বিষয়বস্তুতে চলুন

শৌল

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
শৌল
שָׁאוּל
১৮৭৮ সালের এর্নস্ট জোসেফসন-এর তৈলচিত্রে শৌলের চিত্রণ
ইসরায়েলের রাজা
রাজত্বআনু. ১০৩০ খ্রিস্টপূর্ব – আনু. ১০১০ খ্রিস্টপূর্ব
উত্তরসূরিঈশ্‌বোশেত[][]
দাম্পত্য সঙ্গী
বংশধর
পূর্ণ নাম
Saul ben Kish (שאול בן קיש)
রাজবংশশৌলের বংশ
পিতাকীশ

শৌল (/sɔːl/; হিব্রু ভাষায়: שָׁאוּל‎, Šāʾūl; প্রাচীন গ্রিকΣαούλ, Saoúl; অনু. "প্রার্থিত" বা "অনুরোধকৃত") ছিলেন প্রাচীন ইসরায়েল ও যিহূদার এক রাজা এবং হিব্রু বাইবেলপুরাতন নিয়ম অনুযায়ী ইসরায়েলের প্রথম রাজা। তিনি একক রাজত্ব নামক একটি রাজনৈতিক কাঠামোর অধীনে রাজত্ব করেন, যার ঐতিহাসিক বাস্তবতা অনিশ্চিত।

পরম্পরাগতভাবে, তাঁর শাসনকাল একাদশ শতকের শেষভাগে স্থাপন করা হয়। বাইবেলের বর্ণনা অনুযায়ী, তাঁর শাসনই ইসরায়েলীয়দের বিচিত্র গোত্রসমূহের বিচ্ছিন্ন সমাজ থেকে একটি সংগঠিত রাষ্ট্রব্যবস্থায় রূপান্তরের সূচনা করেছিল।[]

তবে শৌলের ঐতিহাসিকতা এবং ঐক্যবদ্ধ রাজ্যের অস্তিত্ব নিয়ে সকল ঐতিহাসিক একমত নন, কারণ এ বিষয়ে যা জানা যায় তা প্রায় সম্পূর্ণই হিব্রু বাইবেলের উপর নির্ভরশীল।[][]

বাইবেল অনুযায়ী, শৌল শমূয়েল দ্বারা ইসরায়েলীয়দের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হন এবং গিবেয়া থেকে শাসন করেন। গিলবোয়া পর্বতে পলিস্তীয়দের সঙ্গে যুদ্ধে শৌল নিজের তলোয়ার নিজের উপর চালিয়ে আত্মহত্যা করেন। ঐ যুদ্ধে তাঁর তিন পুত্রও নিহত হন। পরে তাঁর পুত্র ঈশ্‌বোশেত সিংহাসনে আরোহণ করেন, তবে তিনি মাত্র দুই বছর রাজত্বের পর নিজের সামরিক অধিনায়কদের হাতে নিহত হন। এরপর শৌলের জামাতা দায়ূদ রাজা হন।

শৌল রাজত্ব ও মৃত্যুর বাইবেলীয় বর্ণনায় একাধিক পাঠ্যবৈপরীত্য এবং শব্দ নিয়ে খেলা দেখা যায়, যা বিভিন্ন পণ্ডিত আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে তাঁর অভিষেক ও মৃত্যুর ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ, দায়ূদের আবির্ভাবের পর শৌলের চরিত্রে নেতিবাচক পরিবর্তন এবং শমূয়েলের জন্মকাহিনিতে শব্দগত অসঙ্গতি—যা কিছু গবেষক বিশ্বাস করেন, মূলত শৌলের জন্মকাহিনি ছিল।

বাইবেলীয় সমালোচনা

[সম্পাদনা]
শৌলের দেহের অবমাননা, ১৫৬০-এর দশক

শৌলের রাজত্ব ও মৃত্যুকে ঘিরে বাইবেলীয় পাঠে বিভিন্ন পাঠ্যগত ও কাহিনিভিত্তিক অসামঞ্জস্যতা রয়েছে, যেগুলো নিয়ে বহু পণ্ডিত আলোচনা করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে শৌলের রাজা হওয়া ও মৃত্যুর বিরোধপূর্ণ বিবরণ এবং শব্দ নিয়ে বিভিন্ন রকম খেলা বা রূপক।

প্রবক্তা শমূয়েলের জন্মকাহিনি (১ শমূয়েল ১:১–২৮) অনুসারে, তাঁর মাতা হান্না ঈশ্বর ইয়াহ্‌ভের নিকট এক পুত্রের জন্য প্রার্থনা করেন এবং সেই সন্তানকে শিলোর মন্দিরে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন। এই অংশে শৌল নামের মূল শব্দমূল নিয়ে বিভিন্ন শব্দচাতুর্যের ব্যবহার দেখা যায় এবং পাঠ্যটি শেষ হয় বাক্যাংশ দিয়ে – hu sa'ul le-Yahweh, অর্থাৎ 'সে ইয়াহ্‌ভের জন্য উৎসর্গীকৃত'। যদিও হান্না তাঁর সন্তানের নাম দেন শমূয়েল, এবং ব্যাখ্যা করেন যে "কারণ আমি ঈশ্বরের নিকট থেকে তাঁকে প্রার্থনা করেছিলাম", শমূয়েল নামটির অর্থ হতে পারে "ঈশ্বরের নাম", "ঈশ্বর শুনেছেন", বা "ঈশ্বর বলেছে"। পণ্ডিতদের মতে, এই নাম ও কাহিনির শব্দমূলের সঙ্গে শৌলের নাম অনেক বেশি সাযুজ্যপূর্ণ। বহু গবেষকের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই কাহিনি সম্ভবত মূলত শৌলের জন্ম নিয়ে রচিত হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীকালে এটি শমূয়েলের জন্য ব্যবহৃত হয়েছে, যাতে দায়ূদ ও শমূয়েলের অবস্থান দৃঢ় হয় এবং শৌলের গুরুত্ব কমানো যায়।[]

বাইবেলে শৌল সম্পর্কে বর্ণনার ধরণ সময়ের সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। বিশেষ করে যখন দায়ূদ কাহিনিতে প্রবেশ করেন (১ শমূয়েলের মধ্যভাগে), তখন শৌলের চরিত্রে নেতিবাচকতা ফুটে ওঠে। শুরুতে তাঁকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হলেও পরবর্তীতে তাঁর ভাবোন্মাদ ভবিষ্যদ্বাণীকে উন্মত্ততা হিসেবে বর্ণনা করা হয়, তাঁর ভুল ও শমূয়েলের আদেশ অমান্য করার দিকগুলো জোর দিয়ে দেখানো হয় এবং তাঁকে এক ধরনের প্যারানয়েড হিসেবে চিত্রিত করা হয়। এর থেকে বোঝা যায়, দায়ূদের প্রতি অনুগত একটি সূত্র থেকে এই অংশ যোগ করা হতে পারে। ২ শমূয়েল ১-এ দায়ূদের শোকগাথা সম্ভবত শৌলের মৃত্যুর দায় থেকে নিজেকে অব্যাহতি দেওয়ার একটি প্রচেষ্টা।[]

১ শমূয়েল ৯:১–১০:১৬-এ শৌলের গোপন অভিষেকের বিবরণে তাঁকে "রাজা" (মেলেখ) না বলে "নেতা" বা "সেনাপতি" (নগীদ) বলা হয়েছে।[][] পরে গিলগালে জনসমক্ষে অভিষেক অনুষ্ঠানে তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে "রাজা" উপাধি দেওয়া হয়।[১০]

শৌলের মৃত্যুর দুটি ভিন্ন বিবরণ মেলাতে বহু গবেষক চেষ্ট করেছেন। যোসেফুস লেখেন, শৌল আত্মহত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হন, তাই তিনি একজন আমালেকীয়কে অনুরোধ করেন তাঁকে হত্যা করতে।[১১] আধুনিক সমালোচকরা ধারণা করেন, শৌলের মৃত্যুর কাহিনি বিভিন্ন উৎস থেকে গৃহীত হয়েছে এবং একত্রে সংকলিত হয়েছে, যদিও এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, কারণ সম্পাদনার সময় বিরোধপূর্ণ বিবরণ কেন রেখে দেওয়া হলো তা ব্যাখ্যা করা কঠিন।[১১] যেহেতু ২ শমূয়েলে কেবল আমালেকীয়ের বর্ণনাই পাওয়া যায়, কিছু গবেষকের মতে, সেই আমালেকীয় সম্ভবত দায়ূদের অনুগ্রহ পেতে মিথ্যা বলেছিল। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে ১ শমূয়েলের বিবরণটি প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরে, আর ২ শমূয়েলের অংশটি আমালেকীয়ের দাবি মাত্র।[১২]

প্রাচীন রাব্বিনিক দৃষ্টিভঙ্গি

[সম্পাদনা]

প্রাচীন রাব্বিনিক সাহিত্যে শৌল সম্পর্কে দুটি বিপরীতমুখী মতামত পাওয়া যায়। একটিতে, যেকোনো শাস্তিকে অপরাধের প্রমাণ হিসেবে ধরা হয়; সেই অনুসারে, শৌলের প্রতি কোনো পবিত্র বা নায়কোচিত ভাবমূর্তি থাকা উচিত নয়। "তাঁর মধ্যে এক মনোনীত যুবক, এবং রূপে সুন্দর"—এই বাক্যাংশটি[১৩] এখানে ব্যাখ্যা করা হয় যে, শৌল সর্বদিক দিয়ে ভালো ছিলেন না, বরং কেবল বাহ্যিক সৌন্দর্যেই "সুন্দর" ছিলেন।[১৪] এই মতানুসারে, শৌল ছিলেন একটি "দুর্বল শাখা",[১৫] যিনি নিজের গুণে নয়, বরং তাঁর পিতামহের কারণে রাজত্ব লাভ করেন। তাঁর পিতামহ লোকদের বেত্‌ মিদ্রাশে যেতে সাহায্য করার জন্য রাস্তায় আলো দিতেন, যার পুরস্কারস্বরূপ তাঁর পৌত্রকে সিংহাসনে বসার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।[১৬]

অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে শৌল একজন মানুষ, বীর ও রাজা হিসেবে সর্বোত্তম আলোকে উপস্থাপন করা হয়। এই মতে, তাঁর বিনয় ছিল এতটাই যে তিনি রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার বিষয়টি প্রকাশ করেননি;[১৭] তিনি ছিলেন নিষ্ঠাবান ও সম্পূর্ণ ন্যায়পরায়ণ। তাঁর মতো ধর্মপরায়ণ কেউ ছিল না;[১৮] রাজ্যাভিষেকের সময় তিনি ছিলেন শিশুর মতো নিষ্পাপ, এবং পূর্বে কোনো পাপ করেননি।[১৯] শৌল ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শন, এবং যখন কুমারীরা তাঁকে শমূয়েলের কথা বলছিল,[২০] তখন তাঁরা দীর্ঘ সময় ধরে কথা বলেছিল যাতে তাঁকে আরও দেখার সুযোগ পাওয়া যায়।[২১]

যুদ্ধে তিনি বিশ্রাম ছাড়াই ১২০ মাইল অতিক্রম করতে পারতেন। যখন তাঁকে আমালেকীয়দের ধ্বংসের আদেশ দেওয়া হয়,[২২] তখন তিনি বলেন, “একজন মৃত ব্যক্তির জন্যও তোরাহ্‌ পাপবলি দাবি করে;[২৩] এখানে তো অনেককে হত্যা করতে হবে। যদি বৃদ্ধরা পাপ করে, তবে তরুণরা কেন ভোগান্তির শিকার হবে? আর যদি পুরুষরা দোষী হয়, তবে পশুদের কেন ধ্বংস করা হবে?” তাঁর এই মানবিকতা-ই ছিল সিংহাসন হারানোর কারণ।

যদিও তিনি শত্রুদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন, নিজের জাতির প্রতি ছিলেন কঠোর। যখন তিনি জানতে পারেন যে আহিমেলেখ নামক এক কোহেন দায়ূদকে খাদ্য দিয়েছেন, তখন প্রতিশোধ হিসেবে শৌল আহিমেলেখের ৮৫ জন আত্মীয় এবং তাঁর শহর নোব-এর বাসিন্দাদের হত্যা করেন।[২৪]

শত্রুর প্রতি তাঁর সহানুভূতি, বিদ্রোহীদের প্রতি নম্রতা এবং নিজের সম্মান বারবার উপেক্ষা করা একদিকে বিস্ময়কর, অন্যদিকে বিভ্রান্তিকর। যদি শত্রুর প্রতি তাঁর দয়া পাপ হয়ে থাকে, তবে সেটিই ছিল তাঁর একমাত্র পাপ; দুর্ভাগ্যবশত, সেটিই তাঁর বিরুদ্ধে গন্য হয়েছে, অথচ দায়ূদ বহু পাপ করেও তার ক্ষতি ভোগ করেননি।[২৫] কিছু বিষয়ে শৌল দায়ূদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ছিলেন—যেমন, তাঁর একমাত্র উপপত্নী ছিলেন (রিজ্‌পা), যেখানে দায়ূদের বহু উপপত্নী ছিল। শৌল নিজের সম্পদ যুদ্ধের জন্য ব্যবহার করতেন, এবং তিনি জানতেন যে যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ও তাঁর পুত্ররা নিহত হবেন, তবুও পিছু হটেননি। অন্যদিকে, দায়ূদ সৈন্যদের ইচ্ছা অনুযায়ী যুদ্ধক্ষেত্রে যাননি।[২৬]

রাব্বিদের মতে, শৌল বলিদানের নিয়ম অনুযায়ী অপবিত্রতার বিধান মান্য করতেন,[২৭] এবং তিনি জাতিকে পশু জবাইয়ের নিয়ম শেখান।[২৮] এর পুরস্কারস্বরূপ ঈশ্বর স্বয়ং তাঁকে যুদ্ধদিনে একটি তলোয়ার দেন, কারণ তাঁর জন্য উপযুক্ত আর কোনো তলোয়ার পাওয়া যায়নি।[২৯]

দায়ূদের প্রতি শৌলের আচরণকে রক্ষা করতে বলা হয়, তাঁর সভাসদরা ছিল চক্রান্তকারী এবং দায়ূদের বিরুদ্ধে অপবাদ দিত।[৩০] তেমনি দোয়েগ তাঁকে নোব-এর পুরোহিতদের বিরুদ্ধে উসকান দেয়।[৩১] তবে এই কর্মক্ষমতার জন্য তাঁকে ক্ষমা করা হয় এবং এক স্বর্গীয় কণ্ঠস্বর (বাত কোল) ঘোষণা করে: "শৌল ঈশ্বর-নির্বাচিত।"[৩২]

গিবিয়োনীয়দের প্রতি তাঁর রোষ ছিল জাতির কল্যাণের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা, ব্যক্তিগত শত্রুতা নয়।[৩৩] তিনি তাঁর কন্যার পুনর্বিবাহের আদেশ দেন, কারণ তাঁর মতে দায়ূদ যে পন্থায় মিকলকে বিয়ে করেছিলেন তা প্রতারণামূলক ছিল এবং সেই কারণে বাতিলযোগ্য।[৩৪]

শৌলের জীবদ্দশায় ইসরায়েলে কোনো মূর্তিপূজা ছিল না। দায়ূদের রাজত্বকালে যে দুর্ভিক্ষ হয়,[৩৫] বাইবেল তা শৌলের ওপর দোষারোপ করলেও রাব্বিদের মতে, প্রকৃত দায় ছিল জাতির—কারণ তারা শৌলের যথাযথ মর্যাদায় সৎকার করেনি।[৩৩]

শেওলে, দায়ূদ শৌলকে জানান, পরপারে তারা একসঙ্গে থাকবে—যা এই সত্যের প্রমাণ যে ঈশ্বর তাঁকে সম্পূর্ণরূপে ক্ষমা করেছেন।[৩৬]

ইসলাম ধর্মে

[সম্পাদনা]

কুরআনে, তালূত (আরবি: طالوت) নামক ব্যক্তিকে প্রচলিতভাবে রাজা শৌলের সঙ্গেই সনাক্ত করা হয়।[৩৭]

মুসলমানদের বিশ্বাস অনুযায়ী (যেমন বাইবেলেও বলা হয়েছে), তিনি ইসরায়েলীয়দের নেতা ছিলেন। কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী, তালূতকে বেছে নেন একজন নবী—যাঁর নাম কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই, তবে প্রচলিত ব্যাখ্যায় তিনি শমূয়েল—যিনি ইসরায়েলবাসীদের অনুরোধে একজন রাজা মনোনয়ন করেন, যেন তিনি তাঁদের যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। ইসরায়েলীয়রা তালূতের মনোনয়নের বিরোধিতা করে, কারণ তিনি ধনী ছিলেন না। নবী তাঁদের এই মনোভাবের নিন্দা করেন এবং জানান যে, তালূত তাঁদের চেয়ে অধিক মর্যাদাপ্রাপ্ত। পরবর্তীতে তালূত গোলিয়াতের বাহিনীর বিরুদ্ধে ইসরায়েলীয়দের নেতৃত্ব দেন এবং বিজয় অর্জন করেন। এই যুদ্ধে দাঊদ গোলিয়াতকে পরাজিত করেন। তালূতকে একটি ঈশ্বরপ্রদত্ত রাজা হিসেবে গণ্য করা হয়।[৩৮]

টেমপ্লেট:Tlitn নামটির ব্যুৎপত্তি অনিশ্চিত। অন্যান্য কুরআনিক ব্যক্তিত্বদের মতো তালূতের নাম হিব্রু নাম “শৌল”-এর সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। মুসলিম তাফসিরকারীরা ব্যাখ্যা করেন, এই নামটি এসেছে আরবি tūl (দৈর্ঘ্য) শব্দ থেকে এবং এটি শৌলের বিশিষ্ট উচ্চতা বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে, যা বাইবেলের বিবরণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।[৩৯] সা'লাবী-এর মতো তাফসিরকারীরা বলেন, সে সময় ভবিষ্যত রাজাকে উচ্চতার মাধ্যমে চিহ্নিত করা হতো; নবী শমূয়েল একটি মাপকাঠি স্থাপন করেন, কিন্তু ইসরায়েলে কেউ সেটিতে উপনীত হতে পারেননি, একমাত্র তালূত ছাড়া।

ইসরায়েলের রাজা হিসেবে শৌল

[সম্পাদনা]

কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, মূসার মৃত্যুর পর ইসরায়েলবাসীরা একজন রাজার দাবি করে। তখন আল্লাহ তাঁদের তালূতকে রাজা হিসেবে মনোনীত করেন। তাঁকে জ্ঞান ও দেহগত শক্তিতে বিশিষ্ট করে তোলা হয়, যা তাঁর নেতৃত্বের উপযুক্ততা নির্দেশ করে। তাঁর রাজত্বের একটি নিদর্শন ছিল—ঈশ্বরের কিবোত/তাবুৎ ইসরায়েলীয়দের কাছে ফেরত আসে।

তালূত একটি নদীর ধারে তাঁর সেনাবাহিনীর পরীক্ষা নেন—যাঁরা নদী থেকে পান করবে, তারা তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিতে পারবে না, তবে কেউ যদি হাতের তালুতে সামান্য পান করে, সে যোগ দিতে পারবে। অনেকেই সেই পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়, কিন্তু কিছু বিশ্বস্ত অনুসারী তাঁর সঙ্গে এগিয়ে যায়। যুদ্ধে দাঊদ গোলিয়াতকে পরাজিত করেন এবং পরবর্তীতে ইসরায়েলের রাজা হন।[৩৮]

তবে কুরআনের এই বিবরণ বাইবেলের সঙ্গে কিছু বিষয়ে ভিন্ন। যেমন, বাইবেলে পবিত্র কিবোত শৌলের রাজত্বের আগেই ফেরত আসে এবং নদীর পানি পান করার মাধ্যমে পরীক্ষার কাহিনি বাইবেলে গিদয়োনের সঙ্গে সম্পৃক্ত,[৪০] শৌলের সঙ্গে নয়।

ঐতিহাসিকতা

[সম্পাদনা]

শৌলের রাজত্বের ঐতিহাসিকতা সর্বজনস্বীকৃত নয়।[][] বাইবেলের বাইরে খুব সামান্য প্রমাণ পাওয়া যায় যা শৌলের রাজত্বকে নিশ্চিতভাবে ঐতিহাসিক ঘটনা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।[৪১]:৫০ff

কয়েকজন পণ্ডিত মনে করেন যে তথাকথিত "ঐক্যবদ্ধ রাজ্য" (United Monarchy)-এর অস্তিত্ব প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে সমর্থিত, যদিও বাইবেলের বিবরণে ধর্মীয় অতিরঞ্জন আছে।[৪২][৪৩][৪৪] তবে ইস্রায়েল ফিনকেলস্টাইন-এর মতো কিছু গবেষক মনে করেন এটি একটি পরবর্তীকালের মতাদর্শগত নির্মাণ।[]

২০১৪ সালের The Jewish Study Bible-এ ওদেদ লিপসচিৎস মত দেন যে, "ঐক্যবদ্ধ রাজ্য" ধারণাটি পরিত্যাগ করা উচিত।[৪৫] আরেন মা'ইর বলেন, এই রাজ্যের অস্তিত্ব সম্পর্কে প্রমাণ অত্যন্ত অপ্রতুল।[৪৬] তিনি যুক্তি দেন, যদিও তেল দান শিলালিপি-তে নবম শতাব্দীতে "দায়ূদের ঘর" উল্লেখ করা হয়েছে, এটি দশম শতাব্দীর বিস্তৃত দায়ূদীয় রাজ্যের প্রমাণ নয়। বরং এতে একটি স্থানীয় যিহূদীয় রাষ্ট্রের অস্তিত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

অন্যদিকে, উইলিয়াম জি. ডেভার তাঁর গ্রন্থ Beyond the Texts (২০১৮) এবং Has Archaeology Buried the Bible? (২০২০)-এ ঐক্যবদ্ধ রাজ্যের ঐতিহাসিকতা রক্ষা করেছেন। তিনি বলেন, শৌল, দায়ূদ এবং সোলোমনের রাজত্ব "যুক্তিসঙ্গতভাবে প্রমাণিত"।[৪৭]

তাঁর যুক্তির সঙ্গে মিল রেখে, আমিহাই মাজার ২০১৩ সালের এক প্রবন্ধে সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিক খননের (বিশেষত ইলাত মাজার-এর নেতৃত্বে যিরূশালেমে এবং খিরবেত কেয়াফায় ইয়োসেফ গারফিঙ্কেলের তত্ত্বাবধানে) তথ্যের দিকে ইঙ্গিত করেন।[৪৮] তিনি বলেন, এসব প্রমাণ একক কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধা দেয়, তবে এই ধরনের একটি রাষ্ট্র কাঠামোর অস্তিত্ব পুরোপুরি অস্বীকার করা যায় না।

২০২৫ সালে প্রকাশিত গ্রন্থ The Bible's First Kings-এ আভরাহাম ফাউস্টজেভ ফারবার যুক্তি দেন যে, প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ও প্রাচীন বাইবেলীয় ঐতিহ্য মিলে ১১-১০ম শতাব্দীতে ঐক্যবদ্ধ রাজ্যের অস্তিত্ব নির্দেশ করে।[৪৯]

প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য থেকে জানা যায়, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ সালের আগে পর্যন্ত—অর্থাৎ লৌহ যুগ I-এর শেষভাগ পর্যন্ত—ইসরায়েলীয় সমাজ ছিল মূলত কৃষক ও পশুপালকদের সমাজ। তখনও কোনো কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোর উপস্থিতি ছিল না।[৫০]

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Garfinkel, Yosef; Ganor, Saar; Hasel, Michael G. (২০১৮)। In the Footsteps of King David: Revelations from an Ancient Biblical City। Thames & Hudson। পৃষ্ঠা 182। আইএসবিএন 978-0-500-77428-1। ১১ অক্টোবর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৫ অক্টোবর ২০২০ 
  2. Avioz, Michael (২০১৫)। Josephus' Interpretation of the Books of Samuel। Bloomsbury। পৃষ্ঠা 99। আইএসবিএন 978-0-567-45857-5। ১১ অক্টোবর ২০২০ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ অক্টোবর ২০২০ 
  3. Van der Toorn, Karel (১৯৯৩)। "Saul and the rise of Israelite state religion"। Vetus Testamentum। XLIII (4): 519–542। জেস্টোর 1518499ডিওআই:10.2307/1518499 
  4. Finkelstein, Israel (২০০৬)। "The Last Labayu: King Saul and the Expansion of the First North Israelite Territorial Entity"। Amit, Yairah; Ben Zvi, Ehud; Finkelstein, Israel; ও অন্যান্য। Essays on Ancient Israel in Its Near Eastern Context: A Tribute to Nadav Naʼaman। Eisenbrauns। পৃষ্ঠা 171ff। আইএসবিএন 978-1-57506-128-3। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০১৬ 
  5. Baruch Halpern (২০০৩)। David's Secret Demons: Messiah, Murderer, Traitor, King। Wm. B. Eerdmans। পৃষ্ঠা 208–211। 
  6. এই ধারণাটি প্রথম উনবিংশ শতকে উপস্থাপিত হয় এবং পরবর্তীকালে পি. কাইল ম্যাককার্টার তাঁর প্রভাবশালী ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থে এটিকে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেন (P. Kyle McCarter, "I Samuel: A New Translation with Introduction, Notes and Commentary", Anchor Bible Series, 1980)
  7. Hayes, Christine। "Introduction to the Old Testament (Hebrew Bible): Lecture 13 – The Deuteronomistic History: Prophets and Kings (1 and 2 Samuel)"Yale Open Courses। Yale University। সংগ্রহের তারিখ ২ মার্চ ২০১৬ 
  8. 1 Samuel; 1 Samuel
  9. Bright, John, A History of Israel, The Westminster Press, Philadelphia, 1972, p. 185.
  10. 1 Samuel
  11. Arnold, Bill T. (১৯৮৯)। "The Amalekite report of Saul's death: political intrigue or incompatible sources?" (পিডিএফ)Journal of the Evangelical Theological Society32 (3): 289–298। 
  12. Life Application Study Bible: Note on 2 Samuel 1:13
  13. 1 Samuel 9:2
  14. Numbers Rabbah 9:28
  15. Genesis Rabbah 25:3
  16. Leviticus Rabbah 9:2
  17. 1 Samuel 10:16; Megillah 13b
  18. Moed Kattan 16b; Exodus Rabbah 30:12
  19. Yoma 22b
  20. 1 Samuel 9:11–13
  21. Berachot 48b
  22. 1 Samuel 15:3
  23. Deuteronomy 21:1–9
  24. Yoma 22b; Numbers Rabbah 1:10
  25. Yoma 22b; Moed Kattan 16b, and Rashi ad loc.
  26. 2 Samuel 21:17; Leviticus Rabbah 26:7; Yalkut Shimoni, Samuel 138
  27. Yalkut Shimoni, Samuel 138
  28. cf 1 Samuel 14:34
  29. 1 Samuel 13:22
  30. Deuteronomy Rabbah 5:10
  31. 1 Samuel 22:16–19; Yalkut Shimoni, Samuel 131
  32. Berachot 12b
  33. Numbers Rabbah 8:4
  34. Sanhedrin 19b
  35. 2 Samuel 21:1
  36. Eruvin 53b
  37. M. A. S. Abdel Haleem: The Qur'an, a new translation, note to 2:247.
  38. কুরআন ২:২৪৬-২৫২
  39. Leaman, Oliver, The Quran, An Encyclopedia, 2006, p. 638.
  40. Judges vii. 5–7
  41. Nelson, Richard D. Historical Roots of the Old Testament (1200–63 BCE). Volume 13 of Biblical Encyclopedia. Society of Biblical Lit, 2014 আইএসবিএন ৯৭৮১৬২৮৩৭০০৬৫
  42. Dever, William G. (২০২০-০৮-১৮)। Has Archaeology Buried the Bible?। Wm. B. Eerdmans। আইএসবিএন 978-1-4674-5949-5 
  43. Halpern, Baruch (২০০৩-১১-১২)। David's Secret Demons: Messiah, Murderer, Traitor, King। Wm. B. Eerdmans। আইএসবিএন 978-0-8028-2797-5 
  44. Mazar, Amihai (২০১৪)। "Archaeology and the Bible: Reflections on Historical Memory in the Deuteronomistic History"Congress Volume Munich 2013: 347–369। আইএসবিএন 9789004281226ডিওআই:10.1163/9789004281226_015 
  45. Lipschits, Oded (২০১৪)। "The history of Israel in the biblical period"। Berlin, Adele; Brettler, Marc Zvi। The Jewish Study Bible (2nd সংস্করণ)। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 2107–2119। আইএসবিএন 978-0-19-997846-5 
  46. Maeir, Aren M. (২০১৪)। "Archeology and the Hebrew Bible"। Berlin, Adele; Brettler, Marc Zvi। The Jewish Study Bible (2nd সংস্করণ)। Oxford University Press। পৃষ্ঠা 2125। আইএসবিএন 978-0-19-997846-5 
  47. Dever, William G. (২০২০-০৮-১৮)। Has Archaeology Buried the Bible?। Wm. B. Eerdmans। আইএসবিএন 978-1-4674-5949-5 
  48. Mazar, Amihai (২০১৪)। "Archaeology and the Bible: Reflections on Historical Memory in the Deuteronomistic History"Congress Volume Munich 2013: 347–369। আইএসবিএন 9789004281226ডিওআই:10.1163/9789004281226_015 
  49. Faust, Avraham; Farber, Zev I. (২০২৫)। The Bible's First Kings: Uncovering the Story of Saul, David, and Solomon। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা 401ff। আইএসবিএন 978-1-009-52633-3 
  50. উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref> ট্যাগ বৈধ নয়; Lemaire নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি