পঞ্চানন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

পঞ্চানন বা পঞ্চানন্দ বা পাঁচু ঠাকুর বাংলার এক খ্যাতিমান লৌকিক দেবতা। লোকবিশ্বাসে ইনি মহাদেব শিবের এক অর্বাচীন রূপ; অন্যমতে, ইনি শিবের পুত্র। মূলত গ্রামরক্ষক, শিশুরক্ষক রূপে পঞ্চানন পূজিত হন; তবে সন্তানদাতা, শস্যদেবতা হিসাবেও বাঙালি হিন্দু সমাজে তার পূজার প্রচলন আছে। রক্তবর্ণ পঞ্চাননের মুণ্ড-মূর্তি ও ঘট প্রতীক পূজিত হয়।[১]

মূলত রাঢ়-বঙ্গের উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া-হুগলী-কলকাতা, বর্ধমান, নদিয়া ও বাঁকুড়াতে এঁর পূজা হয়ে থাকে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বজবজ ২ নং ব্লকের নোদাখালি থানার অন্তর্গত কামরা গ্রামে পঞ্চানন তলা নামক স্থানে বাবা পঞ্চানন ঠাকুর একটি সুবিশাল তেতুল গাছের তলায় প্রায় দীর্ঘ ১৮০ বছরেরও বেশি সময় প্রতিষ্ঠিত।

বৈশিষ্ট্য[সম্পাদনা]

মহাদেব শিবের সঙ্গে পঞ্চানন ঠাকুরের দেহাকৃতি ও বেশভূষার সাদৃশ্য আছে, তবে উভয়ের রূপকল্পনায় পার্থক্যও বিদ্যমান। পঞ্চাননের গাত্রবর্ণ লাল এবং চোখমুখের ভঙ্গি রুদ্ররূপী; বেশ বড় গোলাকার ও রক্তাভ তিনটি চোখ ক্রোধোদ্দীপ্ত। প্রশস্ত ও কালো টিকালো নাক, দাড়ি নেই, গোঁফ কান অবধি বিস্তৃত। মাথায় পিঙ্গলবর্ণের জটা চূড়া করে বাঁধা এবং তার মধ্যে জটা কিছু বুকে পিঠে ছড়ানো। কানে ধুতুরা ফুল।

উর্ধাঙ্গ অনাবৃত; নিম্নাঙ্গ বাঘছাল পরিহিত, আবার স্থানবিশেষে কাপড় পরানো থাকে। তবে গলায় ও হাতে বেশ বড় পঞ্চমুখী রুদ্রাক্ষমালা থাকে। হাতে ত্রিশূল ও ডমরু; পায়ে খড়ম এবং মাথায় বা দেহের উপর সাপ বিদ্যমান। পাশে থাকে পঞ্চরংয়ের বা পাঁচমুখো গাঁজার কলকে।

এঁর অনুচর হলেন লৌকিক দেবতা জরাসুর ও ধনুষ্টংকার নামক দুজন অপদেবতা। এঁর সঙ্গে থাকে মামদো ভূত, ঘোড়া, বাঘ প্রভৃতি।

গ্রামদেবতা রূপে মন্দিরমধ্যে কিংবা গাছতলায় শনি ও মঙ্গলবারে ইনি পূজিত হন; কোথাও মাটির মূর্তিতে, কোথাও শিলা বা ঘটের প্রতীকে। শিশুদের ধনুষ্টংকার এবং গর্ভস্থ শিশু রক্ষা করা বা নষ্ট ভ্রূণ থেকে প্রসূতিকে রক্ষা করা পঞ্চাননের কাজ। তার উদ্দেশ্যে ছাগবলির প্রচলন আছে।[২]

উল্লেখ্য, রাঢ়-বাংলার মুখ্য লোকদেবতা ধর্মঠাকুর ক্রমে ভাগীরথী প্রবাহের নিম্নধারার জনসংস্কৃতিতে পঞ্চানন রূপের ভিতর দিয়ে পরিপূর্ণ শিবমূর্তিতে রূপান্তরিত হয়েছেন। [৩]

কাব্যে উল্লেখ[সম্পাদনা]

মধ্যযুগীয় বেশকিছু মঙ্গলকাব্য-এর পুঁথিতে পঞ্চানন ঠাকুরের উল্লেখ দৃষ্ট হয়। দ্বিজ দুর্গারাম রচিত পঞ্চাননমঙ্গল সংগীতাংশে আছে, "পঞ্চমুখে গান কর ত্রিলোচন।"

রূপরামের ধর্মমঙ্গলে আছে,

"কামারহাটে পঞ্চানন্দ বন্দে জোড় হাতে।
ছেলেদের জন্য কত মেয়ে ওষুধ যায় খেতে।"

'তারকেশ্বর শিবতত্ত্ব' নামক মধ্যযুগীয় কাব্যাংশে আছে,

"পঞ্চানন দেব প্রায় অশ্বত্থ তলায়।
মধ্যমাঠে সরোবর তীর দেখা যায়।।"

[২]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. বাংলার লোকসংস্কৃতির বিশ্বকোষ, দুলাল চৌধুরী, আকাদেমি অব ফোকলোর, কলকাতা: ৭০০০৯৪, প্রথম প্রকাশ:২০০৪, পৃষ্ঠা: ৪৮৬
  2. বাংলার লৌকিক ধর্মসংগীত, তৃপ্তি ব্রহ্ম, পৃষ্ঠা: ২৪৭-২৪৮
  3. ঘোষ, বিনয়, "পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি", তৃতীয় খন্ড, প্রথম সংস্করণ, প্রকাশ ভবন, পৃষ্ঠা: ২৫১-২৫৪