বিষয়বস্তুতে চলুন

ব্যবহারকারী:DelwarHossain/জমি আন্দোলন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

আন্দোলনের ইতিহাস

[সম্পাদনা]

আন্দোলনের নাম নন্দীগ্রাম। ২০০৭ সালের পর থেকে রাজ্য রাজনীতির ওঠা-পড়ায় জ্বলন্ত ভূমিকা রয়েছে এই এলাকার। এমনকী জমি আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে ‘নন্দীগ্রামের জেলা’ বলে পরিচিতি পেয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই ভুলতে বসেছেন এই আন্দোলনের ইতিহাস নিতান্ত বিচ্ছিন্ন নয়। স্বাধীনতা আন্দোলন তো বটেই, এমনকী তারও আগে পুলিশি নির্যাতন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন এখানকার মানুষ। অধিকার রক্ষার সে লড়াইয়ের কথা আজও স্থানীয় মানুষের মুখে মুখে ফেরে। আর অদ্ভুত ভাবে সেই আন্দোলনেও রয়েছে সাম্প্রতিক সমস্যার ছায়া। জানা যায়, ১৩০২ সন অর্থাৎ ইংরাজি ১৯০৩ সালে এই নন্দীগ্রাম এলাকাতেই শুরু হয়েছিল বেআইনি অর্থ লগ্নির ব্যবসা। গোপাল রায় নামে এক ব্যক্তি জুয়াচুরি খেলা শুরু করেন। প্রথম সপ্তাহে তার কাছে টাকা রাখলে পরের সপ্তাহে আসলের অর্ধেক টাকা মুনাফা পেতে পারেন কোনও ব্যক্তি। লোভে পড়ে সাধারণ মানুষ এখানে টাকা রাখতে শুরু করেন এবং প্রতারিত হন। গোপালের সঙ্গে নন্দীগ্রামের দারোগা রায়মোহন ঘোষের সুসম্পর্ক ছিল। তার প্রশ্রয়েই গোপালের বাড়বাড়ন্ত। প্রতারিত আমানতকারীরা টাকা ফেরতের দাবিতে গোপালের বাড়ি ঘেরাও করলে রায়মোহন দারোগা লাঠিচার্জের হুকুম দেন। এতে বিক্ষোভ আরও বাড়ে, ক্ষিপ্ত বাসিন্দারা উল্টে পুলিশকেই তাড়া করে। গোপাল পালালেও ধরা পড়ে যান দারোগা। পরে তাকে গণ পিটুনি দিয়ে খড়ের গাদায় আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মারেন স্থানীয় বাসিন্দারা। এরপর থানা, ডাকঘর-সহ নন্দীগ্রামের বিভিন্ন সরকারি অফিসে আগুন লাগিয়ে দেন তাঁরা। ঘটনায় ব্রিটিশ পুলিশ গোপাল-সহ মোট পাঁচশো জনকে গ্রেফতার করে। দারোগাকে পুড়িয়ে মারার অপরাধে নন্দীগ্রামের তিনজন বাসিন্দার ফাঁসিও হয়। নন্দীগ্রামের মনুচকের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কানাইলাল দাস নন্দীগ্রামের ইতিহাস নিয়ে চর্চা করেন। তিনি বলেন, ‘‘এই ঘটনাটির সঙ্গে ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সরাসরি কোনও যোগাযোগ নেই। তবে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভের আগুন যে ভাবে ছড়িয়েছিল, তা উদ্বুদ্ধ করেছিল সশস্ত্র সংগ্রামকেও।’’ গোপাল রায়ের জুয়াচুরিকে মনে রেখে আজও মুখে মুখে ফেরে ছড়া— “কি খেলা খেলিলি গোপাল/ নন্দীগ্রামের বাজারে,/ খেলার তাপে, গুমগড় কাঁপে/ রাইমন দারোগা পুড়ে মরে,/ খড়ের গাদার ভিতরে।’’ নন্দীগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ‘গুমগড়’ নামটিও। অধরচন্দ্র ঘটকের ‘নন্দীগ্রামের ইতিবৃত্ত’ বইতে রয়েছে এই নামের উল্লেখ। অধরবাবু লিখেছেন, ‘সুদূর অতীত যুগে তাম্রলিপ্ত যখন একটি স্বতন্ত্র বিরাট সাম্রাজ্য ও সমৃদ্ধ সম্পন্ন বাণিজ্য বন্দর ছিল তখন পার্শ্ববর্তী মহিষাদল, দরো, গুমগড়, কেওড়ামাল ও হিজলি পরগনা গুলির অবস্থিতি জ্ঞাপক ভূমিখণ্ড সকল সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত ছিল। কালক্রমে ভাগীরথী, রূপনারায়ণ বা কংসাবতীর স্রোত-প্রবাহে উচ্চ ভূমিভাগের ক্ষয়িত মৃত্তিকায় স্থানগুলি পৃথক পৃথক দ্বীপে সূচিত হইয়া ক্রমে ক্রমে বঙ্গোপসাগর থেকে আত্মপ্রকাশ করিয়া মানুষের বসবাসের উপযোগি হয়।’ খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতকেও নন্দীগ্রাম ছিল সমুদ্রের তলায় ছিল। সে সময়েই নন্দীগ্রামের নাম ছিল গুমগড়। ধীরে ধীরে সমুদ্র থেকে চর, জঙ্গল তৈরি হয়। পরে সেই জঙ্গল কেটে বসতি গড়ে মানুষ। কিন্তু ঠিক কবে থেকে মানুষের বাসোপযোগি হয়ে উঠল নন্দীগ্রাম, সে ইতিহাস পাওয়া যায় না। যা কিছু ইতিহাস পাওয়া গিয়েছে এ অঞ্চলের তা মুঘল আমল থেকে। ওড়িয়া ভাষায় লেখা ‘চৌধুরি চরিত’ থেকে জানা যায় গুমগড়ের রাজা নন্দীগোপাল রায়চৌধুরির নাম অনুসারে পরে এই এলাকার নাম হয় নন্দীগ্রামের। ‘চৌধুরি চরিত’ অনুযায়ী সপ্তদশ শতকে হিজলিতে তাজ খাঁ নামে একজন রাজা ছিলেন। তার কর্মচারী ছিলেন ব্রজগোপাল রায়চৌধুরি। মহিষাদলের রাজার সঙ্গে তাজ খাঁর সন্ধি হলে শর্ত অনুযায়ী গুমগড় পরগনাটি তাজ খাঁর হাতে তুলে দেন মহিষাদলের রাজা। পরে ব্রজগোপালের কর্মদক্ষতায় খুশি হয়ে তাজ খাঁ তাকেই রাজা উপাধি দিয়ে গুমগড় পরগনা দান করেন। সম্পর্কে ব্রজগোপাল মহিষাদলের রাজা কল্যাণ রায়চৌধুরির আত্মীয়। এই ব্রজগোপাল রায়চৌধুরির ছেলেই নন্দীগোপাল রায়চৌধুরি। নন্দীগ্রাম থানার তাজপুর গ্রামে দ্বারকানাথ মণ্ডলের বাড়ি থেকে ওড়িয়া ভাষায় লেখা তালপাতার একটি পুঁথি পাওয়া যায় বলে জানিয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষক কানাইলাল দাস। সেই পুঁথিতে গুমগড়ের চৌধুরি রাজবংশের উপাখ্যান রয়েছে। রয়েছে নন্দীগ্রামের নামকরণের বিষয়টি— “আপন নামে নন্দীগ্রাম,/ দ্বিতীয় গড় রাণীর নাম।/ লগ্নামনি সে ভেটুরাতে,/ কাশী স্থানই তৃতীয়েতে।/ গড়িল গড়কাশী নামে,/ সে যে ঘোলপুকুর গ্রামে”। অর্থাৎ, নিজের নামে নামে নন্দীগ্রাম, রানির নামে ভেটুরাতে লগ্নামণিগড় এবং ঘোলপুকুরে গড়কাশী নির্মাণ করেন রাজা নন্দীগোপাল। নন্দীগ্রামের বাসিন্দা তথা আরএসপির জেলা সম্পাদক অমৃত মাইতি বলেন, ‘‘নন্দীগ্রামের মানুষ বরাবরই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, নিজেদের অধিকার রক্ষার লড়াই করেছেন। ভূপাল পাণ্ডার নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, নন্দীগ্রাম উন্নয়ন পরিষদ তৈরি করে এলাকার উন্নয়নের দাবিতে আন্দোলন এবং সর্বশেষ কেমিক্যাল হাবের বিরুদ্ধে আন্দোলন তার প্রমাণ দিয়েছে। নন্দীগ্রামের মানুষ সংগ্রামী।’’ ১৯৪২ সালে স্বদেশি আন্দোলনে নন্দীগ্রামের অনেক অবদান অনেক। পরবর্তী সময়ে ভূপালচন্দ্র পাণ্ডার নেতৃত্বে নন্দীগ্রামে ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। নন্দীগ্রাম কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক দিলীপ তিওয়ারি জানান এক সময় নন্দীগ্রাম ছিল হলদি ও হুগলি নদী আর বিভিন্ন খাল দিয়ে ঘেরা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। রাস্তা বলতে ছিল তেরপেখ্যা পর্যন্ত প্রায় ১০কিলোমিটার পিচ রাস্তা ছিল। বিদ্যুৎ, পানীয় জল হাসপাতাল কিছুই ছিল না। এ সবের দাবিতে বাসিন্দারা ১৯৮২ সালে নন্দীগ্রাম উন্নয়ন পরিষদ গড়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন। ১৯৮২ সালের ২৫ শে মার্চ নন্দীগ্রামের বাসিন্দারা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। সে দিন পুলিশের ছোড়া গুলিতে খুন হয়েছিলেন দিলীপবাবুর ছেলে সুদীপ্ত তিওয়ারি। আহত হয়েছিলেন বহু মানুষ। আন্দোলনের আবহ ফিরে আসে ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে। কেমিক্যাল হাব গড়ার জন্য নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণ করতে চেয়েছিল তৎকালীন বাম সরকার। তার বিরুদ্ধে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি গড়ে জমি রক্ষার আন্দোলন শুরু করেছিলেন বাসিন্দারা। ২০০৭ সালের ১৪ ই মার্চ পুলিশের গুলিতে ১৪ জন আন্দোলনকারীর মৃত্যু হয়। দেশ জুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। শেষ পর্যন্ত রাজ্য সরকার ঘোষণা করতে বাধ্য হয় জমি নেওয়া হবে না।[]

তথ্যসুত্র

[সম্পাদনা]

টেমপ্লেট:সুত্র তালিকা

  1. "গুমগড়ের ইতিহাস ধরে রেখেছে আন্দোলন"আনন্দবাজার পত্রিকা। ২৬ জুলাই ২০১৫। সংগ্রহের তারিখ ৩০ মে ২০১৯