হারাম (স্থান)
হারাম (আরবি: حَرَم, প্রতিবর্ণীকৃত: ḥaram, অনুবাদ 'sanctuary', আক্ষরিক অর্থে 'পবিত্র স্থান'), মুসলিমরা সাধারণত মক্কার আল-মসজিদ আল-হারাম এবং মদিনার মসজিদে নববী উল্লেখ করতে এই শব্দটি ব্যবহার করেন। এই দুই পবিত্র স্থানে অবস্থানের সময় মুসলমানদের অবশ্যই কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মানতে হবে।[১]
অতীতে ব্যবহৃত হলেও বর্তমানে প্রচলন কমে যাওয়া 'হারাম' শব্দের আরেকটি অর্থ হল "অলঙ্ঘনীয় / সুরক্ষিত অঞ্চল"। এই অর্থে, এমন এক এলাকাকে বোঝানো হতো যেখানে বসবাসরত পরিবারের সংখ্যা সীমিত রাখা হতো। ক্ষেত্রবিশেষে এর সাথে পরিবেশের ধারণক্ষমতার ধারণা এবং প্রকৃতি সংরক্ষণের প্রাথমিক রূপগুলিও যুক্ত ছিল। 'হারাম' শব্দটি মসজিদের নামাজের স্থান বোঝাতেও ব্যবহৃত হতো।
ব্যুৎপত্তি
[সম্পাদনা]আরবি ভাষায় দুটি আলাদা শব্দ রয়েছে, ḥaram (حَرَم) এবং ḥarām (حَرَام), উভয়ই একই ত্রিবর্ণীয় সেমিটিক মূল Ḥ-R-M থেকে উদ্ভূত। উভয় শব্দই সাধারণভাবে "নিষিদ্ধ" এবং/অথবা "পবিত্র" অর্থ বহন করতে পারে,[২] তবে প্রতিটির কিছু বিশেষ অর্থও রয়েছে (ḥarām প্রায়শই "আইন দ্বারা নিষিদ্ধ" অর্থ বহন করে[৩])। একই মূল থেকে উদ্ভূত তৃতীয়টি সম্পর্কিত শব্দ, ḥarīm (حَرِيْم), ইংরেজি "হ্যারেম" এর সাথে সবচেয়ে সরাসরি সঙ্গতিপূর্ণ। এই নিবন্ধটি ḥaram শব্দটি (স্বরবর্ণ সহ একবচনে)
ইসলামে
[সম্পাদনা]সুরক্ষিত অঞ্চল
[সম্পাদনা]ইসলামী নগর পরিকল্পনায় 'হারাম' শব্দটি দ্বারা একটি "অলঙ্ঘনীয় অঞ্চল" বোঝানো হয়। মুসলিম সভ্যতায় এটি নগর পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। এই ধরনের সুরক্ষিত অঞ্চলগুলিকে অভয়ারণ্য হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বিবাদমান পক্ষগুলি এখানে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের মতপার্থক্য নিষ্পত্তি করতে পারতো। সাধারণত নদীর তীরে শহরগুলি গড়ে উঠতো। নদীর উজানে পানীয় ও গৃহস্থালীর কাজে ব্যবহারের জন্য জলের উৎস এবং নিম্ন প্রান্তে বর্জ্য ও নর্দমা অপসারণের জন্য প্রবাহ ব্যবস্থা থাকতো। মুসলমানরা দাবী করে যে তারাই সর্বপ্রথম 'বহন ক্ষমতা'র ধারণা প্রবর্তন করেছে এবং স্পষ্টতই তারা কখনও কখনও কোনো নির্দিষ্ট শহরে বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা সীমিত রাখত।
প্রাকৃতিক উদ্যান ও সবুজ এলাকায় প্রবেশ নিশ্চিত করতে, নগর সম্প্রসারণ সীমিত করতে, জলাধার, জলাশয় এবং মরুদ্যান রক্ষা করতে 'হারাম' গুলোকে সাধারণত উপযুক্ত অবস্থানে নির্ধারণ করা হত। এই বিষয়ে, আধুনিক যুগের জোনিং আইনের সাথে হারামের নিয়মগুলির যথেষ্ট মিল রয়েছে।
কেউ কেউ মনে করেন, 'হারাম' এবং 'হিমা'র মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণ করা প্রয়োজন ছিল, কারণ সীমাবদ্ধতা আরোপ করা হবে এমন অঞ্চল নির্বাচনে দুইটি ভিন্ন পদ্ধতি ছিল। হারাম অঞ্চল নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় সম্প্রদায়ের মতামত গুরুত্ব পেতো, অন্যদিকে হিমা নির্বাচন অঞ্চলটির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিল। জ্ঞানী ব্যক্তিরা প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যসমূহ ভালোভাবে অনুধাবন করতে পারতেন বলেই হিমা নির্বাচনে তাদের মতামত বেশি গুরুত্ব পেতো। মূলত ইসলামে দুটি ভিন্ন দায়িত্বের ভিত্তিতে এই পার্থক্যের ধারণাটি এসেছে। এই দায়িত্ব দুটি হলো - ইজমা (ইসলামের আওতায় প্রতিবেশীদের ঐকমত্যকে সম্মান করা) এবং খিলাফাহ (আল্লাহর দেওয়া নির্দেশনা মেনে প্রকৃতির যত্ন নেওয়া)। তবে ঐতিহাসিকভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এগুলোর ভূমিকা কী ছিল সেটি সঠিকভাবে জানা যায় না।
'হারাম' একটি সংরক্ষিত ও অলঙ্ঘনীয় অঞ্চল হিসাবে বিবেচিত হয় বলে মসজিদের ভেতরে যে নির্দিষ্ট জায়গায় নামাজ ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি অনুষ্ঠিত হয় সেটিকেও 'হারাম' বলা হয়। এটি হল মসজিদের নামাজের স্থান।[৪]
পবিত্র স্থান
[সম্পাদনা]'হারাম' শব্দটি উচ্চ পবিত্রতার স্থানকেও নির্দেশ করে। ইসলাম ধর্মে, সবচেয়ে পবিত্র দুটি স্থান হল মক্কার আল-মসজিদ আল-হারাম (যাকে কুরআনুল কারীমে "হারামান আমিনান" নামে অভিহিত করা হয়েছে) এবং মদিনার মসজিদে নববী। এই দুই স্থানের জন্যই আরবিতে দ্বৈত রূপ 'আল-হারামান' বা 'আল-হারামাইন' ব্যবহার করা হয়। উভয় স্থানই আরব উপদ্বীপের হেজাজ অঞ্চলে অবস্থিত। ১৯৮৬ সাল থেকে সৌদি রাজবংশ "দুই পবিত্র তীর্থক্ষেত্রের রক্ষক" বা "দুই পবিত্র মসজিদের রক্ষক" উপাধি ব্যবহার করে আসছে।[৫][৬]
তাছাড়া, জেরুজালেমের মসজিদ আল-আকসাসহ ('আল হারাম আল শরীফ') অন্যান্য পবিত্র স্থানগুলিকেও সাধারণত 'হারাম' শব্দ দ্বারা উল্লেখ করা হয়। তবে ইবনে তাইমিয়া ধর্মতাত্বিকের মতো ব্যক্তিবর্গ এর প্রতিবাদ করেন। তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে মক্কা, মদিনা এবং সম্ভবত তায়েফের ওয়াজ্জ উপত্যকা ছাড়া অন্য কোনও স্থানকে বৈধভাবে "হারাম" বলা যায় না। তিনি হেবরন এমনকি জেরুজালেমের মতো স্থানের পবিত্রতা মর্যাদাকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বস্তুত, জেরুজালেমের একটি ইসলামী নাম হল "থালিথ আল-হারামাইন" যার অর্থ "দুই পবিত্র স্থানের তৃতীয়টি"। এটি কিছুটা বিপরীতধর্মীভাবে মক্কা ও মদিনার অপ্রতিদ্বন্দ্বী বৈশিষ্ট্যের সাথে জেরুজালেমের বিশেষ মর্যাদাকে স্বীকৃতি প্রদান করেছে। মসজিদ আল-আকসা (কুরআনে নামে উল্লেখিত কয়েকটি মসজিদের মধ্যে অন্যতম এবং ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ) ঐতিহাসিকভাবে নিজস্ব মর্যাদায় পবিত্র স্থান হিসেবে গণ্য।[৭]
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ "Is al-Masjid al-Aqsa considered to be a sanctuary? - Islam Question & Answer"। islamqa.info (ইংরেজি ভাষায়)। সংগ্রহের তারিখ ২০২৩-০৯-০৬।
- ↑ Mohammad Taqi al-Modarresi (২৬ মার্চ ২০১৬)। The Laws of Islam (পিডিএফ) (ইংরেজি ভাষায়)। Enlight Press। আইএসবিএন 978-0994240989। ২ আগস্ট ২০১৯ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ ডিসেম্বর ২০১৭।
- ↑ Adamec, Ludwig (২০০৯)। Historical Dictionary of Islam, 2nd Edition। Lanham, Maryland: Scarecrow Press, Inc.। পৃষ্ঠা 102। আইএসবিএন 9780810861619।
- ↑ Henri Stierlin and Anne Stierlin, Islam: Early architecture from Baghdad to Córdoba, Taschen, 1996, p. 235
- ↑ "Custodian of the Two Holy Mosques King Abdullah bin Abdulaziz"। The Saudi Embassy in Tokyo, Japan। জানুয়ারি ২০, ২০১১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ এপ্রিল ৬, ২০১১।
- ↑ Fakkar, Galal (২৭ জানুয়ারি ২০১৫)। "Story behind the king's title"। Arab News। Jeddah। সংগ্রহের তারিখ ২৭ জুন ২০১৬।
- ↑ Michigan Consortium for Medieval and Early Modern Studies (১৯৮৬)। Goss, V. P.; Bornstein, C. V., সম্পাদকগণ। The Meeting of Two Worlds: Cultural Exchange Between East and West During the Period of the Crusades। 21। Medieval Institute Publications, Western Michigan University। পৃষ্ঠা 208। আইএসবিএন 0918720583।