শুভঙ্কর (গণিতবিদ)
শুভঙ্কর | |
---|---|
জন্ম | রামপুর, পাত্রসায়ের বাঁকুড়া |
পেশা | মল্লরাজের দেওয়ান, গণিতবিদ |
পরিচিতির কারণ | শুভঙ্করী গণিত |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | শুভঙ্কর দাঁড়া বা শুভঙ্কর খাল |
শুভঙ্কর যিনি শুভঙ্কর রায় (মতান্তরে শুভঙ্কর দাস (জন্ম নাম- জগন্নাথ চৌধুরী অন্যমতে ভৃগুরাম দাস) ছিলেন অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের বঙ্গদেশের 'দ্য রাইমিং ম্যাথামেটিশিয়ান' তথা ছড়াকার গণিতবিদ,[১] বিখ্যাত মানসাঙ্কবেত্তা, লোকশিক্ষক, পূর্তবিদ্যাবিশারদ। তিনি নিত্য ব্যবহার্য হিসাব-নিকাশে অঙ্কের সহজ সরল পদ্ধতি “শুভঙ্করী” নামে পাটিগণিত, মানসাঙ্ক তথা মৌখিক গণিতের (মেন্টাল ম্যাথামেটিক্স) এক অসাধারণ ধারার প্রবর্তক। [২]
জীবনী
[সম্পাদনা]জগন্নাথ নবাবী যুগে বঙ্গদেশের তৎকালীন বর্ধমান জেলার, পরবর্তীতে বাঁকুড়া জেলার অন্তর্ভুক্ত অধুনা পাত্রসায়ের সমষ্টি উন্নয়ন ব্লকের অধীনস্থ রামপুর গ্রামের এক দরিদ্র কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা পীতাম্বর দাসগুপ্ত চৌধুরী বিষ্ণুপুরের মল্লরাজাদের (মহারাজ চৈতন্য সিংহ-র ,মতান্তরে গোপাল সিংহ-র) স্বল্পবেতনের কর্মচারী ছিলেন। মল্লরাজাদের কুলপুরোহিত পীতাম্বরের পুত্রের নাম রাখেন জগন্নাথ। জগন্নাথ খুব মেধাবী ছিলেন। পাঁচ বছর বয়সে তার বিদ্যারম্ভ হয়। শারীরিক মানসিকবল ও বুদ্ধিমত্তার কারণে সবার প্রিয় জগন্নাথ গ্রামবাসীদের কাছে 'সুরেন্দ্রনারায়ণ' নামে পরিচিত হয়। কিন্তু শৈশবেই তার পিতৃবিয়োগ হলে বিষ্ণুপুররাজ তার বিধবা মায়ের ভরণ পোষণ এবং জগন্নাথের পড়াশোনার জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করেন। পনের বৎসর বয়সেই জগন্নাথ বাংলাসহ ফরাসী ভাষা আয়ত্ত করেন এবং গণিতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। তিনি গণিতের জটিল সমস্যা মুখে মুখে সমাধানের ক্ষমতা রাখতেন। গণিতশিক্ষার জন্য সরল পদ্ধতি, সূত্র এবং তা সুমধুর ছড়ায় মুখস্থ করার উপায় উদ্ভাবন করেন। সেজন্য বিষ্ণুপুররাজ গোপাল সিংহ দেব তাঁকে শুভঙ্কর উপাধিতে ভূষিত করেন।[৩] তিনি গণিতের জটিল নিয়ম শিশুদের জন্য সুমধুর ছন্দের আকারে গণিত সংক্রান্ত সরল বিধি (আর্যায় বা তোর্যায়) লিপিবদ্ধ করেন যা শুভঙ্করী আর্যা নামে পরিচিত হয়।[৪]গণিতের বিধি তথা আর্যাগুলি প্রাকৃত, অপভ্রংশ, অবহট্ট ও অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল।[৫]শুভঙ্কর প্রবর্তিত শুভঙ্করী গণিতরীতি বহু বছর ধরে প্রাক স্বাধীনতার আগে পর্যন্ত বাংলায় গণিত শিক্ষায় প্রেরণা জুগিয়েছে। বঙ্গদেশের মুদ্রা, ওজন, জমিজমার হিসাব প্রভৃতিও নিত্যপ্রয়োজনীয় বিষয়ও শুভঙ্করীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্তনে শুভঙ্করীর অবহেলা শুরু হয়। তার রচিত গণিত পুস্তক ‘শুভঙ্করী’ নামে বর্তমান সময়েও পরিচিত।[৬]
গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর বিষ্ণুপুর রাজ্যের মন্ত্রী (দেওয়ান) ছিলেন। অসাধারণ দূরদৃষ্টি ও বুদ্ধিমত্তায় তিনি জনহিতকর নানা নির্মাণ কার্যেও সহায়তা করেন। বাঁকুড়া জেলার সোনামুখী ও পাত্রসায়ের অঞ্চলের ঊষ্ণ রুক্ষ্ম ভূভাগের বড় অংশে সেচ পরিকল্পনায় সেচখাল ও পয়ঃপ্রণালী ইত্যাদির নির্মাণে বিশেষ ভূমিকা নেন। সোনামুখী থানার উত্তরাংশে পূর্ব-পশ্চিমে প্রসারিত 'শুভঙ্কর দাঁড়া' ও বড়জোড়া থানার অনুরূপ এলাকায় 'শুভঙ্কর খাল' তার পুরাকীর্তির উদাহরণ। [৬] ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে দুর্ভিক্ষ ও জলককষ্টের সময় খালটির একবার সংস্কার করা হয়।[৪]
শুভঙ্কর রচিত অপর দুটি গ্রন্থ হল - কাগজসার’ ও ‘ছত্রিশ কারখানা’। নবাবী আমলের রাজকীয় বিভাগের পরিচয় ছিল ছত্রিশ কারখানা। তৎকালীন মুসলমান নবাব সরকারের বিভিন্ন বিভাগে ব্যবস্থাপনা শুভঙ্কর সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন। গ্রন্থখানিতে বহু ফরাসী শব্দের সঙ্গে প্রায় ২০০০ শ্লোক আছে।
কয়েকটি জনপ্রিয় শুভঙ্করী আর্যা
[সম্পাদনা]- মানসাঙ্ক সম্পর্কিত অসাধারণ ছড়া—
সরোবরে বিকশিত কমল নিকর।
মধুলোভে এল তথা অনেক ভ্রমর।
প্রতি পদ্মে বসি ভ্রমর যুগল।
অলিহীন রহে তবে একটি কমল।
একেক ভ্রমর বসে প্রত্যেক কমলে।
বাকি রহে এক অলি, সংখ্যা দেহ বলে
ত্রিশ হাত উচ্চ বৃক্ষ ছিল এক স্থানে
চূঁড়ায় উঠিবে এক কীট করে মনে।
দিবাভাগে দশ হাত উঠিতে লাগিলো
নিশাযোগে অষ্ট হাত নীচেতে নামিলো
না পায় যাবৎ চূড়া করে সে অটন
কত দিনে উঠেছিল কর নিরূপণ!
- জমির মাপ সম্পর্কিত ছড়া—
- (বিঘাকালি/কাঠাকালি)
কুড়বা কুড়বা কুড়বা লিজ্জে
কাঠায় কুড়বা কাঠায় লিজ্জে
কাঠায় কাঠায় ধূল পরিমাণ
বিশ গণ্ডায় হয় কাঠার প্রমাণ
গণ্ডা বাকি থাকে যদি কাঠা নিলে পরে
ষোল দিয়ে পুরি তারে সারা গণ্ডা ধরে
- (বৃত্তকালি πr২)
ব্যাসার্দ্ধকে তাই দিয়া পুরণ করিবে।
ফলের বাইশ গুণ লইতে হইবে।।
পাইবে যে অঙ্ক তাকে সাত দিয়া হর।
শিশু সবে এইরূপে বৃত্তকালি কর।
- নৌকায় বহনযোগ্য জিনিসের পরিমাপ—
দৈর্ঘ্য নৌকা হাত যত, প্রস্থ দিয়া পূর তত।
চাড়া দ্বিগুন করে গুন, যত হাত তত মণ।।
সরঞ্জামি তাহা হতে, বাদ দিয়া হবে লতে।
দশ মণে এক মণ, বাদ দাও বাছাধন।
বাকি অঙ্ক রবে যত, কুত মাল হবে তত।।
শুভঙ্করের বসতবাড়ির স্মারক
[সম্পাদনা]২০০৭ খ্রিস্টাব্দের ২৪ অক্টোবর 'পশ্চিমবঙ্গ হেরিটেজ কমিশন' গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর রায়ের রামপুর গ্রামের বসতবাড়ির স্থানটিকে এক ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। মল্লরাজ গোপাল সিংহ দেওয়ান শুভঙ্করকে রামপুর গ্রামের একটি জমিতে রায়তিস্বত্ব দেন এবং সেই জমিতে অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে তিনি বসতবাড়ি নির্মাণ করান। যদিও সেই জমিতে আজ কোন বাড়ির অস্তিত্ব নেই, কিন্তু, সেখানে 'শুভঙ্কর রায় স্মৃতি রক্ষা কমিটি'-র উদ্যোগে একটি স্মারক নির্মিত হয়েছে এবং তাদের রক্ষণাবেক্ষণে স্থান ও স্মৃতিস্তম্ভ ঐতিহ্য বহন করছে।[৭]
আরো পড়ুন
[সম্পাদনা]- ইসলাম, শরিফুল। বাঙালি গণিতজ্ঞ শুভঙ্কর। টেরাকোটা। আইএসবিএন 978-93-8566-360-4।
তথ্যসূত্র
[সম্পাদনা]- ↑ ক খ গ "Subhankar-The Rhyming Mathematician"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-৩০।
- ↑ ক খ গ ঘ "শুভঙ্কর ফাঁকি দেন নি"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-৩০।
- ↑ "শুভঙ্কর ও শুভঙ্করী (প্রথম ভাগ)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-৩০।
- ↑ ক খ সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ৭২২, আইএসবিএন ৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
- ↑ "লোকগণিত"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-৩০।
- ↑ ক খ "শুভঙ্কর ও শুভঙ্করী (শেষ ভাগ/সমাপ্ত)"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-৩০।
- ↑ "House of Mathematician Suvankar Roy"। সংগ্রহের তারিখ ২০২৪-১২-৩১।