হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
"গ্রুস অস হ্যামিলন", ১৯০২

হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার (জার্মান: Rattenfänger von Hameln) গল্পটি পৃথিবী বিখ্যাত। আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছরের বেশি আগে জার্মানির ছোট্ট শহর হ্যামিলিনে ঘটেছিল বিখ্যাত এ ঘটনাটি। হ্যামিলিনের গির্জার দেয়ালে আঁকা ছবি থেকে প্রথম এ ঘটনার কথা জানতে পারে মানুষ। পরে এ নিয়ে গল্প-কবিতা লিখেছেন গ্রিম ভ্রাতৃদ্বয় মতো অনেকেই। এ ঘটনার পেছনে যুক্তি খুঁজতে গিয়ে অনেকে বলেন, জার্মানির উত্তর-পূর্বে স্লাভ অধ্যুষিত দেশগুলোতে উপনিবেশ গড়ে তোলার জন্য শহর ছেড়েছিল হ্যামিলিনের বেশ কিছু অল্পবয়সী অধিবাসী। তাদের এই দেশান্তরী হওয়ার ঘটনাই পরে গল্প-গাঁথায় উঠে এসেছে। কেউ বলেন, সে সময় ভয়ঙ্কর মরণরোগের শিকার হয়েছিল হ্যামিলিনের খুদে বাসিন্দারা। পরে সেই রোগকেই বাঁশিওয়ালার প্রতীকী রূপ দেয়া হয়।এর সত্যতা নিয়ে অনেকের মধ্যে সন্দেহ আছে বটে, কিন্তু এরপরও পুরো ঘটনাটি বিশ্ব ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে।

The oldest picture of Pied Piper copied from the glass window of Marktkirche in Goslar

পটভূমি[সম্পাদনা]

সাতশ' বছর আগের জার্মানি আজকের মতো আধুনিক ছিল না। যেমন এলোমেলো ছিল জার্মানির ছোট্ট শহর হ্যামিলিন। হ্যামিলিন ছিল জার্মানির হানোভারের ৩৩ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত একটি ছোট্ট শহর। শহরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একাদশ শতাব্দীতে। আর আজ থেকে সাতশ' বছরেরও আগে গোটা শহরের মানুষ ইঁদুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ইঁদুরবাহিত রোগ যেমন মহামারির আকার ধারণ করে, ঠিক তেমনি ইঁদুরের অত্যাচার দিন দিন বেড়েই চলছিল। কোনো উপায়ন্তর না দেখে হ্যামলিন শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা ইঁদুরের হাত থেকে বাঁচার জন্য পৌরসভায় মিটিংয়ে বসলেন। মেয়রের নেতৃত্বে সবাই মিলে একজোট হয়ে ঠিক করলেন, শহরকে ইঁদুরের হাত থেকে যে বাঁচাতে পারবে তাকে মোটা অঙ্কের পুরস্কার দেওয়া হবে। সেই ঘোষণায় সাড়া দিয়ে শহরে এসে হাজির হলো রহস্যময় এক বাঁশিওয়ালা। সে জানাল তার বাঁশির সুরে শহরকে ইঁদুরমুক্ত করা সম্ভব। শুনে সবাই অবাক; কিন্তু নিরুপায় হ্যামলিনবাসীর কিছুই করার ছিল না। বাঁশিওয়ালাকে মোটা অঙ্কের পুরস্কারের বিনিময়ে শহরকে ইঁদুরমুক্ত করার আদেশ দিলেন মেয়র। বাঁশি বাজাতে শুরু করলেন বাঁশিওয়ালা। বড় অদ্ভুত সেই সুর। তার বাঁশির শব্দ শুনে গর্ত থেকে বেরিয়ে এলো সব ইঁদুর। যেখানে যেরকম ইঁদুর ছিল সবই বেরিয়ে এলো বাঁশিওয়ালার মায়াবী সুরের টানে। একসময় ইঁদুরগুলোকে নিয়ে গিয়ে ওয়েজার নদীতে ফেলে দিলো বাঁশিওয়ালা। এরপর পারিশ্রমিক চাইতে গেলে মুখ ফিরিয়ে নিল শহরের মেয়র ও গণ্যমান্য মানুষরা। রেগে গিয়ে তখনকার মতো শহর ছেড়ে চলে গেল সেই বাঁশিওয়ালা। কিছুদিন পর এক ধর্মীয় উৎসবের দিনে শহরের বড়রা যখন গির্জায় জমায়েত হয়, তখন আবার ফিরে এলো বাঁশিওয়ালা। এবার তার বাঁশির সুরে বেরিয়ে এলো শহরের ছোট ছোট শিশুরা। তাদের সঙ্গে নিয়ে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল সেই বাঁশিওয়ালা। শিশুদের মধ্যে দু'জন দল থেকে পিছিয়ে পড়েছিল। তারাই নাকি ফিরে এসে এসব কথা জানাল শহরবাসীকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শিশু দু'টির একজন মূক ও অন্যজন দৃষ্টিহীন হওয়ায় বাঁশিওয়ালার গন্তব্য সম্বন্ধে সঠিক তথ্য আর জানা যায়নি। কেউ বলেন, শহরের বাইরে কোপেলবার্গ পাহাড়ের মাথার গুহায় ঢুকে গিয়েছিল সে। কেউ বলেন, ইঁদুরের মতো শিশুদেরও সলিলসমাধি দেয় সেই বাঁশিওয়ালা। সাধাসিধেভাবে বললে মূল গল্পটি এমনই। তবে এ নিয়ে মতভেদেরও কমতি নেই।

আরেকটি মতবাদ অনুসারে বাঁশিওয়ালা যখন শিশুদের নিয়ে রওনা দেয়, তখন শহরের কারোরই কিছু করার ছিল না। কারণ সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বাঁশির সুর শুনছিল। স্বয়ং মেয়রের মুগ্ধতাও বাঁশির সুরেই নিবিষ্ট ছিল। বাঁশিওয়ালা মায়াবী সুরের টানে বাঁশি বাজাতে বাজাতে এগিয়ে যাচ্ছিল। আর শিশুরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো অনুসরণ করছিল। একসময় বাঁশিওয়ালা শিশুদের নিয়ে হ্যামিলিন শহরের পাঁচিল বেয়ে একটা পাহাড়ের দিকে গেল। এরপর পাহাড়টি হঠাৎ দু'ভাগ হয়ে গেল। আর তখন বাঁশিওয়ালা শিশুদের নিয়ে সেই পাহাড়ের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেল। সেই রহস্যময় বাঁশিওয়ালাকে কিংবা সেসব শিশুকে এরপর আর কখনোই দেখা যায়নি। বলা হয়ে থাকে ১২৮৪ সালের ২২ জুলাই ঘটনাটি ঘটেছে।

ইতিহাসবিখ্যাত এ ঘটনাটির সত্যতা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। অনেকে যেমন ঘটনাটিকে মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, তেমনি যুক্তি দেখিয়ে অনেকেই চেষ্টা করেন ঘটনাটির সত্যতা প্রমাণের জন্য। আবার একে নেহাতই গল্প বলে উড়িয়ে দেওয়ার লোকের সংখ্যাও কম নয়।

দীর্ঘদিন অমীমাংসিত এই রহস্যের বিস্তর গবেষণা হয়েছে। হ্যামিলিন শহরের পৌরসভায় রাখা কাগজপত্র তন্নতন্ন করে খোঁজা হয়েছে এ ঘটনার কোনো সত্যতা আছে কি-না তা জানার জন্য। কিন্তু সেখানে এরকম কিছুই খুঁজে পাওয়া যায়নি।

The Lame Child

হ্যামিলিন শহরে এ সংক্রান্ত একটি জাদুঘর রয়েছে। ওই জাদুঘরে সঞ্চিত পঞ্চদশ শতাব্দীতে লেখা কয়েকটি বইয়ে এ রহস্যময় কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে। সেখানে এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেওয়া আছে। ফ্রাউ ভন লিউড নামের এক ১৩ বছরের বালক বলেছে, বাঁশিওয়ালার বয়স আনুমানিক ছিল ৩০। দেখতে ছিল অস্বাভাবিক রকম সুদর্শন। তার বাঁশিটি ছিল রুপার তৈরি। অন্য এক নথিতে পাওয়া যায় ১৩০০ শতাব্দীতে হ্যামিলিনের বাজারে এক কাঠের ফলক ছিল। সেখানে এক বংশীবাদক ও অনেক শিশুর ছবি ছিল। সেটা ১৭০০ সালে ঝড়ে ধ্বংস হয়ে যায়। আরেকটি ঘটনায় হ্যামিলিন শহরে নিকোলাস নামের এক অসৎ ব্যক্তির বর্ণনা পাওয়া যায়। যে কি-না শিশুদের মধ্যপ্রাচ্যে পাচার করে দিয়েছিল। অনেকে হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালার সঙ্গে এই ঘটনারও যোগসাজশ খোঁজেন। সেখানকার একটি রাস্তার নাম বাঙ্গেলোসেন্ট্রাস। যার অর্থ 'যে রাস্তায় বাজনা বাজে না'। ওই রাস্তার একটি কাঠের ফলকে খোদাই করা আছে ১৮২৪ সালের ২৬ জুন হ্যামিলিনের ১৩০টি শিশুকে এক রংচঙা ব্যক্তি অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল যাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। হ্যামিলিনের বাঁশিওয়ালা গল্পে ইঁদুর দ্বারা আক্রান্ত শহরের কথা বলা হয়েছে। কেননা মধ্যযুগে ইউরোপে প্লেগরোগ ভয়াবহ আকার ধারণ করে। তখন ইঁদুর ধরার জন্য এক ধরনের বিশেষ লোক দেখা যেত। বিজ্ঞান বলে, হাই ফ্রিকুয়েন্সির শব্দতরঙ্গ দিয়ে ইঁদুরকে আকৃষ্ট করা যায়। হ্যামিলিনের জাদুঘরে একটি প্রাচীন টিনের বাঁশি রাখা আছে। ধারণা করা হয় প্রাচীনকালে ইঁদুর ধরিয়েরা এ ধরনের বাঁশি ব্যবহার করত। ইতিহাস থেকে আরও জানা যায়, ১২৮৪ সালে হ্যামিলিনে দুটি ঘটনা ঘটে। একটি হচ্ছে প্লেগ, অন্যটি নাচুনে রোগ। এক বিশেষ ধরনের খাদ্য বিষক্রিয়ায় এ রোগ দেখা দেয়। এতে রোগী ঘণ্টার পর ঘণ্টা নাচতে থাকে। লাল রং তাদের আকৃষ্ট করত খুব। সাধারণত ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাই এ রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। এ দুটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে গল্পটির বর্ণনা দেন হ্যান্স ডোবারটিন। বর্তমানে হ্যামিলিনে যে পৌরসভা রয়েছে, তার নামের অর্থ হলো 'ইঁদুর ধরা লোকের বাড়ি'। এটি নির্মিত হয় ১৬০২ সালে। এর দেয়ালে বিশ্ববিখ্যাত কাহিনীটির ছবি চমৎকারভাবে আঁকা আছে।

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

বহিঃসংযোগ[সম্পাদনা]