অর্থমূল

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

অর্থমূল বলতে ভাষাতে ব্যবহৃত অর্থের এক ধরনের একককে বোঝায়। আরও সঠিক করে বললে ভাষাবিজ্ঞানের আলোচনায় অর্থমূল হল রূপমূলের দ্বারা জ্ঞাপিত অর্থ। রূপমূল হল কতগুলি ধ্বনিমূল নিয়ে গঠিত একটি শব্দ বা শব্দের অংশবিশেষ যেটি একটি স্থিতিশীল অর্থ বহন করে, এবং যেটিকে আরও বেশি বিভাজিত করলে আর কোনও অর্থ অবশিষ্ট থাকে না। এই রূপমূলের দ্বারা জ্ঞাপিত অর্থকেই ভাষাবিজ্ঞানে অর্থমূল বলে। ইংরেজি পরিভাষায় অর্থমূলকে "সেমিম" (Sememe) বলে। অর্থমূলের ধারণাটি ভাষাবিজ্ঞানের বাগর্থতত্ত্বরূপমূলতত্ত্ব শাখাগুলিতে গুরুত্বপূর্ণ।

ভাষাবিজ্ঞানের বাইরে সাংগঠনিক সংকেতবিজ্ঞানের আলোচনাতেও অর্থমূলের ধারণাটি অধ্যয়ন করা হয়েছে। সেখানে এটির সংজ্ঞা কিছুটা ভিন্ন। সংকেতবিজ্ঞান অনুযায়ী অর্থমূল ভাষাতে অর্থের ক্ষুদ্রতম একক নয়, বরং অর্থের সবচেয়ে ক্ষুদ্র একক হল অর্থাণু বা ইংরেজি পরিভাষায় "সিম" (Seme)। অর্থাণু হল কোনও সম্প্রচারিত বা উদ্দিষ্ট অর্থের ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য একক, যাকে আর বিশ্লিষ্ট করা সম্ভব নয়। সংকেতবিজ্ঞানীদের মতে যে কোনও অর্থমূল দ্বারা জ্ঞাপিত অর্থের একাধিক দিক বা বৈশিষ্ট্য থাকে। অর্থমূলের অর্থের ঐ প্রতিটি দিক বা বৈশিষ্ট্যকেই এর একেকটি অর্থাণু বলে। অর্থাৎ দুই বা ততোধিক অর্থাণু মিলে অর্থের যে যৌগিক সমবায় সৃষ্টি করে এবং যেটি পরবর্তীতে একটি রূপমূলের দ্বারা ভাষিকভাবে রূপায়িত হয়, তাই হল অর্থমূল।

আভিধানিক শব্দার্থতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে আভিধানিক অর্থমূল (Lexeme) এবং অর্থমূলের (Sememe) মধ্যে সম্পর্ক নিম্নরূপ। আভিধানিক অর্থমূল হল কোনও ভাষার অভিধান বা শব্দভাণ্ডারের তালিকাভুক্ত শব্দগুলির অর্থের একটি একক, যেটি সাধারণত অভিধানের একটি ভুক্তি নির্দেশকারী শিরোশব্দ (Headword) দ্বারা রূপায়িত হয়। আভিধানিক অর্থমূলের সাথে একটিমাত্র অর্থমূল সংযোজিত থাকতে পারে, অর্থাৎ সেটি একার্থবোধক (ইংরেজিতে monosemous) হতে পারে। কিংবা একই আভিধানিক অর্থমূলের সাথে একাধিক অর্থমূল সংশ্লিষ্ট থাকতে পারে, অর্থাৎ সেটি বহু-অর্থবোধক (ইংরেজিতে polysemous) হতে পারে। যেমন বাংলা অভিধানে "কেশর" শিরোশব্দটি একটি আভিধানিক অর্থমূলকে রূপায়িত করেছে, কিন্তু সেটির আবার কাছাকাছি একাধিক অর্থমূল আছে। যেমন একটি অর্থমূল হল "সিংহ, ঘোড়া, প্রভৃতি প্রাণীর ঘাড়ে অবস্থিত দীর্ঘ চুল বা লোম"। অপর একটি অর্থমূল হল "ফুলের পাপড়ির মধ্যস্থ চুল বা কেশের মতো সূক্ষ্ম অঙ্গ।" দুইটি অর্থমূলের সাথেই কেশ বা চুলের অর্থভিত্তিক একটি সম্পর্ক আছে বলে এই দুইটি একই আভিধানিক অর্থমূলের অধীনে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। যেহেতু অভিধানের একটিমাত্র আভিধানিক অর্থমূলবিশিষ্ট শিরোশব্দের অধীনস্থ বিভিন্ন অর্থমূলগুলির একই উচ্চারণ ও একই বানান হয়, তাই এগুলিকে এক ধরনের সমরূপী শব্দ (Homonym) বলা যেতে পারে। কিন্তু সমরূপী শব্দের অপেক্ষাকৃত একটি কঠোর সংজ্ঞা অনুযায়ী কেবলমাত্র ভিন্ন ভিন্ন আভিধানিক অর্থমূল থেকে উৎসারিত ভিন্ন ভিন্ন শব্দ যদি কাকতালীয়ভাবে উচ্চারণে বা বানানে মিলে যায়, তবেই সেই শব্দগুলিকে সমরূপী শব্দ বলে। যেমন ইংরেজি Race শব্দটির দুইটি আভিধানিক অর্থমূল আছে। একটি অর্থমূল দিয়ে "নরগোষ্ঠী" বোঝায় এবং আরেকটি অর্থমূল দিয়ে "দৌড় প্রতিযোগিতা বোঝায়। যেহেতু এই দুইটি অর্থমূলের মধ্যে কোনোই অর্থগত সম্পর্ক নেই, তা এই দুইটিকে একটিমাত্র Race আভিধানিক অর্থমূলের সাথে সম্পর্কিত করা সম্ভব নয়, বরং Race-১ এবং Race-২ – এইভাবে দুইটি ভিন্ন ভিন্ন আভিধানিক অর্থমূল হিসেবে ইংরেজি অভিধানে রাখতে হয়।

অর্থমূলের সাথে সম্পর্কিত আরেকটি ধারণা হল "অধি-অর্থমূল" (episememe), যা মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী লিওনার্ড ব্লুমফিল্ডের রচনায় বর্ণিত হয়েছে। এটি হল ব্যাকরণিক বৃত্তিমূল (Tagmeme) নামক বাক্যিক এককটির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অর্থের একক।

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

উৎসপঞ্জি[সম্পাদনা]

  • Bazell, Charles Ernest (১৯৫৪)। The sememe। in: Litera I. Istanbul। পৃষ্ঠা 17–31।  Reprinted in: Hamp, Eric P.; Fred W. Householder; Robert Austerlitz, সম্পাদকগণ (১৯৬৬)। Readings in linguistics II। University of Chicago Press। পৃষ্ঠা 329–40। 
  • Vakulenko, Serhii (২০০৫)। "The Notion of Sememe in the Work of Adolf Noreen"। The Henry Sweet Society for the History of Linguistic Ideas Bulletin44 (1): 19–35।