র‍্যনে জিরার

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
র‍্যনে জিরার
René Girard
র‍্যনে জিরার (২০০৭ খ্রিস্টাব্দে তোলা আলোকচিত্র)
জন্ম
র‍্যনে নোয়েল তেওফিল জিরার

(১৯২৩-১২-২৫)২৫ ডিসেম্বর ১৯২৩
আভিনিয়োঁ, ফ্রান্স
মৃত্যু৪ নভেম্বর ২০১৫(2015-11-04) (বয়স ৯১)
স্ট্যানফোর্ড, ক্যালিফোর্নিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
শিক্ষাএকল নাসিওনাল দে শার্ত (কলাবিদ্যায় স্নাতকোত্তর)
ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি (ডক্টরেট)
পরিচিতির কারণমৌলিক নৃবিজ্ঞান
অনুকরণমূলক অভিলাষ
অনুকরণমূলক উভয়-সঙ্কট
উৎসর্গমূলক ক্রিয়ার উৎস এবং মানব সংস্কৃতির ভিত্তি হিসেবে বলির পাঁঠা কর্মপদ্ধতি
দলীয় সংঘাতের উপরে জিরারের তত্ত্ব
দাম্পত্য সঙ্গীমার্থা জিরার[১]
সন্তান
পুরস্কারআকাদেমি ফ্রঁসেজ (৩৭নং আসন)
লেজিওঁ দনর-এর শ্যভালিয়ে (নাইট)
অর্দ্র দেজার এত দে লেত্র-এর কোমঁদর
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন
প্রতিষ্ঠানসমূহডিউক ইউনিভার্সিটি,
ব্রিন মর কলেজ,
জন্‌স হপকিন্‌স ইউনিভার্সিটি,
স্টেট ইউনিভার্সিটি অভ নিউ ইয়র্ক অ্যাট বাফেলো,
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি
ডক্টরেট শিক্ষার্থীস্যান্ডর গুডহার্ট
অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থীগামালিয়েল আলতামারিনো কানসিনো, অ্যানড্রিউ ফিনবার্গ
যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেনক্লোদ লেভি-স্ত্রাউস
যাদেরকে প্রভাবিত করেছেনরেমুন্ড শভাগার, জেমস অ্যালিসন, রবার্ট ব্যারন
স্বাক্ষর

র‍্যনে নোয়েল তেওফিল জিরার (ফরাসি: René Noël Théophile Girard) (২৫শে ডিসেম্বর ১৯২৩ – ৪ঠা নভেম্বর ২০১৫) একজন ফরাসি ইতিহাসবিদ, সাহিত্য সমালোচক এবং সামাজিক বিজ্ঞানের দার্শনিক। জিরার উচ্চশিক্ষায়তনিক অঙ্গনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় ৩০টি পুস্তক রচনা করেছেন। তাঁর কর্ম বিংশ ও একবিংশ শতকের সাহিত্য সমালোচনা, সমালোচনামূলক তত্ত্ব, নৃবিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, পুরাণতত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, অর্থশাস্ত্র, সাংস্কৃতিক গবেষণা ও দর্শনের উপরে ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

দর্শনশাস্ত্রে (এবং এর সূত্র ধরে অন্যান্য উচ্চশিক্ষায়তনিক ক্ষেত্রগুলিতে) জিরারের মূল অবদান ছিল অভিলাষের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও নৈতিক ব্যবস্থাসমূহ-সংক্রান্ত উপক্ষেত্রে তাঁর গবেষণা। জিরার বিশ্বাস করতেন যে প্রাথমিকভাবে একটি পর্যবেক্ষণভিত্তিক অনুকরণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানুষের বিকাশ ঘটে। একটি শিশু প্রাপ্তবয়স্কদের আচরণ নকল করা শেখার মাধ্যমে ঐ শিশুর মধ্যে অভিলাষের বিকাশ ঘটে। শিশু তথা ভবিষ্যৎ প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির মধ্যে পরিচিতি, জ্ঞান ও বস্তুগত সম্পদ অর্জনের যে অভিলাষ কাজ করে, জিরারের মতে তার মূল ভিত্তি হল অন্যকে অনুকরণ করা অর্থাৎ অন্যের যা আছে, তা নিজের কাছেও থাকার অভিলাষ।

মানবসমাজে যত প্রতিযোগিতা, দ্বন্দ্ব বা সংঘাত আছে, জিরারের মতে এর সবকিছুর মূলে আছে এই অনুকরণমূলক অভিলাষ। ব্যক্তিতে-ব্যক্তিতে বা গোষ্ঠীতে-গোষ্ঠীতে এই অভিলাষজনিত দ্বন্দ্ব-সংঘাত শেষ পর্যন্ত যখন বিপজ্জনক এক ধ্বংসাত্মক ধাপে গিয়ে পৌঁছায়, তখন এই সংঘাতকে হালকা বা লঘু করার জন্য অন্য কোনও ব্যক্তি বা বস্তুকে বলির পাঁঠা বানানো হয়, জিরার যার নাম দিয়েছেন বলির পাঁঠা কর্মপদ্ধতি। মানুষ সাধারণত সংঘাতের কারণ হিসেবে তার নিজের অবদান বা অংশীদারত্বের দায়িত্ব নিতে চায় না কিংবা এ নিয়ে আত্ম-সমালোচনা করতে নারাজ থাকে। এর পরিবর্তে মানুষেরা দলমত নির্বিশেষে একত্রিত হয় এবং সংঘাতে যার সবচেয়ে কম জনসমর্থন আছে (যেমন কোনও অজনপ্রিয় রাজা বা শাসক, কোনও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, কোনও বিদেশী ব্যক্তি বা দল, ইত্যাদি), সেই ব্যক্তি বা দলকে হত্যা করে নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত লঘু করার প্রচেষ্টা চালায়। এভাবে কাউকে হত্যার পরে তারা নিজেদেরকে বলে যে তাদের মধ্যে সংঘাতজনিত উত্তেজনা অনেক হ্রাস পেয়েছে এবং তারপরে নিহত রাজা বা ব্যক্তিকে মানুষ দেবতা, দেবতাতুল্য মানব, বা সাধুর আসনে অধিষ্ঠিত করে। অথবা তারা নিজেদের মধ্যে সংঘাতের কারণ হিসেবে সম্পূর্ণ নিরপরাধ তৃতীয় কোনও পক্ষকে অভিযুক্ত করে, যে তৃতীয় পক্ষকে হত্যা করার প্রক্রিয়াটি একটি সাধারণ একত্রীকরণমূলক পৌরাণিক ভিত্তিস্তর হিসেবে একটি মানব সংস্কৃতির জন্ম দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে কাজ করে।

জিরারের মতে এ কারণেই ধর্ম ও পুরাণের উৎপত্তি মানব সমাজ, সভ্যতা ও ইতিহাসের বিবর্তনের অপরিহার্য ধাপ ছিল। অনুকরণমূলক দ্বন্দ্ব ও অভীষ্ট বস্তুসমূহের অসম বিতরণ থেকে স্বাভাবিকভাবেই যে হিংস্রতার সৃষ্টি হয়, তাকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যেই পুরাণ ও ধর্মের উৎপত্তি। ধর্ম কাউকে বলির পাঁঠা বানানোর প্রবৃত্তিকে কাল্পনিক ধারণার দিকে ধাবিত করে; যেমন অন্য ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়, বরং অশুভ অপদেবতা বা শয়তানকে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের জন্য দায়ী করা হয়। তাই যদি ধর্ম না থাকতো, তাহলে জিরারেত মতে মানুষে মানুষে সংঘাত অনেক বেশি বৃদ্ধি পেত। জিরারের এই চিন্তাধারা ছিল বিংশ শতাব্দীতে তাঁর জীবদ্দশাতে বহুল প্রচলিত উত্তর-আধুনিকতাবাদের ঘোর বিরোধী। মানব প্রকৃতি নিয়ে মূলধারায় প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গিগুলির তুলনায় জিরারের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনেক বেশি নিরাশাবাদী। তিনি মনে করতেন ধর্ম ও ধর্মীয় রচনাবলির মূল উদ্দেশ্য হল সংঘাত নিরসনের লক্ষ্যে কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে বলির পাঁঠা বানিয়ে যেন হত্যা না করা হয়, তা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে তাঁর চিন্তাধারাতে ফ্রিডরিখ নিচে-র চিন্তাধারার প্রভাব ও সম্প্রসারণ লক্ষ্য করা যায়।

জিরার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় জন্‌স হপকিন্‌স ইউনিভার্সিটি-তে ১৯৫৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত এবং এর পরে ১৯৮২ সাল থেকে অবসর গ্রহণের আগ পর্যন্ত আরেক খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটি-তে অধ্যাপনা করেন। সারা জীবনের অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০০৫ সালের ১৭ই মার্চ তারিখে তাঁকে ফ্রান্সের মর্যাদাবাহী উচ্চশিক্ষায়তনিক প্রতিষ্ঠান আকাদেমি ফ্রঁসেজ তাঁকে ৪০ জন "অমর" (লেজিমর্তেল Les immortels) সদস্যের একজন হিসেবে মনোনীত করে। দীর্ঘদিন রোগে ভোগার পরে জিরার ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড শহরে তার নিজস্ব বাসভবনে ৯১ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন।[১]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Haven, Cynthia (নভেম্বর ৪, ২০১৫)। "Stanford professor and eminent French theorist René Girard, member of the Académie Française, dies at 91"Stanford University। সংগ্রহের তারিখ নভেম্বর ৪, ২০১৫