বায়োফ্লক প্রযুক্তি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বায়োফ্লক প্রযুক্তি হল উপকারি ব্যাকটেরিয়া, অণুজীবশৈবালের সমম্বয়ে তৈরি হওয়া পাতলা আস্তরণ। যা জলকে শোধন করে। জল থেকে নাইট্রোজেন জাতীয় ক্ষতিকর উপাদানগুলি শোষণ করে নেয় এবং এর প্রোটিন সমৃদ্ধ উপাদান মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারে। এই প্রযুক্তিতে যেহেতু উপকারী ব্যাকটেরিয়া (প্রোবায়োটিক ব্যাকটেরিয়া) ব্যবহার করা হয়, যা পানির গুণাগুণ বৃদ্ধি ও রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর জীবাণু নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে উচ্চ বায়োসিকিউরিটি প্রদান করে। এই পদ্ধতিতে বিদ্যমান ক্ষতিকর অ্যামোনিয়া ও বাইরে থেকে সরবরাহকৃত কার্বনকে ব্যবহার করে অণুজীব আমিষ তৈরি করে। এক্ষেত্রে বায়োফ্লক প্রযুক্তি উপকারী ব্যাকটেরিয়া মাছের অব্যবহৃত খাদ্য, মল-মূত্র থেকে নিঃসৃত অ্যামোনিয়াকে ব্যবহার করে অণুজীব প্রোটিন তৈরি করার ফলে বাহির থেকে প্রোটিন সমৃদ্ধ খাদ্য কম সরবরাহ করলেও হয়। এই পদ্ধতিতে ছোট ছোট ট্যাংকে অনেক মাছ উৎপাদন সম্ভব হয় এবং ট্যাংকের পানি খুব কম পরিবর্তন করতে হয় তাই অল্প জমি ও অল্প পানি ব্যবহার করে অধিক মাছ উৎপাদন সম্ভব হয়। এই পদ্ধতিতে মাছ চাষে ব্যবহৃত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ ও অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন নেই বললেই চলে। তাই এটি একটি পরিবেশবান্ধব মাছ চাষ পদ্ধতি।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করা হচ্ছে।

ইতিহাস[সম্পাদনা]

প্রথম বিএফটি ১৯৭০-এর দশকে ইফ্রেমার-সিওপি (ফ্রেঞ্চ রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর এক্সপ্লয়টেশন অফ দ্য সি, ওশেনিক সেন্টার অফ প্যাসিফিক) পেনিয়াস মনোডন, ফেনারোপেনিয়াস মেরগুয়েনসিস, লিটোপেনিয়াস ভ্যানামেই এবং এল. স্টাইলিরোস্ট্রিসের মাছ নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। [১][২] ইসরায়েল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র (ওয়াডেল মেরিকালচার সেন্টার) যথাক্রমে ১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তেলাপিয়া এবং এল. ভ্যানামেইয়ের নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন শুরু করে।

সত্তরের দশকে French Research Institute for Exploitation of the Sea -এর বিজ্ঞানীরা প্রথম বায়োফ্লক প্রযুক্তির ধারণা প্রদান করেন। Steven Serfling 1986-94 সময়কালে Solar Aquafarms নামক তেলাপিয়া খামারে বাণিজ্যিকভাবে বায়োফ্লক প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। সে সময় এ প্রযুক্তির নাম ছিল Organic Detrital Algae Soup (ODAS) System। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে ইসরাইলের Technion University ও আমেরিকার Waddell Mariculture Center (WMC) থেকে আলাদাভাবে দু’দল বিজ্ঞানী যথাক্রমে তেলাপিয়া ও চিংড়িচাষে বায়োফ্লক প্রযুক্তি প্রয়োগের ওপর বেশ কিছু গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করেন। ইসরাইলের Technion University -এর গবেষণা দলটির নেতৃত্ব দেন প্রফেসর ইয়োরাম ইভনিমেলিচ (Professor Yoram Avnimelech)। তাঁকে বায়োফ্লক প্রযুক্তির পথিকৃত মনে করা হয়। গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বায়োফ্লক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সফলভাবে চিংড়ির প্রথম বাণিজ্যিক চাষ শুরু হয়ে মধ্য আমেরিকার দেশ বেলিজ -এর বেলিজ একোয়াকালচার ফার্মে। পরবর্তীতে ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে (থাইল্যাণ্ড, ইন্দ্রোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারতে) বায়োফ্লক প্রযুক্তি জনপ্রিয়তা লাভ করে। বিভিন্ন বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পাশাপশি বর্তমানে মৎস্য অধিদপ্তরের কারিগরি সহায়তায় বাংলাদেশেও বায়োফ্লক প্রযুক্তিতে মাছচাষ সম্প্রসারিত হচ্ছে।

অণুজীবের ভূমিকা[সম্পাদনা]

বায়োফ্লক মাছচাষের একটি অত্যাধুনিক, কার্যকর ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি। বায়োফ্লক প্রযুক্তি হলো অনুজীব বা মাইক্রোবায়াল নিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তি যা পুকুরে চলমান জৈবিক প্রক্রিয়াগুলোর ওপর একটি স্থিতিশীল নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এ প্রযুক্তিতে পানিতে কার্বন ও নাইট্রোজেনের একটি নির্দিষ্ট অনুপাত (১২-১৫:১) বজায় রেখে পানিতে পর্যাপ্ত বায়ু সঞ্চালন (Aeration) করে মাইক্রোবায়াল পপুলেশনকে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধির সুযোগ দেওয়া হয়।

বায়োফ্লক প্রযুক্তির মূলকথা হলো- অণূজীবকে পরিচর্যা কর, অণূজীব মাছ ও চাষ পদ্ধতির পরিচর্যা করবে। অণূজীব পানিতে বিদ্যমান বর্জ্যকে প্রোটিন জাতীয় খাদ্যে রূপান্তরের মাধ্যমে পানির বর্জ্য অপসারণ করে। বায়োফ্লক প্রযুক্তির ইঞ্জিন হলো অণুজীব। এজন্যই বায়োফ্লক প্লান্টে অণূজীবের অনুকূল পরিবেশ তৈরির জন্য কার্বন ও নাইট্রোজেন যথার্থ অনুপাত বহাল রাখতে মোলাসেস(Molasses) প্রয়োগ করা হয়।

এ প্রক্রিয়ায় হেটারোট্রপিক ব্যাকটেরিয়া পানির টোটাল অ্যামোনিয়া নাইট্রোজেন (Total Ammonia Nitrogen–TAN) গ্রহণ করে মাইক্রোবিয়াল প্রোটিনে পরিবর্তন করে, যা মাছ খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। এই টোটাল অ্যামোনিয়া নাইট্রোজেন মূলতঃ অব্যবহৃত খাদ্য ও মাছের বিষ্ঠা থেকে সৃষ্টি হয়, আর তা জৈবিক প্রক্রিয়ায় পূনর্ব্যবহারযোগ্য প্রোটিনে রুপান্তরিত হয়।

হেটারোট্রপিক ব্যাকটেরিয়া সরাসরি অ্যামোনিয়াকে প্রোটিন সেলে রূপান্তর করে। এ জাতীয় ব্যাকটেরিয়ার বংশবৃদ্ধি অত্যন্ত দ্রুতগতিসম্পন্ন প্রক্রিয়ায় ঘটে। এতে ৩০ মিনিট পর পর ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা দ্বিগুণ হয়।

আবার নাইট্রিফাইং ব্যাকটেরিয়া অটোট্রফিক নাইট্রিফিকেশন পদ্ধতিতে অ্যামোনিয়াকে Nitrobacter spp. ও Nitrosococcus spp. এর উপস্থিতিতে জৈবিকভাবে জারিত করে নাইট্রাইটে পরিণত করে। পরবর্তীতে Nitrosomonas spp. ও Nitrospira spp. এর উপস্থিতিতে নাইট্রাইটকে নাইট্রেটে রূপান্তর করে।

প্রজাতির সামঞ্জস্য[সম্পাদনা]

বায়োফ্লক মাছচাষে মূলত দুই ধরনের ব্যাক্টেরিয়া ব্যবহার করা হয়- ১. হেটারোট্রপিক ব্যাক্টেরিয়া- Bacillus subtilis, Bacillus lichniformis, Bacillus megaterium, Bacillus pumilis, Bacillus polymyxa; ইত্যাদি হেটারোট্রপিক ব্যাক্টেরিয়া যারা কোন মাধ্যম ছাড়াই অ্যামোনিয়াকে প্রোটিন সেলে রূপান্তর করতে পারে যেটা বায়োফ্লকে প্রোবায়োটিক ব্যবহারের প্রথম শর্ত।

২. নাইট্রফিাইং ব্যাক্টেরিয়া- Nitrobacter, Nitrosomonas ইত্যাদি নাইট্রিফাইং ব্যাক্টেরিয়া অ্যামোনিয়াকে প্রোটিন সেলে রূপান্তরিত করতে পারে না। কেননাা বায়োফ্লকের প্রধান শর্ত হলো অনুজীবের সাহায্যে অ্যামোনিয়াকে প্রোটিন সেলে রূপান্তর করা।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Maturation and Spawning in Captivity of Penaeid Shrimp: Penaeus merguiensis de Man Penaeus japonicus Bate Penaeus aztecus Ives Metapenaeus ensis de Hann Penaeus semisulcatus de Haan"Proceedings of the Annual Meeting - World Mariculture Society6 (1–4): 123–132। ২০০৯-০২-২৫। আইএসএসএন 0164-0399ডিওআই:10.1111/j.1749-7345.1975.tb00011.x 
  2. PUCEAT, Michel PUCEAT; Neri, Tui; Hiriart, Emilye; Van vliet, Piet (২০১৯)। "A human cell model of valvulogenesis"। Protocol Exchangeআইএসএসএন 2043-0116ডিওআই:10.1038/protex.2019.008অবাধে প্রবেশযোগ্য