডোবানো নৌকো তোলা হল – কোনটা কামান বাহক কোনটাকে সেতু তৈরির কাজে লাগানো হবে। ফারহাদের তৈরি পরিখা, এবং গোলান্দাজি, পীর মহম্মদের লাজবাব কারাওয়ালদের দৌলতে শত্রুদের দূরে থাকা একটা বাহিনী তাদের নদী পার হতে দেখলেও কিছু করে উঠতে পারল না, বরং তাদের নেতা আমীর কুলি মারা গেল।

সৈয়দ তাজ আর মিশকির উল্টোদিকে থাকা দিলির আর দাউদের কাটা পরিখার দায়িত্ব আবদুল্লা খানসারাই, সৈয়দ সালার খান, মিয়ানা খান, জামাল দিলিজাককে দিয়ে, মীর জুমলা স্বয়ং সমধায় এলেন, এখানেই সেনাবাহিনীর বড় অংশটাই শিবির গেড়ে ছিল, যাতে শত্রু নদী পেরোতে না পারে।

মীর জুমলার চালে মাত হয়ে যাওয়া সুজার দুই সেনাপতি সৈয়দ তাজ এবং মিশকি আতঙ্কিত হয়ে ৩ ফেব্রুয়ারি সুজার শিবিরে ফিরে গেল। সুজা শত্রুপক্ষের সহজে মহানন্দা নদী পার হওয়া, চরেদের হাতে ৩ জন সুজাপন্থী সেনা ধরাপড়ার ঘটনায় মর্মাহত হলেন। অথচ তার পক্ষে কোন পদক্ষেপ করা বা মুখোমুখি সংঘর্ষে যাওয়া সমুচিত বোধ হল না। হতাশ হয়ে পড়া সুজার মনোবল চাঙ্গা হয়ে উঠল ঢাকা থেকে সৈয়দ আলম জাইনুদ্দিন আর ১৫০০ রিসালা আর ২০০ কামান পৌঁছনোয়। বর্ষা পর্যন্ত জলে চোবানো দুর্গটি রক্ষা করার পরিকল্পনা করে তিনি সমধার উল্টো দিকের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে নির্দেশ দিলেন।

৫ ফেব্রুয়ারি দিলির আর দাউদ ছেড়ে যাওয়া পরিখার কাছে এলেন। চিরাগের নেতৃত্বে দিলিরের রোজবিহানী বাহিনী গোলান্দাজির জন্য সেতুটি আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হলেও তারা উল্টো দিকে কিছু নৌকো দেখতে পেল। দিলির এবং দাউদের ২ মাইল দূরের মহানন্দার নালা হেঁটে পার হওয়ার কাজ দেখতে এবং তত্ত্বাবধান করতে মীর জুমলা গঙ্গা এবং মহানন্দার পূর্বপ্রান্ততম শাখাটি পার হলেন সেতু তৈরি করে ৭ ফেব্রুয়ারি। পরের দিন তিনি সৈয়দ সালার খান, মিয়ানা খান, জামাল দিলজাকের নেতৃত্বে ১০০০ ঘোড়সওয়ার, বহু পদাতিক এবং কামান মালদার দিকে পাঠালেন পূর্ব দিক থেকে সুজাকে ঘিরে ফেলতে এবং তার পূর্ব দিক হয়ে পালাবার পথ আটগকে দিতে। ইতিমধ্যে সুজার দক্ষিণ, পশ্চিম এবং উত্তরপ্রান্ত হয়ে পালানোর পথ যথাক্রমে রাজমহল থেকে সুতি এবং সমধা থেকে মহানন্দা পর্যন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে পাহারা বসিয়ে। সুজা এখন সর্বনাশের মুখে দাঁড়িয়ে। সুজার বাহিনী মালদা ছেড়ে গেল। মীর জুমলার নির্দেশে দাউদ খান, আমীর খান, রসিদ খান এবং তাদের সবকটি বাহিনী গঙ্গা এবং মহানন্দার মধ্যে পরিখা কাটতে শুরু করল।

৩। শাহজাদা মহম্মদ সুলতান ফিরে এলেন সুজার বিপদ চরমে দেখে শাহজাদা মহম্মদ সুলতান তার শ্বশুরকে ফেলে সম্রাটের শিবিরে ফেরত এলেন। আলমগীরনামা বলছে তার ধারণা হয়েছিল সুজা এখন হারা যুদ্ধ লড়ছে, হারার শিবিরের অংশিদার তিনি হতে চান না। তার ভুল বুঝতে পেরে শাহজাদা তাণ্ডায় তার অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে যাবার ছলে রাজমহলের সাম্রাজ্য শাসক ইসলাম খানকে খবর পাঠিয়ে বললেন দেওগাছি থেকে আসা তার বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করতে। কিন্তু আসল কারণ ছিল অন্য। এর আগে বলা গিয়েছে সুজা যখন পশ্চিম প্রান্ত ছেড়ে যেতে বাধ্য হচ্ছেন তখন তিনি শাহজাদাকে আগে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। এবং পূর্বপাড়েও যখন নিজের সুরক্ষায় সুজা লড়ছেন, তখনও কিন্তু আমরা শাহজাদার দেখা পাইনি। সুজার পক্ষে শাহজাদাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া তার চরিত্রের সঙ্গে খাপ খায় না, কেননা তিনি সুজাকে অনেক সেবা করেছেন, তার বহু আভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এটা বলা যায় যে সুজার মনে শাহজাদার বিষয়ে কিছু না কিছু সংশয় তৈরি হয়েছিল। এই সিদ্ধান্তে আমরা আসতে পারি আলমগীরনামা এবং সেই সময়ের ইওরোপিয় ভ্রমণকারীদের রচনা সূত্রে।

এই ঘটনার নেপথ্যে কিছুটা মীর জুমলার কূটনৈতিক চাতুর্য রয়েছে। এই চাতুর্যের ঘটনা মনে পড়িয়ে দেয় শাহজাদা আকবরের বিদ্রোহকে যেভাবে আওরঙ্গজেব সামলেছিলেন। আওরঙ্গজেবের পরামর্শে শাহজাদার উদ্দেশ্যে মীর জুমলা একটি চিঠি লেখেন যার সারতসার হল, তিনি চান শাহজাদা সুজার কাছে থাকুন যাতে তিনি সম্রাটের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে পারেন এবং তিনি তার পিতাকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, সেই প্রতিশ্রুতি যতদিন না তিনি পূর্ণ করতে পারছেন, ততদিন যেন তিনি সুজার শিবিরেই অবস্থান করেন। উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে চিঠিটি সুজার হাতে পড়ল, স্বভাবতই সুজা সন্দেহ করতে শুরু করলেন শাহজাদার কাজকর্ম। শাহজাদা শ্বশুরকে জানালেন এই ঘটনায় তার কোন হাত নেই। এটা জাল, এবং এটা উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে সুজার সঙ্গে বিরোধ ঘটাতে লেখা হয়েছে। যদিও আলমগীরনামায় এই ঘটনার সঙ্গে মীর জুমলা বা আওরঙ্গজেবের জড়িত থাকার কোন সূত্র দেওয়া হয় নি; পরের লেখকেরা কিন্তু এই ঘটনায় মীর জুমলারই অদৃশ্য হাত দেখতে পেয়েছেন। ঈশ্বরদাস লিখছেন, তিনি তাবির এবং তাজবীর অনুসরণ করে খেলাটা খেলে দিলেন এবং শাহজাদাকে তার শিবিরে ফিরে আসতেই হল। সুজার সন্দেহ জাগার সঙ্গে সঙ্গে তার জামাইও ভাবলেন এই সুযোগে শিবির বদল করা যাবে। তিনি আর হেরো দলের সঙ্গে থাকতে চান না। তিনি যতদিন সুজার সঙ্গে চৌকি-মীরদাদপুরে ছিলেন ততদিন তার পক্ষে কোন পদক্ষেপ করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু যখন তিনি তাণ্ডায় গেলেন – আলমগীরনামার কবিতা সূত্র বলছে সুজার নির্দেশে তাঁর অসুস্থ স্ত্রীকে দেখতে, সেই সময় তিনি দেওগাছি থেকে গোপনে ইসলাম খানের সঙ্গে চিঠি আদানপ্রদান করতে শুরু করলেন। ঢাকা থেকে সুজার পুত্র দীন মহম্মদের নির্দেশে খানইআলমের নেতৃত্বে নতুন বাহিনী এসে পৌঁছনয় শাহজাদার ব্যক্তিত্বে আঘাত লাগল। তার মনে হল তাকে বাদ দিয়েই সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে যাচ্ছে, এবং এটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুঘল ঐতিহ্যের পরিপন্থী বলে তার মনে হল। ঠিক যে রকম করে তিনি তার পিতা আর তার পিতার সেনানয়কএর ওপর রাগ করে একদিন শ্বশুরের শিবিরে যোগ দিয়েছিলেন ঠিক সেই রকম সিদ্ধান্ত হঠাতই সিদ্ধান্ত নিয়ে তিনি আমার তার পূর্বের ছেড়ে আসা শিবিরে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন। ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় শাহজাদা তাণ্ডা ছাড়লেন দেওগাছি যাবার উদ্দেশ্যে। সেখানে তাকে স্বাগত জানাতে অপেক্ষা করছিলেন সেনানী ইসলাম খান, সঙ্গে ১৮টি ইরাণী সোনার কিংখাব (জরবাফত), মৃগনাভি, ৩৬টা সিন্দুকে সোনা, হিরে এবং একটা নীলকান্ত মণি। সুজা শাহজাদার এই কাজে গভীরভাবে দুঃখ পেলেন। তার মনে হল, তার হাত থেকে গ্রেফতারি এড়াতে শাহজাদা পালিয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারলেন যে ভাগ্যের চাকা তাকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে, সুজা বললেন, আমার চোখের জল আমার ভাগ্য... যাকে আমি তৈরি করলাম, সেই আমার শত্রু হল।

সেই মাঝইরাতেই প্রথম সংবাদবাহক মীর জুমলাকে এই সংবাদটা দিল। মীর জুমলা মহানন্দার পূর্বপাড় থেকে সমধায় ফিরে এলেন ১২ ফেব্রুয়ারি শাহজাদাকে স্বাগত জানাতে। তাঁকে সম্মান জানিয়ে নিজে তার ঘোড়া থেকে নামলেন এবং ভেরি বেজে উঠল। তার জন্য সরকারি খাজাঞ্চিখানা থেকে প্রয়োজনীয় রসদ জোগাড় করাছিল, এ ছাড়াও তাকে দেওয়া হল ৪০ পেটি সোনা, নীলকান্ত মণি, জহরত, ৮টি ইরাণের সোনার কিংখাব, মৃগনাভি, রাম(?) এবং য়ুনান(?), ইজিপ্ট এবং সিরিয়া থেকে জোগাড় করা সোনার জিন সহ ৪০টা আরবি ঘোড়া, আর হাতি। এই আড়ম্বরীয় সম্মান দেখানোর পিছনে উদ্দেশ্য একটাই, শাহজাদাকে তার মার্জনাহীন পিতার হাতে তুলে দেওয়া। ইসলাম খানের পরামর্শে শাহজাদা মীর জুমলার আশ্রয়ে এসেছেন, যতক্ষণনা সম্রাটের থেকে কোন প্রতিক্রিয়া আসছে, তার পক্ষে সরাসরি সম্রাটের কাছ এই জটিল মামলা শাহজাদার পক্ষ নিয়ে পাঠানো খুব কঠিন হবে। মীর জুমলার চেষ্টায় পুত্রের ফেরত আসায় সম্রাট স্বস্তি প্রকাশ করলেন কিন্তু তার প্রধান সেনানীকে নির্দেশ দিলেন তাকে চোখে চোখে রাখতে। তবুও মীর জুমলা শাহজাদাকে চিন্তা না করতে বলে বললেন তার পিতা বরাবরের মত ক্ষমাশীল। ২৯ ফেব্রুয়ারি তিনি ফিদায়ি খানকে দিয়ে শাহজাদাকে দরবারের উদ্দেশ্যে পাঠালেন।

৪। তাণ্ডার দিকে মীর জুমলার অভিযান সুজার আশেপাশের ঘিরে থাকা পরাজয়ের জালটিকে আরও ঘণ করে সুজার ওপরে ফেলার চেষ্টা করে চললেন মীর জুমলা। প্রথমে মহানন্দা এবং পরে দক্ষিণের দিকের পালানোর পথটিতেও পাহারা বসিয়ে দিলেন। স্থানীর জমিদারদেরে থেকে খবর পেলেন যে বালাঘাটের কাছে নিচের অববাহিকায় হাঁটু জল থাকতে পারে এবং শত্রুর রসদ এই পথেই যায়। সেখানে গিয়ে মালদার পথ কেটে দেওয়ার নির্দেশ দিলেও এই ঘটনা আঁচ করে সময় মত সুজার পুত্র বুলন্দ আখতার এবং সেনাপতি সৈয়দ আলম ডান পাড় পাহারা দেওয়ায়, সম্রাটের বাহিনীর সেই উদ্দেশ্য পূরণ হল না। মীর জুমলা সময় নিলেন। মালদায় সুজার বাহিনী তার সেখানকার বাহিনীর থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী বুঝে তিনি দিলির খানকে নির্দেশ দিলেন মালদার বাহিনীকে জোরদার করতে এবং তাকে তিনি মালদা-বালাঘাট এলাকার সমস্ত কাজের সেনানায়ক বানিয়ে দিলেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি শিবির ছেড়ে দিলির দক্ষিণের দিকে এগোলেন, রাস্তায় শীতলঘাটে সুজার সেনাপতি মির্জা বেগের বাহিনী হারিয়ে, মহানন্দায় সৈয়দ আলম এবং বুলন্দ আখতারের তীরের উল্টো দিকে ঘাঁটি গাড়লেন।

বাঁদিকের পাড়ের একটি অংশের সেনার হারের খবর সুজার কানে পৌঁছল। তখন তিনি কালিন্দির দক্ষিণ তীরে দাউদ খানের সেনার উল্টো দিকে জান বেগ আর ইবন হুসেনের ছোট বাহিনী নিয়ে পাহারা দিচ্ছিলেন। পুত্র বুলন্দ আখতার আর খানইআলমকে মহানন্দার পূর্ব পাড়ের অংশটা জোর দিতে বলে সুজা সমধার উল্টো দিকে তার নিরাপত্তা জোরদার করলেন। তিনি জানেন এটি হাতছাড়া হওয়া মানেই তার বাহিনীর কচুকাটা হওয়া এবং তার সাম্রাজ্যের পতন।

ঈশপের গল্পের এক চক্ষু হরিণের মত তার সব কিছু সমধার পতনে নির্ধারিত হবে এই চিন্তায় সুজা বড় ভুলটি করে ফেললেন। সুজাকে ব্যস্ত রাখতে মীর জুমলা তার উল্টো দিকে কিছু সৈন্য দাঁড় করিয়ে রেখে মহানন্দার পূর্ব পাড়ের অংশটির প্রতি নজর দিলেন। হেঁটে নদী পার হওয়ার একটাই অসুবিধে ছিল তাকে ব্যক্তিগতভাবে সেই কাজটায় জড়িয়ে থাকতে হবে, না হলে সমস্যা দেখা দিতে পারে। উত্তরের যুদ্ধ ক্ষেত্রে দাউদ খানকে সমস্ত দায়িত্ব দিয়ে সমধায় সুজন সিংকে ১০০০ সেনা আর ৫০০০ বন্দুকবাজ দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে, মীর জুমলা চরটি ছাড়লেন ২৯ ফেব্রুয়ারি। পরের দিন মহানন্দা পার করে মালদার দিকে এগোতে থাকলেন(২ মার্চ)। ৬ তারিখ তিনি মালদার দক্ষিণে মহানন্দার কাছে পৌঁছলেন। পরের দিন তিনি উল্টো দিকে বুলন্দ আখতার এবং সৈয়দ কুলি উজবেগের বাহিনীর দিকে তাক করে পরিখায় কামান খাড়া করা দিলির খানের সাজসজ্জা পরিদর্শন করতে গেলেন।

মীর জুমলা ঢাকা থেকে শত্রুর কাছে পাঠানো রসদের রাস্তায় বাধা তৈরি করার উদ্যম নিলেন। সে অঞ্চল থেকে ঢাকার পথে যাওয়া তিনটি স্থলপথ। দুটি - একটি বালাঘাট হয়ে একটি মালদা হয়ে – নিয়ন্ত্রণ করছে সাম্রাজ্যবাদীরা। তৃতীয় পথটি শেরপুর হাজারাহাটির রাস্তাটি পাহারা দিতে লোদি খানকে নির্দেশ দিলেন।

সুজা আর মীর জুমলার মধ্যেকার দ্বৈত লড়াই এখন সময়ের অপেক্ষা। মীর জুমলা বিপক্ষকে ভুলপথে চালিত করার কাজ আগেও সফলভাবে করেছেন, এবারেও সেই নীতি অনুসরণ করলেন। উত্তরে সুজার বাহিনীর নজর টিকিয়ে রাখার জন্য মীর জুমলা কালিন্দির মধ্যে দিয়ে বলপ্রয়োগ করে সুজার পরিখা ভেদ করে দাউদ খানকে একটা পথ তৈরি করতে নির্দেশ দিলেন। এক মাসের জন্য সমস্ত সুযোগ সুবিধে এবং বিলাসিতা ছেড়ে তিনি মহম্মদাবাদের পড়ে রইলেন যাতে সুজার সঙ্গে যুদ্ধটা তিনি বর্ষার আগেই সেরে ফেলতে পারেন। কিন্তু যতটা সহজে কাজটা হবে ভেবেছিলেন, সুজার বাহিনী, পরিখায় দৃঢভাবে দাঁড়ানো সেনা, গোলান্দাজি, নদী আর নদীতে নৌবহরের জন্য মীর জুমলার কাজটা ততটাই কঠিন হয়ে উঠল।

দিলির খানের বহু চেষ্টা, বহু খোঁজাখুঁজি, বহু পাহারা না দেওয়া, বহুদিন না হাঁটা নদী পথ দেখে দেখে যখন ক্লান্ত, তখন স্থানীয় এক রাজার চেষ্টায় নদীতে একটা পায়ে হাঁটা পেরোবার পথ পাওয়া গেল বালাঘাটের ৪ মাইল নিচে। মীর জুমলা সঙ্গে সঙ্গে এই একমাত্র পথটি যাতে হাত ছাড়া না হয়, অবিলম্বে তার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলেন। প্রাথমিক সব প্রস্তুতি নেওয়ার পর শিবির ছেড়ে মহানন্দার পাড়ে দাঁড়িয়ে ৫ এপ্রিল ভোর তিনটের সময় ১০-১২ হাজার পদাতিক নিয়ে বালাঘাট থেকে দিলির খানকে তুলে ভোরে নদী হাঁটতে নামলেন। সূর্য উঠতে অবাক হয়ে দেখলেন উল্টো দিকে একটা ছোট শত্রু শিবির কয়েকটি কামান তাদের দিকে তাক করে বসে রয়েছে।

এক মুহূর্ত দেরি না করে মীর জুমলা তার বাহিনীকে জলে নামতে নির্দেশ দিলেন। দিলির খান, ইখলাস, মুখলিস এবং মুজফফর সবার আগে নেমে তাদের হাতি জলে ভাসিয়ে দিলেন। তার পরে রিসালা জলে নামল। দুই তীরের দুই পাশে গভীর জল, কিছু সেনা তাড়াতাড়িতে আবার শত্রুর গোলান্দাজির ভয়ে নদীতে নেমে হাঁটা পথ হারিয়ে ফেলে ডুবে গেল, কিছু শত্রুর গোলান্দাজিতে মারা পড়ল - এই সবে বিন্দুমাত্র দমে না গিয়ে তার দূরের লক্ষ্যে মীর জুমলা অটল রইলেন। ১০০০ সেনা মারা গেল। ততক্ষণে সাম্রাজ্যের সেনা নদী পেরিয়ে বিপক্ষকে কচুকাটা করে ফেলেছে, কিছু তাদের সমস্ত রসদ ফেলে পালিয়ে গিয়েছে। মীর জুমলা দীর্ঘ লক্ষ্য পূরণে এই ক্ষতি খুব একটা গায়ে মাখলেন না। বহু পরে শাহজাদা বুলন্দ আখতার আর সৈয়দ আলমের বাহিনী এল, ততক্ষণে তাদের বিশাল বাহিনী স্থানীয়ভাবে নৌকো জোগাড় করে সেতু বানিয়ে নদী পার হয়েগিয়েছে।

সিংহাসন দখলের লড়াইতে এই পর্বের যুদ্ধটায় মীর জুমলা জেতার খেলা খেললেন। বুলন্দ আখতার তাণ্ডা ছেড়ে পালালেন, আর সৈয়দ আলম পালিয়ে দুপুরে চৌকি-মীরদদপুরে পৌঁছে সুজাকে এই দুঃসংবাদ দিলেন। দাউদের তীরের উল্টোদিকে দাঁড়ানো সুজার তিনপাশ তখন ঘিরে ফেলেছে মীর জুমলার বাহিনী। তার সামনে একটাই পথ নদী পথে দ্রুত পালিয়ে যাওয়া। মির্জা জান বেগের পরামর্শে তিনি রাতে চৌকি-মীরদাদপুর ছেড়ে ভোর চারটেয় তাণ্ডা পৌঁছলেন ৬ এপ্রিল। সন্ধ্যে ৪টেয় কয়েকটি যুদ্ধ নৌকোয় চড়ে তিনি ঢাকার দিকে রওনা হয়ে গেলেন।

৫। তাণ্ডা-তারতিপুর-ঢাকা সুজা পালিয়ে যাওয়ার, মীর জুমলা যথেষ্ট সময় পেলেন কেন না হাঁটু জলে নেমে তার বিশাল বাহিনী সামলাতে, নদীতে পড়ে যাওয়া নানান রদস এবং অস্ত্রশস্ত্র তোলার জন্য মাছ ধরার জাল ফেলতেই বহু সময় কাটিয়ে দিয়েছেন, ফলে তাণ্ডার দিকে তাড়াতাড়ি রওনা হতে পারেন নি।

৬ এপ্রিল যখন সুজা টাণ্ডার দিকে তখনও মীর জুমলা ব্যস্ত। সকালে তিনি তাণ্ডার দিকে রওনা হলেন। রাস্তায় তিনি কিছুটা বাঁয়ে তারতিপুরে গিয়ে সুজার গঙ্গার ওপর দিয়ে পালানোর পথ বন্ধ করতে গিয়ে রসদে বোঝাই ৪০০টি নৌবহর পেলেন। সেখানে তিনি ৬০০ বন্দুকবাজ সহ নুরুল হাসান আর মীর আজিরকে ওয়াকিয়ানবিশ হিসেবে রেখে এলেন। মধ্য রাত্রে ৪০০ সেনা বাহিনী নিয়ে তিনি তাণ্ডায় পৌঁছলেন।

মীর জুমলার পৌছন যেন ঘোলা জলে তেল পড়ার মত হল। কিছু ক্ষণের লুঠ খুন আর তাণ্ডবের পর, ৭ এপ্রিল তিনি সব কিছু নতুন করে সাজিয়ে তোলার নির্দেশ দিলেন। সরকারি সমস্ত সম্পদ, সম্পত্তি আর সেনা যে সব জিনিস লুটেছিল সেগুলি উদ্ধারে মন দিলেন। সুজা যে সব মহিলা হারেমের মহিলা ছেড়ে গিয়েছিল সেটির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করে আধিকারিক আর খোজাদের দায় দায়িত্ব পালন করতে বলা হল। এই সন্ধ্যায় দাউদ খান মীরদদপুর হয়ে তাণ্ডায় পৌঁছলেন।

মীর জুমলা তাণ্ডায় ১২ দিন ধরে থেকে সব কিছু নিয়মতান্ত্রিকভাবে শৃঙ্খলিত করলেন। জেতার এলাকায় প্রশাসন বসালেন। পলাতক শাহজাদার থেকে সম্পত্তি এবং ভাণ্ডার উদ্ধার করতে দক্ষিণ দিকে মীর জুমলা নদীর পাড়ে পাহারা বসালেন। তারা তারতিপুরে ধনরত্নভর্তি দুটি ঘুরাব দখল নিল। হাজারাহাটি আর শেরপুরে সুজার আধিকারিক সহ নৌবহরের ৩০টি নৌকো দখল নিল লোদি খান। তারা মীর জুমলার সামনে ৯ এপ্রিল আত্মসমর্পণ করল এবং সম্রাটের সেবায় কাজে লেগে গেল।

যুদ্ধের বিশদ বর্ণনা আর দিলির খানের গুণবত্তা বর্ণনা দিয়ে দিয়ে মীর জুমলা সম্রাটকে চিঠি লিখলেন এবং আশা করলেন, সুজা হয়ত ঢাকায় না গিয়ে আরাকানের দিকে পালিয়ে যাবে। এছাড়াও যুদ্ধের সরঞ্জামগুলি তিনি দরবারে পাঠাবেন কি না সেই প্রশ্নও করলেন। ২০ এপ্রিল চিঠি পেয়ে সম্রাট খুব খুশি হলেন। তিনি সেনানায়ককে পুরষ্কৃত করে বললেন যাতে প্রত্যেক সেনাকে যথাযোগ্য বেতন দেওয়া হয়। রসদগুলি দরবারে পাঠিয়ে ঢাকায় গিয়ে সুজাকে তাড়িয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন।

১৯ এপ্রিল মীর জুমলা তাণ্ডা থেকে তারতিপুরের দিকে রওনা হয়ে গেলেন। ইসলাম খানের যায়গায় রাজমহলের ফৌজদার করে তিনি মুখলিস খানকে পাঠালেন। ইসলাম খানের সঙ্গে মীর জুমলার ঝগড়ার পর সম্রাটের অনুমতি না নিয়ে সে দরবারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়।

২০ এপ্রিল ঢাকার উদ্দেশ্যে স্থলপথে বেরিয়ে তারতিপুর ছেড়ে মীর জুমলা হিজরাপুরে পৌঁছলেন। তার সঙ্গে ছিলেন দিলির খান, দাউদ খান, রশিদ খান, সৈয়দ নাসিরুদ্দিন খান, ফরহাদ খান, উইঘুর খান, কারাওয়াল খান, এবং আবদুল বারি আনসারি। ঢকা থেকে সুজাকে তাড়াতে তিনি দ্রুত ঢাকা চললেন। যেসব জমিদার সুজাকেকে ছেড়ে গিয়েছে তাদের শাস্তি দিতে সুজা এখন অপারগ, অথবা তার দিকে এগিয়ে আসা সেনাপতির সঙ্গেও লড়ায়ের সাধ্য না থাকায় তার পূর্ব দিকের রাজধানী ছেড়ে ৬ মে আরাকানের রাজার থেকে সাহায্যের আশায় ঢাকা ছেড়ে পালালেন। ঢাকার বাইরে মীর জুমলা পৌঁছলেন ৯ মে। সুজা যে সব যুদ্ধ রসদ ছেড়ে গিয়েছেন সেগুলি সম্রাটের উদ্দেশ্যে পাঠালেন। এখন সমগ্র হিন্দুস্তান সম্রাটের আধীনে হল।

ষষ্ঠ পর্ব ইওরোপিয়দের সঙ্গে মীর জুমলার সম্পর্ক(১৬৫৮-৬০)

১। জাহাজ পর্ব তখনও সমাধা হয় নি ১৬৫৮র চুক্তিতে গ্রীনহিলের কুঠিয়ালির সময় মীর জুমলার যে জাহাজটি ব্রিটিশেরা দখল করেছিল, সেই পর্ব তখনও সমাধানের পথে হাঁটে নি। গ্রিনহিল সেটি এডোয়ার্ড উইন্টারকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন, উইন্টার সেটি ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করছিলেন। মুঘল সাম্রাজ্যে মীর জুমলার বাড়তে থাকা প্রভাবে শঙ্কিত হয়ে সুরাটের আধিকারিকরা মাদ্রাজ দপ্তরকে জানাল(২৭ নভেম্বর ১৬৫৮) উইন্টারের থেকে জাহাজটির দাম উসুল করা হোক। মীর জুমলাকে শান্ত করা না গেলে মছলিপত্তনম এবং অন্যান্য এলাকার ব্যবসা সঙ্কটে পড়তে পারে এমন কি বন্ধও হয়ে যেতে পারে। কমিটি অব নিউ জেনারেল স্টক(১৩ সেপ্টেম্বর ১৬৫৮) এই বিষয়ে কোন দায় নিতে অস্বীকার করে এবং কুঠিয়ালদের হুঁশিয়ারি দিয়ে আগামী দিনে স্থানীয় রাজনীতিতে মাথা ঢোকালে কি হাল হতে পারে তা এই ঘটনাটা থেকে শিক্ষা নিতে।

মীর জুমলার জাহাজ উদ্ধারে সম্রাট আওরঙ্গজেবের ফরমানের উত্তরে মীর জুমলার ব্যবসায়িক আধিকারিক মীর মহম্মদ হুসেইন টাপা টাপা(তাবাতাবাই) উইন্টারের কবল থেকে জাহাজটি উদ্ধারের দাবি জানালেন। মছলিপত্তনপমের কুঠিয়াল এই বিষয়ে মাথা গলাতে আস্বীকার করাতে টাপা টাপা(তাবাতাবাই) ব্রিটিশদের হাতে বন্দী মীর জুমলার সেনানী কাজি (মহম্মদ হাশিম)র মুক্তির দাবি জানালেন। এই সব হুঁশিয়ারিতে কোম্পানি এবং আধিকারিকেরা আশংকা করছিলেন যে তাদের ব্যবসার ওপরে আঘাত আসতে চলেছে। ভারতের কোম্পানি এখন দুটি মতদ্বৈধতায় পড়েছে – একদিকে মীর জুমলার জাহাজ ফেরতের জোরালো দাবি কোম্পানির ইংলন্ডের কর্মকর্তা, বিশেষ করে গ্রিনহিলের উত্তরসূরী এজেন্ট চেম্বার, তার স্ত্রীর পক্ষ নিয়ে কোন দায় নিতে অস্বীকার করছে, অন্যদিকে কোম্পানির নির্দেশে উইন্টার সেটি মীর জুমলার ব্যবসায়িক আধিকারিকের কাছে ফেরত দিয়েও পরে সেটি কেড়ে নেন, সে বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

২। বিহার আর বাংলায় মীর জুমলার দায়িত্ব জাহাজ পর্বের আরও জটিলতা বাড়ল বাংলা-বিহারে জুড়ে সুজার বিরুদ্ধে লড়তে মীর জুমলাকে আওরঙ্গজেব সম্পূর্ণ দায়িত্ব দেওয়ায়। যদিও ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা মীর জুমলাকে যমের মত ভয় করত, কিন্তু জাহাজ কাণ্ড সমাধানে তাদের উদ্দেশ্যটা অনেকটা ঘটনা প্রবাহের গতি এবং সিংহাসনের দখলের লড়াতে মীর জুমলার জড়িয়ে থাকা এবং তাঁর ভাগ্য পরিবর্তনের ওপর বহুলভাবে ছেড়ে দিয়েছিল। যদিও বাঙলার কুঠিয়ালেরা এই ঘটনাকে দেখছিল করমণ্ডল কুঠির দায়িত্ব হিসেবে, মীর জুমলা জাহাজ কাণ্ডকে দেখতেন সামগ্রিকভাবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে জড়িয়েই, এবং তিনি স্পষ্টতই মনে করতেন জাহাজ কাণ্ডে বাঙলার কুঠিয়ালেরা তাদের দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। ফলে তার প্রথম কাজটাই হল এই ঘটনার শাস্তি স্বরূপ ব্রিটিশেরা যাতে বিহার থেকে সোরা কিনতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। তাঁর সঙ্গে দু’দুবার দেখা করেন পাটনা কুঠির কুঠিয়াল চেম্বারলিন। দ্বিতীয় আলোচনায়(২১ ফেব্রুয়ারি ১৬৫৯) মীর জুমলা ৬০০টাকার উপঢৌকন পেয়ে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন, ব্রিটিশ কুঠিয়ালকে জলদস্যু বা ছিঁচকে চোরের থেকে বেশি মর্যাদা দেন নি। এর প্রতিক্রিয়ায় তিনি ব্রিটিশদের মাল পরিবহনে গাড়ি, নৌকোগুলি দখল হলে তাঁর সাপেক্ষে অগ্রিম ক্ষতিপূরণ পাওয়ার দস্তক দিতে অস্বীকার করেন এবং একই সঙ্গে বলেন চেম্বারলিনকে গ্রেফতার এবং তাঁর কুঠিকে দখল না করে তাদের প্রতি তিনি যথেষ্টই দয়া দেখিয়েছেন। চেম্বারলিন যেন এটা মনে রাখেন।

সুজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে মীর জুমলার জয় ব্রিটিশদের বাধ্য করল যতদূর সম্ভব মীর জুমলারকে শান্ত রাখার নীতি গ্রহণ করতে। জাহাজটি হয় ফেরত পাওয়া যাবে নয়ত ক্ষতিপূরণ, এবং এই বিষয়টি তিনি বালেশ্বরের কুঠিয়ালের মাধ্যমে সেন্ট জর্জের কুঠিয়ালকে সাড়ে চারমাসের মধ্যে সমাধান করতে অনুরোধ করেছেন, চেম্বারলিনের এই আশ্বাসে পাটনায় ব্রিটিশদের ব্যবসার আনুমতি দিলেন মীর জুমলা এবভং বললেন তাঁর কর্মচারী সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র হাতে পেয়ে সন্তুষ্ট হলে জাহাজ কাণ্ডের সমাধান হয়েছে বলে তিনি মেনে নেবেন।

গোলাগুলি এবং অন্যান্য রসদের সরবরাহ বিষয়ে ডাচেদের সাহায্য চাইতে কাশিমবাজারের কুঠিয়ালকে তাঁর শিবিরে ডেকে পাঠান মীর জুমলা। যেহেতু তাঁর জন্য ব্রিটিশেরা অপেক্ষা করে নি বলে ব্রিটিশদের কাশিমবাজার কুঠি বন্ধে নির্দেশ দেন তিনি। এই নিষেধাজ্ঞা তুলতে কুঠিয়াল কেনকে মে মাসে মীর জুমলার সঙ্গে দু’দুবার দেখা করতে হয়। মীর জুমলা উপঢৌকন নিতে আস্বীকার করেন এবং তাঁর জাহাজটিকে ফেরত এবং ৪০০০০টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। তিনি এর জন্য দুমাসের বেশি অপেক্ষা করতে পারবেন না জানিয়ে দেন, এবং এই কাজের ক্ষতিপূরণের মঞ্জুরিপত্র কেন যাতে বালেশ্বর এবং হুগলী থেকে আনিয়ে নিতে পারেন তাঁর জন্য তাকে বেশ কিছু দিন সময় দেন এবং এটি না করতে পারলে তাদের সব ব্যবসা বন্ধ করিয়ে দেওয়ার এবং সবধরণের অগ্রিম ক্ষতিপূরণের দস্তক না দেওয়ার এবং ক্ষতিপূরণ হিসেবে তাদের মজুদ সোরাও দখল করার হুমকি দেন। মে মাসের শেষের দিকে হুগলীর স্থানীয় কুঠিয়ালদের থেকে চিঠি নিয়ে ম্যাথিয়াস হলস্টেড মীর জুমলার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে আসেন এবং সেই চিঠির প্রেক্ষিতে মীর জুমলা ব্রিটিশদের দাবি কিছুটা মেনে নেন। বালেশ্বর এবং হুগলীর কুঠিয়ালেরা নবাবের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ২৫০০০টাকা ধার্য করার সিদ্ধান্ত নেন। জুনের প্রথম দিকে হলস্টেড আর কেন মীর জুমলার সঙ্গে দেখা করেন এবং এক মাসের মধ্যে তাঁর দখল করা পণ্যের দাম মিটিয়ে দিলে ব্রিটিশদের দস্তক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন।

ডাচ কুঠিয়াল ম্যাথায়াস ভ্যান ডেন ব্রোক মীর জুমলার সঙ্গে দেখা করতে চললেন, ডচেরা হুগলী নদী নৌকো এবং কামান নিয়ে পাহারা দেওয়ার কাজ নিজেদের কাঁধে তুলে নেওয়ায় তাদের ব্যবসার পথ রোধ হয় নি। সে সময় কানাঘুষোয় শোনা যাচ্ছিল যে বিপুল অর্থের বিনিময়ে ডাচেরা হুগলীর প্রশাসনিক ক্ষমতা অর্জন করতে পারে। জুনের মাঝখানে শাহজাদা মহম্মদ সুলতান মীর জুমলার শিবির ছেড়ে সুজার বাহিনীতে যোগ দেওয়ায়, ব্রিটিশেরা সেই সুযোগে জাহাজ নিয়ে দরকষাকষির ব্যাপারটা একটু ঢিলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আগের চুক্তি অনুযায়ী, সেপ্টেম্বরের শুরুতে কেন মুর্শিদাবাদে এসে মীর জুমলা এবং বালেশ্বরের কুঠিয়াল ত্রেভিসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। যুদ্ধের অনিশ্চিতির বাহানা দেখিয়ে বালেশ্বরের কুঠিয়াল ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়া আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে এবং যুদ্ধের গতি কোন দিকে গড়ায় দেখে তা সিদ্ধন্ত নেওয়া হবে কেনকে বলে জানায়। ত্রেভিসা নবাবের সঙ্গে দেখা করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে সুরাটের প্রেসিডেন্ট এন্ড্রু এবং মছলিপত্তনমের মীর জুমলার আধিকারিকের চিঠি মীর জুমলার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেন।

মীর জুমলা খুব কঠিন ধাতের মানুষ ছিলেন, তিনি মন রাখা প্রতিশ্রুতিতে বিন্দুমাত্রও প্রভাবিত হতেন না। তিনি বহু সময় অপেক্ষা করলেন, কুঠিয়ালদের প্রতি সভ্যতা এবং শালীনতা প্রদর্শন করলেন। ক্রমে তাঁর দীর্ঘ অপেক্ষা রাগে রূপান্তরিত হল। আর কোন সমঝোতা নয়, অবিলম্বে নগদে টাকা ছাড়া অন্য কোন কিছুতে সন্তুষ্ট হবেন না জানিয়ে দিলেন। বালেশ্বরের সুবাদারকে বললেন সব ধরণের ব্রিটিশ রপ্তানির ওপর ৪% রপ্তানি শুল্ক প্রয়োগ করতে এবং বন্দরে জাহাজ ভেড়ানোর জন্য একটা শুল্ক চাপিয়ে দিতে এবং ত্রেভিসাকে হুগলীতে পাঠিয়ে দিতে। নভেম্বরে দেখা গেল ব্রিটিশদের সমস্ত ব্যবসাই প্রায় বন্ধের মুখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় বেনিয়াদের থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার করে যে সব বিপুল পণ্যের দাদন দেওয়া হয়েছে, তাকে সন্তষ্ট না করলে সে সবগুলি তিনি দখল নেবেন। হুগলী কুঠিয়ালের সামনে বিপুল দুর্যোগের ঘনঘটা। বিপুল বিনিয়োগে সে বছরের জন্য যে সব পণ্য তারা কিনেছেন, হয়ত মীর জুমলা তাদের সব জাহাজকে বন্দর ছাড়তে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন, সে সবের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি হবে তাই তাঁর মাথা ব্যথা থেকেই গেল। সারা ভারতের সরতাজ বাঙলার ব্রিটিশ ব্যবসা হাত ছাড়া হতে বসেছে দেখে ব্রিটিশদের টড়নক নড়ল যে জাহাজ কাণ্ডকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধা করে ফেলা অত্যন্ত জরুরি।

পাটনায় সোরা ব্যবসার নিষেধাজ্ঞায় উদ্বিগ্ন সুরাটের কুঠিয়াল মাদ্রাজের আধিকারিকদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়ে জাহাজ কাণ্ডকে যততাড়াতাড়ি সম্ভব মিটিয়ে নিতে এবং মীর জুমলার ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিলেন(৩ জুন ১৬৫৯)। একই সঙ্গে সেই নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ১২ অক্টোবর এক নির্দেশে গ্রিনহিল এস্টেট থেকে মীর জুমলাকে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশনামা জারি করলেন। নভেম্বরের শুরুতে মাদ্রাজের কুঠিয়াল, বাঙলার কুঠিয়ালকে পরামর্শ দিলেন যাতে তারা নবাবের চাহিদা মত যত বেশি সম্ভব ক্ষতিপূরণ দিয়ে ব্যাপারটার একটা স্থায়ী মিটমাট করে নেওয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু হঠাতই তাঁর কানে মীর জুমলার যুদ্ধে হারের উড়ো খবর পৌ্ঁছনোয় তিনি বাংলার কুঠিয়ালদের জোর দিয়ে বললেন যে তারা যেন মীর জুমলাকে বুঝিয়ে দেন, মীর জুমলার কাজে যদি তাঁদের কোম্পানির ক্ষতি হয় তাহলে তাদের প্রত্যাঘাত করার যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। খবরটা যে সত্যি উড়ো এবং ভিত্তিহীন সেটা বাঙলার কুঠিয়ালেরা জানত এবং তারা জানত জাহাজ কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মীর জুমলার প্রকৃত ক্ষমতার ব্যপ্তি এবং মাদ্রাজের কুঠিয়ালের এ ধরণের পরামর্শ হাস্যকর ছাড়া আর কিছু নয়।

শেষে ১ ডিসেম্বর ত্রেভিসা কেনের সঙ্গে হুগলি ত্যাগ করে মীর জুমলার শিবিরের দিকে রওনা হল মীর জুমলার সঙ্গে জাহাজ কাণ্ডটির দরাদরি করে স্থায়ী সমাধানের উদ্দেশ্যে। নবাবের সঙ্গে তার যে সব শর্তে চুক্তি হয় সেগুলি হল- ১) সমস্ত দখল নেওয়া পণ্য সহ জাহাজটি তাকে অবিলম্বে ফিরিয়ে দিতে হবে। ২) ক্ষতিপূরণের অর্থের বিষয়টি নিয়ে তাঁর পক্ষ থেকে তাবাতাবাই এবং ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে সর্বশ্রী ঊম আ কোর্ট এবং জার্সি যৌথভাবে দেখাশোনা করবেন এবং এটি আগামী চার মাসের এই হিসেব মধ্যে শেষ করতে হবে। মীর জুমলার ভাবভঙ্গী দেখে ত্রেভিসার মনে হল তাকে সন্তুষ্ট না করতে পারলে নবাব ব্রিটিশদের খোলা হাতে ব্যবসা করার ছাড়পত্র দেবেন না। কিন্তু ৭ জুমাদা ১০৭০, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৬৬০ সালে শাহজাহানের ফার্মানের অনুসরণে তিনি ত্রেভিসার সমস্ত আশঙ্কা উপেক্ষা করে বাস্তবতা অনুসরণ করে ব্রিটিশেরা যাতে ব্যবসা করতে পারেন, সে উদ্দেশ্যে যথাবিহিত দস্তক এবং পরওয়ানা জারি করেন।

ষষ্ঠ অধ্যায় বাঙলার সুবাদার মীর জুমলা

১। বাঙলার সুবাদারি প্রাপ্তি

সুজার আরাকানে পলায়ন এবং মীর জুমলার ঢাকা প্রবেশের খবরে দশ দিনের উতসবের নির্দেশ দিলেন আওরঙ্গজেব(২৪মে)। শেষ ষোল মাস মীর জুমলা নানান বিপদ সামলে যেভাবে সাম্রাজ্যকে সেবা করেছেন, সেই কাজের পুরস্কার স্বরূপ তাকে বাঙলার সুবাদার পদে নিয়োগ করা হল।

জারি করা ফরমানে পাদশাহ স্পষ্টভাবে তাঁর পদপ্রাপ্তির কারণ উল্লেখ করেছেন। যে বিজয় তিনি অর্জন করেছেন, তাতে একজন মহান ক্ষমতাশালী চক্রবর্তী রাজাও গর্বিত হতেন, এবং যে আনুগত্যে, যে সাহসিকতায়, যে দক্ষতায়, যে প্রজ্ঞায় তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করে সাফল্য অর্জন করেছেন, তাঁর পদপ্রাপ্তি সেই সব গুণেরই প্রতিফলন মাত্র। মীর জুমলা তাঁর পুত্রকে লিখছেন, যে বাংলায় সঠিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। তাই এই প্রদেশে যোগ্য সুবাদারের পদপ্রাপ্তিটা মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে খুব জরুরি পদক্ষেপ ছিল। আওরঙ্গজেব তাকে লিখলেন, ‘সামগ্রিকভাবে, বহু বছর ধরে, বাঙলার প্রশাসনে গাছাড়া মনোভাব এবং শৈথিল্য, আনুগত্যের অভাব, এবং বিদ্রোহ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে, এবং সে তথ্য তোমার অজানা নয়... প্রত্যেক জেলায় স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের মদতে দাঙ্গা আর বিদ্রোহের আগুণ জ্বলছে।’ এর আগে মীর জুমলা বাঙলার সুবাদারির পদ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই যুক্তিতে, যে এই স্বার্থপর পদক্ষেপে তাঁর অনুগামীরা তাকে ভুল বুঝে তাঁর থেকে দূরে সরে যাবে। কিন্তু পাদশাহের যুক্তি ছিল বাঙলার মত গুরুত্বপূর্ণ সুবার দায়িত্ব তিনি মীর জুমলা ছাড়া অন্য কারোর হাতে দিতে বিন্দুমাত্র উতসাহী নন, কেননা মীর জুমলার আনুগত্য, দক্ষতা সততা, বিচারের পদ্ধতি এবং নৈতিকতাই তাকে এই পদে যোগ্য করে তুলেছে।

তাঁর আগের মনসব ছাড়াও তাকে হপ্ত হাজারহফত হাজার সওয়ারএর মধ্যে ৩০০০ সওয়ার হবে শেহ আসপা দু আসপা। এক কোটি দাম বেতন ছাড়াও তনখা হিসেবে আগের সুবাদারদের জন্য বরাদ্দ মহালগুলি থেকে বেছে বেছে সব থেকে ভাল জাগিরগুলি দেওয়া হল। একটি অপূর্ব খিলাত, কন্সতান্তিনোপলের তুর্কি সম্রাটের আস্তাবলে থেকে শাহজাহানের ৩১তম জালুসে(বছরে)র উপলক্ষ্যে উপহার দেওয়া থেকে সব থেকে ভাল, বিশেষ এবং দ্রুততম ইরাকি এবং আরবি ১০টি ঘোড়ার সঙ্গে সম্রাটের নিজের আস্তাবলের আরও ৪০টি তাতারি(তুর্কি, ইংরেজদের ভুলভাল উচ্চারণে টাট্টু ঘোড়া) ঘোড়া, একটি মদ্দা হাতি সহ কয়েকটি হাতি দেওয়া হল। এর পরেও বলা হল, কোন মহালকে তিনি যদি খারাপ মনে করেন, এবং সেটি বদলে যদি অন্য কোন ভাল পরগণা মহাল হিসেবে চান, তাহলে তার ইচ্ছে পাদসাহকে জানিয়ে সেটি বদল করে দেওয়া হবে। এ ছাড়াও একটি রত্ন খচিত কোমর বন্ধনী তাঁর সঙ্গে রত্ন খচিত তরবারি, যেটির হাতল আকীক(agate) রত্নদ্বারা তৈরি উপহার দেওয়া হয়।

আওরঙ্গজেব তাঁকে নির্দেশ দিলেন বিক্ষুব্ধদের শান্ত করতে, আইনভঙ্গকারীদের শাস্তি দিতে, গোলান্দাজ এবং বন্দুকবাজদের আয়ত্ত্বে আনতে – বিশেষ করে নোবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলিকে, রাস্তা, রাজপথের আবাধ গতায়াতের বন্দোবস্ত করতে এবং এই কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী জারি করতে। সম্রাট তাকে লিখলেন, ‘অশক্তের ওপর ক্ষমতাশালীর হাত, শোষকের ওপর শোষিতের হাত বলপূর্বক সরিয়ে দিতে হবে। জীবনের সব ক্ষেত্রে শারিয়তের আইন প্রযুক্ত এবং বিচার সুনিশ্চিত করবে। সর্বশক্তিমানের সৃষ্টি সব জীবের বিশেষ করে গৃহী এবং বিদেশি ভ্রমণকারীদের শান্তি দেওয়া তাদের উন্নতি ঘটানো দরকার, এবং সীমান্তের ওপর সদা সতর্ক তোমার নজরদারি থাকুক। অত্যাচারীদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে যাতে কৃষকেরা যাতে চাষের কাজ অবাধে করতে পারে সেই দিকে তোমার মনযোগ ধাবিত হোক।’

পরগনার বিভিন্ন বিদ্রোহী জমিদার বিশেষ করে অসমীয়া এবং মগেদের শাস্তি দেওয়ার কাজে মীর জুমলাকে নির্দেশ দেন, কেননা এরা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার এবং দুর্ব্যবহার করত। ইসলামের সৌভাতৃত্ব এবং ধর্মাচার অবাধ করার জন্য তিনি মীর জুমলাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সেনানীকে অন্তত এক বছর বাংলায় থাকার নির্দেশ দিয়ে কয়েকজনকে দিল্লিতে ডেকে নিয়েছিলেন। এবং যদি মীর জুমলা তাদের মধ্যে থেকে কাউকে যোগ্য মনে করে রেখে দেওয়ার প্রস্তাব সম্রাটকে দেন তাহলে তাঁর অনুরোধ পালন করা হবে।

আওরঙ্গজেবের ৪৪তম জন্মদিবসে(১৫ জুলাই, ১৬৬০) মীর জুমলার সুজার বিরুদ্ধে জয় স্মরণে রাখতে তাকে নতুন করে সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাঙলা জয়ের জন্য তিনি খানইখানান এবং সিপাহসালার উপাধি অর্জন করলেন, ৭০০০ মনসবদার করা হয় তাকে, পাশাপাশি তাঁর পদকে আরও ২০০০ দু আসপা শেহ আসপা বাড়ানো হয়। তাঁর ব্যক্তিগত অনুগামীর মধ্যে ২০০০কে দু আসপা শেহ আসপা করা হয়। এই উপলক্ষ্যে তাকে একটি বিশেষ খেলাত এবং একটি সোনার তরোয়ালও দেওয়া হয়।

মীর জুমলা খুব কঠিন ধাতের মানুষ ছিলেন, তিনি মন রাখা প্রতিশ্রুতিতে বিন্দুমাত্রও প্রভাবিত হতেন না। তিনি বহু সময় অপেক্ষা করলেন, কুঠিয়ালদের প্রতি সভ্যতা এবং শালীনতা প্রদর্শন করলেন। ক্রমে তাঁর দীর্ঘ অপেক্ষা রাগে রূপান্তরিত হল। আর কোন সমঝোতা নয়, অবিলম্বে নগদে টাকা ছাড়া অন্য কোন কিছুতে সন্তুষ্ট হবেন না জানিয়ে দিলেন। বালেশ্বরের সুবাদারকে বললেন সব ধরণের ব্রিটিশ রপ্তানির ওপর ৪% রপ্তানি শুল্ক প্রয়োগ করতে এবং বন্দরে জাহাজ ভেড়ানোর জন্য একটা শুল্ক চাপিয়ে দিতে এবং ত্রেভিসাকে হুগলীতে পাঠিয়ে দিতে। নভেম্বরে দেখা গেল ব্রিটিশদের সমস্ত ব্যবসাই প্রায় বন্ধের মুখে দাঁড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় বেনিয়াদের থেকে উচ্চ সুদে টাকা ধার করে যে সব বিপুল পণ্যের দাদন দেওয়া হয়েছে, তাকে সন্তষ্ট না করলে সে সবগুলি তিনি দখল নেবেন। হুগলী কুঠিয়ালের সামনে বিপুল দুর্যোগের ঘনঘটা। বিপুল বিনিয়োগে সে বছরের জন্য যে সব পণ্য তারা কিনেছেন, হয়ত মীর জুমলা তাদের সব জাহাজকে বন্দর ছাড়তে নিষেধাজ্ঞা জারি করতে পারেন, সে সবের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি হবে তাই তাঁর মাথা ব্যথা থেকেই গেল। সারা ভারতের সরতাজ বাঙলার ব্রিটিশ ব্যবসা হাত ছাড়া হতে বসেছে দেখে ব্রিটিশদের টড়নক নড়ল যে জাহাজ কাণ্ডকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সমাধা করে ফেলা অত্যন্ত জরুরি।

পাটনায় সোরা ব্যবসার নিষেধাজ্ঞায় উদ্বিগ্ন সুরাটের কুঠিয়াল মাদ্রাজের আধিকারিকদের কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়ে জাহাজ কাণ্ডকে যততাড়াতাড়ি সম্ভব মিটিয়ে নিতে এবং মীর জুমলার ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দিলেন(৩ জুন ১৬৫৯)। একই সঙ্গে সেই নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ১২ অক্টোবর এক নির্দেশে গ্রিনহিল এস্টেট থেকে মীর জুমলাকে ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশনামা জারি করলেন। নভেম্বরের শুরুতে মাদ্রাজের কুঠিয়াল, বাঙলার কুঠিয়ালকে পরামর্শ দিলেন যাতে তারা নবাবের চাহিদা মত যত বেশি সম্ভব ক্ষতিপূরণ দিয়ে ব্যাপারটার একটা স্থায়ী মিটমাট করে নেওয়ার কথা ভাবেন। কিন্তু হঠাতই তাঁর কানে মীর জুমলার যুদ্ধে হারের উড়ো খবর পৌ্ঁছনোয় তিনি বাংলার কুঠিয়ালদের জোর দিয়ে বললেন যে তারা যেন মীর জুমলাকে বুঝিয়ে দেন, মীর জুমলার কাজে যদি তাঁদের কোম্পানির ক্ষতি হয় তাহলে তাদের প্রত্যাঘাত করার যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। খবরটা যে সত্যি উড়ো এবং ভিত্তিহীন সেটা বাঙলার কুঠিয়ালেরা জানত এবং তারা জানত জাহাজ কাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত মীর জুমলার প্রকৃত ক্ষমতার ব্যপ্তি এবং মাদ্রাজের কুঠিয়ালের এ ধরণের পরামর্শ হাস্যকর ছাড়া আর কিছু নয়।

শেষে ১ ডিসেম্বর ত্রেভিসা কেনের সঙ্গে হুগলি ত্যাগ করে মীর জুমলার শিবিরের দিকে রওনা হল মীর জুমলার সঙ্গে জাহাজ কাণ্ডটির দরাদরি করে স্থায়ী সমাধানের উদ্দেশ্যে। নবাবের সঙ্গে তার যে সব শর্তে চুক্তি হয় সেগুলি হল- ১) সমস্ত দখল নেওয়া পণ্য সহ জাহাজটি তাকে অবিলম্বে ফিরিয়ে দিতে হবে। ২) ক্ষতিপূরণের অর্থের বিষয়টি নিয়ে তাঁর পক্ষ থেকে তাবাতাবাই এবং ব্রিটিশদের পক্ষ থেকে সর্বশ্রী ঊম আ কোর্ট এবং জার্সি যৌথভাবে দেখাশোনা করবেন এবং এটি আগামী চার মাসের এই হিসেব মধ্যে শেষ করতে হবে। মীর জুমলার ভাবভঙ্গী দেখে ত্রেভিসার মনে হল তাকে সন্তুষ্ট না করতে পারলে নবাব ব্রিটিশদের খোলা হাতে ব্যবসা করার ছাড়পত্র দেবেন না। কিন্তু ৭ জুমাদা ১০৭০, ৯ ফেব্রুয়ারি ১৬৬০ সালে শাহজাহানের ফার্মানের অনুসরণে তিনি ত্রেভিসার সমস্ত আশঙ্কা উপেক্ষা করে বাস্তবতা অনুসরণ করে ব্রিটিশেরা যাতে ব্যবসা করতে পারেন, সে উদ্দেশ্যে যথাবিহিত দস্তক এবং পরওয়ানা জারি করেন।

ষষ্ঠ অধ্যায় বাঙলার সুবাদার মীর জুমলা ১। বাঙলার সুবাদারি প্রাপ্তি সুজার আরাকানে পলায়ন এবং মীর জুমলার ঢাকা প্রবেশের খবরে দশ দিনের উতসবের নির্দেশ দিলেন আওরঙ্গজেব(২৪মে)। শেষ ষোল মাস মীর জুমলা নানান বিপদ সামলে যেভাবে সাম্রাজ্যকে সেবা করেছেন, সেই কাজের পুরস্কার স্বরূপ তাকে বাঙলার সুবাদার পদে নিয়োগ করা হল।

জারি করা ফরমানে পাদশাহ স্পষ্টভাবে তাঁর পদপ্রাপ্তির কারণ উল্লেখ করেছেন। যে বিজয় তিনি অর্জন করেছেন, তাতে একজন মহান ক্ষমতাশালী চক্রবর্তী রাজাও গর্বিত হতেন, এবং যে আনুগত্যে, যে সাহসিকতায়, যে দক্ষতায়, যে প্রজ্ঞায় তিনি যুদ্ধ পরিচালনা করে সাফল্য অর্জন করেছেন, তাঁর পদপ্রাপ্তি সেই সব গুণেরই প্রতিফলন মাত্র। মীর জুমলা তাঁর পুত্রকে লিখছেন, যে বাংলায় সঠিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার অভাব রয়েছে। তাই এই প্রদেশে যোগ্য সুবাদারের পদপ্রাপ্তিটা মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে খুব জরুরি পদক্ষেপ ছিল। আওরঙ্গজেব তাকে লিখলেন, ‘সামগ্রিকভাবে, বহু বছর ধরে, বাঙলার প্রশাসনে গাছাড়া মনোভাব এবং শৈথিল্য, আনুগত্যের অভাব, এবং বিদ্রোহ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে রয়েছে, এবং সে তথ্য তোমার অজানা নয়... প্রত্যেক জেলায় স্থানীয় ক্ষমতাশালীদের মদতে দাঙ্গা আর বিদ্রোহের আগুণ জ্বলছে।’ এর আগে মীর জুমলা বাঙলার সুবাদারির পদ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই যুক্তিতে, যে এই স্বার্থপর পদক্ষেপে তাঁর অনুগামীরা তাকে ভুল বুঝে তাঁর থেকে দূরে সরে যাবে। কিন্তু পাদশাহের যুক্তি ছিল বাঙলার মত গুরুত্বপূর্ণ সুবার দায়িত্ব তিনি মীর জুমলা ছাড়া অন্য কারোর হাতে দিতে বিন্দুমাত্র উতসাহী নন, কেননা মীর জুমলার আনুগত্য, দক্ষতা সততা, বিচারের পদ্ধতি এবং নৈতিকতাই তাকে এই পদে যোগ্য করে তুলেছে।

তাঁর আগের মনসব ছাড়াও তাকে হপ্ত হাজারহফত হাজার সওয়ারএর মধ্যে ৩০০০ সওয়ার হবে শেহ আসপা দু আসপা। এক কোটি দাম বেতন ছাড়াও তনখা হিসেবে আগের সুবাদারদের জন্য বরাদ্দ মহালগুলি থেকে বেছে বেছে সব থেকে ভাল জাগিরগুলি দেওয়া হল। একটি অপূর্ব খিলাত, কন্সতান্তিনোপলের তুর্কি সম্রাটের আস্তাবলে থেকে শাহজাহানের ৩১তম জালুসে(বছরে)র উপলক্ষ্যে উপহার দেওয়া থেকে সব থেকে ভাল, বিশেষ এবং দ্রুততম ইরাকি এবং আরবি ১০টি ঘোড়ার সঙ্গে সম্রাটের নিজের আস্তাবলের আরও ৪০টি তাতারি(তুর্কি, ইংরেজদের ভুলভাল উচ্চারণে টাট্টু ঘোড়া) ঘোড়া, একটি মদ্দা হাতি সহ কয়েকটি হাতি দেওয়া হল। এর পরেও বলা হল, কোন মহালকে তিনি যদি খারাপ মনে করেন, এবং সেটি বদলে যদি অন্য কোন ভাল পরগণা মহাল হিসেবে চান, তাহলে তার ইচ্ছে পাদসাহকে জানিয়ে সেটি বদল করে দেওয়া হবে। এ ছাড়াও একটি রত্ন খচিত কোমর বন্ধনী তাঁর সঙ্গে রত্ন খচিত তরবারি, যেটির হাতল আকীক(agate) রত্নদ্বারা তৈরি উপহার দেওয়া হয়।

আওরঙ্গজেব তাঁকে নির্দেশ দিলেন বিক্ষুব্ধদের শান্ত করতে, আইনভঙ্গকারীদের শাস্তি দিতে, গোলান্দাজ এবং বন্দুকবাজদের আয়ত্ত্বে আনতে – বিশেষ করে নোবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলিকে, রাস্তা, রাজপথের আবাধ গতায়াতের বন্দোবস্ত করতে এবং এই কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী জারি করতে। সম্রাট তাকে লিখলেন, ‘অশক্তের ওপর ক্ষমতাশালীর হাত, শোষকের ওপর শোষিতের হাত বলপূর্বক সরিয়ে দিতে হবে। জীবনের সব ক্ষেত্রে শারিয়তের আইন প্রযুক্ত এবং বিচার সুনিশ্চিত করবে। সর্বশক্তিমানের সৃষ্টি সব জীবের বিশেষ করে গৃহী এবং বিদেশি ভ্রমণকারীদের শান্তি দেওয়া তাদের উন্নতি ঘটানো দরকার, এবং সীমান্তের ওপর সদা সতর্ক তোমার নজরদারি থাকুক। অত্যাচারীদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে যাতে কৃষকেরা যাতে চাষের কাজ অবাধে করতে পারে সেই দিকে তোমার মনযোগ ধাবিত হোক।’

পরগনার বিভিন্ন বিদ্রোহী জমিদার বিশেষ করে অসমীয়া এবং মগেদের শাস্তি দেওয়ার কাজে মীর জুমলাকে নির্দেশ দেন, কেননা এরা মুসলমানদের ওপর অত্যাচার এবং দুর্ব্যবহার করত। ইসলামের সৌভাতৃত্ব এবং ধর্মাচার অবাধ করার জন্য তিনি মীর জুমলাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আওরঙ্গজেব কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ সেনানীকে অন্তত এক বছর বাংলায় থাকার নির্দেশ দিয়ে কয়েকজনকে দিল্লিতে ডেকে নিয়েছিলেন। এবং যদি মীর জুমলা তাদের মধ্যে থেকে কাউকে যোগ্য মনে করে রেখে দেওয়ার প্রস্তাব সম্রাটকে দেন তাহলে তাঁর অনুরোধ পালন করা হবে।

আওরঙ্গজেবের ৪৪তম জন্মদিবসে(১৫ জুলাই, ১৬৬০) মীর জুমলার সুজার বিরুদ্ধে জয় স্মরণে রাখতে তাকে নতুন করে সম্মান জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বাঙলা জয়ের জন্য তিনি খানইখানান এবং সিপাহসালার উপাধি অর্জন করলেন, ৭০০০ মনসবদার করা হয় তাকে, পাশাপাশি তাঁর পদকে আরও ২০০০ দু আসপা শেহ আসপা বাড়ানো হয়। তাঁর ব্যক্তিগত অনুগামীর মধ্যে ২০০০কে দু আসপা শেহ আসপা করা হয়। এই উপলক্ষ্যে তাকে একটি বিশেষ খেলাত এবং একটি সোনার তরোয়ালও দেওয়া হয়।

২। মীর জুমলার বাঙলা প্রশাসন প্রায় তিন বছর(৯ মে ১৬৬০-৩১ মার্চ ১৬৬৩) বাঙলার প্রশাসনিকভার সামলান মীর জুমলা। কিন্তু যেহেতু তিনি নভেম্বর ১৬৬১ সাল থেকেই অসম আর কোচবিহারের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন, তাঁর বাঙলার প্রশাসনিক দায়িত্বের কার্যকর মেয়াদকাল ছিল মোটামুটি দেড় বছর। দীর্ঘকাল পরীক্ষা নিরীক্ষা করে যে প্রশাসনিক সংস্কার করে সুফলগুলি পাওয়া যাওয়ার সুযোগটি তিনি পান নি। সরকার, পরগণা এবং তাঁর আমলাতান্ত্রিকতার যে ব্যবস্থা বাংলায় তাঁর আগে বর্তমান ছিল সেটি আকবরের সময়ে তৈরি। কার্যনির্বাহী শাসক(হুজুর), রাজস্ব(মল) এবং প্রশাসক এবং দেওয়ানের মধ্যে প্রশাসনিক বিভাগটিও আকবরের সময় থেকে বাংলায় পূর্ণদ্যমে চলে আসছে। প্রশাসক, সদর এবং বিচারক, কাজির মধ্যেও যে প্রশাসনিক পার্থক্য সেটি তখনও চালু ছিল। তবুও মীর জুমলার মত শক্তিশালী প্রশাসক খুব কম সময়েও তাঁর নিজের কর্মদক্ষতা প্রমান করেছেন বাংলায়।

তিনি পর্তুগিজ এবং আরাকানি দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে প্রাথমিকভাবে বাঙলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় তুলে নিয়ে যান। টিপেরা, ঘোড়াঘাট আর হাজোর রাজা মীর জুমলাকে রাজস্ব দিতে অস্বীকার করেন। তিনি রশীদ খানের নেতৃত্বে হাজো, ফরহদ খানের নেতৃত্বে টিপেরা এবং সুজন সিংএর নেতৃত্বে ঘোড়াঘাটে সেনা পাঠানোর প্রস্তাব করেন।

রাজস্ব প্রশাসনে জমির যে তিন ধরণের ভাগ ছিল – খালসা, জায়গির বা জমিদারি এবং সায়ুরঘালই বজায় থাকল। ১৬৫৮এ শাহ সুজার প্রশাসনে তোডরমল্লের রাজস্ব প্রস্তাব আআসে এবং সেটি কিছুটা সংস্কার হয় পরের বছর। তোডরমল্লের আগে খালসায় আসল জমা হিসেব(৬৩,৪৪,২৬০ টাকা)রূপে আদায় ছিল। সেই পরিমানটি ২৪ লক্ষ টাকা বাড়ে (৮৭,৬৭,০১৬ টাকা)। কিন্তু জায়গির রাজস্বের বৃদ্ধি ঘটে নি (৪৩,৪৮,৮৯২ টাকা)। এই দুয়ে মিলিয়ে সুজার সময়ে বাঙলার মোট রাজস্ব ছিল ১,৩১,১৫,৯০৭ টাকা। এই হিসেব চলে আওরঙ্গজেবের প্রথম দস্তুর উল আমল(১০৬৯ অলহজ্ব এবং ১০৬৫ ফাসিলে) অর্থাৎ যখন মীর জুমলা বাঙলার সুবাদার বা নবাব হয়ে এলেন, সেই সময় পর্যন্ত। কিন্তু বাস্তবে সংগ্রহ হল মাত্র ৮৬,১৯,২৪৭ টাকা, যা আদতে শাহ সুজার সময়ের আদায়ি মোট খালসা রাজস্বের কিছু কম। এই কম অর্থ আদায়ের বড় কারণ হিবে ধরা হয় সে সময়ে বাঙলার রাজনৈতিক আস্থিরতাকে। রাজস্ব বিষয়ে স্থায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই তাকে কোচবিহার এবং অসম অভিযানে চলে যেতে হয়।

ঢাকায় প্রশাসন চালানোর সময় খালসা জমিতে কৃষকদের থেকে তিনি তাঁর প্রজ্ঞা এবং বাস্তবতা প্রয়োগ করে রাজস্ব আদায় করেছেন।

অন্যদিকে মনসবদারদের থেকে জায়গিরগুলির আদায়ও খুব কিছু সন্তোষজনক ছিল না। যেহেতু সেগুলি দূরে দূরে ভিন্ন ভচি পরগণায় অবস্থিত ছিল, এবং তাদের সঙ্গে জুড়ে ছিল প্রচুর অংশিদার, ফলে কৃষকদের ওপর অত্যধিক চাপ পড়ত। কৃষকদের ওপর অত্যাচার হত এবং পরগণাগুলি শেষ পর্যন্ত জনশূন্য থেকেই যেত।

সায়ুরঘাল জমিগুলি বিষয়ে বলা যায়, মীর জুমলা নিজের জায়গিরে প্রচুর আয়মাদার এবং জলপানি পাওয়া গুণীকে বসিয়েছিলেন। এছাড়াও বহু মানুষ যারা সম্রাটের থেকে শুল্কশূন্য জমি ভোগের ফরমান পেতেন তারাও এই সব জমিতে বসতেন। কিন্তু বহু সময় দেখা গিয়েছে জায়গিরদারের বদলি বা মৃত্যুর পর বহু সময়ে এই ভোগদখলকারীর উত্তরাধিকারীদের হাতে এই জমিগুলি ভোগের পাট্টা থাকত না। মীর জুমলার মৃত্যুর পর তার জায়গিরে এই ধরণের শুল্কমুক্ত জমির(মদদইমাশ, আয়মা, সয়ুরঘাল) দখলদারি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। ১৬৬০ সালে সদর, কাজি রিজভি এই ধরণের অধিকারগুলির দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন। যাদের হাতে সম্রাট বা জায়গিরদারের ফরমান ছিল না, তাদের তিনি জমির ভোগদখল থেকে উচ্ছেদ করেন। জমিগুলি জায়গিরদারদের এস্টেটে দখলিকৃত হয়। আয়মাদারদের জমি কর্ষণের অধিকার দেওয়া হল, এবং তাদের রাজস্বও দিতে হত। এই নির্দেশ আয়মাদারদের ওপরে খুব গভীর হল, কেননা আয়মাদারেরা জমি চাষ করতেন না, ফলে তাদের রাজস্ব দেওয়ার কোন সুযোগই ছিল না। তারা সদর, কাজি রিজভির বিরুদ্ধে শায়েস্তা খাঁয়ের কাছে অভিযোগ করেন এবং তার প্রতিবিধান তারা উসুল করেন শায়েস্তা খানের থেকে।

জাকাত, আয়ের একের চল্লিশভাগের একভাগ কর আদায় হতে থাকল হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সওদাগর(মার্চেন্টস), ভ্রমণকারীদের থেকে এবং শুল্ক(কাস্টম - হাসিল) আদায় করা হতে থাকল কারিগর, ব্যবসায়ী(ট্রেডসমেন), খুশনসিন(নবাগত বা ধনী)দের থেকে। পরগনাগুলিতে জায়গিরদার বা জমিদার নিঃসন্তান রায়ত, নবাগত, বা মরন্মুখ ব্যক্তিদের সম্পত্তি, এমন কি স্ত্রী, কন্যা দখল নিতে শুরু করত।

তাঁর সময়কালে মীর জুমলা দ্রুত এবং যথাযোগ্য বিচারের ব্যবস্থা করেন। তিনি নিজে প্রশাসনিক কাজে আকবরের দেখানো পদ্ধতির অত্যন্ত অনুগামী ছিলেন, ফলে তাঁর কাছে বিচার চাইতে আসা সাধারণের তিনি কোন বাধা ছাড়াই সরাসরি বিচার দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন। তিনি নদীর মুখোমুখি নিজের আসনে বসে অস্ত্রহীন উচ্চনীচ ধনীনির্ধন ভেদাভেদ না করেই যথাযোগ্য বিচার করতেন। ঢাকার নারায়ণগঞ্জের কাছে খিজিরপুরে থাকাকালীন দই বেচানী এক মহিলাকে ডেকে তাঁর এক চাকর অর্থ ছাড়াই দই নিয়েছিল। সেই মহিলা সঙ্গে সঙ্গে নবাবের কাছে বিচার চেয়ে বসল। স্বভাবত চাকরটি সেই অভিযোগ অস্বীকার করে। তাকে বমির ওষুধ দিয়ে বমি করানো হলে দেখা গেল সে খাবারের সঙ্গে দইও বমি করে। সুবাদার তখন তাঁর পেট কেটে প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রেখেদিয়েছিলেন, যাতে এ ধরণের কাজ করতে গিয়ে অন্যেরা সতর্ক হয়। সে সময় জনশ্রুতি ছিল, মীর জুমলার এই বিচারের পদ্ধতি এমন কার্যকর হয় যে কেউ একটাও খড় চুরি করত না।

তাঁর কাছে খবর ছিল ঢাকার কাজি মোল্লা মুস্তাফা ঘুষ নেন এবং মীর আদিল তাকে এই কাজে সাহায্য করেন। তিনি উভয়কেই ঢাকা থেকে বহিষ্কার করেন এবং স্বয়ং ধর্মীয় এবং অন্যান্য বিষয়ে বিচারের দায় নিজের কাঁধে তুলে নেন। তিনি যেটিকে ঠিক বলে বিশ্বাস করেন সেটি নিজে পালন করতেন। অসমের পথে অভিযান করার সময় নির্দেশ দিয়ে গেলেন কোরানীয় বিধিতে যে বিচার হবে সেটি করবেন শেখ আজম, কিন্তু কাগজকলমে তিনি কাজির পাঞ্জা ব্যবহার করতে পারবেন না। ধার দেওয়া বা ধার শোধ চাইবার বা চুরি যাওয়া সম্পদ ফেরত পাওয়ার সময় রাষ্ট্র থানা মার্ফত একের চল্লিশাংশ কেটে রেখে দিত। বিচারকের সামনে অভিযোগ করা বাদী বিবাদী মমলার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত তাদের ধরে রাখা হত, এবং যিনি সমন বা নির্দেশ নিয়ে যেতেন তাকে প্রত্যেক দিন শুল্ক দিতে হত যা রাজস্ব হিসেবে জমা পড়ত।

নিজাম হিসেবে মীর জুমলা বাঙলা প্রশাসনে অব্যাহত একনায়কতন্ত্র চালাতেন। বিহার আর ওডিসার প্রশাসন তিনি কিছুটা নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছেন। ১৬৬০-৬১সালে পাটনার দেওয়টান লুতফুল্লা বেগ রাষ্ট্রের রাজস্ব বাড়াবার জন্য সোরা ব্যবসা দখলের চেষ্টায় ডাচেদের সঙ্গে যে সব মধ্যসত্ত্বভোগীরা কাজ করত তাদের নির্দেশ দিলেন সমস্ত সোরা রাষ্ট্রকে জমা দিতে। হুগলীর ডাচ কুঠিয়াল ভ্যান্ডেনব্রোক, মীর জুমলা এবং ব্রিটিশদের অভিযোগ করে বলেন যে এই কাজটি পাটনার ব্রিটিশ কুঠিয়াল চেম্বারলেইন আর দালাল গঙ্গারামের ষড়ে হয়েছে, গঙ্গারাম দেওয়ানকে সমস্ত সোরা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এবং ব্রিটিশেরা দেওয়ানের থেকে সোরা কিনে নেবে(বলা দরকার সেই সময় পাটনার বিপুল পরিমাণ সোরা কিনত ডাচেরা - অনুবাদক)। এর উত্তরে ব্রিটিশ কুঠিয়াল ত্রেভিসা সরাসরি বললেন তিনি দেওয়ানের এই চুক্তিতে সায় দিচ্ছেন না, বরং সোরা কেনা ব্যবস্থায় ডাচেদের সঙ্গে রয়েছেন এবং তারা সরাসরি দালালদের থেকে সোরা কিনবেন বরাবরের মত। মীর জুমলা পরওয়ানা দিয়ে লুতফুল্লাকে ডাচেদের বিরুদ্ধে যেতে বারণ করলেন।

নিজাম হিসেবে মির জুমলার কোন সহকারী ছিল না, তাহলে হয়ত কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব ভাগ করে দিতে পারতেন। ১৬৫৯এর বসন্তে মীর জুমলা বাঙলার দখল নিশ্চিন্ত করে ইস্তিয়াখ খানকে অস্থির ওডিসার দায়িত্ব দিলেন। মনে হয় এই সময়েই রাষ্ট্রীয় ফরমান বলে মীর জুমলা খালসা রাজস্ব না মেটানোর অভিযোগে ওডিসার রাজা নীলকান্ত দেবের তুয়ুল দখল নেন কিন্তু কাশিজোড়া মহালের সরকার গোয়ালপাড়ার কুতুবপুরের মদদইমাশ জমি ভোগ করা শেখ আবদুল খয়ের স্বত্ব বজায় রাখলেন। ওডিসার দেওয়ান হবিসেবে খানইদৌরানের পদের মাধ্যমে মীর জুমলা কিছুটা হলেও ওডিসার ওপর দখলদারি বজায় রেখে ছিলেন। অসম অভিযানের ঠিক আগে ওডিসা থেকে রাজমহল পর্যন্ত ডাকচৌকি বসানো হল, কিন্তু তার সময়টা জানা যায় নি। রাজমহল হয়ে বাঙলা ওডিসার রাজস্ব একযোগে দিল্লিতে পাঠানো হত।

হিজলির বিদ্রোহী জমিদার বাহাদুর খানকে দমন করতে খানইদৌরানকে ব্যবহার করেন মীর জুমলা। বাহাদুর খান সুজার কারাগার থেকে পালিয়ে গিয়ে নতুন করে তার ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। ইওরোপিয় কুঠির নথি বলছে মীর জুমলা এটি দখল করতে ডাচ, ব্রিটিশ, পর্তুগিজদের থেকে জাহাজ দাবি করেন। তবে ওডিসার প্রধান হিসেবে খানইদৌরানের পদপ্রাপ্তিতে এই অভিযানের পরিকল্পনা কিছু দিনের জন্য স্থগিত থাকে। শেষ পর্যন্ত মীর জুমলা সম্রাটকে প্রভাবিত করে ওডিসা বাঙলার প্রশাসনের অন্তর্ভূক্ত করেন, ব্রিটিশ স্লুপ আর ডাচ গ্যালিয়ট নিয়ে হিজলি দখল করেন। বাহাদুরের ভাই কমল খান নিহত হয়। ৬ মে বাহাদুর এবং তার ১১ জন সাথীকে গ্রেফতার করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।

আরাকানের রাজা মীর জুলমার দখল করা তার কিছু রাজত্বের অংশ চেয়ে পাঠিয়ে একটি উদ্ধত চিঠি দেয়। মীর জুমলা তার অভিযোগ খারিজ করে একটি যুক্তিপূর্ণ চিঠি এবং কিছু সামান্য উপহার পাঠান। সুজাকে আরাকান থেকে নিয়ে আসার জন্য তিনি ডাচেদের ওপরে চাপ দিলেন। মগেদের অত্যাচার চরমে উঠলে মীর জুমলা সম্রাটকে জানান যে খিজিরপুরের আগের মুঘল আধিকারিক মগেদের আক্রমণের ভয়ে পালিয়ে থাকতেন। শীতের পরে যখন মগেদের অক্রমণের ঝাঁঝ কমত, তখন ঢাকার সুবাদার তার সেনা নিয়ে সেখানে যেতেন। মগদের অত্যাচার বন্ধ করার জন্য মীর জুমলা কিছু পরিকল্পনা করেন। তবে সেটি রূপায়িত করার কথা ভাবেন কোচবিহার অভিযানের পরই। কোচবিহার-অসম আক্রমণের আগে তিনি বাংলায় কিছু প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। রাজমহলের দেওয়ান হিসেবে কাজ করতে থাকেন মুখলিস খান, ওডিসার দায়িত্ব ছেড়ে আসার পর তিনি ইস্তিশান খানকে ঢাকা সুরক্ষায় খিজিরপুরের দায়িত্ব দিলেন। সাম্রাজ্যের দেওয়ান রায় ভগবতী দাস এবং খ্বাজা ভগবান দাস সুজায়িকে সাম্রাজ্যের আর্থ ব্যবস্থা দেখাশোনা করার পাশাপাশি বাংলায় মীর জুমলা সরকারের একই বিভাগ দেখাশোনা করার দায়িত্ব দেন। দক্ষ, চতুর এবং কর্মঠ হিসেবে বর্ণিত ঢাকার আধিকারিক মহম্মদ মুকুম নাওয়ারার(নৌবাহিনী) দায়িত্ব এবং মীর গাজিকে খাজাঞ্চি এবং খবর-লেখকের(গোয়েন্দা) দায়িত্ব দেন।

মীর জুমলা যখন অসম অভিযানে যান তখন দুবছর ধরে বাংলায় চরম দুর্ভিক্ষ চলেছিল। জাকাত দানের সমান চালের দাম উঠেছিল। চৌকিদার, রাহদারের(শুল্ক আধিকারিক) অত্যাচারে এবং আভ্যন্তরীণ গোলযোগের জন্য ব্যবসায়ীদের গতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। তালিশ সে সময়ের মানুষের অবর্ণনীয় সমস্যার ওপর আলোকপাত করেছেন, ‘মানুষের জীবন রুটির চেয়েও শস্তা, অথচ দেশের কোথাও রুটি পাওয়া যেত না’। এই দুর্ভিক্ষের প্রভাব পড়েছিল অসমে মুঘল শিবির মথুরাপরের ওপরেও। লাখুতে মুঘল নৌবাহিনীর জন্য কোন ত্রাণ পাঠানো সম্ভব হয় নি। অসমে বাহিনীর খাবার অভাব দূর করতে তিনি অসমের দিহিং নদীতে দখল করা ১২০০০ মণ চাল শিবিরে পাঠাতে নির্দেশ দেন। মীর জুমলার প্রশাসক উত্তরসূরী দাউদ খান জাকাতের সম্পূর্ণ দান জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেন, তাতে কিছুটা দর্ভিক্ষের প্রকোপ প্রশমিত হয়।

সুজার সময় থেকে বাঙলার প্রশাসনিক কিছু সংস্কার করার প্রয়োজন হলেও মীর জুমলা সেগুলি করার সুযোগ পান নি। মীর জুমলার মৃত্যুর পর সাময়িকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্তর পক্ষে এটি রূপায়ন করা সম্ভব হয় নি এবং দুর্যোগ আরও গভীরতর হয়। শায়েস্তা খান বাঙলার নবাব(সুবাদার) হয়ে বেশ কিছু যোগ্য প্রতিবিধান করে এই বিশৃঙ্খলতা মেটান। মীর জুমলার যে কটি অর্ধসমাপ্ত কাজ তিনি সমাধা করেন, তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণটি ছিল নৌবাহিনীকে নতুন করে গড়ে তোলা। যে সব পরগণাকে নৌবাহিনীর দেখাশোনা করার জন্য দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বার্ষিক ১৪ লক্ষ টাকার বিনিময়ে, সুজার সময়ে তার গাছাড়া মনোভাবের জন্য, সারা বাঙলা জুড়ে গোলযোগ চলার জন্য এবং রাজস্ব আদায়কারীদের অত্যাচারের জন্য এই অর্থ তোলা যায় নি, নৌবাহিনী। মীর জুমলার পদপ্রাপ্তির ফারমানে আওরঙ্গজেব, ইব্রাহিম খানের নীতি অনুসরণ করে নৌবাহিনীকে নতুন করে গড়ে তোলার সমস্ত চেষ্টা চালানোর নির্দেশ দেন। নৌবাহিনীকে নতুন করে গড়ে তুলতে নৌবাহিনীর পুরোনো ব্যবস্থাপনা বদলাবার কথা ভাবেন, কিন্তু নতুন ব্যবস্থাটি চালু করার আগেই তাকে কোচবিহার-অসম অভিযানে যেতে হয়। এই অভিযানে প্রচুর নৌসেনাপতি মারা যায় এবং গোটা নৌ বাহিনী ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। ইবন হুসেইন পদত্যাগ করলে মহম্মদ বেগকে এর দায়িত্ব দিয়ে তার গুণগত মান, সংখ্যা এবং অবস্থা সমীক্ষাপত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। নৌ বাহিনীর পতনের ফলে বাংলায় মগ এবং পর্তুগিজ হার্মাদদের অত্যাচার বাড়তে থাকে। ১৬৬৪ সালে নৌবাহিনীর দায়ত্বে থাকা সদরইসৈরাব মুনাওয়ার খান ‘কয়েকটি ভাঙা ঝুরঝুরে নৌকো’ সম্বল করে তাদের মুখোমুখি হতে না পেরে পালিয়ে যান। পরে সায়েস্তা খান এসে সামগ্রিক নৌবহর গড়ে তোলেন।


৩। বাংলায় মীর জুমলার আর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক কাজকর্ম কর্ণাটকের মতই বাংলাতেও মীর জুমলার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মূল চরিত্রিটাই হল একচেটিয়া ব্যবসা। বাঙলার সুবাদারির সুবাদে তিনি নানান পণ্য নিজের শর্তে একচেটিয়া কারবারী রূপে কিনে তার শর্তেই সেগুলি বিক্রি করতেন। ১৬৬০ সালে মীর জুমলা ব্রিটিশ কোম্পানিকে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী সোরা সরবরাহ করার প্রস্তাব দেন। মাদ্রাজের কুঠিয়ালের মন্তিব্য তিনি এই পদক্ষেপটি করেছেন এক্কেবারে ব্যক্তিগত লাভের জন্য। সেই সময়ে পাটনার ব্রিটিশ কুঠিয়ালকে ৩০০০০ থলে(৬০০০ মণ) ধারে সোরা সরবরাহ করেন।

নভেম্বর ১৬৬১ সালের ডাচ নথি থেকে পাচ্ছি মীর জুমলা কী ধরণের দাম চড়াতেন। ঢাকার এক শস্য কারবারির থেকে মীর জুমলা ৫০,০০০ টাকা দাবি করেন, আজকের অর্থনীতিতে এটিকে অতিরিক্ত লাভ্যাংশ কর হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। ডাচ সূত্রটি জানাচ্ছে মীর জুমলা দাবি করেন, কোচবিহার অসম অভিযানের আগে তার শিবিরে চাল সরবরাহ করে সেই ব্যবসায়ি দ্বিগুণ লাভ করেছেন। তারা ১০০০০ টাকা দিতে চাইলে তিনি নিজের লগুড় চালাতে শুরু করেন, এবং তার ফলে তারা ২৫০০০ দিতে বাধ্য হয়। এধরণের অত্যাচারে ঢাকার এক ব্যাঙ্কার ৩০০০০০ দিতে বাধ্য হয়।

১৬৫৮ সালে হুগলীর দেওয়ান মালিক বেগ ব্রিটিশদের থেকে কাস্টমস শুল্কের জায়গায় বার্ষিক ৩হাজার(জুন ১৬৫৮) টাকা দাবি করে এই যুক্তিতে যে বর্তমানে প্রাক্তন শাসক শাহজাহান আওরঙ্গজেবের হাতে বন্দী ফলে শাহজাহানের জারি করা কোন ফরমানই প্রযুক্ত হবে না। পরের বছর বালেশ্বরের প্রশাসকও বন্দরে জাহাজ ভেড়ানোর বিপুল শুল্ক দাবি করেন। ব্রিটিশ কুঠিয়ালেরা দুটি দাবিই মানতে অস্বীকার করায় দুপক্ষের মধ্য তিক্ততা আরও বাড়তে থাকে। ১৬৬০-৬১ সালে হুগলীর ব্রিটিশ এজেন্ট মীর জুমলার অত্যাচারে ‘অতিষ্ঠ’ হয়ে তার বাণিজ্য নৌবহরের একটি দেশি নৌকো দখল ক’রে তাদের ধার শোধ করার দাবি রূপে। ব্রিটিশদের ব্যবহারে ক্ষিপ্ত মীর জুমলা কুঠিগুলি ধ্বংস এবং মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে দেশ ছাড়া করার হুমকি দেন। মাদ্রাজের কর্মকর্তাদের পরামর্শে ত্রেভিসা মীর জুমলার সামনে তাদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চেয়ে নেয়। কিন্তু বার্ষিক ৩০০০ টাকার দাবি মীর জুমলা ছাড়েন নি।

প্রত্যেক বছর বিনা শুল্কে ব্রিটিশদের জাহাজে তার পণ্য(যেমন গালা) সম্ভার বিদেশে, বিশেষ করে পারস্যে পাঠানো অভ্যেস করে ফেলেছিলেন মীর জুমলা। গম্ব্রনে ব্রিটিশ কুঠিয়ালকে মাদ্রাজের কুঠিয়াল লিখলেন, যেহেতু মীর জুমলা বাংলায় ক্ষমতায় রয়েছেন, তার পণ্যের ওপরে দেয় কর/শুল্ক না নেওয়াই উচিত। তবে ১৬৬২ সালের মে মাসের ব্রিটিশদের আভ্যন্তরীণ হিসেবে দেখা যায়, মীর জুমলা যা পণ্য পাঠিয়েছেন, তার কর/শুল্ক হিসেব করলে সেটা জাহাজ কাণ্ডে তার প্রাপ্ত অর্থের পরিমান ছাড়িয়ে যাবে বরং এখানে ব্রিটিশেরা মীর জুমলার থেকেই অর্থ পাবেন। বিনিয়োগের ওপর ভাল সুদ পেয়ে মীর জুমলা ব্রিটিশদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় অন্তত ১ লক্ষ ২৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন ত্রেভিসা মার্ফত। সুরাতের কুঠিয়ালদের বিরক্তি সত্ত্বেও বাঙলার এজেন্ট ধার করে বাঙলার পণ্য কেনার নীতি চালিয়ে যান। মাদ্রাজের কুঠিয়ালেরা এই ধরণের ব্যবসায় অভ্যস্ত ছিলেন, কিন্তু ত্রেভিসার ব্যক্তিগতভাবে ঋণ নেওয়াকে মেনে নিতে পারে নি। তাদের আশঙ্কা ছিল এই ঝামেলা আবার তাদের ঘাড়ে এসে না পড়ে। মীর জুমলার মৃত্যুর আগে পর্যন্ত এই ঋণের একটি অংশ ফেরত দেননি ত্রেভিসা। ৯৭০০ বাকি থাকা টাকার মধ্যে ৫৬৭২ টাকা কাশিমবাজার কুঠিয়ালেরা ১৬৬৪ সালের জুন মাসে শায়েস্তা খানকে শোধ করে। ১৬৬৫ সালে এই টাকা দেওয়া নেওয়ার ঝামেলাটির সমাধান হয়।

৪। ইওরোপিয়দের সঙ্গে মীর জুমলার সম্পর্ক(১৬৬০-৬৩) ব্রিটিশদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় মীর জুমলা চতুরতার সঙ্গে সুবিধাবাদ আর চাপে রাখার নীতির মিলমিশ ঘটয়েছিলেন। তার জাহাজ কাণ্ডকে ব্যবহার করে তিনি চাপ দিয়ে আরাকানে পালিয়ে যাওয়া সুজাকে প্রত্যার্পন করিয়ে আনতে বাধ্য করেছিলেন। মীর জুমলার জাহাজ কাণ্ড সমাধান করতে মছলিপত্তনমের কুঠিয়ালেরা নিজেদের মধ্যে সম্মেলন করে যে সিদ্ধান্ত নেয় তা তাদের প্রধান দপ্তর সুরাটের কুঠিয়ালদের যেমন বিরক্তির কারন হয়েছিল, তেমনি মীর জুমলাও এই সিদ্ধান্তে খুশি হন নি। তিনি যে ২৩০০০ প্যাগোডা দাবি করেছিলেন ব্রিটিশদের মনে হয়েছে তা বেশি, এবং তিনি বকেয়া ঋণের টাকা ৩২০০০ প্যাগোডা চেয়েছিলেন তাও কোম্পানি মেনে নেয় নি। ১৬৬০ সালের মাঝামাঝি অসন্তুষ্ট সুবাদার ব্রিটিশদের কাশিমবাজার কুঠি এবং বঙ্গোপসাগরে তাদের সমস্ত কাজ কর্ম বন্ধ করে দিয়ে ত্রেভিসাকে তার সঙ্গে ঢাকায় বৈঠক করতে নির্দেশ দেন। অগস্ট মাসে একটি ছোট বজরা করে হুগলী থেকে ত্রেভিসা ঢাকার পথে রওনা হন। আগস্টের শেষের দিকে মাদ্রাজের কুঠিয়ালেরা হুগলী কুঠিয়ালদের মীর জুমলার চাহইদা পূর্ণ করে শান্ত করার নির্দেশ দেয় এবং সুজাকে কিভাবে ফেরত আনা যায় তার ব্যবস্থা করারও নির্দেশ দেন। ত্রেভিসার দৌত্য সফল হয়, পাটনার ১৫০০০ মণ সোরা যেগুলি পড়েছিল নবাবের গুদামে সেগুলি উদ্ধার হয় এবং মীর জুমলা সে সময় ব্রিটিশ আর ডাচেদের সুজাকে প্রত্যার্পণে তাকে সাহায্যের নির্দেশ দিলেন।

আওরঙ্গজেবের উদ্বিগ্নতা বুঝে ২৭ অক্টোবর ১৬৬০ সালে ডাচ প্রধান কুঠিয়াল ম্যাথায়াস ভ্যান ডেন ব্রোককে জানান তিনি আরাকান থেকে সুজাকে প্রত্যার্পণে ইচ্ছুক এবং তাকে প্রথমে মুঘল হুগলীতে আনবেন। আর তার এই উদ্যমে সুজা যদি ডাচ জাহাজ করে পারস্য বা মোকায় পালিয়ে যেতে চায়, তা যেন তারা রোখেন। এই কাজটি ডাচেরা করে দিলে ব্রিটিশদের থেকেও বেশি ব্যবসার সুযোগ সুবিধে দেওয়া হবে বলে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন।

সামরিক কারণে মীর জুমলা ব্রিটিশ, ডাচ এবং পর্তুগিজ জাহাজ ব্যবহার করেছেন। ত্রেভিসা যে বজরায় করে ঢাকায় এসেছিলেন, তার ইওরোপিয় নাবিকদের তিনি তার বাহিনীতে নিয়োগ করেন। যুদ্ধ জাহাজ তৈরিতে তিনি ব্রিটিশ আর ডাচেদের সাহায্য নেন। হুগলীতে তৈরি একটি ডাচ গ্যালিওট জাহাজকে ব্রিটিশদের থেকে পালিয়ে আসা ক্যাপ্টেন জন ডুরসনের নেতৃত্ব এক নাবিক বাহিনী ঢাকায় নিয়ে যায় ১৬৬১ সালের মে মাসে। টমাস প্রাট নামক একজন ব্রিটিশকে যুদ্ধ জাহাজ এবং তার উপযোগী গোলাগুলি বানানর জন্য মির জুমলা নিয়োগ করেন। কিছু ইওরোপিয় বন্দুকবাজ মীর জুমলার অসম আভিযানে অংশ নিয়েছিল।

মীর জুমলার জীবদ্দশায় জাহাজ কাণ্ডটির সমাধান ঘটে নি যদিও তার মছলিপত্তনমের কর্মী টাপাটাপার কাছে সেই জাহাজটি ফেরত দেওয়ার কথা ব্রিটিশেরা বলেছিল। ১৬৬২ সালে কেড্ডা থেকে মালাক্কায় যাওয়ার সময় বিপুল ঝড়ের সামনে পড়ে সেটি তার কাজের ক্ষমতা হারায়। মীর জুমলাকে শান্ত করতে মাদ্রাজ কুঠিয়ালের সেটির বদলে অন্য একটি জাহাজ প্রতিস্থপনের প্রতিশ্রুতি দেয়, এবং একই সময়ে তারা মছলিপত্তনমের কুঠিয়ালদের, টাপাটাপার উত্তরসূরী আলি বেগকে অবস্থার কথা এবং তাদের বাধ্যবাধকতা বুঝিয়ে বলতে নির্দেশ দেয়। মীর জুমলার মৃত্যুর(ডিসেম্বর ১৬৬৩) পরে ব্রিটিশদের ধারনা হয়, তার পুত্র মহম্মদ আমিন সব ভুলে যাবেন। ১৬৬৫ সালে মাদ্রাজের কুঠিয়ালেরা কোম্পানিকে জানায় যে তখনও পর্যন্ত কোন দাবিদাওয়া ওঠে নি, মৃত নবাবের সব নথিপত্র আওরঙ্গপজেবের কাছে পাঠানো হয়েছে। তারা আশা করছে চুক্তিপত্র উল্লেখ করে ত্রেভিসার মীর জুমলাকে শান্ত করার চিঠিটি একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গিয়েছে। মোটামুটি তাদের মনে হয়েছে জাহাজ পর্ব সমাধা হয়ে গিয়েছে।

মীর জুমলার মৃত্যুর প্রভাব[সম্পাদনা]

৫। মীর জুমলার মৃত্যুর প্রভাব

বার্নিয়ে লিখছেন, ‘মীর জুমলার মৃত্যুর সংবাদে ভারত জুড়ে উত্তেজনার ঝড় তৈরি হল। বাওরি(Bowery)ও লিখছেন, তার রাজ্যের জ্ঞানী এবং সুচিন্তিত মানুষকে দুঃখ সাগরে ডুবিয়ে, মীর জুমলা মারা গেলেন। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রের যে ক্ষতি হল, তা অপূরণীয়। সে সব থেকে দক্ষ নবাবকে হারাল। ২৩ এপ্রিল মীর জুমলার মৃত্যু সংবাদ লাহোরে আওরঙ্গজেবের কাছে পৌঁছল। মাঝের কিছু সময় ইতিশাম খান প্রশাসন এবং রায় ভগবতী দাস বাঙলা রাজস্ব প্রশাসনের দেখাশোনা করতেন। বাঙলা আর দাক্ষিণাত্যে মীর জুমলার সমস্ত সম্পত্তি রাষ্ট্রের নামে নিয়ে নেওয়া হয়েছিল, সেটি তার পুত্রের দখলে ফিরিয়ে দিল মুঘল সাম্রাজ্য। নাতি মীর আবদুল্লাসহ, মীর জুমলার পরিবারবর্গ, তার সম্পত্তি, হাতি ইত্যাদি নিয়ে ইতিশাম খান সম্রাটের নির্দেশে দরবারের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। সম্রাট নির্দেশ দিলেন যতক্ষণনা বিহার থেকে দাউদ খাঁ এসে পৌঁছচ্ছেন, ততক্ষণ দিলির খাঁ সুবাদার হিসেবে কাজ চালাবেন, এবং সুবাদার হিসেবে শায়েস্তা খাঁ যতক্ষণ না এসে পৌঁছচ্ছেন ততক্ষণ দাউদ খানই প্রশাসন চালাবেন।

বাঙলার প্রশাসন থেকে মীর জুমইলার মত দক্ষ, কড়া এবং প্রভাবশালী প্রশাসক চলে যাওয়ার পরে সুবা জুড়ে চরম অরাজকতা এবং প্রশাসনের কাঠামোয় শিথিলতা নেমে আসে। খানইখানানএর কড়া চাবুকে যে সব স্বার্থবাহী নিরস্ত ছিল, তারা নিজেদের চরিত্র জানান দিতে থাকে। উচ্চাকাঙ্ক্ষী আমলা এবং ব্যক্তিরা প্রকাশ্যেই তাদের স্বার্থ পূরণ করতে উঠেপড়ে লাগল। ইতিসাম খান চরম দুর্বিনীত হয়ে উঠলেন। পদমর্যাদায় এবং ব্যক্তিত্বে তার থেকে অনেক ধাপ ওপরে থাকা দিলির খান অসন্তুষ্ট হলেও মনোভাব প্রকাশ্য করলেন না। প্রত্যেকেই স্বজনপোষণের চরম শিখরে উঠতে লাগল। ক্ষমতাচ্যুত জমিদারেরা তাদের জমিদারি দখল নিলেন। শিহাবুদ্দিন তালিশ এই সময়টিকে জঙ্গলের রাজত্ব নাম দিয়ে লিখছেন, মীর জুমলার মৃত্যুর পর বাংলায় অবিচার এবং বিদ্রোহ ছেয়ে যেতে শুরু করল।

সামরিক বাহিনীতেও এর প্রভাব কম পড়ে নি। মীর জুমলার মৃত্যুর পর কোচবিহার দখলের পরিকল্পনা স্থগিত করা হল। মীর জুমলা এই কাজে যাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন আকসর খানের জেদএ দাউদখানের সমস্ত প্রস্তাব এবং পরামর্শ বিফলে গেল। আকসর খান নিজের জমিদারি চাকলা ফতেপুর ফিরে পেতে উদ্যোগী হয়ে উঠলেন।

মীর জুমলার পরওয়ানা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ব্যবসার শর্ত নিয়ন্ত্রিত হত। মীর জুমলার সমস্ত শুল্ক/কর দেওয়া থেকে ব্রিটিশদের বাঁচিয়ে রাখার পদক্ষেপএর আইনি বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠল, কেননা শাহজাহানের পরওয়ানা তখনও নতুন সম্রাট সম্মতি দেন নি। মীর জুমলার সময়ের বাধ্যবাধকতা থেকে বেরিয়ে এসে সর্বস্তরের আমলা, সওদাগরেদের থেকে বহিঃশুল্ক দাবি করল। মীর জুমলা তাদের ফোর্ট জর্জের যে অধিকার ব্রিটিশদের দিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা তার শাসনে বসা উত্তরাধিকারীরা কিভাবে দেখবে তাই নিয়ে সংশয় দেখা দিল। ডাচেরা সম্রাটের থেকে ফরমান নিয়েছে এই যুক্তি দেখিয়ে বালেশ্বর, পাটনা এবং মাদ্রাজের কুঠিয়ালেরা সুরাটের কর্তাদের আওরঙ্গজেবের থেকে নতুন ফরমান আদায়ের জন্য উদ্যোগী হতে অনুরোধ করলেন। সুরাটের কর্তাদের গড়িমসিতে ক্ষুব্ধ বাঙলার কুঠিয়ালেরা দেওয়ান রায় ভগবতী দাসের থেকে একটা নির্দেশ নামায় পরিষ্কার করে নিলেন মীর জুমলার পরওয়ানা তখনও কার্যকর রয়েছে।


==সপ্তম অধ্যায় প্রথম পর্ব অসম অভিযানের মুখবন্ধ – কোচবিহার জয়==

১। সুজার কবল থেকে বাংলার নিয়ন্ত্রণ ছিনিয়ে নেওয়ার পরে পরেই ভীমবেগে মুঘল ভারতের উত্তরপূর্ব ভারতের অসম রাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনা ছকে ফেলা হল। ইওরোপিয় লেখকেদের বক্তব্য মুঘল পাদশাহ ভেবেচিন্তেই তার রণকুশল সেনানায়ককে সব থেকে কঠিন পরীক্ষার মধ্যে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলেন যাতে মীর জুমলা দিল্লি থেকে বহুকাল বহুদূরে থাকতে বাধ্য হন। এই আক্রমণের পরিকল্পনার পিছনে আরও একটা বিষয় কাজ করছিল, মীর জুমলা তার বাহিনীকে নিয়ে বার্মা হয়ে চিন অভিযানের স্বপ্ন দেখে বিশ্বজয়ী হবার বাসনা মনে মনে পোষণ করতেন। অসম বুরুঞ্জীর লেখকদের অভিযোগ যে মীর জুমলা তার স্বপ্ন সাকার করতে সম্রাটের অনুমতি পর্যন্ত নেন নি। তবে বাদশাহের যে ফারমানে(জুন ১৬৬০) মীর জুমলাকে বাঙলার সুবাদার নিয়োগ করা হয়েছিল, সেই নথিতেই তাকে বাঙলার ঘটনাবলী নিয়ন্ত্রণ করে,। তাকে অসম এবং আরাকানের রাজাদের আক্রমণের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিক কাজটি ছিল পালিয়ে থাকা সুজাকে আরাকান থেকে প্রত্যার্পন। তবে মীর জুমলা আরাকান আক্রমণ সাময়িক স্থগিত রেখে প্রথমে কোচবিহার-অসম অভিযানের অনুমতি আওরঙ্গজেবের থেকে নিয়েছিলেন। তবে আমাদের মনে হয় সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল কোচবিহার-অসম জিতে শুধু সাম্রাজ্যের সম্মান বজায় রাখাই নয়, সাম্রাজ্যকে নিরাপদ রাখাও অন্যতম দৃষ্টিভঙ্গী ছিল। ১৬৩৯ সালের অসম-মুঘল চুক্তি অনুযায়ী পশ্চিম অসমের গুয়াহাটি থেকে মানস(মানাহা) নদী পর্যন্ত ভূভাগটি ছিল মুঘল নিয়ন্ত্রণে। তাদের ফৌজদার গুয়াহাটি থেকে কামরূপ সরকার শাসন করতেন। ১৬৫৭য় শাহজাহানের অসুস্থতা এবং সুজার বাঙলা সুবার নিয়ন্ত্রণ ঢিলে হয়ে যাওয়া আর তার নৌবহর শক্তিহীন হয়ে যাওয়ার পরেই হাজো শুদ্ধ মানস থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের উত্তরতটের এলাকায় দুটি আগুন(মার্চ এপ্রিল ১৬৫৮) জ্বলে ওঠে।

পশ্চিম থেকে মুঘল অধিকৃত কোচবিহার রাজ্যের রাজা প্রাণনারায়ন স্বাধীনতা ঘোষণা করে প্রজা এবং মুসলমানদের ওপর অত্যাচার শুরু করে হাজোয় শিবির স্থাপন করে। পূর্ব থেকে আক্রমন করে রাজা জয়ধ্বজ সিংহের সেনানায়ক বরগোঁহাই তাংচু সান্দিকুই করতোয়া পর্যন্ত জমি দখল করার মানসিকতা নিয়ে। কোন প্রতিরোধ না করতে পেরে মুঘল ফৌজদার মীর লুফতুল্লা পালিয়ে আসে জাহাঙ্গীর নগর(ঢাকা)। সান্দিকুই কোচেদের হাজোয় পরাজিত করে তাড়িয়ে দেয় এবং হারার পর মুঘলদের সঙ্গে যৌথ লড়ায়ে কোচেদের প্রস্তাব সান্দিকুই প্রত্যাখ্যান করে, বারিতলা পর্যন্ত কোনরকম বাধা ছাড়াই এগিয়ে এসে হাটশিলা বা হাতডোবা(ঢাকা থেকে মাত্র কিছু দূরে কারিবাড়ি বা কারাইবাড়িতে)য় সেনা ছাউনি স্থাপন করে, মুঘলদের স্থানীয় বাজারে আসার নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং অত্যাচারের ঝাঁটাপেটা করে বহু মুঘলকে গ্রেফতার করে, তারা সেখানেই বসবাস করতে বাধ্য হয়।

মীর জুমলার বাঙলা প্রবেশের ঠিক আগে মুঘলদের মাথা ব্যথা ঘটানোর এই সব কাণ্ডগুলির কিছু আগে জাহাঙ্গীর আর শাহজাহানের সময় যথাক্রমে সৈয়দ আবু বকর এবং আব্দুস সালামকে অহোমেরা গ্রেফতার করে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে মুঘলেরা কিছু করতে পারে নি। আওরঙ্গজেবের কালে মীর জুমলা বাঙলার ক্ষমতা দখল করলে তাকে এইগুলির প্রতিশোধ নিতে বলা হয়। এটা যে শুধু সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা ছিল তাই নয়, তার কাছের ওয়াকিয়ানবিশ বলছেন, বিধর্মী অহমিয়াদের ওপর ধর্মযুদ্ধ চালাতে চাইছিলেন, যাতে যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দেওয়া যায়, মূর্তিপুজকদের শিক্ষা দেওয়া যায়, ইসলামি ধর্মাচারণের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলিয়ে নিতে বাধ্য করা যায় এবং অবিশ্বাসীদের আচার আচরণ নিষিদ্ধ করা যায়।

২। মীর জুমলার যুদ্ধ প্রস্তুতি

আওরঙ্গজেবের জয় এবং ঢাকায় মুঘলদের যুদ্ধ প্রস্তিতির সংবাদে কোচ আর অহোম রাজারা মুঘলদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করার জন্য প্রস্তাব পাঠায়। অহোম রাজা জয়রাজ শান্তির অনুরোধ জানিয়ে বললেন, তিনি কামরূপ জয় করেছেন কোচদের হাত থেকে উদ্ধার করার জন্য, এখন সেটি মুঘলদের হাতে তুলে দিতে চান। এই প্রস্তাবে মীর জুমলা অহোম রাজ্যকে দখল নিতে রশিদ খানকে পাঠালেন এবং বর্ষার আগে আরাকানে সুজাকে দখল নেওয়ার পরিকল্পনা করলেন। কিন্তু তিনি কোচ করদ রাজ্যের রাজা প্রাণনারায়নকে ছাড় দিতে রাজি হলেন না, রাজা সুজা সিংএর নেতৃত্বে বাহিনী পাঠালেন। তাকে সাহায্য করার জন্য তার পিছন পিছন মীর্জা বেগ সুজায়ীকে। প্রাণনারায়ন দূতের হাত দিয়ে পাঠানো চিঠ সেনানায়ক না পড়েই তাকে কয়েদ করা হয়। অহোম আর কোচদের শান্তি প্রস্তাব আদতে সময় নেওয়ার ছল, যাতে তারা পাল্টা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে পারে। সুসজ্জিত অহোমদের বিরুদ্ধে এগোতে সাহস না পেয়ে রশিদ খান রাঙামাটিতে শিবির ফেললেন। ওদিকে সুজন সিংহ কোচেদের বিরুদ্ধে একদুয়ারের বেশি এগোতেই পারলেন না(মে-জুন ১৬৬১), ভয়াল উত্তরবঙ্গের বর্ষা সামনে আসছে জেনে সেখানে ঘাঁটি গেড়ে বসলেন। কোচেদের বিরুদ্ধে নিজে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করবেন এবভং সম্ভব হলে অহোমদের বিরুদ্ধেও, তাই তিনি বাংলা প্রশাসনে কিছু পরিবর্তন আনলেন। ১৬৬১ সালের ১ নভেম্বর মীর জুমলা এবং দিলির খান খিজিরপুর থেকে ১২০০০ ঘোড়া, ৩০০০০ পদাতিক, প্রচুর যুদ্ধ জাহাজ সহ ৩২৩টা নৌকোর নৌবহর নিয়ে এগোলেন। এই বাহিনীর মধ্যে সব থেকে ভয়াল ছিল ডাচেদের ঘুরাবগুলি, প্রত্যেকটির সঙ্গে ১৪টি কামানযুক্ত ৫০-৬০ জন সেনানী সহ চারটি কষা নৌকো। দোআঁশলা ম্যাস্টকোস ছাড়াও পর্তুগিজদের সব থেকে দক্ষ নৌসেনানীর সঙ্গে ছিল কিছু ডাচ এবং ইংরেজ সেনানীও। ইওরোপিয় যোদ্ধাদের সম্বন্ধে মীর জুমলার সদর্থক মনোভাব ছিল বিশেষ করে পর্তুগিজ, ডাচ গোলান্দাজ আর আমেরিকান রিসালা(ঘোড়সওয়ারদের) ওপর তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত দোআঁশলা পর্তুগিজ ছিল। ডাচেদের মাইনে দেওয়া হত, কিন্তু পর্তুগিজ আর ব্রিটিশেরা সেচ্ছাসেবা দিতে এসেছিল। ৩। মীর জুমলা কোচবিহার দখল করলেন বারিতলা সীমান্ত শিবিরে পৌঁছে মীর জুমলা কোচবিহারের দিকে দুটি পরিচিত রাস্তা, একটা একদুয়ার হয়ে যেটিতে রাজার সেনাবাহিনী সারাক্ষণ নজর রেখেছে, একটি সুসজ্জিত শিবিরও রয়েছে, আরেকটি কুঠিঘাট হয়ে রাঙ্গামাটি দিয়ে দুপাশে জঙ্গলে ভরা ছোট রাস্তা, নালা পার করে যাওয়া যায়। এটি খুব ব্যবহার হয় না। তার দূরদৃষ্টিতে তিনি এই রাস্তাটি বাছলেন এবং এগোলেন এবং এই রাস্তায় খুব বড় নজরদারি নেই, রাস্তার তলায় কোচবিহারের বাইরের দেওয়ালের ছোট আল দিয়ে মুঘল বাহিনী চলতে লাগল। বাহিনী এই পথটা নজরদারি করা শুরু করল। সুজন সিংএর সঙ্গে মীর জুমলার আসার খবর পেয়ে যতটুকু প্রতিরোধ ছিল তাও হল না, সেনারা সব পালিয়ে গেল(১৩ ডিসেম্বর ১৬৬১)। পরের দিন মীর জুমলা আলের পথ ধরলেন। খচ্চরে চড়ে জঙ্গুলে রাস্তা তৈরিতে সাধারণ সেনানীর সঙ্গেও হাত লাগালেন। কোচবিহারে পৌঁছতে আর তিন ধাপ বাকি তখন খবর এল মন্ত্রীকে নিয়ে রাজা ভূটানের সীমান্তে কাঠাঁলবাড়ি হয়ে মারাঙ্গের পথে পালিয়ে গিয়েছেন। জঙ্গল পার হয়ে, নালা পায়ে হেঁটে বাধাহীন ভাবে ১৯ ডিসেম্বর মীর জুমলা কোচবিহারের রাজধানীতে পৌঁছলেন।

৪। কোচবিহারে মীর জুমলার প্রশাসন

মীর জুমলা কোচবিহারকে তো মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভূক্ত করলেন। তার প্রশাসন ছিল তেজি কিন্তু বোঝাপড়ায় সমৃদ্ধ, যাতে সাধারণ মানুষ তুষ্ট হয়। সদর মীর মহম্মদ সিদ্দিকিকে দিয়ে তিনি রাজপ্রাসাদ থেকেই নামাজ পড়ালেন। একডালা দুর্গ ধ্বংস করালেন। ১০০ গজের মধ্যে যে সব জঙ্গল ছিল কেটে ফেলে সমতল করা হল। ১০৬টা কামান, ১৪০টা জম্বুরক, ১১টা রামছঙ্গী, ১২৩তা বন্দুক যুদ্ধ সামগ্রী দখল নিয়ে ঢাকা পাঠানো হল। রাজার ব্যবহৃত নানান জিনিস মহম্মদ আবিদকে দিয়ে পরীক্ষা এবং হিসেব করানো হল। কোচবিহারের নাম হল আলমগীরনগর। মীর জুমলার প্রস্তাবে আওরঙ্গজেবের নির্দেশে আকসর খান স্থায়ী ফৌজদার হিসেবে যোগ না দেওয়া পর্যন্ত আল্লা ইয়ার খানের পুত্র ইসগান্দিয়ার বেগ(খান)কে অন্তর্বর্তীকালীন ফৌজদার, কাজি সামুই সুজাইকে দেওয়ান, মীর বাহাদুর রজ্জাককে মনসবদার এবং খ্বাজা কিশোর দাসকে আমিন পদে নিয়োগ করা হল। দেশের শাসন ব্যবস্থায় যদি ঠিকঠাক পরিবর্তন আনেন, তিনি প্রজ্ঞা দেখিয়েছেন রায়তদের সেনানীর লুঠের হাত থেকে বাঁচিয়ে। শহরে ঢোকার আগেই তিনি নির্দেশ দিয়ে সেনাদের, উপস্থিত-পালিয়ে যাওয়া রায়তদের বাড়ির আসবাব এবং অন্যান্য সব সম্পত্তি অত্যাচার লুঠ করার নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছিলেন। আর যারা করবে তাদের চরম শাস্তি এবং জরিমানা করা হবে। যে সব সেনা পালিয়ে যাওয়া রায়তদের উঠোন থেকে গরু বা ছাগল বা ফসল লুঠ করেছিল, তাদের চুরি করা দ্রব্যগুলো গলায় ঝুলিয়ে শহরের ঘুরিয়ে দেখানো হল। প্রত্যেক রায়তকে শহরে ফিরে আসতে উৎসাহ দিয়ে বাড়ি ফিরে চাষাবাদ করতে বলা হল। আলমগির নগরে একটা টাঁকশাল তৈরি করে সেখান থেকে সম্রাটের নামে মুদ্রা ছাপানোর ব্যবস্থা করা হল। রাখাল দাস বন্দ্যোপাধ্যায় লিখছেন, মুঘল জামানার একমাত্র মুদ্রা যেটিতে বাঙলা অক্ষরে পারসিক না হয় আরবিতে ভাষায় লেখা রয়েছে। স্থানীয় সংস্কৃতিকে শ্রদ্ধা এবং যতদূর সম্ভব পরিবর্তন না করার মীর জুমলার এই নীতি অসাধারণ। রাজার পুত্র মুঘলদের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইসলাম গ্রহন করেন এবং বাবাকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দেয়। তার উজির ভবনাথকে দুপাশ থেকে ইফান্দিয়ার এবনহ ফারহাদ খান ধরে আনে এবং রেজা কুলি বেগ আবাকীশ তাকে গ্রেপ্তার করে এবং কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু রাজাকে ধরা সম্ভব হয় নি। তিনি ভূটান পাহাড়ের তলদেশ কাঁঠালবাড়ি থেকে শৃঙ্গের দিকে ঊঠে গিয়েছিলেন। দূতেরা হাতি, দুটি ঘোড়া এবং তার সেগুলির ভূটিয়া মালিককে নিয়ে ফিরে এল। পশুগুলি নবাব দখলে নিলেন এবং ভূটিয়াকে গ্রেফতার না করে তিনি ভূটানরাজ ধর্মরাজাকে চিঠি লিখলেন রাজাকে ফিরিয়ে দিতে, না হয় অন্তত বহিষ্কার করতে। ভূটানের রাজা তার আশ্রিতকে মীর জুমলারহাতে তুলে দিতে রাজি হলেন না। ভূটানের রাজাকে শাস্তি না দিয়েই তিনি ১৬ দিন কোচ বিহারে থেকে অসম(৪ জানুয়ারি, ১৬৬২) অভিযানে বেরিয়ে গেলেন। ১৬৬২র বর্ষায় রাজা পাহাড় থেকে নেমে এসে তার রাজ্য দখল নিলেন। প্রজারা তত দিনে মুঘলদের চাপিয়ে দেওয়া রাজস্ব ব্যবস্থায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। তিনি মনসবদার মহম্মদ সালিহকে কাঁঠালবাড়িতে খুন করলেন, এবং ইসফানদিয়ার খানের কাছে রসদ আসার পথ কেটে দিলে গোলাঘাটে পালিয়ে যান। আসকর খান পৌঁছলেও কোচবিহার উদ্ধার করতে পারলেন না।


দ্বিতীয় পর্ব

ক। মুঘল কামরূপ উদ্ধার অসমের দিকে যুদ্ধ জয়ের পথে

১। অহোমদের বিরুদ্ধে উদ্দীপ্ত অভিযানে মীর জুমলা

১৬৬১ সালে রশিদ খানের অভিযানের সংবাদে অহোমেরা হাতিশালা এবং ধুবড়ি ছেড়ে মানস নদী পার করে পশ্চাদপসরণ করে। রশিদ অহোমদ পশ্চিমি অসম থেকে রাঙ্গামাটি পর্যন্ত এলাকা দখলে নিলেন। রাস্তায় চোরাগোপ্তা আক্রমণের ফাঁদ পাতা রয়েছে অশংকা করে মীর জুমলার আসার প্রতিক্ষায় শিবির ফেললেন। অহোম সেনা পিছিয়ে আসার জন্য রাজা দুজন ফুকনকে(দিহিঙ্গিয়া এবং লাহুয়ি) দায়ি করে গ্রেপ্তার কজরলেন এবং দক্ষিণ অসম রক্ষা এবং সেনাবাহিনীর দায়িত্ব দিলেন বরদলোই পরিবারের হিন্দু কায়স্থ ভাণ্ডারী(স্টোরকিপার)মানথির ভরালী বড়ুয়াকে। মানসের মুখে যোগীগুপার নিরাপত্তা জোরদার করা হল। অহোম সেনাপতি আহাতুগুড়িয়া লাহন ফুকন এবং কান্ডু খামনের নেতৃত্বে ব্রহমপুত্রের উল্টো দিকের তীরে পঞ্চরতনে একটি দুর্গ তৈরি করা হল। সেনা অভিযানের কারণ জানতে চেয়ে কামরূপের রাজা অহোম প্রধানকে রশিদ খানের উদ্দেশ্যে দূত হিসেবে পাঠালেন। দুর্বিনীত দূতকে ঢাকায় মীর জুমলার উদ্দেশ্যে পাঠিয়ে দেওয়া হল। তাকে মীর জুমলা জানালেন, রাজা যদি তাদের অধিকারের মুঘল কামরূপ অঞ্চলটি, আর দখলি সম্পত্তি ফিরিয়ে দেন, তাহলে আর মুঘল বাহিনীর আক্রমণের যাবে না বরং তিনি উপযুক্ত উপঢৌকন আর তার মেয়েকে উপহার হিসেবে পাঠাবেন। কামরূপ দখলে না রাখতে পারা ঘিলা বিজয়পুরের জয়নারায়ন অহোম রাজার শাস্তি এড়াতে মীর জুমলার সঙ্গে যোগ দিলে মীর জুমলা বুঝলেন অসম দখলের সুবর্ণ সুযোগ উপস্থিত এবং পরিকল্পিত আরাকান আক্রমন পরের বছরের জন্য আপাতত স্থগিত রেখে কোচবিহার এবং অসম আক্রমনে যাওয়ার প্রস্তাব পাঠান পাদশাহের কাছে। তিনি আওরঙ্গজেবকে লিখলেন অহোমেরা কামরূপ দখল করে এবং আমাদের আক্রমণের পরিকল্পনা করছে। আমার মনে হয় এত কম সময়ে মগ দেশ দখল করা যাবে না, ইতোমধ্যে আমার প্রস্তাব কোচবিহার এবং অসম আক্রমন করা হোক। আওরঙ্গজেব তার সেনানায়কের পরিকল্পনা অনুমোদন করলেন। আহোম রাজা ফুকনদের নির্দেশ দিলেন মুঘলদের কাছে কামরূপ আত্মসমর্পন না করতে, যেহেতু এটি মুঘলদের থেকে নয়, কোচেদের থেকে দখল করা হয়েছে। মীর জুমলা কোচবিহার দখল করার পরে যে প্রস্তাবটি অহোমদের পাঠান, তারা তা উপেক্ষা করলেন।

২। মীর জুমলার আরম্ভিক সমস্যা

৪ জানুয়ারি ১৬৬২ সালে মীর জুমলা বিহার থেকে অসমের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে গেলেন। রাঙ্গামাটিতে রশিদের ছাউনিতে যোগ দেওয়ার জন্য কুন্তাঘাটের জঙ্গলের পথ ধরলেন। পদাতিক বাহিনীর সুরক্ষায় নাওয়ারা(নৌবাহিনী) ব্রহ্মপুত্র দিয়ে এগিয়ে গেল। স্থানীয় এলাকার ভূমিরূপ না জানা থাকায় মীর জুমলাদের প্রাথমিকভাবে খুব সমস্যা হল। মীর জুমলার নেতৃত্বগুণে এবং বাধানা মানার উদগ্রবাসনায় প্রকৃতি আর মানুষের সমস্ত বাধা তুচ্ছ করে স্থানীয় জমিদারদের থেকে ঠিক খবর সংগ্রহ করে সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রহ্মপুত্রর পাড় ধরেই এগোবেন যাতে তার বাহিনীকে সহজে ব্যবহার করা যায়। তিনি তার বাহিনীর নির্দেশক দিলির খান এবং গোলাগুলির ভাণ্ডারের দারোগা মীর মুর্তাজাকে নির্দেশ দিলেন জঙ্গলের কঠিন পথ ছেড়ে ব্রহ্মপুত্রের দিকে এগিয়ে যেতে। তালিশের ভাষায় ‘মানুষের নেতা’ বৃদ্ধ কিন্তু হার না মানা সেনা নায়ক সুর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত রাস্তা তৈরির কাজে নিজে হাত লাগালেন, একমাত্র ছুটি নামাজের সময়টুকু। নানান বাধা অতিক্রম করে রাস্তা তৈরি হল। পদাতিক আর হাতিদের দিয়ে খাগড়া গাছগুলি মাড়ানো হল, হ্রদ আর জলাভূমিগুলি বোজানো হল ঘাস আর গাছের কাণ্ড দিয়ে, নালাগুলি পায়ে হেঁটে পেরোবার উপযুক্ত করে তোলা হল।

যে অমানুষিক পরিশ্রম সেনানায়কদের সঙ্গে সাধারণতম সেনাটি করেছিল তার চোখে দেখা বিবরণ রয়েছে তালিশের লেখায়। বিপুল পরিশ্রমে জঙ্গল পরিষ্কার করে বিশ্রাম নেওয়ার সময় সেনারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ত, ভুল যায়গায় পা ফেলে কত সেনা মৃত্যুর মুখে পড়েছে, খাগড়ার ছুঁচোল ডগা বহু সেনানীর পায়ে ঢুকে গিয়েছে, বাঁশের আঘাতে রিসালা বাহিনীর সেনানী মৃত্যুমুখে পড়েছে, বন্দুকধারী আর পা দিয়ে তীরছোঁড়ার বাহিনী ভার বইতে বইতে ক্লান্ত অসুস্থ হয়ে পড়েছে। রাস্তার কাদা আর জলাভূমি সেনাবাহিনীর অগ্রগতি প্রায় থামিয়েই দিল। বিপুল সেনাবাহিনীর জন্য শুধুই একটা ছোট রাস্তা বানানো গেল। পশুমানুষ পরস্পরের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে সরু রাস্তায় বাধ্য হয়ে কষ্ট করে চলতে লাগল। পরিশ্রান্ত, উদ্ভ্রান্ত হাতির হকি লাঠির মত শূঁড়ের আতর্কিত আক্রমনে, ঘোড়ার চাঁটে, উটের ধাক্কায়, ষাঁড়ের পা আর শিঙের চোটে বহু সেনানী মৃত্যুবরণ করেছে। ঘন জঙ্গল, নালা, জলাভূমির জন্য সেনাবাহিনী দৈনন্দিন ৪-৫ মাইলের বেশি এগোতে পারল না।

৩। গুয়াহাটি পৌঁছলেন মীর জুমলা

১৭ জানুয়ারি মীর জুমলা মানস এবং ব্রহ্মপুত্রের সংযোগস্থলের উঁচু জমি যোগীগুপার ৫ মাইল পশ্চিমে পোঁছলেন। নদী আর পাহাড়ি উঁচু জমিতে দুর্গ। সেখানে পশ্চিম থেকে অতর্কিতে আক্রমন করা অসম্ভব। অহোমি রণনীতি অনুসরণ করে এই মাটির দুর্গে অহোমরা বাদুলি ফুকনের নির্দেশে দুর্গের পশ্চিম দিকটি ছুঁচল বাঁশের ডগা – ফাঞ্জি, পুঁতে সুরক্ষিত করেছিল এছাড়াও প্রচুর লুকোনো গর্তও তৈরি করে রাখা ছিল। দূর্গের উত্তরটায় লুকোনো গর্ত, জঙ্গল আর পাহাড়ের নিরাপত্তা ছিল। ডাঙ্গারি অহোমেরা এই দুর্গটি পাহারা দিতে দিতে দাস্ত(কলেরা) রোগের প্রাদুর্ভাব হওয়ায় ছেড়ে চলে যায়। ২০ জানুয়ারি যুদ্ধ ব্যতিরেকে এটি দখল করে মীর জুমলার বাহিনী।

দুরন্ত এবং গভীর মানস নদী পার করে মীর জুমলা তার বাহিনীকে দুটি ভাগে ভাগ করেন। তিনি মূল সেনা নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের উত্তরপাড় দিয়ে আর দক্ষিণ পাড় দিয়ে সৈয়দ নাসিরুদ্দিন খান এগোলেন। মাঝে ব্রহ্মপুত্রে নৌবাহিনীর সারি, ভূমিতলের বাহিনীর সঙ্গে তাল রেখে চলতে শুরু করে।

মীর জুমলার ত্রিফলা আক্রমন সফল হল। যোগীগুপার পতনের খবর পেয়ে রাজা শ্রীঘাট(সরাইঘাট, রাজার শ্বশুর রাজসাউর)এ বাহিনী পাঠালেন যাতে শত্রুর ওপরে জোরদার আক্রমন চালানো যায়। যোগীগুপার থেকে এই দুর্গটি আরেকটু উঁচু এবং রক্ষণটি বেশ মজবুত, সারসার পাঞ্জি, লুকোনো গর্ত আর বল্লার পাঁচিলে ঘেরা। অহোম বাহিনী আসার আগেই মীর জুমলা শ্রীঘাটে পৌঁছে ‘খাট্টার চৌকি’ এবং এই দুর্গটি দখল নেন। ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি শ্রীঘাট এড়িয়ে গিয়ে গুয়াহাটি অবরোধ করেন। খবর পেয়ে রাতের বেলায় আতঙ্কিত অহোম বাহিনী নৌকো করে কাজলির দিকে পালিয়ে যায়। ৫ তারিখে হাজি মহম্মদ বাকর ইস্পাহানিকে নির্দেশ দিয়ে শ্রীঘাটের শালবল্লার পাঁচিল হাতি দিয়ে ভেঙ্গে দেন। দুমাইল দূরে ব্রহ্মপুত্রের উত্তরপাড়ের মুঘল কামরূপের রাজিধানী গুয়াহাটি দখল করেন।

দক্ষিণের বাহিনীটি ফুলবড়ুয়াকে হারিয়ে পঞ্চরত্ন দুর্গটি দখল করে, ফুলবড়ুয়া হেরে সমধারায় পালিয়ে যায়। শ্রীঘাটের উল্টোদিকে শ্রীঘাটের মতই সুরক্ষিত পাণ্ডু দুর্গটি বিনা যুদ্ধে মুঘলেরা দখল করে। পালিয়ে যাওয়া বহু অহোমকে ইয়াগধর খান উজবেগ হত্যা করেন। পাণ্ডুর পূর্বে বেলতলা দুর্গও রাতের আক্রমনে দখল করে রক্ষীদের গণহারে হত্যা করা হয়। পাণ্ডুত ১৪ মাইল কলং নদীর মুখে দূরে শ্রীঘাটের মত গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ কাজলিও দখলে আসে। অহোমেরা জাম্বুর্কা, বন্দুক, বারুদ ইত্যাদি ফেলে রেখে কাঁঠালবাড়িতে পশ্চাদপদসদরণ করে।

খ। গুয়াহাটি থেকে গড়গাঁও

গুয়াহাটিতে বিজয়ী সেনানায়ক দুদিন কাটিয়ে অহোমদের থেকে তার প্রস্তাবের কোন উত্তর না পেয়ে আসম দখল করার মনস্থ করলেন(৭ ফেব্রুয়ারি)। অহোমদের অতর্কিতে এবং রাতে হানার রণনীতিকে বেচাল করতে তিনি প্রত্যেক সেনানীকে সতর্ক করে দিলেন, রাতে পাহারা দেওয়া সেনাদের অস্ত্র হাতে সারারাত জাগতে নির্দেশ দিলেন, ঘোড়ায় জিন চড়িয়ে রাখতে বললেন। রাস্তায় থানা তৈরি করে যোগাযোগ ব্যবস্থা পাকা করা হল। অহোমদের রাজধানী গড়গাঁও ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ পাড়ে অবস্থিত ছিল। গুয়াহাটি আর সমধারার মাঝের একটি জায়গায় মীর জুমলা সমস্ত বাহিনী নিয়ে নদী পেরোলেন(১৫-১৬ ফেব্রুয়ারি)। অহোমদের আক্রমণের আশংকা উপেক্ষা করেই মীর জুমলা সিমলাগড়ের দিকে এগোতে শুরু করলেন। কাজলি পতনের পরে নদীর উত্তরপাড়ের দরঙ্গের রাজা এবং দক্ষিণপাড়ের ডিমারুয়ার রাজা বশ্যতা স্বীকার করলেন, এবং ডিমারুয়ার রাজার ভাইপো মুঘল সেনার সঙ্গে যোগ দিলেন।

২। সিমলাগড় এবং সমধারা

মীর জুমলার পথে একটাই কাঁটা তেজপুরের পূর্বে ভরালী নদীর তীরে ভ্রমরগুড়ি পাহাড়ে অহোম রাজধানী সমধাগড়। এর উল্টো দিকে দক্ষিণ তীরে সিমলাগড়। এই দুটি এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে মীর জুমলার অগ্রগতিকে রুখতে রাজা সেনাবাহিনিকে দুটুকরো করে ভাগ করলেন, বয়স্ক সেনাদের বাতিল করে নবীন যুবাদের আনলেন সামনে। ব্রহ্মপুত্রের দুপাশের বাহিনীর সেনাপত্যের দায়িত্ব দেওয়া হল অতন বুড়াগোঁহাইকে। সমধারাকে সুরক্ষায় উত্তরের সেনার নেতৃত্ব দেওয়া হল সেনাপতি ঘোরা কবরক, তার সহকারী হলেন বাদুলি ফুকন, বারুকিল(বা লাঙ্গিছান) বরগোঁহাই, কেন্দতগুরিয়া বরপাত্র(গোহাঁই)। দক্ষিণের সিমলাগড়ের বাহিনীর নেতৃত্বে রইলেন বাহগড়িয়া বুড়াগোহাঁই, তার সাহায্যে রইলেন শিরিঙ্গিয়া রাজা, ভিটারুল গোঁহাই, বরচেতিয়া নামনিয়াল রাজশাহুর বরফুকন।

রণনৈতিকভাবে ব্রহ্মপুত্র এবং দুখিণের পাহাড়ের মধ্যের সুবিধাজনক দীর্ঘ সমতল সুউচ্চস্থানে অবস্থিত সিমলাগড়ের দুর্গটি উঁচু দেওয়াল আর কামানদ্বারা সুরক্ষিত ছিল। ফাঞ্জি আর লুকোনো গর্ত দিয়ে চারদিক সাজানো দুর্গে ঢোকা খুব মুশকিল ছিল। যারা দুর্গের সুরক্ষা দিচ্ছিলেন তারা পিঁপড়ের মত অগণন হয়ে সুরক্ষার সরঞ্জামগুলি ঠিকঠাক সাজিয়ে রেখেছিলেন। মানুষ আর প্রকৃতির সুরক্ষায় সাজানো এই দুর্গ অভেদ্য ছিল।

২০ ফেব্রুয়ারি দুর্গের দক্ষিণ থেকে পশ্চিমের দিকে বয়ে যাওয়া একটি নালার ধারে শিবির ফেললেন মীর জুমলা। দুর্গ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গোলাগুলি ধেয়ে এল তাদের দিকে। জাম্বুরক গোলা তার তাঁবুর ওপর দিয়ে উড়ে গেল। দুর্গ আক্রমন করলে বহু প্রাণহানি হবে তাই তিনি দুর্গ অবরোধের রাস্তা নিলেন। সাম্রাজ্যের বক্সী মহম্মদ বেগের সুযোগ্য নেতৃত্বে অভিজাতরা শিবিরের রাতের সুরক্ষায় থাকলেন। পরিখা কেটে তার ওপরে কামান রেখে প্রচুর গোলা ছোঁড়া হল দিলির খান আর মীর মুর্তাজার নেতৃত্বে, কিন্তু দুর্গের মোটা দেওয়ালে তার কোন প্রভাবই পড়ল না। শালবল্লার খুঁটির দেওয়াল তুলে দিলির খান কিছু সহযোগী নিয়ে দুর্গের দেওয়ালের কাছে গিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত গোলা ছুঁড়লেন, কিন্তু সে আক্রমন কোন কাজেই এল না।

দীর্ঘকাল ধরে অবরোধ চলায় মীর জুমলা তার রণনীতিতে পরিবর্তন আনলেন। দুর্গকে দু ধার থেকে ঘিরে একযোগে আক্রমন শুরু করলেন। অহোম এক অভিজাতর পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনি জানলেন, দুর্গের দেওয়ালের কোন অংশটা খুব দুর্বল এবং কোথায় লুকোনো খাদ অগভীর এবং ফাঞ্জির সুরক্ষা কোথায় দুর্বল। ২৫ ফেব্রুয়ারি দিলির খান ১৫০০ রিসালা গোলান্দাজ নিয়ে রাতে সজ্জা করে ভোরবেলা অসতর্ক অহোমদের ওপর আক্রমন চালালেন। মীর মুর্তাজা আর মিয়ানা খানকে আগুন জ্বালিয়ে অন্য দিকে অহোম বাহিনীর মনোযোগ আকর্ষণের দায়িত্ব দিয়ে দিলির নিজে আক্রমনের নেতৃত্ব দিলেন, কিন্তু তার পথনর্দেশক তাকে ভুল পথে চালিত করে সব থেকে দুর্গম পথে নিয়ে গেল এবং দুর্গ থেকে মুহূর্মুহু গোলার আঘাত আসতে থাকল, দিলিরের হাতি ২৫টি তীরে বিদ্ধ হলের প্রচণ্ড যুদ্ধ করে দুর্গ প্রাকার চড়তে সক্ষম হল। দুর্গ ছেড়ে পালানো অহোম কিছুকে সৈন্যকে মহম্মদ বেগ বক্সী নালার দিকে ধাওয়া করে ধরলেন, কিছুকে হত্যা করলেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি মীর জুমলা দুর্গে প্রবেশ করে তার সুরক্ষার পরিকল্পনা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন। অসম সূত্রে বলা হচ্ছে যে, দুর্গ সুরক্ষা সামলাতে কত সেনা আর রসদ লাগবে সেই হিসেবের পরিকল্পনা করতেই লাঙ্গিছাঙ্গ বড়ফুকনের ভুল হওয়ায় দুর্গটার পতন ঘটল।

অভেদ্য সিমলাগড়ের পতনে হতোদ্যম হয়ে পড়লেন সমধারার রাজা, সেনা নায়ক। বুড়াগোঁহাই রাজার সঙ্গে পরামর্শ করতে রাজধানীতে গেলেন।

৩। কালিয়াবরে মুঘল নৌসেনার বিজয়

তেজপুরের পূর্ব দিকে এই প্রথম মুঘল সেনা ঢুকল এবং যুদ্ধ না করেই কালিয়াবর দখল হল। তিনি কালিয়াবর ছাড়লেন ২ মার্চ। নদীর তীরটি পাহাড়ি হওয়ায় পদাতিক বাহিনী নৌ বাহিনী থেকে ছয় মাইল দূরে সমতল পথ দিয়ে এগোতে শুরু করল। মুঘলদের যৌথবাহিনীর ভয়ালতা অনুমান করে এবং নৌ বাহিনীর সঙ্গে পদাতিকের যথেষ্ট দূরত্ব অনুধাবন করে অহোমেরা পদাতিক বাহিনীর রসদের সূত্র কেটে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের কাছে আরেকটা খবর ছিল মুঘল সেনানায়ক ইবন হাসান সেনার সঙ্গে ছিল না। ৩ মার্চ সন্ধ্যার আজানের ঠিক পরেপরেই বরগোঁহাইর নেতৃত্বে ৭০০-৮০০ নৌবহর ১০০টি মুঘল সেনা বহরকে আক্রমন করে চকিতে কুকুরাকাটার কাছে। সব থেকে সুসজ্জিত ডাচ যুদ্ধ জাহাজগুলিও হতবাক হয়ে যায়, যেন খাবার থালায় করে কেউ মাংস সাজিয়ে উপহার দিয়েছে কচুকাটা হওয়ার জন্য। নদীর টানে ভেসে গিয়ে পর্তুগিজ জাহাজগুলি বেঁচে যায়। মুনাবর খান যতটা পারেন চেষ্টা করলেন অহোমদের বিরুদ্ধে লড়ার আর অপেক্ষা করছিলেন কখন নতুন বাহিনী তার সাহায্যে এসে পড়বে। রাত দু’প্রহরে সাহায্যের জন্য বাহিনী এসে পড়ল। এবং তিনি ডাচ আর পর্তুগিজদের বাঁচাতে তাদের পাঠালেন। তারা অহোমদের বিরুদ্ধে বাতাসের উল্টো দিকে যততা দ্রুত পারা যায় যেতে চাইল কিন্তু ডাচেদের বাহিনীকে স্রোতের বিরুদ্ধে গুণটানার জন্য মুসলমানদের তীরে নামতেই হল। রাতভর কামানের গোলার আওয়াজ শুসুনতে পেয়ে মীর জুমলা মহম্মদ মুনিম বেগ একাতজ খানকে আক্রান্ত ব্রিটিশ, ডাচ আর পর্তুগিজদের সাহায্যের জন্য পাঠালেন। রাস্তায় বাড়িঘরদোর না থাকায়, বসাল জঙ্গল বেয়ে, জলা জমি আর কাদার তাল পেরিয়ে পরের দিন সকালে মাত্র ১০-১২ জন অশ্বারোহী নিয়ে তীরে পৌঁছে ভেরি বাজালেন।

এই ঘটনায় যুদ্ধের মোড় ঘুরে গেল, অহোমেরা হতোদ্যম হয়ে পড়ল আর মুঘলেরা তেড়েফুঁড়ে নতুন করে লড়াই করা শুরু করল। মুঘলেরা বড় কামানযুক্ত ৩০০-৪০০ জাহাজ এবং অস্ত্রশস্ত্র দখল নিল। সব থেকে ছোট জাহাজে ৭০-৮০ জন সৈন্য ধরত। ২১০০০ সেনাকে যুদ্ধ বন্দী করা হল। অনেকেকে হত্যা করা হল যে ৫০ জন সেনা পালিয়ে এসেছিল তাদের রাজা কঠিনতম সাজা দিলেন। ছদ্মবেশ সত্ত্বেও অহোম সেনাপতিকে গ্রেফতার করা হল, মীর জুমলার সেনানায়কদের সঙ্গে কথা বলার পর তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মীর জুমলার শিবির থেকে মাইল খানেক দূরে থাকা আরও ৩০০ নৌবহরকে দূর থেকে কামান দেগে ডুবিয়ে দেয়া হল, কিছু পালাল, কিছু দখল নেওয়া হল। অসমিয়া নৌ-বহরের কার্যকারিতা শেষ হয়ে গেল।

কালিয়াবরের ঠিক ওপরের যুদ্ধে কিন্তু অহোমদের নৌ বাহিনীর সংখ্যা অনেক অনেক বেশি ছিল। এবং নদীর স্রোতও তাদের পক্ষে ছিল। চকিত আক্রমনে সাম্রাজ্যের বাহিনী হেরে যাওয়ার মুখে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু ৬০-৭০ জনের অহোম বাছারি যুদ্ধ জাহাজগুলি মুঘল জাহাজগুলির তুলনায় বেশি ভারি ছিল। তার পাশাপাশি মুঘল আর ইওরোপিয় সেনানায়কদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সব থেকে দুর্যোগের মুহূর্তেও তাদের হারের করাল গ্রাস থেকে বার করে নিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল। আর সঠিক সময়ে মীর জুমলা মহম্মদ মুনিম বেগকে যুদ্ধ ক্ষেত্রে পাঠানোটাই যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সব থেকে বড় সহায়ক হয়েছে। একজন অনামা ডাচ সেনানীর যুক্তি এখানে প্রণিধান যোগ্য, গুয়াহাটিতেই হঠাই আক্রমণ করে নৌবহরকে দুর্বল করে দেওয়া আর তার রসদ কেটে দেওয়ার রাজার নির্দেশ অহোম সেনানায়কেরা মানে নি। জনৈক প্রৌঢ আহত অহোম সেনানী তালিসকে বলেছিল, মুঘলদের আহোম বাহিনীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকাই আশ্চর্যের এবং তালিশেরও ধারনা হচ্ছিল যে মুঘলেরা এর বেশি এগোতেই পারবে না।

৪। অহোমদের রক্ষণাত্মক চোরাগোপ্তা(গেরিলা) হামলার রণনীতি

দুর্ভেদ্য সিমলাগড়ের পতন, সমধারা থেকে পালিয়ে যাওয়া আর শেষ পর্যন্ত বিপুল নৌবহর ধ্বংসে অহোমদের মনোবলে চিড় ধরিয়ে দিল। এখন আত্মরক্ষার ভার এসে পড়ল আতন বুড়াগোঁহাইয়ের কাঁধে। আজকের রণনীতিতে যাকে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ বলে, তিনি সেই পথ ধারণ করলেন অসাধারণ পরিকল্পনায়। বর্ষা আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার জন্য অহোমেরা পাহাড়ে পালিয়ে গেল। সামনাসামনি লড়াই না করে তারা চোরাগপ্তা লড়ায়ের পরিকল্পনা করল। প্রাথমিকভাবে অনির্দিষ্ট দিক থেকে, কোন নর্দিষ্ট শিবির বাহিত না হয়ে রাতে ছোট ছোট দলে অতর্কিতে হানা দিতে শুরু করে। সেনা বাহিনী কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে মুঘলদের এগোনো আর পিছোনোর সমস্ত রাস্তা ধরে আক্রমন শানাত। গোটা শিবিরে নয়, দল বেঁধে কিছু কাজ করতে বেরোনো যেমন আগুব জ্বালাবার কাঠ আনার দলকে হঠাত হঠাত আঘাত করত, খুন করত, ধরে নিয়ে গিয়ে তুর্কি ধরণের লোহার কুলুপের মত হাতিয়ার দিয়ে অত্যাচার করে ছেড়ে দিত, যাতে তারা শিবিরে ফিরে গিয়ে মারা যায়। দ্বিতীয়ত মুঘলদের বাহিনীর জন্য রসদের রাস্তা কেটে দেওয়া বা সেগুলি লুঠ করে লাখু, গড়গাঁও এবং মথুরাপুরের মুঘল শিবিরে প্রায় অনাহারের মত অবস্থা নেমে এল। মুঘল বাহিনীর জন্য সমস্ত খাবারের রসদএর সূত্র কেটে দেওয়া হল, জমা খাবারে আগুণ লাগিয়ে দেওয়া হল এবং গ্রাম থেকে কোন খাবার যাতে শহরে যেতে না পারে রাজার সে নির্দেশ সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হল। তৃতীয়ত আজকের পোড়ামাটির নীতি অনুসরণ করে মুঘল সেনার যতকিছু রসদ লাগতে পারে যেমন খাদ্য, নৌকো, স্থলযান, সোরার গুদাম সব কিছু মাটিতে মিশিয়ে, আগুণ ধরিয়ে নষ্ট করে ফেলা হল। উত্তর অসমে সমধরা ছেড়ে আসার আগে বারুদের গুদামে আগুণ ধরিয়ে আসা হল। পূর্ব দিকে আসার সময় তারা তিলান নদীর উত্তর পাড়ের সব মানুষকে গ্রাম ছাড়া করিয়ে মুঘলেরা কোন রসদ যাতে না পায় তার ব্যবস্থা করল। জানমুনগের দুর্গের বসতি জ্বালিয়ে দেওয়া হল। চতুর্থত সেগুলিকে হয়ত যুদ্ধ বলা যাবে না অথচ সামনা সামনি ছোটখাট হঠাত উদয় হয়ে লড়াই লাগিয়ে দিত। মীর জুমলা হয়ত যুদ্ধে জিতল, কিন্তু মানুষের হৃদয় জিততে পারল না, তার ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারল না। অহোমেরা মুঘলদের সামনাসামনি যুদ্ধে হয়ত হারাতে পারে নি, কিন্তু চোরাগোপ্তা লড়ায়ে মুঘলদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দিতে পারল এবং এর ফলেই তাদের ফিরে আসতে হয়।

৫। লাখাউতে মীর জুমলার আগমন

অহোমদের চোরাগোপ্তা লড়ায়ের মধ্যেই মীর জুমলা ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ পাড় ধরে তার মত করেই এগিয়ে চলছিলেন অসমের অক্ষ হৃদয়ের পানে। মুঘলদের আসমের আরও ভেতরে নিয়ে আসার রণনীতিতে অহোমদের ছেড়ে যাওয়া সোলাগড় দুর্গ দখল করার পরেই ফুকনেরা তাকে শান্তি বার্তা পাঠাল। কিন্তু আগের অভিজ্ঞতায় তিনি সেই বার্তা উপেক্ষা করলেন, কেননা এর আগের শান্তিবার্তায় তারা কোন উত্তর দেয় নি। তার মনে হয়েছিল এই শান্তিবার্তা শুধুই সময় কেনার আছিলা আর মুঘলদের সতর্ক প্রহরা এড়ানোর বাহানা।

রাজা, বরগোহাঁই ভিটারুয়াল ফুকন, দুয়ারিয়া গোষ্ঠীর দিহিঙ্গিয়া ফুকনকে লাখাউএর নদীর দুপাশের মুঘল বাহিনীর ওপর আক্রমন করতে নির্দেশ দিলেন, কিন্তু অহোম বাহিনী মীর জুমলার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হল। দিহিং এবং ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থল লাখাউতে ঢুকলেন মীর জুমলা। পেশকাশ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার ব্রাহ্মণ গুরু আর তাম্বুলি ফুকনকে দিয়ে আবারও শান্তিবার্তা পাঠালেন রাজা। কিন্তু মীর জুমলা এই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করে বললেন তিনি শীঘ্রই গড়গাঁওতে পৌঁছবেন এবং তখন অবস্থা মত ব্যবস্থা নেবেন।

শ্বশুরের বিশ্বাসঘাতকতা এবং তার বাহিনীর বহু সেনানায়কেরা তাকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় রাজা জয়ধ্বজ পশ্চাদপসণের সিদ্ধান্ত নিলেন – যতটা পারা যায় তার সম্পত্তি নিলেন – কেননা সব নিতে অন্তত ১০০০টি নৌকো লাগত – পেলেন না – যা পেলেন তাই নিয়ে চারাইদেও বা নাগা পাহাড়ের নিচের নামরূপের চারাই-খোরং এবং তার পরে তারাইসতএ গিয়ে তার মন্ত্রী এবং অনুরাগীদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত হল যে বিশাল মুঘল বাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই করে যুদ্ধে জেতা যাবে না। শান্তি আলোচনা ব্যর্থ হওয়ায় কিছু অভিজাত, মহিষীদের নিয়ে আরও ভিতরে টিপামে গিয়ে বসতি করে ভবিষ্যতের জন্য ১ লক্ষ তীরান্দাজ সংগ্রহের পরিকল্পনা করলেন।

৬। গড়গাঁওএর পতন

বহু অহোম সেনাবাহিনী ত্যাগীকে নিয়ে মীর জুমলা লাখাউতে পদার্পন করলেন ১২ই মার্চ। বিপুল বাহিনীর অধিকাংশই বাইরেই থাকল। ছোট দিহিং নালা দিয়ে তারা আসতেই পারল না। প্রয়োজনীয় রসদ ছোট ছোট নৌকো করে নদীপথে সেনাবাহিনীর জন্য নিয়ে আসা হল। পদাতিক বাহিনী নিয়ে মীর জুমলা গড়গাঁওএর দিকে দেওলগাঁও(১৩-১৪ মার্চ), গাজপুর(১৫ মার্চ) এবং ত্রিমোহনী(১৬ মার্চ) হয়ে নালার পর নালা পেরিয়ে এগোতে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি দিখু নালা পেরিয়ে গড়গাঁওতে ঢুকে রাজার প্রাসাদের পূর্ব পাশে শিবির গাড়লেন। নাগা রাজা মুঘলদের কাছে বার্তা পাঠাল তারা মুঘলদের সাহায্য করতে চায়। মীর জুমলা প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন, কিন্তু জানালেন তারা যদি অহোমদের সাহায্য না করে তাহলে তাদের মুঘলেরা সুরক্ষা দেবে।

নাগা পাহাড় পেরতে না পেরে নামরূপের নাগা ফৌজ শিবিরে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিন কাটাতে হচ্ছিল। রাজধানীর পূর্ব দিকে ১৪ দিনের দূরত্বে ভাগানিয়া রাজার ৪৯৮০ জন সঙ্গী বাহিনী বর্ষার আগমনের জন্য দিনগুণতে লাগল। বরগোহাঁই তিরুতে আর ফুকনেরা মাজুলির চরে আশ্রয় নিলেন। ঐতিহাসিক মহম্মদ মুনিমের পুত্র লিখছেন খানইখানান সর্বোচ্চ সেনাপতি, তার চেষ্টায় যুদ্ধ সমাপ্তির পথে, তিনি যখন দুটি রাজধানী দখল করলেন আমরা দেখলাম, সময় কিছু গোপনীয়তায় ছিদ্র বানায়। এক বছরে অনেক কিছুই ঘটল, (যেমন) কোচবিহার আর অসমের জয়।

গ। কামরূপ অসমে মীর জুমলার প্রশাসনিক ব্যবস্থা

১। সেনা শাসন

বাঙলার সঙ্গে যোগাযোগের সুবন্দোবস্ত করতে, জিতে আসা দেশটিকে শাসনে রাখতে, অহোম বিদ্রোহীদের বশে রাখতে, স্থানীয় রায়তদের শান্ত রাখতে যত তিনি এগিয়েছেন, প্রত্যেক জায়গায় সেনা শিবির তৈরি করেছেন। প্রত্যেকটিতে একজন সেনা আধিকারিক আর তার নেতৃত্বে একটি বাহিনী রাখা ছিল। গৌহাটির ফৌজদারির জন্য মহম্মদ বেগ আর কালিয়াবরের জন্য নাসিরুদ্দিন খানকে নিয়োগ করলেন। আর আতাউল্লা হুসেন বেগ, সৈয়দ আলি মির্জা, আলি রাজা বেগ, আনওয়ার বেগ, মীর নুরুল্লা এবং মহম্মদ মুকিমকে যথাক্রমে যোগীগুপা, কাজলি, সমধারা, দেওলগাঁও, গাজপুর, ত্রিমোহনী এবং রামডাঙ্গের থানাদার নিযুক্ত করা হল। ইবন হুসেনের নেতৃত্বে ৩২৩টা নৌবহর রাখা হল। তাকে সাহায্যের জন্য দেওয়া হল জামাল খান, আলি বেগ, অন্যান্য আধিকারিক এবং মুনাবর খান এবং অন্যান্য বাংলার জমিদারকে, অহোমদের মাজুলির জবাবে লাখাউ হল মুঘলদের নৌঘাঁটি। সাধারণের হাতের বাইরে রাখার জন্য গড়গাঁওএর প্রাসাদে পাহারা বসানো হল। সেখানে একটা টাঁকশাল তৈরি হল সম্রাটের নামে টাকা আর খুচরো তৈরির উদ্দেশ্যে। কিন্তু স্থায়ী প্রশাসনের কোন সম্ভাবনাই দেখা যাচ্ছিল না।

মীর জুমলার সঠিক তথ্য পাওয়া খুব জরুরি ছিল। এক মুসলমান চর যে কালিয়াবরে ভুল খবর দিয়েছিল তার জিভ কেটে নেওয়া হয় এবং চাকু চালাবার মত তার পিঠে চাবুক চালানো হয়।

অহোম রাজধানী দখলের অর্থ কিন্তু অহোম বিদ্রোহ শেষ হওয়ার ইঙ্গিত নয়। বিভিন্ন এলাকায় থানা বা চৌকি তৈরি করা হলেও সেগুলোর ওপরে রাজার অনুগত অহোমি সেনা বাহিনীর হঠাত আক্রমণের বিরাম ছিল না। মীর জুমলা যখন গড়গাঁওতে পৌঁছন, তার কিছু দিন পরে গড়গাঁওয়ের উদ্দেশ্যে সোনারুপায় ভর্তি ছটা নৌকো অহোমিরা দখল করে নাবিক-সেনাদের হত্যা করে। রাজার প্রাক্তন আমলা আর গুপ্তঘাতকদের দল মুঘল বাহিনীকে অতিষ্ঠ করে তুলছিল যাতে বর্ষা আসা পর্যন্ত তাদের শিবিরে রসদ পৌঁছতে না পারে।

আশ্চর্যের, সেই বছরের অনেক আগেই বর্ষা এসে গেল। মীর জুমলার পরিকল্পনা ছিল গোটা বর্ষাকালটা তিনি লাখাউতে কাটাবেন যাতে রসদের অভাব না হয়। কিন্তু গতায়াতের অসুবিধেয় জন্য দখল করা মালপত্র পাঠানো সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। তিনি গড়গাঁওয়ের ৭ মাইল দক্ষিণপূর্বে মুথুরাপুরে তার মূল বাহিনীর ছাউনি ফেললেন(৩১ মার্চ)। এটি উচ্চ এবং সৌন্দর্যময় জমিতে অবস্থিত ছিল, আর এটি জুড়ে প্রচুর ফলএর গাছ আর ধান চাষের জমি ছিল ফলে নিত্য খাবারের সমস্যা ছিল না। অহোমিয়াদের হঠাই চোরাগোপ্তা আক্রমণের রুখতে জরুরি সতর্কতা নিলেন।

গড়গাঁওতে গোলান্দাজ ভাণ্ডার, হাতিশাল রসদের ভাণ্ডার আর সেনাবাহিনীর সম্পত্তি রক্ষার ভার দেওয়া ছিল মীর মুর্তাজা, রাজা অমর সিং এবং ৫০জন রিসালাদার আর কিছু বন্দুকবাজকে। কিছু প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র রেখে বাকিগুলি ঢাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দেওয়ানিতন মীর সৈয়দ মহম্মদকে স্থানীয় রায়তদের শান্ত করার ভার দেওয়া হয়েছিল। মহম্মদ আবিদ, বাজেয়াপ্ত মালের দাম নিরূপক, রাজার প্রাসাদের সম্পত্তির খতিয়ান, সেনা বাহিনীর বেতন দেওয়া এবং বাকি অর্থ ঢাকায় পাঠাবার ব্যবস্থা করছিলেন। মহম্মদফ খলিল আমিনি পদে এবং সপত্তি দেখাশোনার কাজে মহম্মদ আশরফ নিযুক্ত হলেন।

গড়গাঁও আর মথুরাপুরের চারপাশ পুলিশি চৌকি দিয়ে সুরক্ষিত ছিল। অহোম সেনাবাহিনী ছেড়ে আসা সেনাদের সাহায্যে মীর জুমলা প্রধাণত মোটামুটি ১০০টা গ্রাম সাইরিং, শিলঘাট, টাউকাক, ছররা, রাওখাম, সিনাতোলি দখল করেন। দক্ষিণের পাহাড়ের সালপানি মিয়ানা খানের প্রশাসনে দেওয়া হল যাতে তিনি বড় গোঁহাইদের আক্রমন আটকাতে পারেন। গড়গাঁও আর সালপানির মধ্যের দেওপানির কর্তৃত্ব দেওয়া হল গাজি খানকে, গড়গাঁওয়ের উত্তরপূর্বের দিহিংএর তীরের দায়িত্ব দেওয়া হল জালাল খানকে। অহোমদের নিয়মিত আক্রমন সত্ত্বেও মুঘল ছাউনিগুলি দাঁড়িয়ে থাকল।

২। অসম যুদ্ধে অধিকৃত জিনিসপত্রের ব্যবস্থা

যুদ্ধে অধিকৃত দ্রব্য গুলি যেহেতু সাম্রাজ্যের, তাই সেগুলির নিরাপত্তার দায়িত্ব মীর জুমলা নিজের বলে মেনে নিয়েছিলেন। সিমলাগড় বা কালিয়াবরে হাতি বা কামান, জাম্বুরক, বন্দুক, বারুদ অহোমিয়ারা ছেড়ে গিয়েছিল, সেগুলি মীর জুমলা দখল নিয়ে তালিকাভুক্ত করিয়েছিলেন বিশেষ এক আধিকারিককে দিয়ে। দেওলগাঁওতে মীর জুমলা কয়েকজন মুসলমান রায়তের থেকে শুনলেন হাতি সহ বেশ কিছু শনাক্ত না করা দ্রব্য রাজা সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেন নি, ফেলে রেখে গিয়েছেন। দিওয়ানিতন মীর সৈয়দ মহম্মদ এবং ফরহাদ খানকে সেই দ্রব্যগুলি আনতে পাঠালেন। উতসাহী সেনাপতি ভাগানিয়া রাজা আর ফুকনদের পদ্ম পুকুরিতে ছুঁড়ে ফেলা প্রচুর এ ধরণের অস্ত্রশস্ত্র নিজে উদ্ধার করিয়েছেন। মথুরাপুরেও তিনি মীর মুরতাজাকে দিয়ে যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করেছেন।

অসমে যুদ্ধ অধিকৃত সংগ্রহগুলি পরিমানে বিশাল, ৮২টি হাতি, সব থেকে দামি ৩ লাখ টাকা নগদ, আর রাজার ফেলে যাওয়া নানান ধরণের মালপত্র। অভিযানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ৬৭৫টা কামান – তার মধ্যে একটা বড়, লোহার ৩ মন গোলা ছুঁড়তে পারে, ১৩৪৩টা উটের সুইভেল, ১২০০ রামছাঙ্গি, ৬৫৭০টা গাদা বন্দুক(ম্যাচলক), ৩৪০ মন বারুদ, ১৯৬০ সিন্দুক সোরা – এক একটার ওজন দুই থেকে আড়াই মন, ৭৮২৮টা লোহার ঢাল, ওজন করা হয় নি লোহা, সোরা আর গন্ধক, ১৭৩টা ধানের গোলা – প্রত্যেকটায় ১০ থেকে ১০০০ মন ধান, বহু বছরের রাজা আর ফুকনদের জন্য সঞ্চিত খাদ্য, যা তারা পোড়াতে ভুলে গিয়েছিল – যার অভাবে মীর জুমলার বাহিনীকে হয়ত অভুক্ত মরতে হত। কালিয়াবরের ওপরে অহোম নৌবাহিনী পর্যুদস্ত হওয়ায় মনে করার কারণ নেই যে রাজার সব জাহাজ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা নৌ বহর বাদ দিলে রাজার নৌশালে প্রচুর নৌকো রাখা ছিল। একটি নৌশাল লাখাউএর দূরে আর একটি ত্রিমোহনীতে মীর জুমলা ঘুরে দেখেন। লাখাউতে১০০টা বাছারি ছপ্পর(ঘাসের ছাদ)ওয়ালা জাহাজ, ৭০, ৮০, ১০০, ১২০ হাত(কিউবিটস) লম্বা, পোক্ত এবং দারুণ সাজসজ্জাওয়ালা। যদিও অসমিয়ারা গড়গাঁও নৌশালায় ১২০টা সমুদ্রে যাওয়া সাজসজ্জাওয়ালা বাছারি জাহাজ ডুবিয়ে চলে গিয়েছিল, তবুও ৬০, ৭০, ৮০ নাবিক বহনক্ষম সমুদ্রগামী ১০০০ জাহাজ মীর জুমলা উদ্ধার করেন। অসমিয়া বন্দুক এবং বারুদ তৈরির প্রযুক্তিবিদদেরকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ জারি করেন। হাতি প্রশিক্ষণের মাহুত নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। কর্নাটকের মত অসমেও মীর জুমলা মন্দির লুঠ করে প্রচুর অর্থ লাভ করেন। কাজলি দখল করার পর তিনি কামাখ্যা, লুনা চামরি এবং ইসমাইল যোগী মন্দিরগুলি নিজের আওতায় নিয়ে আসেন।

উত্তরী অসমে থাকার সময় মীর জুমলা জানতে পারলেন যে ময়দামের কবরগুলিতে প্রচুর সোনাদান থাকে। নির্দিষ্ট একটা কবর থেকে তিনি ৮০ বছর আগের এক রাণীর ৯০০০০ টাকার পানবাটা লুঠ করে তার হাড় গোড় ছড়িয়ে ফেলে দেন। অহোম রাজা দুঃখে মন্তব্য করেন যে তিনি তারে পূর্বজদের হাড়টাও বাঁচাতে পারলেন না। এক অজানা ডাচ নাবিক লিখছেন, ধনীদের কবর (লুঠ করতে)পেলে আর তাদের কে চায়? মানুচি ঢাকায় দেখেন গড়গাঁও এবং অন্যান্য এলাকা থেকে জাহাজ বোঝাই করে লুঠের মাল আসছে।

৩। অসমিয়াদের প্রতি মীর জুমলার ব্যবহার

যারা বিদ্রোহ কররেছে তাদের চরম সাজা হয়েছে। তিনি সেনাদের নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন অবাধ্য অসমিয়াদের খুন করতে। একজন ডাচ নাবিক বলছেন প্রত্যেক কাটা মাথার জন্য ৫০ টাকা আর জীবিত ধরে নিয়ে এলে ১০০টাকা পারিতোষিক দেওয়া হত। মুঘলদের হাতে যে সব অসমিয়া ধরা পড়েছে তাদের প্রচণ্ড অত্যাচার করে মাথা কেটে মারা হয়েছে। এর কারণ ছিল তারা যাতে ভয় পেয়ে মুঘলদের বাহিনীতে যোগদান করে।

অন্যদিকে যারা মুঘলদের সাহায্য করেছে, তাদের অসম্ভব ভাল ব্যবহার করা হয়েছে। তবে যে সব মানুষ যুদ্ধে যুক্ত ছিল না, তাদের উন্নতির জম্য মীর জুমলা ব্যবস্থা করেছেন। তিনি কৃষকদের মন জেতার চেষ্টা করেছেন যাতে তারা বিদ্রোহীদের দলে যোগ না দেয়। সেনা বাহিনীতে লুঠ, ধর্ষণ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন। এতে নারীলোলুপ সেনারা হতাশ হয়েছিল। সেনাবাহিনী অসম থেকে ফেরা পর্যন্ত এই নির্দেশ জারি ছিল – বাহিনীর কোন আমীর, সেনা, তাঁবেদার কোন মহিলার বা তার পরিবারের সম্পত্তির দিকে লাস্যভরা চোখ তুলে তাকাবে না। আর যদি কোন উচ্চাবচ এই কাজটি করে তাহলে তাকে সারা শহর ঘোরানো হবে এবং শাস্তি দেওয়া হবে।

একবার ফারহাদ খান পালয়ে যাওয়া এক গ্রামবাসী ফিরে এসে মুঘলদের রাস্তায় বাধা দান করেছে এই অভিযোগে মহম্মদ মুকিম বেগকে নির্দেশ দেন গ্রামে গিয়ে সেই ধরা পড়া মানুষটিকে খুন করতে, তার সম্পত্তি লুঠ করতে এবং তার স্ত্রী আর সন্তানদের ওপর অত্যাচার করতে। মীর জুমলা এই নির্দেশ খারিজ করে সেই গ্রেপ্তার হওয়া মানুষটিকে ছেড়ে দিতে আর অন্যান্য গ্রামীনদের সুরক্ষা দিতে আদেশ দেন। যারা অহোমদের অত্যাচারে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তাদের বিভিন্ন শহরে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসনের দায়িত্ব নেন মীর জুমলা। সিমলাগড়ে অনেক কামরূপী মুসলমান বন্দী ছিল তাদের ছেড়ে দেন মীর জুমলা।

গড়গাঁওতে পৌঁছে তিনি ঘরছাড়া রায়তদের ফিরিয়ে এনে, পুনর্বাসনের নির্দেশ জারি করেন এবং কামরূপের অধিবাসীদের বাড়ি তৈরি বা চাষে তাদের একবছরের জন্য সব রকম রাজস্ব ছাড় দেওয়ার নির্দেশ দেন। আরও একটি নির্দেশে হিন্দু মসলমান নির্বিশেষে রাজা বা অহোম অভিজাতদের কাছে যারা দাসের মত থাকতেন, এবং মুক্তির আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাদের মুক্তির নির্দেশ দিয়ে খাসা নৌকো করে তাদের বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার এবং জীবিকার বন্দোবস্ত করেন।

এই সবেও প্রজাদের মন জয়ের বিষয়টি সহজ হয় নি। তালিশ দুঃখ করে লিখছেন, মীর জুমলার মহানুভবতা বা রাজার অত্যাচারেও অসমিয়ারা ইসলাম ধর্ম বরণ করে নিল না। হয়ত মীর জুমলার মন্দির ধ্বংস-লুঠ বা কবর লুঠে মানুষের মনে এমন ঘৃণা জেগেছিল যে তারা ইসলামে পরিবর্তিত হওয়ার কথাই ভাবে নি। তবে বিদ্রোহীদের প্রতি কঠোরতা আর জনগণের প্রতি তার মহানুভবতায় মানুষেরা বুঝতে পারল যে মুঘল থানাগুলি আক্রমন করে লাভ নেই। দুখিনকোলের গ্রামের মানুষেরা মুঘলদের প্রতি বশ্যতা স্বীকার করে নিল, এবং উত্তরকোলের গ্রামের মানুষ আস্তে আস্তে বুঝতে পারল যে তাদেরও মুঘলদের কাছে অবনত হতে হবে যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বর্ষার আকারে নেমে এল।

তৃতীয় পর্ব অসমে মীর জুমলার দুর্দশার শুরু

১। মীর জুমলার বাস্তবিক দুর্দশা

বিজিত দল নিয়ে এর আগে অসম অভযানে যে সব দুর্দশার মুখোমুখি হয়েছিলেন, সেগুলি ফিকে হয়ে পড়ল এবারে বর্ষায় যে দুর্যোগে তিনি পড়তে চলেছেন। রাশিয়ার শীত সমতলে যে প্রভাব সৃষ্টি করে, অসমের বৃষ্টিও সেই ভূমিকা পালন করেছে। নদীগুলি সমুদ্রের মত ফুলে ফেঁপে ওঠে আর নালাগুলি যেন নদীতে রূপান্তরিত হয়। অহমিয়াদের আতঙ্ক মুঘল ঘোড়াগুলি বর্ষায়, কাদায় আর জলাজমিতে কোন কাজই করল না। সামনা সামনি লড়াই না করে অহমিয়ারা মুঘলদের ব্যতিব্যস্ত করার পদ্ধতি আরও ঘন ঘনভাবে কজে লাগাতে লাগল। লুকিয়ে থেকে হঠাত হঠাতই এখান সেখান থেকে রাতে মুঘল থানাগুলি আক্রমণ করলেও মুঘলেরা তার প্রত্যুত্তর দিতে পারল না। এছাড়াও যে সব গ্রামীনেরা মুঘলদের কাছে আত্মসমর্পন করেছিল, তাদের ওপর আক্রমন চালাতে লাগল অহমিয়ারা। সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিল, খবর দেওয়া নেওয়ার ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করল, লাখাউ আর গড়গাঁওএর মধ্যের নৌ বাহিনীর রসদ আনায় বাধা দিল অহমিয়ারা। রক্তচোষা তীর ব্যবহার করে তারা মুঘলদের খোলামেলাভাবে ঘোরাফেরা প্রায় বন্ধ করে দিল এমন কি মথুরাপুর আর গড়গাঁওতেও, এখন মুঘলদের তীরান্দাজ সেনা নিয়ে বেরোতে হয়। আত্মসমর্পনকারী গ্রাম দেবলগাঁওয়ের ওপরে আক্রমণ জাগ্রত থানাদারের জন্য ব্যহত হলেও ভিটারুয়াল ফুকন অতর্কিতে হানা দিয়ে আনোয়ার বেগের থেকে গজপুর দখল করে নেয়। ত্রিমোহনী থেকে গজপুর পর্যন্ত দিহিং নদীতে মুঘল সেনার জন্য রসদ আনায় বাধা সৃষ্টি করল অহোম বাহিনী। তিয়ক থেকে আরও ওপর পর্যন্ত সমস্ত মুঘল ব্যাপারী জাহাজ গতায়াত বন্ধ হয়ে গেল অহমিয়াদের আক্রমনে, ফলে রসদ আসাও বন্ধ হয়ে গেল। দিহিংএর বন্যা আর শালপানি পাহাড় থেকে নেমে আসা তীব্র বেগের জল মুঘল দারিয়াবাদীদের গতায়াত বন্ধ করে দেয় এবং মিয়ানা খানের পদাতিক বাহিনী আর রিসালাও বসে যায়। ফলে পাহাড় থেকে বর্ষার মধ্যেই অহোমরা তীব্রবেগে নেমে আসতে আসতে গড়োগাঁও ঘিরে ফেলে যদিও সতর্কভাবে মুর্তাজা বাধা দিতে থাকে এই জেনে যে তার সাহায্যের আর উদ্ধারের জন্য কোন বাহিনী আসবে না। বরগোঁহাইর নেতৃত্বে ১০-১২০০০ সেনা দেওপানি থানা ঘিরে ধরলেও তাদের নেতা মারা যাওয়ায় তারা পিছিয়ে যায়। গড়গাঁও, মথুরাপর আর অভয়পুরের অভয়ে বাস করছিলেন যে সব গ্রামীন, গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। মুঘল আর আহোমদের মধ্যে একেরপরেক লড়াই, খুন, জখম এত বেশি শুরু হয় যে তা আর গণনা করা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কবর খুঁড়ে তার পূর্বজকে বার করার শাস্তিদিতে মুঘলদের হত্যা করার নির্দেশ দেন। কয়েক শকে হত্যা করলেও অহোমরা দেখল, মুঘল সেনার শক্তি কমছে না।

থানাগুলির বিচ্ছিন্নতা মীর জুমলার মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ১৬৬২ সালের মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত মুঘল বাহিনী তাদের শিবিরে বসেই থাকে। কিন্তু সেনাপতিদের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ এতই প্রবল ছিল যে এই বসে থাকার মধ্যেও তার বাহিনী নানান আঘাতের বিরুদ্ধে প্রত্যাঘাত করতে থাকে তাদের জীবনের বিনিময়ে। তালিস লিখছেন, পরিচ্ছদ একেবারের জন্যও খোলার সময় পাচ্ছেনা সেনারা। যে সেনা একটাও ধুলো সহ্য করতে পারে না, তাকেই কাদা মেখে সারাদিন জলে ভিজে, সূর্যের রোদ্দুরে পুড়ে যুদ্ধ করতে হয়, ঘোড়ার জিন একদিনের জন্যেও খোলা হয় না, চাকরেরা তাদের প্রভুদের সেবা করতে পারে না, এবং পালগাঘন্টি শুনলেই কোন সময় না নিয়েই প্রত্যেককে হাতে খোলা তরোয়াল ধরতে হয়।

২। নৌবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করার ব্যার্থতা

মীর জুমলা ছাড়া অন্য কোন সেনা নায়কের পক্ষে বর্ষার অসমের মৃত্যুমুখী পরিবেশ থেকে মুঘল সেনা বাহিনীকে বের করে আনা সম্ভব ছিল না। তার ঠাণ্ডা মাথা, প্রজ্ঞা, ব্যবস্থাপনার দক্ষতার জন্য এই কাণ্ডটি সম্ভবপর হয়েছিল। যেখানে যখন প্রয়োজন সেখানে তিনি প্রয়োজনীয় ত্রান পাঠালেন। তার প্রথম পরিকল্পনা ছিল নৌবাহিনীকে ব্যভার। সেটি তার অসম আক্রমণের প্রাথমিক শক্তি, এবং তার প্রথম কাজ হল নৌবহরের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। দেওয়লগাঁওয়ে আলি রাজাকে সাহায্যের জন্য গেলেন য়াদগার খান উজবেগ, আক্রমনকারীরা পালাল। কিন্তু গজপুরের থানাদার সারান্দাজ খান লাখাউয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হলেন। নালায় বন্যার জন্য তিনি তিয়ক থেকে বেশি দূর পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন নি। মীর জুমলা মহম্মদ মুরাদকে নৌবাহিনী দিয়ে এবং পরে পদাতিক দিয়ে সারান্দাজ খানকে উদ্ধারের জন্য নির্দেশ দিলেন। কিছু আধিকারিকের অযোগ্যত্যার জন্য পরিকল্পনাটি মাঠে মারা গেল লড়াই না করেই সেই বাহিনীকে ধরতে সমর্থ হল আহোমরা। ২৩ মে মুরাদ ত্রিমোহনীর দিকে পালাল আর দিলির খানের নেতৃত্বে কিছু নৌকো সুরক্ষিত অবস্থায় দেওলগাঁওতে আসতে পারল। মীর জুমলা হাসানকে দেওপানি ঘিরে বসে থাকা অহোমদের ধংস করতে পাঠিয়েছিলেন, তিনি সেই কাজ করে দেখালেন। গড়গাঁওএর নিরাপত্তার জন্য এবারে সৈয়দ সালার খানের নেতৃত্বে ৫০টি ঘোড়সওয়ার বাহিনী রইল।

ফারহাদ খানকে মীর জুমলা নির্দেশ দিলেন লাখাউ থেকে রসদ আনা, রাস্তার দুপাশে অহোমদের বাধা হটানো এবং গজপুরে থানা বসানো আর ত্রিমোহনি আর রান্ডাংএর সিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য। ফারহাদ খানকে সাহায্য করার জন্য মীর জুমলার নিজের সিপাহি দিলেন আবুল হাসানকে। কিন্তু এই বিশাল কাজটি ব্যর্থ হতে বসল নৌকোর অভাবের জন্য। গড়গাঁও থেকে ২৭ মে রাতে বেরিয়ে তারা তিয়কে(ত্রিমোহনী আর গজপুরের মাঝে) আটকে গেলেন বন্যার দুর্বিপাকে। জলে ভরা সমতল মাঠ যেন দিহিংএর তুলনায় বিপুলাকায় দেখা যেতে লাগল। রিসালারা তাদের ঘোড়ার ওপরে আর পদাতিকেরা তাদের পায়ের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হল সারারাত। অসহায় ফারহাদ ফিরতে গেলেন সারান্দাজকে নিয়ে ত্রিমোহনী থেকে, পিছন ফিরে দেখলেন, রাস্তা গভীর খাত আর শালবল্লার খুঁটি দিয়ে আটকানো এবং খাতগুলিকে দিহিঙ্গের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে তাদের দ্বীপের মত করে আটকে দিয়েছে। এবারে ভিটারুটয়াল ফুকন তার নৌবহর নিয়ে মুঘলদের চারপাশে ঘুরতে লাগল। নৌবহর আর প্রয়োজনীয় রসদ ছাড়া সেনাপতির প্রায় অসহায় অবস্থা।এই সময় তাদের নিজেদের ঘোড়া আর ষাঁড় কেটে খেতে হয়েছে। মহম্মদ মুনিম বেগ আর একাতাজ খান মীর জুমলার নির্দেশে এলেও তারা ত্রিমোহনীতে বন্যার জন্য আটকে গিয়েছেন। হাতির পিঠে চাপিয়ে উদ্ধারকারী দল পাঠানোর অবাস্তব পরিকল্পনা বাতিল করতের হল। ফারহাদের ইঙ্গিতে সুজন সিংএর বাহিনী অহোমদের নৌবাহিনীর একাংশের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দিলে ফারহাদ ভোরে কয়েকটি ছিটিয়ে থাকা অহোম নৌবাহিনীর ওপর অতর্কিতে হানা দিয়ে ৪১টা আহমিয়া নৌকো দখল করেন, অধিকাংশ খাসা। সেগুলির ওপর নির্ভর করে ত্রিমোহনী পৌঁছতে পারলেন।

৩, গড়গাঁও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল

ফারহাদ খানের উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ রূপে ব্যর্থ হয়ে পড়ায় অহোমেরা পূর্ণদ্যোমে সব রাস্তা বন্ধ করে দিল। এমন হল যে থানাগুলি থেকে কেউ বেরোতেও পারবে না কেউ ঢুকতেও পারবে না। মীর জুমলয়া সব থানা বন্ধ করে দিলেন। অভয়পুর থেকে মথুরাপুর খুব কষ্ট করে ফিরে এলেন আজম খান। অন্যেরা গড়গাঁওতে ফিরে এলেন। দিখু পূর্ব দিকে পাহারা দিচ্ছিল সারান্দাজ খান আর মিয়ানা খান, পশ্চিমে মীর মুর্তাজার নেতৃত্বে জালাল খান দারিয়াবাদী, গাজি খান এবং মহম্মদ মুকিম। লাখাউএর পূর্ব দিকের সম্পূর্ণ দেশটি অহোমদের দখলে চলে যায়, শুধু মুঘলদের হাতে থাকে গড়গাঁও এবং মথুরাপুরটুকু। নিরাপত্তা বাহিনী ছাড়া বাইরে বেরোনো অসম্ভব হল। মীর জুমলার সামনে আর কোন আশা নেই, কোন বাহিনীও উদ্ধারে আসতে পারবে না। খাদ্য সহ কোন রসদ মুঘল শিবিরে প্রবেশ করছে না। সক্কলে বাড়ি ফিরে যাবার সব আশা ছেড়ে দিল। তাদের কোন খবরই বাইরে বেরোতে পারছে না, হিন্দুস্তানের বাড়িতে বাড়িতে সেনাবাহিনীতে যাওয়া মানুষদের শেষ কৃত্য করে ফেলল। তালস লিখছেন, বাবা আদমের সময় থেকে ১২ হাজার পদাতিক বহু সংখ্যক রিসালা, অসংখ্য শিবির ছ মাস কোন কাজ ছাড়া ক্ষমতাহীন হয়ে বসে রয়েছে। এ যেন বইয়ের মধ্যে বৃত্ত। তার বাইরে কেউ পা ফেলতে সাহস করছে না।

অহোমেরা দ্বিগুণ উতসাহে পরিকল্পনা সাজাতে লাগল। অভিজাতদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে রাজা তাদের যুদ্ধে যাবার জন্য উৎসাহিত করতে লাগলেন। তিনি নামরূপ থেকে বেরিয়ে গড়গাঁও থেকে মাত্র চার দিনের পথ শোলাগুড়িতে শিবির ফেললেন। বাদুলি ফুকনকে তার নং ফুকনরূপে বা প্রধানমন্ত্রী এবং সেনানায়ক পদে বৃত করলেন এবং নির্দেশ দিলেন মুঘল সেনানীদের হত্যা করে মীর জুমলাকে ধরে আনার জন্য। অহোমদের নির্দেশ দেওয়া হল বাদুলি ফুকনকে যে কোন প্রকারে সাহায্য করতে। ২-৩ দিনেই ফুকন চওড়া, ৬ মাইল লম্বা উবং উঁচু আর শক্ত বুরুজুওয়ালা দেওয়াল মথুরাপুর পূর্বের দিল্লি নদীর তীরে তুলে দক্ষিণী পাহাড়ের সঙ্গে দিহিং নদীর সংযোগ ঘটিয়ে ফেলল। মথুরাপুরের ওপর তার রাতের আক্রমন দিলির খান বফল করে দিয়েছিলেন।বাদুয়লি ফুকন আর বর গোহাঁইএর যৌথ বাহিনীর আক্রমন হওয়ার আগেই শিলিঘাটের মুঘলেরা নামরূপের দক্ষিণে বুরহাটে চলে এসেছিল। সাইরিঙ্গএর রাজা আগামী দিনের চিক্রধ্বজ সিংহ, বা চারিং রাজা গড়গাঁওএ আক্রমণ করলে সুজন সিং তা প্রতিহত করেন। এরকম প্রচুর ছোটখাট লড়াই চলতে থাকে।


৪। গড়গাঁও ধরে রাখার লড়াই

বাদুলি ফুকন এবারে গড়গাঁও অবরোধের পথে হাঁটলেন। এই শিবিরে মীর জুমলা উপস্থিত না থাকলেও, এখানে সাম্রাজ্যের সম্পত্তি, রসদ, পশু, গোলাবারুদ এবং কিছু যুদ্ধ নৌকোও রয়েছে, তাই এই শিবিরের নিরাপত্তা আঁটসাঁট করে রেখেছেন তিনি। ১৪ জুন তিনি ফারহাদ খানের নেতৃত্বে একটি বাহিনী পাঠালেন মীর মুর্তাজার নিরাপত্তাকে জোরদার করার জন্য। ১৬টি জলবা আর ১৮ খাসাকে তৈরি রাখা হল, বাগানের পশ্চিমে শত্রুর কাটা পরিখা বোজানো হল, শহরের উত্তরপশ্চিম প্রান্তে দিখুর তীর পর্যন্ত বাঁশের কেল্লা তৈরি হল, বিভিন্ন দিকে প্রয়োজনীয় টহলদার মোতায়েন করা হল। অসমের চাচনি গ্রাম থেকে মুসলমান বন্দুকবাজ দিয়ে উত্তরের দিকে নিরাপত্তা বিধান করা হল।

রাজধানীতে পরপর কয়েকটি রাত জুড়ে আক্রমন চালিয়ে গেল অহোমেরা। ৮ জুলাই, উত্তরের বাঁশের বেড়ার পিছনে নিরাপত্তায় বাকসারিয়া বন্দুকবাজদের খতম করে দুর্গের অর্ধেকটা দখল করে নিল তারা। দুর্গের ভিতর থেকে প্রবল প্রতিরোধ হওয়ায় এই আঘাত সামলে নিল মুঘলেরা। তার ভুল বুঝতে পেরে পরের দিন বাঁশের দেওয়ালের বদলে মাটির দেওয়ালের প্রতিরোধ গড়লেন সেনাপতি। এক হপ্তার মধ্যে কয়েকটি বুরুজ দিয়ে একটি বিশাল চওড়া দেওয়াল তৈরি হয়ে গেল। গড়গাঁওএর নিরাপত্তা বিধানে মীর জুমলা এই দেওয়ালের খুব প্রশংসা করেছিলেন। অহোমদের রাতের আক্রমন চলতেই থাকল, কিন্তু যুদ্ধে আসত অসুস্থ ফারহাদ সারা রাত নিজে পাহারায় থাকলেন। মীর জুমলা অহোম বন্দুকবাজদের থেকে ডাঙ্গা নালার মুখের সেতু পাহারা দেওয়ার জন্য প্রত্যেক রাতে ২০০জনের বাহিনী নিয়োগ করেছিলেন, তারা নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য না দেখে গোটা রাজধানীর নিরাপত্তায় নজর রাখত। তারা সারা রাত জেগে থেকে ভোরে মথুরাপুরে ফিরে যেত।

ফরহাদ মীর জুমলার আস্থার পরিপূর্ণ প্রতিদান দিলেন। ১২ তারিখ রাতে চারদিক থেকে চারটি বাহিনী রাজধানী আক্রমন করায় ফারহাদের রণিনীতিতেই বেঁচেছিল সৈয়দ সালারের দারিয়াবাদী বাহিনী গণহত্যার হাত থেকে। তিনি শহরের মাঝে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় রদস মুহুর্মুহু চার দিকে পাঠাবার ব্যবস্থা করছিলেন। শিহাবুদ্দিন তালিশ লিখছেন, একমাত্র তার বাহিনীরই পরাক্রমে উত্তরপশ্চিমে আহোমদের আক্রমন থেকে শহরটি বেঁচেছিল। গড়গাঁওএর ভবিষ্যৎ চিন্তা করে উদ্বিগ্ন মীর জুমলা রাতদিন ‘দূরের গোলমালের দিকে কান খাড়া’ করে রেখেছিলেন। সুউচ্চ কাঠের মিনারে দাঁড়িয়ে গড়গাঁওতে আগুণ দেখা যাচ্ছে কিনা তার নিরাপত্তা কর্মীরা লক্ষ্য রাখতেন। শাহাবুদ্দিন তালিশকে তিনি বলেছিলেন, ‘সকালের নামাজের পরে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি পাতা কার্পেটের ওপরেই ঘুমোতাম। সেখানেই আমার সারা রাত দিন কাটত।’

১৫, ১৬, ১৮ জুলাই অহোমিয়ারা নতুন করে আক্রমন শানাল। কিন্তু গড়ের নিরাপত্তা ভাঙতে পারল না। অসুস্থ, আহত ফারহাদের জায়গায় মীর জুমলা রশিদ খানকে দায়িত্বে দিলেন। গড়গাঁওএর চারপাশের কাটা পরিখাগুলি, বিশেষ করে কাকুজানের(২৩ জুলাই) রশিদ খান নিজে ঝটিকা আক্রমন করে বুজিয়ে দিলেন তাঁর পরাক্রম অহোমদের। দিল্লি নদীর পাশে কাটা পরিখা থেকে নিজেদের সরিয়ে নিল অহোমবাহিনী এবং দাঙ্গা নদী পেরিয়ে চলেও গেল। বহুকাল পরে গড়গাঁওতে শান্তি ফিরে এল।

রণঅক্লান্ত ফুকন তার ব্যার্থতাগুলি বুঝতে পারলেন। রাতের আক্রমন, রসদের ওপর আঘাত বা মুঘল শিবিরের ওপর আক্রমনেও মুঘল বাহিনীর সেনাপতির মনোবলে চিড় ধরল না। হয় নিজের উদ্যোগে বা রাজার নির্দেশে ফুকন শান্তি প্রস্তাব দিলেন(জুন-জুলাই) দিলির খানের মধ্যস্থতায়। মীর জুমলা খুব কিছু কঠিন শর্ত দিলেন, যাতে তাকে অহোমেরা দুর্বল না ভাবে - রাজাকে প্রথম দাঁত কাটা ৫০০ হাতি দিতে হবে, ৩০ লাখ তোলা সোনা আর রূপো দিতে হবে, রাজার মেয়েকে সম্রাটের হারেমে পাঠাতে হবে, প্রথম দাঁত ওঠা ৫০টা মদ্দা যুদ্ধ হাতি বার্ষিক উপহার হিসেবে দিতে হবে, এবং রাজা শুধু নামরূপ এবং তার আশেপাশের পাহাড়গুলি দখল রাখতে পারবেন। মীর জুমলার দূত খ্বাজা ভুর মলকে ফুকনকে জানালেন তিনি মুঘল বাহিনিতে যোগ দিতে ইচ্ছুক যদি রাজা এই শান্তি প্রস্তাব না মানেন। মীর জুমলা মথুরাপুর থেকে বড়গাঁওএর দিকে রওনা হলেন ১৭ আগস্ট মহামারীর আশংকায়। অহোমেরা শান্তিশর্ত বাতিল করল।

৫। মথুরাপুর আর গড়গাঁওএর মুঘল শিবিরে মহামারী এবং মন্বন্তরের প্রকোপ আগস্টে মথুরাপুরে মহামারী আক্রমন করল মুঘল শিবিরে। এবং সেটি অহোমদেরও ছাড় দিন না। মীর জুমলার ভাইপো সহ দুইতৃতীয়াংশ সেনা মারা গেল। অহোমদের প্রায় ২৩ লক্ষ লোক মারা গেল। মৃতদের ঠিকভাবে পোড়ানো বা কবর দেওয়াও গেল না। ব্রহ্মপুত্রর জলে হাজারে হাজারে মৃতদেহ ভাসতে লাগল এবং জল অপেয় দূষিত হয়ে গেল, লাখাউএর মুঘল সেনাকে ফুটিয়ে সেই জল খেতে হত।

মীর জুমলার পক্ষে শিবিরে মজুদ চাল বা অন্যান্য রসদ না নিয়ে মহামারীতে ভোগা শিবির ছেড়ে যাওয়া মুশকিল। কিন্তু গতায়াতের অসুবিধের জন্য সেগুলি নিয়ে যাওয়া যাবে না। কিন্তু মহামারীর সঙ্গে শুরু হল খাবারের অপ্রতুলতা। ১৭৩টা ধানের গোলার মধ্যে মাত্র ১৬টা বন্যার জলের বা শত্রুর লুঠের থেকে বাঁচানো গিয়েছিল। এর মধ্যে ৬টা পশুদের জন্য আর ১০টা মানুষের জন্য বরাদ্দ করে দিলেন মীর জুমলা। লাল, মোটা চাল খেতে হল সক্কলকে। প্রথমের দিকে গরুর মাংস জলে ফুটিয়ে খাওয়া, তার পরে লুঠ করা ষাঁড়গুলির চর্বিতে গরুর মাংস ফুটিয়ে, তার পরে ঘোড়ার, উট এবং হাতির মাংস খাওয়া শুরু হল। দৈনন্দিনের চাল, লাল, তেল, ঘি, মিষ্টি, আফিম, তামাক বা নুনের উভাব দিনের পর দিন বাড়তে বাড়তে শিবিরের সেনারা পাগলপারা হতে থাকে। ঘি বিক্রি হতে থাকল ১৪টাকা সের, ছোলার দাম উঠল ১টাকা সের। আফিমের তোলার দাম উঠল ১টি সোনার মোহর, এক ছিলিম তামাকের দাম উঠল ৩টাকা, মুগডাল আর নুন পাওয়া যেত একযোগে ১০টাকা সের। মহম্মদ বেগ মীর বক্সী যাদের তামাক অতি প্রয়োজন সেনাদের দিয়ে দিলেন, নিজের আফিম খাওয়ার মাত্রা কমিয়ে দিলেন।

মথুরাপুরে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। ১৭ আগস্ট সন্ধ্যায় প্রাসাদে নামাজ সেরে বিপুল বর্ষার মধ্যে শিবির ছেড়ে পরের দিন ভোরে গড়গাঁও পোঁছলেন মীর জুমলা। কয়েকটি সাঁজোয়া গাড়ি রাস্তায় কাদায় আটকে রয়ে গেল। দিলির খান সেগুলি উদ্ধার করে ১৮ তারিখ সন্ধ্যায় নিয়ে আসেন। নির্দেশ সত্ত্বেও গুদামের তিন চতুর্থাংশ ধান নিয়ে আসা গেল না। বহু অসুস্থ সেনাও শিবিরে ছেড়ে আসতে। কোন সাফল্য ছাড়া অহোমদের গড়গাঁওতে রাতের আক্রমন চলতে থাকে। মীর জুমলা তার সেনানায়ককে ঠিক সময় সৈন্য পাঠাতে পারেন। ১৫ সেপ্টেম্বর চাঁদনি রাতের আক্রমনে আবুল হাসান এবং রাজা সুজন সিং আহোমদের এমনভাবে পর্যুদস্ত করে যে তারা আর তার পরে আক্রমন শানাবার কথা ভাবে নি। মারী আক্রান্ত মথুরাপরের উদ্বাস্তুরা গড়গাঁও এসে পৌঁছলে, মন্বন্তর আর মহামারী একসঙ্গে আক্রমন করে মুঘল বাহিনীকে। বমি আর দাস্ত একসঙ্গে চলতে লাগল... শরীর জলশূন্য হয়ে গেল...মরণ যেন ধন্বন্তরী...তার কোলে টেনে নেয়...লাল মোটা চাল আর গাছের লাল পাকা লেবু ছাড়া সব ধরণের খাদ্যদ্রব্যের অভাব ঘটতে লগল...লালচালের ভাত খেলেই কম্প দিয়ে জ্বর আসতে লাগল...। গরীবেরা গাছের পাতা মাঠের ঘাস বা নদীর ধারের শাকপাতা খেতে লাগল। তার জন্য বরাদ্দ মীর জুমলা দিয়ে দিলেন সৈন্যদের। ঐতিহাসিক মহম্মদ মুনিম তাব্রেজি, অসুস্থদের শুশ্রূষা করতে করতে মারা গেলেন।

৬। অসমে মুঘল নৌবহর দুর্দশার মাসগুলোয় মুঘল নৌবাহিনী নিজেদের বাঁচিয়ে রাখে এবং সেনাদের সাহায্যও করে। বর্ষায় মীর জুমলার থেকে সংযোগ চ্ছিন্ন হয়ে গেলেও লাখাউতে নৌবাহিনী প্রধান ইবন হুসেন তার সৈন্যদের মানসিকতা উত্তেজকর বক্তৃতা দিয়ে উঁচু তারে ধরে রেখেছিলেন। আলি বেগের নেতৃত্বে একটি নৌবহর গজপুরে পাঠানো হয়। কিন্তু জলের টানে বাঁশবাড়ি (দেওলগাঁও আর গজপুরের মাঝে) পর্যন্ত ফিরে আসতে হয়। সেখানে যোগ দেন মুনাবার খান। তারা তামুলি দলাইএর থেকে দুটি জাহাজ উদ্ধার করে লাখাউতে ফিরে আসে। আলি বেগ অন্য একটা অচেনা জলপথে গড়গাঁওতে মীর জুমলার সঙ্গে মিলিতে যাবার কথা ভাবলেও সেই পরিকল্পনা দেওলগাঁওএর থানেদার য়াদগার খান বাতিল করায়।

লাখাউ ছিল মন ভেঙ্গে যাওয়া মুঘলদের শেষ ভরসাস্থল। মীর জুমলা নৌসেনাকে বার্তা পাঠালেন যে সেনাদের জন্য আলাদা করে না ভেবে তাদের জন্য যেন তারা রসদ পাঠাব্র ব্যবস্থা করে। এবং কালিয়াবর, সমধারা এবং দেবলগাঁও থেকে বাহিনী নিয়ে লাখাউতে জড়ো করার নির্দেশ দেন।

৭ জুলাই ইবন হুসেন মীর জুমলাকে নৌ বহরের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত না হওয়ার কথা বলেন। কিন্তু সমধারা আর কালিয়াবরের থানা তুলে নেওয়ার প্রতিবাদ জানায়, তার ফলে বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। তবে তিনি দেবলগাঁওএর থানা তুলে নেন কেননা এটি দখল করতে মাজুলি থেকে ভিটারুল ফুকন এগোচ্ছিলেন। তিনি বাঁশের কেল্লা পরিখা তৈরি করে ফুকনের রাত আক্রমণের প্রতিষেধক প্রতিরক্ষা সাজান, এবং গুয়াহাটির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেন। এক সময়ে লাখাউ পশ্চিম, দক্ষিণ এবং উত্তর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের উত্তর তীরের স্থানীয় চাষীদের থেকে প্রচুর ধান জোগাড় করলেন এবং শোলাগড়ে(লাখাউ এবং কালিয়াবরের মধ্যে) অকারণে বহু অহোমকে হত্যা করেন। ভয় পেয়ে বহু চাষী তাদের নেতাকে ধরয়ে দিয়ে মুঘলদের কাছে আত্মসমর্পন করেন(৫ আগস্ট) এবং পশ্চিম দিকের বার্তাবিনিময়ের রাস্তাটি তারা সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। কালিয়াবর হয়ে লাখাউ থেকে গুয়াহাটির মধ্যে বার্তা লেনদেনের রাস্তার সুরক্ষা নিশ্চয় হয়ে যায়। মৃত শ্বশুর সৈয়দ নাসিরুদ্দিনের স্থলে সৈয়দ হুসেন কালিয়াবরের থানাদার হলেন(১২ আগস্ট) আর সমাধায় মৃত সৈয়দ মির্জার স্থলাভিষিক্ত হলেন কিসান সিং। ইবন হুসেন দেশটি ধরে রাখার সমস্ত রকমের চেষ্টা করলেন, কেননা তিনি জানেন মুহূর্তের অসতর্কতায় চরম বিপদ ঘটে যেতে পারে এবং তার সেনাবাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যেতে পারে।

গড়গাঁওতে মুঘল সেনার হাতে পর্যুদস্ত হয়ে অহোমেরা নৌ বাহিনীর ওপরে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়। ভিটারুয়াল ফুকনের লাখাউতে এবং অন্যন্য থানায় রাতের আক্রমন ব্যর্থ হয়। তবে অসমিয়াদের গণহারে হত্যালীলা চালিয়ে গেলেন ইবন হুসেন। ভয়ে ভীত রায়তেরা চিঙ্গুলাং লুথুরি দায়াঙ্গিয়া রাজখোয়া এবং বুড়াগোহাঁইকে ধরিয়ে দিলেন মুঘল নৌ সেনাধ্যক্ষ্যের কাছে। লাখাউ আর গড়গাঁওএর মাঝে অহোম বিদ্রোহীদের হারানোর জন্য মুঘলদের সাহায্য করতে থাকে সাধারণ প্রজারা। প্রজাদের অসন্তোষে ভিটারুল ফুকনকে দেবলগাঁও থেকে মাজুলি দ্বীপের রাঙ্গালি চাপরিতে পালিয়ে যেতে হয়। এবারে ইবন হুসেন দেবলগাঁওতে নতুন করে থানা তৈরি করে মীর জুমলার কাছে দু’দন অহোমের মার্ফত এই খুশির খবর পাঠালেন(৫ সেপ্টেম্বর)। এদিকে তামুলি দলাই বাঁশবাড়িতে হারার পরে পালিয়ে যায়। গজপুর এবারে মুঘলদের দখলে এল।

চতুর্থ পর্ব

১। মীর জুমলার নতুন করে আক্রমন

অভিযানের মাঝামাঝি সময়ে(২০ সেপ্টেম্বর ১৬৬২) যে দুর্যোগের ঘনঘটা ছেয়ে গিয়েছিল মীর জুমলার বাহিনীর ওপর সেটা পুরপুরিই কেটে গেল। দেখতে দেখতে বর্ষা চলে গেল, বন্যার জল নেমে গেল, রাস্তা নতুন করে সারাই করা হল এবং খবরাখবর আদান প্রদান হতে লাগল। দেবলগাঁও থানা তৈরি হবার পর মীর জুমলা গড়গাঁওএর সঙ্গে লাখাউএর সংযোগ তৈরির কাজটি সম্পন্ন করতে উদ্যোগী হলেন। ২৫ সেপ্টেম্বর আবুল হাসান সাইরাং এবং দেবলগাঁওএর দিকে এগোলেন দিখুর তীরে গোলাকার পাড় ঘুরলেন। অহোম পথ প্রদর্শকদের সঙ্গে নিয়ে তিনি অহোম বিদ্রোহীদের দমন করলেন গাজি খানের নেতৃত্বে সাইরাং, গজপুরে সৈয়দ আহমেদ জামাতদারের নেতৃত্বে থানা তৈরি করলেন। দেবলগাঁওতে ঢুকে তিনি তার বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। অসমের অবস্থা বর্ণনা করে সম্রাটের উদ্দেশ্যে এবং ঢাকার উদ্দেশ্যে লেখা মীর জুমলার চিঠি, দরঙ্গের রানী-ডোগারের উদ্দেশ্যে পরওয়ানা, গুয়াহাটির মুঘল ফৌজদারকে, এবং কালিয়াবরের থানাকে দেওয়ার উদ্দেশ্যে চিঠিগুলি পাঠানোর জন্য দেওয়া হল। খুব তাড়াতাড়ি ইস্তিয়াখ খানকে অসমের সুবাদার, রশিদ খানকে কামরূপের ফৌজদার করার পাদশাহের ফরমানটি পৌঁছল। প্রত্যেকেই তাদের পদ নিতে অস্বীকার করেন। যেহেতু নদী পথ তখনও সুরক্ষিত নয়, তাই নৌসেনাধ্যক্ষ্যের মার্ফত দেবলগাঁও এবং তার পরে গড়গাঁও পর্যন্ত ভূমিপথে বাহকদের সাহায্যে ব্যাপারীদের রসদ এবং পশু পাঠানো হল। সেগুলি গড়গাঁওতে পৌঁছল ২৪ অক্টোবর। আবুল হাসানের নৌবহরে করে কিছু রসদ সেখানে পৌঁছল ৩১ তারিখ। ‘দীর্ঘ দিন পরে সাম্রাজ্যের বাহিনীর প্রত্যেকের প্রত্যেকটি চাহিদা পূর্ণ হল’।

২। টিপামের উদ্দেশ্যে মীর জুমলার পভিযান

মাঠঘাট শুকনো হয়ে যাওয়ায় মুঘল সেনাবাহিনী পুরোন আমলের মত অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠল। অহোম রাজা আগের মত নামরূপের পাহাড়ে চলে গিয়েছিলেন। বাদুলি ফুকন দুদিক রেখে তার ঘুটি সাজাতে লাগল। একদিকে তিনি এবং গড়গাঁওনি ফুকন দিল্লি নদীর তীরে বাঁধ চওড়া আর জোরদার করছেন, অন্যদিকে মীর মুর্তাজা মার্ফত মীর জুমলার কাছে শান্তিবার্তাও পাঠালেন। কিন্তু মীর জুমলা অহোমদের শর্তহীন আত্মসমর্পন চান আর যতক্ষণ না ফুকনেরা তার জন্য অপেক্ষা করবে ততক্ষণ তিনি কোন শান্তিচুক্তি মান্য করবেন না। গড়গাঁওএর ২০ মাইল উত্তরপূর্বে দুদিক থেকে বাদুলি ফুকনের শিবির আক্রমন করার পরিকল্পনা নিলেন। আবুল হুসেইন ১০ নভেম্বর দিল্লির দিকে নদী বাহিত হয়ে পিছন দিক থেকে গেল আর মীর জুমলা নিজে ১৬ নভেম্বর দান্দগা এবং দিল্লি নদি হেঁটে পেরোলেন। বাদুলি ফুকন তার বিশাল এবং সুরক্ষিত গড় ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।

২০ নভেম্বর মীর জুমলা দিহিঙ্গে পোঁছে দেখলেন বুড়াগোহাঁই সুরক্ষিত দুর্গ ছেড়ে বরকটে পালিয়ে গিয়েছেন। দক্ষিণে টাওকাক, উত্তরে দিহিং পশ্চিমে শোলাগুড়ি এলাকা নিয়ন্ত্রণ করা সেনানায়ক মীর জুমলার নাম শুনেই পালিয়ে গেলেন। বহুকাল ধরে অসমজুড়ে অভিযান, মন্বন্তর-মহামারী এবং বিপ্রতীপ পরিবেশ মীর জুমলার শ্রীরের ওপর কামড় বসাতে শুরু করল। যে রোগে তিনি মারা যাবেন সেই রোগটি তাকে আক্রমন করল। শত্রুর পরিখা দেখার সময় ঘোড়া থেকে তিনি অচেতন হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন। যতক্ষণনা তার বিছানা তৈরি হল ততক্ষণ তিনি অজ্ঞান ছিলেন। দিলির খান কোলে তার মাথা নিয়ে বসে রইলেন। শিহাবুদ্দিন তালিশ দশ দিন পরে দেখতে এলেন।

৩০ নভেম্বর রাজার দ্বিচারিতা অনুভব করে বাদুলি ফুকন শিল্লিখাটোলে মীর জুমলার সঙ্গে তিন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে দেখা করতে এসে রাজাকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেন। মীর জুমলা তাকে ডেকা রাজা(ছোট রাজা) উপাধি দিলেন। পূর্ব অসমের মুঘল প্রশাসনিক প্রধান হওয়ায় গড়গাঁও থেকে নামরূপ পর্যন্ত গ্রাম এবং শহরের এবং ত্রিমোহনী পর্যন্ত পথ এবং জলসীমায় দায়িত্ব পেলেন ফুকন। দলত্যাগী ফুকনের পথ দেখানোয় অসুস্থতা সত্ত্বেও মীর জুমলা এগিয়ে চললেন। ২ ডিসেম্বর দরবেশ বেগকে দায়িত্ব দিলেন অহোমদের তাড়িয়ে নিয়ে এসে তাদের শোয়ালগুড়ির হাতিগুলি দখল করার। ৬ তারিখে তিনি নামরূপের উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে পরের দিন তিনি শোয়ালগুড়ি পৌঁছলেন। ৮ তারিখে শোয়ালগুড়ি নদী পেরিয়ে দরবেশ বাগ এবং বাদুলি ফুকনকে নিয়ে চললেন।

১০ ডিসেম্বর অসুস্থ হওয়ার এই প্রথম তিনি ধারাস্নান করলেন এবং পরিপূর্ণ খাওয়ার খেলেন, অথচ পাকস্থলীতে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করতে লাগলেন। রাতে ধুম জ্বর আর বুকে ব্যথা হতে লাগল। গিলানের ডাক্তার কারিমা তার চিকিতসা করাতে অস্বস্তি কিছুটা লাঘব হল। কিন্তু রক্ত পরীক্ষা করতে দিতে আস্বীকার করলেন রোগী। দুই বা তিন দিন পরে প্লুরিসি(ফুসফুসের রোগ) দেখা দিল। তবুও মীর জুমলা বাদুলি ফুকনের সাহায্যে রাজাকে ধরতে বদ্ধপরিকর। কিন্তু নেতার অসুস্থতায় মনভেঙ্গে যাওয়া মুঘল বাহিনী নামরূপ ঢুকতে অস্বীকার করল। এলাকা দেখে তাদের ধারণা হল সেখানে বাহিনীর সব কিছু হারিয়ে যাবে – এই এলাকার বাতাসে মৃত্যু আছে, এখানে জলস্থল বাহিত হয়ে কোন রসদ এসে পৌঁছবে না, যখন শুনল এখানে জানুয়ারির শুরুতেই বর্ষা আসে, অনদূর অতীতে মন্বন্তর-মহামারী থেকে ভুগে ওঠার, খালি পেট থাকার স্মৃতি, সাথী হারানোর স্মৃতি তখনও জ্বলজ্বল করচ্ছে প্রত্যেক সেনার মনে। নামরূপের পাহাড়ি এলাকার উঁচু পথ দেখে তাদের মনে হল, রাজাকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টার জেদে যদি তারা এই রাস্তায় ঢোকে, তাহলে হয়ত তাদের বেরিয়ে যাবার কোন পথ থাকবে না, রাজার বাহিনী তাদের চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে কচুকাটা করবে। দিহিং পেরোনোর সময়েই সাধারণ এবং সেনাপতিরা তাদের নেতাকে ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিল। দিলির খান তাদের শান্ত রেখে মহম্মদ বেগকে দিয়ে মীর জুমলাকে অবস্থা জানাতে খবর পাঠান।

সেনার দোদুল্যমান মনোভাবে মীর জুমলা আশ্চর্য হয়ে গেলেন। শারীরিক অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকল। ১৫ ডিসেম্বর যখন একটা পালকিতে তোলা হল তাঁকে তার চেহারা খুবই ভেঙ্গে পড়েছে এবং চোখে মুখে আশংকার অন্ধকার। ১৮ তারিখে মানরূপের গিরিপথের মুখের গ্রাম টিপামে শিবির ফেললেন দিহিঙ্গের অন্যান্য এলাকার সুরক্ষা মিয়ানা খানের দায়িত্বে দিলেন।

৩। শান্তির দিকে

টিপাম মীর জুমলার অসম অভিযানের যেমন শেষ বিন্দু, তেমনি এটি তার পিছিয়ে আসারও এলাকা। শান্তিচুক্তির দরকষাকষি শুরু হল। দুপক্ষই শান্তি চায়। অহোমদের দিক থেকে তাদের এলাকা বিদেশিদের কবলে গিয়েছে এবং তাদের রাজা – স্বর্গদেওকে সেই বাহিনী রাজধানী চ্যুত করেছে। ছোটখাট লড়াই দিয়ে তাদের জাতীয় অবমাননার বিচার করা যাবে না। শত্রুর হাত থেকে দেশকে উদ্ধারের ক্ষেত্রে অহোমদের কাছে কোন মূল্যই যথেষ্ট নয়। আপাতত পেশকাশ বা রাজস্ব দেওয়ার শর্তে একজটা কার্যকরী শান্তিচুক্তিতে উপনীত হতে তারা তীব্রভাবে আগ্রহী। আভ্যন্তরীণ উদ্গীরণ বা কোন বহিঃপ্রভাব যুক্ত অবস্থার পরিবর্তনের বাহানায় আগামী দিনে সেই চুক্তি উল্লঙ্ঘন করা যেতে পারে। অহোমেরা নিশ্চিত ছিল মুঘলদের সঙ্গে আরও বেশি দিন লড়াই চললে আসমের দুর্গতি আরও বাড়বে, এই বার্তা নিয়ে প্রধান সেনাপতি আতন বুড়াগোঁহাই রাজার প্রবাস প্রাসাদে দেখা করে তাকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করেন, বর্তমান অবস্থার অনুকূল প্রতিকূলতা বোঝা, এবং শেষ পর্যন্ত শান্তিচুক্তিতে রাজাকে রাজি করান। বাদুলি ফুকন এবং অন্য অভিজাত অহোমের শিবির ত্যাগ রাজাকে চিন্তায় রেখেছিল। যে সেনাপতি না হারতে এবং শেষ দেখতে দৃঢপ্রতিজ্ঞ, তার বিরুদ্ধে বেশিদিন লড়াই চালানো যাবে না বুঝেই রাজা আর তার ফুকনেরা দেশকে বাঁচাতে শান্তিকেই একমাত্র হাতিয়ার রূপে বেছে নেন, এবং মীর জুমলার উদ্দেশ্যে দূত এবং উপহারের ডালি পাঠানো শুরু করেন।

কিন্তু অহোমদের শান্তির দেখনদারির চেষ্টা মীর জুমলা বাতিল করে দিলেন(৩০ নভেম্বর)। দিন পনেরো পরে এক গুরুত্বপূর্ণ অহোম দূত দিলির খানকে রাজি করিয়ে ফেলেন মীর জুমলাকে বোঝানোর দায় নিতে। বাস্তবে সেনাপতি সব থেকে অবাঞ্ছনীয় অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। তিনি বুঝে গিয়েছেন, মুঘল সেনাবাহিনীর অসম বিজয়েও শান্তিপূর্ণ সরকার গঠন অসম্ভব। জনগনের সাহায্যে বিদ্রোহীরা সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেই যতই মুঘলেরা প্রজাদের স্বার্থে কাজ করুক। সেনা শাসিত সরকার তৈরি করা অবাস্তব এবং সেটা তার মনের কোণেও ঠাঁই পায় নি। অথচ এই বিদেশে তার একমাত্র সম্বল সেনাবাহিনীই। দুর্দশার চরমে পৌঁছে গিয়ে সেনারা দেশে জয়ের সংবাদ নিয়ে ফিরতে চায় – এবং তারা বিদ্রোহের মুখে দাঁড়িয়ে। নিজের রোগ, নিজের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়া, শান্তিচুক্তি বাতিলের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া এবং মুসলমান যুদ্ধ বন্দীদের অবস্থা আন্দাজ করে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মীর জুমলা শান্তিচুক্তিতে রাজি হতে বাধ্য হন। বাস্তবিক অবস্থা, তাকে বাধ্য করেছে শান্তিচুক্তিতে উপনীত হতে এবং এটাই এখানকার সক্কলের জন্য সব থেকে চাহিদাপূর্ণ সমাধান বলে তার মনে হল। রোগ শয্যায় শুয়ে থেকেও তিনি হারের মুখ নয়, কঠোরতাপূর্ণ মনোভাবে নির্দেশ দিলেন মুঘল বাহিনী আরও এগোতে চায় কিন্তু টিপামে শান্তিচুক্তির দরকষাকষি শুরু হোক। তার দূত রাজা ভোর মল রাজার দূত ফুকনদের মীর জুমলার মনোভাব জানিয়ে দিলেন। দিলির খানের মধ্যস্থতায় ঘিলাঝরি ঘাট, টিপামের চুক্তি সম্পন্ন হল ৯ মাঘ ১৫৮৫ শক, ২৩ জানুয়ারি, ১৬৬৩তে।

মীর জুমলা এই চুক্তির মাধ্যমে সম্মানের শান্তি দাবি করতে পারলেন। প্রাথমিকভাবে সম্রাটের সম্মান উঁচুতে থাকল এবং অহোম রাজাকেই মাথা নোয়াতে হল। সম্রাটের অধীনস্থ হয়ে জয়ধ্বজ রাজ্য চালাবার অনুমতি পেলেন। এর জন্য গুয়াহাটির মুঘল দরবারে একজন দূত এবং পাইক বাহিনী পাঠানোর শর্তে রাজি হলেন। উপযুক্ত উপঢৌকন সহ তার এক কন্যা এবং টিপামের রাজার পুত্রকে দরবারে পাঠাবার শর্তে রাজি হলেন।

দ্বিতীয়ত, যুদ্ধের বিপুল ক্ষতিপূরণ রাজার থেকে চাওয়া হল – তাকে সেই মুহূর্তে দিতে হবে ২০ হাজার তোলা সোনা, ১,২০,০০০ তোলার রূপো(রূপিয়া), ২০টি সুসজ্জিত হাতি। পরের বছর থেকে বছরে ৩ লাখ রৌপ্য(রূপিয়া), বছরে তিনবার ৯০টা হাতি। তৃতীয়ত অসম রাজ্যের চারটি বড় স্তম্ভ বুড়াগোঁহাই, বরগোঁহাই, গড়গাঁওনিয়া ফুকন(রাজসুয়ার রাজমন্ত্রী) এবং বড়পাত্র ফুকনদের একজন করে পুত্রকে দিল্লিতে জামিন হিসেবে রাখা হবে যতক্ষণনা এই ক্ষতিপূরনটির কিস্তিগুলি মুঘলদের হাতে এসে না পোঁছাচ্ছে। চতুর্থত রাজা গুয়াহাটিতে বছরে ২০টা করে হাতি উপঢৌকন হিসেবে পাঠাবে। পঞ্চমত মুঘলদের অসমের আধিকার পূর্ব দিকে বাড়বে, রাজাকে তার রাজ্যের প্রায় অর্ধেক মুঘলদের দিতে হল – উত্তরাকোলে দরং - হাতি সমৃদ্ধ, নাকটি রানী, গারো পাহাড়, বেলতলা এবং ডিমারুয়া(বা দক্ষণকোলের ডুমারিয়া পরগণা) এলাকা। পূর্ব দিকে মুঘলদের সীমান্ত মানস থেকে বেড়ে ভরালী পর্যন্ত গেল, এবং উত্তরে কলং নদী দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্রের দক্ষিণ পাড়। কামরূপের মুঘল এলাকার যুদ্ধ বন্দীসহ, গ্রেপ্তার হওয়া বাদুলি ফুকনের পরিবারকে মুক্তি দিতে সম্মত হল।

আওরঙ্গজেবকে জয়ধ্বজের আত্মসমর্পনের চিঠিটি মীর জুমলা পাঠালেন দরবারে। চুক্তি অনুমোদন এবং স্বাক্ষর করে পাদশাহ মীর জুমলাকে যথাবিহিত উপহার দিলেন।

তবে চুক্তিতে যে সব ধারার বা শর্তের কথা বলা হয়েছিল সেগুলির সব কটি রূপায়ণ হওয়া সম্ভবপর হবে না তা বোঝা গেল। মীর জুমলা অসমে থাকালীনই জামিনদার, কিস্তির পরিমান সহ হাতির সংখ্যা, সীমান্ত নিরূপন, মীর জুমলার বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হওয়া যুদ্ধবন্দী আহোমদের ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে বিরোধ বাধল। ১৬৬৩ সালের ৫ জানুয়ারি রাজা, রাজকন্যা, চাহিদামত ৩০০০০ তোলা সোনা, ৪০০০০ তোলা রূপো, ১০টা হাতি মুঘল শিবিরে পৌঁছে দিলেন। তখনও মীর জুমলা লাখাউতে পৌঁছন নি। কিন্তু মীর জুমলা জামিনদারদের হাতে নিতে ইচ্ছুক। অহোমেরা বুড়াগোঁহাইয়ের ছেলের যায়গায় ভাইপোকে পাঠাল। মীর জুমলার কঠোর দাবিতে একজন গুটিবসন্তে ভোগা ছেলে পাঠানো হল, মীর জুমলা বুড়াগোঁহাইএর অন্য সন্তান(রাজার বোনের পুত্র) দাবি করলেন। কিন্তু সে কিছুদিন আগেই মারা গিয়েছে। মীর জুমলা তখন বরফুকনের (রাজার আর এক বোনের) দুই সন্তান দাবি করলেন। কিন্তু দিলির খান এবং রাজা ভুর মলের চাপ সত্ত্বেও ফুকনেরা এই দাবি মানতে রাজি নয়, চুক্তিতে নেই যুক্তিতে। মীর জুমলার মনে হল দিলির খান যদি আরও বেশি চাপ দিতেন তা হলে হয়ত হাতবদলটা হয়েই যেত। দিলির খান নিজে সেনাপতির ঘরে এসে তার মনের বিরুদ্ধতা দূর করার চেষ্টা করলেন।

৩। মীর জুমলার অসম অভিযানের তাৎপর্য, অহোমদের বিরুদ্ধে তার বিজয়ের কারণ

জীবনের শেষতম অভিযানটি মীর জুমলার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মুঘল সাম্রাজ্যের পক্ষে এটি তার প্রথম এবং শেষ অভিযান, যা মুঘল সাম্রাজ্যকে অসম সীমান্ত পর্যন্ত বাড়িয়ে দেবে। ইখতিয়ারুদ্দিন মহম্মদ ইবন বখতিয়ারের সময় থেকে মুসলমান শাসকেরা উত্তরপূর্বে মুঘলদের শাসন এলাকা বাড়াবার পরিকল্পনা করে চলেছিলেন, এটি সেই চেষ্টার ফলবতী রূপ। বাস্তবে রণনীতিগতভাবে এটি অসাধারণ এক যুদ্ধ অভিযান। দিল্লি মহম্মদ বিন তুঘলক এবং বাংলার হুসেন শাহ যেখানে চরম ব্যার্থ হয়েছেন সেখানে মীর জুমলা কিন্তু সফল হলেন। জাহাঙ্গীরের সময়ে মুঘল অভিযান প্রাথমিকভাবে সফল হলেও শেষ পর্যন্ত ব্যার্থই হয়েছিল। রাজার সঙ্গে শোলাগড়ের শান্তিচুক্তির দরকষাকষির সময় মীর জুমলা মন্তব্য করেছিলেন, রাজা যেন তাকে তার পূর্বের মুঘল বাহিনীর সেনানায়কদের মত না ভাবেন, তারা হেরে চলে গিয়েছিলেন, তিনি কিন্তু জিততেই এসেছেন। শিহাবুদ্দিন তালিশ লিখছেন, অতীতে কোন বিদেশি রাজা অসমের এত ভিতরে প্রবেশ করতে পারে নি, এবং কোন বিদেশি এই দেশ জিতিতেও পারে নি। মহম্মদ কাজিম লিখছেন, আসমের রাজারা আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে তাদের মাথা নোয়ায় নি, দেশের সব চেয়ে শক্তিশালী শাসককেও তারা রাজস্ব দেয় নি, তারা দেশের সব থেকে বড় সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মাথা হেঁট করে দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে যে সব বিশ্ববিজেতা জিততে এসেছিল তারা সেই দেশে ঢুকে জেতার পথ হারিয়ে ফেলেছে।

মীর জুমলা মাত্র একমাসের মধ্যে মুঘল কামরূপ, আর ভীতিপ্রদ, দুর্বোধ্য অসম জয় করে ফেলেছিলেন আড়াই মাসেই। কোচবিহার থেকে অহোম রাজধানীতে পৌঁছনোই বিজয় যাত্রা ছিল। অহোম রাজা তার বাহিনী সমাধায় জড়ো করেছিলেন, সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সুরক্ষার গড়, এবং তার ধারণা ছিল অতীতে যে ঘটনা ঘটেছে, সেই ইতিহাস বর্তমান কালেও চক্রবত ঘুরবে একইভাবে। কিন্তু অতীতের অভিযাত্রীদের অসম জেতা স্বপ্নই থেকে গিয়েছিল, মীর জুমলা সেটিকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। ডাচ শল্য চিকিৎসক জানাচ্ছেন, মীর জুমলার পরিকল্পনা এবং সৈন্য সাজানোর পরিকল্পনা এমন ছিল যে অসম জেতার পরে তিনি পেগু হয়ে চিনেও অভিযানের পরিকল্পনা করেফেলেছিলেন। সাম্রাজ্যের বাহিনী ছ মাসের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়েছিল, তার জন্য তাকে চরম দুর্ভোগও পোয়াতে হয়েছে। মন্বন্তর, বন্যা বা মহামারী কোনটারই নিদান মীর জুমলার হাতে ছিল না। এটা বলা দরকার তার বাহিনী অহোমদের হাতে হারে নি। অহোম রাজারা এতই ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে তারা দিল্লির শাসন মাথা পেতে নিয়েছিল, যা অতীতের কোন অসম রাজা করে নি। অসমের ইতিহাসে মীর জুমলার নাম বরাবরের জন্য লেখা থাকবে, বুরুঞ্জীতে তার পাকা স্থান তো হয়েই গিয়েছে।

তাদের পুরোনো সফলতায় অহোমেরা মনে করেছিল এবারেও তারা জিতবে। জমিদারদের থেকে মীর জুমলা দেশের সঠিক খবর পাবেন ভাবেন নি। অথচ প্রত্যেক যায়গায় অহমিয়াদের প্রতিরোধ তাসের ঘরের মত ভেঙ্গে পড়ে, পঞ্চতরন এবং সিমলাগড় ছাড়া তারা মুখোমুখি যুদ্ধে যায়ই নি, এবং যুদ্ধে তাদের বড় ক্ষয়ক্ষতিও হয় নি। যোগিগুপায় মহামারী ঘটে আর শ্রীঘাটে পিছনের সৈন্য আসায় দেরি হয়েগিয়েছিল বটে, কিন্তু অহোমেরা যদি বর্ষা আসার সময় পর্যন্ত কঠোরভাবে নিজেদের প্রতিরোধ বেঁধে রাখতে পারত তাহলে হয়ত তালিশ বলছেন মুঘলেরা একটাও দুর্গ দখল করতে পারত না।

অহোমদের প্রখ্যাতি তাদের শৌর্য আর রণকুশলতায়। তারা সারাক্ষণ নজরদারি করত। সেনানায়কদের মত তাদের দুর্গও কঠোর কঠিন পাথরে তৈরি। তাদের বিপুল বাহিনী ছিল, অর্থ ছিল এবং যুদ্ধ করার প্রচুর রসদও ছিল। সিমলাগড়ের মত কঠিন দুর্গও ছিল, অসম সাঁজোয়া বাহিনী আর তাদের বারুদের গুণমানও অত্যাশ্চর্য ছিল। তবে এগুলি সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া একযোগ হলেও বাস্তবে কার্যকরী হয় না, যদি আদতে সেনানায়ক সেনানীদের মনে অতিরিক্ত জেদ চাপিয়ে দিতে পারেন। রাজা জয়ধ্বজের দোদুল্যমানতা, রাজধানীতে শত্রু আসার আগেই পালিয়ে যাওয়া, যার জন্য অসম বুরুঞ্জীতে তার (বদ)নামই হয়ে গেল ভাগানিয়া রাজা – কখনো মীর জুমলার মত নেতার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে পারে না। প্রথম শিখ যুদ্ধ সম্বন্ধে কানিংহ্যাম যা বলেছেন, ঠিক সেই কথা ১৬৬১-৬২ সালের অহোমদের সম্বন্ধেও বলা যায়, বিদ্রোহীর হৃদয় ছিল, লড়াই করার হাজারো মানুষ ছিল, কিন্তু সবাইকে একসঙ্গে করে পথ দেখাবার মানুষটাই ছিল না।

কামরূপের বিভিন্ন শিবির থেকে পশ্চাদপসরণ কিন্তু অহোমদের উদ্দেশ্যপূর্ণ রণনীতি ছিল না। মানস থেকে গুয়াহাটি পর্যন্ত যেসব অহোম সেনানায়ক বিভিন্ন বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন, তাদের রাজার প্রতি অনাস্থা এবং শিবির বদলের জন্য রাজাকে বাধ্য হতে হয়েছিল পশ্চাদপসরনের সিদ্ধান্ত নিতে। মুঘল কামরূপে তাংচু সান্দিকৈওএর থেকে প্রচুর মালপত্র গুয়াহাটির মুঘল প্রশাসক দখল করেছে, এমন একটা খবর পেয়ে রাজা নিম্ন অসমের সেনা বাহিনীর জন্য একজন অনঅসমিয়া মনথির ভরালী বরুয়াকে অসম বাহিনীর সেনানায়ক এবং প্রশাসক নিযুক্ত করে। রাজার এই পদক্ষেপে অসমের প্রশাসন এবং সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ৪০০ বছরের অসমিয়া নেতৃত্ব দেওয়ার ঐতিহ্যের ছেদ ঘটল। এক দুর্গ থেকে অন্য দুর্গের অহমিয়া সেনাধ্যক্ষরা প্রায় নিষ্ক্রিয় হয়ে গেল বা কোন রকম প্রতিরোধ দিলই না, তারা নাকি মন্তব্য করেছিল, বেজদলইরা এবার থেকে যুদ্ধ করুক। রাজার নিজের শ্বশুর রাজশাহুর বরফুকনই রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মুঘল বাহিনী যাতে অপ্রতিরোধ্যভাবে নওগাঁয় ঢুকতে পারে তার সুযোগ করে দিয়েছিল। রাজাকে ছেড়ে যাওয়া সেনানায়কেরা একে একে মুঘল বাহিনীর সঙ্গে জুড়ে গিয়ে লাখাউ এবং গড়গাঁওএর দিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এছাড়াও গ্রামগুলি দখল করার কাজে বা নির্দিষ্ট খবর দিয়ে নির্দিষ্ট কবর খুঁড়ে দামি ধনরত্ন উদ্ধারে সাহায্য করেছিল। অজানা ডাচ সেনানায়ক(এখন আমরা জানি তার নাম হেডেন - অনুবাদক) অহোমদের মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ার তত্ত্বে খুব একটা গুরুত্ব দেন নি, তিনিও বলছেন, আমরা যখন শত্রুর রাজ্যে ঢুকলাম, অসাধারণ ত্রাস শত্রু পক্ষকে গ্রাস করল, এবং নবাবের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করতে অহমিয়ারা আমাদের পাশে এসে দাঁড়াল। বলা দরকার তাদের রণনৈপুন্য আর ঐতিহ্যের সঙ্গে তাদের আত্মসমর্পন খাপ খায় না।

মীর জুমলা অসমের কৃষকদের ওপর সেনাবাহিনীর অত্যাচার না করতে দেওয়ার যে মানবিক অথচ রণনৈপুন্যের নীতি নিয়েছিলেন সেটি দুর্দান্ত কাজ দিয়েছিল, তিনি থানেদারদের স্থানীয় মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের বিরোধিতা দূর করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। স্থানীয় প্রজারা বহু সময়ে অহমিয়া বিদ্রোহী সেনানায়কদের ধরিয়ে দিয়েছে। আর অহোমদের পোড়ামাটি নীতিতে যসে সব গ্রামবাসী গ্রাম থেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তারা মুঘলদের প্রতিশ্রুতিতে ফিরে এসে ঘরদোর তৈরি করেছেন, নিজেদের জীবিকা ফিরে পেয়েছেন ফলে তারা মুঘলদের রসদ সংগ্রহে সহায়তা করেছেন। অসমের যুদ্ধ মানুষের যুদ্ধ হয়ে উঠতে পারে নি। গড়গাঁওএ থাকাকালীন মুসলমান প্রজাদের থেকে অহোমদের বহু গুপ্ত তথ্য পেয়েছেন মীর জুমলা।

দিলির খান দাউজাদির মত দৃঢবল বহু সেনানায়ক মীর জুমলার সেনা বাহিনীতে ছিলেন যারা জয় ছিনিয়ে নিয়ে এসেছিলেন প্রত্যেক যুদ্ধক্ষেত্র এবগ দুর্যোগ থেকে। ছিলেন ফারাদ খান, মহম্মদ বেগ, রশিদ খান, য়াগদার খান উজবেগ এবং তাদের বাহিনীর দৃঢ মনোভাবের সেনানীরা। মীর জুমলা তাদের ওপর যে প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, তা অন্য কোন সেনানায়ক করে উঠতে পারেন নি। তার নেতৃত্ব, রণনীতি, শৃঙ্খলা, যুদ্ধের পরিকল্পনার সঙ্গে মন্বন্তর এবং মহামারী মোকাবিলা করার ক্ষমতা বাহিনীকে এক করে রেখেছিল। দুর্যোগের সময়ে ঠাণ্ডা মাথা, প্রজ্ঞা, প্রয়োজনের সময় প্রয়োজনীয় সাহায্য পাঠানো, ১৬৬২ সালের বর্ষার দুর্যোগে তার সেনা সংগঠনের উদ্যম তাকে এবং তার বাহিনীকে বহু দুর্যোগ থেকে বাঁচিয়েছিল এবং শেষে জয় দেখতে পেয়েছেন। তিনি অসম্ভবভাবে সুশৃঙ্খল – বর্ষায় যেমন তেমনি অসম ছেড়ে চলে আসার সময়েও। তার কঠোর মনোভাব বাদুলি ফুকনের মত অদম্য সেনা নায়ককে শিবির বদল করতে বাধ্য করেছিল।

বাদুলি ফুলন তার রাজাকে ছেড়ে এসে মীর জুমলার বাহিনীতে প্রবেশ করে ৩-৪ হাজার সেনা জোগাড় করে শোলাগুড়ি আর টিপামে মুঘলদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। পূর্ব অসমের গড়গাঁও এবং নামরূপের মধ্যে এলাকার ডেকা-রাজা নামে অভিষিক্ত করেন মীর জুমলা। তিনি রাজা এবং অন্যান্য অমাত্যকে ধরে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মীর জুমলাকে। এই পরিকল্পনাটা পথভ্রষ্ট হয়ে যায় অতন বরগোহাঁইর জন্য। বাদুলির নির্দেশে তার ভাই মাউপিয়া মেকুরিখোয়ায় নিজের দেশের বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। বাদুলির পথ ধরে জগন্নাথ ডেকা, রঘুনাথ মজুমদার এবং পুত্র মনোহর, উদ্ধব দুরিয়া এবং ডাংধরা বা অন্যান্যরা শিবির পালটে তার দেশকে মুঘলদের হাতে তুলে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন বাদুলিকে নবাব বানানোর শর্তে। মীর জুমলা সরাসরি উত্তর না দিয়ে বলেছিলেন, আমি যা চইছি সেটা পাওয়ার যথেষ্ট তথ্য-প্রমান পেলে আপনারা যা চাইছেন পাবেন। এমনকি মন্থির ভরালি বরুয়া মীর জুমলার বাহিনীতে যোগ দেন জয়ধ্বজকে ধরিয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে।

তবে অস্বীকার করা যাবে না, মীর জুমলাকে এই জেতার জন্য প্রচুর মূল্য দিতে হয়েছিল। তার বাহিনী অভূতপূর্ব দুর্যোগের মধ্যে পড়েছিল। ১৬৬২ সালে তার দুর্যোগের কথা স্মরণ করে তালিশ লিখছেন, লোহাকে গ্রেফতার করা সোজা, জল নয়। এবং মীর জুমলার মৃত্যুতে সম্রাটের নতুন দেশ বিজয় বিস্বাদ হয়েগিয়েছিল। যার জন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না, কিন্তু তার কাছের ওয়াকিয়ানবিশ কিন্তু এই বিজয়ে চোনা ফেলে লিখলেন ফাতিয়াইইব্রিয়া(বিজয় পুস্তক, যার নাম হুঁশিয়ারি) নামক বই।

চরিত্র এবং কৃতিত্ব[সম্পাদনা]

চরিত্র এবং কৃতিত্ব

১। ইতিহাসে মীর জুমলার স্থান সপ্তদশ শতকের ভারতে মীর মহম্মদ সৈয়দ মীর জুমলা অন্যতম অসাধারণ চরিত্র।কুতবনামাইআলমএর লেখক বলছেন, তিনি সময়ের পাতায় নিজের নাম লিখেছেন। উদ্যমী, উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং নিজেকে নিজের বলেই তৈরি করার মানুষ ছিলেন তিনি। তিনি যে চওড়া কপালের জন্য এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায় বিজয়প্রাপ্ত হয়েছেন, এবং কর্ণাটক থেকে দিল্লি, এবং খণ্ডেশ থেকে অসমের রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, এছাড়াও ভারতের সমুদ্র বাণিজ্যে তার বড় অংশ ছিল। পারস্যের এক ভাগ্যান্বেষী অভিযাত্রীর সন্তান হয়ে গোলকুণ্ডায় ভাগ্যপরীক্ষায় এসেছিলেন, তার দক্ষতায় ধাপে ধাপে নথি রক্ষক থেকে মছলিপত্তনমের প্রশাসক এবং তার পরে গোলকুণ্ডার উজির পদের সাফল্যের সিঁড়িতে ওঠেন। সুলতান তাকে কর্ণাটক বিজয়ের দায়িত্ব দিলে তিনি বিজয়ের পরে সেখানে মুক্ত রাজতন্ত্রের স্বাদ অর্জন করে কার্যত কর্ণাটকের প্রথম নবাব হয়ে বসেন। তার পরে তিনি শাহাজানের অনুগত হলে তাকে মুঘল সাম্রাজ্য তাকে দেওয়ানিকুল পদে অভিষিক্ত করে। আওরঙ্গজেবের সময় তিনি কিছুকাল খণ্ডেশের প্রদেশের প্রশাসক হয়ে বাংলার মত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সুবাদার নিযুক্ত হন।

ভারতে মীর জুমলা বিজয়নগর রাজত্বের শেষ ৩০ বছর ধরে কর্মক্ষম ছিলেন। যদিও বিজয়নগর রাজত্ব ১৫৬৫ সালের তালিকোটার যুদ্ধের আঘাত সামলে নেয়, কিন্তু সপ্তদশ শতেই তার বিলয় নিশ্চিত হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কেন্দ্রিয় শাসনের রাশ ক্রমশ কমতে কমতে সিংহাসন দখলের লড়াই ছড়িয়ে পড়ে মূলত মাদুরা, জিঞ্জি, এবং তাঞ্জোরের নায়েকদের মধ্যে এবং তামিল এবং কানাডিদের মধ্যে বিবাদ বাড়ার সুযোগ নেয় মুসলমান সাম্রাজ্য। প্রচণ্ড লড়াই করা সত্ত্বেও রয়্যাল দেখতে পায় যে তার হাত থেকে ক্ষমতার রাশ বেরিয়ে যাচ্ছে একের পর এক। এই সব কটি এবং অন্যান্য নগন্য রাজনৈতিক শক্তি একসঙ্গে মিলেমিশে একটা গোলোযোগের অবস্থা তৈরি হয় দাক্ষিণাত্যে। রয়াল আর নায়েকদের মধ্যে যে জোট ছিল তা সেই মুহূর্তের চাহিদার দাবিতে চ্ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে দাক্ষিণাত্যের রাজনীতি আরও জটিল হয়ে পড়ে। তার সঙ্গে জোড়ে ইওরোপিয় কোম্পানিগুলির কার্যকৃতি।

মীর জুমলা বিজয়নগর রাজত্বের পতনকে আরও গতি দিয়েছিলেন। ১৬৩৬ সালের মে-জুন মাসে মুঘলদের সঙ্গে চুক্তির জন্য উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। তখন দাক্ষিণাত্যের বিজাপুর আর গোলকুণ্ডার সুলতানেরা কৃষ্ণা, তুঙ্গভদ্রা নদীর অববাহিকায় দক্ষিণ-পূর্ব জেলাগুলিতে কৃষ্ণার কর্ণাটক থেকে তাঞ্জোরের কাবেরি পর্যন্ত বিস্তৃত ভেঙ্গে পড়া বিজয়নগর সাম্রাজ্যে, সাম্রাজ্য বিস্তারে মন দেয়। কুতুবশাহী সেনাপতি মীর জুমলা এই কাজে বিপুল ভূলিকা পালন করেন।

এই ভেঙ্গে পড়ার সময়ে দাক্ষিনাত্যের মোঘল সুবাদার আওরঙ্গজেব দূর থেকে মজা দেখার মানুষ ছিলেন না। কর্ণাটককে গিলে খাবার সময় খোঁজার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। তাঁরই উদ্যমে দিল্লি যোগাযোগে মীর জুমলা গোলকুণ্ডার সুলতানের প্রতি বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।

মুঘল সাম্রাজ্যের দুই স্তম্ভ, শাহজাহান এবং আওরঙ্গজেব মীর জুমলার রণনৈতিক নেতৃত্ব এবং দক্ষিণী রাজনীতিতে তার অগাধ জ্ঞান সাম্রাজ্য বিস্তৃতিতে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করেন। ১৬৪৯ সালে কান্দাহার হাতছাড়া হওয়া এবং পর পর তিন বছর ব্যর্থ কান্দাহার অভিযানে সামরিক বাহিনীতে হতাশার ছাপ ছড়িয়ে যায়। শাহজাহানের পরিকল্পনা ছিল মীর জুমলার নেতৃত্বে পারস্যে বাহিনী পাঠিয়ে তার সাম্রাজ্যের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধার করা এবং পারস্যের সেনাবাহিনীর শৌর্য দমন করা। আওরঙ্গজেব, দারা বা সাদুল্লা খান যে যুদ্ধে ব্যর্থ হয়েছেন সেই যুদ্ধ মীর জুমলা জিতবেন এমন একটা ধারনা ছিল তার। কিন্তু মীর জুমলা শাহেনশাহের দৃষ্টি উত্তর-পশ্চিম থেকে সফলভাবে দাক্ষিণাত্যের পানে ঘুরিয়ে দেওয়ার কাজটি করতে পেরেছিলেন। শাহজাহান, কান্দাহার জেতার পরিকল্পনা ত্যাগ করে বিজাপুর জিততে মরিয়া হয়ে ওঠেন। মীর জুমলার পরামর্শটা খুব মনে ধরেছিল শাহজাহানের কেননা তিনি জানতেন মীর জুমলা দাক্ষিণাত্যের দরবারি রাজনীতিকে হাতের চেটোর মত চেনেন। ১৬৫৭-৫৮ সালের বিজাপুরী অভিযানের মূল প্ররোচক মীর জুমলাই। আওরঙ্গজেবের প্রধান পরামর্শদাতা এবং সেনানায়ক হওয়ায়, সুজার বিরুদ্ধে লড়াইতে মীর জুমলাই তাকে রাজসিংহাসনটির দখল নিশ্চিন্ত করান। এবং কোচবিহার আর অসম দখলের অভিযানে মীর জুমলার সাফল্য মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত বহুদূর নিয়ে যেতে সাহায্য করে।

মুঘল সাম্রাজ্যের রণনীতি নির্ধারণে মীর জুমলার প্রভাব বেশ বড় যেমন ছিল, তেমনি, দরবারি রাজনীতি আর প্যাঁচকষাকষিতে সক্রিয় উপস্থিতিও আমরা দেখতে পাই। দিল্লির রাজনীতিতে দারা দাক্ষিনাত্যের শিয়া সুলতানির স্বাতন্ত্রের পক্ষেই ছিলেন। সম্রাটের স্নেহধন্য শাহজাদার বিপক্ষে গিয়ে, আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যবিস্তারের পরিকল্পনায় দাক্ষিণাত্যে শিয়া সুলতানিকে গ্রাস করার রাজনীতিটির নীতি প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন সফলভাবে। মুঘল সাম্রাজ্যের বড় সময় কেটেছে উদারপন্থী দারা আর ধর্মপালক সাম্রাজ্যবাদী আওরঙ্গজেবের পরস্পর বিরোধী নীতিতে সামঞ্জস্য আনতে গিয়ে। শাহজাহানের নীতি প্রায়শই দুই শিবিরের নীতিই প্রতিপালন করত। দাক্ষিণাত্যের শান্তি প্রস্তাবে দরবারে প্রাথমিকভাবে দারার নীতিটি মান্যতা পায়। অথচ সাদুল্লা খানের মৃত্যুর পর, উজির পদে বৃত হন আওরঙ্গজেব ঘনিষ্ঠ সামরিকবাদী মীর জুমলা। দরবারে আগ্রাসী আওরঙ্গজেবের সাম্রাজ্যবাদী নীতি সাফল্য পেল, দারার শান্তি নীতির বিপক্ষে। অথচ ১৬৫৭-৫৮ সালে শাহজাহানের অনুমোদনে যে দাক্ষিণাত্যের বিজাপুরী অভযান শুরু হয়, সেটি দারার হস্তক্ষেপে হঠাতই বন্ধ করে দিতে হয়। মীর জুমলার জীবন শুধু যে রাজনীতি বা কূটনৈতিক ইতিহাসের ছাত্রদের পাঠযোগ্য তাই নয়, এটি ভারতের অর্থনৈতিক ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে প্রবেশেরও দাবি রাখে। কর্ণাটকের খনির উদ্যম তাকে কুড়ি মন হিরের মালিক করেছিল। কর্ণাটক এবং বাংলায় তার ব্যবসার মূল ভিত্তিটাই ছিল দৈনন্দিনের খাদ্য বস্ত্রের একচেটিয়া উদ্যম। পশ্চিম এশিয়া এবং দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সমুদ্র বাণিজ্যের অন্যতম উদ্যমী ছিলেন তিনি। সেই যুগের অর্থনীতির ইতিহাসে তার ব্যবসা বিষয়ে আলোচনা গুরুত্বপূর্ণ কেননা, তখন বিজয়নগর সাম্রাজ্য অস্তাচলে, পর্তুগিজ কোম্পানির উদ্যম ঢালের দিকে, আর এশিয় সমুদ্রগুলিতে ডাচ আর ব্রিটিশে কোম্পানি সবে ডানা মেলছে। দুই স্বজাতি, পর্তুগিজদের হাঠিয়ে দেওয়ার আগেই মীর জুমলা বিজয়নগরের সমুদ্র বাণিজ্যের বড় অংশ দখল করে প্রথমে ডাচেদের এবং পরে ব্রিটিশদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠেন। ইওরোপিয়রা তার ক্ষমতাকে ভয় পেত কিন্তু সাহায্য নিতে ভোলে নি। এদের সঙ্গে পূর্ব উপকূলের বাণিজ্য সম্বন্ধ তার শেষ দিন পর্যন্ত বজায় ছিল।



টেমপ্লেট:সূত্র তালিকা Life of Mir Jumla

টেমপ্লেট:সম্পূর্ণ