বিষয়বস্তুতে চলুন

অভিযোজিত বিকিরণ

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

অভিযোজিত বিকিরণ (ইংরেজি: Adaptive radiation) হল আদি পূর্বপুরুষ থেকে উদ্ভূত সমগোত্রীয় প্রাণীদের বিভিন্ন ভৌগোলিক পরিবেশে বাস করার জন্য বা পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে অভিযোজিত হওয়ার জন্য আকৃতিগত বা স্বভাবগত দিক থেকে বৈচিত্র্য পূর্ণ হয়ে ওঠার ক্ষমতা।[][]

জীববিজ্ঞানের বিবর্তন সংক্রান্ত শাখায় অভিযোজিত বিকিরণ হল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া, যা প্রাণী গোষ্ঠীর বিভিন্ন প্রজাতিকে খুব দ্রুত বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তুলতে সক্ষম। একটি নির্দিষ্ট পূর্বপুরুষের শারীরবৃত্তীয় বৈশিষ্ট্যগুলি তার প্রজাতির মধ্যে প্রদর্শিত হয়, যা প্রকৃতপক্ষে ফিনোটাইপিক অভিযোজন প্রক্রিয়ার ফল।

অসবর্নের সূত্র

[সম্পাদনা]

প্রফেসর অসবর্ন তার নিজের বিবর্তনের তত্ত্বকে "ডনম্যান থিওরি" নামে অভিহিত করেন। তার তত্ত্বটি গিল্ডডাউন ম্যান (ইথ্রোপাস) আবিষ্কার এর উপর ভিত্তি করে স্থাপিত হয়েছিল। তার যুক্তি ছিল যে, লিনিয়াস এর পূর্বে ডারউইনিয়ান শ্রেণীবিন্যাস অনুসরণকারী সমগ্র মানুষের পূর্বপুরুষরা সমান্তরালভাবে বিকশিত হয়েছে। তিনি নিজে অভিযোজনমূলক বিকিরণ বিষয়ক সূত্রের উন্মোচন করেন। তাই সূত্রানুসারে,

আয়তনে যথেষ্ট বড় এবং পরিবেশগত ভূসংস্থান্গত মৃত্তিকা গত ও উদ্ভিদ প্রজাতির উপস্থিতি প্রতিটি বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে যদি বৈচিত্র পূর্ণ হয় তবে বৈচিত্র্যময় প্রাণী গোষ্ঠীর উদ্ভব ঘটাবে।

বৈশিষ্ট্য

[সম্পাদনা]

অভিযোজিত বিকিরণের চারটি বৈশিষ্ট্য:

  1. একই আদি পূর্বপুরুষ: খুব কাছাকাছি সাধারণ পূর্বপুরুষ। একবর্গিতার থেকে আলাদা।
  2. ফিনোটাইপ-পরিবেশ আন্তঃসম্পর্ক: শারীবৃত্তীয় ও বহিঃবৈশিষ্ট্যের সাথে পরিবেশের নিগূঢ় যোগসূত্র।
  3. বৈশিষ্ট্য উপযোগিতা: তাদের সংশ্লিষ্ট পরিবেশে বৈশিষ্ট্য মানগুলির কর্মক্ষমতা বা ফিটনেস সুবিধা।
  4. দ্রুত প্রজাত্যায়ন: বিস্ফোরণের ন্যায় দ্রুত নতুন প্রজাতির আবির্ভাব ও নতুন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা।

কারণ ও ফলাফল

[সম্পাদনা]
কারণ

কোন একটি বাসস্থলে যখন কোন প্রজাতির প্রাণী সংখ্যা বেড়ে যায় তখন ওই জায়গা খাদ্য, বাসস্থল, এমনকি প্রতিরক্ষার খাতিরে প্রাণীরা অনেকে পরিযান দেখায়, এবং যেখানে খাদ্যের প্রাচুর্য রয়েছে বা বসবাসের জায়গাও অনেক, আর প্রতিযোগিতাহীন পরিবেশ পায়, সেখানে তারা বসতি স্থাপন করে। তবে নতুন পরিবেশে নতুন প্রয়োজনীয়তার তাগিদ তারা অনুভব করে, এর থেকে জন্ম নেয় অভিযোজন ক্ষমতা। তারপর ঘটে বিকিরণ।[][]

ফলাফল

অভিযোজিত বিকিরণ নতুন নতুন প্রজাতি সৃষ্টি করে ও কালের আবহে নতুন গণ, গোত্র, বর্গ ও শ্রেণী সৃষ্টি কর। এর ফলে জীবের অভিব্যক্তি প্রকাশিত হয়। তাই একে ম্যাক্রোএভলিউশন বা মেগাএভলিউশনের কারণ বলা হয়।

উদাহরণ

[সম্পাদনা]

ডারউইন ফিঞ্চ

[সম্পাদনা]

অভিযোজিত বিকিরণের একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল প্রশান্ত মহাসাগরের গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জতে বসবাসকারী ফিঞ্চ পাখিদের মধ্যে বিবর্তন ধারার মাধ্যমে নতুন প্রজাতির উদ্ভব। ডারউইন এই দ্বীপপুঞ্জে প্রায় ১৪ টি বিভিন্ন প্রজাতির ফিঞ্চ পাখির সন্ধান পেয়েছিলেন তাই জন্য এদের ডারউইন ফিঞ্চ নামে অভিহিত করা হয়।[]

১৪টি প্রজাতির মধ্যে ৪টি ফিঞ্চ প্রজাতি, যাদের ঠোঁটের আকৃতি বিভিন্ন

দক্ষিণ আমেরিকার মূল ভূখণ্ডে ফিঞ্চ পাখিদের আদি বাসস্থান ছিল। তারা প্রাচীন বীজ ভক্ষণকারী স্থলজ পাখি ছিল। সেখান থেকে তারা প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপপুঞ্জে উড়ে এসে পড়ে যায় পাখি হিসেবে পৃথক পৃথক বাসস্থানে অনেকগুলি পপুলেশন গ্রুপে বাস করতে আরম্ভ করে। মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের মধ্যে জিনগত বৈচিত্র্য তৈরি হয়। তার ফলে নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়। পরিবর্তিত ভৌগোলিক পরিবেশ খাদ্যের জন্য প্রতিযোগিতা, প্রতিকূল অবস্থার আন্তঃক্রিয়ার প্রভাবে নিজেদের পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার জন্য তারা বিভিন্নভাবে অভিযোজিত হতে থাকে। এর ফলে প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্য ফিঞ্চ পাখিদের পপুলেশনগুলি ধীরে ধীরে পরস্পরের থেকে জিনগতভাবে পৃথক হয়ে যায়। পরবর্তী সময় তাদের মধ্যে আর যৌন জনন সম্ভব হয় না। তারা পৃথক পৃথক প্রজাতিরূপে গণ্য হয়। এইভাবে চৌদ্দটি প্রজাতির উদ্ভব ঘটে (তেরোটি প্রজাতি গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে এবং একটি প্রজাতি উত্তর পূর্বে কোকো দ্বীপে আবিষ্কার হয়েছে)।

অভিযোজনগত বিকিরণের ফলে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রজাতির ফিঞ্চ পাখিদের ঠোঁটের গঠন অনুযায়ী তাদের খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তিত হয়েছে:

  1. স্থলজ ফিঞ্চ: ছয় রকম প্রজাতির বীজ ভক্ষণকারী ফিঞ্চ পাখি ঠোঁটের আকৃতি অনুসারে তারা বিভিন্ন প্রকার বীজ ভক্ষণ করে।
  2. গাছে বসবাসকারী ফিঞ্চ: ছয় রকম প্রজাতির গাছে বসবাসকারী ফিঞ্চ দেখা যায়। এদের মধ্যে চারটি প্রজাতির ঠোঁট পতঙ্গ ভক্ষণ করার জন্য, যাদের মধ্যে একটি বড় ও লম্বা (বড় পতঙ্গ ভক্ষণ করতে পারে) এবং বাকি তিনটি ছোট (ক্ষুদ্র পতঙ্গ ভক্ষণ করে)। আরেক প্রকার ফিঞ্চের ঠোঁট টিয়া পাখির মতো, তারা ফল ও গাছের মুকুল ভক্ষণ করে, অপর একটি ফিঞ্চের ঠোঁটের গঠন তীক্ষ্ণ তাদের কাঠঠোকরা ফিঞ্চ বলা হয়। এ ছাড়া ক্যাকটাস খাদক ফিঞ্চ দেখা যায়।
  3. সবুজ ওয়ার্বলার ফিঞ্চ: এই পাখিগুলি স্থলজ এবং গাছে বসবাসকারী ফিঞ্চ পাখিদের থেকে আলাদা। এরা প্রধানত পতঙ্গভুক। এদের ঠোঁট সরু ও লম্বা। গাছের পাতা থেকে পতঙ্গ সংগ্রহ করে এরা ভক্ষণ করে।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Schluter, Dolph (২০০০)। The Ecology of Adaptive Radiation। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 10–11। আইএসবিএন 0-19-850523-X 
  2. Larsen, Clark S. (২০১১)। Our Origins: Discovering Physical Anthropology (2 সংস্করণ)। Norton। পৃষ্ঠা A11। 
  3. Yoder, J. B.; Clancey, E.; Des Roches, S.; Eastman, J. M.; Gentry, L.; Godsoe, W.; Hagey, T. J.; Jochimsen, D.; Oswald, B. P.; Robertson, J.; Sarver, B. A. J. (২০১০)। "Ecological opportunity and the origin of adaptive radiations: Ecological opportunity and origin of adaptive radiations"। Journal of Evolutionary Biology (ইংরেজি ভাষায়)। 23 (8): 1581–1596। এসটুসিআইডি 25334971ডিওআই:10.1111/j.1420-9101.2010.02029.xঅবাধে প্রবেশযোগ্যপিএমআইডি 20561138 
  4. Simpson, G (১৯৪৯)। "Tempo and Mode in Evolution"। Transactions of the New York Academy of Sciences। New York: Columbia University Press। 8: 45–60। ডিওআই:10.1111/j.2164-0947.1945.tb00215.xপিএমআইডি 21012247 
  5. Grant, David R.; Grant, B. Rosemary (২০১৪)। 40 years of Evolution: Darwin's Finches on Daphne Major Island। Princeton: Princeton University Press। পৃষ্ঠা 16আইএসবিএন 978-0691160467  অজানা প্যারামিটার |name-list-style= উপেক্ষা করা হয়েছে (সাহায্য)

আরও পড়ুন

[সম্পাদনা]