ব্যবহারকারী:মাওলানা আব্দুল হােই জেহাদী/মাওলানা আব্দুল হাই জেহাদী

উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে

= দেহলভী চিন্তাধারার সফল রূপকার মহান সংস্কারক সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) -[সম্পাদনা]

অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুল হাই জেহাদী ='[সম্পাদনা]

আরবে মরুর দুলাল ঃ সোনার মদীনায় ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা[সম্পাদনা]

পৃথিবীতে যখন গোষ্ঠি দ্বন্ধ আর ব্যক্তি প্রভাব বিস্তার কলুষে কলুষিত,মানবতা ছিল বিপন্ন এ আইয়্যামে জাহেলিয়াতের এই যুগে ৫৭০ খৃষ্টাব্দে তশরিফ আনেন মরুর দুলালী মা আমিনার লাল সরওয়ারে কায়েনাত সায়্যিদুল মুরসালিন মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। মানবতা হারা বিপথগামী মানুষরূপী দানবদের সীমাহীন যাতনা লাঞ্চনা বঞ্চনার মোকাবেলায় ইসলামের নবী ও তাঁর অনুসারীরা সর্বোচ্চ কোরবানীর নজরানা পেশ করে আদর্শিক বিপ্লবের পথে এগিয়ে গিয়ে আরবের জাহেলী আঁধার বেদ করে দুনিয়ার বুকে সোনার মদীনায় প্রথম ইসলামী শাসনতান্ত্রিক সোনার  রাষ্ট্র কায়েম করেন আখেরি পয়গাম্বর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।

ইসলামের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থাঃ[সম্পাদনা]

ইসলামের নবী আখেরী নবী বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মাদ (সাঃ) ৬১০ খৃষ্টাব্দে নবুওতি লাভের পর ইসলামের দাওয়াত দিতে শুরু করেন। একে একে কয়েকজন ইসলাম গ্রহণ করার পর তাদেরকে ইসলামের দীক্ষা দানে যে ঘরে সমবেত হতেন সেটা ছিল দারে আরকাম আর এটাই ইসলামের ইতিহাসে প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগার। কাফের মুশরিকদের অত্যাচার নিপীড়ন সীমাতিক্রম করার পর দলে দলে আল্লাহর হুকুমে রাসুলের পরামর্শে দলে দলে সাহাবায়ে কেরাম হিজরত করতে থাকের দেশ দেশান্তরে। এই হিজরতের উদ্দেশ্য কেবল পলায়ন বা দেশান্তরিত হয়ে আত্ম রক্ষা ছিলনা বরং এটা ছিল ইসলামের আলো বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার এক দুর্ধান্ত মিশন। এর চুড়ান্ত পর্যায়ে আল্লাহর হুকুমে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) হিজরত করেন মদীনায়। এটি তখনকার ঘটনা যখন আরবের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীরা আল্লাহর রাসুলকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আল্লাহর রাসুলের বাসগৃহ রাতের আধারে ঘেরাও করে ফেলে। আজকের আধুনিক সভ্যতার যুগেও কথিত আধুনিক আবুজেহেল বাহিনীও রাতের আধারে ইসলামের দায়ীদের বাড়ীঘর ঘেরাও করে তাদেরকে হত্যা বা গুম করার জন্য । আজকের যুগেও হাজার হাজার দায়ী ইলাল্লাহ হয় জেলখানায় বন্দী না হয় ফাসির দড়ি মাধ্যম করে জান্নাতে চলে গেছেন। এটাই ইসলামের ইতিহাসের একটা নির্মম পরিণতি তাই কোন কালেই ইসলামের প্রকৃত সৈনিকেরা নির্বিঘেœ পথ চলতে পারেননা। পদে পদে পরীক্ষার সম্মুখিন হতেই হয় তাদেরকে। আমাদের ভারত বর্ষেও এই নির্মমতরি যে ছোঁয়া লাগেনি তা নয়। ভারত বর্ষে ইসলামের আগমন থেকে শুরু করে এখনো এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে কখনো কম কখনো বেশি।

ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমনঃ শিক্ষার আলো[সম্পাদনা]

আরবে যখন আখেরি নবীর আগমনে বিশ্বজাহানে রহমতি পয়গাম। জালিম শাসকদের মসনদ থরথর করে  কাঁপছে ভীত সন্ত্রস্তে। পৃথিবীর মানচিত্রে বিশাল একটি ভুখন্ড ভারতে তখন কুড়িটিরও বেশি পৌত্তলিক ধর্মীয় ফেরকার পাশাপাশি সামাজিক ও রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন,উচূ জাত- নীচুজাত ভেদাভেদ,মানুষকে ঘৃণার পাত্র বানানোর একটা ঘৃণ্য প্রথা ’দাসপ্রথা’, সতীদাহ প্রথা, আঞ্চলিক রাজ্য বন্টন নিয়ে গোলযোগ,ইত্যকার সমস্যা লেগেই ছিল। যেটা আরবেও ছিল। ভারতের  রাজা শশাঙ্ক এই পরিস্থিতিতে আখেরি পয়গাম্বর সায়্যিদুল মুরসালিন (সাঃ) এর আগমন ও নবূওতির দাবী বিষয়ে খবর রাখছিলেন আরব বণিকদের মাধ্যমে। ব্রান্মণ,বৌদ্ধ ,জৈন ও হিন্দু ধর্ম প্রধান ভারতে আরো অন্তত ১০টি ধর্মীয় ও ৩১টি শ্রেণী বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী ছিল। প্রাক-মুসলিম যুগে ভারতবর্ষের শাসন ব্যবস্থা ছিল ধর্ম ভিত্তিক তাই ধর্মালয় কেন্দ্রীক শিক্ষা ব্যবস্থাই বলবত ছিল।

ইসলামের ইতিহাসে স্মরণীয় দিন ১১জানুয়ারী ৬৩০ খৃষ্টাব্দেরর ২০ রমজান ৮ম হিজরী বিনা রক্তপাতে আদর্শিক বিপ্লবের মাধ্যমে মক্কা বিজয় ঘটে। এর পরই ই ভারতের বাংলাদেশ অঞ্চলের লালমনিরহাট জেলা দিয়ে ৬২০/২১ খৃষ্টাব্দেই বাংলাদেশে এক বা একাধিক সাহাবায়ে কেরামের আগমন ঘটে বলে ঐতিহাসিক সূত্রের বরাত দিয়ে বহু প্রবন্ধ নিবন্ধ লেখা হয়েছে। বিশেষতঃ রংপুর জেলার ইতিহাসে এর বিশদ বিবরণ ও সাহাবায়ে কেরামের নামও আছে। অন্য দিকে ইরান হয়ে আফগানিস্তান ও ভারতের সিন্দূ ও পাকিস্তানের মুলতান পাঞ্জাব এলাকায় ও মোসলমানদের আগমন ঘটে ও এর সংখ্যা বাড়তে থাকে। পরবর্তিতে অনেক মুসলিম বণিকও এ সব এলাকায় বসতি স্থাপন করেন।

বাংলাদেশে সাহাবায়ে কেরামের আগমন ঃ[সম্পাদনা]

অন্য দিকে দক্ষিণ ভারতের বর্তমান নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় কিছু ধর্মীয় জাতিগোষ্ঠী ছিল যারা কোন মূর্তিপূজা অগ্নী পুজা করতনা। একশ্বরবাদের প্রতীক হিসেবে এরা দিন ও রাতের পুজা করত। তাদের সংখ্যাধিক্যতা আরাকান রাজ্যেও ছিল। এই জাতী গুলোও  তাদের শিক্ষা কার্যক্রম ধর্মালয় কেন্দ্রীক পরিচালিত করত। পাশাপাশি রাজা বাদশাহ বা ধনী যারা ছিলেন তাদের বাড়িতে ধর্মগুরু/শিক্ষা গুরু  নিয়োগ করতেন। এ দিকে আখেরী পয়গম্বর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন বিদায় হজ্বের ভাষণে ঘোষণা করলেন بلغوا عنى ولو اية যে আমার কাছ থেকে তোমরা যা শুনেছ তা অন্যের কাছে পৌঁছে দাও যদি তা একটি আয়াত ও হয়। তখন থেকেই সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) যার যার ঈমানী দায়ীত্ব পালনের মানসে যে যে দিকে পারেন দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। এই দায়ীদের অনেকেই ভারতে এসে অতি সংগোপনে ইসলামী  দাওয়াতের  কাজ  শুরু করেন।

নবীজির (সঃ) জন্মগ্রহণের ৫০ বছর পর ৬২০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ইসলাম আসে সাহাবায়ে কেরামের মাধ্যমে। ঐতিহাসিকদের সর্বসম্মত মত হলো, আরব বণিকদের মাধ্যমেই এদেশে ইসলাম এসেছে। আরব থেকে আগত মুসলমান বা স্থানীয় মুসলমান- যারা ৬৯ হিজরিতে এ এলাকায় বসবাস করেছিলেন তারাই নিজেদের ধর্মীয় প্রয়োজনে মসজিদ তৈরি করেছিলেন। সেই থেকে বা তারও আগে থেকে বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের কাজ আরম্ভ হয়।‘জাতীয় অধ্যাপক’ দেওয়ান মুহাম্মদ আজরফের মতে, হজরত ওমরের (রাঃ) শাসনামলে মামুন, মুহাইমেন (রাঃ) নামক সাহাবিদ্বয় বাংলাদেশে আগমন করেন। ইসলাম প্রচারের এ ধারা আব্বাসী খেলাফতকালে আরও জোরদার হয়। রাজশাহীর পাহাড়পুরে বৌদ্ধবিহার খননকালে দুটি আরবি মুদ্রা পাওয়া যায়। এই মুদ্রা দুটি তৈরি হয়েছিল ৭৮৮ খৃস্টাব্দে অর্থাৎ আব্বাসী খলীফা হারুনুর রশিদের আমলে।

মোহাম্মাদ বিন কাসিম কর্তৃক ভারত বিজয়ঃ[সম্পাদনা]

উমাইয়া খলিফা ওয়ালিদের সময়  ইরাকের শাসনকর্তা হাজ্জাজ বিন ইউসুফ কারাচী অঞ্চলের অত্যাচারী শাসন রাজা দাহিরকে শায়েস্তা করার জন মোহাম্মদ বিন কাসিমের নেতৃত্বে সৈন্য বাহিনী প্রেরণ করেন। মোহাম্মদ বিন কাসিম ৭১২ ঈসায়ী সালে রাজা দাহিরকে পরাজিত করে সিন্ধু দখল করেন। অতঃপর তিনি পাঞ্জাবের মুলতান পর্যন্ত অগসর হন। এ সময় তিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নির্দেশে আর অগসর না হয়ে ফিরে যান। যাবার প্রাক্কালে মুসলিম শাসক নিয়োগ করে যান ফলে সিন্ধু থেকে মুলতান পর্যন্ত মুসলমান শাসন কায়েম হয়। এবং মুলতানে একটি উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়। এর পাঁচশ বছর পর ভারতের রাজধানী দিল্লিতে সুলতান কুতুব উদ্দিন আইবেকের মাধমে ১২০৩ সালে মুসলিম সালতানাত কায়েম হয়। সাড়ে পাঁচশত বছর স্থায়ী থাকার পর  ১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ দৌলার পরাজয়ের মাধমে এর পতন ঘটে।

আলেম হওয়ার নিয়ম ঃ[সম্পাদনা]

আলিম হবার নিয়ম হচ্ছে আপনি একজন আলিমের তত্ত্াবধানে নির্দিষ্ট বিষয় অধ্যয়ন করবেন। এরপর উস্তাদ যখন নির্দিষ্ট বিষয়ে আপনি পারঙ্গম হয়েছেন বলে নিশ্চিত হবেন তখন তিনি আপনাকে ইজাযাহ (সনদ) দান করবেন। এভাবে আপনি ঐ বিষয়ে আলিম হবেন। ইসলামে আলিম হবার এটাই হচ্ছে প্রচলিত পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতেই আলিম হয়েছেন আমাদের আগের দিনের উলামারা - আয়িম্মায়ে আল-মুজতাহিদীন, মুহাদ্দিসীনগণ সবাই। এখনকার মাদ্রাসা বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নেওয়াটা মূলত ঐ ইজাযাহ পদ্ধতি থেকে চলে আসা পথ। সায়্যিদ আবুল আলা মওদূদী (রঃ) মূলত সেই প্রচলিত ইসলামী ইজাযাহ পদ্ধতিতে গড়ে ওঠা আলিম। তিনি ইসলামের মৌলিক সবগুলো বিষয়ে তৎকালীন ভারতের প্রসিদ্ধ আলিমদের থেকে ইজাযাহ প্রাপ্ত। তাই তাকে যারা চিনতেন তেমন বিরোধীরাও তার আলিম হওয়া নিয়ে কথা বলতেন না। তার পরিবারের কাছে তার ইজাযাহগুলো এখনও সংরক্ষিত।

মধ্যযুগে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ঃ[সম্পাদনা]

ইসলামের ইতিহাসে মধ্যযুগে যারা মাদরাসা তৈরি করেছিল, তাদের মধ্যে মন্ত্রী ও সাহিত্যিক নিজামুল মুলক তুসী সবচেয়ে প্রসিদ্ধ ও সর্বাধিক খ্যাত ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু ঐতিহাসিকগণ বলেছেন, নিজামুল মুলক তুসীর কমপক্ষে এক শতাব্দী পূর্বেই মাদ্রাসা ব্যবস্থা শুরু হয়ে গিয়েছিল। আল্লামা সুবকী তার শিক্ষক শামসুদ্দিন যাহাবীর (৭৪৮ হিজরী/১৩৪৯ ইং) সূত্রে বর্ণনা করেছেন, নাইসাপুর অঞ্চলে মাদরাসায়ে বাইহাকিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে নিজামুল মুলক জন্মেরও প্রায় একশত বছর আগে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক আল্লামা মাকরিযী এই মতকে সমর্থন করেছেন। তিনি বলেছেন, “মাদরাসা পদ্ধতি ইসলামে নব আবিস্কৃত আধুনিক বিষয়। সাহাবী (রাঃ) ও তাবেঈদের (রঃ) সময় এরকম কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিলনা। চতুর্থ হিজরী শতাব্দীর পর মাদরাসা ব্যবস্থা শুরু হয়। শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা গুলোর মধ্যে অন্যতম নাইসাপুরের মাদরাসায়ে বাইহাকিয়া, নাসির বিন সবুক্তগিনের মাদরাসা, সুলতান মাহমুদ বিন সবুক্তগিনের মাদরাসা প্রভৃতি।”

ইমলা পদ্ধতি কি ঃ[সম্পাদনা]

শিক্ষাপ্রদানের ক্ষেত্রে তখন ইমলা-পদ্ধতি খুবই জনপ্রীয় ছিল। ইমলা-পদ্ধতি হলো, শিক্ষক দরসে যেই পাঠ শেখাবেন, সেগুলো হুবহু লিখে রাখা। ব্যাপকভাবে এ পদ্ধতি শিক্ষার মান নির্ণয়  করে দিত। যে ছাত্রের নিকট ইমলাকৃত খাতা বেশি থাকত তাকে অধিক জ্ঞানী মনে করা হতো। কথিত আছে, মুতাজিলা ধর্মতাত্ত্বিক জুব্বাঈ প্রায় এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার পৃষ্ঠার ইমলা লিখেছিল। হিজরী চতুর্থ শতাব্দীতে ভাষাবিদ ও শব্দতাত্বিকরা ইমলা পদ্ধতি বাদ দিয়ে দেন। তারা বর্তমানের মত নির্দিষ্ট গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে পাঠদান পদ্ধতি চালু করেন। আবুল কাশেম যাজজানী (মৃ ৩৩৯ হি./৯৫০ ইং) ছিলেন ভাষাতাত্বিকদের মধ্যে ইমলা-পদ্ধতিতে পাঠদানকারী সর্বশেষ শিক্ষক। কিন্তু মুহাদ্দিস ও কালামবিদদের ঘরানায় তখনো অত্যন্ত প্রতাপের সাথে ইমলা পদ্ধতি প্রচলিত ছিল।

ইমলা পদ্ধতি ও মাদরাসা ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক সূচনা ঃ[সম্পাদনা]

চতুর্থ হিজরী শতাব্দী পর্যন্ত মসজিদগুলো ধর্ম ও ইবাদতের পাশাপাশি ইলিম চর্চা ও প্রসারের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। মসজিদে ফকিহদের নিকটেই মানুষ ভিড় জমাতেন বেশি। কারণ, ফিকহের মাধ্যমে যেমন ইসলামের খুঁটিনাটি বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করা যায়, তেমনিভাবে রাষ্ট্রীয় ও সরকারী বিভিন্ন দাযীত্ব গ্রহণ করার ক্ষেত্রেও সহায়ক হয়।

জানা যায় আবু হামেদ বিন মুহাম্মদ আল-ইসফারাঈনী (মৃত্যু ১০১৫ ঈং/৪০৬ হিঃ) হলেন শাফেয়ী মাযহাবের একজনবড় ও বিচক্ষণ ফক্বীহ আলেম। তিনি বাগদাদের আব্দুল্লাহ বিন মুবারক মসজিদে দরস প্রদান বা পাঠচক্র পরিচালনা করতেন। তার দরসে উপস্থিত হতেন ৩০০ থেকে ৭০০ ফক্বীহ।

মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক প্রচলনঃ

হিজরী চতুর্থ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত সকল সমাজ ও এলাকায় মসজিদভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। কিন্তু যখন যুগের পরিবর্তনে শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তৃতি ঘটলো, পাঠদানের নতুন নতুন পদ্ধতি সামনে আসলো, তখন আসলে এর জন্য মসজিদের শিক্ষাব্যবস্থা যথেষ্ট ছিল না। কারণ, ইলিম চর্চার একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ ছিল বিভিন্ন ফিকহী মাসায়েলে পক্ষে বিপক্ষে তর্ক বিতর্ক। তর্ক-বিতর্ক ছাড়া আসলে জ্ঞানগত পরিবেশের বিস্তৃতি ঘটে না। অথচ তর্কবিতর্কের সময় অনেক ক্ষেত্রে ভাষা ও বক্তব্যের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে যায় যা সুস্পষ্ট মসজিদের আদবের বিরোধী। এছাড়া আরো অনেক প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য করে, স্বতন্ত্রভাবে বিভিন্ন দ্বীনি প্রতিষ্ঠান খোলা হতে লাগল হিজরী চতুর্থ শতাব্দী থেকেই।

তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যেত, এসব মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা ও ওয়াকফকারীরা হতেন সাধারণত প্রসিদ্ধ ব্যক্তিরা। কাম্পিয়ান অঞ্চলের বিচারক আব্দুল হামিদ বিন আব্দুল আজিজ ফকিহদের জন্য একটা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ৫৫৭ হিজরীতে তার ইন্তেকালের পর এ মাদরাসার সীমানায়ই তাকে দাফন করা হয়। আইয়্যুবী বংশের রাজকন্যা সুলতান সালাউদ্দিন আইয়ুবির বোন সিত্তুশ শাম যামরাদ খাতুন দামেস্কের আপন বাড়ীটি ওয়াকফ করে দিয়েছিল মাদরাসা তৈরীর জন্য। পরবর্তীতে এটি ফিকহ ও হাদিসের জন্য দামেস্ক শহরের অন্যতম খ্যাতিমান মাদ্রাসায় পরিনত হয়।

নেজামিয়া মাদ্রাসা ঃ (১০৬৫)[সম্পাদনা]

ইসলামের ইতিহাসে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যববস্থায় বাগদাদের নিজামিয়া মাদ্রাসা একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। এটি ছিল ১০৬৫ সালে বাগদাদে প্রতিষ্ঠিত প্রথম নিজামিয়া মাদ্রাসা যেটাকে সমকালীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়। পারস্যের বিখ্যাত কবি শেখ সাদীও এই মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন ১১৯৫ থেকে ১২২৬ সাল পর্যন্ত। এটিই ছিল প্রথম সিলেবাসভিত্তিক মাদ্রাসা। ১০৯১ সাল থেকে এই মাদ্রাসায় দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী (রঃ) শিক্ষকতা করেন। বাদশাহ নিজামুল মুলক ইমাম গাজ্জালিকে নিয়োগ দেন। ইমাম গাজ্জালী (রঃ) ৫ বছর পর ১০৯৬ সালে তাঁর ভাইকে এখানে দিয়ে দিনে মক্কায় হজ্জ করতে চলে যান। হজ্জ থেকে ফিরে এসে তিনি তাঁর বাড়ীর পাশে একটি খানকা এবং সেখানেই পাঠচক্র শুরু করেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এখানে শিক্ষার্জনের জন্য ছাত্ররা আসতেন। বাগদাদের নেজামিয়া মুলতানের ইসলামিয়া মাদ্রাসা এবং হারমাইন শরীফাইনের বিশেষ পাঠচক্র থেকেই উপ মহাদেশের খ্যাতনামা মুসলিম চিন্তাবিদদের সৃষ্টি এবং তাদের মাধ্যমেই গোটা ভারত বর্ষে শিক্ষার মুলধারা বিকশিত হতে থাকে।

শিক্ষাব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতাঃ[সম্পাদনা]

ইতিহাস থেকে যতটা জানা যায়, সর্বপ্রথম নিজামুল মুলক তুসিই শিক্ষকদের জন্য মাসিক ভাতা ও স্টাফদের জন্য মজুরি বরাদ্দ করেছিলেন। এছাড়াও ছাত্রদের সকল প্রকার ভরণপোষণের দায়িত্বও তিনি নিয়েছিলেন। ইবনে খাল্লিকান সেলজুকী মন্ত্রী নিজামুল মুলকের অবদান আলোচনা করতে গিযয় বলেছেন, “তিনি অনেক মাদরাসা, মসজিদ ও লঙ্গরখানা তৈরি করেছেন। তিনিই সর্বপ্রথম তৈরি করেছেন মাদরাসা। পরবর্তীতে তার অনুসরণে অনেক মাদ্রাসা তৈরি হয়েছে। বাগদাদে মাদরাসা প্রতিষ্ঠার কাজ তিনি শুরু করেন ৪৫৭ হিজরীতে।”

নিজামুল মুলক যখন মাদরাসায়ে নেজামিয়া তৈরি করেছিলেন, সেটাই একটা মডেল ও মাদ্রাসা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তিতে যা একটি উন্নত ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে এবং বিশ্বের আনাচে কানাচে থেকে জ্ঞানপিপাসুদের সমাগম ঘটে এখানে। সমরকন্দ-বোখারা সহ  বিশ্বের বরেণ্য ইসলামী চিন্তাবিদদের অনেকেই এখান থেকে লেখাপড়া করেন। এর অনুকরণে অন্যান্য মাদরাসা তৈরি হতে লাগলো।’ মাদরাসার সম্প্রসারণ ও ক্রমাগত বৃদ্ধি ইসলামী সাম্রাজ্যের বিভিন্ন কেন্দ্র ও প্রান্তলোতে একটা মৌলিক বিশাল প্রকল্পে পরিণত হয়েছিল। এজন্যই দামেস্কের ঐতিহাসিক শিহাব উদ্দিন আবু সামা (১২৬৭ ইং/ ৬৬৫ হিঃ) বলেছেন,“নিজামুল মুলক তুসীর মাদরাসাগুলো ইলিম চর্চার ক্ষেত্রে অনেক প্রসিদ্ধ। কোন শহর তার প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা থেকে খালি ছিলনা। এমনকি ইবনে ওমর উপদ্বীপের মত (মসুল) প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অত্যন্ত সুন্দর বিরাট মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই স্থানটি ছিল অত্যন্ত পরিবেশ বান্ধব, নিরিবিলি ও স্বাচ্ছন্দপূর্ণ। এছাড়াা এ স্থানে বসবাস ছিল আসির বংশের। এই বংশ থেকেই অনেক প্রসিদ্ধ আলেমের জন্ম হয়েছে। যেমন, ইজ্জুদ্দীন বিন আসির, জিয়া উদ্দিন বিন আসির, মাজদ-উদ্দিন বিন আসির। প্রত্যেকেই ফিকহ, হাদিস ও ইতিহাসের এক একটি নক্ষত্র। তাদের অধিকাংশেরই উত্থান ষষ্ঠ হিজরীর দ্বিতীয় ভাগে,যেটা ছিল নিজামুল মুলক তুসীর তৈরিকৃত মাদরাসার সুস্পষ্ট প্রভাব।

ভারতীয় উপমহাদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা ঃ[সম্পাদনা]

ঐতিহাসিকদের বিবরণ অনুযায়ী-”ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম মক্তব বা ফোরকানিয়া মাদ্রাসাসমূহ দিল্লী, লখনৌ, মাদ্রাজ,ঢাকা প্রভৃতি প্রধান প্রধান শহর ও বড় বড় গ্রামীণ জনপদে গড়ে ওঠে। সর্বপ্রথম মাদ্রাসার বিল্ডিং নির্মিত হয়েছিল মুলতানে। এর নির্মাতা ছিলেন মোল্লা নাসির উদ্দীন কুবজা এবং এর প্রধান ছিলেন মাওলানা কুতুবুদ্দীন কাশানী। শেখ বাহাউদ্দিন যাকারিয়া মুলতানী (রঃ) ৫৭৮ হিজরি সালে এই মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। সুলতানী আমলে মাদ্রাসার পাঠক্রমে ছিল আরবী ভাষাতত্ব,নাহু সরফ,বালাগাত  মানতিক,কালাম, তাসাউফ, সাহিত্য, ফিকহ এবং দর্শন।

মোল্লা নাসির উদ্দীন ঃ (১২০৩-১২৮৫)[সম্পাদনা]

সাধারণত অধিকাংশ সংস্কৃতিতে উচ্চজ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব বুজাতে "হোজ্জা" এবং "মোল্লা" শব্দটি ব্যবহৃত হয় যা বর্তমান সংস্কৃতিবাদীদের কাছে এর বিপরীত ব্যবহার হয়ে থাকে। জনপ্রীয় দার্শনিক ও ইসলামী জ্ঞানে সমৃদ্ধ একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন নাসির উদ্দীন তাই কাকে হুজ্জা এবং মোল্লা নামেই ডাকতেন।মোল্লা নাসির উদ্দীন কে নিকটতর ও মধ্যপ্রাচ্য এবং মধ্য এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশেই নাসির উদ্দিনকে তাদের দেশের লোক বলে দাবী করে থাকেন। এর মধ্যে রয়েছে আফগানিস্তান, ইরান, তুরস্ক এবং উজবেকিস্তান। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে তার নাম বিভিন্নভাবে উচ্চারিত হয়। তিনি ছিলেন তুর্কি কাজাখ,বসনীয় একজন মধ্যযুগীয় মুসলিম আধ্যাত্মিক সাধক ও পন্ডিত ব্যাক্তিত্ব। মধ্যযুগে আনুমানিক ত্রোয়োদশ শতকে সেলজুক শাসনামলে ইরানের বৃহত্তর খোরাসানে তিনি বসবাস করতেন। একজন খুশমেজাজী গল্পকার ও হিসাবেও তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। চীনে তিনি "আফান্টি" নামে পরিচিত এবং চীনারা তাকে উইগুরের তুর্কী ব্যক্তি বলে মনে করে। তবে আরো অনেক সূত্র মতে ১৩ শতকে বর্তমান তুরস্কের এসকিহির প্রদেশের সিভরিহিসারের হোর্তু গ্রামে নাসির উদ্দীনের জন্মস্থান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরে সেলজুক শাসনের অধীনে কেনিয়াতে বসতি স্থাপন করেন,

ইমাম যাহাবী তার "ميزان الاعتدال في نقد الرجال", এ  তার পুরো নাম "আবু আল-গুসন দুজাইন আল-ফিজারি", বলে উল্লেখ করেছেন।  তিনি কুফায় উমাইয়্যাদের অধীনে থাকতেন, তার মাকে আনাস ইবনে মালিকের চাকর বলা হয়,তাই তিনি সুন্নি ঐতিহ্যের তাবিয়ীনদের একজন ছিলেন। তাঁর সঠিক জন্ম তারিখ জানা না গেলেও একাধিক সূত্র মতে তিনি ১২০৩ খৃষ্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন এবং ১২৭৫ খৃষ্টাব্দে মারা যান। আরেক বর্ণনা মতে তিনি ১২৮৫ সালে মারা যান।

বাংলায় মাদ্রাসা শিক্ষার ইতিহাস ঃ ১২০৪[সম্পাদনা]

বাংলার প্রথম মুসলিম শাসক ইখতিয়ার উদ্দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার রাজধানী গৌড়ে একটি মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। সুলতান গিয়াস উদ্দীন একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন ১২১২ খ্রিষ্টাব্দে। পরবর্তীকালে তাঁর বংশধর সুলতান দ্বিতীয় গিয়াস উদ্দীনও একটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। মাদ্রাসা দুটির নাম যথাক্রমে লাখনুতী ও গৌড় মাদ্রাসা। হোসেন শাহ ও তাঁর পুত্র নুসরত শাহ গৌড়ে বেশ কয়েকটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। এসব মাদ্রাসার অনেকগুলির ধ্বংসাবশেষ এখনও বিদ্যমান।

১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দে সুবাদার শায়েস্তা খানের উদ্যোগে ঢাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে একটি মাদ্রাসা ও মসজিদ নির্মিত হয়। নবাব জাফর মোরশেদ আলী খান স্থাপন করেন মুর্শিদাবাদ মাদ্রাসা। যার ভবনটি কালের সাক্ষী হিসেবে এখনও অটুট রয়েছে। ১১৭৮ হিজরী সালে জমিদার মুন্সি সদর উদ্দীন আল মুসাভী বুহার গ্রামে বর্ধমান মাদ্রাসা স্থাপন করেন এবং লখনৌ থেকে আগত বাহরুলল উলুম মাওলানা আব্দুল আলীকে শিক্ষক নিয়োগ করেন। নবাবী আমলে মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য সরকার এগুলির জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ লাখেরাজ জমি বরাদ্দ দিত। মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের জন্য সরকার ভাতা ও বৃত্তি দিত।

শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) (১৫৫১-১৬৪২)[সম্পাদনা]

ভারতবর্ষের ইসলামী চিন্তাবিদ স্কলার রাজনৈতীক ও শিক্ষাবিদদের তালিকায় যে নাম গুলো অতি পরিচিত ও আলোচিত এবং যাদের ত্যাগ ইতিহাস প্রসিদ্ধ তাদের আরেকজন হলেন  শায়খ আবুল মজিদ আবদুল হক বিন সাইফুদ্দীন দেহলভী বোখারী  প্রতিষ্ঠিত নাম আব্দুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) তিনি ৯৫৮ হিজরী মোতাবেক ১৫৫১ খৃষ্টাব্দে দিল্লীতে জন্ম গ্রহণ করেন। এবং ইলমে কোরআন ও হাদীসের চর্চা ও প্রচারনায় অনবদ্য অবদান রেখে ১০৫২ হিজরী মোতাবেক ১৬৪২ খৃষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। ইসলামী পন্ডিত,ভারতবর্ষে ইসলাম প্রচারক ও হাদীস বিশারদদের তালিকায় তাঁর নাম শীর্ষে রয়েছে। ৯৯৬ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'হেজাজ ' গমন করে সেখানে কয়েক বছর পর্যন্ত হারামাইন শরীফাইনে যুগশ্রেষ্ঠ উলামায়ে কেরামদের সান্নিধ্য লাভ করেন । বিশেষ করে শায়খ আবদুল ওয়াহাব মুত্তাকি,খলিফায়ে শায়খ আলী মুত্তাকি’র সাহচর্য্যের মধ্য দিয়ে তিনি ২২বছর বয়সের মধ্যেই ' ইলমে হাদিস'র পরিপূর্ণ  জ্ঞান অর্জন করেন । প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বা এর কাগুজে সনদের কোন ধারাবাহিকতা এতো বড় ইসলামী পন্ডিতের ছিলনা। কিন্তু আব্দুল হক মোহাদ্দীসে দেহলভীর মতো আরেকজন এই উপমহাদেশে জন্ম নেননি। তাঁর সম্পর্কে  মুফতি আমিমুল ইহসান (রঃ) হাদীস চর্চার ইতিহাস গ্রন্থে লিখেছেন- এই যুগের সবে য়ে বেশি উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব দু'জন।একজন শায়খ আহমদ সেরহিন্দী মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রঃ)। অন্যজন শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ)। শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) সম্পর্কে মুজাদ্দিদে আলফেসানী তার 'মাকতুবাতে' লিখেছেনন যে,হিন্দুস্থানে হাদীস’র বীজ বপন করেন শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ)। তিনি দিল্লিতে দরসে হাদিস বা হাদীসের পাঠচক্র করতেন। সাধারণ লোকদের সুবিধার্থে ফার্সি ভাষায় 'মিশকাত'র একটি আরবী ও একটি ফার্সি ব্যাখ্যাগ্রন্থ লিখেন। এ ছাড়াও তার আরো বেশ কিছু মূল্যবান রচনাবলী আছে। এর মধ্যে- # আশিআতুল লুমআত শরহে মিশকাত # মাদারেজুন নবুওয়্যাত # জুয্বুল কুলুব # আখবারুল আখিয়ার # জুব্দাতুল আসার # মিফতাহুল ফতুহ # মা সাবাতা মিনাস্ সুন্নাহ্ ফি আইয়্যামিস সুন্নাহ্ # রেসালায়ে যারবুল আকদাম # দেওয়ান # মাকতুবাত # তাকমিলুল ইমান (ফার্সি) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভীর (রঃ) অসংখ্য ছাত্র তার নিকট থেকে শিক্ষার্জন করেছেন এবং তারাও এ উপমহাদেশে ইলমে হাদীসের খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন ।

শায়খ নুরুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ)[সম্পাদনা]

শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভীর (রঃ) ইলমে হাদীস চর্চা এর বিকাশের মিশন পূর্ণতা লাভ করে তাঁর ই সুযোগ্য সন্তান শায়খ শায়খ নুরুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভীর মাধ্যমে। তিনিও পিতার মতই ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে ইলমে হাদীস চর্চার সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টি করে বিভিন্ন এলাকায় খানকা ও মসজিদভিত্তিক হাদীসের দারস বা পাঠচক্র গড়ে তুলেন। যেখানে ভারত ছাড়াও আশপাশের বিভিন্ন দেশ থেকে এসে এই সুযোগ গ্রহণ করতেন। তাই বলা যায় ছেলে শায়খ নুরুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভীর এই কীর্তি বস্তুত পিতা  শায়খ আবদুল হক মুহাদ্দীসে দেহলভীর ইলমে হাদীস চর্চার অভিষ্ঠ লক্ষ্যের পূর্ণতার প্রমাণ বহন করে এতে কোন সন্দেহ নাই। তিনি তার পিতা সহ আরো কয়েকজন উস্তাদের কাছ থেকেই ইলমী যোগ্যতা অর্জন করেন। এর বাইরে কোন আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতার কাগুজে সনদ ছিলনা। অথচ তিনিই সহীহ বোখারীর বিশদ ব্যাখ্যা গ্রন্থ ফার্সি ভাষায় রচনা করেন যার নাম'তায়সীরুল বারী'। অনুরূপ সহীহ মুসলিম এর  একটি ব্যাখ্যা গ্রন্থ  'মানবাউল ইলম' নামে ফার্সি ভাষায় রচনা করেন। কাগুজে সনদ আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়া যদি কোরআন হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রহণ যোগ্য না হয় তাহলে এই মহান মনিষীদের লেখা তাফসীর আর হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রন্থ কি ভাবে গ্রহণযোগ্য হয়।

দরসে নেজামির প্রথম মাদ্রাসা কোলকাতা আলীয়া ঃ ১৭৮০ খৃঃ[সম্পাদনা]

ইংরেজ শাসনামলে এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা একটি নতুন মোড় নেয়। মাদ্রাসাগুলোর নামে মুগল সরকারের বরাদ্দকৃত লাখেরাজ জমি বাজেয়াপ্ত করে। ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অনেক মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলার গভর্নর লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বলা হয়ে থাকে যে এই মাদ্রাসাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারের জন্য কিছুসংখ্যক মুসলিম আইন অফিসার তৈরি করা। তবে সরকারের সমর্থন ও অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হবার কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মাদ্রাসা শিক্ষার বিকাশ গতিরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কলকাতা মাদ্রাসা বাংলায় মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারা প্রবর্তন করে। এই মাদ্রাসার প্রথম প্রধান মৌলভী বাহরূল উলুম মোল্লা মজদুদ্দীন দরসে নিজামির পাঠক্রম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সেই আদলে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেন। হেস্টিংস কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে তিনি এই পাঠক্রমে ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেন। বাংলার অধিকাংশ মাদ্রাসা দরসে নিজামির আদলে শিক্ষাদান পরিচালনা করে। এই ব্যবস্থা ১৯৭০ দশক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। দরসে নেজামী পাঠক্রম অনুযায়ী একজন ছাত্রকে ১৭/১৮ বছর বয়সেই আরবী ও ফার্সি ভাষায় লিখিত নির্বাচিত ৯৯টি গ্রন্থের অন্তত একটি পড়ার ও অনুধাবনের যোগ্যতা অর্জন করতে হতো। ধর্মীয় পাঠ্যক্রম ছাড়া এই পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল ইউনানি চিকিৎসা বিদ্যা, কুটির শিল্প ও কারিগরি প্রশিক্ষণ। দরসে নিজামির মোট শিক্ষাকাল ছিল ৯ বছর।

মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রঃ) (১৫৬৪-১৬২৪)[সম্পাদনা]

শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রঃ) ১৫৬৪ সালের ২৬ মে  মোতাবেক ১৪ সাওয়াল ৯৭১ হিজরী পাঞ্জাব প্রদেশের সিরহিন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হিফজুল কোরআন সহ প্রাথমিক শিক্ষার অধিকাংশই তার পিতা আব্দুল আহাদ (রঃ) ও তার ভাই মুহাম্মদ সাদিক (রঃ) এবং মুহাম্মদ তাহির আল-লাহোরির কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এর পরে তিনি শিয়ালকোটে পড়াশোনা করেছিলেন,যেটি কাশ্মীরী-বংশোদ্ভূত পন্ডিত কামাল উদ্দিন কাশ্মীরির তত্বাবধানে পরিচালিত হত। এবং এটিই তখন এতদাঞ্চালের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রস্থল ছিল। সেখানে তিনি যুক্তি, দর্শন এবং ধর্মতত্ব শিখেন এবং কাশ্মীরের আরেক বিজ্ঞ আলেম  ইয়াকুব সারফি কাশ্মীরি (রঃ) (১৫২১-১৫৯৫) এর অধীনে তাফসীর ও হাদীসের উচ্চতর কিতাবগুলো অধ্যায়ন করেন। শায়খ শারফি (রঃ) মীর সাইয়্যিদ আলী হামাদানী (রঃ) এর শায়খ ছিলেন। কাজী বাহলোল বাদখশানী তাকে আইনশাস্ত্র, এবং নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সিরাত  ও ইতিহাস বিষয়ে  শিক্ষা দান করেন। শায়খ আহমদ সিরহিন্দি মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রঃ) মোগল স¤্রাট আকবরের দ্বীনে এলাহির বিরোধিতা করে ফাসির দন্ডাদেশ নিয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন।কারাগারে থেকে আল্লাহর দ্বীনের দুশমনদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুলেন। বাদশাহ আকবরের চেতনা ফিরে আসে এবং দ্বীনে এলাহী নামক কথিত ভ্রান্ত মতবাদ নিষিদ্ধ করে ইসলামী আইনে রাষ্ট্র পরিচালনার নিমিত্তে দেশের ইসলামী আইনজ্ঞদের দিয়ে জগদ্বিখ্যাত ফতোয়া এ আলমগীরি রচনা করান।

বাদশাহ আকবরের দ্বীন ই ইলাহী ঃ১৫৮২[সম্পাদনা]

ষোড়শ (১৫৮২)শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় রেনেসাঁর যুগে মুসলিম শাসক হয়েও বাদশাহ আকবরের নতুন ধর্মনীতি প্রবর্তন ভারতের ইতিহাসে একটি জঘন্যতম ঘটনা। এই সকল ধর্মের সমতা নামক কথিত বাউল ও মরমীবাদ এর সমন্বিত ধর্মীয় মতবাদ দ্বীন ই ইলাহির জন্য আকবরের গৃহশিক্ষক মরমীবাদী আবদুল লতিফ কে দায়ী করা হলেও প্রকৃত কারণটা ছিল রাজনৈতীক। মূলত সম্রাট আকবর জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল ভারতবাসীর আনুগত্য ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা নিয়ে মোঘল স¤্রাজ্য স্থায়ী করতে ১৫৮২খৃষ্টাব্দে ‘দ্বীন-ই ইলাহী’ নামে একটি নতুন ধর্মীয় মতবাদ প্রবর্তন করেন। ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ এর ভাষায়- ঞযব ১৬ঃয পবহঃঁৎু ধিং ধহ ধমব ড়ভ বহয়ঁরৎু ধহ ফড়ঁনঃ ধহফ অশনধৎ ধিং রঃং সড়ংঃ ঢ়বৎভবপঃ ৎবঢ়ৎবংবহঃধঃরাব. বিশেষতঃ আজকের যুগের মতো তখন ধর্ম চর্চার এতোটা ব্যাপকতা দেখা দিয়েছিল যে অধিক চর্চার নামে ধর্মীয় বিষয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হতে চলেছিল। সেই সুযোগে বাতিল ধর্মচিন্তা ও ভ্রষ্টতা মানুষকে ছেয়ে ফেলেছিল। সে যুগে কবির,নানক, শ্রীচৈতন্য, রামানন্দ প্রভৃতি ব্যক্তির ভক্তিবাদ আন্দোলন আকবরের ধর্ম চিন্তাকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করে। সেই সাথে উদার মতাবলম্বী ও কথিত সহিষ্ণু মনােভাবাপন্ন শিয়া আলেম শেখ মুবারক এবং তার দু’পুত্র আবুল ফজল ও ফৈজির পরামর্শে আকবর ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে নতুন ধর্মমত চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভারতের প্রচলিত জৈন ধর্মের ধর্মীয় গুরুদের তোষামোদও যুক্ত ছিল। জানা যায়  বাদশাহ আকবর সত্য সন্ধানে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে ফতেহপুর সিক্রিতে একটি ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সেখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জ্ঞানী পন্ডিতদের আমন্ত্রণ জানান এবং সকল ধর্মের পন্ডিতদের কথা মনযোগ সহকারে শ্রবণ করেন। এভাবে বিভিন্ন ধর্মের মূল বাণী শ্রবণের পর তিনি একটি নতুন ধর্মমত তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন।

পানিপথের যুদ্ধ ঃ১৫২৬[সম্পাদনা]

মুসলিম সালতানাতের যুদ্ধ ইতিহাসের একটি প্রসিদ্ধ নাম হলো পানিপথের যুদ্ধ। ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের পানিপথ নামক স্থানে তিনটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল যে গুলি ইতিহাসে পানিপথ যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই শহরটি ’উইভিং সিটি অফ ইন্ডিয়া ' নামে পরিচিত।

প্রথম যুদ্ধঃ পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৫২৬ সালে মুঘল সম্রাট বাবর ও দিল্লির পরাক্রমশালী সুলতান ইব্রাহিম লোদীর সঙ্গে। এই যুদ্ধে মুঘল স¤্রাট  বিজয়ী হন। এই যুদ্ধে বাবর প্রথম ভারতে কামানের ব্যবহার করে ইব্রাহিম লোদীর লক্ষাধিক সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াাই করেও জয়লাভ করেন। বাদশাহ বাবার এর আসল নাম জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ কিন্তু তিনি বাবর বা বাবুর (সিংহ) নামেই সমধিক পরিচিতি। তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে এশিয়ার সমরখন্দের সিংহাসনে আরোহন করেন এবং অল্প বয়সেই দু'বার সিংহাসন হারান। তারপর তিনি নিজ দেশ ছেড়ে আফগানিস্তানের সিংহাসন অধিকার করেন এবং পরে ভারতের ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে দিল্লি অধিকার করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

২য় যুদ্ধ  সংঘটিত হয় ১৫৫৬ সালে। সম্রাট আকবর বনাম সম্রাট হেম চন্দ্র বিক্রমাদিত্যর (হেমু) সঙ্গে।এ যুদ্ধে মোঘলদের জয় হয়।

তৃতীয় যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ১৭৬১ সালে দুররানি সাম্রাজ্য ও মারাঠা সাম্রাজ্য দ্বয়ের মধ্যে- এতেদুররানি সাম্রাজ্য বিজয়ী হয়। এই বিজয়ের ফলে দুররানি সম্রাজ্য পরবর্তী সময়ে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই যুদ্ধ গুলো সম্পর্কে এখানে উপস্থাপনের কারণ হলো এই পরিস্থিতিতে তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থান কি দশা ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়।

শাহ আব্দুর রহিম (রঃ) (১৬৮৮-১৭১৯)ঃ[সম্পাদনা]

মুসলিম ভারতে যে মাদ্রাসাটি মুসলিম শিক্ষার্থীদের আধারে আলোকবর্তিকা হিসাবে তথা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার দ্বার উম্মুক্ত করে সেটি হলো দিল্লির রহিমিয়া মাদ্রাসা।বাদশাহ আলমগীরের সময়ে রচিত বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী আইন শাস্ত্রের কিতাব ফতোয়া ই আলমগিরীর অন্যতম একজন লেখক শাহ আবদুর রহিম (রঃ) ছিলেন এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ফকীহ আলেম এবং আরব আজমের বিশিষ্ট আলেমদের কাছ থেকে তিনি উচ্চতর জ্ঞান লাভ করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি মুসলিম ভারতে শিক্ষার এক বিশাল গবেষণাগার। যা মুসলিম শিক্ষার্থী ও পরবর্তিতে ইসলামী স্কলারদের গবেষনার সুতিকাগার।বৃটিশ স¤্রাজ্যবাদীরা এটির অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়। শাহ আব্দুর রহিম (রঃ) ছিলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভীর পিতা। মুসলিম ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার ধারায় বাগদাদের নেজামুল মুলক তুসির মাদ্রাসার পর ভারতে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর বিশ্বময়তা তখন ছিল এর মধ্যে পাকিস্তানের (তখনো ভারত) মুলতান ও দিল্লির রহিমিয়াও ছিল অন্যতম।

মাদ্রাসা শিক্ষার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঃ[সম্পাদনা]

তবে মাদরাসাগুলো সাধারণত মাধ্যমিক,উচ্চমাধ্যমিক, উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র ছিল। প্রাথমিক শিক্ষা ও মক্তবব্যবস্থা মসজিদের সাথে ওৎপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। মসজিদকেন্দ্রিকই প্রচলিত ছিল প্রাথমিক শিক্ষাধারা। মসজিদ থেকে শিক্ষাব্যবস্থাকে পৃথক করে ফেলার হেতু যেমনিভাবে ধর্মীয় (আদব রক্ষা) ও সংস্কৃতিগত (শিক্ষার বিস্তৃতি) ছিল, তেমনিভাবে রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত কারণও এখানে কার্যকর ছিল। দেখা যেত, বিভিন্ন মাযহাব ও আকিদার আলাদা আলাদা মাদরাসা তৈরি হচ্ছে, তেমনিভাবে রাজনৈতিক নেতারাও নিজস্ব চিন্তার বিদ্যাকানন হিসেবে মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতেন।

তৃতীয় ও চতুর্থ হিজরী শতাব্দীতে আকার ও কাঠামোগত দিক থেকে মাদরাসার বিবর্তন ঘটে। পাঠদানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় ব্যাকরণ, ছরফ বা শব্দতত্ব, অলঙ্কার, সাহিত্য, যুক্তি এবং গণিত। শিক্ষার ক্ষেত্রে যতটা না গ্রন্থ থেকে শেখা হত, তার চেয়ে বেশি শিক্ষকের আলোচনা ও বক্তব্যের উপর জোর দেয়া হতো। এছাড়া দূর-দূরান্তের ইলমি সফরের ক্ষেত্রে ছাত্রদের জন্য পথে পথে থাকা খাওয়ার উন্নত ব্যবস্থা থাকতো।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) (১৭০৩-১৭৬২)[সম্পাদনা]

ইলমে হাদীসের চর্চা ও এর বিকাশে মুসলিম ভারতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে যাদের নাম প্রথম সারিতে আসে  তাদের মধ্যে হলেন মুসলিম দার্শনিক শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)। ভারতবর্ষে ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী শিক্ষা বিস্তার বলুন এর প্রেরণার বাতিঘর বলে যাকে সকলেই সমীহ করেন এবং ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারা বলে তৃপ্তি লাভ করেন তিনিই হলেন ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)। তাঁর পূর্ণ নাম কুতুবউদ্দিন আহমেদ ইবনে আবদুর রহিম। কিন্তু তিনি শাহ ওয়ালিউল্লাহ নামেই খ্যাতি লাভ করেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) ভারতের মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষ মুহূর্তে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুজফফর নগরের ফুলাত শহরে ২১ ফেব্রæয়ারী ১৭০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন (তাঁর জন্মের চার বছর পরে, আওরঙ্গজেব মারা যান)। তাঁর জন্ম নাম ছিল কুতুবউদ্দীন।


শিক্ষা জীবনঃ

চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রঃ) তাঁর দাদার কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখন শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইসলামী শিক্ষার সাথে পরিচয় হয়। দুই বছর পরে তিনি পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতে পারেন।এই সময়ে তিনি তাফসীর, হাদিস, আধ্যাত্মিকতা, রহস্যবাদ,অধিবিদ্যা,যুক্তি এবং ইলম-উল-কালাম সম্পর্কেও জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।এরপর ফারসি ও আরবি ভাষার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে তিনি এক বছরে তার পাঠ শেষ করতে সক্ষম হন। এর পরে তিনি ব্যাকরণ এবং বাক্য গঠনে মনোনিবেশ করেন। সর্বোপরি তিনি চিকিৎসা নিয়েও পড়াশোনা করেছিলেন। ১৭৩০ সালে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রঃ) আরবে উচ্চতর পড়াাশোনা শুরু করেন। তিনি মক্কা এবং মদীনায় নামকরা দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশােনা করেছিলেন, যেখানে তিনি একজন স্বনামধন্য আলেম হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সব মিলিয়ে তিনি ১৪ বছর মদীনায় পড়াশোনা করেছিলেন, যেখানে তিনি হাদীসে তাঁর সনদ অর্জন করেছিলেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) কেবল আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতির গভীর উপলব্ধিই রাখতেননা বরং তিনি অর্থনীতির গভীর প্রভাবও স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি ছিলেন ভারতীয় মুসলিম ধর্মীয় নেতা এবং প্রভাবশালী ইসলামি সংস্কারক।যিনি এশিয়ার মুসলিম সমাজকে নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) ছিলেন হানাফী মাজহাবের অনুসারী একজন পনিডত ও লেখক গবেষক। তিনি ৫১টি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। পিতার ইন্তেকালের পর তিনি রহিমিয়া মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার আমলেই মাদ্রাসা ই রহিমিয়া এতদাঞ্চলের ইসলামী স্কলারদের জ্ঞানার্জনের এক সূতিকাগারে পরিণত হয়।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভীর মিশন ঃ[সম্পাদনা]

ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সমাজ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে বিশৃঙ্খলায় ছিল। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) সমস্যার কারণ চিহ্নিত করে যথাযথ প্রতিকারের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি মুসলিম সমাজে একীভূত হয়ে ওঠা এমন অনৈসলামিক রীতিনীতি সম্পর্কে সমালোচনা করেছিলেন,বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা মুসলিম সমাজে হিন্দু ধর্মের সংস্পর্শে থাকার কারণে এসেছিল। বিশেষত,তিনি অযৌক্তিক বিবাহ অনুষ্ঠানএবং উৎসবগুলির নিন্দা করেছিলেন।এছাড়াও, তিনি মুসলিম সমাজে অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের কারণগুলি নির্ধারণ করেছিলেন এবং সম্পদের বৃহত্তর বন্টন সহ যথাযথ পরিবর্তনগুলির প্রস্তাব করেছিলেন। এটি এমন একটি ধারণা যা কার্ল মার্ক্সের অর্থনৈতিক তত্বগুলির পূর্বাভাস করেছিল যিনি উনিশ শতকের দার্শনিক এবং অর্থনীতিবিদ। তিনি পুঁজিবাদকে অবজ্ঞা করেছিলেন এবং সাম্যবাদের পিতা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।


কোরআনকে সহজবোধ্য করতে প্রথম ফার্সি অনুবাদ ও ব্যাখ্যা ঃ[সম্পাদনা]

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) রাজনীতি,অর্থনীতি,সমাজনীতি,রাষ্ট্র নীতি নিয়ে শুধু তার দার্শনিক উপস্থাপনে সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি এতদাঞ্চলীয় মুসলমানদের মধ্যে কোরআনকে সহজবোধ্য করার জন্য এর ফার্সি অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাও করেন। কারণ তখন এতদাঞ্চলের মানুষের সাধারণ ভাষা ছিল ফার্সী। শাহ ওয়ালিউল্লাহ কেবল আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতির গভীর উপলব্ধিই রাখেননি,তিনি অর্থনীতির গভীর প্রভাবও স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি যা দেখেছিলেন তার উপর ভিত্তি করে তিনি আর্থসামাজিক ভারসাম্য ধারণার প্রচার করেছিলেন এবং ধন-সম্পদের সঞ্চারকে অবহেলা করেছিলেন। এবং এটিকে মূলতঃ বিশ্বের সমস্ত অশুভের প্রবাদকূপ হিসাবে দেখেন। অধিকন্তু তিনি এমন একটি সামাজিক শৃঙ্খলার পক্ষে ছিলেন যা সাম্য, ভ্রাতৃত্ব এবং ভ্রাতৃত্বের ইসলামি নীতিগুলিকে মেনে চলে।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর রচনা ঃ[সম্পাদনা]

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভীর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা হলো ‘হুজ্জাতুল্লাহ-ইল-বালিগাহ’। রচনাটির একটি অধ্যায়ে তিনি পুঁজিবাদের কুফল সম্পর্কে বর্ণনা করেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী) (রঃ)বিশ্বাস করতেন যে, রোমান ও সাসানিয়া সাম্রাজ্যের পতনের কারণ ছিল অর্থনীতি ও সমাজতত্ব সম্পর্কিত তার অনেক তত্বই এখন বিপ্লবী হিসাবে বিবেচিত। শাহ ওয়ালিউল্লাহকে কার্ল মার্ক্সের (কধৎষ গধৎী) অগ্রদূত হিসাবে বিবেচিত করা হয়।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) দেখছিলেন  দরিদ্রদের শোষণের নমুনা। দরিদ্রদের শোষণ করাকে তিনি রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের রূপক হিসাবে দেখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিপ্লব হবে শান্তিপূর্ণ ও বৌদ্ধিক প্রকৃতির। তিনি শান্তিপূর্ণ এবং বৌদ্ধিক বিপ্লবের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রঃ) রচিত আরেকটি বই হলো ‘ইজালাতুল-খিফা।শাহ ওয়ালিউল্লাহ’র রাজনৈতিক বিপ্লব সম্পর্কে যে ভাবধারা লালন করতেন তা পুরোপুরি বর্ণনা করা হয় এই রচনায়। মুসলিম সমাজের জন্য তার আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি এমন ছিল যে, সাধারণ মানুষ নিজেদের বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকবে এবং এর শাসকরা তাদের সিদ্ধান্ত গুলো নিবেন পবিত্র কুরআনের উপর ভিত্তি করে। বইটিতে তিনি মুঘল শাসক এবং ভারতের বিলাসিতাপ্রিয় অলস ধনী ব্যক্তিদের সমালোচনা করেছিলেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) তার মিশন বাস্তবায়নে থাকাকালেই  ২০আগস্ট, ১৭৬২ ঈসায়ী ইন্তেকাল করেন।

দেহলভী চিন্তাধারার সফল রূপকার মহান সংস্কারক সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ)[সম্পাদনা]

মাওলানা সায়িদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) এর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বিশেষতঃ তাঁর শিক্ষার্জনের উচ্চাকাঙ্খা গবেষণা ও সমাজসংস্কারের চিন্তা ভাবনায় কোরআনের সহজবোধ্য উপস্থাপনের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারে বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থা অবলম্বন। বিশেষতঃ সমকালীন বিশ্বে প্রচলিত ভ্রান্ত রাজনীতি সমাজনীতি,অর্থনীতি মুসলিম সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছিল দেখে মাওলানা মাওদুদী  ঈমানী চেতনায় ব্যাকুল হলেও বিচলিত বা নিরাশ হননি। আশায় বুক বেধে আল্লাহর উপর ভরসা করেই তাফহীমুল কোরআন লেখেন। রাসাঈল ও মাসায়েল লেখেন,তাফহীমাত লেখেন,আল জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ সহ এক বিশাল সাহিত্য ভান্ডার। সেই সাথে ময়দানী আন্দোলন জোরদার করতে প্রতিষ্ঠা করেন জামায়াতে ইসলামী নামক এবটি সংস্কার আন্দোলন যার গন্তব্য ইক্বামতে দ্বীন আর উদ্দেশ্য আল্লাহর রেজামন্দি। এ জন্যই নিঃসঙ্কুচ বলা যায় যে মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী রঃ এর সংস্কার আন্দোলন ছিল শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর সংস্কার আন্দোলনের ই ধারাবাহিকতা।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ঃ[সম্পাদনা]

ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার জন্য ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয় জয়েন্ট-স্টক কোম্পানি বা "ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি"। ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাণী প্রথম এলিজাবেথ এই কোম্পানিকে ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার রাজকীয় সনদ প্রদান করেছিলেন। এ সনদ কোম্পানিটিকে ১৫ বছর পর্যন্ত পূর্ব ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্য করার প্রাধিকার অর্পণ করেছিল। তবে পরবর্তীকালে এ কোম্পানি ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং ১৮৫৮ সালে বিলুপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছিল। অত:পর ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারত শাসন শুরু করে।

মীর জাফর পুরো নাম সৈয়দ মীর জাফর আলী (১৬৯১-১৭৬৫) সমগ্র উপমহাদেশে ব্রিটিশ সম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ভূতপূর্ব নবাব সিরাজউদ্দৌলা নদীয়ার পলাশীর কাছে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। মীর জাফর ছিলেন উক্ত যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এবং প্রধান বিশ্বাসঘাতক। ইসলামের ইতিহাসে এজিদের নামের পরেই ভারতবর্ষের মোসলমানদের কাছে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যে নামটি ঘৃণাভরেই নেয়া হয়।

পলাশীর যুদ্ধঃ (১৭৫৭)[সম্পাদনা]

১৭৫৭ সালের  ভারতবর্ষের রাজনীতির একটি বেদনাদায়ক দিন। এই দিন পলাশির আ¤্রকাণনে মুসলিম সুলতানাতের পতন ঘটে স¤্রাজ্যবাদী বৃটিশ ও তাদের দোসর বিশ্বাস ঘাতক মীরজাফর আলী ও ঘষেটি বেগমদের ষড়যন্ত্রে সম্মুখ সমরে। ঐতিহাসিক বিবরণ অনুযায়ী- ১৭৫৭ সালের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জুন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করল না। নবাব বুঝতে পারলেন, সেনাপতিরাও  সিরাজুদ্দৌলার পতনের এ ষড়যন্ত্রে শামিল। এর পরও নবাব সিরাজুদ্দৌলা মীরজাফরআলীকে ক্ষমা করে দিয়ে নতুন শপথ করিয়ে আবার যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেন। আল্লাহর কালাম কোরআন মজিদ স্পর্শ করে শপথ নিয়ে মীরজাফর আলী পলাশির আমবাগান জমায়েত ইংরেজবাহিনীর সাথে যুদ্ধ না করে পিছু হঠেযায়। নবাব বাহিনীর আক্রমনে ক্লাইব বাহিনী পিছু হটে আম বাগানে আত্মগোপন করে। মীরমদন সহ অন্যরা আক্রমন জোরদার করলে ক্লাইব বাহিনী বিচলিত হয়ে পড়ে। এ সময় আক্রমন জোরদার না করে মীরজাফর তার বাহিনীকে নিয়ে ফিরে আসে যুদ্ধ বিরতী ঘোষণা করে। এ সময় মীর মদন গোলার আঘাতে নিহত হলে ক্লাইব বাহিনী নবাবের ছাউনিতে আক্রমণ করে তা দখল করে নেয়। নবাব রাজধানী রক্ষার তাগীদে মুর্শিদাবাদের দিকে রওয়ানা দিলেও মীরজাফর এই পথে না গিয়ে রাজধানী সুরক্ষা না করে রাজধানীতে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নেয়। নবাবকে বন্দী করার সংকল্প নিয়ে গেলে নবাব কে পাওয়া যায়নি। এ দিকে নবাববের নৌকা নাজিমপুরের ভাটায় চরে আটকা পড়ে গেলে তিনি আর অগ্রসর হতে পারেননি। ৪ জুলাই (মতান্তরে ৩রা জুলাই) বাজারে খাদ্য কিনতে গেলে মীর জাফরের গোয়েন্দারা তাকে ধরিয়ে দেয়। মীরজাফরের আদেশে তার পুত্র মিরনের তত্ত্বাবধানে মুহম্মদীবেগ নামের এক ঘাতক সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করে। কথিত আছে, সিরাজের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে তাকে কবর দেয়া হয়।

এর আগে মুর্শিদকুলী খানের জামাতা সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খান ১৭২৭ থেকে ১৭৩৯ পর্যন্ত সুবাহ বাংলার নবাব হিসেবে মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলা শাসন করছিলেন। এক দুর্যোগময় পরিস্থিতিতেই আলিবর্দি খাঁ ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। চারদিকে শুরু হয় প্রচন্ড অরাজকতা এবং ষড়যন্ত্র। ইংরেজরা নবাবের অনুমতি না নিয়েই কলকাতায় দুর্গ সংস্কার করা শুরু করে। রাজবল্লভ ঘসেটি বেগমকে সহায়তা করার জন্য পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে ঢাকার রাজকোষের সম্পূর্ণ অর্থসহ কলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পাঠান। এ রকম পরিস্থিতিতেই ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল শাহ কুলি খান মির্জা মোহাম্মদ হায়বৎ জং বাহাদুর ওরফে সিরাজ-উদ-দৌলা  বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করেন।

বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর (১৬৯১- ১৭৬৫)[সম্পাদনা]

ইতিহাসে মীর জাফর একটি ঘৃণিত নাম বিশ্ববিখ্যাত বিশ্বসঘাতক হওয়ার কারণে। মীর জাফর এর পুরো নাম সৈয়দ মীর জাফর আলী খান (১৬৯১- ১৭৬৫)। বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশে মীর জাফর নামটি বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুর্শিদাবাদের তার বাড়িটি নিমক হারাম দেউরি (বিশ্বাসঘাতকের ঘর) নামে পরিচিত। মীরজাফর এতটাই বিশ্বাসঘাতক ছিল যে এখনও কেউ অবিশ্বাসী হলে তাকে মীরজাফরের সাথে তুলনা করা হয়।বিশ্বাস ঘাতকতা করে পলাশির আ¤্রকাণনে নবাব বাহিনীর সেনাপ্রধান হয়েও সৈন্য পরিচালনা না করে শিবিরে ফিরিয়ে এনে নবাবী দখল করতে চায়। ইংরেজদের সাথে মীর জাফরের এই মর্মে একটি চুক্তি ছিল যে, যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হলে মীর জাফর হবে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব হবে। তার অধীনের সৈন্যবাহিনী যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা ও তার বাংলা-বিরোধী পদক্ষেপের জন্য বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজয় বরণ ও নির্মম ভাবে নিহত হতে হয়। বিনিময়ে মীর জাফর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে পাঁচ লক্ষ পাউন্ড ও কলকাতায় বসবাসকারী ইউরোপীয়দের আড়াাই লক্ষ পাউন্ড প্রদান করবে। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত সিংহাসনচ্যুত ও নিহত হলে মীর জাফর বাংলার নবাব হয় বটে কিন্তু ব্রিটিশদের দাবীকৃত বিপুল অর্থের যোগান দিতে সে সমর্থ হয়নি। ১৭৫৮ সালে রবার্ট ক্লাইভ তার প্রতিনিধি খোজা ওয়াজিদের মাধ্যমে জানতে পারে যে, মীর জাফর চিনশুরায় ওলন্দাজদের সাথে একটি চুক্তি করেছে। হুগলি নদীতে ওলন্দাজ জাহাজের আনাগোনা দেখতে পাওয় যায়। এসব কিছু চুঁড়ান্ত যুদ্ধের পটভূমি সৃষ্টি করে।

ব্রিটিশ কর্মকর্তা হেনরী ভেন্সিটার্ট মীর জাফরের কাজে সহায়তা করার জন্য তার জামাতা মীর কাশিমকে বাংলার সহকারী সুবাদার নিয়োগ করার জন্য প্রস্তাব করেন। ১৭৬০ সালে কোম্পানি মীর জাফরকে মীর কাশিমের নিকট ক্ষমতা অর্পণ করতে বাধ্য করে। মীর কাশিম ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা ব্যক্তি এবং তিনি বাংলাকে স্বাধীনভাবে শাসন করার ইচ্ছা পোষণ করতেন। এ নিয়ে ইংরেজদের সাথে তার দ্বন্ধ শুরু হয় এবং ১৭৬৩ সালে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে পুনরায় মীর জাফরকে নবাব করা হয়। ক্ষমতাচ্যুত নবাব এই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। তিনি কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। মীর জাফর ১৭৬৫ সালের ৫ ফেব্রæয়ারী তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জাফরগঞ্জ কবরস্থানে তার সমাধি আছে।

শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) ১৭৪৬- ১৮২৪)[সম্পাদনা]

শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভীর (রঃ) জ্যাষ্ঠপুত্র।১১ অক্টোবর ১৭৪৬ ঈসায়ী মোতাবেক ২৫ রমজান ১১৫৯ হিজরী সনে মুঘল সম্রাট মুহাম্মাদ শাহের (১৭১৯-১৭৪৮) শাসনামলে দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। দিল্লী ছিল তখন মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। তার পিতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ যখন মারা যান তিনি তখন মাত্র ১৭ বছরের যুবক। রহিমিয়া মাদ্রায় পিতার তত্বাবধানেই তাঁর লেখাপড়া। পিতার মৃত্যুর পর তিনি হাদীসের শিক্ষক হিসেবে পিতার উত্তরাধিকারী হন এবং পরবর্তীকালে দিল্লির বিখ্যাত মুহাদ্দীসে পরিণত হন। তিনি একাধারে মুহাদ্দিস, মুফাসসির এবং মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক ছিলেন। তিনিই পিতার আদলে কোরআনকে মানুষের কাজে সহজবোধ্য করে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে ফার্সি ভাষায় তাফসীরে আজিজিয়া বা ফাতহুল আজিজ নামে একটি তাফসীর লিখেন। এ ছাড়াও বিখ্যাত ফতোয়া এ আজিজিয়াও তাঁর অমর কীর্তি। তার ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেনÑ

# মাওলানা সৈয়দ শাহ আলে রাসুল মারহারাভী কাদেরী # সায়্যিদ আহমাদ শহীদ # শাহ ইসমাইল শহীদ # মাওলানা হাইদার আলি, ফাইজাবাদ # গুলাম আলী দিহলাবী # মাওলানা ফজলে হক খাইরাবাদী # মাওলানা মাহবুব আলী দেহলভী # মুফতি সদরুদ্দীন আজুরদাহ # মাওলানা মুহাম্মাদ আলী # মাওলানা আহমাদ আলী # মাওলানা কারামাতুল্লাহ মুহাদ্দিস আলিপুরী।

দারুল হারব ঘোষণা[সম্পাদনা]

শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) বৃটিশ শাসিত ভারতকে দারুল হারব ঘোষণা করে মোসলমানদের বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে উদ্ভুদ্ধ করেন। আর তখন থেকেই মোসলমানরা স্বশস্ত্র জেহাদে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। বৃটিশ বেনিয়ারা বে পরোয়া ভাবে মোসলমান বিশেষত আলেম উলামাদের গণহারে হত্যকরে সকল মসজিদ মাদ্রাসা জ্বালিয়ে দিতে থাকে। মোসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ আলকোরআন আল্লাহর কালামের সকল মুদ্রণকপি পুড়িয়ে দিতে থাকে। আর এ ভাবেই  ভারতবর্ষ কে ইসলাম ও মোসলমান মুক্ত করতে বৃটিশরা একর পর এক গণহত্যা চালাতে থাকে।

শাহ ইসমাইল শহীদ (রঃ) (১৭৭৯ -১৮৩১)[সম্পাদনা]

শাহ ইসমাইল শহীদ ছিলেন একজন ভারতীয় ইসলামী পন্ডিত। উনিশ শতকে পাঞ্জাবের শিখ রাজ্যের বিরুদ্ধে সৈয়দ আহমদ বেরলভির ডাক দেয়া জেহাদের তিনি একজন যোদ্ধা ছিলেন। তিনি আহলে হাদিস,তাবলগী জামায়াত এবং দেওবন্দীদের কাছেও সন্মানিত ব্যাক্তিত্ব। শাহ মুহাম্মদ ইসমাইল ছিলেন শাহ আবদুল গনি মুহাদ্দীসে দেহলভীর একমাত্র পুত্র ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর নাতি। শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ রফিউদ্দিন মুহাদ্দিসে দেহলভী ও শাহ আবদুল কাদির মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ) তার চাচা ছিলেন।শাহ ইসমাইল দেহলভী (রঃ) ২৬ এপ্রিল ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দ জন্মগ্রহণ করেন।  প্রচলিত কিছু সূফি কর্মকান্ডের জবাবে তিনি “তাকবিয়াতুল ঈমান” নামক গ্রন্থ রচনা করেন। তবে তিনি নিজেও তাসাউফ পন্থি হওয়া সত্বেও প্রচলিত সুফিবাদের মধ্যকার কু সংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি এটি লিখেছিলেন। তিনি সৈয়দ আহমদ শহীদের অনুসারী ছিলেন। সৈয়দ আহমদ শহীদ ও শহীদ ইসমাইল শহীদ তাদের সঙ্গী মুজাহিদ, বালাকোটের ৬টি সোয়াতি গোত্র ও কাঘানের সৈয়দদের সহায়তায় বেশ কিছু বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ও শিখদের বিরুদ্ধে লড়াাই করেন।  ১৮৩১ সালের ৬ মে সৈয়দ আহমদ শহীদ ও শাহ ইসমাইল শহীদ কয়েক’শ অনুসারী বালাকোটের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তাদেরকে বালাকোটে দাফন করা হয়। তবে সৈয়দ আহমদ শহীদের মৃতদেহ খুজে পাওয়া যায়নি বলেই তার সমাধি কোথায় তা নিশ্চিতে বলা যায়না।

সৈয়দ আহমদ বেরেলভি (রঃ) (১৭৮৬-১৮৩১)[সম্পাদনা]

সৈয়দ আহমদ বেরেলভি (রঃ) ১৭৮৬ সালের ২৯ নভেম্বর উত্তর প্রদেশের রায় বেরেলিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮০৪ সালে দিল্লি গিয়ে শাহ আবদুল কাদির মুহাদ্দীসে দেহলভীর (রঃ) কাছে আরবি-ফারসি ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করে নবাব আমির খানের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।কিন্তু কয়েক বছর পর আমির খান ইংরেজদের সাথে সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ হওয়ায় তিনি শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দীসে দেহলভীর খেদমতে হাজির হন। তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় অনেক উচ্চশিখরে আরোহণ করেছিলেন। শাহ আব্দুল আজিজ (রঃ) এর ভ্রাতুষ্পুত্র শাহ ইসমাইল ও জামাতা মাওলানা আবদুল হাই তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। তার দাওয়াতে প্রায় ৪০ হাজার হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ইসলাম গ্রহণ করেন। ১৮২২ সালে তিনি ৭৫৩ জন যাত্রী নিয়ে পবিত্র মক্কা নগরীতে যান। হজ করে ১৮২৪ সালে রায় বেরেলি ফিরে আসেন।  মুসলিম সমাজে যেসব কুসংস্কার, গোঁড়ামি, অনৈসলামিক রীতি-রেওয়াজ ঢুকে পড়েছিল; সেগুলো দূর করে ইসলামি রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন। সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় স্থানীয় শাসক, সরদার ও সাধারণ জনতা তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ৯০০ মুজাহিদ একটি বৃহৎ শিখবাহিনীকে পরাজিত করেন। এতে মুজাহিদ বাহিনীর প্রভাব চার পাশে ছড়িয়ে পড়ে। দিন কাটত তাদের যুদ্ধের ময়দানে আর রাত কাটত জায়নামাজে। কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন। সর্বদাই তারা একমাত্র আল্লাহর ওপরই নির্ভর করতেন। বলা হয়ে থাকে বালাকুটের চেতনায় উজ্জীবিত মুসলিমদের বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্বে নিয়ে । অবশেষে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। অথচ উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনদানকারী এ মহান শহীদেরা আজো উপেক্ষিত।


ঐতিহাসিক বালাকোট যুদ্ধ ১৮৩১[সম্পাদনা]

১৮৩১ সালের ৬ মে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বালাকোট প্রান্তরে শাহাদতবরণ করেন সৈয়দ আহমদ বেরেলভি ও শাহ ইসমাইল শহীদ সহ ১৩৫ জন মুজাহিদ। মুসলিম বাহিনীর পক্ষে ছিলেন মাত্র ৯০০ মুজাহিদ,অন্য পক্ষে ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও প্রশিক্ষিত ২০ হাজারের বিশাল শিখ সৈন্য বাহিনী এবং স্থানীয় বিশ্বাসঘাতক চক্র। বালাকোট যুদ্ধের প্রধান ছিলেন সৈয়দ আহমদ বেরেলভি (রঃ)।

বালাকোটের যুদ্ধ পর্যন্ত ১১টির অধিক যুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনী শত্রæর মোকাবেলা করেছিলেন। মুসলিম বাহিনী ৩০ হাজার শিখ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করে। প্রায় এক লাখ স্থানীয় মুজাহিদ সাইয়েদ আহমদের পতাকাতলে সমবেত হন। কিন্তু শিখ সেনাপতি বুধ সিংহের প্রলোভনে পেশোয়ারের সরদারেরা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। তারা সাইয়েদ আহমদকে বিষপানের মাধ্যমে হত্যা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। সম্মুখসমরেও তারা শিখদের সাথে যোগ দেয়। ফলে মুজাহিদ বাহিনী পরাজিত হয়। সৈয়দ আহমদ বেরেলভি আন্দোলনের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল এ উপমহাদেশকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করা। তাদের পথ ধরেই স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছেন উপমহাদেশের মানুষ।

ভারত থেকে ব্রিটিশ বেনিয়াদেরকে খেদিয়ে এখানে ইসলামি হুকুমাত কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে-নিয়ে ছোটবেলা থেকেই ভাবতেন সৈয়দ আহমদ বেরেলভী (রঃ) । ছোটবেলা থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন রণকৌশলে পারদর্শী একজন দক্ষ যোদ্ধা। বড় হবার পর শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভির সাহচার্যপ্রাপ্ত হয়ে তাঁর সেই চেতনাকে আরও ঝালিয়ে নেন। তরিকায়ে মুহাম্মদিয়া আন্দোলন যখন সাড়া ফেলে দিলো সমগ্র ভারত জুড়ে, সাইয়িদ আহমদ শহিদ তখন তাঁর চূড়ান্ত চিন্তার কথা ভাবলেন। এ দেশকে বিদেশি বেনিয়াদের দখলদারি থেকে মুক্ত করে এখানে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে হবে।এই চিন্তা থেকে তাঁর একান্ত অনুসারীদের নিয়ে সাহসী তেজোদ্দীপ্ত এবং জানবাজ একটি মুজাহিদ বাহিনী তৈরি করেন। যাঁরা ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকত। সৈয়দ আহমাদ বেরেলভী (রঃ) তৎকালীন ভারতের অভ্যন্তরে তাঁর যুদ্ধ পরিচালনার কেন্দ্র স্থাপন করেননি,এটা তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতারই পরিচায়ক। বরং তিনি তাঁর জিহাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রচারসহ বিভিন্ন স্থানে সফর করে এবং যুদ্ধকেন্দ্র হিসাবে আফগানিস্তানকে মনোনীত করে অবশেষে তথায় পৌঁছে যান। সঙ্গে নিয়ে যান তাঁর জানবাজ মুজাহিদ বাহিনী, সেখানেও যাবার পর স্থানীয়রাও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুজাহিদ বাহিনীতে নাম লেখায়। আফগানিস্তানের কান্দাহার, কাবুল অতিক্রম করে জানবাজ এ মুজাহিদ কাফেলা নিয়ে সাইয়িদ আহমদ খেশগিতে উপস্থিত হন এবং সেখান থেকে ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৮২৬ নওশহরে অবস্থান গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি অত্যাচারী শিখ রাজা বুখ্য সিং-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রথমে কর বা জিজিয়া প্রদানের প্রস্তাব দেন। এরপরই একজন সংবাদবাহক এসে খবর দেয় যে, বুখ্য সিং সৈন্য নিয়ে আকুতভয় প্রবেশ করেছে। একথা শুনে সকলকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। মুসলিম বাহিনীর নৈশকালীন অতর্কিত হামলায় সাত,শ শিখ সেনা নিহত হয় এবং মুসলমানদের পক্ষে ৩৬ জন ভারতীয় ও ৪৫ জন কান্দাহারী মুজাহিদ নিহত হন এবং আরও ৩০/৪০ জন আহত হন। এই যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়েই মুসলমানদের সাহস, আগ্রহ-উদ্দীপনা শতগুণে বেড়ে যায়। কান্দাহার পেশোয়ারের বড় একটি অংশ জুড়ে সৈয়দ আহমদ শহিদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামী হুকুমত।

ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঃ ১৮৩১[সম্পাদনা]

পেশওয়ার থেকে পাঞ্জতার আসার পর স্থানীয় সর্দারগণ সৈয়দ সাহেবকে অভ্যর্থনা জানান এবং তাঁর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। পাঞ্জতার ও তার পার্শ্ববর্তী বিরাট এলাকায় মুসলিম জনবসতি ছিল। সৈয়দ সাহেব বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সর্দারদেরকে সাধারণ বাইয়াত না করিয়ে শরীয়তের বাইয়াত করালেন এবং বললেন, এ এলাকার সব অধিবাসী মুসলমান। এখানে নির্বিঘেœ শরীয়তের হুকুম চালু করা যায়। আপনারা যদি এ এলাকায় শরীয়তের আইন চালু করেন, তাহলে আমি এখানে থাকবো। আর না হয় অন্যত্র চলে যাবো। সৈয়দ সাহেবের এই শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১২৪৪ হিজরীর পহেলা শাবান পাঞ্জতারে আলেম ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের এক সভা আহবান করা হয়। সভায় সীমান্তের খান ও আমীরগণ চাড়াও প্রায় দুহাজার আলেম উপস্থিত হন। যীদার আশরাফ খান এবং হান্ডের খাবে খানও এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। অত্র এলাকায় শরীয়তের আইন চালু করার ব্যাপারে এ সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জুমার নামাজের পর সকল খান, আমীর ও আলেমগণ সৈয়দ সাহেবের নিকট শরীয়তের বাইয়াত গ্রহণ করেন। বাইয়াত গ্রহণের সময় লিখিত শপথ নামা পাঠ করানো হয়। শপথ নামায় ছিল-

(১) শরীয়তের বিধি বিধান মেনে চলার প্রতিশ্রæতিতে স্বেচ্ছায় সৈয়দ সাহেবকে ঈমাম মনোনীত করে তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলাম।

(২) এ এলাকায় শরীয়ত বিরোধী কাজ বন্ধ করে শরীয়তের হুকুম প্রতিষ্ঠা করবো।

(৩) ইমাম মনোনীত করার পর তার বিরোধিতা করা সাংঘাতিক অপরাধ। বিরোধিতার সীমা অতিক্রম করলে তার মোকাবিলায় অস্ত্র ধারণ সকল মুসলমানের উপর ফরজ। এতে শরীয়ত প্রতিষ্ঠাকারী কেউ মারা গেলে শহীদ, শরীয়ত বিরোধী কেউ মরা গেলে পাপী এবং দোযখী বলে গণ্য করা হবে।

(৪) ইতোপূর্বেও আমরা বাইয়াত গ্রহণ করেছি। আজ আলেমদের সম্মুখে নতুন করে বাইয়াত গ্রহণ করলাম। সৈয়দ সাহেব আমাদের জন্য দোয়া করবেন, যেন আমাদের মরা বাঁচা শুধুমাত্র ইসলামের জন্য হয়।

এই ঐতিহাসিক বাইয়াতের পর সীমান্তের বিরাট এলাকায় ইসলামী শরীয়ত চালু হয়। ক্ষুদ্র একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যার নেতৃত্বে ছিলেন সৈয়দ আহমদ বেরলভী। শরীয়তের বিধান চালু হবার পর পুরো এলাকায় শান্তি স্থাপিত হলো। একের উপর অপরের জুলুম বন্ধ হলো। জুলুম করে পলায়নের পথ বন্ধ হলো। কাজী নিযুক্ত করে বিচার ফায়সালা শুরু হলো। উৎপাদিত ফসলের একদশমাংশ(ওশর) আদায়ের ব্যবস্থা করা হলো। খারায ও যাকাত আদায় এবং বণ্টনের জন্য ব্যবস্থা গৃহীত হলো। এ ভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও এই উপমহাদেশের এক কোনে একটি ক্ষুদ্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উইলিয়াম হান্টার এই ক্ষুদ্র ইসলামী রাষ্ট্রটিকে জেহাদি বসতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। এখানে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর স্থানীয় মাতব্বর শ্রেণী ও কিছু স্বার্থপর লোক এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এক সময় এটাও ইংরেজদের দালাল কতিপয় মুসলিম আর বিশ্বাস ঘাতক দালাল শিখদের ষড়যন্ত্রের বিষফলে তা তছনছ হয়ে যায়।

বালাকোট- বিপর্যয় ও কারণ :[সম্পাদনা]

বালাকোট দেখেছি। সেই সাথে সৈয়দ আহমদ বেরেলভি শহীদ বর্তমান পাকিস্তানের যেসব জায়গায় ঘুরেছিলেন সেসব জায়গাও। পেশোয়ার, সোয়াত তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সৈয়দ সাহেব বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ ও লখনৌ শহরের মাঝে রায়বেরেলি শহরে ১৭৮৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তিতে দিল্লী বাংলা, মক্কা-মদীনা সফর করেন। সৈয়দ সাহেব ও তাঁর অনুসারীদের অমুসলিমরা ‘ওয়াহাবি’ বলে প্রচারণা চালায়, যেমনভাবে তারা সব মুসলিমকে ‘মোহামেডান’, ইসলাম ধর্মকে ‘মোহামেডান ধর্ম’ বলে প্রচার করত। ১৮৩১ সালের ৬ মে বালাকোটের বিপর্যয়ে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরাট ক্ষতি হয়েছিল। বালাকোট বিপর্যয় না হলে ইংরেজদের হয়তো তথাকথিত সিপাহি বিদ্রোহের আগেই উপমহাদেশ ছাড়তে হতো। সৈয়দ সাহেব সরাসরি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ না করে শিখ অধিকৃত এলাকায় কেন জিহাদ শুরু করলেন? এর জবাবে বলা হয় যে-এই উপমহাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে ইংরেজ হানাদারদের বের করতে হলে পশ্চিমের মুসলিম উপজাতিদের সাহায্য প্রয়োজন ছিল। অথচ এ সময় শিখরা সেখানে ক্ষমতায়। তারা আবার স্থানীয় মুসলিমদের ওপর, এমনকি নারীদের ওপরও জুলুম করছিল। অন্য দিকে তারা ইংরেজদের মিত্র। এ জন্যই হয়তো সৈয়দ আহমদ পশ্চিমে তার শিবির স্থাপন করেছিলেন। কিছুটা কাজও হয়েছিল। পেশোয়ার কেন্দ্রিক ইসলামী স্বাধীন প্রশাসন তিনি শুরু করেছিলেন, কিন্তু স্থানীয় মুসলমানদের কিছু লোক শিখ ও ইংরেজদের ফাঁদে পড়ে সৈয়দ সাহেবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। পরে ইংরেজরা শিখদের সেই মিত্রতার ‘প্রতিদান’ দেয় শিখ রাজ্যটাই দখলে নিয়ে। সৈয়দ সাহেবের ইচ্ছা ছিল মুসলিম উপজাতিদের নিয়ে শিখ ও ইংরেজদের মোকাবেলা করা কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই চূড়ান্ত। বালাকোটের বিপর্যয়ের পরও ঈমানদার মুসলমানরা ১৮৫৭ সালে সশস্ত্র সংগ্রাম করেন। এর পরও ইংরেজরা না যাওয়া পর্যন্ত খোরাসানিরা শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিল।

বালাকোটে সাইয়েদ আহমদ ও ইসমাইল শহিদের নেতৃত্বে মাত্র সাত শত মুজাহিদ অপরদিকে শের সিংহের নেতৃত্বে শিখ বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ১০ হাজার। বালাকোটের যেখানটায় মুজাহিদ বাহিনী অবস্থান নিয়েছিলেন, পাহাড়ি গিরি পথ মাড়িয়ে শিখ বাহিনী এত সহজে এ জায়গায় পৌঁছতে পারত না। কিন্তু স্থানীয় মুসলমানদের গাদ্দারির কারণে বালাকোট পর্যন্ত পৌঁছার রাস্তা পেয়ে যায় শিখবাহিনী। অবশেষে আসে ১৮৩১ সালের ৬ মে। ১০ হাজারের মুকাবেলায় মাত্র সাত শত মুজাহিদ, জীবনবাজি রেখে তাঁরা লড়াই চালিয়ে যান। শাহাদত বরণ করেন সাইয়্যিদ আহমদ শহিদ ও ইসমাইল শহিদ রহ.। তাঁদের সঙ্গে বীর বিক্রমে লড়তে লড়তে ছোট্ট এ বাহিনীর বেশির ভাগ সৈন্যই পান করেন শাহাদতের অমীয় সুধা।

মাওলানা সায়িদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) এর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বিশেষতঃ তাঁর শিক্ষার্জনের উ”চাকাঙ্খা গবেষণা ও সমাজসংস্কারের চিন্তা ভাবনায় কোরআনের সহজবোধ্য উপ¯’াপনের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারে বুদ্ধিবৃত্তিক পš’া অবলম্বন। বিশেষতঃ সমকালীন বিশ্বে প্রচলিত ভ্রান্ত রাজনীতি সমাজনীতি,অর্থনীতি মুসলিম সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছিল দেখে মাওলানা মাওদুদী ঈমানী চেতনায় ব্যাকুল হলেও বিচলিত বা নিরাশ হননি। আশায় বুক বেধে আল্লাহর উপর ভরসা করেই তাফহীমুল কোরআন লেখেন। রাসাঈল ও মাসায়েল লেখেন,তাফহীমাত লেখেন,আল জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ সহ এক বিশাল সাহিত্য ভান্ডার। সেই সাথে ময়দানী আন্দোলন জোরদার করতে প্রতিষ্ঠা করেন জামায়াতে ইসলামী নামক এবটি সংস্কার আন্দোলন যার গন্তব্য ইক্বামতে দ্বীন আর উদ্দেশ্য আল্লাহর রেজামন্দি। এ জন্যই নিঃসঙ্কুচ বলা যায় যে মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী রঃ এর সংস্কার আন্দোলন ছিল শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর সংস্কার আন্দোলনের ই ধারাবাহিকতা।

মাওলানা আবুল আলা মওদুদী’র (রঃ)অভিব্যাক্তি[সম্পাদনা]

মাওলানা আবুল আলা মওদুদী (রঃ) বালাকোটের যুদ্ধ ও ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তার সার কথা হলোÑ ” আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালানোই মুমিনের সত্যিকারের সাফল্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী (রঃ) শাহ ইসমাঈল শহীদ (রঃ) ও তাঁদের অনুসারীগণ অবশ্যই সফলকাম হয়েছিলেন। তবে পার্থিব ফলাফলের দিক দিয়ে তাঁদের ব্যর্থতা পরিস্ফুট। কার্যতঃ তারা জাহেলিয়াতের কর্তৃত্ব নির্মূল করে ইসলামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। আমরা এই কারণসমূহ পর্যালোচনা করবো,যাতে করে পরবর্তীকালে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ঐ কারণসমূহের ব্যাপারে সতর্ক থাকা সম্ভব হয়। কতিপয় জাগতিক কারণে তাঁরা ব্যর্থ হন। এ কারণগুলো আমি পরে বর্ণনা করছি। কিন্তু চিন্তার জগতে তাঁরা যে আলোড়ন সৃষ্টি করে যান, তার প্রভাব এক শতাব্দীর অধিক সময় অতিক্রান্ত হবার পর আজও উপমহাদেশে পরিদৃষ্ট হচ্ছে। (শিবির অনলাইন)

অভিযোগঃ

সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) আলেম নয় কেন?[সম্পাদনা]

মাওলানা মওদুদী (রঃ) ভারতের হায়দরাবাদের (বর্তমান মহারাষ্ট্র) আওরঙ্গবাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সায়্যিদ আহমদ হাসান, তিনি পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী। মাওলানা মওদুদী বংশীয় দিক দিয়ে সাইয়্যিদুনা হুসাইন (রাঃ) এর ৩৬তম উত্তর পুরুষ। তাঁর ২৩তম পূর্বপুরুষ খাজা মঈন উদ্দীন মওদুদ চিশতি (রঃ)। মাওলানা সায়্য্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) আলেম নয় একজন সাংবাদিক স্ব-শিক্ষিত তিনি কোন মাদ্রাসা পড়–য়া ডিগ্রীদারী আলেম নয় বরং একজন সাহিত্যিক বা ভালো লেখক বলা যায়। তাই তাঁর রচিত কোরআন হাদীসের ব্যাখ্যা এবং ইসলামী শরীয়তের বিধিবিধান সম্পর্কিত মতামত গ্রহনযোগ্য নয় বলে জনশ্রæতি আছে। এই জনশ্রæতির ভিত্তিতে আমি নিজেও ছাত্র বেলা থেকে এবং কর্মজীবনে এসেও অনেক লেখালেখি সেমিনার স্যাম্পুজিয়াম ও ওয়াজ মাহফিলে ঘরোয়া পরিবেশে মসজিদের মিম্বরে বয়ান রেখেছি। পরবর্তিতে আমি নিজে যখন এ বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হলাম তখন ই সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ)এর শিক্ষা জীবন ও শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি নিয়ে কিছু ঘাটাঘাটি করে বুজতে পারলাম তিনি স্বশিক্ষিত নয় বরং উচ্চশিক্ষিত এবং সঠিক পদ্ধতিতে একজন উপযুক্ত আলেম। আর কেবল আলেম ই নয় জগদ্বিখ্যাত আলেম। এতটাই বিখ্যাত ও সু পরিচিত এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব যে এই উপমহাদেশে এই মানের আর কোন আলেম তার আগের পেছনের শত বছরেও আর একজন ছিলেন বলে মনে হয়না। অথচ তাঁকেই এই উপমহাদেশের ই কোন কোন দেশের কোন কোন আলেম স্ব-শিক্ষিত,অল্প শিক্ষিত,মাদ্রাসা শিক্ষিত সনদদারী আলেম নয় কোরআন হাদীস পড়েননি ইত্যাদী বলে ঢিল ছুড়েন।

কেন এই বিতর্কঃ[সম্পাদনা]

গায়্যিদ আবুল আলা মওদুদীর (রাঃ) শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় তাঁর কোন ক্ষতি হয়নি বরং তাঁর যোগ্যতা প্রতিভা ও গবেষণা নিয়ে শিক্ষিতজনদের আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। এতে একদিকে তার পরিচিতি এবং তার রচনা শৈলী পড়ে তাঁর প্রতি তার যোগ্যতার প্রতি আগ্রহ আগ্রহ আরো বেড়যায় বেড়ে যায় তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও। বিশেষতঃ ভারতবর্ষের বিশেষ বিশেষ কোন এলাকায় বিশেষ বিশেষ কিছু ইউনিটিতে এই বিতর্ক বা অপপ্রচারের মাত্রা বেশী। বিষয়টিকে নিছক একটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে আঁড় চোখে দেখার বা আমলে নেয়ার সুযোগ নেই বলে আমি অনুধাবন ও হ্রদয়ের গভীর থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছি। বরং আমি এ বিষয়টি একাধিক কারণে হয়েছে যা হওয়াটাই যুক্তি-যুক্ত ও স্বাভাবিক। এতে অবাক হওয়ার বা গালি দেওয়ার কোন সুযোগ নেই দু একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া। যেমন এর পেছনে যে সব কারণ কাজ করেছে আমার অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ

(এক) শিক্ষা জীবন সম্পর্কে লেখার গুরুত্ব না দেয়া ঃ[সম্পাদনা]

সায়্যিদ আবুল আলা মওদূদীর (রঃ) বিরাহমীন কলমী আন্দোলন রাজনৈতীক আন্দোলন গবেষণামূলক কার্যক্রম ও নিজের দেশের বাইরেও বিভিন্ন মিটিং সভাসেমিনার সেই সাথে ভিন্নমতাবলম্ভিদের লাগামহীন বে পরোয়া পদচারণা মাওলানার নিজের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দল পরিবার ও প্রতিষ্ঠান মাওলানার শিক্ষা জীবনের একটা সারসংক্ষেপ স্বতন্ত্রভাবে লিপিবদ্ধ করে প্রকাশের না সময় পান আর না প্রয়োজন মনে করেন। আল্লাহ যাকে চান তাকে এ ভাবেই উপরে উঠাতে পারেন। এ জন্য কোন প্রচার প্রচারণা বা ডাক ঢোল পেঠানোর প্রয়োজন পড়েনি। তাই বিষয়টি শুধু যে দলের ও মতের বাইরের লোকেরই অজানা তা নয় বরং দলের ভেতরের এবং মাওলানার সমর্থকদের অনেকেও মাওলানার শিক্ষা জীবনের পুরো হিষ্ট্রী জানেন না তবে গাছের পরিচয় তার ফলেই মিলে এই সত্যবাকের আলোকে তাঁর রচনাবলির গভীরে ই যে তার যোগ্যতা লুকিয়ে আছে এ কথা বিশ্বাসের কোন ত্রæটি নেই। এ জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দায়িত্বশীল সহ যারা মাওলানা মওদুদীর (রঃ) জীবন ও কর্ম নিয়ে লিখেছেন তারা শিক্ষা জীবনের বিষয়টি স্বতন্ত্র ভাবে লেখার খুব গুরুত্ব দেননি বা অনুভব বা প্রয়োজন মনে করেননি। ।

(দুই) সমকালীন পরিবেশ পরিস্থিতি বিষয়ে না জানা ঃ[সম্পাদনা]

মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা (রঃ) ভারতবর্ষের রাজনৈতীক সামাজিক ধর্মীয় ও শিক্ষা ব্যবস্থার যে পরিবেশ পরিস্থিতির সময়ে জন্মগ্রহণ করেন সে সময় এবং তারও বহূ বছর আগে থেকেই শিক্ষা দান ও শিক্ষা গ্রহণের কি পদ্ধতি বা ধরণ চলে আসছিল এ সম্পর্কে সঠিক পদ্ধতিতে সঠিক ধারণা বা জ্ঞান না থাকার কারনেই এই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষতঃ মাওলানা মওদুদী (রঃ) লেখনির মাধ্যমে গোটা ভারতবর্ষকে একটি আদর্শিক বিপ্লবের বিষয়ে সচেতন করার মিশন নিয়ে কাজ করায় তাঁর প্রতিই বেশি দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক। আর সেটাই হয়েছে এবং হচ্ছে। অথচ সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদীর চেয়ে উচ্চজ্ঞান সম্পন্ন উচ্চমর্য্যাদা সম্পন্ন ওলামায়ে কেরামের বিষয়ে এমন বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি। কারণ তারা একটা বিশেষ পরিমন্ডলে স্ব-মহিমায় ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদেরও কিন্তু শিক্ষার্জনের ধরণ মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর মতই ছিল। এবং তাদের সাথেই মাওলানা মওদুদীর (রঃ) শিক্ষকদের সিলসিলা মিলিত যাদের সাথে মিলিত আকাবীরে দেওবন্দ ও আকাবীরে বেরেলীদের সিলসিলা মিলিত। আমাদের এই বিষয়ে জানার সুযোগ দেয়া হয়নি আমরা জানার চেষ্টা করিনি এবং আমরাও আমাদের ছাত্রদের এ বিষয়ে জানাতে পারিনি। উল্লেখ সে সময়ে আল্লামা শিবলী নো'মানী,নওয়াব নিযামুল মূলক বিলগেরামী ও মাওলানা হামীদুদ্দীন ফারাহীর পরিকল্পনা অনুযায়ী হায়দারাবাদ ও আওরংগাবাদে এক নতুন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করা হয়। শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দূ। ইতিহাস, কোরআন-হাদীস,ফেকাহ, মানতেক (তর্কশাস্ত্র) প্রভৃতি পড়ানো হতো।এ মানের মেট্রিকুলেশনকে মৌলভী, ইনটারমিডিয়েটকে মৌলভী আলেম এবং ডিগ্রী কলেজকে দারুল উলুম বলা হতো। মাওলানা মওদূদী (রঃ) সেই ধারাই ছাত্র ছিলেন।

=== (তিন) আলেমের সঃজ্ঞা ও ইজাযা সনদ ঃ ===[সম্পাদনা]

এখনো সাধারণ মানুষ তো বটে বেশির ভাগ আলেম ও জানেন না যে কেবল ই মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়ে বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মাওলানা খেতাব পাওয়া আর একটা কাগুজে সনদের নাম ই কেবল আলেম নয়। ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পুর্ব পর্যন্ত আসহাবে রাসূল (সাঃ) তাবেয়ীন,তবে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ফোকাহা এ দ্বীন ই মতীন সলফে সালেহীন এমনকি তৎকালীন মুসলিম রাজা বাদশাহগনও এবং বর্তমানেও সালিকীনদের সকলেই ছিলেন سند اجازة প্রাপ্ত বা মৌখিক অনুমতি প্রাপ্ত জ্ঞানী পন্ডিত ফক্বীহ,মুফতি মুহাদ্দীস ইমামুল হুজ্জাহ ফিল হাদীস, মূফাস্সীরীন ও তাফসীরকারক ছিলেন। চার মাজহাবের প্রধান ছাড়াও অসংখ্য মুজতাহিদ ইমামগণ, ইমাম বোখারী, ইমাম মুসলিম সহ ছেহাহ ছিত্তাহ ও অন্যান্য ছহীহ হাদীসের কিতাবাদী, সুনান, মাসানিদ, মুসতাদরাক মুয়াত্তা হাদীস গ্রন্থের প্রণেতাগণের সকলেই ছিলেন সনদে ইজাযাহ প্রাপ্ত মুসলিম উম্মাহ’র রাহবর। জগতবিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী,ইবনে সিনা,ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন,ইবনে রুশদ,ইবনে সিনা,ইলমে তাসাউফের স¤্রাট হাসান বসরী,আব্দুল কাদির জিলানী জুনাইদ আল বাগদাদী,বাহাউদ্দীন নকশবন্দী,মঈন উদ্দিন চিশতী,শাহজালালাল ইয়ামনী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস ই দেহলভী,ছাবেরিয়া তরীকার প্রবর্তক বৃটিশ শাহ ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মোহতামীম কাসিম নানুতবী (রাহিমাহুমুল্লাহ) সহ এই ভারত বর্ষের লাখো লাখো মুসলিম পন্ডিতগণই এই পদ্ধতির বিদ্যার্জনকারী যে পদ্ধতিতে সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) জ্ঞানাহরণ করেছেন। এই পদ্ধতিটা এখন আর নেই বলেই আমাদের অনেকেই সেই ইতিহাস সম্পর্কে জানিনা। একমাত্র ইলমে তাসাউফের সনদ সনদে ইজাযা বহাল আছে আর বাকী সকল শিক্ষা ধারার ই আমুল পরিবর্তন ঘটে গেছে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ পদ্ধতিতে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিনে যেমন ধর্ম তত্ব নিয়ে জ্ঞানচর্চার ধারা বহাল আছে তেমনি থিসিস পদ্ধতিও আছে যদিও সেটাও কোন না কোন প্রতিষ্ঠানের অধীনে হয়ে থাকে। সুতরাং এটা প্রমাণিত সত্য যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াও শিক্ষার্জনের ধারা এবং কাগুজে সনদের বাইরে ইজাযাহ সনদ একটি মূলধারার স্বীকৃত পদ্ধতি। এই পদ্ধতীতে জ্ঞানার্জনকারীদের সমকালীন ব্যবহারিক ভাষায় পরিচিত বা সম্বোধন করা আলেম এর পরিপন্থি বা আলেম না হওয়ার হাস্যকর খোড়া যুক্তির আওতায় পড়েনা। ভারতবর্ষের কিছু এলাকা ছাড়া আর কোতাৗ এই মাওলানা আল্লামা মুফতি মুহাদ্দিস খেতাব পরিচিতিও নেই এ নিয়ে দ্বন্ধও নেই। কোরআন হাদীস জানা আর ইসলামের দাওয়াতী কাজের জন্য কেবল ই একটি প্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালের ভেতর থেকে পড়া আর একটি কাগুজে সনদের বাধ্যবাধকতা ইসলামের অনিবার্য কোন বিধান বা বিষয় নয়। এটা কেবল সামাজিক একটা সিষ্টেম। যারা এটাকে নিজেদের ই কেবল আলেম হওয়ার আর কোরআন হাদীসের বিষয়ে বা ইসলামের দাওয়াত দেয়ার একমাতও দাবীদার গন্য করে অন্যদের তাচ্ছিল্য করেন তাদের এবার এ বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার পাশাপাশি কিছু করারও দরকার।

(গ) রাজনৈতিক প্রেক্ষপট ঃ[সম্পাদনা]

মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) কেবল ই একজন লেখক গবেষক এবং সাংবাদিক ছিলেন না তিনি এসব করতেন একটি মিশন নিয়ে যেটার মুল স্প্রিট হলো ইসলামী খেলাফত পুনরুদ্ধারে মোসলমানদের জাগ্রত করা। কারণ ইসলামী খেলাফতের পতন ঘটিয়ে একের পর এক স্বৈরাচারী,রাজতন্ত্রী,শাসন ব্যবস্থা,পাশ্চাত্য গণতন্ত্র ও পুজিবাদী সমাজতন্ত্র ব্যবস্থার কবলে পড়ে মুসলিম জাতি তাদের নিজেদের বীরত্বগাঁতা স্বতন্ত্র বৈশীষ্টপূর্ণ মর্যাদার কথা ভ’লেই গিয়েছিল।এমনকি ইসলাম যে একটি বিপ্লবী ধর্ম,কল্যাণমূখি মানবতবাদী জীবনব্যবস্থা সেটা মেনে নেয়াতো দুরে থাক বেশিরভাগ মুসলিম ই তা সহ্য করতে পারেনা। এই বেদনা থেকেই উম্মাহকে সচেতন করতেই সমকালিন বিশ্বকে ইসলামী খেলাফতের তথা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কল্যাণের দিক গুলো আগে শিখাতে চান অতঃপর সমকালীন ইসলামী চিন্তাবিদদের পরামর্শের আলোকে একটি রাজনৈতীক দলও গঠন করেন যার না জামায়াতে ইসলামী। পাশ্চাত্য গণতন্ত্্র পুজিবাদী সমাজতন্ত্র সুদী অর্থনীতি নৈতীকতা,আদর্শ ও চরিত্রতা বিবর্জিত শিক্ষা ব্যস্থার আদলে শিক্ষিত লোকদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে পরিচালিত গতানুগতিক রাজনৈতীক প্রভাবে রাজনৈতীক অঙ্গন দোষিত হওয়ার প্রেক্ষপটে এর বিকল্প হিসাবে মুসলিমদের কাঙ্খিত কোন রাজনৈতীক শক্তি না থাকায় ভালোই চলছিল বটে। কিন্তু মাওলানা মওদুদীর এই বহুমূখি বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ও কর্মপরিকল্পনা সেই রাজনীতিবিদদের ই ভাবিয়ে তুলে। আর তারাই এই পথে যে বাধার প্রাচীর গুলোর দাঁড় করায় তার ই একটি ছিল এটা যে মাওলানা মওদুদী তো আলেম নয় যে এতো বড় বড় কিতাব লিখবেন ফতোয়া দিবেন আর সমকালীন রাজনীতিতে মিশ্র জাতীয়তা ভিত্তিক ঐক্য বিনষ্ট করবেন? এ থেকেই এই বিতর্কটি বলা যায় এই প্রচারণাটাই বাজারে বেশি প্রচার হতে থাকে। যার রেষ অনেকের কাছ থেকে এখনো কাটেনি।

ইসলাম বিদ্ধেষী শিক্ষানীতি (১৮৩৪)[সম্পাদনা]

ভারতবর্ষ যেহেতু শত শত বছর মুসলমানদের শাসনের ছিল.তাই স্বাভাবিকভাবে মুসলমানরা তাদের হারানো সম্পদ পুনরোদ্ধারে আন্দোলন শুরু করে। মুসলমানদের টার্গেট করে দেশীয় শিক্ষা বিলুপ্ত করে ১৮৩৪ সালে এমন একটি নতুন শিক্ষানীতি চালু করা হয়.খোদ ইংরেজদের দাবি-যারা এই শিক্ষানীতি গ্রহণ করবে.তারা কেবল বংশগত দিক থেকে থাকবে ভারতীয় কিন্তু মনমস্তিস্কের দিকে থেকে হবে বৃটিশ। এজন্য তৎকালিন ওলামায়ে কেরাম এই শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হারাম ফতোয়া ঘোষণা করেন। ওলামায়ে কেরাম কিন্তু ইংরেজী শিক্ষা হারাম বলেন নি যা পরবর্তিতে ব্যাপক প্রচার করা হয় এবং অনেকে ইংরেজী ভাষা বর্জন করেন।

এক নজরে মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ)[সম্পাদনা]

বিংশ শতাব্দীর মহান সংস্কারক মানবতার মুক্তি আন্দোলন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা ও আমীর, বিশ্ববিখ্যাত মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপকার, সিলেবাস প্রণেতা ও ভাইস চ্যান্সেলর, ওআই সির রূপকার, ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদীর (সঃ) কর্মজীবনের সারসংক্ষেপ। ১৯১৮- সাংবাদিক হিসেবে 'বিজনোর' (ইরলহড়ৎব) পত্রিকায় যোগ দেন। ১৯২০- জবলপুরে 'তাজ' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ লাভ । ১৯২১- দৈনিক 'মুসলিম' পত্রিকার এডিটর হিসেবে নিয়োগ । ১৯২৫- নয়া দিল্লীর 'আল জামিয়াহ' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ লাভ। ১৯৩৩- ভারতের হায়দরাবাদ থেকে 'তরজুমানুল কুরআন' নামক পত্রিকা প্রকাশ। ১৯৩৮- পাঠানকোটে দারুল ইসলাম ট্রাস্ট ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন। ১৯৪১- লাহোরে 'জামায়াতে ইসলামী হিন্দ' প্রতিষ্ঠা করেন । ১৯৪২ - তাফহীমুল কুরআন নামক তাফসির গ্রন্থ’ প্রণয়ন শুর“ করেন। ১৯৪৮ - 'ইসলামী সংবিধান' ও 'ইসলামী সরকার' প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারণা শুরু করেন। ১৯৪৮ কারাগারে বন্দী । ১৯৪৯ - পাকিস্তান সরকার জামায়াতে 'ইসলামী সংবিধানের রূপরেখা' গ্রহণ করে। ১৯৫০ - কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন। ১৯৫৩- 'কাদিয়ানী সমস্যা' নামে একটি বই লিখে গ্রেফতার অতপর ফাসির দন্ডাদেশ প্রাপ্ত হন। ১৯৫৩- মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর চাপ এবং দেশী বিদেশী মুসলিম নেতৃবৃন্দের অনুরোধে মৃত্যুদন্ডাদেশ পরিবর্তন অতপর প্রত্যাহর। ১৯৫৮- সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়্যুব খান 'জামায়াতে ইসলামী'কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ১৯৬৪- আবারো তাকে কারাবন্দী হন। একই বছর মুক্তি লাভ। ১৯৭১- পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হবে কিনা এ সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের উপর ন্যস্ত করেন। ১৯৭২- তাফহীমুল কুরআন নামক তাফসির গ্রন্থ রচনা সম্পন্ন করেন। ১৯৭২- জামায়াতে ইসলামীর আমির পদ থেকে ইস্তফা। ১৯৭৮- তাঁর রচিত শেষ বই 'সিরাতে সারওয়ারে আলম' প্রকাশিত। ১৯৭৯- চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গমন এবং একই বছর সেখানেই ইন্তেকাল ১৯৭৯- লাহোরের ইছরায় জানাজা ও দাফন।

(১) জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষাঃ [সম্পাদনা]

মাওলানা সায়্যিদ আবুল আ'লা মওদুদী (রঃ) ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। এবং ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯সালে ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন বিশ্ববরেণ্য একজন মুসলিম স্কলার,একাধারে গবেষক, আইনবিদ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ,দার্শনিক,উলূমে কোরআন ও হাদীস এবং আসমাউর-রিজালের উপর বিশেষজ্ঞ। তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সংস্কারক বিপ্লবী ইসলামী চিন্তাবিদ। তাঁর সম্পর্কে উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েলস্মিথ বলেন-’মাওলানা মওদুদী (রঃ) ইসলামের সবচেয়ে নিয়মতান্ত্রিক একজন চিন্তাবিদ"। সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) ১৯১৪ সালে হায়দারাবাদ শিক্ষা বোর্ডের অধীন মৌলভী বা এস.এস.সি/ সমমান দাখিল পরীক্ষা দিয়ে বোর্ডে বিরল কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এর পর বৃটিশ খেদাও আন্দোলন জোরদার হওয়ার প্রেক্ষাপটে ভারত বর্ষে দারুল উলুম দেওবন্দ ও বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ছাড়া বেশীর ভাগ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বিশেষত যারা সরাসরি বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের দমন পীড়নন চরম আকার ধারণ করে। দিল্লী দারুল উলুম দিল্লী ইসলামিয়া কলেজ সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান হয় বন্ধ করে দেয়া হয় না হয় তাদের লোক দ্বারা পরিচালনা করা হয়। বেশীরভাগ নেতৃত্ব প্রদানকারী ওলামায়ে কেরাম কে হয় শহীদ করা হয় না হয় নির্বাসনে দেয়া হয়। সমকালীন দূরদর্শী ওলামা মাশায়েখদের সম্মিলিত পরামর্শের ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যক্তি কেন্দ্রিক মসজিদ ও খানকা কেন্দ্রীক উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়। যে গুলো তখন স্থর বিশেষ একেকটি কলেজ /হাই মাদ্রাসা / বিশ্ববিদ্যালয় তথা দারুল উলুম এর মর্যাদা রাখতো। মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) এমন ই কিছু ব্যাক্তি কেন্দ্রীক পরিচালিত উন্নত পাঠচক্র বা দারস থেকে শিক্ষার্জন করেন। যার ধারাবাহিকতা তখনো ভারতবর্ষে ছিল এবং দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাগণ সহ আরো অনেক নামী দামী ইসলামী স্কলারগণ ই এই পদ্ধতিতে উচ্চ শিক্ষালাভ করেছেন যার বিবরণ আমরা ইতিমধ্যে তুলে ধরেছি।

(২) আরবী ভাষা-সাহিত্যঃ[সম্পাদনা]

সমকালীন নিয়ম ও ধারা অনুযায়ী মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) পিতার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর পর আরবী ভাষা, যেমন-ইলমে নাহু,ইলমে সরফ,ইলমে মা'ক্বুলাত ওয়াল-বালাগাহ ওয়াল মা'আনী শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হন। আরবী ভাষা,সাহিত্য বিশেষতঃ কোরআন হাদীস ্ও আলমে ফিক্বহ ও উসূল বুজার জন্য আরবী ভাষা জানা-বুজা অতীব জরুরী। তাই মাওলানা মওদুদী (রঃ) তৎকালীন ভারতের আহলে ইলমের মধ্যে আরবী ভাষার পন্ডিত ব্যাক্তিত্ব দিল্লী দারুল উলুম এর মাওলানা শায়খ আব্দুস-সালাম নিয়াজী দেহলভীর (র:) দারস বা পাঠচক্রে ভর্তি হন। দিল্লীর দরাজ গেইট জামে মসজিদে তাঁর এই দরসগাহ ছিল। যিনি ছিলেন সমকালীন ভারতের অনেক খ্যাতিমান ওলামায়ে কেরামের উস্তাদ। তার দাদা উস্তাদ ছিলেন আকাবীরে দেওবন্দের বেশির ভাগ ওলামায়ে কেরামের উস্তাদ ও দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসিম নানুতবীর (রঃ) উস্তাদ মাওলানা মমলুক আলীর (রঃ)। মাওলানা মওদুদী (রঃ) মাওলানা আব্দুস সালাম নিয়াজী'র কাছ থেকে سند إجازة (ইজাযাহ সনদ) লাভ করেন ।

(৩) হাদীস, উসূলে -হাদীস ও ফেক্বাহ শিক্ষা ঃ[সম্পাদনা]

মাওলানা মওদুদী (রঃ) আরব আযমে স্বীকৃত মুহাদ্দিস মাওলানা খলিল আহমদ সাহরানপুরীর বিশেষ ছাত্র দিল্লীর দারুল উলুম ফতেহপুরের শায়খুল হাদীস ভারতের বিখ্যাত মুহাদ্দীস মাওলানা আশফাকুর রহমান কান্ধলভীর (রঃ) কাছে দাওরায়ে হাদীসের (কামিল/টাইটেল) সকল হাদীসগ্রন্থ পড়ে ১৯২৭ সালে হাদীসের সর্বোচ্চ ইযাজা সনদ লাভ করেন। এর এক বছর পর ই ১৯২৮ সনে তিরমিযি ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক শিক্ষা দানের ইজাযাত লাভ করেন।এর পর ও আরো দু বছর সময় ইলমে হাদীস ইলমে তাফসীর ও উলূমে ফিক্বহ এর উপর তাখাসসুসাত পড়াশোনা করেন। আল্লামা ইশফাকুর রহমান কান্ধলবী (রঃ) সম্পর্কে জানা যায় যে তিনি আল্লামা জালাল উদ্দীন সুয়ুতির ভাষা ও সিন্দীর টীকা সংক্ষিপ্ত করে এবং আসমাউর রিজাল সংযোজন করে ১৩৫০ হিজরীতে সুনানে নাসাঈ দিল্লী থেকে প্রকাশ করেন। মাওলানা মওদুদী তখন তাঁর দরসের ছাত্র ছিলেন। (৪) ফিক্বহ,তাফসীর বায়জাবী এবং আল- মাতূল ফী 'ইলম আল-মা'আনী ওয়াল- বালাগাহ এ বিষয়গুলোতে সনদে ইজাযাহ লাভ করেন শায়খ শরীফুল্লাহ'র (রঃ) কাছ থেকে।

(৫) ইংরেজী ভাষা: সাহিত্য ঃ[সম্পাদনা]

মৌলভী মুহাম্মদ ফাজিল এর কাছ থেকে ইংরেজী ভাষা, ইতিহাস,দর্শন, সমাজ বিজ্ঞান ও বিভিন্ন ধর্মের তুলনা মূলক আলোচনা পড়ে সনদে ইজাযাহ লাভ করেন। তিনি তৎকালীন ম্যাট্রিকুলেশন মানের পুস্তকাদি পড়ে ইংরেজীতে এতখানি জ্ঞান লাভ করেন যে,অসাধারণ মেধাশক্তির বলে কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি ইংরেজী সংবাদপত্র অথবা পুস্তক পাঠ করে তার মর্ম উপলব্ধি করতে পারতেন। দু'বছর যাবৎ তিনি ইংরেজী ভাষা অধ্যয়ন করেন। শিক্ষকের সাহায্য ব্যতিরেকেই তিনি বিভিন্ন গ্রন্থাদি শুধু অভিধানের সাহায্যে অধ্যয়ন করে প্রভূত জ্ঞান সঞ্চয় করতে থাকেন। মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী সাহেবের (রঃ) সনদ গুলোর বিবরণ পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী একত্রিত করে বই আকারে বের করেছে। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ফকীহ এবং আলিম ড. সায়্যিদ আব্দুল হালিম মুহাম্মদ হুসাইন তাঁর "নাযারাত ফী ফিকরি আবীল-আলা আল- মওদূদী কিতাবে আল্লামা মওদূদীর শিক্ষাগত যোগ্যতার যে বিবরণ দিয়েছেন সেখানে তিনি এই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ড. শায়খ আব্দুস-সালাম আযাদী ও তাই লিখেছেন।

মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদীর (রঃ) উস্তাদগনের সিলসিলাঃ[সম্পাদনা]

মাওলানা সায়িদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) মাওলানা আশফাকুর রহমান কান্ধলবী (রঃ) মাওলানা খলিল আহমদ সাহরান পূরী (রঃ) (যিনি শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মদনীরও (রঃ) একদিনের উস্তাদ ছিলেন। মাওলানা মাজহার নানুতবী (রঃ) (দারুল উলুম ফতেহপুরের মোহতামীম) মাওলানা মমলুক আলী (রঃ) (যিনি কাসিম নানুতবীর (রঃ) উস্তাদ ) মাওলানা শাহ ইসহাক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ) শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ) শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) শায়খ আবু তাহির মোহাম্মাদ আল কুদি (রঃ) শায়খ আব্দুল কুদ্দুস নিশাবী (রঃ) শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ রামলী (রঃ) শায়খ জাকারিয়া ইবনে মুহাম্মাদ আব ুইয়াহিয়া আনসারী শায়খ হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (রঃ) শায়খ ইবাহীম ইবনে আহমাদ তানূখী (রঃ) শায়খ আহমদ ইবনে আবুতালিব (রঃ) শায়খ সিরাজুল ইসলাম ইবনুল মোবারক (রঃ) শায়খ আব্দুল আউয়াল ইবনে ঈসা আল হারুরী (রঃ) শায়খ আব্দুর রহমান ইবনে মুজাফ্ফর দাউদী (রঃ) শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ সূরুখসী (রঃ) মোহাম্মাদ বিন ইউসুফ ফাআল ফারাবী (রঃ) শায়খ মুহাম্মদ বিন ইসমাল আল বোখারী (রঃ) শায়খ আহমদ বিন আসকাব (রঃ) শায়খ মুহাম্মদ বিন ফুজায়ল (রঃ) শায়খ আম্মারা বিন কা'কা (রঃ) শায়খ আবু জারয়া (রঃ) আবু হুরায়রা রাজিয়ল্লাহু আনহু সায়িদূনা মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ।

মাওলানা মওদূদীর (রঃ) বংশ পরম্পরা[সম্পাদনা]

ইমামুল মুত্তাকীন সায়্যিদুনা হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ) হযরত ইমাম হুসাইন শহীদ (রাঃ) হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (রঃ) হযরত ইমাম মুহাম্মদ আলবাফ্ (রঃ) হযরত ইমাম মুহাম্মদ জা'ফর সাদেক (রাঃ) হযরত ইমাম মূসা আল কাযেমী (রঃ) হযরত ইমাম মুহাম্মদ তকী (রঃ) হযরত ইমাম মুহাম্মদ নকী (রঃ) সায়্যিুস্ সা'দাত আব্দুল্লাহ- আলী আকবর (রঃ) সাইয়িদুস্ সা'দাত হুসাইন (রঃ) সায়্যিদুস্ সা'দাত মুহাম্মদ (রঃ) সাইয়দিুস সা'দাত ইবরাহীমী (রঃ) মুহাম্মদ শাময়ান চিশতি (রঃ) খাজা নাসিরুদ্দীন আবু ইউসুফ চিশতী (রঃ) খাজায়ে খাজগান কুতুবুদ্দীন (মঈন উদ্দীন) মওদূদ চিশতী (রঃ) খাজা আবু আহমদ মওদূদী চিশতী (রঃ) খাজা রুকনুদ্দীন মওদূদী চিশতী (রঃ) খাজা নিযামুদ্দীন মওদূদী চিশতী (রঃ) খাজা কুতুবুদ্দীন মুহাম্মদ মওদূদী চিশতী (রঃ) খাজা আলী আবু আহমদ সানী মওদূদী চিশতী (রঃ) খাজা আহমদ আবু ইউসুফ সানী মওদূদী চিশতী (রঃ) খাজা মুহাম্মদ যাহেদ মওদূদী চিশতী (রঃ) খাজা কুতুবুদ্দীন মওদূদ সানী চিশতী (রঃ) খাজা নিযামুদ্দীন আলী মওদূদী চিশতী (রঃ) খাজা মুহাম্মদ মুহীউদ্দীন শাহ খাগী মওদূদী চিশতী (রঃ) শাহ আবুল আ'লা মওদূদী চিশতী (রঃ) শাহ আবদুল আলী মওদূদী (রঃ) খাজা আবদুল গনি মওদূদী (রঃ) খাজা আবদুস সামাদ মওদূদী (রঃ) খাজা আবদুস শাকুর (ওরফে খোশহাল মুহাম্মদ) মওদূদী (রঃ) খাজা আবদুল্লাহ (ওরফে গুল মুহাম্মদ) মওদূদী (রঃ) খাজা আব্দুল বারী (ওরফে মীর ভিখারী) মওদূদী (রঃ) খাজা আবদুল ওয়ালী (ওরফে মীর ফযল ইলাহী) মওদূদী (রঃ) শাহ আবদুল আযীয (ওরফে মীর করম ইলাহী) মওদূদী (রঃ) শাহ ওয়ারেস আলী মওদূদী (রঃ) সায়িদ হাসান মওদূদী (রঃ) সায়িদ আহমদ হাসান মওদূদী (রঃ) সায়্যিদ আবুল আ'লা মওদূদী (রঃ)

হিজরত আন্দোলন ও মাওলানা মওদূদী[সম্পাদনা]

খেলাফত আন্দোলন ব্রিটিশের অনমনীয় মনোভাব লক্ষ্য করে ভারতের আলেম সমাজ ঘোষণা করেন যে, ভারত 'দারুল হরব' এবং এখান থেকে হিজরত করা মুসলমানের দ্বীনী দায়িত্ব। ১৯২০ সালে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ রাঁচী জেল থেকে মুক্তি লাভ করার পর হিজরত আন্দোলন শুরু করেন। সে সময়ে আফগানিস্তানের বাদশাহ আমীর আমানুল্লাহ খান এক জনসভায় বলেন যে, ভারতীয় মুসলমান হিজরত করে আফগানিস্তান চলে যেতে পারে। মাওলানা আযাদের কথায় মুসলমানগণ চক্ষু বন্ধ করে হিজরতের জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। হিজরত কমিটি গঠিত হয় এবং দিল্লীতে দস্তুর মতো তার দফতর কায়েম করা হয়। হাজার হাজার ধর্মভীরু মুসলমানপরিবার নামমাত্র মূল্যে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে হিজরত কমিটির দফতরে পৌঁছতে থাকেন। শুধু আগস্ট মাসেই আঠারো হাজার লোক হিজরত করে আফগান সীমান্ত অতিক্রম করে। প্রায় পাঁচ লক্ষ মুসলমান হিজরতের নামে তাদের বহু মূল্যবান সম্পদ হাতছাড়া করে। মওদূদী ভ্রাতৃদ্বয় (আবুল আ'লা মওদূদী ও তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আবুল খায়ের মওদূদী) হিজরতের উদ্দেশ্যে দিল্লী হিজরত কমিটির দফতরে হাজির হন। মাওলানার জনৈক পরিচিত বন্ধু মিঃ তোজাম্মেল হোসেন ছিলেন সেক্রেটারী। তার সাথে মাওলানার দীর্ঘ আলোচনা হয়। আলোচনায় মাওলানা জানতে পারেন যে, হিজরতের পশ্চাতে কোন সুচিন্তিত ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা বা স্কীম নেই। শত সহস্র লোক আফগানিস্তানে চলে যাচ্ছেন, অথচ আফগান সরকারের সাথে এ ব্যাপারে কোনই আলাপ-আলোচনা করা হয়নি।

দরসে নেজামির প্রথম মাদ্রাসা কোলকাতা আলীয়া ঃ ১৭৮০ খৃঃ[সম্পাদনা]

ইংরেজ শাসনামলে এদেশে মাদ্রাসা শিক্ষা একটি নতুন মোড় নেয়। মাদ্রাসাগুলোর নামে মুগল সরকারের বরাদ্দকৃত লাখেরাজ জমি বাজেয়াপ্ত করে। ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে অনেক মাদ্রাসা বন্ধ হয়ে যায়। বাংলার গভর্নর লর্ড ওয়ারেন হেস্টিংস ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা আলীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। বলা হয়ে থাকে যে এই মাদ্রাসাটির মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারের জন্য কিছুসংখ্যক মুসলিম আইন অফিসার তৈরি করা। তবে সরকারের সমর্থন ও অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হবার কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীতে মাদ্রাসা শিক্ষার বিকাশ গতিরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কলকাতা মাদ্রাসা বাংলায় মাদ্রাসা শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি নতুন ধারা প্রবর্তন করে। এই মাদ্রাসার প্রথম প্রধান মৌলভী বাহরূল উলুম মোল্লা মজদুদ্দীন দরসে নিজামির পাঠক্রম দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সেই আদলে নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়ন করেন। হেস্টিংস কর্তৃক নির্দেশিত হয়ে তিনি এই পাঠক্রমে ইসলামী আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে প্রাধান্য দেন। বাংলার অধিকাংশ মাদ্রাসা দরসে নিজামির আদলে শিক্ষাদান পরিচালনা করে। এই ব্যবস্থা ১৯৭০ দশক পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। দরসে নেজামী পাঠক্রম অনুযায়ী একজন ছাত্রকে ১৭/১৮ বছর বয়সেই আরবী ও ফার্সি ভাষায় লিখিত নির্বাচিত ৯৯টি গ্রন্থের অন্তত একটি পড়ার ও অনুধাবনের যোগ্যতা অর্জন করতে হতো। ধর্মীয় পাঠ্যক্রম ছাড়া এই পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল ইউনানি চিকিৎসা বিদ্যা, কুটির শিল্প ও কারিগরি প্রশিক্ষণ। দরসে নিজামির মোট শিক্ষাকাল ছিল ৯ বছর।

মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রঃ) (১৫৬৪-১৬২৪)[সম্পাদনা]

শায়খ আহমদ সিরহিন্দি (রঃ) ১৫৬৪ সালের ২৬ মে  মোতাবেক ১৪ সাওয়াল ৯৭১ হিজরী পাঞ্জাব প্রদেশের সিরহিন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি হিফজুল কোরআন সহ প্রাথমিক শিক্ষার অধিকাংশই তার পিতা আব্দুল আহাদ (রঃ) ও তার ভাই মুহাম্মদ সাদিক (রঃ) এবং মুহাম্মদ তাহির আল-লাহোরির কাছ থেকে পেয়েছিলেন। এর পরে তিনি শিয়ালকোটে পড়াশোনা করেছিলেন,যেটি কাশ্মীরী-বংশোদ্ভূত পন্ডিত কামাল উদ্দিন কাশ্মীরির তত্বাবধানে পরিচালিত হত। এবং এটিই তখন এতদাঞ্চালের জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রস্থল ছিল। সেখানে তিনি যুক্তি, দর্শন এবং ধর্মতত্ব শিখেন এবং কাশ্মীরের আরেক বিজ্ঞ আলেম  ইয়াকুব সারফি কাশ্মীরি (রঃ) (১৫২১-১৫৯৫) এর অধীনে তাফসীর ও হাদীসের উচ্চতর কিতাবগুলো অধ্যায়ন করেন। শায়খ শারফি (রঃ) মীর সাইয়্যিদ আলী হামাদানী (রঃ) এর শায়খ ছিলেন। কাজী বাহলোল বাদখশানী তাকে আইনশাস্ত্র, এবং নবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর সিরাত  ও ইতিহাস বিষয়ে  শিক্ষা দান করেন। শায়খ আহমদ সিরহিন্দি মুজাদ্দিদে আলফে সানী (রঃ) মোগল স¤্রাট আকবরের দ্বীনে এলাহির বিরোধিতা করে ফাসির দন্ডাদেশ নিয়ে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন।কারাগারে থেকে আল্লাহর দ্বীনের দুশমনদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন গড়ে তুলেন। বাদশাহ আকবরের চেতনা ফিরে আসে এবং দ্বীনে এলাহী নামক কথিত ভ্রান্ত মতবাদ নিষিদ্ধ করে ইসলামী আইনে রাষ্ট্র পরিচালনার নিমিত্তে দেশের ইসলামী আইনজ্ঞদের দিয়ে জগদ্বিখ্যাত ফতোয়া এ আলমগীরি রচনা করান।

বাদশাহ আকবরের দ্বীন ই ইলাহী ঃ[সম্পাদনা]

ষোড়শ (১৫৮২)শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় রেনেসাঁর যুগে মুসলিম শাসক হয়েও বাদশাহ আকবরের নতুন ধর্মনীতি প্রবর্তন ভারতের ইতিহাসে একটি জঘন্যতম ঘটনা। এই সকল ধর্মের সমতা নামক কথিত বাউল ও মরমীবাদ এর সমন্বিত ধর্মীয় মতবাদ দ্বীন ই ইলাহির জন্য আকবরের গৃহশিক্ষক মরমীবাদী আবদুল লতিফ কে দায়ী করা হলেও প্রকৃত কারণটা ছিল রাজনৈতীক। মূলত সম্রাট আকবর জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল ভারতবাসীর আনুগত্য ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা নিয়ে মোঘল স¤্রাজ্য স্থায়ী করতে ১৫৮২খৃষ্টাব্দে ‘দ্বীন-ই ইলাহী’ নামে একটি নতুন ধর্মীয় মতবাদ প্রবর্তন করেন। ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ এর ভাষায়- ঞযব ১৬ঃয পবহঃঁৎু ধিং ধহ ধমব ড়ভ বহয়ঁরৎু ধহ ফড়ঁনঃ ধহফ অশনধৎ ধিং রঃং সড়ংঃ ঢ়বৎভবপঃ ৎবঢ়ৎবংবহঃধঃরাব. বিশেষতঃ আজকের যুগের মতো তখন ধর্ম চর্চার এতোটা ব্যাপকতা দেখা দিয়েছিল যে অধিক চর্চার নামে ধর্মীয় বিষয়ে মানুষের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি হতে চলেছিল। সেই সুযোগে বাতিল ধর্মচিন্তা ও ভ্রষ্টতা মানুষকে ছেয়ে ফেলেছিল। সে যুগে কবির,নানক, শ্রীচৈতন্য, রামানন্দ প্রভৃতি ব্যক্তির ভক্তিবাদ আন্দোলন আকবরের ধর্ম চিন্তাকে কিছুটা হলেও প্রভাবিত করে। সেই সাথে উদার মতাবলম্বী ও কথিত সহিষ্ণু মনােভাবাপন্ন শিয়া আলেম শেখ মুবারক এবং তার দু’পুত্র আবুল ফজল ও ফৈজির পরামর্শে আকবর ইসলাম থেকে বিচ্যুত হয়ে নতুন ধর্মমত চালুর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভারতের প্রচলিত জৈন ধর্মের ধর্মীয় গুরুদের তোষামোদও যুক্ত ছিল। জানা যায়  বাদশাহ আকবর সত্য সন্ধানে ১৫৭৫ খ্রিস্টাব্দে ফতেহপুর সিক্রিতে একটি ইবাদতখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সেখানে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী জ্ঞানী পন্ডিতদের আমন্ত্রণ জানান এবং সকল ধর্মের পন্ডিতদের কথা মনযোগ সহকারে শ্রবণ করেন। এভাবে বিভিন্ন ধর্মের মূল বাণী শ্রবণের পর তিনি একটি নতুন ধর্মমত তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন।

পানিপথের যুদ্ধ ঃ[সম্পাদনা]

মুসলিম সালতানাতের যুদ্ধ ইতিহাসের একটি প্রসিদ্ধ নাম হলো পানিপথের যুদ্ধ। ভারতের হরিয়ানা প্রদেশের পানিপথ নামক স্থানে তিনটি ভয়ঙ্কর যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল যে গুলি ইতিহাসে পানিপথ যুদ্ধ নামে পরিচিত। এই শহরটি ’উইভিং সিটি অফ ইন্ডিয়া ' নামে পরিচিত।

প্রথম যুদ্ধঃ পানিপথের প্রথম যুদ্ধ সংঘটিত হয় ১৫২৬ সালে মুঘল সম্রাট বাবর ও দিল্লির পরাক্রমশালী সুলতান ইব্রাহিম লোদীর সঙ্গে। এই যুদ্ধে মুঘল স¤্রাট  বিজয়ী হন। এই যুদ্ধে বাবর প্রথম ভারতে কামানের ব্যবহার করে ইব্রাহিম লোদীর লক্ষাধিক সৈন্যের বিরুদ্ধে লড়াাই করেও জয়লাভ করেন। বাদশাহ বাবার এর আসল নাম জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ কিন্তু তিনি বাবর বা বাবুর (সিংহ) নামেই সমধিক পরিচিতি। তিনি মাত্র ১১ বছর বয়সে এশিয়ার সমরখন্দের সিংহাসনে আরোহন করেন এবং অল্প বয়সেই দু'বার সিংহাসন হারান। তারপর তিনি নিজ দেশ ছেড়ে আফগানিস্তানের সিংহাসন অধিকার করেন এবং পরে ভারতের ইব্রাহিম লোদিকে পরাজিত করে দিল্লি অধিকার করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

২য় যুদ্ধ  সংঘটিত হয় ১৫৫৬ সালে। সম্রাট আকবর বনাম সম্রাট হেম চন্দ্র বিক্রমাদিত্যর (হেমু) সঙ্গে।এ যুদ্ধে মোঘলদের জয় হয়।

তৃতীয় যুদ্ধটি সংঘটিত হয় ১৭৬১ সালে দুররানি সাম্রাজ্য ও মারাঠা সাম্রাজ্য দ্বয়ের মধ্যে- এতেদুররানি সাম্রাজ্য বিজয়ী হয়। এই বিজয়ের ফলে দুররানি সম্রাজ্য পরবর্তী সময়ে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল। এই যুদ্ধ গুলো সম্পর্কে এখানে উপস্থাপনের কারণ হলো এই পরিস্থিতিতে তৎকালীন শিক্ষা ব্যবস্থান কি দশা ছিল তা সহজেই অনুমান করা যায়।

শাহ আব্দুর রহিম (রঃ) (১৬৮৮-১৭১৯)ঃ[সম্পাদনা]

মুসলিম ভারতে যে মাদ্রাসাটি মুসলিম শিক্ষার্থীদের আধারে আলোকবর্তিকা হিসাবে তথা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার দ্বার উম্মুক্ত করে সেটি হলো দিল্লির রহিমিয়া মাদ্রাসা।বাদশাহ আলমগীরের সময়ে রচিত বিশ্ববিখ্যাত ইসলামী আইন শাস্ত্রের কিতাব ফতোয়া ই আলমগিরীর অন্যতম একজন লেখক শাহ আবদুর রহিম (রঃ) ছিলেন এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট ফকীহ আলেম এবং আরব আজমের বিশিষ্ট আলেমদের কাছ থেকে তিনি উচ্চতর জ্ঞান লাভ করেন। এই প্রতিষ্ঠানটি মুসলিম ভারতে শিক্ষার এক বিশাল গবেষণাগার। যা মুসলিম শিক্ষার্থী ও পরবর্তিতে ইসলামী স্কলারদের গবেষনার সুতিকাগার।বৃটিশ স¤্রাজ্যবাদীরা এটির অস্তিত্ব বিলীন করে দেয়। শাহ আব্দুর রহিম (রঃ) ছিলেন শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভীর পিতা। মুসলিম ভারতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থার ধারায় বাগদাদের নেজামুল মুলক তুসির মাদ্রাসার পর ভারতে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর বিশ্বময়তা তখন ছিল এর মধ্যে পাকিস্তানের (তখনো ভারত) মুলতান ও দিল্লির রহিমিয়াও ছিল অন্যতম।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) (১৭০৩-১৭৬২)[সম্পাদনা]

ইলমে হাদীসের চর্চা ও এর বিকাশে মুসলিম ভারতে অবদান রাখার ক্ষেত্রে যাদের নাম প্রথম সারিতে আসে  তাদের মধ্যে হলেন মুসলিম দার্শনিক শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)। ভারতবর্ষে ইসলামী আন্দোলন ও ইসলামী শিক্ষা বিস্তার বলুন এর প্রেরণার বাতিঘর বলে যাকে সকলেই সমীহ করেন এবং ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারা বলে তৃপ্তি লাভ করেন তিনিই হলেন ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)। তাঁর পূর্ণ নাম কুতুবউদ্দিন আহমেদ ইবনে আবদুর রহিম। কিন্তু তিনি শাহ ওয়ালিউল্লাহ নামেই খ্যাতি লাভ করেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) ভারতের মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষ মুহূর্তে ভারতের উত্তর প্রদেশের মুজফফর নগরের ফুলাত শহরে ২১ ফেব্রæয়ারী ১৭০৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন (তাঁর জন্মের চার বছর পরে, আওরঙ্গজেব মারা যান)। তাঁর জন্ম নাম ছিল কুতুবউদ্দীন।

শিক্ষা জীবনঃ[সম্পাদনা]

চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রঃ) তাঁর দাদার কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেছিলেন। তার বয়স যখন মাত্র পাঁচ বছর তখন শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইসলামী শিক্ষার সাথে পরিচয় হয়। দুই বছর পরে তিনি পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করতে পারেন।এই সময়ে তিনি তাফসীর, হাদিস, আধ্যাত্মিকতা, রহস্যবাদ,অধিবিদ্যা,যুক্তি এবং ইলম-উল-কালাম সম্পর্কেও জ্ঞান অর্জন করেছিলেন।এরপর ফারসি ও আরবি ভাষার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে তিনি এক বছরে তার পাঠ শেষ করতে সক্ষম হন। এর পরে তিনি ব্যাকরণ এবং বাক্য গঠনে মনোনিবেশ করেন। সর্বোপরি তিনি চিকিৎসা নিয়েও পড়াশোনা করেছিলেন। ১৭৩০ সালে শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রঃ) আরবে উচ্চতর পড়াাশোনা শুরু করেন। তিনি মক্কা এবং মদীনায় নামকরা দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশােনা করেছিলেন, যেখানে তিনি একজন স্বনামধন্য আলেম হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। সব মিলিয়ে তিনি ১৪ বছর মদীনায় পড়াশোনা করেছিলেন, যেখানে তিনি হাদীসে তাঁর সনদ অর্জন করেছিলেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) কেবল আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতির গভীর উপলব্ধিই রাখতেননা বরং তিনি অর্থনীতির গভীর প্রভাবও স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি ছিলেন ভারতীয় মুসলিম ধর্মীয় নেতা এবং প্রভাবশালী ইসলামি সংস্কারক।যিনি এশিয়ার মুসলিম সমাজকে নতুনভাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। শাহ ওয়ালীউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) ছিলেন হানাফী মাজহাবের অনুসারী একজন পনিডত ও লেখক গবেষক। তিনি ৫১টি গুরুত্বপূর্ণ ইসলামিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। পিতার ইন্তেকালের পর তিনি রহিমিয়া মাদ্রাসা পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তার আমলেই মাদ্রাসা ই রহিমিয়া এতদাঞ্চলের ইসলামী স্কলারদের জ্ঞানার্জনের এক সূতিকাগারে পরিণত হয়।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভীর মিশন ঃ[সম্পাদনা]

ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলিম সমাজ সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আধ্যাত্মিকভাবে বিশৃঙ্খলায় ছিল। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) সমস্যার কারণ চিহ্নিত করে যথাযথ প্রতিকারের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি মুসলিম সমাজে একীভূত হয়ে ওঠা এমন অনৈসলামিক রীতিনীতি সম্পর্কে সমালোচনা করেছিলেন,বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যা মুসলিম সমাজে হিন্দু ধর্মের সংস্পর্শে থাকার কারণে এসেছিল। বিশেষত,তিনি অযৌক্তিক বিবাহ অনুষ্ঠানএবং উৎসবগুলির নিন্দা করেছিলেন।এছাড়াও, তিনি মুসলিম সমাজে অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের কারণগুলি নির্ধারণ করেছিলেন এবং সম্পদের বৃহত্তর বন্টন সহ যথাযথ পরিবর্তনগুলির প্রস্তাব করেছিলেন। এটি এমন একটি ধারণা যা কার্ল মার্ক্সের অর্থনৈতিক তত্বগুলির পূর্বাভাস করেছিল যিনি উনিশ শতকের দার্শনিক এবং অর্থনীতিবিদ। তিনি পুঁজিবাদকে অবজ্ঞা করেছিলেন এবং সাম্যবাদের পিতা হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

কোরআনকে সহজবোধ্য করতে প্রথম ফার্সি অনুবাদ ও ব্যাখ্যা ঃ[সম্পাদনা]

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) রাজনীতি,অর্থনীতি,সমাজনীতি,রাষ্ট্র নীতি নিয়ে শুধু তার দার্শনিক উপস্থাপনে সীমাবদ্ধ থাকেননি তিনি এতদাঞ্চলীয় মুসলমানদের মধ্যে কোরআনকে সহজবোধ্য করার জন্য এর ফার্সি অনুবাদ ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাও করেন। কারণ তখন এতদাঞ্চলের মানুষের সাধারণ ভাষা ছিল ফার্সী। শাহ ওয়ালিউল্লাহ কেবল আঞ্চলিক ও জাতীয় রাজনীতির গভীর উপলব্ধিই রাখেননি,তিনি অর্থনীতির গভীর প্রভাবও স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি যা দেখেছিলেন তার উপর ভিত্তি করে তিনি আর্থসামাজিক ভারসাম্য ধারণার প্রচার করেছিলেন এবং ধন-সম্পদের সঞ্চারকে অবহেলা করেছিলেন। এবং এটিকে মূলতঃ বিশ্বের সমস্ত অশুভের প্রবাদকূপ হিসাবে দেখেন। অধিকন্তু তিনি এমন একটি সামাজিক শৃঙ্খলার পক্ষে ছিলেন যা সাম্য, ভ্রাতৃত্ব এবং ভ্রাতৃত্বের ইসলামি নীতিগুলিকে মেনে চলে।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর রচনা ঃ[সম্পাদনা]

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভীর সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা হলো ‘হুজ্জাতুল্লাহ-ইল-বালিগাহ’। রচনাটির একটি অধ্যায়ে তিনি পুঁজিবাদের কুফল সম্পর্কে বর্ণনা করেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী) (রঃ)বিশ্বাস করতেন যে, রোমান ও সাসানিয়া সাম্রাজ্যের পতনের কারণ ছিল অর্থনীতি ও সমাজতত্ব সম্পর্কিত তার অনেক তত্বই এখন বিপ্লবী হিসাবে বিবেচিত। শাহ ওয়ালিউল্লাহকে কার্ল মার্ক্সের (কধৎষ গধৎী) অগ্রদূত হিসাবে বিবেচিত করা হয়।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) দেখছিলেন  দরিদ্রদের শোষণের নমুনা। দরিদ্রদের শোষণ করাকে তিনি রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের রূপক হিসাবে দেখতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিপ্লব হবে শান্তিপূর্ণ ও বৌদ্ধিক প্রকৃতির। তিনি শান্তিপূর্ণ এবং বৌদ্ধিক বিপ্লবের প্রয়োজন অনুভব করেছিলেন।

শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রঃ) রচিত আরেকটি বই হলো ‘ইজালাতুল-খিফা।শাহ ওয়ালিউল্লাহ’র রাজনৈতিক বিপ্লব সম্পর্কে যে ভাবধারা লালন করতেন তা পুরোপুরি বর্ণনা করা হয় এই রচনায়। মুসলিম সমাজের জন্য তার আদর্শিক দৃষ্টিভঙ্গি এমন ছিল যে, সাধারণ মানুষ নিজেদের বিষয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন থাকবে এবং এর শাসকরা তাদের সিদ্ধান্ত গুলো নিবেন পবিত্র কুরআনের উপর ভিত্তি করে। বইটিতে তিনি মুঘল শাসক এবং ভারতের বিলাসিতাপ্রিয় অলস ধনী ব্যক্তিদের সমালোচনা করেছিলেন। শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) তার মিশন বাস্তবায়নে থাকাকালেই  ২০আগস্ট, ১৭৬২ ঈসায়ী ইন্তেকাল করেন।

দেহলভী চিন্তাধারার সফল রূপকার মহান সংস্কারক সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ)[সম্পাদনা]

মাওলানা সায়িদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) এর জীবনের প্রতিটি অধ্যায় বিশেষতঃ তাঁর শিক্ষার্জনের উচ্চাকাঙ্খা গবেষণা ও সমাজসংস্কারের চিন্তা ভাবনায় কোরআনের সহজবোধ্য উপস্থাপনের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারে বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থা অবলম্বন। বিশেষতঃ সমকালীন বিশ্বে প্রচলিত ভ্রান্ত রাজনীতি সমাজনীতি,অর্থনীতি মুসলিম সমাজকে গ্রাস করে ফেলেছিল দেখে মাওলানা মাওদুদী  ঈমানী চেতনায় ব্যাকুল হলেও বিচলিত বা নিরাশ হননি। আশায় বুক বেধে আল্লাহর উপর ভরসা করেই তাফহীমুল কোরআন লেখেন। রাসাঈল ও মাসায়েল লেখেন,তাফহীমাত লেখেন,আল জিহাদ ফী সাবিলিল্লাহ সহ এক বিশাল সাহিত্য ভান্ডার। সেই সাথে ময়দানী আন্দোলন জোরদার করতে প্রতিষ্ঠা করেন জামায়াতে ইসলামী নামক এবটি সংস্কার আন্দোলন যার গন্তব্য ইক্বামতে দ্বীন আর উদ্দেশ্য আল্লাহর রেজামন্দি। এ জন্যই নিঃসঙ্কুচ বলা যায় যে মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী রঃ এর সংস্কার আন্দোলন ছিল শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর সংস্কার আন্দোলনের ই ধারাবাহিকতা।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ঃ[সম্পাদনা]

ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার জন্য ষোড়শ শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত হয় জয়েন্ট-স্টক কোম্পানি বা "ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি"। ১৬০০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাণী প্রথম এলিজাবেথ এই কোম্পানিকে ভারতীয় উপমহাদেশে বাণিজ্য করার রাজকীয় সনদ প্রদান করেছিলেন। এ সনদ কোম্পানিটিকে ১৫ বছর পর্যন্ত পূর্ব ভারতে একচেটিয়া বাণিজ্য করার প্রাধিকার অর্পণ করেছিল। তবে পরবর্তীকালে এ কোম্পানি ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে এবং ১৮৫৮ সালে বিলুপ্ত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করেছিল। অত:পর ব্রিটিশ সরকার সরাসরি ভারত শাসন শুরু করে।

মীর জাফর পুরো নাম সৈয়দ মীর জাফর আলী (১৬৯১-১৭৬৫) সমগ্র উপমহাদেশে ব্রিটিশ সম্রাজ্য বিস্তারের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। ভূতপূর্ব নবাব সিরাজউদ্দৌলা নদীয়ার পলাশীর কাছে যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হন। মীর জাফর ছিলেন উক্ত যুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এবং প্রধান বিশ্বাসঘাতক। ইসলামের ইতিহাসে এজিদের নামের পরেই ভারতবর্ষের মোসলমানদের কাছে ক্বিয়ামত পর্যন্ত যে নামটি ঘৃণাভরেই নেয়া হয়।

পলাশীর যুদ্ধঃ (১৭৫৭)[সম্পাদনা]

১৭৫৭ সালের  ভারতবর্ষের রাজনীতির একটি বেদনাদায়ক দিন। এই দিন পলাশির আ¤্রকাণনে মুসলিম সুলতানাতের পতন ঘটে স¤্রাজ্যবাদী বৃটিশ ও তাদের দোসর বিশ্বাস ঘাতক মীরজাফর আলী ও ঘষেটি বেগমদের ষড়যন্ত্রে সম্মুখ সমরে। ঐতিহাসিক বিবরণ অনুযায়ী- ১৭৫৭ সালের ১২ জুন কলকাতার ইংরেজ সৈন্যরা চন্দননগরের সেনাবাহিনীর সঙ্গে মিলিত হয়। সেখানে দুর্গ রক্ষার জন্য অল্প কিছু সৈন্য রেখে তারা ১৩ জুন অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে যুদ্ধযাত্রা করে। কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদের পথে হুগলি, কাটোয়ার দুর্গ, অগ্রদ্বীপ ও পলাশীতে নবাবের সৈন্য থাকা সত্বেও তারা কেউ ইংরেজদের পথ রোধ করল না। নবাব বুঝতে পারলেন, সেনাপতিরাও  সিরাজুদ্দৌলার পতনের এ ষড়যন্ত্রে শামিল। এর পরও নবাব সিরাজুদ্দৌলা মীরজাফরআলীকে ক্ষমা করে দিয়ে নতুন শপথ করিয়ে আবার যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেন। আল্লাহর কালাম কোরআন মজিদ স্পর্শ করে শপথ নিয়ে মীরজাফর আলী পলাশির আমবাগান জমায়েত ইংরেজবাহিনীর সাথে যুদ্ধ না করে পিছু হঠেযায়। নবাব বাহিনীর আক্রমনে ক্লাইব বাহিনী পিছু হটে আম বাগানে আত্মগোপন করে। মীরমদন সহ অন্যরা আক্রমন জোরদার করলে ক্লাইব বাহিনী বিচলিত হয়ে পড়ে। এ সময় আক্রমন জোরদার না করে মীরজাফর তার বাহিনীকে নিয়ে ফিরে আসে যুদ্ধ বিরতী ঘোষণা করে। এ সময় মীর মদন গোলার আঘাতে নিহত হলে ক্লাইব বাহিনী নবাবের ছাউনিতে আক্রমণ করে তা দখল করে নেয়। নবাব রাজধানী রক্ষার তাগীদে মুর্শিদাবাদের দিকে রওয়ানা দিলেও মীরজাফর এই পথে না গিয়ে রাজধানী সুরক্ষা না করে রাজধানীতে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নেয়। নবাবকে বন্দী করার সংকল্প নিয়ে গেলে নবাব কে পাওয়া যায়নি। এ দিকে নবাববের নৌকা নাজিমপুরের ভাটায় চরে আটকা পড়ে গেলে তিনি আর অগ্রসর হতে পারেননি। ৪ জুলাই (মতান্তরে ৩রা জুলাই) বাজারে খাদ্য কিনতে গেলে মীর জাফরের গোয়েন্দারা তাকে ধরিয়ে দেয়। মীরজাফরের আদেশে তার পুত্র মিরনের তত্ত্বাবধানে মুহম্মদীবেগ নামের এক ঘাতক সিরাজদ্দৌলাকে হত্যা করে। কথিত আছে, সিরাজের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। মুর্শিদাবাদের খোশবাগে নবাব আলিবর্দী খানের কবরের কাছে তাকে কবর দেয়া হয়।

এর আগে মুর্শিদকুলী খানের জামাতা সুজাউদ্দিন মুহাম্মদ খান ১৭২৭ থেকে ১৭৩৯ পর্যন্ত সুবাহ বাংলার নবাব হিসেবে মুর্শিদাবাদ থেকে বাংলা শাসন করছিলেন। এক দুর্যোগময় পরিস্থিতিতেই আলিবর্দি খাঁ ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন। চারদিকে শুরু হয় প্রচন্ড অরাজকতা এবং ষড়যন্ত্র। ইংরেজরা নবাবের অনুমতি না নিয়েই কলকাতায় দুর্গ সংস্কার করা শুরু করে। রাজবল্লভ ঘসেটি বেগমকে সহায়তা করার জন্য পুত্র কৃষ্ণবল্লভকে ঢাকার রাজকোষের সম্পূর্ণ অর্থসহ কলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পাঠান। এ রকম পরিস্থিতিতেই ১৭৫৬ সালের ১০ এপ্রিল শাহ কুলি খান মির্জা মোহাম্মদ হায়বৎ জং বাহাদুর ওরফে সিরাজ-উদ-দৌলা  বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করেন।

বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর (১৬৯১- ১৭৬৫)[সম্পাদনা]

ইতিহাসে মীর জাফর একটি ঘৃণিত নাম বিশ্ববিখ্যাত বিশ্বসঘাতক হওয়ার কারণে। মীর জাফর এর পুরো নাম সৈয়দ মীর জাফর আলী খান (১৬৯১- ১৭৬৫)। বর্তমানে ভারতীয় উপমহাদেশে মীর জাফর নামটি বিশ্বাসঘাতকতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মুর্শিদাবাদের তার বাড়িটি নিমক হারাম দেউরি (বিশ্বাসঘাতকের ঘর) নামে পরিচিত। মীরজাফর এতটাই বিশ্বাসঘাতক ছিল যে এখনও কেউ অবিশ্বাসী হলে তাকে মীরজাফরের সাথে তুলনা করা হয়।বিশ্বাস ঘাতকতা করে পলাশির আ¤্রকাণনে নবাব বাহিনীর সেনাপ্রধান হয়েও সৈন্য পরিচালনা না করে শিবিরে ফিরিয়ে এনে নবাবী দখল করতে চায়। ইংরেজদের সাথে মীর জাফরের এই মর্মে একটি চুক্তি ছিল যে, যুদ্ধে ইংরেজরা জয়ী হলে মীর জাফর হবে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব হবে। তার অধীনের সৈন্যবাহিনী যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা ও তার বাংলা-বিরোধী পদক্ষেপের জন্য বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে পরাজয় বরণ ও নির্মম ভাবে নিহত হতে হয়। বিনিময়ে মীর জাফর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে পাঁচ লক্ষ পাউন্ড ও কলকাতায় বসবাসকারী ইউরোপীয়দের আড়াাই লক্ষ পাউন্ড প্রদান করবে। ১৭৫৭ সালে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত সিংহাসনচ্যুত ও নিহত হলে মীর জাফর বাংলার নবাব হয় বটে কিন্তু ব্রিটিশদের দাবীকৃত বিপুল অর্থের যোগান দিতে সে সমর্থ হয়নি। ১৭৫৮ সালে রবার্ট ক্লাইভ তার প্রতিনিধি খোজা ওয়াজিদের মাধ্যমে জানতে পারে যে, মীর জাফর চিনশুরায় ওলন্দাজদের সাথে একটি চুক্তি করেছে। হুগলি নদীতে ওলন্দাজ জাহাজের আনাগোনা দেখতে পাওয় যায়। এসব কিছু চুঁড়ান্ত যুদ্ধের পটভূমি সৃষ্টি করে।

ব্রিটিশ কর্মকর্তা হেনরী ভেন্সিটার্ট মীর জাফরের কাজে সহায়তা করার জন্য তার জামাতা মীর কাশিমকে বাংলার সহকারী সুবাদার নিয়োগ করার জন্য প্রস্তাব করেন। ১৭৬০ সালে কোম্পানি মীর জাফরকে মীর কাশিমের নিকট ক্ষমতা অর্পণ করতে বাধ্য করে। মীর কাশিম ছিলেন একজন স্বাধীনচেতা ব্যক্তি এবং তিনি বাংলাকে স্বাধীনভাবে শাসন করার ইচ্ছা পোষণ করতেন। এ নিয়ে ইংরেজদের সাথে তার দ্বন্ধ শুরু হয় এবং ১৭৬৩ সালে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে পুনরায় মীর জাফরকে নবাব করা হয়। ক্ষমতাচ্যুত নবাব এই সিদ্ধান্ত মেনে নেননি। তিনি কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। মীর জাফর ১৭৬৫ সালের ৫ ফেব্রæয়ারী তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার জাফরগঞ্জ কবরস্থানে তার সমাধি আছে।

শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) ১৭৪৬- ১৮২৪)[সম্পাদনা]

শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) ছিলেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভীর (রঃ) জ্যাষ্ঠপুত্র।১১ অক্টোবর ১৭৪৬ ঈসায়ী মোতাবেক ২৫ রমজান ১১৫৯ হিজরী সনে মুঘল সম্রাট মুহাম্মাদ শাহের (১৭১৯-১৭৪৮) শাসনামলে দিল্লীতে জন্মগ্রহণ করেন। দিল্লী ছিল তখন মুঘল সাম্রাজ্যের রাজধানী। তার পিতা শাহ ওয়ালিউল্লাহ যখন মারা যান তিনি তখন মাত্র ১৭ বছরের যুবক। রহিমিয়া মাদ্রায় পিতার তত্বাবধানেই তাঁর লেখাপড়া। পিতার মৃত্যুর পর তিনি হাদীসের শিক্ষক হিসেবে পিতার উত্তরাধিকারী হন এবং পরবর্তীকালে দিল্লির বিখ্যাত মুহাদ্দীসে পরিণত হন। তিনি একাধারে মুহাদ্দিস, মুফাসসির এবং মুজাদ্দিদ বা সংস্কারক ছিলেন। তিনিই পিতার আদলে কোরআনকে মানুষের কাজে সহজবোধ্য করে উপস্থাপনের উদ্দেশ্যে ফার্সি ভাষায় তাফসীরে আজিজিয়া বা ফাতহুল আজিজ নামে একটি তাফসীর লিখেন। এ ছাড়াও বিখ্যাত ফতোয়া এ আজিজিয়াও তাঁর অমর কীর্তি। তার ছাত্রদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেনÑ

# মাওলানা সৈয়দ শাহ আলে রাসুল মারহারাভী কাদেরী # সায়্যিদ আহমাদ শহীদ # শাহ ইসমাইল শহীদ # মাওলানা হাইদার আলি, ফাইজাবাদ # গুলাম আলী দিহলাবী # মাওলানা ফজলে হক খাইরাবাদী # মাওলানা মাহবুব আলী দেহলভী # মুফতি সদরুদ্দীন আজুরদাহ # মাওলানা মুহাম্মাদ আলী # মাওলানা আহমাদ আলী # মাওলানা কারামাতুল্লাহ মুহাদ্দিস আলিপুরী।

দারুল হারব ঘোষণা[সম্পাদনা]

শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ) বৃটিশ শাসিত ভারতকে দারুল হারব ঘোষণা করে মোসলমানদের বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে উদ্ভুদ্ধ করেন। আর তখন থেকেই মোসলমানরা স্বশস্ত্র জেহাদে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। বৃটিশ বেনিয়ারা বে পরোয়া ভাবে মোসলমান বিশেষত আলেম উলামাদের গণহারে হত্যকরে সকল মসজিদ মাদ্রাসা জ্বালিয়ে দিতে থাকে। মোসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ আলকোরআন আল্লাহর কালামের সকল মুদ্রণকপি পুড়িয়ে দিতে থাকে। আর এ ভাবেই  ভারতবর্ষ কে ইসলাম ও মোসলমান মুক্ত করতে বৃটিশরা একর পর এক গণহত্যা চালাতে থাকে।

শাহ ইসমাইল শহীদ (রঃ) (১৭৭৯ -১৮৩১)[সম্পাদনা]

শাহ ইসমাইল শহীদ ছিলেন একজন ভারতীয় ইসলামী পন্ডিত। উনিশ শতকে পাঞ্জাবের শিখ রাজ্যের বিরুদ্ধে সৈয়দ আহমদ বেরলভির ডাক দেয়া জেহাদের তিনি একজন যোদ্ধা ছিলেন। তিনি আহলে হাদিস,তাবলগী জামায়াত এবং দেওবন্দীদের কাছেও সন্মানিত ব্যাক্তিত্ব। শাহ মুহাম্মদ ইসমাইল ছিলেন শাহ আবদুল গনি মুহাদ্দীসে দেহলভীর একমাত্র পুত্র ও শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভীর নাতি। শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ রফিউদ্দিন মুহাদ্দিসে দেহলভী ও শাহ আবদুল কাদির মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ) তার চাচা ছিলেন।শাহ ইসমাইল দেহলভী (রঃ) ২৬ এপ্রিল ১৭৭৯ খ্রিষ্টাব্দ জন্মগ্রহণ করেন।  প্রচলিত কিছু সূফি কর্মকান্ডের জবাবে তিনি “তাকবিয়াতুল ঈমান” নামক গ্রন্থ রচনা করেন। তবে তিনি নিজেও তাসাউফ পন্থি হওয়া সত্বেও প্রচলিত সুফিবাদের মধ্যকার কু সংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি এটি লিখেছিলেন। তিনি সৈয়দ আহমদ শহীদের অনুসারী ছিলেন। সৈয়দ আহমদ শহীদ ও শহীদ ইসমাইল শহীদ তাদের সঙ্গী মুজাহিদ, বালাকোটের ৬টি সোয়াতি গোত্র ও কাঘানের সৈয়দদের সহায়তায় বেশ কিছু বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেন ও শিখদের বিরুদ্ধে লড়াাই করেন।  ১৮৩১ সালের ৬ মে সৈয়দ আহমদ শহীদ ও শাহ ইসমাইল শহীদ কয়েক’শ অনুসারী বালাকোটের যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেন। তাদেরকে বালাকোটে দাফন করা হয়। তবে সৈয়দ আহমদ শহীদের মৃতদেহ খুজে পাওয়া যায়নি বলেই তার সমাধি কোথায় তা নিশ্চিতে বলা যায়না।

সৈয়দ আহমদ বেরেলভি (রঃ) (১৭৮৬-১৮৩১)[সম্পাদনা]

সৈয়দ আহমদ বেরেলভি (রঃ) ১৭৮৬ সালের ২৯ নভেম্বর উত্তর প্রদেশের রায় বেরেলিতে জন্মগ্রহণ করেন। ১৮০৪ সালে দিল্লি গিয়ে শাহ আবদুল কাদির মুহাদ্দীসে দেহলভীর (রঃ) কাছে আরবি-ফারসি ভাষায় বুৎপত্তি অর্জন করে নবাব আমির খানের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।কিন্তু কয়েক বছর পর আমির খান ইংরেজদের সাথে সন্ধি সূত্রে আবদ্ধ হওয়ায় তিনি শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দীসে দেহলভীর খেদমতে হাজির হন। তিনি আধ্যাত্মিক সাধনায় অনেক উচ্চশিখরে আরোহণ করেছিলেন। শাহ আব্দুল আজিজ (রঃ) এর ভ্রাতুষ্পুত্র শাহ ইসমাইল ও জামাতা মাওলানা আবদুল হাই তার হাতে বায়াত গ্রহণ করেন। তার দাওয়াতে প্রায় ৪০ হাজার হিন্দুসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী ইসলাম গ্রহণ করেন। ১৮২২ সালে তিনি ৭৫৩ জন যাত্রী নিয়ে পবিত্র মক্কা নগরীতে যান। হজ করে ১৮২৪ সালে রায় বেরেলি ফিরে আসেন।  মুসলিম সমাজে যেসব কুসংস্কার, গোঁড়ামি, অনৈসলামিক রীতি-রেওয়াজ ঢুকে পড়েছিল; সেগুলো দূর করে ইসলামি রাষ্ট্র ও সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন। সীমান্ত প্রদেশের নওশেরায় স্থানীয় শাসক, সরদার ও সাধারণ জনতা তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ৯০০ মুজাহিদ একটি বৃহৎ শিখবাহিনীকে পরাজিত করেন। এতে মুজাহিদ বাহিনীর প্রভাব চার পাশে ছড়িয়ে পড়ে। দিন কাটত তাদের যুদ্ধের ময়দানে আর রাত কাটত জায়নামাজে। কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন। সর্বদাই তারা একমাত্র আল্লাহর ওপরই নির্ভর করতেন। বলা হয়ে থাকে বালাকুটের চেতনায় উজ্জীবিত মুসলিমদের বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্বে নিয়ে । অবশেষে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা এ দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। অথচ উপমহাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবনদানকারী এ মহান শহীদেরা আজো উপেক্ষিত।

ঐতিহাসিক বালাকোট যুদ্ধ[সম্পাদনা]

১৮৩১ সালের ৬ মে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বালাকোট প্রান্তরে শাহাদতবরণ করেন সৈয়দ আহমদ বেরেলভি ও শাহ ইসমাইল শহীদ সহ ১৩৫ জন মুজাহিদ। মুসলিম বাহিনীর পক্ষে ছিলেন মাত্র ৯০০ মুজাহিদ,অন্য পক্ষে ছিল আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ও প্রশিক্ষিত ২০ হাজারের বিশাল শিখ সৈন্য বাহিনী এবং স্থানীয় বিশ্বাসঘাতক চক্র। বালাকোট যুদ্ধের প্রধান ছিলেন সৈয়দ আহমদ বেরেলভি (রঃ)।

বালাকোটের যুদ্ধ পর্যন্ত ১১টির অধিক যুদ্ধে মুজাহিদ বাহিনী শত্রæর মোকাবেলা করেছিলেন। মুসলিম বাহিনী ৩০ হাজার শিখ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করে। প্রায় এক লাখ স্থানীয় মুজাহিদ সাইয়েদ আহমদের পতাকাতলে সমবেত হন। কিন্তু শিখ সেনাপতি বুধ সিংহের প্রলোভনে পেশোয়ারের সরদারেরা ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। তারা সাইয়েদ আহমদকে বিষপানের মাধ্যমে হত্যা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়। সম্মুখসমরেও তারা শিখদের সাথে যোগ দেয়। ফলে মুজাহিদ বাহিনী পরাজিত হয়।

সৈয়দ আহমদ বেরেলভি আন্দোলনের আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল এ উপমহাদেশকে ব্রিটিশ শাসনমুক্ত করা। তাদের পথ ধরেই স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছেন উপমহাদেশের মানুষ।

ভারত থেকে ব্রিটিশ বেনিয়াদেরকে খেদিয়ে এখানে ইসলামি হুকুমাত কীভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, সে-নিয়ে ছোটবেলা থেকেই ভাবতেন সৈয়দ আহমদ বেরেলভী (রঃ) । ছোটবেলা থেকেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন রণকৌশলে পারদর্শী একজন দক্ষ যোদ্ধা। বড় হবার পর শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভির সাহচার্যপ্রাপ্ত হয়ে তাঁর সেই চেতনাকে আরও ঝালিয়ে নেন। তরিকায়ে মুহাম্মদিয়া আন্দোলন যখন সাড়া ফেলে দিলো সমগ্র ভারত জুড়ে, সাইয়িদ আহমদ শহিদ তখন তাঁর চূড়ান্ত চিন্তার কথা ভাবলেন। এ দেশকে বিদেশি বেনিয়াদের দখলদারি থেকে মুক্ত করে এখানে ইসলামি হুকুমত প্রতিষ্ঠা করতে হবে।এই চিন্তা থেকে তাঁর একান্ত অনুসারীদের নিয়ে সাহসী তেজোদ্দীপ্ত এবং জানবাজ একটি মুজাহিদ বাহিনী তৈরি করেন। যাঁরা ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে সদা প্রস্তুত থাকত। সৈয়দ আহমাদ বেরেলভী (রঃ) তৎকালীন ভারতের অভ্যন্তরে তাঁর যুদ্ধ পরিচালনার কেন্দ্র স্থাপন করেননি,এটা তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতারই পরিচায়ক। বরং তিনি তাঁর জিহাদের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য প্রচারসহ বিভিন্ন স্থানে সফর করে এবং যুদ্ধকেন্দ্র হিসাবে আফগানিস্তানকে মনোনীত করে অবশেষে তথায় পৌঁছে যান। সঙ্গে নিয়ে যান তাঁর জানবাজ মুজাহিদ বাহিনী, সেখানেও যাবার পর স্থানীয়রাও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মুজাহিদ বাহিনীতে নাম লেখায়। আফগানিস্তানের কান্দাহার, কাবুল অতিক্রম করে জানবাজ এ মুজাহিদ কাফেলা নিয়ে সাইয়িদ আহমদ খেশগিতে উপস্থিত হন এবং সেখান থেকে ১৮ই সেপ্টেম্বর ১৮২৬ নওশহরে অবস্থান গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি অত্যাচারী শিখ রাজা বুখ্য সিং-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রথমে কর বা জিজিয়া প্রদানের প্রস্তাব দেন। এরপরই একজন সংবাদবাহক এসে খবর দেয় যে, বুখ্য সিং সৈন্য নিয়ে আকুতভয় প্রবেশ করেছে। একথা শুনে সকলকে প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ প্রদান করেন। মুসলিম বাহিনীর নৈশকালীন অতর্কিত হামলায় সাত,শ শিখ সেনা নিহত হয় এবং মুসলমানদের পক্ষে ৩৬ জন ভারতীয় ও ৪৫ জন কান্দাহারী মুজাহিদ নিহত হন এবং আরও ৩০/৪০ জন আহত হন। এই যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়েই মুসলমানদের সাহস, আগ্রহ-উদ্দীপনা শতগুণে বেড়ে যায়। কান্দাহার পেশোয়ারের বড় একটি অংশ জুড়ে সৈয়দ আহমদ শহিদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসলামি হুকুমত।

ইসলামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন ঃ[সম্পাদনা]

পেশওয়ার থেকে পাঞ্জতার আসার পর স্থানীয় সর্দারগণ সৈয়দ সাহেবকে অভ্যর্থনা জানান এবং তাঁর নিকট বাইয়াত গ্রহণ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। পাঞ্জতার ও তার পার্শ্ববর্তী বিরাট এলাকায় মুসলিম জনবসতি ছিল। সৈয়দ সাহেব বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সর্দারদেরকে সাধারণ বাইয়াত না করিয়ে শরীয়তের বাইয়াত করালেন এবং বললেন, এ এলাকার সব অধিবাসী মুসলমান। এখানে নির্বিঘেœ শরীয়তের হুকুম চালু করা যায়। আপনারা যদি এ এলাকায় শরীয়তের আইন চালু করেন, তাহলে আমি এখানে থাকবো। আর না হয় অন্যত্র চলে যাবো। সৈয়দ সাহেবের এই শর্তের পরিপ্রেক্ষিতে ১২৪৪ হিজরীর পহেলা শাবান পাঞ্জতারে আলেম ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের এক সভা আহবান করা হয়। সভায় সীমান্তের খান ও আমীরগণ চাড়াও প্রায় দুহাজার আলেম উপস্থিত হন। যীদার আশরাফ খান এবং হান্ডের খাবে খানও এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। অত্র এলাকায় শরীয়তের আইন চালু করার ব্যাপারে এ সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জুমার নামাজের পর সকল খান, আমীর ও আলেমগণ সৈয়দ সাহেবের নিকট শরীয়তের বাইয়াত গ্রহণ করেন। বাইয়াত গ্রহণের সময় লিখিত শপথ নামা পাঠ করানো হয়। শপথ নামায় ছিল-

(১) শরীয়তের বিধি বিধান মেনে চলার প্রতিশ্রæতিতে স্বেচ্ছায় সৈয়দ সাহেবকে ঈমাম মনোনীত করে তাঁর হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলাম।

(২) এ এলাকায় শরীয়ত বিরোধী কাজ বন্ধ করে শরীয়তের হুকুম প্রতিষ্ঠা করবো।

(৩) ইমাম মনোনীত করার পর তার বিরোধিতা করা সাংঘাতিক অপরাধ। বিরোধিতার সীমা অতিক্রম করলে তার মোকাবিলায় অস্ত্র ধারণ সকল মুসলমানের উপর ফরজ। এতে শরীয়ত প্রতিষ্ঠাকারী কেউ মারা গেলে শহীদ, শরীয়ত বিরোধী কেউ মরা গেলে পাপী এবং দোযখী বলে গণ্য করা হবে।

(৪) ইতোপূর্বেও আমরা বাইয়াত গ্রহণ করেছি। আজ আলেমদের সম্মুখে নতুন করে বাইয়াত গ্রহণ করলাম। সৈয়দ সাহেব আমাদের জন্য দোয়া করবেন, যেন আমাদের মরা বাঁচা শুধুমাত্র ইসলামের জন্য হয়।

এই ঐতিহাসিক বাইয়াতের পর সীমান্তের বিরাট এলাকায় ইসলামী শরীয়ত চালু হয়। ক্ষুদ্র একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে, যার নেতৃত্বে ছিলেন সৈয়দ আহমদ বেরলভী। শরীয়তের বিধান চালু হবার পর পুরো এলাকায় শান্তি স্থাপিত হলো। একের উপর অপরের জুলুম বন্ধ হলো। জুলুম করে পলায়নের পথ বন্ধ হলো। কাজী নিযুক্ত করে বিচার ফায়সালা শুরু হলো। উৎপাদিত ফসলের একদশমাংশ(ওশর) আদায়ের ব্যবস্থা করা হলো। খারায ও যাকাত আদায় এবং বণ্টনের জন্য ব্যবস্থা গৃহীত হলো। এ ভাবে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও এই উপমহাদেশের এক কোনে একটি ক্ষুদ্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। উইলিয়াম হান্টার এই ক্ষুদ্র ইসলামী রাষ্ট্রটিকে জেহাদি বসতি বলে আখ্যায়িত করেছেন। এখানে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর স্থানীয় মাতব্বর শ্রেণী ও কিছু স্বার্থপর লোক এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। এক সময় এটাও ইংরেজদের দালাল কতিপয় মুসলিম আর বিশ্বাস ঘাতক দালাল শিখদের ষড়যন্ত্রের বিষফলে তা তছনছ হয়ে যায়।

বালাকোট- বিপর্যয় ও কারণ :[সম্পাদনা]

বালাকোট দেখেছি। সেই সাথে সৈয়দ আহমদ বেরেলভি শহীদ বর্তমান পাকিস্তানের যেসব জায়গায় ঘুরেছিলেন সেসব জায়গাও। পেশোয়ার, সোয়াত তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য। সৈয়দ সাহেব বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ ও লখনৌ শহরের মাঝে রায়বেরেলি শহরে ১৭৮৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। পরবর্তিতে দিল্লী বাংলা, মক্কা-মদীনা সফর করেন। সৈয়দ সাহেব ও তাঁর অনুসারীদের অমুসলিমরা ‘ওয়াহাবি’ বলে প্রচারণা চালায়, যেমনভাবে তারা সব মুসলিমকে ‘মোহামেডান’, ইসলাম ধর্মকে ‘মোহামেডান ধর্ম’ বলে প্রচার করত। ১৮৩১ সালের ৬ মে বালাকোটের বিপর্যয়ে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরাট ক্ষতি হয়েছিল। বালাকোট বিপর্যয় না হলে ইংরেজদের হয়তো তথাকথিত সিপাহি বিদ্রোহের আগেই উপমহাদেশ ছাড়তে হতো। সৈয়দ সাহেব সরাসরি ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদ না করে শিখ অধিকৃত এলাকায় কেন জিহাদ শুরু করলেন? এর জবাবে বলা হয় যে-এই উপমহাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে ইংরেজ হানাদারদের বের করতে হলে পশ্চিমের মুসলিম উপজাতিদের সাহায্য প্রয়োজন ছিল। অথচ এ সময় শিখরা সেখানে ক্ষমতায়। তারা আবার স্থানীয় মুসলিমদের ওপর, এমনকি নারীদের ওপরও জুলুম করছিল। অন্য দিকে তারা ইংরেজদের মিত্র। এ জন্যই হয়তো সৈয়দ আহমদ পশ্চিমে তার শিবির স্থাপন করেছিলেন। কিছুটা কাজও হয়েছিল। পেশোয়ার কেন্দ্রিক ইসলামী স্বাধীন প্রশাসন তিনি শুরু করেছিলেন, কিন্তু স্থানীয় মুসলমানদের কিছু লোক শিখ ও ইংরেজদের ফাঁদে পড়ে সৈয়দ সাহেবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে। পরে ইংরেজরা শিখদের সেই মিত্রতার ‘প্রতিদান’ দেয় শিখ রাজ্যটাই দখলে নিয়ে। সৈয়দ সাহেবের ইচ্ছা ছিল মুসলিম উপজাতিদের নিয়ে শিখ ও ইংরেজদের মোকাবেলা করা কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছাই চূড়ান্ত। বালাকোটের বিপর্যয়ের পরও ঈমানদার মুসলমানরা ১৮৫৭ সালে সশস্ত্র সংগ্রাম করেন। এর পরও ইংরেজরা না যাওয়া পর্যন্ত খোরাসানিরা শেষ পর্যন্ত সশস্ত্র যুদ্ধ করেছিল।

বালাকোটে সাইয়েদ আহমদ ও ইসমাইল শহিদের নেতৃত্বে মাত্র সাত শত মুজাহিদ অপরদিকে শের সিংহের নেতৃত্বে শিখ বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা ১০ হাজার। বালাকোটের যেখানটায় মুজাহিদ বাহিনী অবস্থান নিয়েছিলেন, পাহাড়ি গিরি পথ মাড়িয়ে শিখ বাহিনী এত সহজে এ জায়গায় পৌঁছতে পারত না। কিন্তু স্থানীয় মুসলমানদের গাদ্দারির কারণে বালাকোট পর্যন্ত পৌঁছার রাস্তা পেয়ে যায় শিখবাহিনী। অবশেষে আসে ১৮৩১ সালের ৬ মে। ১০ হাজারের মুকাবেলায় মাত্র সাত শত মুজাহিদ, জীবনবাজি রেখে তাঁরা লড়াই চালিয়ে যান। শাহাদত বরণ করেন সাইয়্যিদ আহমদ শহিদ ও ইসমাইল শহিদ রহ.। তাঁদের সঙ্গে বীর বিক্রমে লড়তে লড়তে ছোট্ট এ বাহিনীর বেশির ভাগ সৈন্যই পান করেন শাহাদতের অমীয় সুধা।

মাওলানা আবুল আলা মওদুদী’র (রঃ)অভিব্যাক্তি[সম্পাদনা]

মাওলানা আবুল আলা মওদুদী (রঃ) বালাকোটের যুদ্ধ ও ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন তার সার কথা হলোÑ ” আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালানোই মুমিনের সত্যিকারের সাফল্য। এ পরিপ্রেক্ষিতে সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী (রঃ) শাহ ইসমাঈল শহীদ (রঃ) ও তাঁদের অনুসারীগণ অবশ্যই সফলকাম হয়েছিলেন। তবে পার্থিব ফলাফলের দিক দিয়ে তাঁদের ব্যর্থতা পরিস্ফুট। কার্যতঃ তারা জাহেলিয়াতের কর্তৃত্ব নির্মূল করে ইসলামের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। আমরা এই কারণসমূহ পর্যালোচনা করবো,যাতে করে পরবর্তীকালে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ঐ কারণসমূহের ব্যাপারে সতর্ক থাকা সম্ভব হয়। কতিপয় জাগতিক কারণে তাঁরা ব্যর্থ হন। এ কারণগুলো আমি পরে বর্ণনা করছি। কিন্তু চিন্তার জগতে তাঁরা যে আলোড়ন সৃষ্টি করে যান, তার প্রভাব এক শতাব্দীর অধিক সময় অতিক্রান্ত হবার পর আজও উপমহাদেশে পরিদৃষ্ট হচ্ছে। (শিবির অনলাইন)

কলকতা আলীয়া মাদ্রাসা ঃ[সম্পাদনা]

১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধের বিপর্যয়ের পর ব্রিটিশ সরকার ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হাতে নিয়ে মসজিদ, মাদরাসা ও খানকার নামে সুলতানি ও মোগল আমলে বরাদ্দকৃত অনুদান ও লাখেরাজ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ফেলেন। ইংরেজি স্কুল চালু করার ধুম পড়ে যায়। স্থানীয় মুসলমানদের সহযোগিতায় মসজিদগুলো চালু থাকলেও বহু দ্বীনি মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। এভাবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আলেম বানানোর পথ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। সে সময় সচেতন মুসলমানরা পরিকল্পনা করলেন, যেকোনো প্রকারে হোক, দ্বীনি মাদরাসা চালু করতে হবে। ভারতের প্রথম ইংরেজ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে প্রথমে সম্মত হননি। ব্রিটিশশাসিত ভারতবর্ষে মাদরাসা শিক্ষা না থাকলে জনগণ ধীরে ধীরে দ্বীন থেকে দূরে সরে যেত। আর বর্তমানে, ইংলিশ স্কুল চালু হওয়ায় পার্থিব সুবিধাপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় বহু মুসলমান পরিবার ওই দিকে ধাবিত হচ্ছে। যা হোক, সরকার সমর্থক কিছু দ্বীন-দরদী মুসলমান তৎকালীন বড়লাটের প্রতি আবেদন, নিবেদন ও চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন মাদরাসা প্রতিষ্ঠার জন্য। একপর্যায়ে হেস্টিংস সম্মত হন। তবে এ ব্যাপারে বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেন। এর মধ্যে ইংরেজ প্রিন্সিপাল নিয়োগ উল্লেখযোগ্য। এ মাদরাসায় কুরআন, হাদিস ও ফিকহের সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা হয়।

মোট কথা, ধর্মীয় শিক্ষার পুনঃপ্রবর্তন ব্রিটিশ শাসকরা ভালো চোখে দেখেননি। কলকাতায় শিয়ালদহের কাছে ভাড়া করা ঘরে ৪০ জন ছাত্র নিয়ে মাদরাসা চালু হওয়ার পরও তারা বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মুসলিম জনগোষ্ঠীর অব্যাহত দাবির মুখে তারা এ সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হন। পরবর্তীকালে নিজস্ব জায়গায় গড়ে ওঠে গড়যধসবফধহ ঈড়ষষবমব ড়ভ ঈধষপঁঃঃধ, লোকমুখে যা ‘কলকাতা আলিয়া মাদরাসা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৫০ থেকে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত ৭৭ বছরে ২৬ জন ইংরেজ ব্যক্তি কলকাতা আলিয়া মাদরাসার প্রিন্সিপালের দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে প্রখ্যাত প্রাচ্যবিদ ড. স্প্রেংগার অন্যতম। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর কলকাতা আলিয়া মাদরাসা ঢাকার বকশিবাজারে স্থানান্তরিত হয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশে এই মাদরাসা ইসলামী শিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আলীয়া পদ্ধতির মাদরাসা উপমহাদেশে অনেক বিদগ্ধ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, আলেম, রাজনীতিক ও সমাজসেবকের জন্ম দিয়েছে এটা অস্বিকার করার কোন সুযোগ নেই।যেমনÑ

* দৈনিক আজাদের সম্পাদক ও মুফাসসিরে কুরআন মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ,

* শামসুল ওলামা মাওলানা বেলায়েত হোসেন,

* পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী চৌধুরী,

* চিফ মিনিস্টার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী,

*  প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান,

* বিজ্ঞানী ড. কুদরত-এ-খুদা,

* আইন বিশেষজ্ঞ ও বিচারপতি ব্যারিস্টার সৈয়দ আমির আলী

* প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদ,

* মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম,

* মাওলানা মুহিউদ্দীন খান,

* অধ্যাপক আখতার ফারুক

* সাবেক পরারাষ্ট্র মন্ত্রী ও স্পীকার হুমায়ূন রশিদ চৌধূরী ছিলেন সিলেট আলীয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী।

* বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল বারী প্রমুখ ।

আলিয়া মাদরাসার ব্যাকগ্রাউন্ড আছে এমন বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পরবর্তী সময়ে মাদরাসা,স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সিভিল প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে দায়িত্বশীল পদে থেকে দেশ ও জাতির খেদমত করে গেছেন এবং আজো যাচ্ছেন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া জয়নাল আবেদিন ছিলেন চট্টগ্রামের চুনতি হাকিমিয়া আলিয়া মাদরাসার ছাত্র। সমাজে ইসলামী শিক্ষার বিকাশ ও নৈতিকতার উজ্জীবনে তাদের অবদান স্মরণীয়। প্রতিষ্ঠার পর প্রায় ১০০ বছর ধরে কলকাতা আলিয়া মাদরাসা তথা আলিয়াধারার মাদরাসাগুলোর প্রভাব ও আধিপত্য ছিল একচ্ছত্র। তখন অন্য ধারার কোনো মাদরাসা গড়ে ওঠেনি। তৎকালে ভারতীয় উপমহাদেশে বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া, উপমহাদেশে কোথাও আলিয়া পদ্ধতির মাদরাসা ছিল না। পরে আসাম, বিহার, উড়িষ্যা ও উত্তর প্রদেশে এ পদ্ধতির কিছু মাদরাসা গড়ে ওঠে। ১৮৬৬ সালে জন্মলাভ করে উত্তর ভারতের প্রখ্যাত দেওবন্দ মাদরাসা।

ঐতিহাসিক শ্যমলী যুদ্ধ[সম্পাদনা]

শামলীর যুদ্ধ বা থানা ভবনের যুদ্ধ ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের ধারাবাহিকতায় সংঘটিত হয়েছিল। এর এক পক্ষে ছিল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এবং অন্য দিকে ছিলেন ভারতীয় স্বধীনতাকামীদের পক্ষে শাহ ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রঃ)। ১৮৫৭ সালের ১০ মে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। ১০ মে ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর নেতৃত্বে কোম্পানি শাসনের বিরুদ্ধে  প্রতিবাদ করতে স্থানীয় মুসলমানরা দিল্লি থেকে প্রায় ১২০ মাইল দূরে বর্তমান উত্তরপ্রদেশের শামলী জেলার একটি ছোট শহর থানা ভবনে জড়ো হয়েছিলেন। ওলামায়ে কেরাম সেদিন বিজয়ী হন এবং একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। যা পরবর্তীতে শামলীর যুদ্ধ হিসেবে পরিচিতি পায়।এই যুদ্ধে ওলামায়ে কেরামের পক্ষে মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি সেনাপতি, এবং মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি রাজ্যের কাজী ছিলেন। কিন্তু দুর্ভগ্য বসতঃ মোহাম্মদ জামিনের শহীদ হওয়া এবং সিপাহী বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান নেতা বাহাদুর শাহ জাফরের গ্রেপ্তারের পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কোম্পানির পক্ষে শামলীও ব্রিটিশদের হাতে চলে যায় এবং থানা ভবনটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাবাহিনী দ্বারা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

জানা যায় দিনকাল ছিল ১৯ সেপ্টেম্বর ১৮৫৭ সাল। ইংরেজ সৈন্যরা দিল্লীতে মোগল সাম্রাজ্যের শেষ স্মারক সম্রাট বাহাদুর শাহ জফরকে গ্রেফতার করে, পুরো দিল্লীতে ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়। দিল্লীতে ধ্বংস-লুটতরাজ চালানোর পর কিছুদিনের মধ্যে ইংরেজ সৈন্যরা বিজয়ের বেশে থানাভবনের প্রাচীরে এসে তোপ স্থাপন করে।এদিকে ইংরেজদের অধীনে চাকুরীরত দেশীয় সিপাহীদের মধ্যে বিদ্রোহের দানা বাঁধতে শুরু করে।


অবশেষে হিন্দুস্তানের ভূমি থেকে ব্যবসার নামে ভূমি দখলদারি গাদ্দার বৃটিশদের হটিয়ে দিতে একদল ওলামায়ে কেরাম মুক্তিযুদ্ধা হয়ে ঘাটি বাঁধেন ঐতিহাসিক শামেলির ময়দানে নিজেদের হারানো সম্পদ এবং বৈরীনির্যাতন থেকে নিজেদের মুক্ত করে হারানো স্বাধীনতা ফিরে পেতে।এ সিদ্ধান্তের আলোকেই ওলামায়ে কেরাম হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর (রঃ)  তত্বাবধানে একটি বৈঠকের আয়োজন করেন। বৈঠকের এজেন্ডা ছিলো ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ‘জিহাদের ঘোষণা’। বৈঠকে হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী (রঃ)কে আমীর নিয়োগ করা হয়। হযরত মাওলানা কাসিম নানুতবী (রঃ) কে সেনাবাহিনীর প্রধান এবং হযরত মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহি কে (রাঃ) নিয়োগ করা হয় কাজী বা প্রধান বিচারপতি। মাওলানা মুহাম্মদ মুনীর (রঃ) ও হযরত হাফিয জামিন (রঃ) কমান্ডিং অফিসার।

তখন পর্যন্ত অস্ত্রের উপর বিধি নিষেধ আরোপ ছিলনা তাই সাধারন মানুষের কাছে অস্ত্র থাকতো, যেগুলোকে রাখা এবং এর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করাকে মুসলমানরা আবশ্যক মনে করতেন। কিন্তু এ অস্ত্রগুলো পুরাতন মডেলের ছিলো। অপর দিকে ইংরেজদের কাছে ছিল আধুনিক সমরাস্ত্র। তাই যুদ্ধে মোসলমানদের জয় হয়েও হলোনা ব্যাপক প্রাণহানির পর বৃটিশরা শ্যমলী ও তার তার আশপাশ দখলে নিল। মূলত এই যুদ্ধের পর থেকেই শসস্ত্র যুদ্ধের চিন্তা পরিবর্তন করাহয় এবং বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন জোরদার করা হয়। যার একটি ছিল শিক্ষা বিস্তার ও মসজিদ ভিত্তিক দাওয়াতীকার্যক্রম। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৬৬ সালে দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠা। সুতরাং ইতিহসি সচেতন ও পরিবেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল কোন মানুষ কখনো সে সময়কার শিক্ষার্জনকারীদের কাগুজে সনদ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনা। যদিও এই অভিযোগটি কেবল মাওলানা মওদুদীর উপর আনা হয়। এটাকে ইনসাফের পরিপন্থি বিবেকবোধের প্রতি অবিচার ই বলা যায়।

মাওলানা মমলুক আলী (রঃ)  (১৭৮৯-১৮৫১)[সম্পাদনা]

ভারত উপমহাদেশে যে সব ইসলামী স্কলার ও রাজনৈতীক ব্যক্তিত্ব ও ইলমে তাসাউফের ধারায় সুনামখ্যাতি অর্জন করে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে আছেন তাদের একজন হলেন মাওলানা মমলুক আলী (রঃ)। মাওলানা সায়িদ আবুল আলা মওদুদীর শিক্ষকদের উর্ধ্বপুরুষদের মধ্যেও যার নাম যুক্ত। আর দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মোহতামিম হুজ্জাতুল ইসলাম কাসিম নানুতবীর (রঃ) সাথে যুক্ত।  মাওলানা মমলুক আলীর বংশ তালিকাও বংশ পরস্পরায় সরাসরি হযরত আবু বকর (রাঃ) পর্যন্ত মিলিত। যেমনÑ মামলুক আল-আলী বা মামলুক আলী, ইবনে আহমদ আলী, ইবনে গোলাম শরাফ, ইবনে আবদুল্লাহ, ইবনে আবদ ফাতাহ, ইবনে মুহাম্মদ মুঈন, ইবনে আবদ সামি, ইবনে মুহাম্মদ হাশিম, ইবনে শাহ মুহাম্মদ ,ইবনে কাজী তাহা, ইবনে মোবারক, ইবনে আমানউল্লাহ, ইবনে জামালউদ্দীন, ইবনে কাজী মীরান, ইবনে মাজহারউদ্দিন, ইবনে নাজমুদ্দীন সানী, ইবনে নূরউদ্দীন রাব্বি, ইবনে কিয়ামউদ্দিন, ইবনে জিয়া উদ্দিন, ইবনে নূরুদ্দীন সালিস, ইবনে নাজমুদ্দীন, ইবনে নূরউদ্দিন সানী, ইবনে রুকনউদ্দিন, ইবনে রাফি-উদ্দিন, ইবনে বাহাউদ্দিন, ইবনে শিহাবুদ্দীন, ইবনে খাজা ইউসুফ, ইবনে খলিল, ইবনে সদ্দুদ্দীন, ইবনে নূরউদ্দিন ইবনে, সদরউদ্দীন আল-হাজ, ইবনে ইসমাইল শহীদ, ইবনে নূরউদ্দীন কিতাল, ইবনে মাহমুদ, ইবনে বাহাউদ্দিন, ইবনে আবদুল্লাহ, ইবনে জাকারিয়া, ইবনে নূর, ইবনে সিরাহ, ইবনে শাদি আস-সিদ্দিকী, ইবনে ওয়াহেদ উদ্দীন, ইবনে মাসউদ, ইবনে আবদুর রাজ্জাক, ইবনে কাসিম, ইবনে কাসিম, ইবনে মুহাম্মদ, ইবনে আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)। মূলত ভারতবর্ষের খুব আলেমরই নসবনামা এ রকম ধারাবাহিক ভাবে হযরত আবু বকর (রাঃ) পর্যন্ত মিলে গেছে। অথচ কোথাও নিজেকে আওলাদে রাসুল পরিচয় দেয়ার কোন প্রতিযোগিতা নেই।

জন্ম ও শিক্ষা জীবনঃ[সম্পাদনা]

মাওলানা মামলুক আলী (রঃ) ১৭৮৯ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের নানুতায় জন্ম গ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়না। তবে যতটুকু জানা যায় যে তিনি তাঁর পরিবারের প্রবীণদের কাছ থেকে তার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। নূরুল হাসান রশিদ কান্ধলভি (রঃ) অনুমান করেছেন যে, তার পড়াশোনা মুফতি ইলাহী বখশের আবদুর রহমন এবং আবদুর রহিমের শিক্ষার্থীদের তত্ত্বাবধানে হয়েছিল। তিনি মুফতি ইলাহী বখশ কান্ধলভি (রঃ) এবং মুহাম্মদ কালান্দার জলালাবাদীর অধীানে মাধ্যমিক পড়াশোনা শেষ করেন। তিনি শাহ আবদুল আব্দুল আজিজ মুহাদ্দীসে দেহলভীর (রঃ) সাথে একটি বিষয় অধ্যয়ন করেছেন বলে জানা যায়। আরেক বর্ণনা মতে-তিনি আবদুল্লাহ খান আলভীর কাছ থেকে পড়াশোনা করেছেন। তিনি রশিদ উদ্দীন খানের অধীনে উচ্চতর পড়াশোনা শেষ করেন।

দিল্লী কলেজের অধ্যক্ষ মাওলানা মমলুক আলী (রঃ) ঃ[সম্পাদনা]

মাওলানা মমলুক আলী (রঃ) লেখা পড়া শেষ করে দিল্লীতে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি ১৮২৫ সালের জুনে, দিল্লী কলেজে আরবি বিভাগের প্রভাষক পদে নিযুক্ত হন এবং ১৮৪১ সালের ৮ নভেম্বর প্রধান শিক্ষকের পদে পদোন্নতি পান এবং সারা জীবন ই এই কলেজের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।  যুক্তি বিদ্যা বিজ্ঞান, আরবি ভাষা, ফিকহ সম্পর্কিত কিতাবাদী পড়ানোর পাশাপাশি তিনি সিহাহ সিত্তার উল্লেখযোগ্য কিতাব পড়াতেন। সমকালীন ইসলামী স্কলারদের মধ্যে তিনি প্রথম সারির একজন ছিলেন।

মাওলানা মমলুক আলীর ছাত্র ঃ[সম্পাদনা]

মাওলানা মমলুক আলী (রঃ) ছিলেন একজন কলেজ শিক্ষক ও প্রিন্সিপাল। তাই বলে কি তার শিক্ষার ধন্যতা ছিল না শিক্ষার কমতি ছিল না কি তার ছাত্রদের তালিকায় কোন ছোট খাটো আলেম ছিলেন? তাঁর ছাত্রদের মধ্যে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেনÑ

(১)  দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মোহতামীম হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা  কাসেম নানুতুবি (রঃ)

(২) আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ খান (রঃ)।

(৩) ভারতবর্ষের প্রসিদ্ধ ফক্বীহ মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহি (রঃ) ।

(৪) মুহাম্মদ ইয়াকুব নানুতুবি (রঃ) 

(৫) নাজির আহমদ দেহলভী (রঃ) উর্দু উপন্যাসের জনক।

(৬) মাজহার নানুতুবি (রঃ) মাজাহিরুল উলুম,সাহারানপুরের প্রতিষ্ঠাতা ।

(৭) আহমদ আলী সাহারানপুরি (রঃ)

(৮) জুলফিকার আলী দেওবন্দি (রঃ) (মাহমুদ হাসান দেওবন্দির পিতা)

(৯) ফজলুর রহমান উসমানি (রঃ)  (শাব্বির আহমদ উসমানির (রঃ) পিতা)

(১০) হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রঃ)

(১১) মুহাম্মদ মুনির নানুতুবি (রঃ) (দারুল উলুম দেওবন্দের (মোহতামীম)

(১২) মৌলভী জামাল উদ্দীন কিনভি ( বোপাল রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী)

(১৩) মৌলবী করিমুদ্দিন পানীপথি (রঃ)

স্যার সৈয়দ আহমদ খান বাহাদুর ও আলীগড় আন্দেলন (১৮১৭-১৮৯৮)[সম্পাদনা]

সৈয়দ আহমদ  স্যার সৈয়দ আহমদ ভারতের একজন বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ যিনি ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার ক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৭ অক্টোবর ১৮১৭ সালে জন্ম গ্রহণ করেন এবং  ২৭ মার্চ ১৮৯৮ ইংরেজী ইন্তেকাল করেন। পশ্চাৎপদ মুলমানদের উচ্চ শিক্ষা বিশেষ করে ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজন উপলব্ধি করে তিনি বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেন। এই লক্ষ্যে তিনি ১৮৫৮ সালে মোরাদাবাদে একটি বিদ্যালয় করেন। একই ভাবে তিনি ১৮৬৪ সালে গাজীপুরে ‘আলিগড় বৈজ্ঞানিক সমিতি’ নামে একটি সমিতি প্রাতষ্ঠা করেন। যার উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্যের বিভিন্ন বই ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করা। ১৮৭৬ সালে মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন যা পরবর্তীতে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিতি লাভ করে।  তিনি ‘তাহজিব-উল-আখলাক’ নামে একটি উর্দু পত্রিকা প্রকাশ করেন।

আলীগড় আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী[সম্পাদনা]

এই আন্দোলনেরউদ্দেশ্য ও কর্মসূচী সম্পর্কে বলা হয় যে-

১. অশিক্ষা, কু শিক্ষা ও গোঁড়ামী,অজ্ঞতা ও অধঃপতনের হাত থেকে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসিত মুসলমানদের রক্ষা করা।

২. মুসলিমরাও যাতে প্রশাসনিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে সুযোগ সুবিধা ভোগ করার সুযোগ পায় সেই সুযোগ সৃষ্টি করা।

৩.মুসলিম সমাজে বিরাজমান কুসংস্কার, অজ্ঞতা দূর করে সচেতনতা সৃষ্টি করে তাদের গৌরব ও ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করা।

৪.মুসলমান জাতিদের ভিতর পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার ঘটানো।

৫.সাহিত্য,শিক্ষা,সংস্কৃতি,আর্থিক ও রাজনৈতিকভাবে মুসলমানদেরকে হিন্দুদের সমকক্ষ করে গড়ে তোলা।

আলীগড় আন্দোলনকে সফল করার জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। যেমন-

১.বই প্রকাশনা ঃ আন্দোলনের প্রারম্ভে স্যার সৈয়দ আহমদ কয়েকটি প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রচনা করেন। এর  ১৮৫৯ সালে তিনি শিল্পবিপ্লবের কারণ ও ঘটনাবলি যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করে 'আলবান-ই-ভাগাওয়াত হিন্দ' (উর্দু) শীর্ষক গ্রন্থ রচনা করেন।

২.পত্রিকা প্রকাশ ঃ পত্রিকা প্রকাশ করে জনসাধারণকে সচেতন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ১৮৬৬ সালে বিজ্ঞান সমিতির পক্ষ থেকে “আলীগড় ইনস্টিটিউট গেজেট" নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হয়। ১৮৭০ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান মুসলিম সমাজের রীতিনীতি সংস্কারের জন্য 'তাহজিবুল আখলাক' নামে উর্দু ভাষায় একটি পত্রিকা বের করেন।

৩. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন ঃ শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেয়ার জন্য স্যার সৈয়দ আহমদ খান ১৮৭৫ সালে আলীগড়ে একটি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৭৭ সালে এটি 'মোহামেডান অ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজে' উন্নীত হয় এবং পরে ১৯২০ সালে মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় নাম ধারণ করে।

৪.মুসলিম সাহিত্য সমাজ ঃ মুসলমানদের মধ্যে থেকে উন্নত চিন্তাধারার প্রসার ঘটানো।

৫. দুর্ভিক্ষ নিবারণী সমিতিঃ স্যার সৈয়দ আলী আহম্মদ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় দুর্ভিক্ষ নিবারণী সমিতি করে মানব সেবা।

৬.বিজ্ঞান সমিতি ঃ স্যার সৈয়দ আহমদ ১৯৬৩ সালে গাজীপুরে বিজ্ঞান সমিতি গঠন করে আলীগড়ে স্থানান্তরিত করেন। যা পরবর্তিতে গোটা ভারত বর্ষে ছড়িয়ে পড়ে।

আলীগড় বিশ্ববিদ্যায় প্রতিষ্টা ঃ

তার চিন্তাধারা ও কাজকর্ম বাহ্যিক দৃষ্টিকোন থেকে পাশ্চত্য মুখি ভাবা হলেও সময়ের প্রেক্ষাপটে ভারতবষের্র মুসলমানদের মধ্যে একটি নতুন চেতনার জন্ম দেয়। এর প্রভাবে প্রভাবান্বিত এই মুসলমান বুদ্ধিজীবীরাই পরবর্তীতে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আলীগড় আন্দোলনের সূচনা করেন। ইতিহাসে এটাই আলীগড় আন্দোলন নামে পরিচিত। যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় রাজনীতিতে মুসলিমদের অধিকার নিশ্চিত করা। যদ্দরুণ এই আন্দোলন সমকালীন মুসলিম চিন্তাবিদ বিশেষত ওলামায়ে কেরামের বাধার মুখে পড়লেও বৃটিশদের পৃষ্ঠপোষকতার ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে সৈয়দ আহমদ ভারতবর্ষের জাতীয় নেতায় পরিণত হন। ১১৫৫ একর ভ’মির উপর বিশাল ক্যাম্পাস জুড়ে রয়েছে  বেশ কিছু বিখ্যাত স্থাপনা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি অনুষদে (অমৎরপঁষঃঁৎধষ ঝপরবহপবং, অৎঃং, ঈড়সসবৎপব, ঊহমরহববৎরহম ্ ঞবপযহড়ষড়মু, খধ,ি খরভব ঝপরবহপবং, গবফরপরহব, গধহধমবসবহঃ ঝঃঁফরবং ্ জবংবধৎপয, ঝপরবহপব, ঝড়পরধষ ঝপরবহপবং, ঞযবড়ষড়মু, টহধহর গবফরপরহব) মোট ৭৪ টি ডিপার্টমেন্ট রয়েছে।১৮৭৮ সালে লর্ড লিটন তাঁকে রাজকীয় আইনসভায় মনোনয়ন দান করেন। ১৮৮৭ সালে লর্ড ডাফরিন তাঁকে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবে নিয়োগ করেন। ১৮৮৮ সালে বৃটিশ সরকার তার ‘নাইটহুড’ প্রদান করে। এর পর থেকে তিনি স্যার সৈয়দ আহমদ; হিসাবে পরিচিত হতে থাকেন। ১৮৯৮ সালের ২৭ মার্চ স্যার সৈয়দ আহমদ খান ইন্তেকাল করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া করে ভারত বর্ষ ছাড়াও বিশ্বের বহু খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব দেশ ও জাতী গঠনে অবদান রেখেছেন।

দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট ঃ[সম্পাদনা]

১৮৫৭ সালের গণ-আন্দোলনে (সিপাহি বিদ্রোহ) ইংরেজ দখলদার বাহিনী দিল্লিতে ৩৩ হাজার আলিমকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। মুসলমানদের রাষ্ট্রক্ষমতা কেড়ে নেয় ও সম্পত্তি লুটে নেয়। এমন পরিস্থিতিতে আল্লামা কাসেম নানুতুভীর মতো আলেমরা মনে করেছিলেন, ধর্মীয় শিক্ষার ক্ষেত্রও যদি হাতছাড়া হয়ে যায়, ভারতে মুসলিম জাতিসত্তা মহাবিপর্যয়ের মুখে পড়বে। এ উপলব্ধি থেকেই বেসরকারি মাদরাসা কায়েমের পরিকল্পনা করা হয়।  বিশেষতঃ বালাকোটের বিপর্যয় এর পর শ্যামলীর বিপর্যয় মুসলিম মনিষীদের বিচলিত করে তুলে। তাই স্বশস্ত্র যুদ্ধের পথ পরিহার করে বুদ্ধিবৃত্তিক জ্ঞানভিত্তিক আন্দোলন গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েই শুরু হয় দেওবন্দ আন্দোলন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল ভারতবর্ষে ইসলালামী খেলাফত ব্যবস্থা পুনঃরুদ্ধার। যেটা সম্ভব হতে পারে খাস ওয়ারিশে আম্বিয়া তৈরির মাধ্যমে। তাই সিলেবাসভুক্ত সব কিতাবের পূর্ণ পাঠদান এবং সরকারি কর্তৃত্বের গন্ডি থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে, আল্লাহ তায়ালার সাহায্য ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় কওমি মাদরাসার যাত্রা শুরু হয়। ১৮৬৬ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে দারুল উলুম নামে প্রথম কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শায়খুল ইসলাম আল্লামা কাসেম নানুতুভী ও হাজী সাঈদ আবিদ হোসাইন ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। কোনো ধরনের অবকাঠামোগত সুবিধা ছাড়া মাত্র একজন ছাত্র ও একজন শিক্ষক দিয়ে এ মাদরাসা চালু করা হয় ডালিম গাছের ছায়ায়। এটাই পরবর্তীকালে বিশ্বখ্যাত হয় দারুল উলুম দেওবন্দ নামে। সরকার থেকে কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় অনুদান, বেতনভাতা ও অবকাঠামোগত সুবিধা নিতে কওমি মাদরাসা কর্তৃপক্ষ সম্মত হননি। অষ্টম নীতিমালার (উসুলে হাশতগানা) আলোকে মজলিসে শূরার মাধ্যমে এ মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এ ভাবেই পরিচালিত হয়ে আসছে।  মূলত এটা আলীগড় আন্দোলনের দশ বছর পর শুরু হয় এবং আলীগড় আন্দোলন ছিল পশ্চিমাদের আদলে সমাজ বিণির্মাণ করে তাদের মতহয়ে ভারতবর্ষে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা। পক্ষান্তরে দেওবন্দ আন্দোলন ছিল এর বিপরীতে পূর্ণ ইসলামের আনুগত্যতার মধ্যে থেকে দেশ ও জাতীকে মুক্ত করে আল্লাহর জমীনে আল্লাহর দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা।বর্তমানে দারুল উলুম দেওবন্দ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বটে প্রতিষ্ঠাকালীন লখ্যউদ্দেশ্য ষোলকনা মেনে চলা সম্ভব হচ্ছেনা রাজনৈতীক প্রতিকুলতার কারণে। কারণ দারুল উলূম দেওবন্দের বর্তমান হালচাল ভারতীয় জাতীয়তাবাদের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারছেনা।  এশিয়া, আফ্রিকা, কানাডা, ইংল্যান্ডসহ ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়া তথা সারা দুনিয়ায় এর শাখা ছড়িয়ে আছে।

দেওবন্দ মাদ্রাসার গোড়া পত্তনঃ[সম্পাদনা]

১৮৬৬ সালে বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ইসলামি পন্ডিত এটির প্রতিষ্ঠা করেন যাদের প্রধান ছিলেন হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবি (রঃ)। দেওবন্দ ছিল মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবির শ্বশুরালয়। সেখানে গেলে তিনি সাত্তা মসজিদে নামাজ আদায় করতেন। হাজী আবেদ হোসেন ছিলেন সাত্তা মসজিদের ইমাম। মাওলানা জুলফিকার আলী ও মাওলানা ফজলুর রহমান অত্র এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। এসব ব্যক্তিবর্গ নামাজান্তে হাজী আবেদ হোসেনের হুজরায় প্রায় মিলিত হলে দেশের এহেন পরিস্থিতি বিশেষতঃ  ইসলামী শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতেন ! কিন্তু বিকল্প কোন পথ কেউ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। দীর্ঘ ৬/৭ বছর এভাবে কেটে গেল। ১৮৬৬ সালে মাওলানা কাসেম নানুতুবী দেওবন্দের দেওয়ান মহল্লায় স্বীয় শ্বশুরবাড়ীতে  বেড়াতে আসেন। বাড়ী সংলগ্ন সাত্তা মসজিদের ইমাম হাজী আবিদ হোসানের সাথে মাদরাসা শিক্ষা নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলোচনা হওয়ার পর সেখানেই একটি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অভিমত ব্যক্ত করেন এবং এ দিন ই  প্রথম তহবিল গঠন হয় ফজরের নামাজের পর হাজী আবেদ (রঃ) এর উদ্যোগে। এতে হাজী আবেদ (রঃ)  তিন টাকা মাওলানা মাহতাব আলীর (রঃ) কাছে গেলে তিনি ৬ টাকা। মাওলানা ফজলুর রহমান (রঃ) ১২ টাকা, হাজী ফজলুল হক (রঃ) ৬ টাকা। মাওলানা জুলফিকার আলীর (রঃ)  ১২ টাকা। দরবেশ সম্রাট “আবুল বারাকাত” মহল্লা থেকে আরো কিছু মিলিয়ে মোট ৩০০ টাকার ফান্ড গঠন করেন। এর পর মুখে মুখে তা প্রচার হতে থাকলে আরো কিছু টাকা সংগৃহিত হয়।  এর পর জনগণের উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখে তিনি মিরাটে কর্মরত হযরত মাওলানা কাসেম নানুতুবির নিকট এই মর্মে পত্র লিখেন যে, আমরা মাদ্রাসার কাজ শুরু করে দিয়েছি আপনি অনতিবিলম্বে চলে আসুন। চিঠি পেয়ে নানুতুবী (রঃ) মোল্লা মাহমুদকে শিক্ষক নিযুক্ত করে পাঠিয়ে দিলেন এবং তার মাধ্যমে মাদ্রাসার কাজ চালিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে ফিরতি চিঠি লিখে দিলেন। এভাবেই গণচাঁদার উপর ভিত্তি করে ছোট্ট একটি ডালিম গাছের নিচে দেওবন্দ মাদ্রাসার গোড়াপত্তন হয়। মোল্লা মাহমুদ সর্বপ্রথম শিক্ষাদান করেন যার প্রথম ছিলেন ছাত্র মাহমুদ (রঃ)। যিনি পরবর্তীতে শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান দেওবন্দি নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। তিনি উর্দূ ভাষায় কোরআন শরীফের অনুবাদ ও এর সংক্ষিপ্ত তাফসীর টীকা হিসাবে লিখেন যা তাফসীরে শায়খুল হীন্দ নামে পরিচিত। এর বাংলা অনুবাদও প্রকাশিত হয়েছে। দারুল উলূম দেওবন্দ ভারতের মুসলিম সমাজের নানা অসংগতি, কুপ্রথা ও স্থানীয় আচরণকে সংস্কার করে শরীতের নৈতিকতা ও আদবকে প্রতিস্থাপন করতে পেরেছিল এবং মুসলিম সমাজের ইসলামায়ন প্রক্রিয়াকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিল। ঔপনিবেশিক ও অমুসলিম অধ্যুষিত ভারতে মুসলমানদোর ধর্ম ও সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার পথ দেখিয়েছে। বিশ্বখ্যাত দারসে নেজামিকেই দারুল উলুম দেওবন্দের পঠিত সিলেবাস হিসাবে গ্রহণ করা হয়।

মোল্লা মাহমুদ (রঃ)[সম্পাদনা]

মোল্লা মাহমুদ (রঃ) দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবির সহযোদ্ধা ছিলেন। নাম ধেখেই এটা সহজে অনুমেয় যে তখন মোল্লা খেতাব বা উপাধিটাও ছিল সম্মানের হেয় পতিপন্ন করার জন্য এটা ব্যবহার হতনা। মোল্লাহ মাহমুদ (রঃ)  শাহ আবদুল গনি মুহাদ্দীসে দেহলভীর কাছ থেকে ইলমে হাদীস অধ্যায়ন করেন। ১৮৬৬ সালে, দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠিত হলে, তিনি এর প্রথম শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৮৮৬ সালে তিনি মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রায় বিশ বছর দারুল উলূম দেওবন্দে শিক্ষকতা করেন।  তার ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন শায়খুল হিন্দ মাওলানা  মাহমুদুল হাসান দেওবন্দি (রঃ) ও হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী (রঃ)  এবং আজিজুর রহমান উসমানী (রঃ) উল্লেখযোগ্য।

আকাবীরে সিত্তা বা দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাগন[সম্পাদনা]

দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতারা ইতিহাসে আকাবিরে সিত্তাহ নামে পরিচিত। আকবার শব্দের বহুবচন আকাবির এর অর্থ বড়, ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন, সম্মানিত ব্যক্তি, আর সিত্তাহ শব্দের অর্থ ছয়্ সুতরাং  আকাবিরে সিত্তাহ’র শাব্দিক অর্থ ছয়জন সম্মানিত ব্যক্তি। আর পরিভাষাগত অর্থে আকাবিরে সিত্তাহ বলতে দেওবন্দ আন্দোলন তথা দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা ছয় জন ব্যক্তিকে বোঝায়।

১ মাওলানা মুহাম্মদ কাসেম নানুতবী (রঃ)

২ মুহাম্মদ ইয়াকুব নানুতবী (রঃ)

৩ হাজী মুহাম্মদ আবেদ (রঃ)

৪ রফি উদ্দিন উসমানী (রঃ)

৫ মাওলানা যুলফিকার আলী  (রঃ)

৬  মাওলানা ফজলুর রহমান (রঃ)

এরা কেউ ই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় তেমন শিক্ষিত ছিলেন না কিন্তু পাঠচক্র বা বিশেষ ব্যাক্তিগনের তত্বাবধানে পরিচালিত দারস থেকে সমকালীন ভারত বর্ষের সেরা জ্ঞানীদের কাছ থেকে বিদ্যার্জন সহ বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের স্বশস্ত্র প্রশিক্ষণ ও সম্মুখ সমরে অংশ গ্রহণ করেন। বৃটিশ খেদাও আন্দোলন ছিল তখন ফরজ, কারণ ভারত ছিল দারুল হারব বা ভিন্ন জাতি কর্তৃক আক্রান্ত। তাও আবার ইসলামী সালতানাত কেড়ে নিয়েছিল বৃটিশ বে নিয়ারা। সুতরাং তখন প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা আর কাগুজে সনদের ঘাটাঘাটি করার চেয়ে দেশ-জাতী তথা ইসলাম ও মোসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা ছিল বড় কথা।

বিশ্বখ্যাত দরসে নেজামী ঃ[সম্পাদনা]

ইসলামের ইতিহাসে দরসে নেজামী নামে একটি সিলেবাস ও সিলেবাস ভিত্তিক শিক্ষাদান পদ্ধতি চালু হয় ১১০০ শতাব্দীর পরে। এর  পূর্ব পর্যন্ত শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাপকহারে থাকলেও তা কোনো সিলেবাসভিত্তিক বা কারিকুলামের আলোকে ছিল না। ১১০৫ হিজরিতে মোল্লা নিজামুদ্দীন সাহলাভী ইসলামী শিক্ষাকে কিছুটা ঢেলে সাজান। তিনিই দরসে নেজামী আকারে মাদরাসা শিক্ষা পদ্ধতি চালু করেন। তিনি ছিলেন একাধারে দ্বীনের সুদক্ষ আলেম,ফিকাহ শাস্ত্রবিদ,দার্শনিক, ভাষ্যকার এবং একজন শিক্ষাবিদ। তিনি উত্তর ভারতের সাহালী শহরে ১০৮৮/৮৯ মোতাবেক ১৬৭৭-৭৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন।

হিরাতের প্রসিদ্ধ শিক্ষাবিদ শায়খ আব্দুল্লাহ আনসারী ছিলেন তাঁর পূর্বপুরুষ। শায়খ নিজামুদ্দীন সাহালীতে ইসলামী শিক্ষা কেন্দ্রের সূচনা করেন। তারই প্রপৌত্র শায়খ হাফিজের জ্ঞানসাধনায় মুগ্ধ হয়ে সম্রাট আকবর তাকে ঐ এলাকায় ভালো একটি জায়গীর প্রদানের নির্দেশ দেন। ফলে শায়খ ও তাঁর পুত্রগণ নিশ্চিন্তে তালীমের কাজে মগ্ন থাকেন। ছাত্রদের খাদ্য ও বাসস্থানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাও করেন। ইসলামের শত্রুরা ১১০৩ হিজরি মোতাবেক ১৬৯১ সালে মোল্লা নিজামুদ্দীনের পিতা মোল্লা কুতুবুদ্দীনকে শহীদ করে তার শিক্ষা উপকরণসমূহ জ্বালিয়ে দেয়। ফলে মোল্লা নিজামুদ্দীন তার চার ভাইসহ ভারতের উত্তর প্রদেশের রাজধানী লাখনৌ চলে যান।

সম্রাট আওরঙ্গজেব এই পরিবারের শিক্ষার অবদানের কথা বিবেচনা করে লাখনৌর প্রসিদ্ধ মহল্লা ফিরিঙ্গী মহলে একস্থানে সরকারি আদেশবলে জায়গীর দান করেন। মোল্লা নিজামুদ্দীন এখানে দ্বীনি শিক্ষার কাজ চালিযয় যান,এমন সময়এটাও মাদরাসায়ে নেজামিয়া নামে সুপরিচিতি লাভ করে। এই ফিরিঙ্গী মহলে এসেই তিনি ১১০৫ হিজরি সনে দরসে নেজমী প্রণয়ন করেন৷তিনি গঠনমূলকভাবে অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে প্রায় ১১টি বিষয়ের সমন্বিত সিলেবাসটি প্রণয়ন করেন। ইতিহাসে এটাই দরসে নেজামী নামে পরিচিত। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পরে উক্ত দরসে নেজামীই মাদরাসার নেসাবভুক্ত করা হয় বলে তারিখে দারুল উলুমে ও তাহরীকে দারুল উলূমে উল্লেখ আছে।

হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে  মক্কী ঃ (১৮১৭-১৮৯৯)[সম্পাদনা]

হাজী ইমদাদ উল্লাহ মুহাজির মক্কী (রঃ) ৩১ ডিসেম্বর ১৮১৭ ঈসায়ী জন্মগ্রহণ করেন। এবং ১৮ অক্টোবর ১৮৯৯ ঈসায়ী ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন ভারতের একজন মুসলিম স্কলার ও ইলমে তাসাউফের শায়খ। একই সাথে বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের একজন নেতা ও সেনা কমান্ডার। তার নেতৃত্বে শামলীর যুদ্ধ হয়। তিনি মিয়াজি নূর মুহাম্মদের খলিফা এবং নজিব আলী চৌধুরীর ওস্তাদ ছিলেন। তার খলিফাগণই ভারতবর্ষে রাজনীতি ইসলামী শিক্ষা ও ইসলামী আন্দোলনের বিকাশে ব্যাপকতর বিস্তার লাভ করেছেন।

হাজী ইমদাদ উল্লাহ মুহাজির মক্কী ভারতের উত্তর প্রদেশের শাহারানপুর জেলায় ১৮১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন।  তিনি ছিলেন হযরত উমর ফারুকের (রাঃ) বংশধর। তারা তিন ভাই ছিলেন তন্মধ্যে জুলফিকার ও ফিদা হুসাইন তার বড় এবং বাহাদুর আলি শাহ তার ছোট ছিলেন। বি ওয়াজিরুন্নিসা নামে তার এক ছোট বোনও ছিল। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় ইমদাদ হুসাইন। মুহাদ্দিস শাহ মুহাম্মদ ইসহাক দেহলভী (রঃ) এটি শোনার পর অসন্তুষ্ট হন এবং নাম বদলিয়ে ইমদাদ উল্লাহ রাখতে বলেন। তাকে “খোদা বখশ”ও “আবদুল করিম”বলেও ডাকা হত। ইমদাদউল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর বয়স যখন সাত বছর  তখন তার মা ইন্তেকাল করেন।

নয় বছর বয়সে তিনি মাওলানা মামলুক আলীর (রঃ) সাথে দিল্লি যান। সেখানে তিনি আরবী ও ফারসি ব্যাকরণ শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি মুহাম্মদ কালান্দার মুহাদ্দিস জালালাবাদীর তত্তাবধানে মিশকাতুল মাসাবিহ ও মাওলানা আবদুর রহিম নানুতুবীর তত্তাববধানে ফিকহুল আকবর অধ্যায়ন করেন। এছাড়াও তিনি জালাল উদ্দিন রুমির মসনবি অধ্যয়ন করেন। ২৩ বছর বয়সে তিনি কোরআন মুখস্থ করেন তাঁর নিজ উদ্যোগে। দারুল উলূম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে হুজ্জাতুল ইসলাম কাসিম নানুতবী (রঃ) ও রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রঃ) দুজন ই তাঁর ইলমে তাসাউফের শিষ্য বা খলিফা ছিলেন।

মাওলানা কাসিম নানুতবীর (রঃ)ঃ (১৮৩২-১৮৮০)[সম্পাদনা]

আজকের এই আধুনিক যুগের মত শ,বছর আগে এইসব অট্রালিকা ঘেরা সুরক্ষিত ভবনে পরিপাটি করে রাখা বই কিতাবের সেলফ ও ছিলনা আর কাগুজে সনদের ডিগ্রীও ছিলনা। আজকের প্রজন্ম এ বিষয়ে হয়তো জানেই না তবে না জানলেও এ নিয়ে কেউ প্রশ্ন তুলেনা তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতা দেখে। কিন্তু বিশেষ কোন ব্যাক্তির বিষয়ে এ প্রশ্ন তখন আসে যখন তাঁর প্রতিভা আর যোগ্যতার প্রভাবে সমাজ তাঁর প্রতি অধিক আকৃষ্ট হয়। মাওলানা মওদুদী এ রকম ই একজন প্রতিভাবান ব্যাক্তিত্ব যে তার বহুমূখি প্রতিভা চতুর্মূখি কর্মনিয়ে ব্যস্ত হতাশ মানুষকে আন্দোলিত করে তুলেছিল যে তার শিক্ষক কে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কোথায় ছিল এ নিয়ে ভাবার সুযোগ ছিল কি। সকলেই যে ইতিবাচক ধারনা রাখবে সেটা আশা করাটাও ঠিক নয়। যেমন-

সমকালীন ভারতবর্ষের খ্যাতনামা ব্যাক্তিত্ব ভারতবর্ষের সমকালীন ওলামায়ে কেরামের মধ্যে হযরত মাওলানা কাসিম নানুতবী (রঃ) ছিলেন অগ্রজ ইসলামী পন্ডিত। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের স্বশস্ত্র সংগ্রামের সেনা কমান্ডার। একজন ক্রিড়াবিদ ও খ্যাতিমান কবি সাহিত্যিক,সাংবাদিক ও বাগ্মিপ্রবণ হিসেবে সম্মানের পাত্র। একজন ইতিহাস বেত্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবেও ছিল তাঁর খ্যাতি। অথচ তাঁর বেশিরভাগ শিক্ষার্জনের ধরণ বা পদ্ধতিও ছিল  ইজাযাহ সনদের পাঠচক্রভিত্তিক। এ থেকে অনুমিত হয় একজন ইসলামী স্কলারের জীবনের কর্ম পরিধির সীমানা কেবল মাদ্রসার মসজিদের চার দেয়ালের ভেতর সীমাবদ্ধ ছিলনা বরং এই চার দেয়াল প্রতিকী হলেও গোটা দনিয়া এবং দুনিয়ার মানুষের কল্যাণ কামনা চিন্তা তাদের অন্তরে ঘোরপাক খেত। অমনি অমনি তাদেরকে হুজ্জাতুল ইসলাম খেতাব দেয়া হয়নি। মাওলানা কাসেম নানুতবী (রঃ) ছিলেন দারুল উলুম দেওবন্দের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম মোহতামীম।

মাওলানা কাসিম নানুতবী (রঃ) ১৮৩২ সালে বর্তমান ভারতের উত্তর প্রদেশের সাহারানপুরের নিকট নানুতা নামক  গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নিজ শহরে প্রাথমিক শিক্ষালাভ করার পর দেওবন্দ চলে যান। সেখানে মৌলভি মাহতাব আলীর মাদরাসায়  কিছু দিন শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি শাহারানপুর চলে যান সেখানে তার নানার সাথে অবস্থান করে শাহারান পুরে মৌলভি নওয়াজের তত্বাববধানে আরবী ব্যাকরণ বিষয়ে প্রাথমিক গ্রন্থাদি পাঠ করেন।  ১৮৪৩ সালের শেষের দিকে মাওলানা মামলুকুল আলীর কাছে কাফিয়া ও যুক্তি বিদ্যা,দর্শন শাস্ত্রের  উপর পড়া শুনা করেন। এ ছাড়া ধর্মতত্বের উপর বিভিন্ন গ্রন্থাদি পাঠ করেন একটি পাঠচক্রে যোগ দান করে । এর পর তিনি  মাওলানা আবদুল গণি মুজাদ্দেদির পাঠচক্রে অংশগ্রহণ করে কোরআন হাদীস অধ্যায়ন করেন।কর্ম জীবনের শুরুতে তিনি সাংবাদিকতা পেশায় যোগ দেন। তিনি মাতবাহে আহমদি'র সম্পাদক নিযুক্ত হন। এর পর তিনি ১৮৬৬ সালে আকাবীরে সাত্তা’র পরামর্শের আলোকে ১৮৬৬ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। এর পরও  ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকা সম্পাদনা ও একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে চাকুরী করতেন। সুতরাং কোন বিশেষ ব্যাক্তিত্ব’র সাংবাদিক হওয়া বা সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে হেয় করা তাচ্ছিল্য করে তার দিকে অযোগ্যতার অঙ্গুলি তোলা আদৌ ঠিক নয়। যদিও তিনি ভিন্ন মতের হন। হুজ্জাতুল ইসলাম কাসিম নানুতবী (রঃ) ১৮৮০ সালে ইন্তেকাল করেন।

আকাবীরে দেওবন্দ ও তাদের অবদানঃ[সম্পাদনা]

মূলত কওমি শিক্ষাধারা একটি আন্দোলন। মিশনারি স্পৃহা নিয়ে কওমি আলেমরা কাজ করে যাচ্ছেন। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের বিভিন্ন স্থানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ও অনুদান ছাড়া এত বিশাল আয়তনের মাদরাসাগুলো গড়ে উঠেছে, যা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। ক্রমান্বয়ে কওমি শিক্ষাধারা শহরে ও গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃতি লাভ করছে। আল্লাহ তায়ালার ওপর তাওয়াক্কুল বা নির্ভরতা এবং জনগণের স্বেচ্ছাপ্রণোদিত শ্রম ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ কওমি মাদরাসা। দারুল উলুম দেওবন্দ শত বছরের পথপরিক্রমায় লাখ লাখ বিশেষজ্ঞ আলেম,ইমাম, খতিব, লেখক ও বিতার্কিক তৈরি করেছে। পবিত্র কুরআনের প্রামাণ্য তাফসির, হাদীসে রাসূল সা:-এর গবেষণাধর্মী ভাষ্য এবং ফিকহে ইসলামীর ব্যাখাগ্রন্থ তাদের হাতে তৈরি হয়েছে। যেমনÑ

*বিশ্বনন্দিত গবেষক সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদভী

*পাকিস্তানের উত্তর চিফ মিনিস্টার মুফতি মাহমুদ আহমদ

*মুফাসসিরে কুরআন আল্লামা মুফতি মুহাম্মদ শফি

*আল্লামা সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মাদানী (রঃ)

*মাওলানা ওবায়দুল্লাহ সিন্ধী,

*হাকিমুল উম্মত আল্লামা আশরাফ আলী থানভী

* আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরি

* আল্লামা ইদরিস কান্ধলভী

* আল্লামা শিব্বির আহমদ ওসমানী

* মাওলানা মানযুর নোমানী

* আল্লামা কারি মুহাম্মদ তৈয়ব

*আল্লামা ইউসুফ বান্নুরী

* মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী

* খতিব উবায়দুল হক জালালাবাদী

* হজরত আবদুল করিম শায়খে কৌড়িয়া

* আল্লামা তকি ওসমানী

* মাওলানা আতহার আলী

* খতিবে আজম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ

*মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর

*শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক

* মুফতি ফজলুল হক আমিনী

* আল্লামা আহমদ শফী প্রমুখ।

ভারতে ‘ব্রিটিশ খেদাও’ আন্দোলনে কওমি আলেমদের কোরবানি ইতিহাসে সোনালি অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ভারত মহাসাগরের সুদূর আন্দামান নিকোবরে স্থাপিত ব্রিটিশ বন্দিশালায় ইংরেজদের অকথ্য নির্যাতনে যারা প্রাণ হারিয়েছেন, তাদের মধ্যে বেশির ভাগ আলেম দেওবন্দ ঘরোনার। ভারত-বাংলাদেশে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় কোনো ফিতনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে কওমী মাদরাসা ছাত্র-শিক্ষকদের রাজপথে প্রতিবাদমুখর হতে দেখা যায়। ‘বিশ্বের বহু দেশের মুসলিমরা ধর্মীয় পথনির্দেশনার জন্য তাকিয়ে থাকেন ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দের দিকে। সরকারি তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে কওমি মাদরাসার সংখ্যা ১৩ হাজার ৯০২। শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৪ লাখেরও বেশি। তবে বেসরকারি হিসাব মতে, কওমি মাদরাসার সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। বহু বছর ‘দরসে নিজামী’ ছিল উভয়ধারার মাদরাসার অভিন্ন পাঠ্যক্রম। ফিকহ, আরবি সাহিত্য, মানতিক, হিকমত ও প্রাচীন দর্শন ছিল এ পাঠ্যক্রমের বৈশিষ্ট্য। পরবর্তীকালে সিহাহ সিত্তাহ বা ষষ্ঠ প্রামাণ্য হাদিস গ্রন্থ সংযোজিত হয়। এগুলো হলো বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, আবু দাউদ, নাসায়ী ও ইবনে মাজাহ। সময়ের ব্যবধানে সিলেবাসে পরিবর্তন এসেছে।

হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী (রঃ)[সম্পাদনা]

আশরাফ আলী থানভী ছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক, ইসলামি গবেষক ও পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি আকাবীরে দেওবন্দের মতাবলম্বী একজন চিন্তাবিদ। ১৯ আগস্ট ১৮৬৩ ইংরেজী জন্মগ্রহণ করেন,এবং ২০ জুলাই ১৯৪৩ ইংরেজী ইন্তেকাল করেন। ভারতের থানা ভবনের অধিবাসী হওয়ায় তাঁর নামের শেষে "থানভী" যোগ করা হয়। তিনি ইলমে তাসাউফ বা আধ্যাত্মিক লাইনেও ছিলেন বেশ পরিচিতি লাভ করেন এবং উপমহাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তার কাছে আসতেন ইলমে তাসাউফের দীক্ষা নেবার জন্য। তিনি দাওয়াতুল হক্ব নামে একটি দাওয়াতি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা করেন। বাংলাদেশে এর প্রধান ছিলেন আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী (রঃ)। এর পর হযরত মাওলানা মোহাম্মাদ উল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর (রঃ) এর হাল ধরেন।বর্তমানে এর দায়িত্বে আছেন যাত্রাবাড়ীর  মোহতামীম হযরত মাওলানা মাহমুদুল হাসান সাহেব।  মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রঃ) পিতার দিক থেকে হযরত ওমরের এবং মাতার দিক থেকে হযরত আলী (রাঃ) এর বংশধর ছিলেন বলে জানা যায়। তবে এর ধারাবাহিক কোন বংশ তালিকা পাওয়া যায়নি।

পাঁচ বছর বয়সেই তিনি মা কে হারান। শৈশবেই তিনি হাফেয হোসাইন আলীর (রঃ) কাছে কুরআন মুখস্থ করেন। এর পাশাপাশি  নিজ গ্রামের ই  ফতেহ মুহাম্মদ থানভীর কাছে ফার্সি ও আরবি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১২৯৫ হিজরীতে আশরাফ আলী  থানবী (রঃ) ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। পাঁচ বছর পর ১৯ বছর বয়সে তিনি দেওবন্দের শিক্ষা সমাপ্ত করেন। দারুর উলুম দেওবন্দে তিনি হাদীস, তাফসীর, আরবী সাহিত্য, ইসলামী দর্শন, যুক্তিবিজ্ঞান, ইসলামি আইন এবং ইতিহাস অধ্যায়ন করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম যুগের শিক্ষা সমাপনকারী ছাত্রদের মাঝে তিনি অন্যতম। এরপর তিনি মক্কা মুকাররমায়  আবদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কীর কাছে ইলমে কেরাত ও তাজবীদের শিক্ষা গ্রহণ করেন। তাঁর রচিত অমর কীতির মধ্যে রয়েছে বয়ানুল কোরআন বা তাফসীরে আশরাফী,বেহেশতি জেওর সহ শতাধিক মূল্যবান গ্রন্থ। এখানে দেখা যাচ্ছে আশরাফ আলী থানবী (রঃ) দারুল উলূম দেওবন্দে ভর্তি হওয়ার আগে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার্জন করেছেন।

সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মদনী (রঃ) [সম্পাদনা]

উনবিংশ-বিংশ শতকের এক মহান সংস্কারক ভারতের অন্যতম জাতীয়তাবাদী রাজনীতিবিদ, দার্শনিক,আধ্যাত্মিকতা জগতের এক মহান রাহবর, লেখক গবেষক ও ও ইসলামি স্কলার কুতবে আলম খ্যাত শায়খুল হাদীস হযরত মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানী (রঃ) ৬ অক্টোবর ১৮৭৯ ঈসায়ী ভারতের উত্তর প্রদেশে ভারতের উত্তরপ্রদেশের উন্নাও জেলার বাঙ্গার মৌজায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম সৈয়দ হাবিবুল্লাহ এবং মাতার নাম নুরুন্নেসা। তার পিতা উর্দু, ফার্সি ও হিন্দি ভাষার পন্ডিত ছিলেন এবং এলাহদাদপুরের নিকটস্থ একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। সেই সুবাদে হোসাইন আহমদ মদনী (রঃ) প্রথমিক শিক্ষা তাঁর বাবার কাছ থেকেই অর্জন করেন। তার আরেকটি উপনাম হলো “চেরাগ মুহাম্মদ” । বংশগতভাবে পিতা ও মাতা উভয়ের দিক থেকেই তিনি মুহাম্মদ (সঃ)-এর বংশধর। পঞ্চম পূর্বপুরুষ শাহ  মুদনে গিয়ে উভয়ের বংশধারা মিলিত হয়। হোসাইন ইবনে আলী (রাঃ) ছিলেন তার ৩৩ তম পূর্বপুরুষ। তবে এর লিখিত কোন বংশপরস্পরা তালিকা পাওয়া যায়নি। একটি স্বপ্নের ভিত্তিতে এই সম্পর্ক স্থাপনের কথা জানানো হয় বলে জানা যায়। তারা শাহ ফজলুর রহমান গঞ্জে মুরাদাবাদীর মুরিদ ছিলেন।

তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস,খেলাফত আন্দোলন এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাবশালী নেতা ছিলেন। দেওবনদী মসলকের ওলামায়ে কেরামের কাছে হাকিমুল উম্মত আশরাফ আলী থনবী (রঃ) ও হোসাইন আহমদ মদনী (রঃ) এর প্রভাব ভারতবর্ষে সমধিক পরিচিত ও ব্যাপৃত। ভারতীয় জাতীয়তাবাদের রাজনীতির প্রতি তাঁর অগাদ ভালোবাসা ও অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক পদ্মাভ’ষণে যাদেরকে প্রথম ভূষিত করা হয়েছিল তিনি তাদের অন্যতম। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার তাকে এই পদকে ভূষিত করে এবং । ২০১২ সালের ২৯ আগস্ট ভারতীয় ডাক বিভাগ তার সম্মানে একটি স্মারক ডাকটিকিট বের করেছে। ইসলামের খেদমতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ উপমহাদেশের উলামায়ে কেরাম তাকে শায়খুল ইসলাম উপাধিতে ভুষিত করেছেন।

মদীনায় হিজরত[সম্পাদনা]

১৮৯৯ সালে তিনি মদীনা চলে যান এবং মসজিদে নববীতে অবৈতনিক শিক্ষকতা শুরু করেন। মসজিদে নববীতে তিনি ১৮ বছর শিক্ষকতা করেছেন যার কারণে তাকে ‘শায়খুল হারাম’ও বলা হয়। ১৯১৫ সালে মাহমুদ হাসান দেওবন্দি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে মদীনায় গেলে তিনিও তার সাথে যোগ দেন। ১৯১৬ সালে মক্কার শরিফ হুসাইন বিন আলীর বিদ্রোহের কারণে হেজাজের নিয়ন্ত্রণ ব্রিটিশদের হাতে চলে গেলে দেওবন্দী গ্রেফতার হয়ে মাল্টায় নির্বাসিত হন। দেওবন্দীর বার্ধক্যের কথা চিন্তা করে মাদানী তার সাথে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেন। ১৯১৭ সালের রবিউস সানি মাসে তারা মাল্টা দ্বীপে প্রেরিত হন। সেখানে তখন বিভিন্ন দেশীয় প্রায় ৩০০০ যুদ্ধবন্দী বিদ্যমান ছিল। মাদানী আজীবন রাজনীতিতে মাহমুদ হাসান দেওবন্দির নীতি অনুসরণ করেছেন এবং ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন।

শিক্ষা জীবন ঃ[সম্পাদনা]

বাড়ীতে মায়ের কাছে ও মক্তবে শিক্ষকের কাছে এবং পিতার কাছে স্কুলে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত মোট আট বছর লেখাপড়া করেন। এখানে উল্লেখ করা আবশ্যক যে তখন স্কুলের সর্বোচ্চ শ্রেণীকে প্রথম শ্রেণী এবং সর্বনিম্ন শ্রেণীকে অষ্টম শ্রেণী বলা হত। মদনী (রঃ) অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে দ্বিতীয় শ্রেণী অর্থাৎ সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখা করেন। এখানে মাতৃভাষা উর্দু, ইতিহাস,ভূগোল,বীজ গণিত, পাটিগণিত ইত্যাদি শাস্ত্রে দক্ষতা অর্জন করেন। কিন্তু স্কুল শিক্ষা তার পছন্দ না হওয়ায় স্কুলের শিক্ষাজীবন সমাপ্তির এক বছর পূর্বে তাকে দারুল উলুম দেওবন্দে পাঠিয়ে দেয়া হয়। দারুল উলূম দেওবন্দে ৭ বছর সহ মোট ১৫ বছর শিক্ষা জীবন কাটান। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৯ বছর। এর পর মদীনার মসজিদে নববীতে ইলমে হাদীসের দারসে (পাঠচক্রে) পড়া শোনা করেন। ১৯০৮ সালে মদিনা থেকে ফিরে এক বছর মাহমুদ হাসান দেওবন্দীর কাছে পুনরায় হাদীস অধ্যায়ন করেন।  মাওলানা সায়্যিদ হোসাইন আহমদ মদনী (রঃ) ৭ বছরে দারুল উলূম দেওবন্দে দরসে নিজামীর অন্তর্ভুক্ত ১৭টি বিষয়ের উপর ৬৭টি কিতাব অধ্যায়ন করেন। ১১ জন শিক্ষক মন্ডলির মধ্যে মাহমুদ হাসান দেওবন্দীর (রঃ) কাছেই ২৪টি কিতাব পড়েছেন। তন্মধ্যে ১০টি শ্রেণীকক্ষে এবং ১৪টি ব্যক্তিগতভাবে। এর মধ্যে একটি পাঠচক্র উদ্ভোধনে জগদ্বিখ্যাত শায়খুল হাদীস খলিল আহমদ সাহরানপূরী (রঃ) ছিলেন। যার বিশেষ ছাত্র ছিলেন মাওলানা মওদুদীর উস্তাদ। অপর দিকে মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) দশম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে সনদ পরীক্ষায় বোর্ডে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। এ দিক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মাওলানা মওদুদী যে একেবারেই পিছিয়ে এটা নিরেট অপপ্রচার ছাড়া আর কিছু নয়। কারণ শায়খুল ইসলাম মদনীর (রঃ) মত মানুষ মাওলানা মওদুদী কে যোগ্যতার মাপকাঠিতে যাচাই করেই পত্রিকার সম্পাদক নিয়োগ করেছিলেন।

একজাতী তত্ব ও কাফের ফতোয়ার শিকার ঃ[সম্পাদনা]

ব্যাতিক্রমী জীবন মান আর বিচিত্র অভিজ্ঞতার অধিকারী হোসাইন আহমদ মদনী (রঃ) বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং বৃটিশদের বিরোধিতার কারণে মাল্টার নির্বাসন জীবন ছাড়াও ছ বারেরও বেশী কারাবরণ করেন। সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার হলো তিনি কারাগারে ও মাল্টায় বন্দী থাকালে ই তার স্ত্রী ও সন্তানাদী মারা যান তিনি দেখতে বা দাফন কাফনেও শরীক হতে পারেননি। তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের রাজনীতির প্রতি অবিচল থাকার কারণে কখনো ভারত বিভক্তি চানননি। এতে বিরুদ্ধবাদীরা তাকে কাফের ফতোয়া দিলে তিনি ১৯৩৮ সালে মুত্তাহিদায়ে ক্বওমিয়ত ও ইসলাম বা একজাতী তত্বমুলক দর্শন ইসলাম সমর্থিত বলেন। এতে অন্যান্য মুসলিম দল বিশেষতঃ মুসলিম লীগ আর আল্লামা ইকবালের মধ্যে বিরোধ  তুঙ্গে হয়ে উঠে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ক্রমশ শারিরিক ভাবে দুর্ভল হয়ে পড়েন এবং রাজনীতি থেকেও দুরে সরে যান এবং ৫ ডিসেম্বর ১৯৫৭ ঈসায়ী ইন্তেকাল করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনাবলী হচ্ছেÑ নকশে হায়াত, হামারা হিন্দুস্তান আওর উসকে ফাজায়েল, আশ শিহাবুস সাকিব । এ ছাড়াও তার লিখিত চিঠি ও বয়ান সমূহ ফরমুদাতে মদনী ও মকতুবাতে শায়খুল ইসলাম নামে প্রকাশিত হয়েছে।

দুই ধারার মেলবন্ধন ঃ[সম্পাদনা]

একই সিলেবাসে পাঠদান পদ্ধতি চালু থাকায় আলিয়া ও কওমি মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে মানসিকতার মেলবন্ধন, চেতনার ঐক্য ও চিন্তার সাদৃশ্য পরিলক্ষিত হয়। ইসলামী বৈরী শক্তির মোকাবেলায় উভয় ধারার আলেমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। দেওবন্দ, সাহারানপুর, লাহোর, মুলতান, করাচি এবং চাটগাঁর হাটহাজারী থেকে দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রিধারী বহু আলেম আলিয়া পদ্ধতির দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে দ্বীনের খিদমতে নিয়োজিত ছিলেন এবং রয়েছেন। অন্য দিকে দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল পাস করে, কওমি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে প্রাথমিক স্তর থেকে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্নকারী আলেমের সংখ্যাও কম নয়।

এক সময়ে বিপুলসংখ্যক দেওবন্দী আলেম আলিয়া মাদরাসায় ইলমের খিদমতে নিয়োজিত ছিলেন। আলিয়া মাদরাসার কামীল ডিগ্রিধারী অনেক আলেমের কওমি মাদরাসায় শিক্ষকতা করার রেকর্ডও আছে। আল্লামা আশরাফ আলী থানভী রহ:-এর ভাগিনা আল্লামা জাফর আহমদ উসমানী এবং বায়তুল মোকাররমের জাতীয় মসজিদের খতিব মাওলানা উবায়দুল হক ছিলেন ফাজিলে দেওবন্দ। তারা সারা জীবন শিক্ষকতা করেছেন ঢাকা আলিয়া মাদরাসায় এবং সদরুল মুদাররিসিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। আল্লামা মুহাম্মদ ফজলুল্লাহ ছিলেন ফাজিলে সাহারানপুর। সারা জীবন নাজিমে আ’লা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতী হাকিমিয়া আলিয়া মাদরাসায়। বুখারির ব্যাখ্যাগ্রন্থ “ইন’আমুল বারী”-এর লেখক মাওলানা মুহাম্মদ আমীন, কবি ইকবালের শিকওয়া ওয়া জওয়াবে শিকওয়ার ভাষ্যকার মাওলানা আবদুন নুর ও মুহাদ্দিস মাওলানা আবদুর রশিদ চুনতী হাকিমিয়া আলিয়া মাদরাসা থেকে ফাজিল ডিগ্রি নেয়ার পর দারুল উলূম দেওবন্দে অধ্যয়ন করে দাওরায়ে হাদিস পাস করেছিলেন।

আল্লামা আশরাফ আলী থানভীর প্রখ্যাত খলিফা মাওলানা ইসহাক বর্ধমানী উত্তর প্রদেশের কানপুর মাদরাসার মুহাদ্দিস ও মুহতামিম ছিলেন। জীবনের শেষ দিকে তিনি কলকাতা আলিয়া মাদরাসায় হাদিসের ওস্তাদ হিসেবে যোগ দেন।

ঢাকা আলিয়া মাদরাসার শিক্ষক আল্লামা সাইয়েদ মুফতি আমিমুল ইহসান লিখিত ৩৪৫ পৃষ্ঠার ‘কাওয়ায়েদুল ফিকহ’ দারুল উলুম দেওবন্দে ইফতা বিভাগে পাঠ্যতালিকাভুক্ত। বাংলাদেশের প্রাচীনতম কওমি মাদরাসা দারুল উলুম হাটহাজারীর দু’জন প্রতিষ্ঠাতা যথাক্রমে মাওলানা মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ সাহেব ও মাওলানা আবদুল হামিদ ছিলেন চট্টগ্রাম মুহসিনিয়া আলিয়া মাদরাসার ফাজিল। চট্টগ্রাম দারুল উলুম আলিয়া মাদরাসার শায়খুল হাদিস মাওলানা মুহাম্মদ আমিন ছিলেন হজরত আল্লামা আশরাফ আলী থানভীর বিশিষ্ট মুরিদ এবং কওমি মাদরাসায় আলেমদের সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের চট্টগ্রাম মহানগরীর দায়িত্বশীল। পটিয়া আল জামিয়াতুল ইসলামিয়ার প্রধান পরিচালক মাওলানা আবদুল হালিম বুখারি শিক্ষকতা জীবনের সূচনা করেন সাতকানিয়া আলিয়া ও টাঙ্গাইল আলিয়া মাদরাসার হাদিসের ওস্তাদ হিসেবে। বরিশালের চরমোনাইতে একই ক্যাম্পাসে আলিয়া ও কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত। উভয় মাদরাসার পরিচালক ও মুরব্বি হিসেবে রয়েছেন চরমোনাইর পীর সাহেব।

আলিয়া ও কওমি ঘরানার ওলামা-মাশায়েখদের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক  ইস্যুতে এক প্ল্যাটফর্মে জমায়েত হয়ে অভিন্ন রূপরেখা প্রণয়ন করার ইতিহাস আছে। ১৯৫২ সালের আলেমদের ঐতিহাসিক ২২ দফায় উভয় ঘরানার আলেমরা স্বাক্ষর করেন, যার ভিত্তিতে ১৯৫৬ সালের সংবিধান রচিত হয়। আলিয়া ও কওমি ঘরানার ওলামা-মাশায়েখের মধ্যে যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও সহমর্মিতার ঐতিহ্য রয়েছে তা ধরে রাখতে হবে। সংযমী আচরণের মাধ্যমে একে অপরের কাছে আসার সুযোগ আছে। ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে যেন ফাটল না ধরে, এ ব্যাপারে উভয় ঘরানার মুরব্বিদের সচেতন থাকার প্রয়োজনীয়তা সবচেয়ে বেশি। ঐক্যই শক্তির উৎস। এ জাতীয় দৃষ্টান্ত ভারত ও বাংলাদেশে অনেক। আলিয়া ও কওমিধারার ছাত্র-শিক্ষকের মাঝে পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। অনেকে ইতিহাস না জেনে অপরের প্রতি কঠিন মন্তব্য ও রূঢ় আচরণ করে থাকেন। এতে দ্বন্ধ ও দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের কিছু জায়গায় দেওবন্দী-বেরেলভী বিরোধ এখনো তুঙ্গে থাকলেও পরিস্থিতির উন্নতি লক্ষ করা যায়। উভয় ঘরানায় উদারপন্থী, সহনশীল ও বৈশ্বিক চিন্ত-চেতনার ওলামা-মাশায়েখ আছেন। কিছু মাসায়েলে ইখতিলাফ ও ভিন্নতা সত্বেও উভয়  ধারার আলেমরা সহনশীল মানসিকতার চর্চা করতে পারলে সমাজে উম্মতের ঐক্যের নির্ভুল বার্তা যেত।

(ডঃ আ ফ ম খালেদ হোসাইন লিখিত প্রবন্ধ-দৈনিক নয়া দিগন্ত। লেখক  অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ওমর গণি এম ই এস ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম

রেশমী রুমাল আন্দোলনঃ (১৯১৩- ১৯২০ )[সম্পাদনা]

বৃটিশ খেদাও আন্দোলন ও ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে বারবার স্বশস্ত্র আন্দোলনে ব্যর্থ হওয়ার পর বিচলিত দেওবন্দী ওলামায়ে কেরাম বৃটিশদের বিতাড়নে বহির্জগতের সামরিক হস্তক্ষেপ কামনার একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এই পরিকল্পনার একটি অংশ ছিল চিঠি লিখে দুত প্রেরণ করার মাধ্যমে।  ইতিহাস খ্যাত রেশমি রুমাল আন্দোলোন বলতে ব্রিটিশ শাসন থেকে ভারতকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যে ১৯১৩ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে দেওবন্দি নেতাদের কর্তৃক সংগঠিত আন্দোলনকে বোঝায়। এতে উসমানীয় সাম্রাজ্য, জার্মান সাম্রাজ্য ও আফগানিস্তানের সহায়তা নেয়ার পরিকল্পনা করা হয়। আফগানিস্তানে দেওবন্দি নেতা উবাইদুল্লাহ সিন্ধির কাছ থেকে পারস্যে অন্য আরেকজন নেতা শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসানের (রঃ) কাছে পাঠানো চিঠি উদ্ধারের মাধ্যমে পাঞ্জাব সিআইডি পরিকল্পনার কথা জানতে পারে। ব্রিটিশ রাজ উৎখাতের পরিকল্পনা একটি রেশমের কাপড়ের উপর লেখা হয়েছিল বলে এই নামে এর নামকরণ করা হয়।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৯১৫ সালের অক্টোবরে মাওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধি (রঃ) ও দারুল উলুম দেওবন্দের প্রিন্সিপাল মাওলানা মাহমুদ হাসান কাবুলের দিকে যাত্রা করেন। ভারতের উপজাতীয় এলাকায় একটি মুসলিম বিদ্রোহ ঘটানোর পরিকল্পনা ছিল। এ উদ্দেশ্যে উবাইদুল্লাহ সিন্ধি আফগানিস্তানের আমির হাবিবুল্লাহ খানকে ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার জন্য প্রস্তাব করতে চেয়েছিলেন। অন্যদিকে শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান জার্মান ও তুর্কিদের সাহায্য চান। মাহমুদ হাসান হেজাজের দিকে অগ্রসর হন। এর মধ্যে উবাইদুল্লাহ সিন্ধি (রঃ) আফগানিস্তানের আমিরের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপনে সক্ষম হন। তাকে তুরস্কে পৌছে দিতে তার সাথে আসা অনুসারী ছাত্রদের নিয়ে কাবুলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্যান-ইসলামি উদ্দেশ্য সর্বোত্তম ভূমিকা রাখতে পারবে। ব্রিটেনের বিরুদ্ধে খলিফার জিহাদে যোগদানের জন্য তিনি তুরস্ক যেতে ইচ্ছুক ছিলেন।

বার্লিন-ভারতীয় কমিটি (যা ১৯১৫ সালের পর ভারতীয় স্বাধীনতা কমিটিতে রূপ নেয়) ইন্দো-জার্মান-তুর্কি মিশনে রূপ নেয় যার আওতায় ইন্দো-ইরানি সীমান্তের উপজাতিগুলোকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে উৎসাহ দেয়ার কথা ছিল। এই গ্রুপ ১৯১৫ সালের ডিসেম্বরে কাবুলে দেওবন্দিদের সাথে মিলিত হয়। এই মিশন ভারতীয় আন্দোলনের কর্মীদের ভারতের সীমানায় নিয়ে আসার পাশাপাশি জার্মান সম্রাট, আনোয়ার পাশা ও মিশরের খেদিব আব্বাস হিলমির বার্তা নিয়ে আসে যাতে ভারতের বিরুদ্ধে অগ্রসরের কথা উল্লেখ ছিল। মিশনের তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানের আমিরের ব্রিটিশ ভারতের বিরুদ্ধে অগ্রসর হওয়া এবং আফগান সরকারের কাছ থেকে চলাচলের উন্মুক্ত পথ লাভ করা। কিন্তু পরিকল্পনা ফাঁস হওয়ার পর শীর্ষ দেওবন্দী নেতারা গ্রেপ্তার হন। শাইখুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসানকে মক্কা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় শায়খুল হিন্দের ছাত্র শায়খুল ইসলাম হোসাই আহমদ মদনী (রঃ) মক্কায় ছিলেন তাই উস্তাদের বার্ধ্যকতার কথা চিন্তা করে তিনিও উস্তাদের খেদমতে নিজেকে উৎসর্গ করেন। তাই  হুসাইন আহমদ মাদানিসহ তাদেরকে মাল্টায় নির্বাসন দেয়া হয়। ২০১৩ সালের জানুয়ারি ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে রেশমি রুমাল আন্দোলনের স্মরণে স্মারক ডাকটিকেট প্রকাশ করেন। এছাড়াও ইতিহাসবিদ ইলা মিশ্র এই আন্দোলন নিয়ে রেশমী রুমাল ষড়যন্ত্র নামে একটি বই লিখেছেন।

অভিযোগঃ[সম্পাদনা]

সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) আলেম নয় ![সম্পাদনা]

মাওলানা মওদুদী (রঃ) ভারতের হায়দরাবাদের (বর্তমান মহারাষ্ট্র) আওরঙ্গবাদ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম সায়্যিদ  আহমদ হাসান, তিনি পেশায় ছিলেন একজন আইনজীবী। মাওলানা মওদুদী বংশীয় দিক দিয়ে সাইয়্যিদুনা হুসাইন (রাঃ) এর ৩৬তম উত্তর পুরুষ। তাঁর ২৩তম পূর্বপুরুষ খাজা মঈন উদ্দীন মওদুদ চিশতি (রঃ)।

মাওলানা সায়্য্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) আলেম নয় একজন সাংবাদিক স্ব-শিক্ষিত তিনি কোন মাদ্রাসা পড়–য়া ডিগ্রীদারী আলেম নয় বরং একজন সাহিত্যিক বা ভালো লেখক বলা যায়। তাই তাঁর রচিত কোরআন হাদীসের ব্যাখ্যা এবং ইসলামী শরীয়তের বিধিবিধান সম্পর্কিত মতামত গ্রহনযোগ্য নয় বলে জনশ্রæতি আছে। এই জনশ্রæতির ভিত্তিতে আমি নিজেও ছাত্র বেলা থেকে এবং কর্মজীবনে এসেও অনেক লেখালেখি সেমিনার স্যাম্পুজিয়াম ও ওয়াজ মাহফিলে ঘরোয়া পরিবেশে মসজিদের মিম্বরে বয়ান রেখেছি। পরবর্তিতে আমি নিজে যখন এ বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু হলাম তখন ই সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ)এর শিক্ষা জীবন ও শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি নিয়ে কিছু ঘাটাঘাটি করে বুজতে পারলাম তিনি স্বশিক্ষিত নয় বরং উচ্চশিক্ষিত এবং সঠিক পদ্ধতিতে একজন উপযুক্ত আলেম। আর কেবল আলেম ই নয় জগদ্বিখ্যাত আলেম। এতটাই বিখ্যাত ও সু পরিচিত এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব যে এই উপমহাদেশে এই মানের আর কোন আলেম তার আগের পেছনের শত বছরেও আর একজন ছিলেন বলে মনে হয়না। অথচ তাঁকেই এই উপমহাদেশের ই কোন কোন দেশের কোন কোন আলেম স্ব-শিক্ষিত,অল্প শিক্ষিত,মাদ্রাসা শিক্ষিত সনদদারী আলেম নয় কোরআন হাদীস পড়েননি ইত্যাদী বলে ঢিল ছুড়েন।

কেন এই বিতর্কঃ[সম্পাদনা]

গায়্যিদ আবুল আলা মওদুদীর (রাঃ) শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ায় তাঁর কোন ক্ষতি হয়নি বরং তাঁর যোগ্যতা প্রতিভা ও গবেষণা নিয়ে শিক্ষিতজনদের আগ্রহ আরো বেড়ে যায়। এতে একদিকে তার পরিচিতি এবং তার রচনা শৈলী পড়ে তাঁর প্রতি তার যোগ্যতার প্রতি আগ্রহ আগ্রহ আরো বেড়যায় বেড়ে যায় তাঁর গ্রহণযোগ্যতাও। বিশেষতঃ ভারতবর্ষের বিশেষ বিশেষ কোন এলাকায় বিশেষ বিশেষ কিছু ইউনিটিতে  এই বিতর্ক বা অপপ্রচারের মাত্রা বেশী।  বিষয়টিকে নিছক একটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলে আঁড় চোখে দেখার বা আমলে নেয়ার সুযোগ নেই বলে আমি অনুধাবন ও হ্রদয়ের গভীর থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছি। বরং আমি এ বিষয়টি একাধিক কারণে হয়েছে যা হওয়াটাই যুক্তি-যুক্ত ও স্বাভাবিক। এতে অবাক হওয়ার বা গালি দেওয়ার কোন সুযোগ নেই দু একটি ব্যাতিক্রম ছাড়া। যেমন এর পেছনে যে সব কারণ কাজ করেছে আমার অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ

(এক) শিক্ষা জীবন সম্পর্কে লেখার গুরুত্ব না দেয়া ঃ[সম্পাদনা]

সায়্যিদ আবুল আলা মওদূদীর (রঃ) বিরাহমীন কলমী আন্দোলন রাজনৈতীক আন্দোলন গবেষণামূলক কার্যক্রম ও নিজের দেশের বাইরেও বিভিন্ন মিটিং সভাসেমিনার সেই সাথে ভিন্নমতাবলম্ভিদের লাগামহীন বে পরোয়া পদচারণা মাওলানার নিজের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত দল পরিবার ও প্রতিষ্ঠান মাওলানার শিক্ষা জীবনের একটা সারসংক্ষেপ স্বতন্ত্রভাবে লিপিবদ্ধ করে প্রকাশের না সময় পান আর না প্রয়োজন মনে করেন। আল্লাহ যাকে চান তাকে এ ভাবেই উপরে উঠাতে পারেন। এ জন্য কোন প্রচার প্রচারণা বা ডাক ঢোল পেঠানোর প্রয়োজন পড়েনি। তাই বিষয়টি শুধু যে দলের ও মতের বাইরের লোকেরই অজানা তা নয় বরং দলের ভেতরের এবং মাওলানার সমর্থকদের অনেকেও মাওলানার শিক্ষা জীবনের পুরো হিষ্ট্রী জানেন না তবে গাছের পরিচয় তার ফলেই মিলে এই সত্যবাকের আলোকে তাঁর রচনাবলির গভীরে ই যে তার যোগ্যতা লুকিয়ে আছে এ কথা বিশ্বাসের কোন ত্রæটি নেই। এ জন্য বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর দায়িত্বশীল সহ যারা মাওলানা মওদুদীর (রঃ)  জীবন ও কর্ম নিয়ে লিখেছেন তারা শিক্ষা জীবনের বিষয়টি স্বতন্ত্র ভাবে লেখার খুব গুরুত্ব দেননি বা অনুভব বা প্রয়োজন মনে করেননি। ।

(দুই) সমকালীন পরিবেশ পরিস্থিতি বিষয়ে না জানা ঃ[সম্পাদনা]

মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা (রঃ) ভারতবর্ষের রাজনৈতীক সামাজিক ধর্মীয় ও শিক্ষা ব্যবস্থার যে পরিবেশ পরিস্থিতির সময়ে জন্মগ্রহণ করেন সে সময় এবং তারও বহূ বছর আগে থেকেই শিক্ষা দান ও শিক্ষা গ্রহণের কি পদ্ধতি বা ধরণ চলে আসছিল এ সম্পর্কে সঠিক পদ্ধতিতে সঠিক ধারণা বা জ্ঞান না থাকার কারনেই এই বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষতঃ মাওলানা মওদুদী (রঃ) লেখনির মাধ্যমে গোটা ভারতবর্ষকে একটি আদর্শিক বিপ্লবের বিষয়ে সচেতন করার মিশন নিয়ে কাজ করায় তাঁর প্রতিই বেশি দৃষ্টি নিবদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক। আর সেটাই হয়েছে এবং হচ্ছে। অথচ সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদীর চেয়ে উচ্চজ্ঞান সম্পন্ন উচ্চমর্য্যাদা সম্পন্ন ওলামায়ে কেরামের বিষয়ে এমন বিতর্ক সৃষ্টি হয়নি। কারণ তারা একটা বিশেষ পরিমন্ডলে স্ব-মহিমায় ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে যাচ্ছিলেন। তাদেরও কিন্তু শিক্ষার্জনের ধরণ মাওলানা আবুল আলা মওদুদীর মতই ছিল। এবং তাদের সাথেই মাওলানা মওদুদীর (রঃ) শিক্ষকদের সিলসিলা মিলিত যাদের সাথে মিলিত আকাবীরে দেওবন্দ ও আকাবীরে বেরেলীদের সিলসিলা মিলিত। আমাদের এই বিষয়ে জানার সুযোগ দেয়া হয়নি আমরা জানার চেষ্টা করিনি এবং আমরাও আমাদের ছাত্রদের এ বিষয়ে জানাতে পারিনি। উল্লেখ সে সময়ে আল্লামা শিবলী নো'মানী,নওয়াব নিযামুল মূলক বিলগেরামী ও মাওলানা হামীদুদ্দীন ফারাহীর পরিকল্পনা অনুযায়ী হায়দারাবাদ ও আওরংগাবাদে এক নতুন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা কায়েম করা হয়। শিক্ষার মাধ্যম ছিল উর্দূ। ইতিহাস, কোরআন-হাদীস,ফেকাহ, মানতেক (তর্কশাস্ত্র) প্রভৃতি পড়ানো হতো।এ মানের মেট্রিকুলেশনকে মৌলভী, ইনটারমিডিয়েটকে মৌলভী আলেম এবং ডিগ্রী কলেজকে দারুল উলুম বলা হতো। মাওলানা মওদূদী (রঃ) সেই ধারাই ছাত্র ছিলেন।

(তিন) আলেমের সঃজ্ঞা ও ইজাযা সনদ ঃ[সম্পাদনা]

এখনো  সাধারণ মানুষ তো বটে বেশির ভাগ আলেম ও জানেন না যে কেবল ই মাদ্রাসায় কিছুদিন পড়ে বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থায় মাওলানা খেতাব পাওয়া আর একটা কাগুজে সনদের নাম ই কেবল আলেম নয়। ইসলামের ইতিহাস থেকে জানা যায় যে স্বতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পুর্ব পর্যন্ত আসহাবে রাসূল (সাঃ) তাবেয়ীন,তবে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদীন ফোকাহা এ দ্বীন ই মতীন সলফে সালেহীন এমনকি তৎকালীন মুসলিম রাজা বাদশাহগনও এবং  বর্তমানেও সালিকীনদের সকলেই ছিলেন  سند اجازة প্রাপ্ত  বা মৌখিক অনুমতি প্রাপ্ত জ্ঞানী পন্ডিত ফক্বীহ,মুফতি মুহাদ্দীস ইমামুল হুজ্জাহ ফিল হাদীস, মূফাস্সীরীন ও তাফসীরকারক ছিলেন। চার মাজহাবের প্রধান ছাড়াও অসংখ্য মুজতাহিদ ইমামগণ, ইমাম বোখারী, ইমাম মুসলিম সহ ছেহাহ ছিত্তাহ ও অন্যান্য ছহীহ হাদীসের কিতাবাদী, সুনান, মাসানিদ, মুসতাদরাক মুয়াত্তা হাদীস গ্রন্থের প্রণেতাগণের সকলেই ছিলেন সনদে ইজাযাহ প্রাপ্ত মুসলিম উম্মাহ’র রাহবর। জগতবিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইমাম গাজ্জালী,ইবনে সিনা,ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন,ইবনে রুশদ,ইবনে সিনা,ইলমে তাসাউফের স¤্রাট হাসান বসরী,আব্দুল কাদির জিলানী জুনাইদ আল বাগদাদী,বাহাউদ্দীন নকশবন্দী,মঈন উদ্দিন চিশতী,শাহজালালাল ইয়ামনী, শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিস ই দেহলভী,ছাবেরিয়া তরীকার প্রবর্তক বৃটিশ শাহ ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা মোহতামীম কাসিম নানুতবী (রাহিমাহুমুল্লাহ) সহ এই ভারত বর্ষের লাখো লাখো মুসলিম পন্ডিতগণই এই পদ্ধতির বিদ্যার্জনকারী যে পদ্ধতিতে সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) জ্ঞানাহরণ করেছেন। এই পদ্ধতিটা এখন আর নেই বলেই আমাদের অনেকেই সেই ইতিহাস সম্পর্কে জানিনা। একমাত্র ইলমে তাসাউফের সনদ সনদে ইজাযা বহাল আছে আর বাকী সকল শিক্ষা ধারার ই আমুল পরিবর্তন ঘটে গেছে। তবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ পদ্ধতিতে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিনে যেমন ধর্ম তত্ব নিয়ে জ্ঞানচর্চার ধারা বহাল আছে তেমনি থিসিস পদ্ধতিও আছে যদিও সেটাও কোন না কোন প্রতিষ্ঠানের অধীনে হয়ে থাকে। সুতরাং এটা প্রমাণিত সত্য যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াও শিক্ষার্জনের ধারা এবং কাগুজে সনদের বাইরে ইজাযাহ সনদ একটি মূলধারার স্বীকৃত পদ্ধতি। এই পদ্ধতীতে জ্ঞানার্জনকারীদের সমকালীন ব্যবহারিক ভাষায় পরিচিত বা সম্বোধন করা আলেম এর পরিপন্থি বা আলেম না হওয়ার  হাস্যকর খোড়া যুক্তির আওতায় পড়েনা। ভারতবর্ষের কিছু এলাকা ছাড়া আর কোতাৗ এই মাওলানা আল্লামা মুফতি মুহাদ্দিস খেতাব পরিচিতিও নেই এ নিয়ে দ্বন্ধও নেই। কোরআন হাদীস জানা আর ইসলামের দাওয়াতী কাজের জন্য কেবল ই একটি প্রতিষ্ঠানের চার দেয়ালের ভেতর থেকে পড়া আর একটি কাগুজে সনদের বাধ্যবাধকতা ইসলামের অনিবার্য কোন বিধান বা বিষয় নয়। এটা কেবল সামাজিক একটা সিষ্টেম। যারা এটাকে নিজেদের ই কেবল আলেম হওয়ার আর কোরআন হাদীসের বিষয়ে বা ইসলামের দাওয়াত দেয়ার একমাতও দাবীদার গন্য করে অন্যদের তাচ্ছিল্য করেন তাদের এবার এ বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার পাশাপাশি কিছু করারও দরকার।

(গ)  রাজনৈতিক প্রেক্ষপট ঃ[সম্পাদনা]

মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) কেবল ই একজন লেখক গবেষক এবং সাংবাদিক ছিলেন না তিনি এসব করতেন একটি মিশন নিয়ে যেটার মুল স্প্রিট হলো ইসলামী খেলাফত পুনরুদ্ধারে মোসলমানদের জাগ্রত করা। কারণ ইসলামী খেলাফতের পতন ঘটিয়ে একের পর এক স্বৈরাচারী,রাজতন্ত্রী,শাসন ব্যবস্থা,পাশ্চাত্য গণতন্ত্র ও পুজিবাদী সমাজতন্ত্র ব্যবস্থার কবলে পড়ে মুসলিম জাতি তাদের নিজেদের বীরত্বগাঁতা স্বতন্ত্র বৈশীষ্টপূর্ণ মর্যাদার কথা ভ’লেই গিয়েছিল।এমনকি ইসলাম যে একটি বিপ্লবী ধর্ম,কল্যাণমূখি মানবতবাদী জীবনব্যবস্থা সেটা মেনে নেয়াতো দুরে থাক বেশিরভাগ মুসলিম ই তা সহ্য করতে পারেনা। এই বেদনা থেকেই উম্মাহকে সচেতন করতেই সমকালিন বিশ্বকে ইসলামী খেলাফতের তথা ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার কল্যাণের দিক গুলো আগে শিখাতে চান অতঃপর সমকালীন ইসলামী চিন্তাবিদদের পরামর্শের আলোকে একটি রাজনৈতীক দলও গঠন করেন যার না জামায়াতে ইসলামী।

পাশ্চাত্য গণতন্ত্্র পুজিবাদী সমাজতন্ত্র সুদী অর্থনীতি নৈতীকতা,আদর্শ ও চরিত্রতা বিবর্জিত শিক্ষা ব্যস্থার আদলে শিক্ষিত লোকদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বে পরিচালিত গতানুগতিক রাজনৈতীক প্রভাবে রাজনৈতীক অঙ্গন দোষিত হওয়ার প্রেক্ষপটে এর বিকল্প হিসাবে মুসলিমদের কাঙ্খিত কোন রাজনৈতীক শক্তি না থাকায় ভালোই চলছিল বটে। কিন্তু মাওলানা মওদুদীর এই বহুমূখি বৈপ্লবিক চিন্তাধারা ও কর্মপরিকল্পনা সেই রাজনীতিবিদদের ই ভাবিয়ে তুলে। আর তারাই এই পথে যে বাধার প্রাচীর গুলোর দাঁড় করায় তার ই একটি ছিল এটা যে মাওলানা মওদুদী তো আলেম নয় যে এতো বড় বড় কিতাব লিখবেন ফতোয়া দিবেন আর সমকালীন রাজনীতিতে মিশ্র জাতীয়তা ভিত্তিক ঐক্য বিনষ্ট করবেন? এ থেকেই এই বিতর্কটি বলা যায় এই প্রচারণাটাই বাজারে বেশি প্রচার হতে থাকে। যার রেষ অনেকের কাছ থেকে এখনো কাটেনি।

ইসলাম বিদ্ধেষী শিক্ষানীতি (১৮৩৪)[সম্পাদনা]

ভারতবর্ষ যেহেতু শত শত বছর মুসলমানদের শাসনের ছিল.তাই স্বাভাবিকভাবে মুসলমানরা তাদের হারানো সম্পদ পুনরোদ্ধারে আন্দোলন শুরু করে। মুসলমানদের টার্গেট করে দেশীয় শিক্ষা বিলুপ্ত করে ১৮৩৪ সালে এমন একটি নতুন শিক্ষানীতি চালু করা হয়.খোদ ইংরেজদের দাবি-যারা এই শিক্ষানীতি গ্রহণ করবে.তারা কেবল বংশগত দিক থেকে থাকবে ভারতীয় কিন্তু মনমস্তিস্কের দিকে থেকে হবে বৃটিশ। এজন্য তৎকালিন ওলামায়ে কেরাম এই শিক্ষানীতি গ্রহণ করা হারাম ফতোয়া ঘোষণা করেন। ওলামায়ে কেরাম কিন্তু ইংরেজী শিক্ষা হারাম বলেন নি যা পরবর্তিতে ব্যাপক প্রচার করা হয় এবং অনেকে ইংরেজী ভাষা বর্জন করেন।

সিপাহী বিপ্লবঃ (১৮৫৭)[সম্পাদনা]

বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের ধারাহিকতায় ১৮৫৭ সালে শুর হয় সিপাহী বিপ্লব। দিল্লি ব্যতিত তখন সারা ভারতবর্ষ বৃটিশদের হাতে চলে গিয়ছিল। দিল্লির মসনদে ছিলেন. শেষ মোগল সম্রাট আবুল মুজাফ্ফর মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দীন বাহালুল শাহ জাফর। সম্রাট অনুগত দেশপ্রেমিক সিপাহী বাহিনী. ওলামায়ে কেরাম ও জনগণ বৃটিশ অনুগত সৈন্যের বিরুদ্ধে প্রাণপণে জিহাদে লিপ্ত হন। দেশের বিভিন্ন স্থানে ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে বড় ধরণের সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়।

পরিতাপের বিষয়. সুসজ্জিত ইংরেজ বাহিনী এবং বিশেষ করে দেশীয় মুনাফিকদের ষড়যন্ত্রের কারণে সিপাহী বিপ্লব ব্যর্থ হয়। ৯০ বছর বয়স্ক শেষ মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরও তাঁর পরিবারকে গ্রেপ্তার করে রেঙ্গুনে নির্বাসন করা হয়। দেশের বড় বড় শহরে প্রকাশ্যে গাছের ডালে ঝুলিয়ে স্বাধীনতাকামী হাজার হাজার ওলামায়ে কেরামকে শহিদ করা হয়। এর পরেও ওলামায়ে কেরামের সাহস ও মনোবল অটুট থাকে। তাঁরা ধৈর্য্যচ্যুত না হয়ে আল্লাহর উপর পুর্ণ ভরসায় অটল থাকেন। জেহাদের পাশা-পাশি তাঁরা দ্বীনি শিক্ষা প্রসার করে প্রকৃত জেহাদী-আলেম কাফেলা তৈরীর কাজে আত্মনিয়োগ করেন।

আলেমের সঃজ্ঞা ও ইজাযা সনদ ঃ[সম্পাদনা]

ইলিম থেকে আলেম । যার সহজ কথায় বলতে গেলে ইলিম অর্থ জানা বুজা আর নিজের জানা বিষয়টি আগে নিজে আমলে নেয় আর এ বিষয়ে অন্যদের জানানো। যারা এই বিশ্বাস ও বিশ্বাসের মূলে আমলে অব্যস্থ তারাই আলেম। ইমাম গাজ্জালীর মতে ইলমের সংজ্ঞা হলো এই যে- আল্লাহ প্রদত্ত যে সব জ্ঞান অহীর মাধ্যমে রাসুলের কাছে প্রেরিত হয়েছে এর সাথে আল্লাহর রাসুল (সাঃ) যে সব বিষয়ে হাতে কলমে শিখিয়েছেন তার নাম ই ইলিম। এই ইলিম বা জ্ঞানার্জনের ধারা আদিকাল থেকেই বিভিন্ন ভাবে চলে আসছে  প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হওয়ার হাজার হাজার বছর আগে থেকেই।

স্বতন্ত্র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার পুর্ব পর্যন্ত  আসহাবে রাসূল (সাঃ) তাবেয়ীন,তবে তাবেয়ীন, আইম্মায়ে মুজতাহিদিন ফোকাহা এ দ্বীন এ মতীন এবং বর্তমানেও সালিকীনদের সকলেই ছিলেন  سند اجازة প্রাপ্ত জ্ঞানী পন্ডিত মুফতি মুহাদ্দীস মূফাস্সীর ছিলেন। এ বিষয়ে জানা থাকলে এ কথা বলার কোন সুযোগ নেই যে আলেম হতে হলো কেবল ই মাদ্রাসার চার দেয়ালে লেখাপড়া করে এরাই কেবল আলেম। এর বাইরে যারা যত বড়  জ্ঞানী হোন তিনি আলেম নয় তিনি কোরআন হাদীস নিয়ে লেখা লেখি করার অধিকার রাখেন না।


এক নজরে মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ)[সম্পাদনা]

বিংশ শতাব্দীর মহান সংস্কারক মানবতার মুক্তি আন্দোলন জামায়াতে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা ও আমীর, বিশ্ববিখ্যাত মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপকার, সিলেবাস প্রণেতা ও ভাইস চ্যান্সেলর, ওআই সির রূপকার, ইসলামী চিন্তাবিদ ও দার্শনিক আল্লামা সাইয়্যেদ আবুল আলা মওদুদীর (সঃ) কর্মজীবনের সারসংক্ষেপ।

১৯১৮- সাংবাদিক হিসেবে 'বিজনোর' (ইরলহড়ৎব) পত্রিকায় যোগ দেন।

১৯২০- জবলপুরে 'তাজ' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ লাভ ।

১৯২১- দৈনিক 'মুসলিম' পত্রিকার এডিটর হিসেবে নিয়োগ ।

১৯২৫- নয়া দিল্লীর 'আল জামিয়াহ' পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ লাভ।

১৯৩৩- ভারতের হায়দরাবাদ থেকে 'তরজুমানুল কুরআন' নামক পত্রিকা প্রকাশ।

১৯৩৮- পাঠানকোটে দারুল ইসলাম ট্রাস্ট ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন।

১৯৪১- লাহোরে 'জামায়াতে ইসলামী হিন্দ' প্রতিষ্ঠা করেন ।

১৯৪২ - তাফহীমুল কুরআন নামক তাফসির গ্রন্থ’ প্রণয়ন শুর“ করেন।

১৯৪৮ - 'ইসলামী সংবিধান' ও 'ইসলামী সরকার' প্রতিষ্ঠার জন্য প্রচারণা শুরু করেন।

১৯৪৮ কারাগারে বন্দী ।

১৯৪৯ - পাকিস্তান সরকার জামায়াতে 'ইসলামী সংবিধানের রূপরেখা' গ্রহণ করে।

১৯৫০ - কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করেন।

১৯৫৩- 'কাদিয়ানী সমস্যা' নামে একটি বই লিখে গ্রেফতার অতপর ফাসির দন্ডাদেশ প্রাপ্ত হন।

১৯৫৩- মুসলিমপ্রধান দেশগুলোর চাপ এবং দেশী বিদেশী মুসলিম নেতৃবৃন্দের অনুরোধে মৃত্যুদন্ডাদেশ পরিবর্তন  অতপর প্রত্যাহর।

১৯৫৮- সামরিক শাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়্যুব খান 'জামায়াতে ইসলামী'কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

১৯৬৪- আবারো তাকে কারাবন্দী হন। একই বছর মুক্তি লাভ।

১৯৭১- পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হবে কিনা এ  সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের উপর ন্যস্ত করেন।

১৯৭২- তাফহীমুল কুরআন নামক তাফসির গ্রন্থ রচনা সম্পন্ন করেন।

১৯৭২- জামায়াতে ইসলামীর আমির পদ থেকে ইস্তফা।

১৯৭৮- তাঁর রচিত শেষ বই 'সিরাতে সারওয়ারে আলম' প্রকাশিত।

১৯৭৯- চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গমন এবং একই বছর সেখানেই ইন্তেকাল

১৯৭৯- লাহোরের ইছরায় জানাজা ও দাফন।

(১) জন্ম ও প্রাথমিক শিক্ষাঃ[সম্পাদনা]

মাওলানা সায়্যিদ আবুল আ'লা মওদুদী (রঃ) ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯০৩ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। এবং ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭৯সালে ইন্তেকাল করেন। তিনি ছিলেন বিশ্ববরেণ্য একজন মুসলিম স্কলার,একাধারে গবেষক, আইনবিদ, ইতিহাসবিদ, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ,দার্শনিক,উলূমে কোরআন ও হাদীস এবং আসমাউর-রিজালের উপর বিশেষজ্ঞ। তিনি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সংস্কারক বিপ্লবী ইসলামী চিন্তাবিদ। তাঁর সম্পর্কে উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েলস্মিথ বলেন-’মাওলানা মওদুদী (রঃ) ইসলামের সবচেয়ে নিয়মতান্ত্রিক একজন চিন্তাবিদ"।

সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) ১৯১৪ সালে হায়দারাবাদ শিক্ষা বোর্ডের অধীন মৌলভী বা এস.এস.সি/ সমমান দাখিল পরীক্ষা  দিয়ে বোর্ডে বিরল কৃতিত্বের পরিচয় দেন। এর পর  বৃটিশ খেদাও আন্দোলন জোরদার হওয়ার প্রেক্ষাপটে ভারত বর্ষে দারুল উলুম দেওবন্দ  ও বিশেষ কিছু প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি ছাড়া  বেশীর ভাগ প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি বিশেষত যারা সরাসরি বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের দমন পীড়নন চরম আকার ধারণ করে। দিল্লী দারুল উলুম দিল্লী ইসলামিয়া কলেজ সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান হয় বন্ধ করে দেয়া হয় না হয় তাদের লোক দ্বারা পরিচালনা করা হয়। বেশীরভাগ নেতৃত্ব প্রদানকারী ওলামায়ে কেরাম কে হয় শহীদ করা হয় না হয় নির্বাসনে দেয়া হয়।

সমকালীন দূরদর্শী ওলামা মাশায়েখদের সম্মিলিত পরামর্শের ভিত্তিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যক্তি কেন্দ্রিক মসজিদ ও খানকা কেন্দ্রীক উচ্চতর শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়। যে গুলো তখন স্থর বিশেষ একেকটি  কলেজ /হাই মাদ্রাসা / বিশ্ববিদ্যালয় তথা দারুল উলুম এর মর্যাদা রাখতো। মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) এমন ই কিছু ব্যাক্তি কেন্দ্রীক পরিচালিত উন্নত পাঠচক্র বা দারস থেকে শিক্ষার্জন করেন। যার ধারাবাহিকতা তখনো ভারতবর্ষে ছিল এবং দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতাগণ সহ আরো অনেক নামী দামী ইসলামী স্কলারগণ ই এই পদ্ধতিতে উচ্চ শিক্ষালাভ করেছেন যার বিবরণ আমরা ইতিমধ্যে তুলে ধরেছি।

(২) আরবী ভাষা-সাহিত্যঃ[সম্পাদনা]

সমকালীন নিয়ম ও ধারা অনুযায়ী মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ) পিতার কাছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীর পর আরবী ভাষা, যেমন-ইলমে নাহু,ইলমে সরফ,ইলমে মা'ক্বুলাত ওয়াল-বালাগাহ ওয়াল মা'আনী শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হন। আরবী ভাষা,সাহিত্য বিশেষতঃ কোরআন হাদীস ্ও আলমে ফিক্বহ ও উসূল বুজার জন্য আরবী ভাষা জানা-বুজা অতীব জরুরী। তাই মাওলানা মওদুদী (রঃ) তৎকালীন ভারতের আহলে ইলমের মধ্যে আরবী ভাষার পন্ডিত ব্যাক্তিত্ব দিল্লী দারুল উলুম এর মাওলানা শায়খ আব্দুস-সালাম নিয়াজী দেহলভীর (র:) দারস বা পাঠচক্রে ভর্তি হন। দিল্লীর দরাজ গেইট জামে মসজিদে তাঁর এই দরসগাহ ছিল। যিনি ছিলেন সমকালীন ভারতের অনেক খ্যাতিমান ওলামায়ে কেরামের উস্তাদ। তার দাদা উস্তাদ ছিলেন আকাবীরে দেওবন্দের বেশির ভাগ ওলামায়ে কেরামের উস্তাদ ও দারুল উলুম দেওবন্দের প্রতিষ্ঠাতা হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসিম নানুতবীর (রঃ) উস্তাদ মাওলানা মমলুক আলীর (রঃ)। মাওলানা মওদুদী (রঃ) মাওলানা আব্দুস সালাম নিয়াজী'র কাছ থেকে  سند إجازة (ইজাযাহ সনদ) লাভ করেন ।

(৩) হাদীস, উসূলে -হাদীস ও  ফেক্বাহ শিক্ষা ঃ[সম্পাদনা]

মাওলানা মওদুদী (রঃ) আরব আযমে স্বীকৃত মুহাদ্দিস মাওলানা খলিল আহমদ সাহরানপুরীর বিশেষ ছাত্র দিল্লীর দারুল উলুম ফতেহপুরের শায়খুল হাদীস ভারতের বিখ্যাত মুহাদ্দীস মাওলানা আশফাকুর রহমান কান্ধলভীর (রঃ) কাছে দাওরায়ে হাদীসের (কামিল/টাইটেল) সকল হাদীসগ্রন্থ পড়ে ১৯২৭ সালে হাদীসের সর্বোচ্চ  ইযাজা সনদ লাভ করেন। এর এক বছর পর ই  ১৯২৮ সনে তিরমিযি ও মুয়াত্তা ইমাম মালিক শিক্ষা দানের ইজাযাত লাভ করেন।এর পর ও আরো দু বছর সময় ইলমে হাদীস ইলমে তাফসীর ও উলূমে ফিক্বহ এর উপর তাখাসসুসাত পড়াশোনা করেন। আল্লামা ইশফাকুর রহমান কান্ধলবী (রঃ) সম্পর্কে জানা যায় যে তিনি আল্লামা জালাল উদ্দীন সুয়ুতির ভাষা ও সিন্দীর টীকা সংক্ষিপ্ত করে এবং আসমাউর রিজাল সংযোজন করে ১৩৫০ হিজরীতে সুনানে নাসাঈ দিল্লী থেকে প্রকাশ করেন। মাওলানা মওদুদী তখন তাঁর দরসের ছাত্র ছিলেন।

(৪) ফিক্বহ,তাফসীর বায়জাবী এবং আল- মাতূল ফী 'ইলম আল-মা'আনী ওয়াল- বালাগাহ এ বিষয়গুলোতে  সনদে  ইজাযাহ লাভ করেন শায়খ শরীফুল্লাহ'র (রঃ) কাছ থেকে।

(৫)  ইংরেজী ভাষা: সাহিত্য ঃ[সম্পাদনা]

মৌলভী মুহাম্মদ ফাজিল এর কাছ থেকে  ইংরেজী ভাষা, ইতিহাস,দর্শন, সমাজ বিজ্ঞান ও বিভিন্ন ধর্মের তুলনা মূলক আলোচনা পড়ে সনদে ইজাযাহ লাভ করেন। তিনি তৎকালীন ম্যাট্রিকুলেশন মানের পুস্তকাদি পড়ে ইংরেজীতে এতখানি জ্ঞান লাভ করেন যে,অসাধারণ মেধাশক্তির বলে কয়েক মাসের মধ্যেই তিনি  ইংরেজী সংবাদপত্র অথবা পুস্তক পাঠ করে তার মর্ম উপলব্ধি করতে পারতেন। দু'বছর যাবৎ তিনি ইংরেজী ভাষা অধ্যয়ন করেন। শিক্ষকের সাহায্য ব্যতিরেকেই তিনি বিভিন্ন গ্রন্থাদি শুধু অভিধানের সাহায্যে অধ্যয়ন করে প্রভূত জ্ঞান সঞ্চয় করতে থাকেন। মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদী সাহেবের (রঃ) সনদ গুলোর বিবরণ পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামী একত্রিত করে বই আকারে বের করেছে। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশিষ্ট ফকীহ এবং আলিম ড. সায়্যিদ আব্দুল হালিম মুহাম্মদ হুসাইন তাঁর  "নাযারাত ফী ফিকরি আবীল-আলা আল- মওদূদী কিতাবে আল্লামা মওদূদীর শিক্ষাগত যোগ্যতার যে বিবরণ  দিয়েছেন সেখানে তিনি এই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। ড. শায়খ আব্দুস-সালাম আযাদী ও তাই লিখেছেন।


মাওলানা সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদীর (রঃ) উস্তাদগনের সিলসিলাঃ

মাওলানা সায়িদ আবুল আলা মওদুদী (রঃ)

মাওলানা আশফাকুর রহমান কান্ধলবী (রঃ)

মাওলানা খলিল আহমদ সাহরান পূরী (রঃ) (যিনি শায়খুল ইসলাম হোসাইন আহমদ মদনীরও (রঃ) একদিনের উস্তাদ ছিলেন।

মাওলানা মাজহার নানুতবী (রঃ) (দারুল উলুম ফতেহপুরের মোহতামীম)

মাওলানা মমলুক আলী (রঃ) (যিনি কাসিম নানুতবীর (রঃ) উস্তাদ )

মাওলানা শাহ ইসহাক মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)

শাহ আবদুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রঃ)

শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দীসে দেহলভী (রঃ)

শায়খ আবু তাহির মোহাম্মাদ আল কুদি (রঃ)

শায়খ আব্দুল কুদ্দুস নিশাবী (রঃ)

শায়খ মুহাম্মাদ ইবনে আহমাদ রামলী (রঃ)

শায়খ জাকারিয়া ইবনে মুহাম্মাদ আব ুইয়াহিয়া আনসারী

শায়খ হাফিজ ইবনে হাজার আসকালানী (রঃ)

শায়খ ইবাহীম ইবনে আহমাদ তানূখী (রঃ)

শায়খ আহমদ ইবনে আবুতালিব (রঃ)

শায়খ সিরাজুল ইসলাম ইবনুল মোবারক (রঃ)

শায়খ আব্দুল আউয়াল ইবনে ঈসা আল হারুরী (রঃ)

শায়খ আব্দুর রহমান ইবনে মুজাফ্ফর দাউদী (রঃ)

শায়খ আব্দুল্লাহ ইবনে আহমদ সূরুখসী (রঃ)

মোহাম্মাদ বিন ইউসুফ ফাআল ফারাবী (রঃ)

শায়খ মুহাম্মদ বিন ইসমাল আল বোখারী (রঃ)

শায়খ আহমদ বিন আসকাব (রঃ)

শায়খ মুহাম্মদ বিন ফুজায়ল (রঃ)

শায়খ আম্মারা বিন কা'কা (রঃ)

শায়খ আবু জারয়া (রঃ)

আবু হুরায়রা রাজিয়ল্লাহু আনহু

সায়িদূনা মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম । 

মাওলানা মওদূদীর (রঃ) বংশ পরম্পরা[সম্পাদনা]

ইমামুল মুত্তাকীন সায়্যিদুনা হযরত আলী ইবনে আবি তালিব (রাঃ)

হযরত ইমাম হুসাইন শহীদ (রাঃ)

হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন (রঃ)

হযরত ইমাম মুহাম্মদ আলবাফ্ (রঃ)

হযরত ইমাম মুহাম্মদ জা'ফর সাদেক (রাঃ)

হযরত ইমাম মূসা আল কাযেমী (রঃ)

হযরত ইমাম মুহাম্মদ তকী (রঃ)

হযরত ইমাম মুহাম্মদ নকী (রঃ)

সায়্যিুস্ সা'দাত আব্দুল্লাহ- আলী আকবর (রঃ)

সাইয়িদুস্ সা'দাত হুসাইন (রঃ)

সায়্যিদুস্ সা'দাত মুহাম্মদ (রঃ)

সাইয়দিুস সা'দাত ইবরাহীমী (রঃ)

মুহাম্মদ শাময়ান চিশতি (রঃ)

খাজা নাসিরুদ্দীন আবু ইউসুফ চিশতী  (রঃ)

খাজায়ে খাজগান কুতুবুদ্দীন (মঈন উদ্দীন) মওদূদ চিশতী (রঃ)

খাজা আবু আহমদ মওদূদী চিশতী (রঃ)

খাজা রুকনুদ্দীন মওদূদী চিশতী (রঃ)

খাজা নিযামুদ্দীন মওদূদী চিশতী (রঃ)

খাজা কুতুবুদ্দীন মুহাম্মদ মওদূদী চিশতী (রঃ)

খাজা আলী আবু আহমদ সানী মওদূদী চিশতী (রঃ)

খাজা আহমদ আবু ইউসুফ সানী মওদূদী চিশতী (রঃ)

খাজা মুহাম্মদ যাহেদ মওদূদী চিশতী (রঃ)

খাজা কুতুবুদ্দীন মওদূদ সানী চিশতী (রঃ)

খাজা নিযামুদ্দীন আলী মওদূদী চিশতী (রঃ)

খাজা মুহাম্মদ মুহীউদ্দীন শাহ খাগী মওদূদী চিশতী (রঃ)

শাহ আবুল আ'লা মওদূদী চিশতী (রঃ)

শাহ আবদুল আলী মওদূদী (রঃ)

খাজা আবদুল গনি মওদূদী (রঃ)

খাজা আবদুস সামাদ মওদূদী (রঃ)

খাজা আবদুস শাকুর (ওরফে খোশহাল মুহাম্মদ) মওদূদী (রঃ)

খাজা আবদুল্লাহ (ওরফে গুল মুহাম্মদ) মওদূদী (রঃ)

খাজা আব্দুল বারী (ওরফে মীর ভিখারী) মওদূদী (রঃ)

খাজা আবদুল ওয়ালী (ওরফে মীর ফযল ইলাহী) মওদূদী (রঃ)

শাহ আবদুল আযীয (ওরফে মীর করম ইলাহী) মওদূদী (রঃ)

শাহ ওয়ারেস আলী মওদূদী (রঃ)

সায়িদ হাসান মওদূদী (রঃ)

সায়িদ আহমদ হাসান মওদূদী (রঃ)

সায়্যিদ আবুল আ'লা মওদূদী (রঃ)

হিজরত আন্দোলন ও মাওলানা মওদূদী[সম্পাদনা]

খেলাফত আন্দোলন ব্রিটিশের অনমনীয় মনোভাব লক্ষ্য করে ভারতের আলেম সমাজ ঘোষণা করেন যে, ভারত 'দারুল হরব' এবং এখান থেকে হিজরত করা মুসলমানের দ্বীনী দায়িত্ব। ১৯২০ সালে মাওলানা আবুল কালাম আযাদ রাঁচী জেল থেকে মুক্তি লাভ করার পর হিজরত আন্দোলন শুরু করেন।

সে সময়ে আফগানিস্তানের বাদশাহ আমীর আমানুল্লাহ খান এক জনসভায় বলেন যে, ভারতীয় মুসলমান হিজরত করে আফগানিস্তান চলে যেতে পারে। মাওলানা আযাদের কথায় মুসলমানগণ চক্ষু বন্ধ করে হিজরতের জন্যে ব্যাকুল হয়ে পড়েন। হিজরত কমিটি গঠিত হয় এবং দিল্লীতে দস্তুর  মতো তার দফতর কায়েম করা হয়। হাজার হাজার ধর্মভীরু মুসলমানপরিবার নামমাত্র মূল্যে তাদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ বিক্রি করে হিজরত কমিটির দফতরে পৌঁছতে থাকেন। শুধু আগস্ট মাসেই আঠারো হাজার লোক হিজরত করে আফগান সীমান্ত অতিক্রম করে। প্রায় পাঁচ লক্ষ মুসলমান হিজরতের নামে তাদের বহু মূল্যবান সম্পদ হাতছাড়া করে। মওদূদী ভ্রাতৃদ্বয় (আবুল আ'লা মওদূদী ও তাঁর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা আবুল খায়ের মওদূদী) হিজরতের উদ্দেশ্যে দিল্লী হিজরত কমিটির দফতরে হাজির হন। মাওলানার জনৈক পরিচিত বন্ধু মিঃ তোজাম্মেল হোসেন ছিলেন সেক্রেটারী। তার সাথে মাওলানার দীর্ঘ আলোচনা হয়। আলোচনায় মাওলানা জানতে পারেন যে, হিজরতের পশ্চাতে কোন সুচিন্তিত ও সুষ্ঠু পরিকল্পনা বা স্কীম নেই। শত সহস্র লোক আফগানিস্তানে চলে যাচ্ছেন, অথচ আফগান সরকারের সাথে এ ব্যাপারে কোনই আলাপ-আলোচনা করা হয়নি।

হিজরতের বিষয়ে জমিয়ত নেতাদের সাথে মাওলানা (বালক) মওদুদীর মতবিণিময়ঃ[সম্পাদনা]

কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ব্যতিরেকে শুধুমাত্র ধর্মীয় ভাবপ্রবণতার বশবর্তী হয়ে তদানীন্তন আলেম সমাজ হিজরতের ফতোয়া দিয়ে কয়েক লক্ষ মুসলমানকে নিঃস্ব বাস্তুহারায় পরিণত করেন। মাওলানা মওদূদীর দূরদর্শিতা ও সময়োচিত হস্তক্ষেপের ফলে আরও কয়েক লক্ষ মুসলমান বিপদ থেকে বেঁচে যান।

বালক মওদূদীর এ অসাধারণ প্রতিভা, তীক্ষè বুদ্ধি ও দূরদর্শিতা মাওলানা মুহাম্মদ আলী ও জমিয়ত নেতৃবৃন্দকে স্তম্ভিত  ও আকৃষ্ট করে। যার ফলে তাঁরা তাঁদের নিজ নিজ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণে বালক মওদূদীকে বারবার অনুরোধ জানান।

হিজরতের ব্যাপারে মাওলানা মুফতী কেফায়েতুল্লাহ (রঃ) মাওলানা আহমদ সাঈদ (রঃ)  প্রমুখ জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের নেতৃবৃন্দ পরম আগ্রহী ছিলেন। মাওলানা মওদূদী (বালক মওদূদী) তাঁদের সাথে সাক্ষাত করে বলেন যে, কোন সুষ্ঠু পরিকল্পনা ব্যতিরেকে হিজরত অবাস্তব ও ক্ষতিকর হবে। তাঁরা ত্রুটি স্বীকার করেন এবং বালক মওদুদীকে এ বিষয়ে পরিকল্পনা পেশ করতে অনুরোধ জানান। মাওলানা মওদূদী প্রস্তাব করেন যে, সর্বপ্রথম আফগান সরকারের সাথে আলোচনা করে এ কথা জেনে নেয়া যাক যে, ভারত থেকে হিজরতকারীগণের পুনর্বাসনের ইচ্ছা তাঁদের আছে কিনা এবং থাকলে তার পদ্ধতি ও কর্মসূচী কি হবে। অতঃপর দিল্লীস্থ আফগান রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাত করে জানা গেল যে, তাঁরা ইতোমধ্যেই এ নিয়ে বিব্রত হয়ে পড়েছেন। যারা ভারত থেকে চলে গেছেন তাঁদেরকে বিদায় করে দিতে সরকার যদিও দ্বিধাবোধ করছেন, কিন্তু তাদের ব্যয়ভার বহন করা সরকারের সাধ্যের অতীত হয়ে পড়েছে। এর পর এখানেই হিজরত আন্দোলনের ইতি ঘটে।

সায়্যিদ আবুল আলা মওদুদীর রচনাবলীঃ[সম্পাদনা]

# কোরআন

১. তরজমায়ে কুরআন মজীদ।

২. তাফহীমুল কুরআন (তাফসীর)।

৩. তাফহীমুল কুরআন বিষয়ে নির্দেশিকা মাওযুয়াতে কোরআনী।

৪. কুরআনের মর্মকথা মুকাদ্দামায়ে তাফহীমুল কুরআন।

৫. কুরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা- কুরআন কী চার বুনীয়াদী ইসতেলার্হী।

# হাদীস/সুন্নাহঃ[সম্পাদনা]

৬. সুন্নাতে রাসূলের আইনগত মর্যাদা  সুন্নাত কী কানুনী হাইসিয়ত।

৭. কুরআনের মহত্ব ও মর্যাদা- ফাযায়েলে কুরআন (হাদীস কী রোশনী মে)।

ইসলামী জীবন দর্শন ঃ

৮. ইসলাম পরিচিতি রিসালায়ে দ্বীনীয়াত।

৯. ঈমানের হাকিকত-হাকীকতে ঈমান।

১০.ইসলামের হাকিকত-হাকীকতে ইসলাম।


১১. নামায রোযার হাকিকত- হাকীকতে সাওম আওর সালাত।

১২. জিহাদের হাকিকত-  হাকীকতে জিহাদ।

১৩. হজ্জের হাকিকত -হাকীকতে হজ্জ।

১৪. যাকাতের হাকিকত-হাকীকতে যাকাত।

১৫. তাকদীরের হাকিকত- মাসআলা ই  জবর ও কদর।

১৬.তাকওয়র হাকিকত-  হাকীকতে তাকওয়া।

১৭. শিরকের হাকিকত -হাকীকতে শিরক।

১৮. তাওহীদের হাকিকত – হাকীকতে তাওহীদ।

১৯. শান্তিরপথ - সালামতী কা রাস্তা।

২০. একমাত্র ধর্ম- দ্বীনে হক;

২১. তাওহীদ রিসালাত ও আখিরাত তাওহীদ রিসালাত আওর যীন্দেগী বা’দ মওতকা আকলী সুবুত।

২২. ইসলামের জীবন পদ্ধতি- ইসলাম কা নেযামে হায়াত।

২৩. ইসলাম ও জাহেলিয়াত-ইসলাম আওর জাহেলিয়াত।

২৪. ইসলামের শক্তির উৎস-  ইসলাম কা ছের চশমায়ে কুওয়াত।

২৫. কুরবানীর তাৎপর্য- ইসবাতে কুরবানী বি-আয়াতে কুরআনী।

২৬. ইসলামের নৈতিক দৃষ্টিকোণ -ইসলাম কা আখলাকী নোকতায়ে নযর।

২৭. ইসলামী দাওয়াতের দার্শনিক ভিত্তি - ইসলাম আওর মাগরিবী লা দ্বীনী জমহুরিয়ত।

২৮. ইসলাম ও সামাজিক সুবিচার- ইসলাম আওর আদলে ইজতেমায়ী।

২৯. ইসলামী জীবন ব্যবস্থার মৌলিক রূপরেখা- ইসলামী নেযামে যিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসবিরাত।

৩০. ইসলাম ও পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্ধ- তানকীহাত।

৩১. ইসলামী সংস্কৃতির মর্মকথা  ইসলামী তাহযীব আওর উসকে উসুল ও মুবাদী।

৩২. ইসলাম ও জাতীয়তাবাদ- মাসআালায়ে কাওমিয়ত।

৩৩. ইসলাম ও সমাজতন্ত্র।

৩৪. শিক্ষা ব্যবস্থা : ইসলামী দৃষ্টিকোণ- তা’লীমাত।

৩৫. আল জিহাদ - আল জিহাদু ফিল ইসলাম।

৩৬. নির্বাচিত রচনাবলী (১-৩ খন্ড) তাফহীমাত (১-৩ খন্ড)। আইন, রাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা

৩৭. ইসলামের রাজনৈতিক মতবাদ -ইসলাম কা নযরিয়ায়ে সিয়াসী।

৩৮. ইসলামী রাষ্ট্র- ইসলামী রিয়াসত।

৩৯. ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়ণ- ইসলামী দস্তুর কি তাদবীন।

৪০. ইসলামী শাসনতন্ত্রের মূলনীতি- ইসলামী দস্তুর কি বুনিয়াদী।

৪১. ইসলামী আইন – ইসলামী কানুন।

৪২. ইসলামে মৌলিক মানবাধিকার- ইনসানকে বুনিয়াদী হুকুম।

৪৩. ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের অধিকার – ইসলামী রিয়াসত মে জিম্মীয়ু কী হুকুক।

৪৪. খেলাফত ও রাজতন্ত্র- খিলাফত ও মুলূকিয়ত।

৪৫. উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুসলমান (১-২খন্ড)  তাহরীকে আযাদী হিন্দ আওর মুসলমান (১-২জিলদ)।

৪৬. কুরআনের রাজনৈতিক শিক্ষা- কুরআন কী সিয়াসী তা’লীমাত।

৪৭. মুরতাদের শাস্তি- মুরতাদ কী সাযা।

৪৮. জাতীয় ঐক্য ও গণতন্ত্রের ভিত্তি- কওমী ওয়াহদাত।

৪৯. দাক্ষিণাত্যের রাজনৈতিক ইতিহাস-দাককিন কী সিয়াসী তারীখ।

ইসলামী আন্দোলন ও সংগঠনঃ[সম্পাদনা]

৫০. ইসলামী দাওয়াত ও কর্মনীতি- দাওয়াতে ইসলামী আওর উসকা তারীকা।

৫১. ইসলামী আন্দোলনের নৈতিক ভিত্তি -তাহরীকে ইসলামী কী আখলাকী বুনিয়াদ।

৫২. দায়ী ইলাল্লাহ - দাওয়াত ইলাল্লাহ।

৫৩. ভাঙা ও গড়া- বানাও আওর গড়াও।

৫৪. একটি সত্যনিষ্ঠ দলের প্রয়োজন - এক সালেহ জামায়াত কা জরুরত।

৫৫. সত্যের সাক্ষ্য - শাহাদাতে হক্ব।

৫৬. জামায়াতে ইসলামীর দাওয়াত- জামায়াতে ইসলামী কা দাওয়াত।

৫৭. জামায়াতে ইসলামীর উদ্দেশ্য,ইতিহাস,কর্মসূচী - জামায়াতে ইসলামী কা মাকসাদে তারীখ আওর লেহজায়ে আমল।

৫৮. ইসলামী বিপ্লবের পথ- ইসলামী হুকুমাত কি সতারাহ কায়েম হূতী হ্যায়।

৫৯. মুসলমানদের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের কর্মসূচী – মুসলমানুঁকা মাযী হাল মুস্তাকবেল কে লিজহায়ে আমল।

৬০. ইসলামী আন্দোলন সাফল্যের শর্তাবলী- তাহরীকে ইসলামী কামিয়াবী কা শারায়েত।

৬১. আন্দোলন সংগঠন কর্র্মী- তাহরীক আওর কারে কুন।

৬২. ইসলামী আন্দোলনের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী -তাহরীকে ইসলামী কা আয়েন্দাহ লেহজায়ে আমল।

৬৩. শাহাদাতে হুসাইন রাঃ - শাহাদাতে ইমাম হসাইন রাঃ।

৬৪. আল্লাহর পথে জিহাদ-  জিহাদুন ফি সাবীলিল্লাহ।

৬৫. বিশ্ব মুসলিম ঐক্যজোট আন্দোলন -  ইত্তেহাদে আলমে ইসলামী।

৬৬. আজকের দুনিয়ায় ইসলাম - ইসলাম আসরে হাযের মে।

৬৭. ইসলামী রেনেসা আন্দোলন- তাজদীদ ওয়া ইহইয়ায়ে দ্বীন।

৬৮. জামায়াতে ইসলামীর ঊনত্রিশ বছর  জামায়াতে ইসলামী কা ঊনত্রিশ সাল।

অর্থনীতি ও ব্যাংক ব্যবস্থা ঃ[সম্পাদনা]

৬৯. ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতি- ইসলামী মায়াশিরাত কে উসুল।

৭০. কুরআনের অর্থনৈতিক নির্দেশিকা- কুরআন কী মায়াশী তা’লীমাত।

৭১. ইসলাম ও আধুনিক অর্থনৈতিক মতবাদ-  ইসলাম আওর জাদীদে মায়া’শী নযরিয়াত।

৭২. অর্থনৈতিক সমস্যার ইসলামী সমাধান -ইনসান কা মায়শী মাসআালা আওর উসকা ইসলামী হল।

৭৩. ভূমির মালিকানা বিধান –মাসআালায়ে মিলকিয়াতে যমীন।

৭৪. জাতীয় মালিকানা-কওমী মিলকিয়াত।

৭৫. ইসলামী অর্থনীতি- মায়াশিয়াতে ইসলাম।

৭৬. সুদ ও আধুনিক ব্যাংকিং সুদ।

দাম্পত্য জীবন ও নারীঃ[সম্পাদনা]

৭৭. পর্দা ও ইসলাম।

৭৮. মুসলিম নারীর নিকট ইসলামের দাবী - মুসলিম খাওয়াতীন সে ইসলাম কে মুতালিবাত।

৭৯. স্বামী স্ত্রীর অধিকার - হুকুকুয যাওজাইন।

৮০. ইসলামের দৃষ্টিতে জন্ম নিয়ন্ত্রণ- ইসলাম আওর যবতে বেলাদাত।

তাযকিয়ায়ে নফসঃ (বা ইলমে তাসাউফ)

৮১. হিদায়াত ।

৮২. ইসলামী ইবাদতের মর্মকথা - ইসলামী ইবাদত পর তাহকীকী নযর।

৮৩. আত্মশুদ্ধির ইসলামী পদ্ধতি- তাযকিয়ায়ে নফস।

৮৪. ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা- খুতবাত।

সীরাতঃ[সম্পাদনা]

৮৫. আদর্শ মানব - সরওয়ারে আলম কা আসলী কারনামা।

৮৬. খতমে নবুয়্যাত- খতমে নবুওয়াত।

৮৭. সীরাতে সরওয়ারে আলম (১-২খন্ড) সীরাতে সরওয়ারে আলম (১-২জিলদ)।

৮৮. নবীর কুরআনী পরিচয়।

৮৯. সাহাবায়ে কিরামের মর্যাদা- মাকামে সাহাবা।

অন্যান্যঃ

৯০. কাদিয়ানী সমস্যা -কাদিয়ানী মাসয়ালা।

৯১. রাসায়েল ও মাসায়েল (১-৫খন্ড)  রাসায়েল ও মাসায়েল (১-৫খন্ড)।

৯২. যুব সমাজের মুখোমুখি মাওলানা মওদূদী- তাসরীহাত।

৯৩. যুব জিজ্ঞাসার জবাব (১-২খন্ড) ইসতিফসারাত (১-২জিলদ)।

৯৪. বিকালের আসর (১-২খন্ড) আসরী মাজালিশ (১-২জিলদ)।

৯৫. খুতবাতুল হারাম- খুতবাতুল হারাম।

৯৬. বেতার বক্তৃতা- নশরী তাকরীরী।

৯৭. সায়্যিদ আবুল আ’লা মওদূদীর পত্রাবলী (১-২খন্ড) মাকাতীব মাওলানা মওদূদী (রঃ) (১-২জিলদ)।

৯৮. পত্রালাপ মাওলানা মওদূদী ও মরিয়ম জমিলা - মাওলানা মওদূদী আওর মরিয়ম জমিলা কে দরমিয়ান খত।

যাদের ধারা প্রভাবিত ঃ[সম্পাদনা]

মাওলানা আবুল আলা মওদুদী (রঃ) যাদের চিন্তাধারায় প্রভাবিত হয়েছিলেন তারা হলেন # শাহ ওয়ালিউল্লাহ (রঃ) ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রঃ) হাফিজ ইবনুল কায়্যিম (রঃ) হাসান আল বান্না, (রঃ) আল্লামা ইকবাল (রঃ) ও মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জাওহার (রঃ) এর রাজনৈতীক চিন্তাধারা ও দর্শন এবং শিক্ষা বিকাশের ধারার প্রতি আকৃষ্ট বা প্রভাভিত হয়েছিলেন।

ভাবশিষ্যঃ

সায়্যিদ কুতুব শহীদ (রঃ) জালালুদ্দিন উমরি (রঃ) ইউসুফ ইসলাহী (রঃ) ইসরার আহমেদ, হাফিজ সাঈদ, সায়্যিদ আলী শাহ গীলানী, মালিক গুলাম আলী ,তুফাইল মুহাম্মাদ ,ইউসূফ আল-কারযাভী (রঃ) অধ্যাপক গোলাম আজম (রঃ) কাজী হুসাইন আহমাদ (রঃ)।

মওদুদীর (রঃ) সাথে ইরানের বিপ্লবী নেতার সাক্ষাৎ[সম্পাদনা]

মাওলানা মওদুদীর প্রভাব সম্পর্কে ইতিহাসবেত্তা ফিলিপ জেনকিন্সের মতে, মিসরের হাসান আল বান্না এবং সায়্যিদ শহীদ কুতুব (রঃ) তার বই পড়ে অনুপ্রাণিত হন। সায়্যিদ শহীদ কুতব তার কাছ থেকে আদর্শ গ্রহণ করেন এবং এটি আরো সম্প্রসারিত করেন। তিনি একটি অগ্রগামী ইসলামী বিপ্লবী দল গঠনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেন। ফিলিস্তিন ইসলামপন্থী জুরিস্ট আবদুল্লাহ আযযামও তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হন।

দক্ষিণ-এশীয় জনগন মাওলানা মওদুদীর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। এমনকি শিয়া অধ্যুিিষত ইরানেও মওদুদীর বড় ধরণের প্রভাব আছে। ইরানের ইসলামী বিপ্লবের নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ্ খোমেনী ১৯৬৩ সালে মাওলানা মওদুদীর সাথে সাক্ষাত করেন, পরবর্তীতে ইমাম খোমেনী মওদুদীর বইগুলো ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন। এখনো পর্যন্ত প্রায়শই ইরানের ইসলামী সরকার মাওলানা মওদুদীর কর্মপন্থা অনুসরন করে থাকে। বলা হয় ইমাম ইবনে তাইমিয়ার পর তিনি মাওলানা মওদুদীই  দ্বিতীয় চিন্তাবিদ যিনি আধুনিক বিশ্বে ইসলামী রাজনৈতিক চিন্তাধারা-কে প্রভাবিত করেছেন।

খেলাফত আন্দোলন ও মাওলানা মওদুদীঃ তাজ পত্রিকা বন্ধ[সম্পাদনা]

মাওলানা মওদূদীর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায়ই নয়,মুসলমানদের জাতীয় ইতিহাসের দিগদর্শী। সংক্ষেপে হলেও এ সম্পর্কে কিছু আলোচনার প্রয়োজন, যাতে করে তার পটভূমিকায় মাওলানার জীবন চরিত সম্যক উপলব্ধি করা যেতে পারে। খেলাফত আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলেও তা ভারতের ইতিহাসে বিরাট প্রভাব রেখে যায় এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্যে একটা অদম্য প্রেরণার সঞ্চার করে। মাওলানা মওদূদীর উপর এর প্রভাব এই যে,এ আন্দোলন তাঁর মধ্যে জনসভায় বক্তৃতা করার প্রেরণা, সাহস ও শক্তি দান করে এবং লেখনীর মাধ্যমে মুসলিম মিল্লাতের আশা-আকাঙ্খা ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা প্রকাশেরও সুযোগ দান করে। খেলাফত আন্দোলনের সময় মাওলানা জব্বলপুর থেকে 'তাজ' পত্রিকার সম্পাদনার কাজ করছিলেন। তাঁর বয়স তখন মাত্র সতেরো বছর। তিনি তাঁর আত্মকথায় বলেনঃ "সে সময় এখানে মুসলমানদের পক্ষ থেকে জনসভায় কিছু বলার কোন লোক ছিল না। বাধ্য হয়ে আমাকেই এ কাজ করতে হয়। এতে আমার দু'টি বড়ো উপকার হয়েছিল। প্রথমটি এই যে, আমার মধ্যে বিরাট আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল যা পূর্বে ছিল না। পূর্বে কোন দায়িত্বপূর্ণ কাজ করতে সাহস করতাম না। কিন্তু জব্বলপুরে যখন অপরের সাহায্য ব্যতিরেকে সম্পূর্ণ একাকী এবং সম্পূর্ণ নিজের দায়িত্বে সাংবাদিকতা ও জনসেবার কাজ শুরু করলাম, তখন অনুভব করলাম যে,আমার মধ্যে এমন কিছু শক্তি লুক্কায়িত আছে, যা প্রয়োজনের সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে আত্মপ্রকাশ করে। তারপর থেকে কোন দায়িত্ব গ্রহণের কখনো দ্বিধাবোধ করিনি। দ্বিতীয় উপকার এই যে, আমি আমার জীবনে একেবারে আত্মনির্ভরশীল হয়ে পড়লাম। ইতঃপূর্বে আমি কোন না কোন আত্মীয় বন্ধুর সাথে একত্রে বাস করতাম এবং অপরের উপর নির্ভর করার দুর্বলতা কিয়ৎ পরিমান হলেও আমার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। কিন্তু জব্বলপুরে আত্মনির্ভরশীল হয়ে কাজ করতে পেরেছি।"

জব্বলপুরে সে সময়ের 'তাজ' পত্রিকায় লিখিত মাওলানার সম্পাদকীয় প্রবন্ধ পড়লে এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, অত অল্প বয়সে তিনি এতখানি তত্বজ্ঞানী হয়ে পড়েছিলেন যে,জনগণের মধ্যে উদ্দীপনা ও অদম্য প্রেরণা সৃস্টি করার ভাষাজ্ঞানও তাঁর ছিল। তাঁর প্রতিটি কথা ছিল অতীব যুক্তিপূর্ণ,সুধী সমাজের গ্রহণযোগ্য এবং অতীব দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। তাঁর পূর্বাপর কথার মধ্যে ছিল পরিপূর্ণ ভারসাম্য ও সামঞ্জস্য। সে সময়ে ব্রিটিশ কর্তৃক তুরস্কের প্রতি যে চরম অবিচার করা হয়েছিল, তিনি সেজন্যে ব্রিটিশের তীব্র সমালোচনা করে দীর্ঘ সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লেখেন। যার ফলে 'তাজের' প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়।


সার কথা ঃ

মাওলানা মওদুদী (রঃ) কুরআনের ব্যাখ্যা, হাদিস, আইন, দর্শন এবং ইতিহাসের মতো বিভিন্ন শাখায় প্রচুর কাজ করেছেন। তিনি মুসলিম মিল্লাতের কাছে ইসলামের আসল রূপ তুলে ধরার চেষ্টা করেন। তার লেখাগুলো মূলত উর্দুতে । পরে তার লেখাগুলো অন্যান্য অনেক ভাষায় অনুবাদ করা হয়। দ্বীনী জ্ঞান নেয়ার ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন,এ ব্যাপারে মাওলানা মওদুদী বলেন, "আমি অতীত ও বর্তমানের কারো কাছ থেকে দ্বীনকে বুঝবার চেষ্টা না করে সর্বদা কোরআন ও সুন্নাহ থেকে বুঝবার চেষ্টা করেছি। অতএব আল্লাহর দ্বীন আমার ও প্রত্যেক মুমিনের কাছ থেকে কি দাবী করে, এ কথা জানার জন্যে আমি দেখার চেষ্টা করি না যে, অমুক বুযুর্গ কি বলেন ও কি করেন। বরঞ্চ শুধু দেখার চেষ্টা করি যে, কোরআন কি বলে এবং তার রাসূল (সাঃ) কি করেছেন।

তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মুসলিমদের রাজনীতির জন্য ইসলাম অপরিহার্য। শরিয়া এবং ইসলামী সংস্কৃতি সংরক্ষণ করা প্রয়োজন খেলাফতে রাশেদার শাসনের মতো এবং অনৈতিকতা ত্যাগ করা প্রয়োজন। তিনি পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের কুফল হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং সমাজতন্ত্রকে দেখতেন। মাওলানা মওদুদী তার গবেষণায় তা সাহিত্য ভান্ডারে মোসলমানদের পারস্পরিক কোন এখতেলাফী বিষয়ে স্পর্শও করেননি বা বিতর্ক সৃষ্টির মতো কিছু করেননিন

বাংলাদেশের মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার হালচাল ঃ[সম্পাদনা]

বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষাকে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ৩ শ্রেণীতে বিন্যস্ত করা যায়: (ক) প্রাচীন কাঠামোভিত্তিক দরসে নিজামী (খ) পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত পাঠক্রম-ভিত্তিক দরসে নিজামী এবং (গ) আলীয়া নেসাব। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর মাদ্রাসাসমূহকে কওমী বা বেসরকারি মাদ্রাসা বলা হয়।  ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি শিক্ষা বোর্ড এসবের কার্যক্রম সমম্বয় করে। ১৯৯৮ পর্যন্ত সারাদেশে ২,০৪৩টি মাদ্রাসা কওমী মাদ্রাসা এই বোর্ডে নিবন্ধিত হয়েছে। বর্তমানে মাদ্রাসা শিক্ষা বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য সরকারি সংস্থার প্রণীত শর্ত পূরণ করে এমন সকল ধরনের অনুমোদিত মাদ্রাসা সরকারি অনুদান পায়। সরকারি অনুদানপুষ্ট অধিকাংশ মাদ্রাসাতেই এখন বাংলা, ইংরেজি এবং বিজ্ঞান শিক্ষা প্রচলিত আছে। মাদ্রাসা শিক্ষা শেষে অনুমোদিত ডিপ্লোমাপ্রাপ্ত স্নাতকরা উচ্চতর শিক্ষার জন্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে ভর্তি হতে পারে। ২০০২ সালে বাংলাদেশে ইবতেদায়ী মাদ্রাসা ছিল ১৪,৯৮৭টি, দাখিল ৬,৪০২টি, আলিম ১,৩৭৬টি, ফাজিল ১,০৫০টি এবং কামিল ১৭২টি। এছাড়া কওমী মাদ্রাসা ছিল প্রায় ৩,০০০টি।