জগজ্জীবনপুর তাম্রশাসন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
জগজ্জীবনপুর তাম্রশাসন সম্মুখভাগ

জগজ্জীবনপুর তাম্রশাসন নবম শতাব্দীর পালবংশীয় রাজা মহেন্দ্রপালের তাম্রশাসন, ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে যার আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে এই রাজার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়েছে এবং দেবপাল-পরবর্তী পাল রাজাদের ক্রম ও বংশলতিকা নির্ণয়ে দীর্ঘকালের প্রমাদ ও রহস্য দূরীভূত হয়েছে। এই তাম্রলিপির ১৭শ-১৯শ পঙ্‌ক্তি থেকে প্রতিপন্ন হয়েছে যে, পালবংশীয় রাজা দেবপাল এবং তদীয় মহিষী মাহটার পুত্র মহেন্দ্রপাল ছিলেন চতুর্থ পালরাজা এবং স্বীয় ভ্রাতা পঞ্চম পালরাজা প্রথম শূরপালের পূর্বসূরী। দেবপালের পর মহেন্দ্রপাল নবম শতাব্দীতে কমপক্ষে পনের বছর রাজত্ব করেছিলেন বলে নিশ্চিত ধারণা করা হয়।[১]

আবিষ্কার[সম্পাদনা]

মালদা জেলার সদর মহকুমার হাবিবপুর থানার অন্তর্গত জগজ্জীবনপুর মৌজার দাগ নং ৬৩৯-এ তুলাভিটা বা সলাইডাঙা নামে একটি সওয়া-পাঁচ মিটার উঁচু ঢিপিতে ১৯৮৭ সালের ১৩ই মার্চ এটি আবিষ্কৃত হয়। এই জায়গাটি মালদা শহর থেকে প্রায় ৩৬ কি.মি. পূর্বে। জগদীশচন্দ্র গাঁই নামে স্থানীয় কৃষক তার জমি কোপানোর সময় এটি আবিষ্কার করেন।[২] বর্তমানে এই তাম্রশাসনটি মালদা জেলা জাদুঘরে রাখা আছে। এই আবিষ্কারের পর প্রথমে সুধীন দে ও পরে অমল রায়ের নেতৃত্বে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরাতত্ত্ব ও জাদুঘর অধিকরণের গবেষকরা তুলাভিটা ও সন্নিহিত অঞ্চলে খননকার্য চালান, ফলে একটি বৌদ্ধ বিহারের (নন্দদীর্ঘিকা-উদ্রঙ্গ মহাবিহার) ধ্বংসাবশেষ ও অন্যান্য পুরাকীর্তি পাওয়া যায়।

বিবরণ[সম্পাদনা]

তামার পাতটি আয়তাকার, ৩৮ সে.মি. লম্বা এবং ৫২.৫ সে.মি. চওড়া। ওপরে পালবংশীয় রাজচক্র ঢালাই করে লাগানো, রাজচক্রের নিচে লেখা শ্রীমহেন্দ্রপালদেবঃ। রাজচক্রটি ২০ সে.মি. লম্বা এবং ২২ সে.মি. চওড়া। তামার পাতের সামনের দিকে ৪০ পঙ্‌ক্তি এবং পেছনের দিকে ৩৩ পঙ্‌ক্তি লেখা আছে। ভাষা পদ্য-গদ্যাত্মক সংস্কৃত। লিপি তৎকালীন সিদ্ধমাতৃকা[৩]। এই লিপি সিদ্ধং লিপি থেকে বিকশিত এবং বর্তমান বাংলা লিপির পূর্বসূরী।

ছন্দ: শ্লোক ১৭-১৯, ২১, ২৩: অনুষ্টুভ্; শ্লোক ২৪: ইন্দ্রবজ্রা; শ্লোক ২, ২৫, ২৯: মালিনী; শ্লোক ৩৪: মন্দাক্রান্তা; শ্লোক ২০: পুষ্পিতাগ্রা; শ্লোক ১, ৪, ৮, ১০, ১৪-১৫, ২৬, ৩১: শার্দূল-বিক্রীড়িত; শ্লোক ৫, ২৭, ৩২: স্রগ্ধরা; শ্লোক ৩, ৬-৭, ১২-১৩, ১৬, ২২, ৩৩: বসন্ততিলক; শ্লোক ৯, ১১, ২৮, ৩০: উপজাতি।

তাম্রশাসনটি মহেন্দ্রপালের রাজত্বের সপ্তম বছরে উৎকীর্ণ এবং এতে মহেন্দ্রপাল কর্তৃক পুণ্ড্রবর্ধন ভুক্তির কুণ্ডলখাতক বিষয়ে নন্দদীর্ঘিকা শহরে পূর্বপ্রতিষ্ঠিত বৌদ্ধ বিহারের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সমগ্র নন্দদীর্ঘিকা শহরটি দান করা হয়েছে।

১৯৯১ সালে কমলাকান্ত গুপ্তের পাঠোদ্ধার প্রকাশিত হয় ঢাকার ইতিহাস পরিষৎ পত্রিকায় এবং পরের বছর কোলুবেল ব্যাসরায় রমেশ ও এস. সুব্রহ্মণ্য আয়ারের পাঠোদ্ধার ও ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণের এপিগ্রাফিয়া ইন্ডিকা ৪২তম খণ্ডে। এই সংস্করণে নানারকম ভুল ছিল, পরে ২০০৬ সালে সুরেশচন্দ্র ভট্টাচার্য সংশোধিত রূপ প্রকাশ করেন[৪]

ঐতিহাসিক গুরুত্ব[সম্পাদনা]

আগে ঐতিহাসিকরা মনে করতেন যে দেবপালের পর রাজা হন তার খুড়তুতো ভাইয়ের ছেলে প্রথম বিগ্রহপাল। বিভিন্ন সমকালীন অভিলেখে শূরপাল ও মহেন্দ্রপাল নামে আরও দুই রাজার নাম পাওয়া যায়। মনে করা হত শূরপাল বিগ্রহপালেরই অপর নাম এবং মহেন্দ্রপালকে ধরা হত গুর্জর-প্রতিহার রাজা প্রথম মহেন্দ্রপাল। ১৯৭০ সালে শূরপালের মির্জ়াপুর তাম্রশাসন (বর্তমানে লখনউ জাদুঘরে রক্ষিত) আবিষ্কারের পর এই রাজার আলাদা অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয় এবং এই রাজাকে প্রথম শূরপাল ধরে নিয়ে দীনেশচন্দ্র সরকার ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত তার পাল-সেন যুগের বংশানুচরিত গ্রন্থে পাল রাজাদের ক্রম ও বংশলতা পুনর্গঠন করেন। জগজ্জীবনপুর তাম্রশাসন থেকে পালবংশীয় রাজা হিসেবে মহেন্দ্রপালের অস্তিত্ব নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়, জানা যায় যে মহেন্দ্রপাল ও শূরপাল ছিলেন দেবপাল ও মাহটা দেবীর দুই পুত্র এবং দেবপালের পর রাজা হন মহেন্দ্রপাল। ফলে পালবংশের ক্রম আবার পুনর্গঠনের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৯৮৮ সালে গৌরীশ্বর ভট্টাচার্য South Asian Studies পত্রিকায় The New Pāla Ruler Mahendrapāla: Discovery of a Valuable Charter নিবন্ধে এবং ১৯৯৪ সালে দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায় তার Ancient India: History and Archaeology বইতে এই পুনর্গঠন করেন। গঙ্গোপাধ্যায় মহেন্দ্রপালের রাজত্বকাল নির্ধারণ করেন ৮৪৫-৮৬০ খ্রিষ্টাব্দ। ১৯৯৫ সালে এক মার্কিন সংগ্রাহকের ব্যক্তিগত সংগ্রহে পালযুগের দুইটি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হয়, যা প্রথম শূরপাল ও মাণিক্যদেবীর পুত্র গোপাল নামে রাজার চতুর্থ বর্ষে উৎকীর্ণ।[৫] ফলে পাল-বংশলতা আবার পরিবর্তিত হয়েছে।[৬]

এর আগে বিহার ও বাংলায় বিভিন্ন মূর্তির পাদদেশে উৎকীর্ণ মহেন্দ্রপালের নয়টি ক্ষুদ্র অভিলেখ পাওয়া গিয়েছিল, যা থেকে মনে করা হত প্রতিহার রাজা মহেন্দ্রপাল পাল সাম্রাজ্যের বিরাট অংশ দখল করে নিয়েছিলেন। জগজ্জীবনপুর তাম্রশাসন থেকে এখন এটা প্রতিষ্ঠিত যে আগের অভিলেখগুলি ছিল পালবংশীয় মহেন্দ্রপালের এবং তার সময়ে পাল সাম্রাজ্যের সীমানা অক্ষুণ্ণ ছিল।

টীকা ও সূত্র[সম্পাদনা]

  1. Essays on Buddhist Hindu Jain Iconography and Epigraphy: Gouriswar Bhattacharya, The International Centre for Study of Bengal Art, Dhaka, 2000, pp.407-409
  2. Interpreting a Stone and a Bronze Image of Malda Museum in West Bengal, গোপাল দাস, The Journal of Social Science Researcher, Vol III, No. 3, July 2014, pp. 34-40.
  3. প্রাক্-বাংলা লিপির এই নামটি দিয়েছিলেন প্রসিদ্ধ অভিলেখবিদ্ দীনেশচন্দ্র সরকার, আলবেরুণীর লেখা অনুসরণে। বর্তমানে ঐতিহাসিক মহলে এই নামই চালু।
  4. ভট্টাচার্য, সুরেশচন্দ্র, "The Jagajjibanpur Plate of Mahendrapāla Comprehensively Re-edited", Journal of Ancient Indian History, Vol. XXIII, 2005-2006, p. 61.
  5. The New Pāla Ruler, Gopāla (II), Son of Śūrapāla (I), গৌরীশ্বর ভট্টাচার্য, Facets of Indian Culture, 1998, pp. 177-181.
  6. পাল বংশলতার সর্বশেষ সংস্করণের জন্য দেখুন: মুখোপাধ্যায়, শ্যামচাঁদ, The Royal Charters of King Madanapāla and the Chronology of the Pāla Kings of Bengal and Bihar, Journal of Bengal Art, Vol. 4, 1999.