ওয়ালীদ ইবনে ওয়ালিদ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
(ওয়ালিদ ইবনে আল-ওয়ালিদ থেকে পুনর্নির্দেশিত)
ওয়ালীদ ইবনে ওয়ালিদ
মুহাম্মাদের সাহাবা
জন্মবনু মাখজুম শাখা, কুরাইশ গোত্র মক্কা
মৃত্যু৬২৮ খ্রিস্টাব্দ
যার দ্বারা প্রভাবিতমুহাম্মাদ
পিতামাতা
উল্লেখযোগ্য কাজমক্কা বিজয় অভিযান, উমরাতুল কাযায় অংশগ্রহণ
আত্মীয়

ওয়ালীদ ইবনুল ওয়ালীদ ইবনুল মুগীরা (মৃত্যু ৮ম হিজরি) মুহাম্মদ এর একজন প্রখ্যাত সাহাবা ছিলেন। তিনি খালিদ বিন ওয়ালিদের বৈমাত্রেয় ভাই ছিলেন।[১]

নাম ও বংশ পরিচয়[সম্পাদনা]

ওয়ালীদ ইবনে ওয়ালিদের পিতা ছিলেন আরবের শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সমালোচক ওয়ালিদ ইবনে আল-মুগিরা। তিনি কুরাইশ গোত্রের বনু মাখযুম শাখার সন্তান। প্রখ্যাত সাহাবী ও সেনানায়ক হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদহিশাম ইবনুল ওয়ালীদের ভাই। একটি বর্ণনায় জানা যায়, তিনি হিশামের সহোদর ও খালিদের বৈমাত্রীয় ভাই। তাছাড়া তিনি উম্মুল মুমিনীন উম্মু সালামার চাচাতো বোন ছিলেন । আবার খালিদ ইবন ওয়ালীদের বৈমাত্রেয় ভাই ছিলেন ।

ইসলাম পূর্ব জীবন[সম্পাদনা]

রাসুলের মাক্কী জীবনে ওয়ালীদ ইসলাম গ্রহণ করেননি। এ সময় মুসলমানদের সাথে তার আচরণ কেমন ছিল জীবনী গ্রন্থাবলীতে সে সম্পর্কে তেমন কিছু উল্লেখ নেই। তবে দেখা যায়, মক্কার কুরাইশ বাহিনীর সাথে যোগ দিয়ে বদর যুদ্ধে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন এবং পরাজিত হয়ে হযরত আবদুল্লাহ ইবন জাহাশ মতান্তরে সুলাইত ইবন কায়েসের হাতে বন্দী হন।[২] তখন ওয়ালীদের অন্য দুই ভাই খালিদ ইবনুল ওয়ালীদহিশাম ইবনুল ওয়ালীদ তাকে ছাড়িয়ে নিতে আসেন । এবং মোটা অর্থের বিনিময়ে তাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান ।[৩]

ইসলাম গ্রহণ[সম্পাদনা]

ওয়ালীদ মুক্তি পেয়ে ভাইদের সাথে মক্কার পথে যাত্রা করলেন। যুল-হুলাইফা নামক স্থানে পৌঁছার পর ভাইদের নিকট থেকে পালিয়ে আবার মদীনায় রাসূলুল্লাহর নিকট ফিরে আসেন এবং ইসলাম গ্রহণ করেন। তার ভাইয়েরা ফিরে এসে আবার তার সাথে দেখা করে বলেন, যদি তোমার মুসলমান হওয়ার ইচ্ছা ছিল, তাহলে মুক্তিপণ দেওয়ার পূর্বে হলে না কেন? ওয়ালীদ তাদেরকে বলেন, অন্য কুরাইশদের মত আমিও মুক্তিপণ প্রদান করে মুক্ত হতে চেয়েছিলাম। মুক্তির পূর্বে আমি ইসলামের ঘোষণা এ জন্য দেইনি যে, যাতে কুরাইশরা এমন কথা বলতে না পারে, আমি মুক্তিপণ দেওয়ার ভয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছি।

নির্যাতনের স্বীকার[সম্পাদনা]

ইসলাম গ্রহণের পর তিনি ভাইদের সাথে আবার মক্কার পথে যাত্রা করেন। পথে তার ভাইয়েরা তাকে তেমন কিছু বললো না । কিন্তু মক্কায় পৌঁছে সকল মুসলমানদের মত ‍তাঁঁকেও বন্দী করলো ।তাকে আইয়াশ ইবন রাবীয়া, হিশাম ইবনুল আস, সালামা ইবন হিশাম প্রমুখের সাথে এক ঘরে আটকে রাখলো ।ঐতিহাসিকরা বলেছেন, এসব বন্দীদের ওপর কুরাইশরা বহু নির্যাতন চালাতো।এমনকি তাদের হত্যারও হুমকি দেয়া হতো।

কালবী বলেনঃ যাদের কোন গোত্রীয় শক্তি বা জনবল ছিল না এমন একটি দূর্বল সম্প্রদায়কে ইসলাম গ্রহণের কারণে শাস্তি দেওয়া হয়েছিল। তাদের অনেকে দ্বীন ত্যাগ করেছে, অনেকে ইসলামে অটল থেকেছে, আবার অনেকে ঈমান না হারিয়ে তাদের আদেশ পালন করেছে। অভিজাত ঘরের অনেকে ইসলাম গ্রহণ করে পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে। যেমনঃ সালামা ইবন হিশাম, ইবনুল মুগীরা, ওয়ালীদ ইবন ওয়ালীদ, আইয়াশ ইবন রাবীয়া প্রমূখ।[৪] ইবন ইসহাক বলেন, তার ভাই হিশাম ইবন ওয়ালীদ তার সাধ্যনুযায়ী ওয়ালীদকে সমর্থন দিয়েছেন ।[৫]

নির্যাতন থেকে মুক্তি ও মদিনা গমন[সম্পাদনা]

বদর যুদ্ধের পূর্বে হযরত রাসূলে কারীম আইয়াশ ইবন রাবীয়া, সালামা ইবন হিশাম, হিশাম ইবন আস প্রমূখের মুক্তির জন্য আল্লাহর দরবারে দু’আ করতেন। [হায়াতুস সাহাবা-৩/৩৪৮]।

বদর যুদ্ধের বন্ধী থেকে তাঁর ভাইয়েরা তাকে নিয়ে যাওয়ার পর বেশ কিছুদিন তাঁর বন্দী দশায় কাটে। একদিন সুযোগ বুঝে তিনি মদীনায় পালিয়ে আসেন। হযরত রাসূলে কারীম তাঁর কাছে আইয়াশ ও ‍সালামার অবস্থা জিজ্ঞেস করেন। ওয়ালীদ বলেন, তাঁদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে ।তখন রাসুল আইয়াশ ও সালামাকে মুক্ত করার জন্য ওয়ালীদকে মক্কায় পাঠান ।এবং ওয়ালীদ ইবনে ওয়ালিদ তাঁদের মুক্ত করে নিয়ে আসতে সক্ষম হন ।

কিন্তু আজবাস নামক স্থানে তিনি পড়ে গেলে একটি অঙ্গুলি মারাত্মকভাবে আহত হয়ে রক্ত ঝরতে থাকে।

মক্কা বিজয়[সম্পাদনা]

হুদাইবিয়ার ‍চুক্তি অনুযায়ী হযরত রাসূলে কারীম হিজরী সপ্তম সনে বিগত বছরের কাজা উমরা আদায় করতে মক্কায় যান। ওয়ালীদ এ সময় রাসূলুল্লাহর সফরসঙ্গী ছিলেন। তখনও তাঁর ভাই খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ ইসলাম গ্রহণ করেননি। এ সম্পর্কে হযরত খালিদ ইবনুল ওয়ালীদ বলেনঃ হুদাইবিয়ার সন্ধির পর আমি যখন দারুণ অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি, তখন হিজরী ৭ম সনে যুল-কাদাহ্‌ মাসে হযরত রাসূলে কারীম “উমরাতুল কাযা” আদায়ের উদ্দেশ্যে মক্কায় প্রবেশ করলেন। তাদের কারও সামনে পড়তে হয় এই আশংকায় আমি আত্মগোপন করে থাকলাম। তাদের কারও সাথে আমার দেখা হলো না। আমার ভাই ওয়ালীদ ইবনুল ওয়ালীদ এই সফরে রাসূলুল্লাহর সঙ্গী ছিলেন। তিনি আমাকে খুঁজে না পেয়ে আমাকে একটি চিঠি লিখেন। চিঠির বিষয়বস্তু নিম্নরূপঃ

“বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম। অতঃপর ইসলামের ব্যাপারে আপনার এমন বিরূপ মনোভাব পোষণের কারণে আপনাকে আমার খুব আশ্চর্য মানুষ বলে মনে হয়েছে। অথচ আপনি একজন বড় বুদ্ধি ও প্রজ্ঞার অধিকারী ব্যক্তি। আপনার মত কোন ব্যক্তি কি ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে পারে? রাসূলুল্লাহ আপনার সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করছিলেনঃ খালিদ কোথায়? আমি বলেছিঃ শিগগিরই আল্লাহ তাঁকে নিয়ে আসবেন। তিনি তখন বললেনঃ তাঁর মত ব্যক্তি কি ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ থাকতে পারে? তাঁর বুদ্ধি ও চেষ্টা যদি মুসলমানদের পক্ষে হতো, তাহলে তা তাঁর কল্যাণ বয়ে আনতো এবং আমি তাঁকে অন্যদের চেয়ে বেশি মর্যাদা দিতাম। ভাই, যে ভালো কাজ আপনার হাতছাড়া হয়ে গেছে, এখনই আপনি এসে তাতে শরিক হউন।” মূলতঃ এই চিঠি পেয়ে হযরত খালিদ ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন এবং অল্পদিনের মধ্যে মদীনার দিকে যাত্রা করেন।[৬][৭]

ভিন্ন মতে জীবন বৃত্তান্ত

তাছাড়া ওয়াকিদী বলেছেনঃ কেউ কেউ মনে করেন, ওয়ালীদ মক্কা থেকে পালিয়ে আবু বাসীরের দলের সাথে যোগ দেন। উল্লেখ্য যে, এই আবু বাসীর হুদাইবিয়ার সন্ধির পর মদীনায় আসেন। হযরত রাসূলে কারীম সন্ধির শর্ত অনুযায়ী ‍তাকে মক্কায় ফেরত পাঠান। কিন্তু পথিমধ্যে তার এক সঙ্গীকে হত্যা করে আবার মদীনায় রাসূলুল্লাহর নিকট ফিরে আসেন। তিনি আবু বাসীরকে মদীনা ত্যাগের নির্দেশ দেন। আবু বাসীর মদীনা ত্যাগ করে লোহিত সাগরের উপকূল এলাকায় চলে যান। এরপর মক্কার আরও কিছু নও মুসলিম যুবক তার সাথে যোগ দেন। তারা কুরাইশদের বাণিজ্য কাফিলা আক্রমণ করে লুটপাট করতেন। ফলে কুরাইশদের ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। অতঃপর কুরাইশরা অনন্যোপায় হয়ে এই দলটিকে মদীনায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য রাসূলুল্লাহকে অনুরোধ জানায়। রাসূলুল্লাহ তাদেরকে মদীনায় ডেকে পাঠান।[৮] তবে বালাযুরী এই বর্ণনাকে সঠিক বলে মনে করেননি।

মৃত্যু[সম্পাদনা]

ওয়ালীদ ইবনে ওয়ালিদ এর মৃত্যু সাল সম্পর্কে তেমন স্পষ্ট কিছু জানা যায়না তবে ।একাধিক বর্ণনায় জানা যায়, তিনি হিজরী ৭ম সনে রাসূলুল্লাহর সাথে “উমরাতুল কাযা” আদায়ে শরিক ছিলেন । এবং ৮ম হিজরির পরে তার জীবনকাল সম্পর্কে আর কিছু পাওয়া যায়না । তাই ঐতিহাসিকগণ ধারণা করছেন ৭/৮ হিজরির দিকে তিনি হয়তো মৃত্যুবরণ করেছেন ।

আর একটি বর্ণনায় রয়েছে,তিনি আইয়াশ ও সালামাকে মুক্ত করে মদীনায় ফিরে অল্প কিছুদিনের মধ্যে ৫ম হিজরির দিকে মৃত্যুবরণ করেন।[৯][১০]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. বইঃ আসহাবে রাসূলের জীবনকথা – দ্বিতীয় খন্ড) 
  2. [আনসাবুল আশরাফ-১/৩০২] 
  3. [আনসাবুল আশরাফ-১/২১০] 
  4. [আনসাবুল আশরাফ-১/১৯৭] 
  5. [সীরাতু ইবন হিশাম-১/৩২১] 
  6. [হায়াতুস সাহাবা- (১/১৬০) 
  7. উসুদুল গাবা- [৫/৯৩] 
  8. [আনসাবুল আশরাফ-১/২১০-২১১] 
  9. [আল-ইসাবা - (৩/৬৪০) 
  10. আনসাবুল আশরাফ - [১/২১০-২১১]