তারানাথ তর্কবাচস্পতি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
তারানাথ তর্কবাচস্পতি
তারানাথ তর্কবাচস্পতি
তারানাথ তর্কবাচস্পতি
জন্মতারানাথ ভট্টাচার্য
(১৮১২-১১-০৪)৪ নভেম্বর ১৮১২[১]
কালনা, বর্ধমান, বাংলা প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বর্ধমান)
মৃত্যু২০ জুন ১৮৮৫(1885-06-20) (বয়স ৭২)
কলকাতা, বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি, ব্রিটিশ ভারত (অধুনা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে)
পেশাসংস্কৃত পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী, সংস্কারক।
ভাষাসংস্কৃত
জাতীয়তাব্রিটিশ ভারতীয়
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসংস্কৃত কলেজ (১৮৩০-১৮৩৫)
সময়কালনবজাগরণ
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি"বাচস্পত্য"
দাম্পত্যসঙ্গী(?)
অম্বিকা দেবী (মৃ.১৮৫০)
প্রসন্নময়ী
সন্তানজীবানন্দ (ভট্টাচার্য) বিদ্যাসাগর
আত্মীয়কালিদাস সার্বভৌম (পিতা)
মাহেশ্বরী দেবী (মাতা)

পণ্ডিত তারানাথ তর্কবাচস্পতি (৪ নভেম্বর ১৮১২ – ২০ জুন ১৮৮৫) ঊনবিংশ শতকের একজন বিশিষ্ট বাঙালি শিক্ষাবিদ, সংস্কৃত পণ্ডিত, সফল ব্যবসায়ী ও সমাজ সংস্কারক।[২] সংস্কৃত কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ সংস্কৃতজ্ঞ ইবি কাউয়েল সাহেব তারানাথের প্রগাধ পাণ্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ‘সংস্কৃত সাহিত্যের জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া’ আখ্যা দেন। সংস্কৃত ভাষাসাহিত্যে অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য সংস্কৃত কলেজ থেকে ১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি তর্কবাচস্পতি উপাধি লাভ করেন। তার রচিত সংস্কৃত ভাষার অভিধান 'বাচস্পত্য' পৃথিবীর সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষা চর্চায় অপরিহার্য পুস্তক।[১]

জন্ম ও শিক্ষা জীবন[সম্পাদনা]

তারানাথ তর্কবাচস্পতি ১৮১২ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা নভেম্বর বৃটিশ ভারতের অধুনা পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কালনায় "বাঙাল ভট্টাচার্য" পরিবারের জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতামহ রামরাম তর্কসিদ্ধান্তের আদি নিবাস ছিল পূর্ববাংলার বরিশাল জেলার বৈচণ্ডী নামক এক গ্রামে। তর্কসিদ্ধান্তের পূর্বপুরুষদের সংস্কৃত শিক্ষাদানে বিশেষ খ্যাতি ছিল। ওই সময়ে বর্ধমানের মহারাজা তিলকচন্দ্র বাহাদুর দেশের নানা স্থান হতে পণ্ডিতব্যক্তিদের এনে কালনায় তার সমাজবাড়িতে সভার আয়োজন করতেন। ঘটনাচক্রে রামরাম তর্কসিদ্ধান্ত তার সভায় এলে, মহারাজা তাঁকে কালনার শ্যামরাইপাড়ায় ভূসম্পত্তি প্রদান করেন এবং সেখানে বসবাস করতে থাকেন। স্থানীয় মানুষদের কাছে 'বাঙাল ভট্টাচার্য' হিসাবেই পরিচিত হন। তারানাথের পিতা রামরাম তর্কসিদ্ধান্তের কনিষ্ঠ পুত্র কালিদাসের নানা শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তির কারণে 'সার্বভৌম' উপাধি লাভ করেছিলেন। শৈশবে মাতা মাহেশ্বরী দেবী প্রয়াত হলে তিনি বর্ধমানের 'ঘোষপাঁচকা' নামক গ্রামে মাতুলালয়ে প্রতিপালিত হন। পাঁচ বৎসর বয়সে তার শিক্ষারম্ভ হয় কালনার এক পাঠশালায়। অতিশয় মেধাবী ছিলেন তিনি। তার শাস্ত্র বিষয়ক তর্ক-বিতর্ক লক্ষ্য করেন 'বাঙাল ভট্টাচার্য' পরিবারের বন্ধু সংস্কৃত কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ও বাঙাল ব্যাঙ্কের দেওয়ান রামকমল সেন। তিনিই তারানাথকে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের ১০ই মে প্রথমে ভর্তি করান অলঙ্কার শ্রেণীতে। কলকাতার ঠনঠনিয়ায় থেকে পড়াশোনা করতে থাকেন। ধীরে ধীরে তিনি ব্যাকরণ, অলঙ্কার, ন্যায়, জ্যোতিষ, স্মৃতি, বেদান্ত, পাতঞ্জল, উপনিষদ বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য এই যে, সংস্কৃত কলেজে তারানাথ যখন ন্যায় শ্রেণির ছাত্র, তখন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ছিলেন এই কলেজেরই অলঙ্কার শ্রেণির ছাত্র৷ তারানাথ ঈশ্বরচন্দ্রকে ভালবাসতেন এবং ঈশ্বরচন্দ্রও তারানাথকে শ্রদ্ধা করতেন। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই জানুয়ারি কলেজ পরিত্যাগকালে কলেজের এডুকেশন কাউন্সিল তাঁকে তর্কবাচস্পতি উপাধি প্রদান করে। ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ল' কমিটির ও মুনসেফী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং প্রশংসাপত্র প্রাপ্ত হন। পরে তিনি কাশী চলে যান। সেখানে চার বৎসর বেদান্ত ও পাণিনি অধ্যয়ন করেন।

কর্মজীবন[সম্পাদনা]

কাশী থেকে ফিরে চাকুরি না নিয়ে স্বগ্রামে টোল খোলেন এবং বিভিন্ন ব্যবসায় ব্রতী হন। অধ্যাপনার পাশাপাশি ব্যবসার কারণ তার বিশ্বাস ছিল, কালনা-সহ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকা তার বিপুল ছাত্রসমাজের ভরণপোষণের দায় আসলে আচার্যেরই। আর সেই কারণেই কাপড়, শাল কাঠ ও ধান-চালের , সূতা, দুগ্ধজাত দ্রব্য ইত্যাদির বিরাট ব্যবসা শুরু করেন। সফলতাও পান তিনি।[৩] পরে সরকারি চাকরি গ্রহণের পর পুত্র জীবানন্দ বিদ্যাসাগরের নামে ব্যবসা চালাতে থাকেন।[২] পরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনুরোধে তিনি সফল ব্যবসাপত্তর ছেড়ে দিয়ে ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে মাত্র নব্বই টাকা মাসিক বেতনে সংস্কৃত কলেজে ব্যাকরণের অধ্যাপকের পদ গ্রহণ করেন এবং ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে অবসর গ্রহণ করেন। ১৮৪৬ খ্রিস্টাব্দে কিছুদিনের জন্য কলেজের সহকারী সম্পাদক হয়েছিলেন।

শিক্ষা বিস্তারে ও সমাজ সংস্কারে ভূমিকা[সম্পাদনা]

সংস্কৃত কলেজ থেকে অবসরের পর তিনি শিক্ষা বিস্তারে , গ্রন্থ প্রকাশনা ও সম্পাদনের কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন৷ কলকাতায় বাড়ির ব্যবস্থা করে অবৈতনিক সংস্কৃত কলেজ তৈরি করে ছাত্রদের বিনা অর্থে আহার দিয়ে সংস্কৃত শিক্ষা দিতেন। ভারতের নানান জায়গা থেকে পড়ুয়ারা আসতেন তার কাছে সংস্কৃত শিখতে। ছাত্রদরদিও ছিলেন তিনি। সেসময় ‘কিরাতার্জ্জুনীয়’ ও ‘শিশুপালবধ’ কাব্য দু’টি দুর্লভ ছিল। তিনি এই কাব্যগ্রন্থ দুটি কাশীর মল্লিনাথের ঠীকাসহ ছাত্রদের জন্য ছাপানোর ব্যবস্থা করেন; কোন লভ্যাংশ গ্রহণ করলেন না। সমাজ সংস্কারক হিসাবেও তার ভূমিকা ছিল অসাধারণ৷ বিধবা বিবাহ আন্দোলনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরম সহায়ক ছিলেন তিনি। কিন্তু বহুবিবাহ-নিরোধ আন্দোলনের বিরোধিতা করেন। বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ , বিধবা বিবাহ প্রচলন এবং স্ত্রী শিক্ষা প্রসারে তার ভূমিকা ছিল অন্যতম৷ বিদ্যাসাগর -পুত্র নারায়ণচন্দ্রের বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক উপস্থিত ছিলেন তিনি৷ ওই বিবাহে বিদ্যাসাগরের আত্মীয়রা নববধূকে বরণ করতে রাজি না হওয়ায় তারানাথ সহধর্মিনীকে দিয়ে নববধূকে বরণ করিয়েছিলেন৷ তিনি স্ত্রীশিক্ষায় উৎসাহী ছিলেন এবং হিন্দুমেলার উদ্যোগী সংগঠক ছিলেন। স্ত্রীশিক্ষায় উৎসাহ দিতে কলকাতায় বেথুন সাহেবের স্কুল প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি প্রথমে তার কন্যা জ্ঞানদাকে ভর্তি করিয়েছিলেন। দেশে প্রচলিত প্রতিমা পূজায় তার আস্থা ছিল না এবং বিদেশযাত্রা তথা সমুদ্রযাত্রাকে তিনি অশাস্ত্রীয় বলে মনে করতেন না। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে ডিউক অব এডিনবরার ভারত আগমনে বাঙালিদের পক্ষে অভ্যর্থনা উপলক্ষে তিনি রাজপ্রশস্তি রচনা করেছিলেন।

রচনাসম্ভার[সম্পাদনা]

তারানাথ তর্কবাচস্পতির রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলির মধ্যে সিদ্ধান্ত কৌমুদীর উপর 'সরলা' -নাম্নী টীকা সারা দেশে ও পাশ্চাত্যেও সমাদৃত। এছাড়া তিনি বারো বৎসরের (১৮৭৩ -৮৪) চেষ্টায় সংস্কৃত অভিধান বাচস্পত্য রচনা করেন এবং এটি তার জীবনের প্রধান কীর্তি।

  • সিদ্ধান্তকৌমুদীর সরলা টীকা
  • আশুবোধ ব্যাকরণ
  • বাচস্পত্য (সংস্কৃত অভিধান)
  • শব্দস্তোমমহানিধি (অভিধান, ১৮৬৯-৭০)
  • শব্দার্থরত্ন (১৮৫২)
  • বহুবিবাহবাদ
  • বিধবা বিবাহ খণ্ডন
  • কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস প্রণীত গয়ামাহাত্ম্যম্

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "তারানাথ তর্কবাচস্পতির জন্মদিবস পালন কালনায়"। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৬-২০ 
  2. সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ২৬৯,২৭০ আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
  3. ""ব্যাকরণ আর ব্যবসা""। সংগ্রহের তারিখ ২০২১-০৬-২০