ইনকুইজিশন

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
ঊনবিংশ শতাব্দিতে আঁকা একটি চিত্রকর্মে গ্যালিলিও গ্যালিলিকে ক্যাথলিক চার্চের অফিসে যবানবন্দি দিতে দেখা যাচ্ছে

ইনকুইজিশন ছিল একটি বিচারিক পদ্ধতি এবং ক্যাথলিক চার্চের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলির একটি গ্রুপ যার লক্ষ্য ছিল ধর্মদ্রোহিতার বিরুদ্ধে লড়াই করা, সন্দেহভাজন ধর্মবিশ্বাসীদের বিচার পরিচালনা করা। রেকর্ডের অধ্যয়ন থেকে দেখা গেছে যে সিংহভাগ শাস্তির মধ্যে তপস্যা ছিল, কিন্তু অনুতাপহীন ধর্মদ্রোহিতার দোষী সাব্যস্ত করা ধর্মনিরপেক্ষ আদালতে হস্তান্তর করা হয়েছিল, যার ফলে সাধারণত মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।[১][২][৩]

মধ্যযুগের ক্যাথলিক চার্চের অধীনে কিছু প্রতিষ্ঠানকে বোঝায় যারা ক্যাথলিক মতবিরুদ্ধ ধর্ম বা চিন্তাধারাকে প্রতিহত করার কাজে লিপ্ত ছিল। মধ্যযুগে সম্রাট প্রথম কন্সটানটাইন ৩১৩ খ্রিষ্টাব্দে খ্রিষ্টান ধর্ম কে রোমান সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করেন এর পরপরই ইউরোপে খ্রিস্টধর্ম বিকাশের পালে হাওয়া লাগে আর ক্যাথলিক চার্চ ইউরোপে উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ক্ষমতা অর্জন করে। মধ্যযুগে সারা ইউরোপে যখন খ্রিস্টধর্ম অতিমাত্রায় বিকাশ হচ্ছিল সেসময় হেরেটিকদের বিরোধিতা ছিল। তারা সরাসরি খ্রিস্টান ধর্ম অস্বীকার করত এবং তাদের মতামত প্রচার করত। সেসময় খ্রিস্টান ধর্মের বিরোধীদের মুরতাদ-পন্থায় চিহ্নিত করা হতো। মুরতাদদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় ভাবে শায়েস্তা করার ব্যাপারে সাধু অগাস্টাইনের (৩৫৪-৪৩০) অনুমতি ছিলো। তিনি বিশ্বাস করতেন মুরতাদ-পন্থা খুন-খারাবির চেয়েও বেশি অনিষ্টকর।কারণ এটি আত্মার ক্ষতি ডেকে আনে।

বারো শতকে চার্চীয় দৃষ্টিতে ধরা পড়ে মুরতাদ পন্থার উত্থান ঘটছে সংগঠিতরূপে এক্ষেত্রে তাদের প্রথম শত্রু হয়ে দাঁড়ায় আলবিজেনশীয়রা। পোপ ইনোসেন্ট আলবিজেনশীয়দের ঐতিহ্যগত সামাজি প্রথা-প্রতিষ্ঠান বিরোধী ঘোষণা করেন যার ফলাফল দাড়ায় ক্রসেড। পরে পোপ নবম গ্রেগরি ১২৩১ খ্রিষ্টাব্দে একটি অধ্যাদেশ অনুমোদন করেন এর ফলেই রাষ্ট্রীয়ভাবে রোমান সাম্রাজ্যে ইনকুইজিশন আরম্ভ। চার্চের কর্তৃত্ব ধরে রাখা এবং বিরোধীদের দমনের জন্যেই রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ হেরেটিকদেরবন্দি করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। বিচারে সময় তাদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে চালানো হত ভয়াবহ নির্যাতন। ভয়াবহ নির্যাতন পদ্ধতিটিই ইনকুইজিশন নামে পরিচিত। ইনকুইজিশন ব্যাপ্তিসময় ছিলো ১২৩১ থেকে ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দ অব্দি। ইঙ্কুইজিশনে শুধু খ্রিস্টধর্ম বিরোধীরাই নয়, বহু নিরপরাধ মানুষ নারী ও শিশুরাও। রাষ্ট্র হেরেটিকদের শাস্তি দিতে ট্রাইবুনাল প্রতিষ্ঠা করার নির্দেশ দেয়। প্রাক-মধ্য যুগে মুরতাদপন্থা দেখাশোনার দায়িতবভার ছিলো ডাইওসীয় বিশপদের কিন্তু তারা দুর্ব্লভাবে সজ্ঞায়িত, প্রক্রিয়া ও শাস্তিদানে ছিলো অপর্যাপ্ত। তাই ডোমেনিকান অর্ডারের সাধুদের ওপর ইনকুইজিশন-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়! প্রথম ইনকুইজিশনের শিকার হয় ক্যাটহার-রা। এরা ‘বিশুদ্ধবাদী’ নামে পরিচিত। ক্যাটহার-রা হেরেটিক ছিল কেননা এদের শিক্ষা ও বিশ্বাসের সঙ্গে রোমান ক্যাথলিকদের শিক্ষার ও বিশ্বাসের ফারাক ছিল এরা ছিল দ্বৈতাবাদী। দক্ষিণ ফ্রান্সে এদের সংখ্যা বেশি ছিল। স্বভাবতই ট্রাইবুনালে ক্যাটহার সম্প্রদায়ের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রথম ডাকা হয়। ইনকুইজিশন চলাকালে স্বাধীন চিন্তার অধিকারী বহু মানুষকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। এদের মধ্যে অন্যতম। গ্যালিলিও গ্যালিলিকে ইনকুইজিশন করা হলে তিনি নিজ শিক্ষার সত্যতা সম্পর্কে অস্বীকৃতি জানান। এভাবে তিনি মুলত আত্মরক্ষা করেন। কিন্তু সাধনা থেকে বিচ্যুত হননি। ইতালির গিওদার্নো ব্রুনো।

স্প্যানিশ ইনকুইজিশন[সম্পাদনা]

১৪৭৮ সালে স্পেনে ইনকুইজিশন-এর শুরু হয়। অন্য যেকোন ইনকুইজিশন-এর চেয়ে এটি ছিলো ক্ষমতাবান এবং প্রাথমিক লক্ষ্য ছিলো খ্রিষ্টে ধর্মান্তরিত ইহুদি বা মারানোসরা এর শিকার । মারানোস মুলত তাদের হলা হয় যারা জোরপুর্বক খ্রিষ্টে ধর্মান্তরিত হওয়ার পরেও ইহুদি ধর্ম পালন করতো। পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে স্পেন মুসলিম অধ্যুষিত গ্রানাদা জয় করে সুতরাং মুসলিমরাও ইনকুইজিশনের শিকার হয়। ষষ্ঠদশ শতকে লুথেরিয়ান প্রেটেস্টনরা ইনকুইজিশন- এর শিকার হয়। স্প্যানিশরা দক্ষিণ আমেরিকার উপনিবেশেও আদিবাসীদের ওপর ইনকুইজিশন চাপিয়ে দিয়েছিল।

ধর্ম কখনও কখনও রাজনৈতিক রূপ পরিগ্রহ করে। স্পেনের ইতিহাসে এর প্রমাণ রয়েছে। পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে, রাজা ২য় ফার্দিনান্দ এবং রানী ইসাবেলার শাসনামলে স্প্যনিশ ইনকুইজিশন চালু হয় । আশ্চর্য এই-এরা দুজনেই ছিলেন ধর্মনিপেক্ষ। এরা দুটি স্প্যানিশ রাজ্য একীভূত করেছিলেন । স্প্যানিশ রাজতন্ত্র ছিল ক্যাথলিক। এই একত্রীকরণের জন্য প্রয়োজন ছিল ধর্মীয় ঐক্য। ইনকুইজিশন-এর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। রোমে তখন স্প্যানিশ সৈন্য অবস্থান করছিল। রোমে তুর্কি আক্রমণের আশঙ্কা ছিল। স্পেন পোপকে বলল, ইনকুইজিশন এর অনুমোদন দিন, নইলে সৈন্য সরিয়ে নেব! পোপ সম্মতি দিলেন। এ ছাড়া স্থানীয় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ও পারিবারিক জোট দূর্বল করতে দূর্বল করতেও ইনকুইজিশন কে ব্যবহার করা হয় । এককথায় রাজনৈতিক স্বার্থে ইনকুইজিশন অব্যাহত রাখে । তবে এর পিছনে অর্থনৈতিক কারণও ছিল। যেমন, সরকার হেরেটিক এর ধনসম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে পারত। মধ্যযুগে রোমের গির্জা এবং স্পেনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির অন্যতম কারণ ছিল ইনকুইজিশন।

ইনকুইজিশন প্রক্রিয়া[সম্পাদনা]

ইনকুইজিটরা সপ্তাহ বা মাসের নির্দিষ্ট দিনে আদালতে বসতো এবং যাদেরকে মুরতাদ বলে মনে করতো তাদের হাজিরার আদেশ দিতো। যেকোন সন্দেহভাজনের বিরুদ্ধে তারা মামলা করতে পারতো। হাজিরা ও দোষ স্বীকারকারীদের কম শাস্তি মিলতো। ইনকুইজিশন আদালতের নির্দেশ অমান্য করলে ইনকুইজিটরিয়াল পুলিশ সেইসব লোকের বিরুদ্ধে তল্লাশি চালাতো। মুরতাদদের নির্বাসন অধিকারও ছিলো নাহ। অভিযুক্তকে সাক্ষ্য দিতে হতো নিজের বিরুদ্ধে। এছাড়া মাত্র দুজন ব্যক্তির সাক্ষ্যের ভিত্তিতেই দোষী ঘোষণা করা বিধান ছিলো।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Internet History Sourcebooks Project"legacy.fordham.edu। ২০ মার্চ ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৩ অক্টোবর ২০১৭ 
  2. Peters, Edwards. "Inquisition", p. 67.
  3. Lea, Henry Charles"Chapter VII. The Inquisition Founded"A History of the Inquisition In The Middle Ages1আইএসবিএন 1-152-29621-3। ২০০৭-১০-১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০০৯-১০-০৭