কোস্টা রিকার ইতিহাস

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ক্রিস্টোফার কলম্বাস এর আগমনের পূর্বে আদিবাসী দিকি জনগোষ্ঠীর বসতির একটি নমুনাচিত্র

কোস্টা রিকা'র প্রথম আদিবাসী জনগোষ্ঠী ছিল শিকারী ও সংগ্রহকারী। যখন স্প্যানিশ ঔপনিবেশিকরা সেখানে গিয়ে পৌঁছায়, ভৌগোলিকভাবে মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত হওয়ার কারণে তখনই সেখানে দু'টি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক অঞ্চল বিদ্যমান ছিল: মেসো-আমেরিকান এবং আন্দিজ (ইন্‌কা সাম্রাজ্যের) সংস্কৃতি, যেখানে উভয়েরই প্রভাব বিদ্যমান ছিল।[১]

১৫০২ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রথম কোস্টা রিকা’র উভিটা দ্বীপে নোঙর ফেলেন। খুব শীঘ্রই তার বাহিনী আদিবাসীদের পরাজিত করে। তিনি ১৫২৪ সালে নব্য স্পেন এর প্রদেশ হিসেবে ক্যাপ্টেন্সি জেনারেল অফ গুয়াতেমালা অঞ্চলের মধ্যে একে অন্তর্ভুক্ত করেন। পরবর্তী ৩০০ বছর কোস্টা রিকা ছিল স্পেনের একটি উপনিবেশ। ফলস্বরূপ, কোস্টা রিকা’র সংস্কৃতি গভীরভাবে স্পেনের সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত।[২] এই সময়কালে কোস্টা রিকা ছিল দারিদ্র্যপীড়িত এবং সামান্যই উন্নয়নশীল।

মেক্সিকোর স্বাধীনতা যুদ্ধের (১৮১০–১৮২১) পর, ১৮২১ সালে কোস্টা রিকা স্বাধীন মেক্সিকান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৮২১ সালে সম্পূর্ণ স্বাধীন হবার আগে, ১৮১৩ সাল পর্যন্ত কোস্টা রিকা মধ্য আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র (Federal Republic of Central America)– এর অন্তর্গত ছিল। ইউরোপীয় বণিকদের সাথে সংযোগের অভাবে তাদের অর্থনীতি বেশ ধুঁকছিল। ১৮৫৬ সালে কোস্টা রিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে আগত এক অধিবাসী কর্তৃক তাদের সরকার দখলের প্রচেষ্টাকে প্রতিহত করে।

১৮৬৯ সালের পর কোস্টা রিকা একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে।[২]

১৯৪৮ সালে কোস্টা রিকার গৃহযুদ্ধের পর, সরকার একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন করে, যেখানে সর্বজনীন ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান এবং সামরিক বাহিনী বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়। আজ কোস্টা রিকা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র যা প্রযুক্তি ও বাস্তু-পর্যটন (eco-tourism) এর ওপর নির্ভরশীল। যদিও একবিংশ শতাব্দির গোড়া থেকে সেখানে দারিদ্র্য নিম্নমুখী, তারপরও অর্থনৈতিক সংকট এখনো বিদ্যমান। কোস্টা রিকা এখনো অনুপযুক্ত কর্মসংস্থান (underemployment), বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ ঋণ, এবং বাণিজ্য ঘাটতির মত সমস্যার সম্মুখীন।[২]

শিকারী-সংগ্রহকারী[সম্পাদনা]

কোস্টা রিকায় মানব বসতির প্রাচীনতম নিদর্শন, খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১০,০০০ থেকে ৭,০০০ অব্দের মধ্যে, একটি শিকারী–সংগ্রহকারী গোষ্ঠীর আগমনের সাথে সম্পৃক্ত। তুরিয়ালবা উপত্যকার গার্দিরিয়া ও ফ্লোরেন্স নামক স্থানের প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন (প্রস্তর-নির্মিত যন্ত্রপাতি), এর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ খনি এবং কর্মশালা; এবং সেখানে প্রাপ্ত ক্লোভিস বর্শার ফলা ও দক্ষিণ আমেরিকান ধাঁচের তীরের উপস্থিতি থেকে সেটা প্রমাণিত হয়। এসব কিছু এটাই ইঙ্গিত করে যে, সেই সময় এই এলাকাটিতে দু’টি সংস্কৃতির সহাবস্থান ছিল।

এ যুগের মানুষ ছিল যাযাবর প্রকৃতির। তারা ২০ থেকে ৩০ জনের পরিবার-ভিত্তিক কতগুলো দলে বিন্যস্ত থাকতো। তাদের শিকার করা গতানুগতিক প্রাণিগুলোকে বলা হত বৃহৎ প্রাণিকুল (megafauna), যেমন– দৈত্যাকার আর্মাডিলো, স্লথ, মাস্টোডন (অধুনাবিলুপ্ত বৃহদাকার হাতিবিশেষ)। আধুনিক যুগ শুরুর প্রায় ৮,০০০ বছর আগেই এরা বিলুপ্ত হয়ে যায়। নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য প্রথম বসতি স্থাপনকারীদেরকে ক্ষুদ্রতর আকারে প্রাণি শিকার এবং যথার্থ কৌশল রপ্ত করে নিতে হয়।

প্রাক-কলম্বাস যুগের কোস্টা রিকা[সম্পাদনা]

প্রাক–কলম্বাস যুগে দিকিদের (Diquis) তৈরি প্রস্তর গোলক
সিরামিকের তৈরি ধূপ দহনকারী চুল্লি
প্রাক–কলম্বাস যুগে নিকয়াদের তৈরি সিরামিকের তৈজসপত্র
দিকিদের তৈরি মানব প্রতিমূর্তি বিশিষ্ট দুল (pendant)

প্রাক–কলম্বাস যুগে, বর্তমানে কোস্টা রিকা নামে পরিচিত এলাকার আদিবাসীরা, ভৌগোলিকভাবে মধ্যবর্তী অবস্থানে থাকার কারণে, মেসো–আমেরিকান এবং আন্দিজীয় – এই দুটি সাংস্কৃতিক অঞ্চলে বিভক্ত ছিল।[১]

ষোড়শ শতাব্দিতে যখন স্প্যানিশ বিজেতারা আক্রমণ করে, তখন দেশটির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত নিকয়া উপদ্বীপ ছিল মেসো–আমেরিকান সংস্কৃতির প্রভাবের সর্বদক্ষিণ প্রান্ত। নিকয়া সংস্কৃতি ছিল কোস্টা রিকা’র প্রশান্ত উপকূলীয় অঞ্চলের বৃহত্তম গোষ্ঠী (cacicazgo)। দেশের মধ্য ও দক্ষিণ অংশ ছিল ইস্‌মো–কলম্বিয়ান সাংস্কৃতিক অঞ্চলের (Isthmo-Colombian) অন্তর্গত, যেখানে মুইস্কাদের (Muisca) প্রভাব ছিল গভীর, কেননা এইসব অঞ্চলের অধিবাসীদের ভাষা ছিল প্রধানত চিব্‌চান ভাষাবংশের (Chibchan languages) অন্তর্ভুক্ত।[১][৩] দিকি সংস্কৃতি ৭০০ থেকে ১৫৩০ অব্দের মধ্যবর্তী সময়ে বিকাশ লাভ করে এবং তারা তাদের ধাতব ও প্রস্তরকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল।[৪]

আধুনিক কোস্টা রিকান সংস্কৃতিকে আদিবাসী গোষ্ঠীসমূহের প্রভাব তুলনামূলকভাবে অতি নগণ্য। ইউরোপীয়দের আগমনের অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই, আদিবাসীদের অনেকে হাম ও গুটি বসন্তের মত সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়; ইউরোপীয়দের কাছে এসব রোগ অঞ্চলগত হলেও আদিবাসীদের দেহে এগুলোর বিরুদ্ধে কোন রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা ছিল না।[৫]

স্প্যানিশ উপনিবেশ স্থাপন[সম্পাদনা]

ওরোসি উপত্যকা, কার্তাগো প্রদেশ – এ উহারাদের ঐতিহাসিক ভূমি। গির্জাটি ১৬৮৬ থেকে ১৬৯৩ অব্দের মধ্যে নির্মিত।
তালামাঙ্কায় আদিবাসী আমেরিকানদের হিংস্র আক্রমণ, ১৭০৯ অব্দ।

১৮ সেপ্টেম্বর ১৫০২ সালে, ক্রিস্টোফার কলম্বাস তার চতুর্থ সমুদ্র-অভিযাত্রায় কোস্টা রিকা’র পূর্ব উপকূলে গিয়ে গিয়ে পৌঁছালে, সেখানে ঔপনিবেশিক যুগের সূচনা ঘটে। পরবর্তীকালে আরও কয়েকটি স্প্যানিশ অভিযানের পর, অবশেষে ১৫২৪ সালে কোস্টা রিকা, ভিয়া ব্রুসেলাস (Villa Bruselas) – এ প্রথম স্প্যানিশ উপনিবেশ স্থাপিত হয়।[৬]

ঔপনিবেশিক যুগের অধিকাংশ সময়জুড়ে কোস্টা রিকা ছিল ক্যাপ্টেন্সি জেনারেল অফ গুয়াতেমালা’র (Captaincy General of Guatemala) সর্বদক্ষিণ প্রদেশ, যেটা নামেমাত্র ভাইসরয়্যালিটি অফ নিউ স্পেন (অর্থাৎ মেক্সিকো) এর অংশ ছিল। বাস্তবে এটি মূলত স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের অধীনে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবেই পরিচালিত হতো। গুয়াতেমালার রাজধানী থেকে কোস্টা রিকা’র দূরত্ব, স্প্যানিশ আইনের অধীনে দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রতিবেশি পানামার (যা ঐ সময় ভাইসরয়্যালিটি অফ নিউ গ্রানাডা তথা কলম্বিয়ার অন্তর্ভুক্ত ছিল) সাথে বাণিজ্যের ওপর আইনি নিষেধাজ্ঞা এবং স্বর্ণ ও রৌপ্যের মত খনিজ সম্পদের অভাব, কোস্টা রিকা খুব কম সংখ্যক অধিবাসীদের আকৃষ্ট করেছিল। এটা স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের অধীনে দরিদ্র, বিচ্ছিন্ন, এবং বিক্ষিপ্তভাবে অধ্যুষিত একটি অঞ্চল ছিল।[৭] ১৭১৯ সালে একজন স্প্যানিশ গভর্নর কোস্টা রিকাকে “আমেরিকার স্প্যানিশ উপনিবেশগুলোর মধ্যে দরিদ্রতম এবং সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত” বলে অভিহিত করেন।[৮]

অনেক ইতিহাসবেত্তা বলেন যে, এই এলাকায় জোরপূর্বক শ্রমের জন্য আদিবাসী জনগণের বেশ অভাব ছিল, যার মানে অধিকাংশ কোস্টা রিকান ঔপনিবেশিকদেরকে নিজেদের জমিতে নিজেদেরকেই কাজ করতে হত। এ কারণে এখানে বড় আকারের আবাদীভূমি (haciendas) প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এসব কারণে, মোটের ওপর কোস্টা রিকা স্প্যানিশরাজ কর্তৃক অসমাদৃত ও উপেক্ষিতই ছিল, এবং স্বপ্রণোদিত উন্নয়ন ছাড়া তাদের আর কোন বিকল্প ছিল না। ক্ষুদ্র ভূস্বামীদের তুলনামূলকভাবে দরিদ্র অবস্থা, আদিবাসী শ্রমশক্তির অভাব, জনগণের জাতিগত ও ভাষাগত অভিন্নতা, এবং মেক্সিকো ও আন্দিজ অঞ্চলে স্প্যানিশ উপনিবেশের কেন্দ্র থেকে কোস্টা রিকা’র বিচ্ছিন্নতা – এই সব কিছুই এখানে একটি স্বায়ত্তশাসিত এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক কৃষিভিত্তিক সমাজ গঠনে ভূমিকা পালন করে।[৯] এমনকি এখানকার গভর্নরকেও দারিদ্র্যের কারণে নিজের শস্যের উৎপাদন ও পরিচর্যা নিজেকেই করতে হত। আদিবাসী ও দাসশ্রম ভিত্তিক ঔপনিবেশিক সমাজ গঠনে ব্যর্থতা, অষ্টাদশ শতকে এখানে কৃষিতান্ত্রিক অর্থনীতির বিকাশ ঘটায়।[১০]

অভিযানের সময়কালে এই এলাকায় বিশটি পর্যন্ত স্বতন্ত্র আদিবাসী সমাজ ছিল, যেখানে বহুসংখ্যক ভাষার কয়েক লক্ষ মানুষের নিবাস ছিল।[১০] ১৫১০ সালে সূচনার পর প্রায় অর্ধ-শতাব্দিজুড়ে স্প্যানিশদের কোস্টা রিকা অভিযান অব্যাহত ছিল।[১০] এই অভিযানের প্রথম ধাপ ছিল উত্তর প্রশান্ত উপকূলের নিকয়া সমাজব্যবস্থাগুলোর আদিবাসীদের গণহত্যা এবং দাসত্ব। দ্বিতীয় ধাপে ছিল দেশটির ক্যারিবীয় প্রান্তে স্প্যানিশ উপনিবেশ সংহত করার ফলশূন্য প্রচেষ্টা। নৃশংস স্প্যানিয়ার্ডদের জন্য, রোগব্যাধি, যুদ্ধ, প্রতিহিংসা, আবাস স্থানান্তর এবং পাশবিক নির্যাতনজনিত কারণে আদিবাসী জনসংখ্যা বিলুপ্তির আশংকায় পড়ে যায়। ১৫৬৯ সালে আদিবাসী জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১,২০,০০০; যা ১৬১১ সালের মধ্যেই মাত্র ১০,০০০ এ নেমে আসে।[১০][বিতর্কিত ]

স্পেন এর কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ[সম্পাদনা]

১৮৪৮ সালে হোসে মারিয়া কাস্ত্রো মাদ্রিজ কোস্টা রিকাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মধ্য আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র থেকে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করেন।

হোসে মারিয়া কাস্ত্রো মাদ্রিজ (José María Castro Madriz) ১৮৪৮ সালে কোস্টা রিকাকে মধ্য আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্র (Federal Republic of Central America) হতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন হিসেবে ঘোষণা করেন।

উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে নেপোলিয়নের স্পেন দখলের পর, সমগ্র স্প্যানিশ আমেরিকাজুড়ে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীনতাকামীদের সকল সংঘর্ষ, ১৮১০ থেকে ১৮২১ সালের মধ্যে, নব্য স্পেনের মধ্যভাগে (যা বর্তমানে মধ্য মেক্সিকো) সংঘটিত হয়। ১৮২১ সালে যখন রাজধানী শহরে (বর্তমানে মেক্সিকো সিটি) ভাইসরয় পরাজিত হয়, তখন স্বাধীনতার সংবাদ নব্য স্পেনের সমস্ত অঞ্চলে প্রেরিত হয়, যার মধ্যে প্রাক্তন ক্যাপ্টেনসি জেনারেল অফ গুয়াতেমালা– ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কোস্টা রিকাও অন্যান্য মধ্য আমেরিকান প্রশাসনিক অঞ্চলগুলোর সাথে যৌথভাবে স্পেন হতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, স্বাধীনতা আইন ১৮২১ – এ স্বাক্ষর করে।

অক্টোবর ১৩, ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে সকল নথিপত্র কার্তাগোতে পৌঁছে, এবং গভর্নর হুয়ান ম্যানুয়েল দে কানিয়াস (Juan Manuel de Cañas) কর্তৃক একটি জরুরি সভা আহ্বান করা হয়। স্বাধীনতা অর্জনের পর কী করা উচিৎ তা নিয়ে অনেক রকমের মতামত ছিল, যেমন– মেক্সিকো অথবা গুয়াতেমালা কিংবা নব্য গ্রানাডার (বর্তমানে কলম্বিয়া) সাথে যুক্ত হওয়া। কয়েকজনের একটি দলকে নিয়ে একটি আইন পরিষদ (Junta de Legados) ঘোষণা করা হয়, যারা কোস্টা রিকার ঊর্ধ্বতন সরকার (Junta Superior Gubernativa de Costa Rica) নামক একটি সরকার গঠন করে। এ দিনের ঘটনাবলি নিয়ে "Mientras se aclaraban los nublados del día" (বাংলা: মেঘ কেটে গেছে), বুলিটি ঐ সময়ে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল।

স্পেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের বিষয়টি ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত এবং অনুমোদিত হয় ২৯ অক্টোবর, ১৮২১ তারিখে। এরপর ১৮২১ সালের ১ নভেম্বর স্যান হোসে, ৩ নভেম্বর কার্তাগো, ১১ নভেম্বর হেরেদিয়া, এবং ২৫ নভেম্বর আলাহুয়েলাতে তা অনুমোদিত হয়।[১১]

স্বাধীনতা ঘোষণার পর, নব্য স্পেন সংসদ একটি কমনওয়েলথ প্রতিষ্ঠা করতে চায় যেখানে স্পেনের রাজা, সপ্তম ফার্দিনান্দ, নব্য স্পেনেরও সম্রাট থাকবেন, কিন্তু উভয় রাষ্ট্র পৃথক আইনকানুন এবং স্বতন্ত্র আইনসভা দ্বারা পরিচালিত হবে। রাজা যদি এই পদ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান, সেক্ষেত্রে এই আইনে হাউজ অফ বুর্বোঁ’র কোন সদস্য কর্তৃক নব্য স্পেনের সিংহাসনে আরোহণের সুযোগ রাখা হয়। সপ্তম ফার্দিনান্দ উপনিবেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেননি এবং নব্য স্পেনের সিংহাসনে স্পেন কখনোই অন্য কোন ইউরোপীয় রাজপুত্রকে বসতে দেবে না বলে জানিয়ে দেন।

সংসদের সুপারিশক্রমে, রাজপ্রতিনিধি দলের সভাপতি আগুস্তিন দে ইতুর্বিদে (Agustín de Iturbide)– কে নব্য স্পেনের সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করে এর পুনঃনামকরণ করা হয় “মেক্সিকো”। ১৮২১ থেকে ১৮২৩ সালের এই রাজতান্ত্রিক শাসনের আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয় মেক্সিকান সাম্রাজ্য। মেক্সিকান সাম্রাজ্যের সীমানার মধ্যে মহাদেশীয় ভূ-খণ্ডসহ নব্য স্পেনের প্রদেশগুলোও (প্রাক্তন ক্যাপ্টেন্সি জেনারেল অফ গুয়াতেমালা সহ) অন্তর্ভুক্ত ছিল (দেখুন: মধ্য আমেরিকার ইতিহাস)। ৫ এপ্রিল, ১৮২৩ তারিখে কার্তাগো’র দুই দলের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়, যাদের একদল মেক্সিকান সাম্রাজ্যের সাথে সংযুক্ত হতে চেয়েছিল এবং আরেক দল স্বাধীন থাকার পক্ষপাতী ছিল। এতে প্রজাতন্ত্রপন্থীদের জয় হয় এবং রাজধানী কার্তাগো থেকে স্যান হোসে-তে সরিয়ে নেওয়া হয়।

মধ্য আমেরিকা[সম্পাদনা]

১৮৬২ সালে প্রকাশিত, ১৮৪৯ সালের জাতীয় কুলচিহ্ন খচিত প্রথম ডাকটিকেট (চার কোস্টা রিকান রিয়াল মূল্যমানের)।

১৮২৩ সালে, মেক্সিকোতে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সম্রাট আগুস্তিন দে ইতুর্বে ক্ষমতাচ্যুত হন। একটি নতুন মেক্সিকান সংসদ, মধ্য আমেরিকান প্রশাসনিক অঞ্চলগুলোর নিয়তি যার যার হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে মতপ্রদান করে। ঐ বছরই জেনারেল ম্যানুয়েল হোসে আর্সে’র নেতৃত্বে পাঁচটি মধ্য আমেরিকান অঞ্চল নিয়ে মধ্য আমেরিকান প্রাদেশিক জোট (United Provinces of Central America) গঠিত হয়। এই অঞ্চলগুলো তখন রাজ্য হিসেবে পরিচিতি পায়। জোটবদ্ধ প্রাদেশিক ফেডারেশন, যেটা গোড়া থেকেই তেমন একটা জোটবদ্ধ ছিল না, অন্তঃপ্রাদেশিক বৈরিতার কারণে দ্রুতই ভেঙে যায়।

১৮৩৮ সালে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা লাভের পর, ইউরোপীয় বাজারে কফি রপ্তানির জন্য কোস্টা রিকার প্রতিষ্ঠিত কোন নিয়মিত বাণিজ্যপথ ছিল না। তাদের অবকাঠামোর অভাব পরিবহনে অন্তরায় সৃষ্টি করে: কফি উৎপাদনকারী অঞ্চলগুলো ছিল মূলত মধ্য উপত্যকায় এবং কেবল প্রশান্ত উপকূলের পুন্তারেনাস (Puntarenas) বন্দরের সাথেই তার যোগাযোগ ছিল। পানামা খাল চালু হওয়ার আগে, ইউরোপের জাহাজগুলোকে হর্ন অন্তরীপ ঘুরে প্রশান্ত উপকূলে আসতে হত। ১৮৪৩ সালে, উইলিয়াম লে লাশোর (William Le Lacheur) নামক গার্নসি’র (Guernsey) এক বণিক ও জাহাজ-মালিকের সহায়তায়, দেশটি ইউরোপগামী একটি বাণিজ্যপথ প্রতিষ্ঠা করে।

১৮৫৬ সালে উইলিয়াম ওয়াকার নামক একজন আমেরিকান দস্যু মধ্য আমেরিকায় অনুপ্রবেশ করে। নিকারাগুয়াতে পৌঁছানোর পর, সে নিজেকে নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট হিসেবে দাবি করে এবং ইতোমধ্যে বিলুপ্ত দাসপ্রথা পুনর্বহাল করে।[১২] তার উদ্দেশ্য ছিল কোস্টা রিকাও দখল করা এবং যখন সে সেখানে ঢুকে পড়ে, দেশটি ওয়াকার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। কোস্টা রিকা’র সেনাবাহিনী প্রধান, প্রেসিডেন্ট হুয়ান রাফায়েল মোরা পোরাস এর নেতৃত্বে ঐ দস্যুরা পরাজিত ও দেশ থেকে বিতাড়িত হয়। কোস্টা রিকার সেনারা ঐ দস্যুদের রিভাস, নিকারাগুয়া পর্যন্ত ধাওয়া করে, যেখানে চূড়ান্ত যুদ্ধে উইলিয়াম ওয়াকার এবং তার সেনাদের অবশেষে প্রতিহত করা হয়। চূড়ান্ত এই যুদ্ধে, হুয়ান সান্তামারিয়া নামক আরাহুয়েলা’র এক ঢাকবাদক বালক, দস্যুদের ঘাঁটিতে আগুন লাগাতে গিয়ে প্রাণ হারায়। আজ তাকে জাতীয় বীর হিসেবে স্মরণ করা হয়।

প্রজাতন্ত্র[সম্পাদনা]

১ ডিসেম্বর, ১৯৪৮ তারিখে কুয়ারতেল বেইয়াভিস্তায় (Cuartel Bellavista; বর্তমানে কোস্টা রিকা জাতীয় যাদুঘর), হোসে ফিগেরেস ফেরের কর্তৃক সেনাবাহিনীর বিলুপ্তিকরণের প্রতীকী অনুষ্ঠান

১৮৬৯ সালের নির্বাচনের মাধ্যমে কোস্টা রিকায় একটি শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক যুগের সূচনা হয়। মধ্য আমেরিকাজুড়ে যেমন সংক্রামকভাবে সহিংসতা বিস্তার লাভ করেছে, কোস্টা রিকা তার অনেকখানিই এড়াতে পেরেছে। উনিশ শতকের শেষের দিক হতে থেকে মাত্র দুই বার স্বল্পকালীন দুটি সহিংসতার ঘটনা এই প্রজাতন্ত্রের বিকাশকে ক্ষুণ্ণ করেছে। ১৯১৭–১৯ সাল পর্যন্ত তিনোকো গ্রানাদোস একনায়ক হিসেবে দেশটি শাসন করেন।

১৯৪৮ সালে বিতর্কিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জের ধরে, হোসে ফিগেরেস ফেরের একটি সশস্ত্র অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। “এই অভ্যুত্থানের ফলশ্রুতিতে সংঘটিত ৪৪ দিনের কোস্টা রিকান গৃহযুদ্ধে ২,০০০ এর বেশি লোক নিহত হয়, যা বিংশ শতাব্দির কোস্টা রিকার ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী ঘটনা।”[১৩] বিজয়ী সামরিক জান্তা সংবিধানের একটি খসড়া তৈরি করে, যেখানে সর্বজনীন ভোটাধিকারসহ অবাধ নির্বাচন এবং সামরিক বাহিনী বিলোপের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। ফিগেরেস একজন জাতীয় বীর বনে যান, এবং নতুন সংবিধানের অধীনে ১৯৫৩ সালের প্রথম নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তখন থেকে কোস্টা রিকা স্বল্পসংখ্যক গণতন্ত্রের অন্যতম যাদের কোন সামরিক বাহিনী নেই।[১৪] এই জাতি শান্তিপূর্ণভাবে ১৬টি ধারাবাহিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পন্ন করেছে, যার সর্বশেষটি ছিল ২০১৮ সালে।

কোস্টা রিকার অর্থনীতি ১৯৭৮ সালে একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। দেশটি “অর্থনৈতিক বিকাশের সফলতার গল্প” থেকে একটি তীব্র আর্থ–সামাজিক সংকটের মধ্যে প্রবেশ করে। কোস্টা রিকা কলা এবং কফি রপ্তানির ওপর নির্ভর করত। ১৯৭৮ সালে কফির দাম পড়ে যায় এবং ফলে রাজস্বও কমে যায়। ১৯৭৯ সালে, তেল, যা ছিল তাদের প্রধান একটি আমদানি পণ্য, তার দাম মাত্রাধিক ও দ্রুতভাবে বেড়ে গেলে, দেশটি গভীর সংকটে নিমজ্জিত হয়। দেশের অর্থনীতির উন্নয়নে সহায়তা করার জন্য, প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো কারাজো আন্তর্জাতিক ঋণ নিতে থাকেন, যা দেশটিকে ঋণের ভারে জর্জরিত করে তোলে।[১৫]

একদা কৃষিপ্রধান দেশ থেকে রূপান্তরিত হয়ে কোস্টা রিকা প্রযুক্তি-ভিত্তিক শিল্প ও সেবা, এবং বাস্তু–পর্যটন নির্ভর হয়ে উঠেছে। কোস্টা রিকা’র রপ্তানি বাণিজ্যের প্রধান উৎস এখন প্রযুক্তি-ভিত্তিক। মাইক্রোসফ্‌ট, মটোরোলা, ইন্টেল, এবং অন্যান্য প্রযুক্তি-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো কোস্টা রিকায় তাদের কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করেছে। স্থানীয় কোম্পানিগুলো সফটওয়্যারসহ অন্যান্য কম্পিউটার–সংক্রান্ত পণ্য তৈরি ও রপ্তানি করছে। ত্বরান্বিত বেগে পর্যটনের প্রসার ঘটছে এবং অনেকের ধারণা এই শিল্প থেকে আগত আয় শীঘ্রই জাতীয় জিডিপি’র (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রধান অবদানকারী হয়ে উঠবে। সনাতন কৃষিব্যবস্থা, বিশেষত কফি ও কলা, এখন পর্যন্ত দেশের রপ্তানির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

সাধারণ:

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Hoopes, John W.; Oscar Fonseca Z. (২০০৩)। Goldwork and Chibchan Identity:Endogenous Change and Diffuse Unity in the Isthmo-Colombian Area (পিডিএফ)। Washington, DC: Dumbarton Oaks। আইএসবিএন 0-82631-000-1। ২০০৯-০২-২৫ তারিখে মূল (Online text reproduction) থেকে আর্কাইভ করা। 
  2. "Costa Rica." Funk & Wagnalls New World Encyclopedia (2014): 1p. 1.; accessed 19 February 2015.
  3. Quilter, Jeffrey and John W. Hoopes, editors (২০০৩)। Gold and Power in Ancient Costa Rica, Panama, and Colombia। Washington, DC: Dumbarton Oaks। আইএসবিএন 0-88402-294-3। ২০১৯-০৩-২৭ তারিখে মূলবিনামূল্যে নিবন্ধন প্রয়োজন (Online text reproduction) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-০৯-০৮ 
  4. "Diquís"। Museo Chileno de Arte Precolombino। সংগ্রহের তারিখ ২৫ মার্চ ২০১২ 
  5. The Story Of... Smallpox
  6. [১] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত মে ১, ২০১৩ তারিখে
  7. "A Brief History of Costa Rica: Colonial Times"। সেপ্টেম্বর ২২, ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৭-১২-২১ 
  8. Shafer, D. Michael (১৯৯৪)। Winners and losers: how sectors shape the developmental prospects of statesবিনামূল্যে নিবন্ধন প্রয়োজন। Ithaca, N.Y.: Cornell University Press। আইএসবিএন 0-8014-8188-0 
  9. "Costa Rica – Cartago"। Costarica.com। ২০০৯-০৫-২২। ২০০৮-০২-২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০১০-০৬-২৬ 
  10. Palmer, eds, Steven; Molina, eds, Ivan (অক্টোবর ২৯, ২০০৪)। The Costa Rican Reader: History, Culture, Politics। Duke University Press। 
  11. Mi Patria, Fascículo #5, "Acta de la Independencia de Costa Rica", La Nación, September 4, 2013
  12. "history of costa rica"। ২৬ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ আগস্ট ২০২০ 
  13. [২] ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত নভেম্বর ১৭, ২০১৩ তারিখে
  14. "YFU Costa Rica - Democracy in Costa Rica"। ২০১৩-০২-১০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। 
  15. Sawchuk, Dana M. The Costa Rican Catholic Church, Social Justice, And The Rights Of Workers, 1979–1996. [Electronic Resource]. n.p.: Waterloo, Ont. : Wilfrid Laurier University Press, 2004 (Baltimore, Md. : Project MUSE 2012) (Baltimore, Md. : Project MUSE, 2014), 2012. Louisiana State University. Web. 19 February 2015.

আরও পড়ুন[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]