ব্যবহারকারী:DHURJATI PRASAD CHATTOPADHYAY/খেলাঘর

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

বাঙালির রিলিজিয়নের ভূত তাড়ানোর মন্ত্রপ্রকল্প


ধূর্জটিপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়


বাঙালি দুটি রিলিজিয়নে বিভক্ত, মূলত দুটি ভিন্ন রাজনৈতিক সীমায় তাদের বসবাস; অথচ একই প্রকৃতি, একই ভাষা আর প্রায় একই লোকাচার। অথচ কী ভয়ঙ্কর দূরত্ব ! এমনটার জন্য ইংরেজকে দোষী করে বাঙালি নামের এই জনজাতিটির সংযম অভ্যাস করার নাম— দুরাচার। লক্ষণীয়, রিলিজিয়ন শব্দটির ব্যবহার। ধর্ম বা ধম্মো বলতে দ্বিধাপ্রস্ত হয়ে অতঃপর ইংরাজি শব্দটির ব্যবহারে প্রবৃত্তি হল। এই সময়ে, অর্থাৎ একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বাঙালিরা যে আদর্শাচারে বিভক্ত তা অবশ্যই রিলিজিয়ন। ধর্ম ও রিলিজিয়নের এক সূক্ষ্ম পার্থক্য আছে। ধর্ম হচ্ছে যা তোমার-আমার-জনজাতির চরিত্রকে ধারণ করে তা। রিলিজিয়ন শব্দটি বুত্‍পত্তিগত ভাবে ল্যাটিন 'রিলিজিও' থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ জুড়ে রাখা। রিলিজিয়নের বোধ যা ওই শব্দে ওতপ্রোত, তা মনে হয়— জনজাতির দৈন্যে যে নীতি তার পাশে দাঁড়ায় তা। 'ধর্ম' শব্দটি চরিত্র ধারণ করা বোধে আশ্লিষ্ট। উপমহাদেশীয় 'ধর্ম' সদাই ব্যক্তিগত নির্বাণ বা মোক্ষকে বড় করে দেখেছে। এই দুই ভাবই  মহতী। কিন্তু তফাৎ আছে প্রায়োগিক বিভঙ্গে।  'রিলিজিয়ন' অনেকটাই সামাজিক বোধে ব্যবহৃত। সমাজ ও রাজনীতিতে তাই  রিলিজিয়নের বোধ অনেক সফল। ধর্মকে রাজধর্ম হিসেবে প্রয়োগ করতে গিয়ে বারবার সমাজ থমকে গেছে।

         এই অবধি পড়ে বাঙালি পাঠকের প্রাবন্ধিকের নামটা জানার ইচ্ছে জাগবে। সে দেখবে, লেখক তথাকথিত হিন্দু নামধারী। কিন্তু, এমনটা হবার কথা ছিলনা। কে লিখছে তার জাত বোঝার দায় পাঠকের না থাকাই বাঞ্ছনীয়। এই বাংলাই হয়ে উঠছে  লালনের 'আজব কারখানা'। একবার মনে হয়েছিল প্রবন্ধ প্রয়াস না করে লালনের কবিতাটাই আমার পিতৃদেবের স্টাইলে দুর্গা নামের মত একশো আটবার লিখে ছাপিয়ে দিলেই ভাল হয়। 'জাত গেল জাত গেল বলে - একি আজব কারখানা - সত্য কাজে কেউ নয় রাজি -সবই দেখি তা না না না।। আসবার কালে কি জাত ছিলে - এসে তুমি কি জাত নিলে- কি জাত হবে যাবার কালে -সে কথা ভেবে বলো না।। ব্রাহ্মণ চন্ডাল চামার মুচি - একি জলেই সব হয় গো সুচি - দেখে শুনে হয় না রুচি - যমে তো কাউকে ছাড়বে না।। গোপনে যে বেশ্যার ভাত খায় - তাতে ধর্মের কি ক্ষতি হয় -লালন বলে জাত কারে কয়- সে ঘোরও তো গেল না।। জাত গেল জাত গেল বলে -একি আজব কারখানা।।' সনাতন যে বলে তার ধর্ম সংস্থাপনার কাজ চলতেই থাকবে ! তো কোথায় সেই ধর্ম সংস্থাপন ! ওপরের অসামান্য শোকময় কাব্যটি মূলত লালন তথাকথিত সনাতনীদের উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন যারা নিজেদের হিন্দু ধর্মীয় তকমা দিয়ে সেসময় অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিশিষ্টতা উপভোগ করত এবং বিভাজনের নব নব নীতি অর্থনৈতিক সুবিধাবদীরা ধর্ম সংস্থাপনার নামে প্রণয়ন করত। এদিক থেকে ইসলামীয়দের রিলিজিয়নে নব্য নীতি আনয়নের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে, তাই অনেকটাই বাঁচোয়া। কিন্তু দুর্জনের ছলের অভাব হয়না। সংখ্যাগুরু এলাকায় বৈদিক দর্শনের ব্যাখ্যা যেমন নিজের মত করে অসাধু পন্ডিতরা টিকি দুলিয়ে করত আপামর জনগণের সংস্কৃত না জানার অছিলায়, ঠিক তেমনি অসাধু মৌলবিরা দাড়ি নাড়িয়ে করে সাধারণ মানুষের আরবি-ফারসি না জানার সুযোগ নিয়ে।   ‘আজব কারখানা’য় এসে, শূন্য হাতে বাঙালির ইচ্ছে কখনোই পূর্ণমনস্কতা পায়নি অতীতে। আজও পায়না। তাই একবার বৈদিক মূল স্রোতে মিশতে চেয়ে, পেরে ওঠেনা আবার ইসলামী দুনিয়াতেও কলকে পায়না। বাঙালির কিন্তু একটা নিজস্ব ধর্ম আছে রিলিজিয়ন নির্বিশেষে যার বীজমন্ত্র হল — "বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে নিকানো উঠোনে ঝরে রোদ , বারান্দায় লাগে জ্যোৎস্নার চন্দন । বাংলা ভাষা উচ্চারিত হলে অন্ধ বাউলের একতারা বাজে উদার গৈরিক মাঠে, খোলা পথে, উত্তাল নদীর বাঁকে বাঁকে, নদীও নর্তকী হয় ।..." আমরা  বাংলা বলি। এটাই সাধারণ ধর্ম আমাদের জাতির। এই ভাষা উচ্চারিত হলে আমাদের বিবেক জাগ্রত হয়। ভুললে চলবে না যে, ভাষা দিবস বাঙালির সর্বোত্তম গর্বের দিন। স্বাধীনতা দিবস দুই ভূগোলে পৃথক কিন্তু ভাষা দিবস দুই বাংলার সমান গর্বের বিষয়।          ভারতের বাঙালিরা রাষ্ট্র পায়নি নিজের ভাষার, তারা ভারতের রাষ্ট্রত্বে অনেকটাই ব্রাত্য ও অভিমানী, তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশের জাত্যাভিমান দেখে ঈর্ষাকাতর হয়। যখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট ম্যাচ হয়, তখন ভারতকে সমর্থন করে অন্তরকে অনেকরকম প্রশ্ন করে। যখন বাংলাদেশ ভারত ভিন্ন অন্য কাউকে হারায় তখন আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। এই ট্র্যাজেডি নিয়ে একটা জনজাতি কেমন বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। ভারতের বাঙালি যতটা বাংলাভাগের কষ্ট পেয়েছে বাংলাদেশের বাঙালি তার থেকে অনেকাংশ কম পেয়েছে। তারা স্বজন হারানোর কষ্ট নিশ্চয়ই  পেয়েছিল  কিন্তু বর্তমান প্রজন্ম তা কাটিয়ে উঠেছে। রিলিজিয়ন রাষ্ট্র নির্মাণে সহায়ক তার মূল সংজ্ঞানুসারে। বাংলাদেশের বাঙালি একটা রাষ্ট্র পেয়েছে কিন্তু ইসলামকে আঁকড়ে নয়। সেই সংগ্রামের মুখটা ছিল বাংলা ভাষা। এবং অবশ্যই এই ভাষা হচ্ছে সেই ধর্ম যার থেকে রিলিজিয়ন অনেকটাই আলাদা। ভারত ও পাকিস্তান, এই দুটি রাষ্ট্র নির্মাণ করার মূলে কিন্তু ছিল রিলিজিয়ন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে সংস্কৃতির তীব্র আত্মাভিমান থেকে। ভাষাও যে পারে রাষ্ট্রনির্মাণ করতে তা প্রমাণিত। বাংলাদেশের বাঙালি যখন স্বাধীনতা পেল, ঠিক একই সময় ভারতের বাঙালিরাও এক নতুন ইজমের খোঁজে মগ্ন হয়েছিল নিজেদের অজান্তে। আজ সেই সময়ের পঞ্চাশ বছর পর সেই খোঁজকে নতুন রিলিজিয়নের খোঁজ বললে অযৌক্তিক হবেনা। মার্ক্সবাদের আজ যে আঙ্গিক তাতে তাকে অপর এক রিলিজিয়ন ছাড়া কিছু বললে বিজ্ঞানকে অবমাননা করা হবে। সেই খোঁজ ও তার জন্য চলনের নামও ছিল মুক্তিযুদ্ধ। যেমন বাংলাদেশেও ছিল। কিন্তু ভারতের বাঙালির এই রিলিজিয়নের চাহিদায় বাঙালির সংস্কৃতি ওতপ্রোত ছিলনা। এই মুক্তিযুদ্ধে নিশ্চয়ই মুক্তির নিঃশ্বাস নেবার আয়োজন ছিল, সদ্ভাবনাও ছিল, উচ্ছ্বাস অবশ্যই ছিল, যেটা ছিলনা তা হল আপামর বাঙালি সমাজের মিলিত সংস্কৃতির আবেগ। এই মুক্তি যুদ্ধের আয়োজন তাই হঠকারী বলে আখ্যায়িত হল। পাকফৌজের সামনে বাংলাদেশের বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের প্রতিরোধও হঠকারী প্রমাণিত হতে পারত। কিন্তু আন্তর্জাতিক সমর্থন তা হতে দেয়নি। একটা সম্মিলিত জনজাতির সামাজিক সংস্কৃতির চাহিদা তার ভাষা ধর্মে অনুরণিত হয়ে সফলতা প্রাপ্ত হয়েছিল।        

         দুই বাংলাতে একই সময় মুক্তিযুদ্ধে তরুণ প্রজন্ম প্রায় সাফ হয়ে গেছিল এবং অদ্ভুত সাযুজ্য ছিল এই হত্যালীলার। যারা হত্যা করেছিল তারা ছিল স্বরাষ্ট্রীয় সামরিক বাহিনী দুই বাংলাতেই। বাংলাদেশের বাঙালির আনন্দ উচ্ছ্বাস ঘটাতে যে রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী তাদের সমর্থন করেছিল, আবার তারাই ধ্বস্ত করেছিল ভারতের বাঙালিদের — এটা ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ পরিহাসময় বিড়ম্বনাগুলির অন্যতম। এরপর গণতন্ত্র নামের এক যাজকের মাধ্যমে ভারতের বাঙালি পেল তাদের কাঙ্ক্ষিত রিলিজিয়ন স্থাপনের এক রূপান্তরিত বিকল্প — মার্ক্সবাদী সরকার, সন ১৯৭৭। এর কিছুদিন আগে বাংলাদেশের বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের নায়ককে মৃত্যুবরণ করতে হল তারই সহযোদ্ধা ও বিশ্বস্ত আপনজনের হাতে, সন ১৯৭৫। সত্তরের দশক মুক্তির দশক হয়ে উঠেছিল কি ভারতের বাঙালিদের কাছে ! আর হয়েও তা কেন এত বিষাদময় হয়ে উঠল বাংলাদেশের বাঙালিদের কাছে ? ঠিক ভারতের মত করেই বাংলাদেশেও কেন জাতির জনকে পরিণত মানুষটিকে প্রাণ দিতে হল?

         ভারতের বাঙালিদের বাম নামের এই রিলিজিয়ন স্থায়ী হয়েছিল প্রায় তিন দশক, কিন্তু ভারত নামের এক বিশাল রাষ্ট্রে তো বিচ্ছিন্নতাবাদ করে নব রাষ্ট্র নির্মাণ সম্ভব নয়, আর বামবাদী এই গণতন্ত্রবিশ্বাসী রিলিজিয়নে তার সুযোগও ছিলনা, ভারতের বাঙালি তা চায়ও না। ভারতের বাঙালি তবে কী চায়? অবশ্যই স্বতন্ত্রতা। এই স্বতন্ত্রতার চাহিদায় তারা ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের সদাবিরোধী— এমনটা সত্তর বছরের গণতন্ত্রে প্রকাশিত। এটাই ভারতের বাঙালিদের সমর্থন পাবার জন্য যে কোনও রাজনৈতিক দলের অনন্য অস্ত্র। বাঙালির এই স্বতন্ত্রতা পাবার ইচ্ছে কিন্তু জেনেটিক বা উদ্ভবের বীজ সম্বন্ধীয়। এটিকে লালন না করলে জনজাতিটির মনের লালন কোনও রাষ্ট্রের পক্ষে সম্ভবপর হবেনা। পাকিস্তান পারেনি। ভারতও পেরে উঠছে না। এই স্বতন্ত্রতাই বাঙালির ধর্ম, রিলিজিয়ন নয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর 'গান্ধারীর আবেদন' কাব্যে ধৃতরাষ্ট্রের সেই উদ্ধত প্রশ্ন —"কী দিবে তোমারে ধর্ম ?" এর উত্তরে গান্ধারীর মুখে স্থাপন করেছিলেন এক অনবদ্য শব্দবন্ধ —"দুঃখ নব নব।" এই নব নব দুঃখ ধারণ করে বাঙালিকে বাঁচতে শিখতে হচ্ছে।

         ক্ষিতিমোহন সেনের লেখা 'বাংলার সাধনা' বইয়ের ভূমিকা থেকে রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির একটু বখরা নেওয়া যাক। "মানবপন্থী বাংলাদেশ প্রাচীন কালেও ভারতের শাস্ত্রপন্থী সমাজ-নেতাদের কাছে নিন্দনীয় ছিল। তীর্থযাত্রা ছাড়া এখানে এলে প্রায়শ্চিত্ত করতে হত। তার মানে বাংলাদেশ চিরদিনই শাস্ত্রগত-সংস্কারমুক্ত।" শাস্ত্রজ্ঞান অবশ্যই থাকবে অথচ শাস্ত্রগত-সংস্কারমুক্ত থাকতে হবে — এমনটাই বাঙালি জাতির ধর্ম। বাংলা ভাষা সংস্কৃত উপলব্ধ মাগধী প্রাকৃত বা ভাষাবিদ মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে গৌড়ীয় প্রাকৃত জাত হলেও এই  গৌড়ীয় প্রাকৃত উপাদানগত ভাবে মূলত অস্ট্রিক, এবং পার্শ্বিক ভাবে দ্রাবিড় ও তিব্বতী-বর্মী শব্দক্রিয়াভাণ্ডার ও ভাষাভঙ্গি দ্বারা সমৃদ্ধ। পরবর্তী অধ্যায়ে আরবি ও ফারসি শব্দ বাংলা ভাষাকে দ্যোতনা দিয়ে উন্নীত করেছে এক মুক্ত মঞ্চে, যেখানে দাঁড়িয়ে এ ভাষার মাধ্যমে বিজ্ঞান, দর্শন, সঙ্গীত, সংস্কৃতি চর্চা করা সহজসাধ্য ও সাবলীল। এ ভাষার উচ্চারণ রীতি এত মুক্ত ও শব্দ ভাণ্ডার এতটাই সংস্কারহীন হয়েও সমৃদ্ধ যে কাব্য রচনার প্রশস্ততা ও সুযোগ এতে সর্বাধিক। অতি সহজেই সংস্কৃত ছন্দ বাংলায় প্রতিফলিত করা যায়, সাঁওতালি লয় মাদল, ধামসা থেকে উঠে এসে অবব্যহিত বাণী লেগে যায় স্বরবৃত্তে, রাখালিয়া বাঁশির সুর হাতড়ে তোটক ছন্দে রূপায়িত করা যায় রুদ্ধদল, মুক্তদল এর অনুকল্প ব্যবহারে।

         চটুল খেমটা, লম্পটিয়া, লেটো, ঘেঁটু, পটুয়া, ভাদু, টুসু, জাওয়া, চটকা, পুতুলনাচ, মেয়েলি, ব্রত, গাজী সাহেবের গান, গাজনের গান, শীতলার গান, বনবিবির গান, দক্ষিণরায়ের গান, বোলান, গম্ভীরা, ঝুমুর, আলকাপ, মায় ছাদপেটানি গানের স্থানীয় ভাষাপ্রকল্প  নিজস্ব মূর্ছনায় সংস্কারমুক্ত হয়েও তার নিজের শাস্ত্র নিজেই গড়ে নেয়। রিলিজিয়নে বিভক্ত দুই বাংলায় কাব্য ও লোকসাহিত্যের পরম্পরা কিন্তু বিভাজিত হয়নি রাষ্ট্রীয় দূরত্ব সত্ত্বেও। উদার ও ব্যাপ্তি এবং অবশ্যই এই ভাষার সমৃদ্ধ ছন্দ প্রকরণের সুবিধার কারণে তাত্ক্ষণিক কাব্য প্রতিভা উন্মীলনের মঞ্চ হয়ে ওঠে কবিগান সমৃদ্ধ কবিয়ালের লড়াই। বঙ্গভঙ্গর পরে কলকাতা কেন্দ্রিক এই চর্চা বেঁচে ছিল তত্কালীন পূর্ববঙ্গে। শিব কেন্দ্রিক গম্ভীরা গান রাঢ় অঞ্চল থেকে অপসৃয়মান হওয়ায় তাকে সযত্নে বুকে আঁকড়ে বাঁচিয়ে রাখে সেই পূর্ববঙ্গ নব পিতামহ-প্রপৌত্র আঙ্গিকে। ইসলামীয় স্থানীয় কবিরা পিতামহর মাঝে শিবের গম্ভীর অথচ স্নেহময় খামখেয়ালি রূপটিকে লালন করে রেখেছেন অদ্যাবধি। পূর্ববঙ্গের ময়মনসিং গীতিকা নিয়ে কলকাতা যে উত্তাল হয়ে ওঠে বা পশ্চিমবঙ্গের লোকসঙ্গীত শিল্পীরা মুরশিদি, আউলিয়া বা ভাটিয়ালি সংগ্রহে না থাকা বা পরিবেশন না করতে পারা কে সঙ্গীতচর্চার অসম্পূর্ণতা বলে যে মনে করে তা এক দীর্ঘ পরম্পরার অন্তর্গত। এই পরম্পরার উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্কটি একজন খাঁটি রাঢ়ী ঘটি যাকে বাঙালরা হাইজ্যাক করে দেশে নিয়ে গিয়ে জাতীয় কবির সেরা সম্মানটি যে দিয়েছে তার জন্য ভারতীয় বাঙালিদের চির কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। বাউল ফকির, মারফতি গান, আউলিয়া, ধামালি,  জারি গান, মুরশিদি, ভাওয়াইয়া, বিচ্ছেদী, সারি, মাইজভাণ্ডারি, ঝাঁপ, ভাটিয়ালি, কীর্তন, গজল, ভজন, ঠুংরি, শ্যামা সঙ্গীত — সব উন্নত শাস্ত্রীয় আঙ্গিকেই নজরুলের গান প্রভাবিত করেছে স্থানীয় কবিদের। শাস্ত্রগত অথচ সংস্কার মুক্ত হবার কারণ বাঙালি শাস্ত্রকে ধী তে স্থান দিয়েছে বিধিতে নয়।

         ভারতের এহেন বাঙালিকে গত দশ বছরে রাষ্ট্রের ভূতে ধরেছে। এটা কিছুটা প্রতিবেশী বাংলাদেশের প্রতি ঈর্ষায় এবং অবশ্যই স্বরাজ্য থেকে সরে ভারতের ভিন রাজ্যে গিয়ে ধনী হওয়ার তত্ত্বের সত্যতায়। এটা তারা ভাবছেনা যে, এই সুযোগটা কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালিদের পেতে গেলে রাষ্ট্র ত্যাগ করতে হয় এবং  চলে যেতে হয় পশ্চিমে, যেখানে সূর্য দেরিতে ওঠে। ভারতের বাঙালিদের একাংশ যাদের বয়স পঞ্চাশের বেশি তারা এখনও শাস্ত্রগত-সংস্কারমুক্ত তাই স্বরাষ্ট্রে ব্রাত্য। তাদের বাম রিলিজিয়নের ভূত এখনও সম্পূর্ণ কাটেনি। নব প্রজন্ম বাংলা শিক্ষাকে কিছুটা সুবিধাপ্রবঞ্চিত গ্রামীণ এলাকার বাধ্যতামূলক পাঠ্যক্রম বলে মনে করে। বাঙালির ঐতিহ্য ও প্রগতি তার ভাষা ও সংস্কৃতিতেই অনুবিদ্ধ আছে, এবং তার জন্য রাষ্ট্র নির্মাণকারী রিলিজিয়নের ধার ধারেনা—এই আপ্তবাক্য বাঙালি বিস্মরিত হলে চরম নৈরাজ্য সূচিত হবে। বিচ্ছেদ গানের বেদনা যেন জনজাতির কাব্যের উপাদান হয়ে ওঠে — “আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম-গ্রামের নওজোয়ান হিন্দু মুসলমান-মিলিয়া বাউলা গান আর ঘাটু গান গাইতাম-আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম।”

         পরিসংখ্যান বলে — ইসলামীয়দের জনসংখ্যা পশ্চিমবঙ্গে ১৯৭১ এর ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০১১ তে হয়েছে ২৭ শতাংশ।

বাংলাদেশেও কেন একই ভাষা ব্যবহারকারী একই সংস্কৃতির অপর এক রিলিজিয়নে বিশ্বাসী তথাকথিত হিন্দু গোষ্ঠীর জনসংখ্যা ১৯৭১ এ দেশ রাষ্ট্রত্ব পাবার পর থেকে প্রায় ২০ শতাংশ থেকে ৮.৫  শতাংশে নেমে আসবে? তবে কী পশ্চিমবঙ্গের এক বৃহত্‍ রাষ্ট্রের অন্তর্গত থেকে বাঙালির দুই রিলিজিয়নে বিভাজনের মর্মান্তিকতার ফল এই রাজ্যে অপেক্ষাকৃত কম দন্ত-নখর উন্মোচন করেছে ? বাংলাদেশ মারফত বাঙালি যে রাষ্ট্র পেয়েছে তার পঞ্চাশ বছর হতে চলল, পশ্চিমবঙ্গে সেই অর্থে কোনও সংখ্যাগরিষ্ঠ মৌলবাদের দাপট ছিলনা এই সুদীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী জুড়ে। তবে কী পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি এই ইসলামীয় জনসংখ্যার বৃদ্ধিকে গৌরবের অধ্যায় বলে স্বীকার না করে রাষ্ট্রীয় রিলিজিয়ন তত্ত্বের সামনে নতজানু হবে? চাইবে সংখ্যালঘুরা আরও কৃশতা প্রাপ্ত হোক ! বাঙালির সংস্কৃতিতন্ত্রে স্বসৃষ্ট বহুজাতিকতার সর্বাধিক মুল্যবান উপাদানকেই সে নিজেই অগ্রাহ্য করে বসবে !

         'উদারচরিতানাম্‌' নামক  কণিকা সঙ্কলেনের এক কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন —  "প্রাচীরের ছিদ্রে এক নামগোত্রহীন-ফুটিয়াছে ছোটো ফুল অতিশয় দীন। ধিক্‌ ধিক্‌ করে তারে কাননে সবাই--সূর্য উঠি বলে তারে, ভালো আছ ভাই?"  সূর্যর পরিবর্ত হিসেবে আল্লা বা পরমেশ্বরকে যদি কল্পনা নাও করতে পারি, আমরা বাঙালিরা যদি তাকে আমাদের উদারচরিত ভাষা ভিত্তিক সৃষ্ট স্বধর্মর নায়ক বলে মনে করি তবে ইতিহাসে ধর্মযুদ্ধর তথাকথিত রিলিজিয়ন কেন্দ্রিক কুব্যাখ্যা কে বদলিয়ে আমরাই আবার সীমন্তরেখাকে অক্ষুণ্ণ রেখেও ভাষাভিত্তিক নবধর্ম সংস্থাপনের কাজ সূচনা করতে পারব। গোপনে বেশ্যার ভাত খেলেও বাঙালির জাত যাবেনা কারণ সেই নারীটি আমার খিধে মাতৃরূপে মিটিয়েছেন। এটাই শেষ সত্য। রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন যে বাংলা মানবপন্থী, শাস্ত্রপন্থী নয়। তাই শাস্ত্র বিশ্বাস ব্যাষ্টিতে অক্ষুণ্ণ রেখে মানবপন্থার যে সুর বাঙালির সৃষ্টি, তা সমষ্টিতে অনুরণিত হোক। বাঙালির রিলিজিয়নের ভূত তাড়ানোর মন্ত্রপ্রকল্প তাই তারই তৈরি করা ভাষা ধর্মে সংস্থাপিত হোক।


source: বাংলাপিডিয়া: বাংলার লোকসংস্কৃতি, wikipedia : music of bangladesh