কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয় বা সুভাষিত রত্নকোষ আনুমানিক খ্রিস্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে সংকলিত একটি সংস্কৃত শ্লোক সংকলন। ডক্টর সুকুমার সেনের মতে গ্রন্থটির রচনাকাল দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ।[১] এই শ্লোকগুলির রচয়িতাগণ বাঙালি বলে অনুমিত হয়। পরবর্তীকালে বাংলায় প্রচলিত সংস্কৃত ও বাংলা আদিরসাত্মক ভক্তিবাদের বিকাশে এই শ্লোকসংগ্রহটি বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। ক্ষুদ্র অথচ সুলিখিত এই শ্লোকগুলি সমকালীন বাঙালি জীবন ও রুচির একটি চিত্র তুলে ধরে। সমকালীন বাংলায় এগুলি বিশেষ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেছিল। ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় শ্লোকগুলি সম্পর্কে বলেছেন, “এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শ্লোকগুলিতেই বাঙালির লীরিক-প্রতিভা প্রকাশের পথ পেয়েছে। পরবর্তিকালে রচিত বৈষ্ণব পদের সঙ্গে এই সমস্ত শ্লোকের কিছুটা সাদৃশ্য আছে।” [২] ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় মন্তব্য করেছেন, “সংস্কৃত সাহিত্যে এই ধরনের কবিতা-সংগ্রহ বা কবিতা-চয়নিকার-ধারার উদ্ভব বোধ হয় এই পর্বের বাঙলা দেশেই, এবং কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়ই এই জাতীয় সর্বপ্রথম সংকলন-গ্রন্থ।”[৩]

আবিষ্কার[সম্পাদনা]

কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়-এর পুথি নেপাল থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে। এটি দ্বাদশ শতকীয় নেওয়ারি অর্থাৎ নেপালি লিপিতে রচিত। তবে এর সঙ্গে পুরনো বাংলা লিপির কিছু সাদৃশ্য রয়েছে। পুথিটির প্রথমদিকে কিছু অংশ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় এর প্রকৃত নাম বা পরিচয় জানা যায় না। টীকায় কথিত ‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ কথাটিই তাই সংকলক এফ ডবলিউ টমাস গ্রন্থনাম হিসাবে গ্রহণ করেছেন। ডক্টর সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সংস্কৃত সাহিত্যে বাংলার দান গ্রন্থে এই মত প্রকাশ করেছেন যে, গ্রন্থটি বিদ্যাকর সংগৃহীত সুভাষিত রত্নকোষ গ্রন্থের অংশবিশেষ। ডক্টর সুকুমার সেন মনে করেন, গ্রন্থটির নাম সুভাষিতরত্নকোশ এবং সংকলক বিদ্যাকর ছিলেন বাংলার কোনও বৌদ্ধবিহারের পণ্ডিত।[১] তবে ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, এই গ্রন্থের নাম হওয়া উচিত ‘সুভাষিত রত্নকোষ’।[২] ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন, “সংকলয়িতার নাম জানিবার উপায় নাই, তবে তিনি বৌদ্ধ ছিলেন। বইখানি যে বাঙলাদেশেই সংকলিত হইয়া পরে অন্যান্য অনেক গ্রন্থের মতো নেপালে নীত হইয়াছিল, এই অনুমান অযৌক্তিক নয়।” [৪]

কবি[সম্পাদনা]

কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয় গ্রন্থে সংস্কৃত ভাষায় ধ্রুপদী কবিদের সঙ্গে সমকালীন কবিদের রচনা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই সংকলনে একদিকে যেমন রয়েছে প্রাচীন কবি কালিদাসভবভূতির রচনা। অন্যদিকে তেমনই রয়েছে সমকালীন বিশিষ্ট ও অর্বাচীন কবিদের শ্লোকও। এঁরা হলেন বন্দ্য তথাগত, গৌড় অভিনন্দ, মধুশীল, রতিপাল প্রমুখ। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে, “...তাঁদের মধ্যে কারো কারো নাম দেখে বাঙালি মনে হচ্ছে।” [২]

ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, এই সংকলনে ১১১ জন কবির মোট ৫২৫টি শ্লোক সংকলিত। [৩] ডক্টর সুকুমার সেনের মতে কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয় গ্রন্থে মোট ২২৩ জন কবির শ্লোক সংকলিত [১][৫] এবং এঁরা অনেকেই পাল রাজাদের সমসাময়িক। তিনি শ্লোকগুলির রচয়িতাদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকাও দিয়েছেন। তাঁর মতে এঁরা হলেন, “অভিনন্দ, কুমুদাকর-মতি (পাণ্ডুভূমি বিহারের মহাপণ্ডিত), চক্রপাণি (দত্ত?), জিতারি-নন্দী, জ্ঞানশ্রী-মিত্র (অতীশের সমসাময়িক), ধর্মদাস, বুদ্ধাকর-গুপ্ত (জগদ্দল বিহারের মহাপণ্ডিত?), মনোবিনোদ, যোগেশ্বর, ধর্মপাল (রাজা?), রাজ্যপাল (রাজা বা রাজপুত্র), লডহচন্দ্র (রাজা শ্রীচন্দ্রের পৌত্র), বসুকল্প (দত্ত), বীর্যমিত্র, বাক্‌কূট, শ্রীধর-নন্দী, সঙ্ঘশ্রী (রাজগুরু), সুবিনীত (শ্রীচন্দ্রের সভাকবি), ইত্যাদি।” [১] অন্যদিকে ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় এই কবিদের যে তালিকাটি পেশ করছেন সেটি এইরূপ, “গৌড়-অভিনন্দ, ডিম্বোক বা হিম্বোক, কুমুদাকর মতি, ধর্মকর, বুদ্ধাকরগুপ্ত, মধুশীল, বাগোক, ললিতোক, বিনয়দেব, ছিত্তপ, বন্দ্য তথাগত, জয়ীক, বিতোক, সিদ্ধোক, সোনোক বা সোন্নোক, হিঙ্গোক্, বৈদ্যধন্য, অপরাজিত রক্ষিত”। এছাড়া তিনি দু-এক জন মহিলা কবির কথাও উল্লেখ করেছেন। এঁরা হলেন ভাবাক বা ভাবদেবী ও নারায়ণ-লক্ষ্মী।[৩]

বসুকল্প[সম্পাদনা]

কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বসুকল্প। সম্পূর্ণ নাম বসুকল্প দত্ত। তাঁর জন্মস্থান কম্বোজ (উত্তরবঙ্গ ও প্রাগজ্যোতিষ অর্থাৎ পশ্চিম অসম অঞ্চল)। গ্রন্থের একটি কবিতায় প্রবাসী বসুকল্প তাঁর জন্মভূমিকে নমস্কার জানাচ্ছেন –


তৎকল্পদ্রুমকীর্ণসংস্তরিরজস্ তৎকামধেনোঃ পয়স্ তং ত্রম্বকনেত্রদগ্ধবপুষঃ পুষ্পায়ুধস্যানলম্।
পদ্মায়াঃ শ্বসিতানি চ শরৎকালস্য তচ্চ স্ফুটং ব্যোমাদায় বিনির্মিতোঽসি বিধিনা কম্বোজ তুভ্যং নমঃ।।

সুকুমার সেন-কৃত এই শ্লোকের বঙ্গানুবাদটি নিম্নরূপ –

অনুমান করা হয়, বসুকল্পের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন সমতটের কোনও কম্বোজ-বংশীয় রাজা। একটি শ্লোকে কবি সেই রাজা ও তাঁর পিতৃ-পিতামহের উচ্চ প্রশংসা করেছেন –


ত্বং কাম্বোজ বিরাজসে ভুবি ভবত্তাতো দিবি ভ্রাজতে তত্তাতস্তু বিভূষণঃ স কিমপি ব্রহ্মৌকসি দ্যোততে।
যুষ্মাভিস্ত্রিভির্ এভিরর্পিততনু স্ত্বৎ কীর্তিরুজ্জৃম্ভিণী মাণিক্যস্তবকত্রয়প্রণয়িনী হারস্য ধত্তে শ্রিয়ম।।

সুকুমার সেন কর্তৃক শ্লোকটির বঙ্গানুবাদ –

সুকুমার সেন মনে করেন, সেযুগের বৈশিষ্ট্য অনুসারে বসুকল্প “যুগপৎ বৌদ্ধ ও শৈবভাবাপন্ন ছিলেন”। তিনি নিজে ছিলেন বৌদ্ধ ও তাঁর পৃষ্ঠপোষক রাজা শৈব। সেই কারণে তাঁর রচনায় বুদ্ধ, শিবগণেশের বন্দনা পাওয়া যায়।[৮]

অভিনন্দ[সম্পাদনা]

কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়-এর অন্যতম বিশিষ্ট কবি অভিনন্দ বা গৌড় অভিনন্দ। তাঁর পাঁচটি শ্লোক এই গ্রন্থে সংকলিত। এগুলিতে অবশ্য কবির নামের সঙ্গে গৌড় অভিধাটি যুক্ত হয়নি। ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় মনে করেন,

বৈশিষ্ট্য ও বিষয়বস্তু[সম্পাদনা]

সংস্কৃত সাহিত্যের উজ্জীবনের প্রচেষ্টা[সম্পাদনা]

এই শ্লোকসংগ্রহের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল প্রাচীন ও অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন কালের কবিদের রচনা একই সঙ্গে সংকলিত হওয়া। যে যুগে এই কাব্য সংকলিত হয়, সেই যুগটি ছিল সংস্কৃত সাহিত্যের অবক্ষয়ের যুগ। এই অবক্ষয় ও রুচির অবনমনকে ধ্রুপদী সাহিত্যের ঐতিহ্যের সাহায্যে রোধ করতে তৎপর হন সমকালের কবিরা।

জীবনমুখিনতা[সম্পাদনা]

এই কাব্যের অপর উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল, এর জীবনমুখিনতা। সমকালীন সময় ও সমাজের একটি খণ্ডচিত্র এই শ্লোকগুলি আমাদের সামনে উপস্থাপিত করে। সাহিত্যে রাজসভার বাইরে অবস্থিত লৌকিক জীবনের প্রভাব পড়তে শুরু করে। দরিদ্র জনসাধারণের জীবনযাত্রার প্রতিও এক অস্ফুট মমত্ব এই শ্লোকগুলিতে ফুটে উঠেছে। ডক্টর নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন,

সংস্কৃত ও বাংলা ভাষার প্রতি মমত্ববোধ[সম্পাদনা]

সংস্কৃতবাংলা ভাষার প্রতি কবিদের মমতা ও ভালবাসাও কোনও কোনও শ্লোকে প্রকট। একটি আর্যায় বঙ্গাল নামধারী জনৈক কবি লিখেছেন, “ঘনরসময়ী গভীরা রক্তিম সুভগোপজীবিতা কবিভিঃ। অবগাঢ়া চ পুণীতে গঙ্গা বঙ্গাল বাণী চ।” অর্থাৎ, গঙ্গা ও বঙ্গালবাণী (শব্দটি দ্ব্যর্থক। এক অর্থে বঙ্গালবাণী হল বাংলা ভাষা, অপর অর্থে কবি বঙ্গালের বাণী) দুইই পবিত্র। তাই এতে অবগাহনে পূণ্য। একটি গভীর ধারা বিশিষ্ট, অপরটি মধুময় চেতনায় ভরা। উভয়েই কবির আনন্দপ্রদ। [১০]

বিষয়বস্তু ও প্রভাব[সম্পাদনা]

অনুমিত হয়, কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়-এর অজ্ঞাতনামা সংকলক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিলেন। তাই গ্রন্থের আদিতে বুদ্ধের বন্দনা সংকলিত। এছাড়া কোথাও বৌদ্ধ বিষয়বস্তুর উল্লেখ মেলে না। বরং অনেকগুলি শ্লোক হরির উপর রচিত। এছাড়া গ্রীষ্ম, বর্ষা, বসন্ত ইত্যাদি ঋতুর উপর রচিত শ্লোকও পাওয়া যায়। এই শ্লোকগুলি বাস্তবধর্মী ও বর্ণনাত্মক। মাঝে মাঝে গীতিকবিতার লক্ষণও স্পষ্ট। সংকলনের দুই-তৃতীয়াংশ শ্লোক আদিরসাত্মক। এই জাতীয় শ্লোকের সংখ্যা ৩৫০।

অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয় শ্লোকসংকলনের প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য ও পরবর্তীকালের বাংলা সাহিত্যে এর প্রভাব সম্পর্কে লিখেছেন,

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. বঙ্গভূমিকা, সুকুমার সেন, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, আকাদেমি সংস্করণ, ১৯৯৯, পৃ.১৬১
  2. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ষষ্ঠ সংস্করণ, ২০০৬, পৃ.৫২
  3. বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব, নীহাররঞ্জন রায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, চতুর্থ সংস্করণ, অগ্রহায়ণ, ১৪১০ বঙ্গাব্দ, পৃ.৫৮৫
  4. বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব, নীহাররঞ্জন রায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, চতুর্থ সংস্করণ, অগ্রহায়ণ, ১৪১০ বঙ্গাব্দ, পৃ.৫৮৪-৫
  5. বঙ্গভূমিকা, সুকুমার সেন, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, আকাদেমি সংস্করণ, ১৯৯৯, পৃ.১৭৩
  6. বঙ্গভূমিকা, সুকুমার সেন, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, আকাদেমি সংস্করণ, ১৯৯৯, পৃ.১৬৩
  7. বঙ্গভূমিকা, সুকুমার সেন, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, আকাদেমি সংস্করণ, ১৯৯৯, পৃ.১৬৪
  8. বঙ্গভূমিকা, সুকুমার সেন, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, আকাদেমি সংস্করণ, ১৯৯৯, পৃ.১৬৫
  9. বাঙ্গালীর ইতিহাস : আদি পর্ব, নীহাররঞ্জন রায়, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, চতুর্থ সংস্করণ, অগ্রহায়ণ, ১৪১০ বঙ্গাব্দ, পৃ.৫৮২ আইএসবিএন ৮১-৭০৭৯-২৭০-৩
  10. বাংলা সাহিত্য পরিচয়, ডক্টর পার্থ চট্টোপাধ্যায়, তুলসী প্রকাশনী, কলকাতা, চতুর্থ পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণ, ২০০৮, পৃ. ১১
  11. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, প্রথম খণ্ড, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, মডার্ণ বুক এজেন্সী প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ষষ্ঠ সংস্করণ, ২০০৬, পৃ.৫২-৩, ৫৪