দীঘাপতিয়া রাজবংশ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

দীঘাপতিয়া রাজার মনোগ্রাম
রাষ্ট্রউত্তরবঙ্গ
প্রতিষ্ঠাকাল১৮ শতক
প্রতিষ্ঠাতারাজা দয়ারাম রায়
বর্তমান প্রধান১৯৫০ সালে রহিতকরণ

দীঘাপতিয়া রাজবংশ বর্তমান বাংলাদেশের নাটোর জেলার অন্তর্গত একটি প্রাচীন জমিদার বংশ। নাটোর রাজবংশের পতনকালে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এই দীঘাপতিয়া রাজবংশের অভ্যুদয় হয়। প্রতিষ্ঠাতা দয়ারাম রায়। দয়ারাম রায় প্রথমত নাটোরের মহারাজা রামজীবন রায়ের অধীনে একজন সামান্য কর্মচারী নিযুক্ত হয়েছিলেন।[১]

দয়ারাম রায়[সম্পাদনা]

দীঘাপতিয়া রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন যিনি তার নাম শ্রী দয়ারাম রায়। তিনি জাতিতে তিলি হলেও নাটোরের মহারাজা রামজীবন রায়ের অধীনে কর্মচারী হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন। সামান্য কর্মচারী হলেও নিজ যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা ও আন্তরিক সেবাপ্রবণতার গুণে দেওয়ান হিসেবে পদোন্নতি লাভ করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনি মহারাজা রামজীবনের আমল থেকে থেকে রাণী ভবানীর আমল অবধি নাটোর রাজসরকারের দেওয়ান পদে কার্য নিযুক্ত থেকে প্রভূত অর্থার্জনে সমর্থ হন। নাটোর রাজভবনে তার বিশেষ সম্মান ও প্রতিপত্তি ছিল। মুর্শিদাবাদের নবাব সরকারেও তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। যশোর জেলার অন্তর্গত মহম্মদপুরের স্বাধীন রাজা সীতারাম রায়কে বন্দি করার সময় মুর্শিদাবাদের নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁকে বিশেষ সাহায্য করে কৃতজ্ঞতাভাজন হন এবং সে সাহায্যের পুরস্কার স্বরূপ নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁ তাকে “রায় রাইয়ান” উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এক পর্যায়ে নাটোরের মহারাজ রামকৃষ্ণ রায় রাজস্ব দায়ে স্বীয় জমিদারি বিক্রয় করতে বাধ্য হন। এ সময় দয়ারাম সাহ-উজিয়াল ইত্যাদি পরগণা নিলামে খরিদ করে নেন এবং জমিদারীর প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সংস্কৃত ভাষার অনুরাগী ও উৎসাহদাতা ছিলেন। রাজশাহীতে তিনি একটি চতুষ্পাঠী প্রতিষ্ঠা করে সকলের প্রশংসা অর্জন করেন। এছাড়াও রাজবাড়িতে তিনি একটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। দীঘাপতিয়া রাজবাড়িতে কৃষ্ণজীউ, গোবিন্দজীউগোপালজীউ নামে বিগ্রহ স্থাপন করে তাদের সেবার জন্য প্রয়োজনীয় জমি ও অর্থ দান করেছিলেন। প্রজাপ্রিয় এই শাসক স্বীয় জমিদারির মধ্যে অনেকগুলি সরোবর খনন করে সাধারণ মানুষের পানির সুবন্দোবস্ত করেছিলেন। রাজা দয়ারাম রাম বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ, ন্যায়পরায়ণ ও ধর্মপরায়ণ লোক হিসেবে সকলের নিকট ধন্য ছিলেন।

জগন্নাথ রায়[সম্পাদনা]

দয়ারাম রায়ের পর তার পুত্র জগন্নাথ রায় উত্তরাধিকারসূত্রে জমিদারী লাভ করেন। কিন্তু তিনি দীর্ঘজীবী হননি। অল্প কয়েক বৎসর জমিদারী পরিচালনার পর তার অকাল মৃত্যু হয়। তারপর তার একমাত্র পুত্র প্রাণনাথ রায় জমিদারীর পরবর্তী উত্তরাধিকারী হন।

প্রাণনাথ রায়[সম্পাদনা]

জগন্নাথ রায়ের অকাল মৃত্যুর পর তার একমাত্র পুত্র প্রাণনাথ রায় বিষয়সম্পত্তি প্রাপ্ত হন। তিনি পারিষদবর্গে পরিবৃত হয়ে এবং সকলের পরামর্শ নিয়ে জমিদারী পরিচালনা করতেন। তার অদ্ভুত স্বার্থত্যাগ ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞাশীলতা সকলকে অভিভূত করেছিল। প্রজাদের কল্যাণার্থে তিনি গভীর মনোনিবেশ সহকারে এবং দক্ষতার সহিত জমিদারি সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয় পরিদর্শন করতেন। বিয়ে করলেও তার কোনও সন্তান হয়নি। এ কারণে তিনি পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেন যার নাম প্রসন্ননাথ রায়। মৃত্যুর আগে তিনি সকল বিষয়সম্পত্তি প্রসন্ননাথ রায়কে সম্প্রদান করে যান।

প্রসন্ননাথ রায়[সম্পাদনা]

পালক পিতা প্রাণনাথ রায়ের মৃত্যুর পর জমিদারীর উত্তরাধিকারী হন দত্তক পুত্র প্রসন্ননাথ রায়। তিনি প্রতিভাশালী মানুষ ছিলেন। তার বদান্যতাও ছিল সুবিদিত। জনকল্যাণে তিনি প্রচুর অর্থ ব্যয় করেছিলেন। দীঘাপতিয়া থেকে বোয়ালিয়া পর্যন্ত একটি রাস্তা নির্মাণকল্পে তিনি ব্রিটিশ সরকারকে ৩৫০০০ টাকা দান করেন। পরবর্তীকালে এ সড়কের মেরামত ও সংস্কারের জন্যও তিনি বহু অর্থ দান করেছিলেন। তিনি দীঘাপতিয়ায় একটি ইংরেজি বিদ্যালয় এবং নাটোরবোয়ালিয়াতে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। এ দুইয়ের পরিচালনার জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারকে এক লক্ষ টাকা দান করেছিলেন। তিনি নিজ কার্যাবলি ও ব্যবহারের জন্য ব্রিটিশ সরকারের নিকট বিশেষ মর্যাদা লাভ করেন। ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ২০ এপ্রিল তারিখে ব্রিটিশ সরকারর জমিদার প্রসন্ননাথ রায়কে “রাজাবাহাদুর” উপাধিতে ভূষিত করে। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি রাজশাহী জেলায় এসিস্টেন্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্তি লাভ করেন। প্রসন্ননাথ রায় দীঘাপতিয়ার রাজবাড়ি সুসজ্জিত করেছিলেন। এছাড়া একটি নাচঘর ও “সিংহী-হল” নির্মাণ করেন। হোলিঝুলনের সময় এখানে নানা উৎসব-আনন্দের ব্যবস্থা করা হতো। স্বদেশানুরাগী, পরমদাতা ও পরোপকারী জমিদাররাজা প্রসন্ননাথ রায় বাহাদুর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন। বিয়ে করলেও তিনি ছিলেন অপুত্রক। তাই জীবদ্দশায় পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেন, যার নাম প্রমথনাথ রায়।

প্রথমনাথ রায়[সম্পাদনা]

প্রসন্ননাথ রায়ের পর উত্তরাধিকার হিসেবে প্রথমনাথ রায় জমিদার হন। তিনি ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক “রায়বাহাদুর” খেতাবপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। রায়বাহাদুর প্রথমনাথ রায় ছিলেন পিতার পোষ্যপুত্র। দীঘাপতিয়া রাজভবনেই ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দে তার জন্ম হয়। প্রসন্ননাথ রায় তাকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করেছিলেন।

পিতার মৃত্যুকালে প্রথমনাথ রায় ছিলেন অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাই জমিদারীর দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে কলকাতার ওয়ার্ডস ইনস্টিটিউশনে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ঐ বিদ্যালয় হইতে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছিলেন। তিনি ডাক্তার রাজা রাজেন্দ্রলাল মিত্র মহোদয়ের অভিভাবকত্বে বড় হন। কুমার প্রথমনাথ রায় বাহাদুর বয়ঃপ্রাপ্ত হলে ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে কলকাতা থেকে দীঘাপতিয়ায় প্রত্যাগমন করেন এবং জমিদারী পরিচালনার দায়িত্বভার কাঁধে তুলে নেন।

তিনি দাতা, বিদ্যোৎসাহী ও জনহিতকর হিসেবে সুবিদিত হন। পিতা রাজা প্রসন্ননাথ রায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ‘রামপুর-বোয়ালিয়ার প্রসন্ননাথ দাতব্য ঔষধালয়ের’ ভবন নির্মাণকল্পে তিনি ১০ হাজার টাকা দান করেছিলেন। তিনি নাখিলার কাছারিতে একটি দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল মাসে রাজশাহী বালিকা বিদ্যালয়ে বাৎসরিক ২০০ টাকার সাহায্যমঞ্জুরী প্রদানের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন। বোয়ালিয়ার বালিকা বিদ্যালয়ে কৃতী ছাত্রীদের শিক্ষায় উৎসাহ প্রদানকল্পে তিনি তিনটি বৃত্তি প্রবর্তন করেছিলেন।

১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী বিভাগের কমিশনার তার বিশেষ প্রশংসা করে ব্রিটিশ সরকারের নিকট একটি শংসামূলক প্রতিবেদন প্রেরণ করেন। এরই সূত্রে ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে দিল্লির দরবারে প্রমথনাথ রায়কে “রাজাবাহাদুর” উপাধিতে ভূষিত করা হয়। একই বৎসর রাজা বাহাদুর প্রমথনাথ রায় বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নিযুক্ত হন।

যশোর-মহম্মদপুরের রাজা সীতারাম রায়ের পতন হওয়ার পর তদীয় দুর্গের মন্দিরে রক্ষিত শ্রীকৃষ্ণ বিগ্রহটি ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে রাজাবাহাদুর প্রমথনাথ কর্তৃক দীঘাপতিয়ার রাজভবনে আনীত ও প্রতিষ্ঠা হয়।

প্রমদানাথ রায়[সম্পাদনা]

দীঘাপতিয়ার রাজপ্রাসাদে ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে প্রমদানাথ রায়ের জন্ম। তিনি রাজা প্রমথনাথ রায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র। শৈশবেই তার পিতা রাজা প্রমথনাথ রায়ের মৃত্যুর হওয়ার কারণে ১৮৯৪ পর্যন্ত দীঘাপতিয়া জমিদারি কোর্ট অফ ওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে ছিল। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি সাবালকত্ব অর্জনের পর তিনি জমিদারীর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাকে “রাজা” উপাধিতে ভূষিত করেন। সরকারী সিদ্ধান্তে রাজা প্রসন্ননাথ দাতব্য ঔষধালয় স্থানান্তরের প্রয়োজন হলে রাজা প্রমদানাথ রায় নতুন ভবন নির্মাণের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেন। উপরন্তু তিনি হাসপাতাল নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় ভূমি দান করেন। পরহিতকর এই জমিদার হাসপাতালে স্বীয় পিতামহী রাণী ভবানীর নামে একটি মহিলা ওয়ার্ড নির্মাণ করে দেন। তিনি জমিদারির অন্তর্গত বনাগাঁতিতে একটি দাতব্য ঔষধালয় স্থাপন করেছিলেন।

রাজা প্রমদানাথ রায় একজন বিদ্যোৎসাহী নৃপতি ছিলেন। তিনি রাজশাহী কলেজে একটি ছাত্রাবাস নির্মাণ করে দেন। এছাড়াও তিনি ছাত্রদের জন্য অনেকগুলো বৃত্তি প্রবর্তন করেন। দীঘাপতিয়ার বিদ্যালয়েও উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি বৃত্তি প্রবর্তন করেন। রাজশাহীর রেশমের কার্য শিক্ষার বিদ্যালয়ে তিনি তখনকার সময়ের পাঁচ হাজার টাকা মূল্যমানের ভূমিদান করেন। উপরনতু রামপুর বোয়ালিয়ার আদর্শ কৃষিকার্য ব্যবস্থা প্রবর্তনের নিমিত্ত ভূমি দান করেন।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সংঘটিত ভূমিকম্পে দীঘাপতিয়ার রাজভবনের বিশেষ ক্ষতি হয়েছিল। এসময় রাজাবাহাদুর রাজা প্রমদানাথ রায় বহু অর্থ ব্যয়ে রাজপ্রসাদ নির্মাণ করেন। কলকাতা এবং নাটোরে তিনি রাজভবন নির্মাণ করেন। রাজাবাহাদুর প্রমদানাথ রাজশাহী অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি, বঙ্গীয় জমিদার সভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও অবৈতনিক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পূর্ববঙ্গের ভূতপূর্ব ছোটলাট স্যার ল্যান্সলেট হেয়ার-এর স্মৃতি রক্ষাকল্পে ২৫০ টাকা দান করেন। ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় রাজ প্রতিনিধি লর্ড মিণ্টো-র প্রস্তর মূর্তি স্থাপনার্থে তিনি ৫০০ টাকা দান করেন।

ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে তিনি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তিনি ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে “পূর্ববঙ্গ ও আসাম” প্রদেশের জমিদার সম্প্রদায় কর্তৃক ছোটলাটের ব্যবস্থাপক সভার সভ্য নির্বাচিত হন। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা শহরের নবীন ভারতেশ্বর মহামান্য পঞ্চম জর্জ ও রাণীর সংবর্ধনার আয়োজনের জন্য ২৫০০ টাকা দান করেন। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে ৪ জানুয়ারি কলিকাতার লাটভবনে ভারত সম্রাট ও তৎমহিষীর একটি সভায় মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর দীঘাপতিয়ারাজকে সম্রাটের নিকট পরিচিত করিয়ে দেন।

১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে বারাণসীধামের হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৫০০ টাকা দান করেন রাজা বাহাদুর প্রমদানাথ রায়। তিনি স্বর্গীয় পিতা প্রতিশ্রুতি অনুসারে ছয় হাজার টাকা ব্যয় করে প্রমথনাথ বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য একটি মনোরম ভবন নির্মাণ করে দেন। অধিকতর ঐ বিদ্যালয়ের গাড়ি ঘোড়া ক্রয়ার্থে এক হাজার টাকা দান করেন। রাজশাহী কলেজে “দ্রবময়ী হিন্দু বোর্ডিং” নামে একটি ছাত্রাবাস নির্মাণকল্পে প্রমদানাথ রায় ১২০০০ টাকা দান করেন।

আরো দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. কলিকাতা সেকালের ও একালের