রূপকল্প বিবৃতি

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

রূপকল্প বিবৃতি বলতে কোনও সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠী মধ্যম বা দীর্ঘ মেয়াদে (৫, ১০, ১৫ এমনকি ২০ বছর পরে) কী সামগ্রিক কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করতে চায় ও সেটি কীভাবে অর্জন করতে চায়, সে বিষয়ে একটি বা কয়েকটি বাক্য সম্বলিত একটি আদর্শবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষামূলক ভবিষ্যৎমুখী বিবৃতিকে বোঝায়।[১]

উদাহরণস্বরূপ, উইকিপিডিয়া প্রকল্পের রূপকল্প বিবৃতিটি নিম্নরূপ:

কারণ[সম্পাদনা]

রূপকল্প বিবৃতিটি সংগঠনের ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধির অভিমুখ প্রতিষ্ঠা করে। এটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা কী বিশ্বাস করবে, কী আচরণ করবে ও কীভাবে সিদ্ধান্তগ্রহণ করবে, সেগুলি সম্পর্কে উচ্চস্তরের বিমূর্ত ভাষায় বক্তব্য দেয়। রূপকল্প বা দৃশ্যকল্প অর্থ এমন একটি আদর্শ কল্পবিশ্ব, যার বর্তমানে কোনও অস্তিত্ব নেই। রূপকল্প বিবৃতির উদ্দেশ্য হল ঐ কল্পবিশ্বকে বাস্তবে রূপদান করতে সংগঠনের সদস্যদেরকে উৎসাহিত করা।

কোন ব্যক্তি কী কাজ করবে, কীভাবে কাজ করবে, কী পণ্য উৎপাদন করবে, কী সেবা প্রদান করবে, এই ব্যাপারগুলির সাথে রূপকল্প বিবৃতির কোনও সম্পর্ক নেই, কেননা তাহলে এর পরিধি সীমায়িত হয়ে পড়ে। বরং সংগঠনের সদস্যরা রূপকল্পের আদর্শ পরিস্থিতিটিকে বাস্তবে রূপ দিতে, এটিকে সার্থক করতে ব্যবহারিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত ও কর্মপদক্ষেপ গ্রহণ করেন।

রূপকল্প বিবৃতি প্রতিষ্ঠানের পরিচালকমণ্ডলী ও সর্বস্তরের কর্মচারীদের জন্য কৌশলগত সিদ্ধান্তগ্রহণের একটি কেন্দ্রবিন্দু ও আদর্শ হিসেবে কাজ করে। রূপকল্প বিবৃতি কৌশলগত ব্যবস্থাপনার একটি অপরিহার্য অঙ্গ। কৌশলগত লক্ষ্য ছাড়া কোনও প্রতিষ্ঠান এমন একটি কর্মপরিচালনামূলক পরিকল্পনা সৃষ্টি করতে অসমর্থ হয়, যেটিকে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করা সম্ভব। পরিস্কার রূপকল্পের অনুপস্থিতিতে কর্মচারীদের পক্ষে আদর্শ কোনও কিছুর পেছনে এক কাতারে দাঁড়ানো সম্ভব হয় না, এবং এর ফলে ক্রেতা, বিক্রেতা ও অংশীপত্রের মালিকদের দৃষ্টিকোণ থেকে সংগঠনটির কাছ থেকে কী প্রত্যাশা করা উচিত, সে ব্যাপারে কোনও প্রারম্ভবিন্দু থাকে না।

রূপকল্প বিবৃতিগুলি সাধারণত খানিকটা আদর্শবাদী হয়ে থাকে এবং বাস্তব বিশ্বের সীমাবদ্ধতাগুলি এখানে ছোট করে দেখা হয়। কিন্তু একই সাথে এটি সংগঠনের সদস্যদের যৌথ প্রচেষ্টায় বাস্তব বিশ্বের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা উৎরাতে অনুপ্রেরণা প্রদান করে। তাই রূপকল্প বিবৃতিগুলি সাংগঠনিক উদ্ভাবন, কর্মচারীদের অঙ্গীকারবদ্ধতা, প্রেরণা, কাজ করায় সন্তুষ্টি, সাংগঠনিক সংযুতি, কার্যকারিতা ও সাফল্যের পেছনের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। এইরূপ বিবৃতি প্রধান প্রতিষ্ঠাতা বা দূরদর্শী নেতাদের কাছ থেকে আসতে পারে, কিংবা সাংগঠনিক সংস্কৃতি থেকে উৎপত্তি লাভ করতে পারে। এই বিবৃতিতে কোনও সংগঠনের কেন্দ্রীয় মূল্যবোধগুলি (যেমন উদ্ভাবন, স্বয়ংসম্পূর্ণতা, কর্মদক্ষতা, বাজারে নেতৃত্বদান, ইত্যাদি) ও সেটির কৌশলগত সামর্থ্যগুলি বিধৃত হয়ে থাকে। রূপকল্প বিবৃতিতে যে মূল্যবোধ ও কেন্দ্রীয় সামর্থ্য বিষয়ক বিশ্বাসগুলি বর্ণিত থাকে, সেগুলি সংগঠনের প্রতিটি সিদ্ধান্তে অগ্রাধিকার পায়। মূল্যবোধগুলি সাধারণত বিমূর্ত প্রকৃতির হয়ে থাকে, তাই বিমূর্ত ও ভবিষ্যৎমুখী রূপকল্প বিবৃতিতে এগুলি সহজাতভাবেই স্থান পেয়ে থাকে। ঐ সব মূল্যবোধ ও সামর্থ্য কীভাবে ভবিষ্যতে সংগঠনটির আদর্শ বা সেরা সাফল্য বয়ে নিয়ে আসতে পারে, বিবৃতিতে তার বর্ণনা থাকে।

প্রতিষ্ঠাতা বা নেতা যদি এইরূপ বিবৃতি না দেন, তাহলে সংগঠনের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপকমণ্ডলী বা পরিচালকমণ্ডলী, যারা সংগঠনের কর্মকৌশলের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত, তারা এই বিবৃতিটি তৈরিতে বা সংশোধনে বড় ভূমিকা রাখেন। তবে তারা এক্ষেত্রে যথাসর্বোচ্চ সম্ভব কর্মচারীবৃন্দ ও অংশীপত্রের মালিকসহ সংগঠনের সকল স্তরের সদস্য ও অংশীজনকে সংগঠনের রূপকল্প বিবৃতি রচনার প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এক্ষেত্রে গুণবাচক গবেষণা, আলোচনাচক্র, কর্মী জরিপ, ইত্যাদি মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করতে পারে। রূপকল্প বিবৃতিটি রচিত হবার পর সেটিকে সংগঠনের সর্বস্তরের কর্মী ও অংশীজনের কাছে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগমূলক প্রচেষ্টার মাধ্যমে তুলে ধরা অত্যাবশ্যক। রূপকল্প সম্পর্কে এই ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন না হয়ে ধারাবাহিকভাবে বজায় থাকা পছন্দনীয়। সাংবাৎসরিক প্রশিক্ষণ বা নতুন কর্মচারীদের কাছে এটি স্মরণ করিয়ে দিতে হয়। অধিকন্তু, এটিকে সর্বদা দলগত আলোচনা ও কৌশলগত দিকনির্ণয়ের অংশ হিসেবে থাকতে হয়। রূপকল্প বিবৃতিটিকে সাংগঠনিক সংস্কৃতির সর্বত্র, সবসময় সক্রিয় ও বিদিত হতে হয় এবং প্রায়শই এর প্রতি নির্দেশ করতে হয়।

রূপকল্প বিবৃতি দীর্ঘমেয়াদী বা অসীম মেয়াদী, তাই এটিতে সাধারণত কোনও পরিবর্তন করা হয় না। তবে প্রতি পাঁচ বা দশ বছর অন্তর বাজারের অবস্থা, প্রযুক্তি, প্রবিধান, প্রতিযোগী, ইত্যাদিতে পরিবর্তনের ফলে এটিতে সামান্য সংশোধন আনা হতে পারে, কিন্তু এ কাজটি এমনভাবে করা হয় না যাতে সংগঠনের ভিত্তিই নড়বড়ে হয়ে যায়। বিমূর্ত প্রকৃতির কারণে এই বিবৃতিগুলি সাধারণত বহুদিন যাবৎ স্থিতিশীল থাকে এবং সংগঠনের সব অংশীজনের জন্য আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করে। এটি সংগঠনের অগ্রাধিকার নির্ণয় ও সীমিত সম্পদের সদ্ব্যবহারে সহায়ক হয়। রূপকল্প বিবৃতি একটি সংগঠনকে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা অর্জনে সাহায্য করতে পারে।

রূপকল্পের সাথে অভিলক্ষ্যের পার্থক্য আছে। একটি অভিলক্ষ্য সসীম সময়ের জন্য স্থির করা হয়, এর একটি বিশেষ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থাকে, এবং বাস্তব পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে এটিতে পরিবর্তন আনা হতে পারে।

মূল্যায়ন[সম্পাদনা]

কোনও রূপকল্পের সঠিক সূত্রায়নে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতার উদ্দীষ্ট আবেগ থাকতে হয় এবং ঐ আবেগটি কীভাবে সংগঠনের বাকি সদস্যদের উপর প্রভাব ফেলতে পারে, সে ব্যাপারটিও গণনায় ধরতে হয়। যদি সেটি স্বার্থপর ভাষায় লেখা হয়, তাহলে সেটির অভীষ্ট প্রভাবটি কখনোই বাস্তবায়িত হবে না। বিবৃতিটিকে এমনভাবে সৃষ্টি করতে হবে, যাতে অন্যরা সেটি থেকে এক ধরনের প্রেরণা পায়।

একটি রূপকল্প বিবৃতি সাধারণত নিচের বৈশিষ্ট্যগুলির অধিকারী হয়ে থাকে:[২]

  • সংক্ষিপ্ত: সহজেই মনে রাখা যায় ও পুনরাবৃত্ত করা যায়
  • পরিস্কার: একটি সামগ্রিক বা সর্বপ্রধান লক্ষ্যের সংজ্ঞা থাকে
  • ভবিষ্যৎমুখী: সংগঠনটি বর্তমানে কোথায় অবস্থিত তা নয়, বরং ভবিষ্যতে কোথায় যাচ্ছে, তা বর্ণনা করে
  • স্থিতিশীল: একটি দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গী প্রদান করে, যেটির রাজনীতি, সংস্কৃতি, বাজার বা প্রযুক্তির পরিবর্তনের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
  • প্রতিকূল: এমন কিছু নয় যা সহজেই অর্জন করা সম্ভব
  • বিমূর্ত: সংগঠনের সব স্বার্থ ও কৌশলগত লক্ষ্য ধারণ করে
  • প্রেরণাদায়ী: কর্মী বা কর্মচারীদেরকে প্রেরণা দেয়
  • অংশগ্রহণভিত্তিক: কর্মীরা এটিকে আকাঙ্ক্ষণীয় কিছু হিসেবে গণ্য করে এবং এর অংশ হতে চায়

উপরের বৈশিষ্ট্যগুলি পূরণ করেছে কি না, তার ভিত্তিতে একটি রূপকল্প বিবৃতি ভালো না মন্দ, তা মূল্যায়ন করা যেতে পারে।

উদ্দেশ্য[সম্পাদনা]

প্রাসঙ্গিকতা[সম্পাদনা]

রচনা ও বাস্তবায়নে সমস্যা[সম্পাদনা]

রূপকল্প বিবৃতি সৃষ্টি ও বাস্তবায়ন সংগঠনের জন্য দুরূহ প্রতিভাত হতে পারে। এগুলি রচনা করা এই কারণে দুরূহ কেননা এগুলিতে একদিকে যেমন ভবিষ্যৎমুখী ও আদর্শবাদী একটি অবস্থার বর্ণনা দিতে হয়, অন্যদিকে এমন কোনও কিছু লিখতে হয় না যা অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়; রচয়িতাদেরকে এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রাখতে হয়। যদি সংগঠনের কর্মী বা কর্মচারীদের কাছে মনে হয় যে রূপকল্পটি সংগঠনের উদ্ভব ও উদ্দেশ্যের সাথে সম্পর্কবিহীন বিভিন্ন অন্তঃসারহীন হুজুগে ব্যবসায়িক পরিভাষায় পরিপূর্ণ, তাহলে তারা কখনোই সেটি অনুসরণ করবে না।[৩] তাই রূপকল্প বিবৃতি লেখার পাশাপাশি সেটিকে উপস্থাপন করা ও জোরদার করার প্রচেষ্টা চালাতে হয়, রূপকল্পের সাথে ব্যবসায়িক বা সাংগঠনিক সব প্রক্রিয়া এক কাতারে নিয়ে আসতে হয়, এবং রূপকল্পকে যেন সমর্থন করে, এরূপ কাজ করার জন্য কর্মী বা কর্মচারীদের ক্ষমতা ও উৎসাহ প্রদান করতে হয়।[২]

আরও দেখুন[সম্পাদনা]

তথ্যসূত্র[সম্পাদনা]

  1. Shannon A. Bowen (২০১৮), "Mission and Vision", The International Encyclopedia of Strategic Communication 
  2. Kantabutra, Sooksan; Avery, Gayle (২০১০)। "The power of vision: statements that resonate" (পিডিএফ)Journal of Business Strategy31 (1): 37–45। ডিওআই:10.1108/02756661011012769 
  3. Lipton, Mark (Summer ১৯৯৬)। "Demystifying the Development of an Organizational Vision" (PDF download)Sloan Management Review37 (4): 83। সংগ্রহের তারিখ ২০১৯-১১-২৫