বিষয়বস্তুতে চলুন

গীতসংহিতা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
দশম শতাব্দীর প্যারিস প্যাল্টারে রাজা দাউদ ভজন রচনা করছেন[]

গীতসংহিতা (/sɑː(l)mz/ SAH(L)MZ, SAW(L)MZ;[] হিব্রু ভাষায়: תְּהִלִּים‎, Tehillīm, lit. "praises"; গ্রিক: Ψαλμός, Psalmós; লাতিন: Liber Psalmorum; আরবি: زَبُورُ, Zabūr),  সামস, বা সল্টার নামেও পরিচিত। এটি হিব্রু বাইবেলের তৃতীয় অংশ কেতুভিম ("লেখনী")-এর প্রথম গ্রন্থ, এবং পুরাতন নিয়মের অন্তর্ভুক্ত।[]

এই বইটি হিব্রু ধর্মীয় স্তবগানের একটি সংকলন। ইহুদি ও পশ্চিমা খ্রিস্টান ঐতিহ্যে, ১৫০টি স্তবসঙ্গীত রয়েছে এবং পূর্বী খ্রিস্টান চার্চগুলিতে আরও বেশ কিছু সংখ্যক স্তবসঙ্গীত পাওয়া যায়। বইটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত, প্রতিটি অংশের শেষে একটি স্তোত্র বা প্রশংসার স্তবগান রয়েছে। এতে স্তবগান বা প্রশংসার গান, সাম্প্রদায়িক এবং ব্যক্তিগত বিলাপ, রাজকীয় স্তবগান, অভিশাপ, এবং ব্যক্তিগত ধন্যবাদ সহ বিভিন্ন ধরনের স্তবগান্ত রয়েছে। বইটিতে সাম্প্রদায়িক ধন্যবাদ, প্রজ্ঞা, তীর্থযাত্রা এবং অন্যান্য বিষয়শ্রেণীর স্তবগানও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

অনেক স্তবসঙ্গীতে রাজা দায়ূদ এবং আসফ, কোরহের পুত্র, এবং সলোমন সহ অন্যান্য বাইবেলীয় ব্যক্তিত্বের নামের উল্লেখ থাকলেও, বেশিরভাগ আধুনিক বাইবেল পণ্ডিতরা দায়ূদের রচনা হিসেবে এগুলোকে স্বীকার করেন না। এর পরিবর্তে, তারা নবম এবং পঞ্চম শতাব্দী খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে বিভিন্ন লেখককে স্তবগানের রচনার সাথে সম্পৃক্ত করেন। কেনানের ইস্রায়েলীয় বিজয়ের সময় থেকে নির্বাসন-পরবর্তী সময় পর্যন্ত স্তবগান্ত রচিত হয়েছিল এবং সম্ভবত পঞ্চম শতাব্দী খ্রিস্টপূর্বাব্দের নির্বাসন-পরবর্তী সময়ে এই বইটির বর্তমান রূপে সংকলিত এবং সম্পাদিত হয়।[]

ইংরেজিতে, বইটির শিরোনামটি গ্রিক শব্দ ψαλμοί (psalmoi) থেকে নেওয়া হয়েছে, যার অর্থ "বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গীত" এবং বর্ধিত অর্থে, "সঙ্গীতের পাশাপাশি কথাগুলি"। বইটির হিব্রু নাম, তেহিলিম (תהילים), যার অর্থ "প্রশংসা", কারণ এতে ঈশ্বরের প্রতি অনেক প্রশংসা এবং প্রার্থনা রয়েছে। কোরআনে স্তবগানকে নির্দেশ করতে আরবি শব্দ জবুর ব্যবহৃত হয়।[]

কাঠামো

[সম্পাদনা]
ধর্মীয় ট্র্যাক্ট সোসাইটির ম্যাগাজিন "দ্য সানডে অ্যাট হোম"-এর ১৮৮০ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত "গীতসংহিতা ২৩"-এর জন্য তৈরি একটি চিত্র। এটি বাক্সটার প্রক্রিয়া ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল, যা একটি বর্ণাঢ্য এবং বিস্তারিত মুদ্রণ প্রযুক্তি।

অংশসমূহ

[সম্পাদনা]

গীতসংহিতার পুস্তকটি পাঁচটি অংশে বিভক্ত, প্রতিটি অংশ একটি স্তব (অর্থাৎ একটি উপকারী কথা) দিয়ে শেষ হয়েছে। সম্ভবত তোরাহের পাঁচ ভাগের অনুকরণে সম্পাদকরা এই বিভাগগুলি প্রবর্তন করেছিলেন।[]

গ্রন্থ ১ (গীতসংহিতা ১-৪১)

গ্রন্থ ২ (গীতসংহিতা ৪২-৭২)

গ্রন্থ ৩ (গীতসংহিতা ৭৩-৮৯)

গ্রন্থ ৪ (গীতসংহিতা ৯০-১০৬)

গ্রন্থ ৫ (গীতসংহিতা ১০৭-১৫০)

শীর্ষলিপি

[সম্পাদনা]

অনেক গীতে (১৫০ এর মধ্যে ১১৬) পৃথক শীর্ষলিপি (শিরোনাম) রয়েছে, যা দীর্ঘ ভাষ্য থেকে শুরু করে একটি শব্দ পর্যন্ত হতে পারে। এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি "নেতা" বা "গায়কদলের প্রধান" এর উদ্দেশ্যে বলা  সঙ্গীত নির্দেশনা বলে মনে হয়।  যেমন- "তারযুক্ত বাদ্যযন্ত্র সহ" এবং "লিলি অনুসারে" ইত্যাদি।  অন্যান্য নির্দেশনাগুলি সঙ্গীত রচনার ধরন বলে মনে হয় যেমন “একটি গীত” এবং “গান”। আবার, অনেকে গীতটি ব্যবহারের উপলক্ষ সম্পর্কে নির্দেশনা বহন করে (“মন্দিরের উৎসর্গের সময়”, “স্মরণার্থ নৈবেদ্যের জন্য”, ইত্যাদি)। অনেক শীর্ষলিপিতে ব্যক্তিদের নাম রয়েছে, যার মধ্যে সবচেয়ে বেশী  হলো (৭৩টি গীত - যদি নতুন নিয়মের দায়ূদ-এর জন্য আরো দুটি গীত যুক্ত করা হয় তবে ৭৫টি)  'দায়ূদের', এবং এর মধ্যে তেরোটি রাজার জীবনের ঘটনাগুলির সাথে স্পষ্টভাবে সম্পর্কিত। অন্যান্য নামগুলির মধ্যে রয়েছে আসফ (১২), কোরহের পুত্ররা (১১), সলোমন (২), মোশি (১), এজ্রীয়দের মধ্যে এথন (১), এবং এজ্রীয়দের মধ্যে হেমন (১)। সেপ্টুয়াজিন্ট, পেশিত্তা (সিরিয়াক ভালগেট) এবং ল্যাটিন ভালগেট প্রতিটি বিভিন্ন গীতকে (যেমন ১১১ এবং ১৪৫) হাগগাই এবং জেখারিয়াহর সাথে যুক্ত করেছে। সেপ্টুয়াজিন্ট ইজিকিয়েল এবং যিরমিয়র মতো বেশ কিছু গীত (১১২ এবং ১৩৫) এর জন্য দায়ী করেছে।[]

গণনা করা

[সম্পাদনা]

হিব্রু (মাসোরেটিক) এবং গ্রীক (সেপ্টুয়াজিন্ট) পাণ্ডুলিপিতে গীতসংহিতার গণনা আলাদা হয়—বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি সংখ্যার পার্থক্য। প্রোটেস্ট্যান্ট অনুবাদসমূহ (লুথারান, অ্যাংলিকান, ক্যালভিনিস্ট) হিব্রু গণনা ব্যবহার করে, কিন্তু অন্যান্য খ্রিস্টান সম্প্রদায়গুলোতে পার্থক্য দেখা যায়:

রোমান মিসালের মতো ক্যাথলিক আনুষ্ঠানিক ধর্মগ্রন্থগুলো গ্রীক গণনা ব্যবহার করে।

আধুনিক ক্যাথলিক অনুবাদগুলিতে প্রায়শই হিব্রু গণনা ব্যবহার করা হয় (গ্রীক সংখ্যাটি উল্লেখ করে)।

পূর্ব অর্থোডক্স এবং পূর্ব ক্যাথলিক অনুবাদে গ্রীক সংখ্যায়ন ব্যবহার করা হয় (হিব্রু সংখ্যাটি উল্লেখ করে)।

মাসোরা এবং সেপ্টুয়াজিন্ট ধর্মগ্রন্থের গণনার এই পার্থক্য সম্ভবত গীতসংহিতার আসল কাব্যিক রূপটির ধীরে ধীরে অবহেলার ফলে ঘটেছে; এই ধরনের অবহেলা আচার-অনুষ্ঠানের ব্যবহার এবং লেখকদের অমনোযোগের কারণে ঘটেছিল। সাধারণত স্বীকার করা হয় যে গীতসংহিতা ৯ ও ১০ (হিব্রু গণনা) মূলত একটি আদ্যক্ষর কবিতা ছিল, মাসোরা কর্তৃক ভুলভাবে বিভক্ত করা হয়েছিল এবং সেপ্টুয়াজিন্ট এবং ভালগেটে ঠিকভাবে একত্রিত হয়েছিল। গীতসংহিতা ৪২ এবং ৪৩ (হিব্রু গণনা) বিষয়ের অভিন্নতা (ইয়াহওয়ের গৃহের জন্য আকাঙ্ক্ষা), ছান্দসিক গঠন এবং বিরতির অভিন্নতা দ্বারা দেখানো হয়েছে (গীতসংহিতা ৪২:৬, ১২; ৪৩:৫ – হিব্রু), এগুলো এক ও অভিন্ন কবিতার তিনটি স্তবক ছিল। হিব্রু পাঠটি ১৪৬ এবং ১৪৭ গীতসংহিতাকে একটি হিসাবে গণনা করার ক্ষেত্রে সঠিক। পরবর্তী আনুষ্ঠানিক ব্যবহার এইগুলি এবং অন্যান্য কয়েকটি গীতসংহিতাকে বিভক্ত করেছে বলে মনে হয়।

প্রাথমিক প্রকার

[সম্পাদনা]

হেরমান গুনকেলের সালম গ্রন্থের (Psalms) যুগান্তকারী রূপগত সমালোচনা, ব্যক্তিগত স্তোত্রসমূহের অর্থবহ ব্যাখ্যার জন্য একটি নতুন প্রেক্ষাপট প্রদান করেছে। স্তোত্রগ্রন্থের মধ্যেকার সাহিত্যিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা না করে (যা তিনি তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন না) তিনি বরং স্তোত্রগ্রন্থের বিভিন্ন স্থান থেকে একই ধাঁচের (Gattung)  স্তোত্রগুলো (psalm) একত্রিত করেছেন। গুনকেল স্তোত্রগুলিকে পাঁচটি প্রাথমিক ধরনে ভাগ করেছেন:

স্তুতিগীত (Hymns)

[সম্পাদনা]

স্তুতিগীত হলো সৃষ্টি বা ইতিহাসের মধ্যে ঈশ্বরের কাজের প্রশংসা করে গাওয়া গান। এগুলো সাধারণত প্রশংসার আহ্বান দিয়ে শুরু হয়, প্রশংসার উদ্দেশ্য বর্ণনা করে এবং আহ্বানের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে শেষ হয়। দুটি উপ-বিভাগ হলো "রাজ্যাভিষেক স্তোত্র" যা ঈশ্বরকে রাজা হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়াকে উদযাপন করে, এবং জিয়োন স্তোত্র, যা জেরুজালেমের ঈশ্বরের আবাসস্থল সিয়োন পর্বতকে মহিমান্বিত করে। গুনকেল "সমাপ্তি-সংক্রান্ত স্তুতিগীত" এর একটি বিশেষ শাখার বর্ণনা করেন যাতে  ভবিষ্যতের পুনরুদ্ধার (স্তোত্র ১২৬) বা বিচারের (স্তোত্র ৮২) বিষয়াবলী অন্তর্ভুক্ত থাকে।

সাম্প্রদায়িক শোকগাথা (Communal Laments)

[সম্পাদনা]
David is depicted giving a psalm to pray for deliverance in this 1860 woodcut by Julius Schnorr von Karolsfeld

সাম্প্রদায়িক শোকগাথা এমন স্তোত্র যেখানে জাতি কোনো সামষ্টিক দুর্যোগে শোক প্রকাশ করে। সাম্প্রদায়িক এবং ব্যক্তিগত উভয় ধরনের শোকগাথাতেই নিম্নলিখিত উপাদানগুলো সাধারণত (কিন্তু সবসময় নয়) অন্তর্ভুক্ত থাকে:

ঈশ্বরকে সম্বোধন করা,

দুর্ভোগের বিবরণ,

দুর্ভোগের জন্য দায়ী পক্ষকে অভিশাপ,

নির্দোষিতার প্রতিবাদ বা অপরাধ স্বীকার,

ঐশ্বরিক সাহায্যের জন্য আবেদন,

প্রার্থনা গ্রহণে ঈশ্বরের উপর বিশ্বাস,

ঐশ্বরিক সাড়ার প্রত্যাশা, এবং

কৃতজ্ঞতার গান।

সাধারণভাবে, একবচন "আমি" বা বহুবচন "আমরা" এর ব্যবহার দ্বারা ব্যক্তিগত এবং সাম্প্রদায়িক উপ-ধরনগুলো আলাদা করা যেতে পারে। তবে এক্ষেত্রে, "আমি" একজন ব্যক্তির অভিজ্ঞতাকেও চিহ্নিত করতে পারে যা সমগ্র সম্প্রদায়কে প্রতিফলিত করে।

রাজকীয় স্তোত্র (Royal Psalms)

[সম্পাদনা]
David is depicted giving a penitential psalm in this 1860 woodcut by Julius Schnorr von Karolsfeld

রাজকীয় স্তোত্রগুলো রাজার রাজ্যাভিষেক, বিয়ে, যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। এগুলোর কোনটিতেই কোনো নির্দিষ্ট রাজার নাম উল্লেখ নেই এবং তাদের উৎপত্তি এবং ব্যবহার অস্পষ্টই রয়ে গেছে। বিভিন্ন স্তোত্র, বিশেষত স্তোত্র ৯৩-৯৯, ঈশ্বরের রাজত্বকে প্রাধান্য দেয় এবং এটি এমন একটি বার্ষিক অনুষ্ঠানের সাথে সম্পর্কিত হতে পারে যেখানে ঈশ্বরকে আচার অনুসারে পুনরায় রাজা হিসাবে বহাল করা হতো।

ব্যক্তিগত শোকগাথা (Individual Laments)

[সম্পাদনা]

ব্যক্তিগত শোকগাথা বক্তার নিজস্ব ভাগ্যে শোক প্রকাশ করে। এটি সবচেয়ে বেশি প্রচলিত স্তোত্র যা সাধারণত ঈশ্বরের আহ্বান দিয়ে শুরু হয়, এরপরে শোকগাঁথা এবং সাহায্যের আবেদন অনুসরণ করে এবং প্রায়শই আত্মবিশ্বাসের প্রকাশের মাধ্যমে শেষ হয়।

ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা স্তোত্র (Individual Thanksgiving Psalms)

[সম্পাদনা]

ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা স্তোত্র, ব্যক্তিগত শোকগাঁথার বিপরীত। এতে বক্তা, ব্যক্তিগত বিপদ থেকে মুক্তির জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেয়।

এই পাঁচটি প্রধান ধরনের পাশাপাশি, গুনকেল আরও কিছু ছোট ধরনের স্তোত্রকেও চিহ্নিত করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে:

সাম্প্রদায়িক কৃতজ্ঞতা স্তোত্র, যেখানে পুরো জাতি উদ্ধারের জন্য ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানায়;

প্রজ্ঞামূলক স্তোত্র, পুরাতন নিয়মের মূল সাহিত্যকে প্রতিফলিত করে;

তীর্থযাত্রী স্তোত্র, জেরুজালেমের পথে তীর্থযাত্রীদের দ্বারা গাওয়া হয়;

প্রবেশ এবং ভবিষ্যদ্বাণীপূর্ণ ধর্মানুষ্ঠান;

এবং মিশ্র স্তোত্রের একটি দল যাকে কোনও বিভাগে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না।

গুপ্তপদসমূহের রচনা কমপক্ষে পাঁচ শতক জুড়ে বিস্তৃত, যার শুরু দশম শতাব্দী খ্রিস্টপূর্বাব্দে (২৯তম গুপ্তপদ) থেকে শুরু করে নির্বাসনের পরবর্তী সময়কাল পর্যন্ত (পঞ্চম শতাব্দী খ্রিস্টপূর্বাব্দের পূর্বে নয়)। অধিকাংশের উৎপত্তি জুদিয়ার দক্ষিণ রাজ্যে এবং সেগুলো জেরুসালেমের মন্দিরের সাথে যুক্ত ছিল, যেখানে সেগুলো সম্ভবত মন্দিরের উপাসনার সময় স্তোত্র-পুস্তিকা (libretto) হিসেবে কাজ করতো। কিভাবে সেগুলো এভাবে ব্যবহৃত হত তা স্পষ্ট নয়, যদিও কিছু পদে এর ইঙ্গিত পাওয়া যায়: "ছাগলীর শিং পর্যন্ত উৎসবের শোভাযাত্রাকে শাখা দিয়ে বেঁধে দাও" বলিদানের সাথে একটি যোগসূত্রের পরামর্শ দেয়, এবং "আমার প্রার্থনাকে ধুনোর মত গণ্য করা হোক" ধুনো উৎসর্গের সাথে একটি যোগসূত্রের পরামর্শ দেয়।

ইহুদি ঐতিহ্য অনুসারে, গুপ্তপদসমূহের পুস্তিকাটি রচনা করেছিলেন প্রথম মানব (আদম), মেলকিসেদেক, আব্রাহাম, মোশি, দায়ূদ, সলোমন, হিমান, যিদূথুন, আসাফ এবং কোরহের তিন পুত্র। আব্রাহাম ইবনে এজরা অনুসারে, পুস্তকটির চূড়ান্ত সম্পাদনা করেছিলেন  'মহান সমাবেশের লোকেরা' (Men of the Great Assembly)।

প্রভাব

[সম্পাদনা]

কিছু কিছু গুপ্তপদ ওই অঞ্চলের পূর্ববর্তী পাঠ- থেকে প্রভাবিত হবার লক্ষণ দেখায়; এর উদাহরণগুলোর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন উগারিটিক পাঠ এবং ব্যাবিলনীয় এনুমা এলিশ। এই প্রভাবগুলো পটভূমির সাদৃশ্য বা বৈপরীত্যের হতে পারে। যেমন ২৯তম গুপ্তপদ কনানীয় ধর্মীয় কবিতা এবং মূল প্রতিপাদ্যের সাথে বৈশিষ্ট্য ভাগ করে বলে মনে হয়। তবে এর থেকে বেশি কিছু ব্যাখ্যা করা উচিত হবে না। রবার্ট অল্টারের মতে, শুরুর সম্বোধন "ঈশ্বরের পুত্রগণ" কে বহু-ঈশ্বরবাদী পুরাণের একটি ক্ষণস্থায়ী সাহিত্যিক পরজীবন হিসেবে ভাবা যেতে পারে, কিন্তু এই বিশ্বাস "গুপ্তপদ রচনাকারী লেখকদের মধ্যে শেয়ার করা হত এটা অসম্ভাব্য"। বহু-ঈশ্বরবাদী ধর্মের সাথে বৈপরীত্যটি ১০৪:২৬ পদে ভালোভাবে দেখা যায় যেখানে তাদের ভয়ংকর সামুদ্রিক দেবতার রীতি, যেমন ব্যাবিলনীয় তিয়ামত, কনানীয় যম এবং লিভিয়াথান যা হিব্রু বাইবেলেও দেখা যায়, সেটিকে একটি জলজ পোষা প্রাণীতে সংকুচিত করা হয়েছে যার সাথে YHWH খেলা করতে পারেন।

প্রাচীন যুগে গীতসংগীতের ধারা

[সম্পাদনা]

গীতসংগীত শুধু কবিতা আকারে নয়, গান হিসেবেও লেখা হত। বাইবেল বিশেষজ্ঞ সাদিয়া গাওঁন (৮৮২-৯৪২) - যিনি ব্যাবিলনীয় ইহুদি সম্প্রদায়ে সেবা করেছিলেন - এর মতে, গীতসংগীত মূলত লেভীয়দের দ্বারা মন্দির এলাকায় গাওয়া হত। নির্দিষ্ট গীতসংগীতের বিধানের ওপর ভিত্তি করেই এগুলি পরিবেশিত হত (গায়কের বংশপরিচয়, গানের সময় ও স্থান, বাদ্যযন্ত্র, গাওয়ার ধরন ইত্যাদি)। তবে যে কেউ, যে কোনো সময়ে বা স্থানে ইচ্ছেমতো এগুলি পড়তে পারে। গীতসংগীতের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি অংশ সঙ্গীত পরিচালকের উদ্দেশ্যে লেখা হয়েছে। কিছু গীতসংগীত আরাধককে গান গাওয়ার জন্য উৎসাহিতও করে (যেমন- গীতসংগীত ৩৩:১-৩; ৯২:১-৩; ৯৬:১-৩; ৯৮;১; ১০১:১; ১৫০)। কিছু শিরোনাম বাদ্যযন্ত্রগুলি নির্দেশ করে যেগুলির ওপর  গীতসংগীত বাজানো উচিত (গীতসংগীত ৪, ৫, ৬, ৮, ৬৭)। কিছু গীত আবার লেভীয়দের বোঝায়,  যারা আটটি সুরের একটি গাইত, যেগুলির একটি 'অষ্টম' (হিব্রু: শেমিনিট) নামে পরিচিত ছিল (গীতসংগীত ৬, ১২)। আবার কিছু প্রাচীন পূর্বের ধাঁচ ধরে রাখে, যেমন আয়েলেট হা-শাখার (ভোরের হরিণ; গীতসংগীত ২২); শোশানিম/শুশান (লিলি/লিলি; গীতসংগীত ৪৫; ৬০), যা একটি নির্দিষ্ট সুর বোঝাতে ব্যবহৃত হয়; অথবা 'আলমুথ/'আলামোথ (নিঃশব্দ; গীতসংগীত ৯, ৪৬), যা সাদিয়া গাওঁনের মতে, হল "একটি নিঃশব্দ সুর, প্রায় শ্রবণাতীত।"

প্রাচীন যুগের সঙ্গীত হারিয়ে গেছে বলে একটি প্রচলিত ধারণা থাকলেও, এগুলিকে পুনর্গঠন করার উপায় এখনও রয়েছে। মন্দিরের গীতসংগীতের অংশগুলি প্রাচীন উপাসনালয় এবং গীর্জার স্তোত্রগুলিতে সংরক্ষিত আছে, বিশেষ করে গীতসংগীত ১১৪ এর টোনাস পেরেগ্রিনাস সুরে। গাওয়ার সুর লিপিবদ্ধ করার জন্য, প্রাচীন কাল থেকে ক্যান্টিলেশনের চিহ্ন ব্যবহার করা হত; এর প্রমাণ মৃত সাগরের স্ক্রলের গীতসংগীতের প্রাচীনতম বিদ্যমান কপির পাণ্ডুলিপিতে পাওয়া যায় এবং আরও ব্যাপকভাবে পাওয়া যায় ম্যাসোরেটিক গ্রন্থে, যা প্রাথমিক মধ্যযুগের। সেকালের টিবেরিয়ান লেখকরা দাবি করেছিলেন যে তারা তাদের কাজকে মন্দির-কালের চিহ্নগুলির উপর ভিত্তি করে লিপিবদ্ধ করছেন। (কোডেক্স কাইরেনসিসে মোশে বেন আশেরের 'সঙ্গ অফ দ্যা ভাইন' কোলোফন দেখুন)।

ম্যাসোরেটিক ক্যান্টিলেশনকে বোঝার জন্য বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা করা হয়েছে, তবে ২০তম শতাব্দীর শেষার্ধে সুজান হাইক-ভ্যানতুরা (১৯২৮-২০০০) এর গবেষণা সবচেয়ে বেশি সাফল্য এনেছে। তিনি ধরে নেন যে,  চিহ্নগুলি বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের স্কেলের ডিগ্রি - অর্থাৎ, স্বতন্ত্র নোটগুলি - কে প্রতিনিধিত্ব করে। এটি তাঁর অনুসন্ধানকে অন্যান্য সমস্ত বিদ্যমান ঐতিহ্যের সাথে সাংঘর্ষিক করে তোলে, যেখানে চিহ্নগুলি সর্বদা মেলোডিক মোটিফকে উপস্থাপন করে। এছাড়াও তাঁর অনুসন্ধানে পুরোনো স্বরলিপি পদ্ধতি যেমন ব্যাবিলনীয় এবং ফিলিস্তিনি পদ্ধতির কোনো হিসাব রাখা হয়নি।  তাই সঙ্গীতশাস্ত্রীরা হাইক-ভ্যানতুরার তত্ত্বগুলি প্রত্যাখ্যান করেছেন, কারণ তার ফলাফল সন্দেহজনক এবং তার পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ। এসত্ত্বেও, মিচেল বারবার এটির পক্ষে যুক্তি দেখিয়েছেন যে ম্যাসোরেটিক  ক্যান্টিলেশনের ওপর যখন এটি প্রয়োগ করা হয় তখন গীতসংগীত ১১৪ এর মতো চার্চ এবং সিনাগগের টোনাস পেরেগ্রিনাসের স্বীকৃত সুর পাওয়া যায়। মিচেল তার Songs of Ascents এর ধারাভাষ্যে গীতসংগীত ১২০-১৩৪ এর মন্দির স্তোত্রের সঙ্গীত প্রতিলিপি অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

পাঁচটি গ্রন্থে বিভক্তির দৃষ্টিভঙ্গি

[সম্পাদনা]

"The Flow of the Psalms" গ্রন্থে, ও. পামার রবার্টসন গীতসংহিতার পাঁচটি পুস্তকে একটি বিষয়ভিত্তিক অগ্রগতির ধারণা দেন, যেখানে প্রতিটির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং জোর রয়েছে:

পুস্তক ১: বিরোধিতা - মূলত দায়ূদের জন্য দায়ী, এই গীতগুলি উৎপত্তিতে প্রাচীনতম বলে বিবেচিত হয়। এই পুস্তকে ঈশ্বরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের উপর জোর দেওয়া হয়েছে, যেখানে যিহোবা হলেন প্রধান নাম।

পুস্তক ২: যোগাযোগ - অবিরাম বিরোধিতার মধ্যেও এই পুস্তকটি ঈশ্বরের শত্রুদের কাছেও আহ্বান প্রতিফলিত করে। ঈশ্বরের প্রচলিত নাম এখানে এলোহিমে পরিবর্তিত হয়, বিশেষ করে যখন পুস্তক ১ থেকে অংশগুলি ধার করা হয়। রবার্টসন পরামর্শ দেন যে পুস্তক ২ এর উৎপত্তি হতে পারে উত্তর রাজ্যে।

পুস্তক ৩: ধ্বংস - জেরুজালেমের পতনের দ্বারা চিহ্নিত, এই পুস্তকটি যাকোব এবং যোসেফের জন্য আশা রাখে, সম্ভবত দক্ষিণ ও উত্তর রাজ্যের প্রতীক হিসেবে। "ঈশ্বরে বিশ্বাস" এর মতো অভিব্যক্তি হ্রাস পায়।

পুস্তক ৪: পরিপক্বতা - বিশেষভাবে, ইতিহাস পুস্তক (Chronicles) থেকে ১০টিরও বেশি উদ্ধৃতি সহ, এটি প্রথম তিনটি বইয়ের বাইরে একটি লৌকিক অগ্রগতি নির্দেশ করে।

পুস্তক ৫: সমাপ্তি - রবার্টসন প্রস্তাব করেন যে, আরোহণের গীতসমূহ এবং হাল্লেল গীতসমূহ হল ব্যাবিলনীয় নির্বাসনের পরবর্তী রচনা। এগুলি বিভিন্ন বিষয় এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিপূর্ণতা চিত্রিত করে।

থিম ও বাস্তবায়ন

[সম্পাদনা]

অধিকাংশ স্তোত্রাবলীতে ঈশ্বরের শক্তি ও উপকারিতার জন্য তাঁর প্রশংসা করা হয়। তাঁর জগৎ সৃষ্টি এবং ইস্রায়েলকে তাঁর অতীতের উদ্ধারকাজের জন্য তাঁকে স্তুতি করা হয়। এই স্তোত্রগুলো এমন একটি জগতের কল্পনা করে যেখানে সকলেই ঈশ্বরের প্রশংসা করে এবং জবাবে তিনি তাদের প্রার্থনা শোনেন ও সাড়া দেন। কখনো কখনো ঈশ্বর "তাঁর মুখ লুকান" এবং সাড়া দিতে অস্বীকার করেন। এই ঘটনা স্তোত্রকারের মনে ঈশ্বর ও প্রার্থনার মধ্যেকার সম্পর্কের প্রশ্ন তোলে যা স্তোত্রাবলী গ্রন্থের একটি অন্তর্নিহিত ধারণা।

কিছু স্তোত্রাবলীকে "মাসকিল"(maschil) বলা হয় যার অর্থ "আলোকিত" বা "জ্ঞানের কথা", কারণ এইগুলি প্রজ্ঞা প্রদান করে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৪২তম স্তোত্র যাকে কখনো কখনো "দায়ূদের মাসকিল"(Maskil of David) বলা হয় ; অন্য মাসকিল গুলোর মধ্যে রয়েছে ৩২তম ও ৭৮তম স্তোত্র।

স্তোত্রাবলী গ্রন্থের একটি বিশেষ গোষ্ঠীকরণ এবং বিভাগ হল পনেরটি স্তোত্র (স্তোত্র ১২০-১৩৪) যেগুলো shir ha-ma'aloth ("উত্থানের গান") নামে পরিচিত। সা'দিয়া গাওন এর মতে, এই গানগুলো অন্যান্য স্তোত্র থেকে আলাদা কারণ লেবীয়রা এগুলো "উচ্চ সুরে" গাইত (Judeo-Arabic:  بلחן מרתפע‎)। আসাফের জন্য নিবেদিত প্রত্যেকটি স্তোত্র (যেমন ৫০, ৭৩-৮৩) তার বংশধররা করতাল ব্যবহার করে গাইত, ১ বংশাবলী ১৬:৫ অনুসারে। যখন "মহলাতের উপর" (যেমন স্তোত্র ৫৩ বা ৮৮) মুখবন্ধ পাওয়া যায়, তখন বোঝা যায় লেবীয়রা বড় আকারের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করত যার দুই দিকে চওড়া বন্ধ ভেজা থাকত এবং কাঠের লাঠি দিয়ে তাতে আঘাত করে বাজানো হত।

ও. পালমার রবার্টসন লক্ষ্য করেন যে অনেক স্তোত্র মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রচিত এবং তিনি বলেন "প্রত্যেক মানুষের জীবনের এই অপ্রাকৃত সমাপ্তি কেবলমাত্র আদি মানুষকে দেওয়া মূল হুমকির প্রসঙ্গেই বোঝা যেতে পারে:  ' যেদিন তুমি সেটি খাবে সেদিনই তুমি মরবে।'" রবার্টসন আরও বলেন  "কবর থেকে মুক্তির প্রত্যাশা মৃত্যুর অনিবার্যতাকে জয় করে। স্তোত্রকার পুরোপুরিভাবে ওই শেষ শত্রু থেকে সম্পূর্ণ উদ্ধারের প্রয়োজন সম্পর্কে অবগত এবং উদ্ধারের প্রত্যাশা প্রকাশ করে।"

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Helen C. Evans; William W. Wixom, সম্পাদকগণ (৫ মার্চ ১৯৯৭)। The Glory of Byzantium: Art and Culture of the Middle Byzantine Era, A.D. 843-1261। Metropolitan Museum of Art। পৃষ্ঠা 86আইএসবিএন 9780870997778। সংগ্রহের তারিখ ৫ মার্চ ২০১৮ – Internet Archive-এর মাধ্যমে। 
  2. "Psalm." Longman Pronunciation Dictionary. Pearson.
  3. Mazor 2011, পৃ. 589।
  4. Berlin ও Brettler 2004, পৃ. 1282।
  5. "The Bible - Google Books"। সংগ্রহের তারিখ ২০২২-০৯-২৪ 
  6. Bullock 2004, পৃ. 58।
  7. Catholic Encyclopedia, The Biblical Commission, published by New Advent, accessed 19 November 2021