বিষয়বস্তুতে চলুন

রিপার ক্রু

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

“রিপার ক্রু” বা “শিকাগো রিপার্স” ছিল শয়তানী সম্প্রদায় এবং সংগঠিত অপরাধ গ্রুপ যা রবিন গেচট এবং তিন সহযোগী: এডওয়ার্ড স্প্রেইজার এবং ভাই এন্ড্রু এবং থমাস কোকরালিস গঠন করেছিল। ১৯৮১ এবং ১৯৮২ সালে ১৮ মহিলার নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে তাদেরকে সন্দেহ করা হয়েছিল।

  • ১৯৮১ সালের দোসরা জুনের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের ভিলা পার্ক এলাকার একটি মাঠ থেকে খুঁজে পাওয়া যায় এক নারীর মৃতদেহ। খোঁজ-খবর নিয়ে জানা যায়, দুর্ভাগা সেই নারীর নাম লিন্ডা সাটন, বয়স ২৮। মে মাসের ২৩ তারিখ থেকেই নিখোঁজ ছিলেন তিনি। লিন্ডার মৃতদেহটিকে বিকৃত করেছিলো খুনীরা, কেটে নিয়েছিলো বাম পাশের স্তন।
  • এরপর কেটে যায় প্রায় একটি বছর। এর মাঝে এমন কোনো অদ্ভুত খুন আর দেখতে হয় নি পুলিশকে। পরের বছরের ১৫ মে’র কথা। নিজের অফিসের সামনে থেকেই সেদিন অপহরণ করা হয়েছিলো লোরেইন বোরোস্কিকে। প্রায় পাঁচ মাস পর ভিলা পার্কেরই এক কবরস্থানে সন্ধান পাওয়া যায় লোরেইনের নিথর দেহের, একইরকম বিকৃতাবস্থায়।
  • এ ঘটনার ঠিক চৌদ্দ দিন পরের কথা। ভিলা পার্কের উত্তর দিকে অবস্থিত হ্যানোভার পার্ক থেকে অপহরণ করা হয় শুই মাক নামের এক নারীকে। চার মাস পর খোঁজ মিলেছিলো শুইয়ের মৃতদেহের।
  • শুইয়ের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই দুই সপ্তাহ পর ঘটে পরবর্তী অপহরণের ঘটনাটি। এবারের শিকার দেহ ব্যবসায় নিয়োজিত এক নারী, নাম তার অ্যাঞ্জেল ইয়র্ক। অপহরণকারীরা দরদাম ঠিক করে ভ্যানে তুলে নিয়েছিলো অ্যাঞ্জেলকে। এরপরই হাতকড়া পরিয়ে তার উপর শুরু করা হয় পাশবিক নির্যাতন। ছুরি দিয়ে ক্ষত-বিক্ষত করেছিলো তারা অ্যাঞ্জেলের স্তন। মারাত্মক আহত অবস্থাতেই তাকে গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে পালিয়ে যায় দলটি। অ্যাঞ্জেল পুলিশকে জানিয়েছিলো ঠিকই। এবারই প্রথম কোনো জীবিত ভিক্টিমের সন্ধান পেয়েছিলো পুলিশ। কিন্তু দুর্ভাগ্যই বলা লাগে, কারণ অ্যাঞ্জেলের দেয়া অপরাধীর বর্ণনা মোতাবেক কাউকেই খুঁজে বের করতে পারে নি তারা। এ ঘটনার পর দুই মাসের মতো একেবারেই গা ঢাকা দিয়েছিলো সেই অপহরণকারীর দলটি।
  • ১৯৮২ সালের ২৮ আগস্টের কথা। শিকাগো নদীর তীর থেকে খুঁজে পাওয়া যায় আরেক দেহ ব্যবসায়ী নারীর লাশ, নাম তার স্যান্ড্রা ডেলাওয়ার। ছুরি দিয়ে কুপিয়ে আর শ্বাসরোধ করেই খুন করা হয়েছিলো তাকে। হতভাগিনীর মৃতদেহ থেকেও কেটে নেয়া হয়েছিলো বাম স্তনটি।
  • পরের মাসের ৮ তারিখে এক গলি থেকে উদ্ধার করা হয় রোজ ডেভিস নামে আরেক নারীর মৃতদেহ। তার পরিণতিও হয়েছিলো স্যান্ড্রার মতোই।
  • রাত্রির অন্ধকারের পর যেমন পূর্বাকাশে সূর্যের সোনালি কিরণের দেখা মেলে, তেমনই একদিন এ দুর্ধর্ষ অপরাধী চক্রের হাত থেকে মুক্তি পায় জনগণ। আর এ মুক্তির পেছনে ছিলো আরেক নারীর বন্দীত্ব আর নির্যাতনের কাহিনী।[1]

গ্রেফতার

[সম্পাদনা]

১৯৮২ সালের ৬ ডিসেম্বর। সেদিন সেই চক্রটি অপহরণ করেছিলো বেভারলি ওয়াশিংটন নামে এক নারীকে। যথারীতি ধর্ষণ ও অত্যাচারের পর তার একটি স্তন কেটে নিয়েছিলো তারা। এরপর অচেতন বেভারলিকে মৃত ভেবে তাকে তারা ফেলে রেখে গিয়েছিলো রেল লাইনের পাশে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছে ছিলো বোধহয় অন্যরকম। তাই এত রক্তক্ষয়ের পরও বেঁচে গিয়েছিলেন তিনি। এরপর পুলিশের কাছে গিয়ে একজন অপহরণকারী এবং অপহরণকার্যে ব্যবহৃত গাড়িটির নিখুঁত বর্ণনা দেন তিনি। সেই বর্ণনার পরিপ্রেক্ষিতেই একজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তার নাম ছিল রবিন গেখ্‌ট, দলটির সর্দার ছিলো সে। তবে গ্রেফতার ও সাক্ষী থাকলেও প্রশানের অভাবে রবিনকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিলো পুলিশ। কিন্তু তাকে সবসময় নজরেই রাখা হচ্ছিলো, সেই সাথে চলছিলো তার বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহের পায়তারা। শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখতে পায় পুলিশ। জানা যায়, ১৯৮১ সালে একটি মোটেলে আরো তিন সঙ্গী সহ পাশাপাশি তিনটি রুম ভাড়া নিয়েছিলো রবিন। হোটেল ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় যে, সেই চারজন মোটেলে পার্টির মতো কোনো অনুষ্ঠান করেছিলো। তাদের কাজ কারবার দেখে ম্যানেজারের কাছে মনে হয়েছিলো যে, তারা হয়তো কোনো গুপ্তসংঘের সাথে জড়িত। হোটেলের লগ বই থেকে বাকিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে পুলিশ। অল্প কিছুদিনের মাঝে সেই তিনজনকে গ্রেফতারও করা হয়। তাদের নাম ছিলো এডওয়ার্ড স্প্রিটজার, অ্যান্ড্রু কোকোরালিস ও থমাস কোকোরালিস। এদের মাঝে শেষোক্ত দুজন ছিলো সহোদর।

পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর তিনজনই নিজেদের অপরাধের কথা স্বীকার করে নেয়। আর নিজেদের সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জানিয়ে দেয় পুলিশকে।

পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দী

[সম্পাদনা]

পুলিশের কাছে দেওয়া জবানবন্দীতে গ্রেফতারকৃত এডওয়ার্ড স্প্রিটজার, অ্যান্ড্রু কোকোরালিস ও থমাস কোকোরালিস জানায় তারা আসলে শয়তানের পূজারী একটি গুপ্ত সংঘের সদস্য। দলের মোট সদস্য চারজন, এদের মাঝে নেতা ছিলো রবিনই।১৯৮১ সালের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ১৯৮২ সালের শেষ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো তাদের হত্যাকাণ্ডের সময়কাল। প্রায় দেড় বছরের এ সময়কালে আনুমানিক ১৮ জন দুর্ভাগা নারীকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো তাদের হাতে, যাদের সবার পরিচয় জানাও সম্ভব হয় নি। প্রথমেই একজন নারীকে অপহরণ করতো তারা। এরপর তার উপর চলতো অমানুষিক নির্যাতন, ধর্ষণ এবং সবার শেষে খুন। এরপর ঘটতো আরো নৃশংস ঘটনা। হতভাগা সেই নারীর মৃতদেহের অংশবিশেষ খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়তো তারা। দলটির সদস্যদের এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড জনমনে মারাত্মক আতঙ্ক তৈরি করে। সবাই তাদের ডাকতে শুরু করে ‘রিপার ক্রু (Ripper Crew)’ বা ‘শিকাগো রিপার্স (Chicago Rippers)’ নামেই। মৃতদেহকে এ দলটি বিকৃত করে ফেলতো দেখেই দেয়া হয়েছিলো এ নামটি। একটু আগেই বলেছি যে, শিকাগো রিপার্স ছিলো শয়তানের পূজারী একটি গোপন সংঘ। নারীদের প্রতি এ দলটির সদস্যদের যতই ক্ষোভ থাকুক না কেন, দলনেতা রবিন কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তিন সন্তানের জনক ছিলো। স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সুখেই সংসার করতো সে। রাতের বেলায় রবিনের স্ত্রী চাকরির জন্য বেরিয়ে গেলে তার বাসায় আসতো বাকি তিনজন। তারপর তারা চলে যেতো চিলেকোঠার ঘরটিতে। ঘরটির অবশ্য একটি নাম দিয়েছিলো রবিন- ‘The Satanic Chapel’। ঘরটিতে আলোর জন্য ব্যবহার করা হতো মোমবাতি। লাল রঙের চাদরে ঢাকা ছিলো একটি বেদি। আর চারদিকের দেয়াল জুড়ে ছিলো মোট ছয়টি লাল-কালো ক্রুশের সমাহার। অপহরণের পর দুর্ভাগা নারীকে নিয়ে আসা হতো রবিনের সেই স্যাটানিক চ্যাপেলে। সেখানেই তার উপর করা হতো নির্যাতন। এরপর তারা নিয়ে আসতো পিয়ানোতে ব্যবহৃত তার। কেন? কারণ এই তার দিয়েই তারা এরপর অপহৃত নারীর একটি স্তন কেটে নিতো।

এবার তারা সবাই বসে পড়তো লাল চাদরে মোড়ানো সেই বেদিতে। রবিন তার কাছে থাকা স্যাটানিক বাইবেল থেকে বিভিন্ন মন্ত্রোচ্চারণ করতো, অন্যরা সেগুলো মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যেত। এরপর তারা একে একে কর্তিত সেই স্তনের উপর হস্তমৈথুন করতো। এ ধাপের পর ছুরি দিয়ে সেই স্তনকে ছোট ছোট টুকরা করে সবার হাতে ধরিয়ে দিতো রবিন। চারজন মিলে তখন খেতে বসে যেত সেই কাটা অংশগুলোই!খাওয়ার আগে অবশ্য আরেকটা কাজও করতো রবিন। স্মারক হিসেবে স্তনের ছোট একটি টুকরা সে একটি বক্সেও রেখে দিত। থমাস কোকোরালিস জানিয়েছিলো যে, একবার ঐ বাক্সে সে পনেরটির মতো কাটা স্তনের টুকরো দেখতে পেয়েছিলো।

এত অভিযোগ, প্রমাণ আর স্বীকারোক্তির পর অবশেষে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় দলনেতা রবিন গেখ্‌টকে। দলের সবাই নিজেদের দোষ স্বীকার করে নিয়েছিলো, স্বীকার করে নি শুধু দলনেতা নিজেই। বারবার সে নিজেকে নির্দোষ বলেই দাবি করতো।

পরিনতি

[সম্পাদনা]

অনেক অভিযোগ, প্রমাণ আর স্বীকারোক্তির পর অবশেষে পুনরায় গ্রেফতার করা হয় দলনেতা রবিন গেখ্‌টকে। দলের সবাই নিজেদের দোষ স্বীকার করে নিয়েছিলো, স্বীকার করে নি শুধু দলনেতা নিজেই। বারবার সে নিজেকে নির্দোষ বলেই দাবি করতো।

এছাড়া থমাস কোকোরালিসকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিলো। কিন্তু শুরুতে পুলিশকে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সহায়তা করায় তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়া হয়েছিলো। সেই সাজাও ধীরে ধীরে কমিয়ে আনা হয়েছে। খুনের দায় এড়াতে পারে নি অ্যান্ড্রু কোকোরালিস। ১৯৯৯ সালের ১৬ মার্চ প্রাণঘাতী ইনজেকশন প্রয়োগের মাধ্যমে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছিলো তার। এডওয়ার্ড স্প্রিটজারকে শুরুতে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেয়া হয়েছিলো। পরবর্তীতে শাস্তির মাত্রা কমিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের সাজা দেয় কর্তৃপক্ষ। ওদিকে বেভারলি ওয়াশিংটনকে ধর্ষণ ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে ১২০ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয় দলনেতা রবিন গেখ্‌টকে।

এভাবেই শেষ পর্যন্ত ইতি ঘটে এককালের কুখ্যাত, শয়তানের পূজারী শিকাগো রিপার্স নামক গুপ্ত সংঘটির।[2]