সজল বারুই

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
১৯৯৭ সালে সজল বারুই।

সজল বারুই হলেন একজন কারারুদ্ধ অপরাধী। ইনি নিজের বাবা, সৎ মা ও সৎ ভাইকে হত্যার অপরাধে বর্তমানে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন। ১৯৯৩ সালের ২২ নভেম্বর কলকাতায় সজল বারুই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিলেন।[১] এই হত্যাকাণ্ডের নৃশংসতা এবং সজল বারুই নাবালক অবস্থায় সেই নৃশংস ঘটানোয় সেই ঘটনা কলকাতার গণমাধ্যমগুলিতে বিশেষ আলোড়ন তুলেছিল।[১][২][৩][৪]

শৈশব[সম্পাদনা]

সজল বারুইয়ের বাবা সুবল বারুই তার প্রথমা স্ত্রী নিয়তি বারুইকে পরিত্যাগ করেছিলেন। এই সময় অন্য একটি মহিলার সঙ্গে তিনি অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হন। এই মহিলার নাম ছিল মিনতি।[২] সজল বারুই হলেন সুবল ও নিয়তি বারুইয়ের ছেলে।[২] কয়েক বছর পরে সুবল বারুই নিয়তির কাছে এসে সজলকে তার সঙ্গে নিয়ে যান। সজল আট বছর বয়সের পর আর নিজের মাকে দেখেননি।[২] গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি জানিয়েছিলেন, ছেলেবেলায় মাঝে মাঝেই তাকে জ্বলন্ত সিগারেট ও তপ্ত লোহা দিয়ে ছ্যাঁকা দেওয়া হত।[২]

হত্যাকাণ্ড[সম্পাদনা]

১৯৯৩ সালের ২২ নভেম্বর সজল ও তার চার সমবয়স্ক বন্ধু তাদের উত্তর কলকাতার বাড়িতে এসে উপস্থিত হন। সৎ মাকে একা পেয়ে তারা তার মুখ চেপে তাকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে ফেলেন।[২] মধ্যরাতের কিছু আগে সজলের বাবা ও সৎ ভাই বাড়ি ফিরলে তাদেরও একই অবস্থা হয়। সজল ও তার বন্ধু রঞ্জিত তিনজনকেই গলা টিপে হত্যা করতে যান। কিন্তু শুধুমাত্র তার সৎ মাই এই উপায়ে মারা যান।[২] তখন সজল ও রঞ্জিত বাকিদের কুপিয়ে ও ছোরা মেরে খুন করেন। সমস্ত ঘটনা ঘটতে প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগে।[২]

অপরাধ ঘটানোর পর সজলের নির্দেশে তার বন্ধুরা সরষের তেল দিয়ে অস্ত্রগুলি পরিষ্কার করে সেগুলিকে ভালোভাবে টেবিলে সাজিয়ে রাখেন।[২] ক্লান্ত হয়ে তারা রেফ্রিজেটর থেকে কয়েকটি মিষ্টি বের করে খান এবং মিষ্টির ‘দাম’ হিসেবে কিছু খুচরো পয়সা টেবিলের উপর রেখে দেন। এই ধারণাটি একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখে সজলের মাথায় এসেছিল।[২]

সজলের বন্ধুরা যাবার আগে সজলকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে তার মুখও বেঁধে দেন, যাতে মনে হয় যে সজলও আক্রান্ত হয়েছিলেন।[১][২] প্রথম দিকে সজল পুলিশের সন্দেহ এড়িয়ে যেতে সমর্থ হন।[৩] যদিও পরে কলকাতা পুলিশের সন্দেহ হয়। কারণ, সজলের শরীরে কোনো আঘাত বা মারামারির চিহ্ন ছিল না।[১] জিজ্ঞাসাবাদের পর সজল খুন করার কথা স্বীকার করে হত্যাকাণ্ডের বিস্তারিত বিবরণ দেন। তবে তার বা তার সঙ্গীদের মনে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কোনো অনুশোচনা দেখা যায়নি। এমনকি যখন তাদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করা হয়, তখন তারা হাততালি দিয়ে একসঙ্গে গান গেয়ে ওঠেন।[২] পরে কলকাতা হাইকোর্ট মৃত্যুদণ্ড হ্রাস করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেন।

পলায়ন[সম্পাদনা]

প্রথমে সজল বারুই দমদম ক্যান্টনমেন্টে কারাদণ্ড ভোগ করছিলেন। কিন্তু ২০০০ সালের জুলাই মাসে ‘প্রশাসনিক অসুবিধা’র জন্য তাঁকে মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।[৫] ২০০১ সালে কারারুদ্ধ অবস্থায় সজল বারুই কিডনির সমস্যার কথা জানান। তাঁকে কলকাতা ন্যাশানাল মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে পরীক্ষার জন্য আনা হয়।[৩][৪] ২০০১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর তিনি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যান এবং ২০০৩ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত পলাতক থাকেন।[৪][৬] পালানোর রাতে সজল একটি বিয়ার পার্টির আয়োজন করেছিলেন এবং তাতে তাঁর প্রহরায় নিযুক্ত দুই পুলিশ কনস্টেবলকে নিমন্ত্রণও করেছিলেন।[৬] নিজের প্রেমিকার থেকে গোপনে আনীত বিয়ার তিনি কনস্টেবলদের খাইয়েছিলেন। তাঁরা সজলের উদ্দেশ্য ধরতে পারেননি।[৬] রাতে তিনি দুই বোতল বিয়ারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে কনস্টেবলদের ঘুম পাড়িয়ে দেন।[৬] তারপর সকলের অলক্ষ্যে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যান।[৬]

পলাতক জীবন[সম্পাদনা]

পুলিশের কাছ থেকে পালিয়ে সজল বারুই মুম্বইতে এক বন্ধুকে ই-মেইল করে সেখানে পালিয়ে যান।[৬] সেখানে তিনি বিয়ে করেন এবং স্ত্রীকে আসানসোলে রেখে কলকাতায় ফিরে আসেন।[৬] কলকাতায় ফিরে বিভিন্ন ছদ্মনামে তিনি একাধিক অপরাধের ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন।[৬] কলকাতার ফুলবাগানমানিকতলা থানার পুলিশ আধিকারিকেরা ২০০৩ সালের গোড়ার দিকে সজলের বান্ধবীর সন্ধান পেয়ে তার মাধ্যমে একটি স্টিং অপারেশন চালিয়ে সজলকে ধরতে সমর্থ হয়েছিলেন প্রায়। তবে সজল ধরা পড়েননি।[৪] এরপর সজল লেকটাউনে স্থানীয় গুন্ডা ‘হাতকাটা’ বিশুর ঠেকে আশ্রয় নেয়। বিশুর অধীনে থাকার সময় কমল ছদ্মনামে তিনি উল্টোডাঙায় একটি ডাকাতির ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন।[৪] পুলিশ ‘কমলে’র খোঁজ শুরু করলে সজল বারুই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জামবনিতে পালিয়ে গিয়ে স্থানীয় অপরাধী রাজীব মেতির অধীনে কাজ শুরু করেন।[৪]

পুনরায় গ্রেফতার[সম্পাদনা]

২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার জামবনিতে সাধারণ অপরাধে অভিযুক্ত হয়ে শেখ রাজু নামে এক অপরাধী ধরা পড়েন। তাকে মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে আনা হয়।[৪] ২০০৩ সালের ১৬ মে, প্রায় তিন মাস শেখ রাজু নামে জেলবন্দী থাকার পর জানা যায়, তিনি আসলে সজল বারুই। কলকাতার আলিপুর কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগের সময় এক জেলার তাকে দেখেছিলেন। তিনিই সজলকে সনাক্ত করেন।[৪]

এরপর সজলকে কলকাতার প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে আনা হয়। এখানে তিনি আমেরিকান সেন্টার জঙ্গিহানায় অভিযুক্ত সন্ত্রাসবাসী আফতাব আনসারির সঙ্গে কাজ শুরু করেন। এছাড়া দেবাশিষ চক্রবর্তী নামে আরও এক অপরাধী, যিনি নিজের বান্ধবীকে হত্যা করেছিলেন এবং নিজের মাকে হত্যার চেষ্টা করেছিলেন, তার সঙ্গেও কাজ শুরু করেন সজল।[৭][৮] কিছুদিন পরেই এই অপরাধচক্রটি ধরা পড়ে যায়। সজল বারুইকে আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে সরিয়ে আনা হয়।[৭] দেবাশিষ চক্রবর্তীকে মেদিনীপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ২০০৫ সালের ২৮ মে সেখান থেকে দেবাশিষ পালিয়ে যান। কিন্তু দুদিন পরেই ধরা পড়েন।[৮] ২০১০ সালের অগস্ট মাসে সজল বারুই জেল থেকে ছাড়া পান। কিন্তু ২০১১ সালের জুন মাসে আবার ডাকাতির অভিযোগে গ্রেফতার হন।[৯]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Ghosh, Labonita (২০০৬)। "Killer Kids in India Today web exclusive"। ৯ মে ২০০৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০০৬ 
  2. Kumar, Kanti (১ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯)। "The Sajal Barui case in The Trend of Violence on the Indian Screen & its Influence on Children (KK Birla Foundation Fellowship Report)"। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০০৬ 
  3. Staff Reporter (২০০৩)। "Young killer escapes from hospital"। ২ মার্চ ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০০৬ 
  4. Mondal, Pronab (১৭ মে ২০০৩)। "Jailer nails Sajal Barui, aka Sk Raju"The Telegraph। Calcutta, India। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০০৬ 
  5. Staff Reporter (১৬ সেপ্টেম্বর ২০০১)। "Sajal Barui escapes from custody"। ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০০৬ 
  6. Staff reporter (২২ মে ২০০৩)। "Two beer bottles to freedom"The Telegraph। Calcutta, India। ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০০৬ 
  7. Sen, Saibal (২৩ মার্চ ২০০৫)। "It's still raining ransoms for Aftab"The Times of India। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০০৬ 
  8. Staff Reporter (৩০ মে ২০০৫)। "Lifer tracked down to uncle's home"The Telegraph। Calcutta, India। সংগ্রহের তারিখ ৭ অক্টোবর ২০০৬ 
  9. "Family killer held for dacoity"The Telegraph। Calcutta, India। ২৮ জুন ২০১১। ১ জুলাই ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৮ জুন ২০১১