বর্ধমানের যুদ্ধ (১৭৪২)

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
বর্ধমানের প্রথম যুদ্ধ
মূল যুদ্ধ: বর্গির হাঙ্গামা এবং বাংলায় মারাঠা আক্রমণ (১৭৪২)
তারিখএপ্রিল ১৭৪২; ২৮২ বছর আগে (April 1742) [১]
অবস্থান
ফলাফল

বাংলার নবাবের বিজয়[১][২][৩]

  • নবাব মারাঠাদের অবরোধ ভেদ করতে সক্ষম হন[১][২]
  • মারাঠারা পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়[১]
বিবাদমান পক্ষ
বাংলা মারাঠা সাম্রাজ্য
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী
আলীবর্দী খান
গোলাম মুস্তফা খান
ভাস্কর পণ্ডিত
মীর হাবিব
শক্তি
৩,০০০ অশ্বারোহী সৈন্য[২]
১,০০০ পদাতিক সৈন্য[২]
~৪০,০০০ সৈন্য[১]
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি
অজ্ঞাত অজ্ঞাত, তবে প্রচুর[১][২]

বর্ধমানের প্রথম যুদ্ধ ১৭৪২ সালের এপ্রিলে বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমানে মারাঠা বাহিনী এবং বাংলার নবাবের বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত হয়[১][২]। এ যুদ্ধের সময় মারাঠারা নবাবের বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করে ফেলেছিল। কিন্তু তীব্র যুদ্ধের পর নবাবের বাহিনীর মারাঠাদেরকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়[১] এবং মারাঠাদের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়।

পটভূমি[সম্পাদনা]

১৭৪১ সালে বাংলায় প্রথম মারাঠা আক্রমণ ব্যর্থ হওয়ার পর মারাঠা নেতা রঘুজী ভোঁসলে ১৭৪২ সালে তার প্রধানমন্ত্রী ভাস্কর পণ্ডিতকে ৪০,০০০ অশ্বারোহী সৈন্যসহ বাংলা আক্রমণ করতে প্রেরণ করেন[১]। ভাস্কর পণ্ডিত বাংলায় প্রবেশ করে বর্ধমানমুর্শিদাবাদ অঞ্চলে ব্যাপক লুটতরাজ আরম্ভ করে দেন। এসময় নবাব আলীবর্দী উড়িষ্যা থেকে প্রত্যাবর্তন করছিলেন। মারাঠা আক্রমণের সংবাদ পেয়ে তিনি হুগলীর মুবারক মঞ্জিল থেকে মারাঠা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অগ্রসর হন[১][২]

যুদ্ধের ঘটনাবলি[সম্পাদনা]

মারাঠা ও নবাবের সৈন্যদল মুখোমুখি[সম্পাদনা]

১৭৪২ সালের ১৫ এপ্রিল নবাব বর্ধমানের নিকটে বিশাল মারাঠা বাহিনীর সম্মুখীন হন[১]। এসময় নবাবের সঙ্গে ছিল মাত্র ৪,০০০ সৈন্য (৩,০০০ অশ্বারোহী ও ১,০০০ পদাতিক)[২]। তা সত্ত্বেও ভাস্কর পণ্ডিত আলীবর্দীর মতো সুদক্ষ সেনাপতির বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে সাহসী হন নি। তিনি মারাঠাদের প্রচলিত অনিয়মিত যুদ্ধপদ্ধতি অনুসরণ করেন[৪]। মারাঠা সৈন্যরা নবাবের সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে 'অকস্মাৎ আক্রমণ ও পলায়ন', 'বিক্ষিপ্ত আক্রমণ', 'রসদপত্র সরবরাহে বিঘ্ন সৃষ্টি' প্রভৃতি কৌশল অবলম্বন করে। তারপরেও তারা সুবিধা করে উঠতে পারে নি[১]

ভাস্কর পণ্ডিতের প্রথম শান্তি প্রস্তাব[সম্পাদনা]

নবাবের সৈন্যদলের বিরুদ্ধে বিশেষ সুবিধা করতে না পেরে ভাস্কর পণ্ডিত নবাবের নিকট একটি শান্তি প্রস্তাব প্রেরণ করেন। তিনি নবাবের কাছে ১০ লক্ষ টাকা দাবি করেন এবং তার দাবি মেনে নেয়া হলে তিনি তার সৈন্যবাহিনীসহ স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করবেন বলে অঙ্গীকার করেন[১]। কিন্তু নবাব আলীবর্দী আশঙ্কা করছিলেন যে, ভাস্কর পণ্ডিতের দাবি মেনে নেয়া হলে তিনি তার প্রতিশ্রুতি নাও রাখতে পারেন এবং আরো টাকা দাবি করতে পারেন। এজন্য নবাব ভাস্কর পণ্ডিতের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন[১][২]

নবাব অবরুদ্ধ[সম্পাদনা]

নবাব আলীবর্দী ভাস্কর পণ্ডিতের শান্তি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার পর উভয়পক্ষে আবার বিক্ষিপ্ত খন্ড খণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধ হওয়ার ফলে এক পর্যায়ে মারাঠাদের একটি বৃহৎ বাহিনী আলীবর্দীকে ঘিরে ফেলে[১]। আরেকদল মারাঠা সৈন্য আশপাশের অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক হারে লুটতরাজ চালাতে থাকে[৪]। স্বল্পসংখ্যক সৈন্যসহ অবরুদ্ধ নবাব খাদ্য ও রসদপত্রের অভাবে নিশ্চিত ধ্বংসের সম্মুখীন হন[১]

ভাস্কর পণ্ডিতের দ্বিতীয় শান্তি প্রস্তাব[সম্পাদনা]

অবরুদ্ধ নবাবের দুরবস্থার সুযোগে ভাস্কর পণ্ডিত আবার নবাবের নিকট একটি সন্ধির প্রস্তাব প্রেরণ করেন। তিনি নবাবের কাছে ১ কোটি টাকা দাবি করেন[১]। কিন্তু নবাব এই অপমানজনক সন্ধির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন[১]

মীর হাবিবের দলত্যাগ[সম্পাদনা]

নবাব অবরুদ্ধ থাকাকালে তার দরবারের একজন ইরানি আমির মীর হাবিব মারাঠাদের হাতে বন্দি হন এবং তাদের সঙ্গে যোগদান করেন[১][৩]। মীর হাবিব ক্রমে বাংলায় মারাঠাদের সবচেয়ে বড় সহযোগীতে পরিণত হন। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন এবং তার সহযোগিতার ফলে বাংলায় মারাঠাদের আক্রমণাভিযান সহজতর হয়ে ওঠে[৪]

নবাবের বিজয়[সম্পাদনা]

মারাঠাদের দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে নবাবের সৈন্যবাহিনীর দুর্দশা চরমে পৌঁছে[১]। নবাব যে কোনো মূল্যে মারাঠাদের অবরোধ ভেদ করার সিদ্ধান্ত নেন। তার আফগান সেনাপতি গোলাম মুস্তফা খানের নেতৃত্বে একটি ক্ষুদ্র আফগান অশ্বারোহী সৈন্যদল অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে মারাঠা সৈন্যব্যূহ ভেদ করতে সক্ষম হয়[৪]। আলীবর্দীর অশ্বারোহী ও গোলন্দাজ বাহিনী মারাঠা পশ্চাদ্ধাবনকারীদের পিছু হটতে বাধ্য করে। নবাব অবরোধ ভেদ করতে সক্ষম হওয়ায় ভাস্কর পণ্ডিত হতাশ হয়ে পড়েন এবং বাংলা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন[১]

ফলাফল[সম্পাদনা]

অতি স্বল্পসংখ্যক সৈন্য নিয়ে নবাব আলীবর্দী বর্ধমানের যুদ্ধে সাফল্য অর্জন করায় ভাস্কর পণ্ডিত বাংলা থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নিলেও মীর হাবিব তাকে ভিন্নরূপ পরামর্শ দেন। তিনি ভাস্কর পণ্ডিতকে নবাবের অনুপস্থিতিতে অরক্ষিত রাজধানী মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করার জন্য উৎসাহিত করেন[১]। ফলে ১৭৪২ সালের মে মাসে মারাঠারা মুর্শিদাবাদ আক্রমণ ও লুণ্ঠন করে[১][২]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. ড. মুহম্মদ আব্দুর রহিম, (বাংলাদেশের ইতিহাস), আলীবর্দী ও মারাঠা আক্রমণ, পৃ. ২৯৩–২৯৯
  2. "Relation of Alivardi with the Marathas" 
  3. Jadunath Sarkar"Fall Of The Mughal Empire" 
  4. Shah, Mohammad। "Maratha Raids"Banglapedia। Asiatic Society of Bangladesh। ২০০৮-০১-০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৮-০২-২১