১৯১৮ সালে ভারতের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

১৯১৮ সালে ভারতের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী বলতে স্পেনীয় ফ্লুয়ের বৈশ্বিক মহামারীর অংশ হিসেবে ১৯১৮ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে ভারতে একটি অস্বাভাবিক প্রাণঘাতী ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারীর প্রাদুর্ভাবের ঘটনাটিকে বোঝানো হয়। এটিকে বোম্বে ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বোম্বে জ্বর নামেও ভারতে ডাকা হয়ে থাকে।[১][২] অনুমান করা হয় যে এই মহামারীর কারণে ভারতে ১ কোটি ২০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৭০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়েছিল, যা ছিল সারা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ।[৩][৪] আর্নল্ড (২০১৯)-এর প্রাক্কলন অনুযায়ী পারয় ১ কোটি ২০ লক্ষ লোকের মৃত্যু হয়, যা ছিল ভারতের তৎকালীন জনসংখ্যার প্রায় ৫%।[৫]

ভারতে মহামারীটি প্রথমে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) শহরে ১৯১৮ সালের জুন মাসে ছড়িয়ে পড়ে।[৬][৭] প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাদেরকে ইউরোপ থেকে নিয়ে ফেরত আসা জাহাজগুলিকে ভাইরাসটির একটি সম্ভাব্য উৎস হিসেবে গণ্য করা হয়।[৬][৮] এরপরে রোগটি পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারত থেকে ক্রমে পূর্বে ও উত্তরে ছড়িয়ে পড়ে[৮] এবং আগস্ট মাসের মধ্যেই দেশের সর্বত্র পৌঁছে যায়।[৯] এটি দেশের ভিন্ন ভিন্ন অংশে তিনটি তরঙ্গে আঘাত হানে, যাদের মধ্যে দ্বিতীয় তরঙ্গটির ক্ষেত্রে মৃত্যুহার ছিল সবচেয়ে বেশি।[৬][৯] বোম্বে শহরে ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে, মাদ্রাস (বর্তমান চেন্নাই) শহরে অক্টোবরের মাঝামাঝি এবং কলকাতা শহরে নভেম্বরের মাঝামাঝি মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি ছিল। [৭]

মহামারীটি ২০ থেকে ৪০ বছর বয়সী তরুণদেরকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, এবং পুরুষদের চেয়ে নারীরা আনুপাতিকভাবে অনেক বেশি কষ্টের স্বীকার হন।[৯] ১৯১৮ সালের স্বাস্থ্য কমিশনারের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বোম্বে ও মাদ্রাস এই দুই শহরের এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ সংখ্যক ২০০-রও বেশি ব্যক্তি মারা যায়।[৭] মৌসুমী বৃষ্টি ঠিকমতো হয়নি বলে একই সময়ে ভারতে খরার মতো অবস্থার সৃষ্টিহয় এবং ফলে অনেক ব্যক্তি অভুক্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে ও ঘনবসতিপূর্ণ শহরে অভিবাসন করে; এ ব্যাপারটি ইনফ্লুয়েঞ্জার বিস্তারকে আরও ভয়াবহ রূপ দান করে।[২] মহামারীটি এতই গুরুতর ছিল যে ১৯১৯ সালে ভারতে শিশু জন্মের সংখ্যা ৩০% হ্রাস পায়।[৯] ১৯১১-১৯২১ দশকে ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ১.২%, যা ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলের সব দশকগুলির মধ্যে সর্বনিম্ন। হিন্দি কবি সূর্যকান্ত ত্রিপাঠী তাঁর স্মৃতিচারণমূলক রচনাতে লেখেন যে "গঙ্গানদী মানুষের মৃতদেহের কারণে ফুলে উঠেছিল।" ১৯১৮ সালের স্বাস্থ্য কমিশনারের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয় যে ভারত জুড়ে সব নদী মৃতদেহের কারণে পানির প্রবাহ আটকে গিয়েছিল,[৬] কেননা চিতায় শবদেহ পোড়ানোর মতো যথেষ্ট লাকড়ি ছিল না।[৯]

ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা মহাত্মা গান্ধীও এই ভাইরাসে আক্রান্ত হন।[৪] এই মহামারীটি স্বাধীনতা সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখে। দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা চিকিৎসার চাহিদার হঠাৎ বৃদ্ধি সামাল দিতে সক্ষম হয়নি। এর ফলস্বরূপ যে ব্যাপক মৃত্যু ও দুঃখকষ্টের সৃষ্টি হয় এবং অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে, তার কারণে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জনরোষ আরও ফুঁসে ওঠে।[৪][৬]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. "Deja flu: Spanish Lady killed 14 million in British India a century ago"Times of India। ২০২০-০৩-০৮। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৮ 
  2. "Coronavirus: What India can learn from the deadly 1918 flu"BBC। ২০২০-০৩-১৮। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-১০ 
  3. Mayor, S. (২০০০)। "Flu experts warn of need for pandemic plans"British Medical Journal321 (7265): 852। ডিওআই:10.1136/bmj.321.7265.852পিএমআইডি 11021855পিএমসি 1118673অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  4. "How the Spanish flu changed the course of Indian history"Gulf News। ২০১৫-০৩-১৫। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৮ 
  5. David Arnold, "Dearth and the Modern Empire: The 1918–19 Influenza Epidemic in India," Transactions of the Royal Historical Society 29 (2019): 181-200
  6. "An unwanted shipment: The Indian experience of the 1918 Spanish flu"Economic Times। ২০২০-০৪-০৩। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৮ 
  7. Chandra S, Kassens-Noor E (২০১৪)। "The evolution of pandemic influenza: evidence from India, 1918–19"BMC Infectious Diseases14 (510)। 
  8. "Pandemics of the Past"India Today। ২০২০-০৩-১৮। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৪-০৮ 
  9. Mills, I D (১৯৮৬)। "The 1918-1919 Influenza Pandemic— The Indian Experience"। The Indian Economic & Social History Review23 (1)। ডিওআই:10.1177/001946468602300102