উইস্কট অল্ড্রিচ সিনড্রোম

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

উইস্কট-অল্ড্রিচ সিনড্রোম (ইংরেজি: Wiskott-Aldrich Syndrome) একটি বিরল বংশগত রোগ। মানবদেহের X-ক্রোমজমের রিসেসিভ (recessive) ত্রুটির কারণে এই রোগ হয়, ফলে সাধারণত পুরুষদের হয়। সাধারণ ভাবে এই রোগের তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকে:

  1. একজিমা,
  2. স্বল্প প্লেটিলেট (platelet) বা অণুচক্রিকা, এবং
  3. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার অভাব।

প্লেটিলেট কম হলে রক্তক্ষরণের প্রবণতা বাড়ে। এই রোগে তা অনেক সময় এত কম হয় যে, মলের সাথে রক্তক্ষরণ হয়।

প্যাথোফিজিওলজি[সম্পাদনা]

মানব দেহের X-ক্রোমজমের অন্যতম কাজ হল উইস্কট-অল্ড্রিচ সিনড্রোম প্রোটিন (WASP) নামে এক ধরনের প্রোটিন তৈরী করা। এই প্রোটিন (WASP) সকল রক্ত কোষে থাকে। রোগ প্রতিরোধের জন্য অতীব প্রয়োজনীয় লিম্ফোসাইট ও এন্টিবডির স্বাভাবিক কাজ করার ক্ষমতা এবং প্লেটিলেট তৈরীর জন্য এই প্রোটিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উইস্কট-অল্ড্রিচ সিনড্রোম নামক রোগে উক্ত প্রোটিন উৎপাদনকারী জ্বীনের ত্রুটির কারণে এই প্রোটিনটির ঘাটতি দেখা দেয়। ফলে উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্য সমূহ দেখা দেয়।

এপিডেমিওলজী[সম্পাদনা]

এ রোগটি অত্যন্ত বিরল। সাধারণ জনসংখ্যার হিসেবে প্রতি দশ লক্ষ মানুষের মধ্যে এক থেকে দশ জনের এ রোগ হয়। যেহেতু পুরুষদের দেহে একটি মাত্র X-ক্রোমজম থাকে, তাই এই রোগটি পুরুষ দেহে হয়। নারী দেহে এটি হয় না বললেই চলে, যদিও তা পাওয়া যাওয়ার খবর আছে।

রোগের লক্ষনসমূহ[সম্পাদনা]

সাধারণত জীবনের প্রথম দুই বছরের মধ্যে এই রোগ দেখা দেয়। তবে জন্ম থেকে পচিশ বছর বয়সের মধ্যে যেকোন বয়সেই এ রোগের লক্ষন সমূহ প্রকাশ পেতে পারে। মোটামুটি ৯০% ক্ষেত্রে স্বল্প প্লেটিলেট নিয়ে এই রোগ প্রকাশ পায়। এক তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে উপরিউক্ত তিনটি বৈশিষ্ট্যের সব গুলো এবং ৫% ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ইনফেশন ও ২০% ক্ষেত্রে শুধুমাত্র রক্ত ক্ষরন থাকে।

রক্ত ক্ষরন জনিত সমস্যাগুলো নিম্নরূপঃ

  • মশার কামড়ের মত বা তার চেয়ে বড় চামড়ার নিচে লাল বা কাল ছোট ছোট দাগ হওয়া।
  • দাঁত ও মাড়ি এবং নাক দিয়ে রক্তপাত।
  • রক্ত পায়খানা।
  • নবজাতকের নাভী কাটা অংশ থেকে রক্তক্ষরণ।
  • মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, যা জন্মের সময়ও মাথায় আঘাতের কারণে হতে পারে।

ইনফেকশন জনিত সমস্যাগুলো সাধারণত জন্মের তিন মাস পর দেখা দেয়। কারণ গর্ভাবস্থায় মায়ের শরীর থেকে যে এন্টিবডিগুলো বাচ্চার শরীরে আসে, তা এই সময়ের মধ্যে নিঃশেষ হয়ে যায়। সাধারণত পুনঃ পুনঃ নিউমোনিয়া, সাইনুসাইটিস কিংবা মেনিঞ্জাইটসের আকারে এই ইনফেকশন দেখা দেয়।

একজিমা জনিত সমস্যাগুলো জন্মের প্রথম বছরেই শরীরের বিভিন্ন অংশে দেখা দেয়। এটি সর্দির আকারেও দেখা দিতে পারে এবং ইনফেকশন জনিত সমস্যার সময় প্রকট হতে পারে। অটোইমিউন জাতীয় সমস্যাগুলোর মধ্যে আছে অটোইমিউন হিমোলাইটিক এনিমিয়া বা লোহিত কনিকা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণে রক্তশুন্যতা এবং একই কারণে প্লেটিলেট স্বল্পতা বা থ্রম্বোসাইটোপেনিয়া, কিডনীর প্রদাহ জনিত কারণে অকেজো হওয়া, আরথ্রাইটিস বা গিটে ব্যাথা, স্ট্রোক, ভাসকুলাটিস ইত্যাদি। রক্তশুন্যতা যে কোন বয়সেই দেখা দিতে পারে, তবে তা সাধারণত ৫ বছর বয়সের মধ্যেই দেখা দেয়। এই রোগে ক্যান্সার হতে পারে তবে তা প্রাপ্ত বয়স্কদের ক্ষেত্রেই সাধারণত দেখা যায়। ক্যান্সারগুলোর মধ্যে লিম্ফোমা এবং লিউকেমিয়ার প্রবণতা বেশি।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও তার ফললাফল
  • প্লেটিলেট (platelet) সংখ্যা কম (<৭০,০০০/মি,লি) এবং তা আকারে ছোট (<৫ ফে,লি)।
  • IgG ও IgM এন্টিবডির পরিমাণ কম, কিন্তু IgA ও IgE এন্টিবডির পরিমাণ বেশি হয় (বয়সের সাথে সামঞ্জস্যতা প্রযোজ্য)।
  • অটোইমিউন হিমোলাইটিক এনিমিয়া (autoimmune hemolytic anemia)-র জন্য কূম্বস টেষ্ট এবং একই কারণে রক্ত স্বল্পতা ও প্লেটিলেট স্বল্পতায় অস্বাভাবিক এন্টিবডির উপস্থিতি।
  • রক্ত কোষের ফ্লোসাইটোমেট্রি পরীক্ষার মাধ্যমে উইস্কট-অল্ড্রিচ সিনড্রোম প্রোটিনের ঘাটতি এবং জেনেটিক পরীক্ষার মাধ্যমে উইস্কট-অল্ড্রিচ সিনড্রোম প্রোটিন (WASP) জীনের ত্রুটি নির্নয় এই রোগের নিশ্চিত পরীক্ষা যা সকল ক্ষেত্রে পাওয়া যায়। এই জেনেটিক পরীক্ষা রোগীর মা এবং মাতৃকুলের সকল পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

সাধারণ চিকিৎসা[সম্পাদনা]

• ইনফেশনের জন্য সঠিক এন্টিবায়োটিক। • রক্ত ক্ষরনের জন্য প্লেটিলেট কিংবা প্রয়োজনে লাল রক্ত ট্রান্সফিউশন। প্রিডনিসোলন জাতীয় ষ্টেরয়েড ঔষধ অনেক ক্ষেত্রে প্লেটিলেটের পরিমাণ বাড়ায়, তবে তা সাময়িক। মারাত্মক ক্ষেত্রে স্প্লীন কেটে ফেলা যায়, কিন্তু তা ইনফেকশনের ঝুকি আরও বাড়িয়ে দেয় যা ইতমধ্যেই একটি সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। • একজিমার চিকিৎসার জন্য ময়শ্চারাইজিং ও ষ্টেরয়েড ক্রীম ব্যবহার হয়।

প্রতিকার মূলক চিকিৎসা

বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টেশনই এক মাত্র প্রতিকার মূলক চিকিৎসা।

পরিণতি[সম্পাদনা]

ইনফেকশন প্রতিরোধ, ট্রান্সফিউশন ও ট্রান্সপ্লান্ট ব্যবস্থার উন্নতির ফলে বিগত বছরগুলোতে এই রোগের সম্ভাব্য পরিণতিতে প্রভূত উন্নতি সাধিত হয়েছে। ৯০% রোগী বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্টের দ্বারা সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ করে থাকে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যায়। তবে এর দ্বারা বংশ গতির ধারা পরিবর্তিত হয় না। অর্থাৎ আরোগ্য লাভের পরও তার বংশধরদের মধ্যে এই রোগ প্রবাহিত হয়। বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়া রোগী তার জীবনের দ্বিতীয় বা তৃতীয় দশকে রক্ত ক্ষরন, ইনফেকশন বা ক্যন্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]